ইয়াহিয়া জবাব দাও
প্রথম সওয়াল
২৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
আগা মোহাম্মদ এহিয়া খান, আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে চাই।
আমার সওয়াল খুব ছোট। ইচ্ছে করলে এক কথায় জবাব দিতে পারেন। আপনাকে জিজ্ঞেস করি, ১৯৭০ সনে আপনি ইলেকশন কেন দিয়েছিলেন? একদম সোজা জবাব দেবেন। সাফ, সাফ। তালিবালি করবেন না। কারণ, আপনার খাসলৎ আমাদের জানা আছে। খালি আপনার নয়, পাঞ্জাবে যত ইসলামের চ্যাম্পিয়ান আছে, সকলের খাসলৎ আমাদের জানা। সাংবাদিক হিসেবে আপনার সঙ্গে সফর করবার বদনসীব বা খোশ-নসীব আমার হয়েছে। বেলা এগারোটা না বাজতে আপনার ছাতি শুকিয়ে যায়, আপনার বড় পেয়াস লাগে। আপনার তেষ্টা আবার সাধারণ পানিতে যায় না। পেগের পর পেগ হুইস্কি জরুরৎ হয়।তাই বলছি সাফ-সাফ জবাব দেবেন। বাংলাদেশের মানুষের চোখে অনেক ধুলো দিয়েছেন, আর তা চেষ্টা করবেন না।
আসুন, আসুন, আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান, এবার ঢুক করে জবাবটা বলে ফেলুন, আপনি নির্বাচন বা ইলেকশান কেন দিয়েছিলেন?
এখন মনে হচ্ছে আপনি নির্বাচনের মানে জানতেন না। ইলেকশান মানে জনগণের রায়। তখন বাংলার মানুষ কী চেয়েছিল? দেশের সাচ্চা জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা ফিরে আসুক। ইলেকশানের ফল বেরুনোর পরই আপনি বললেন, শেখ মুজিব পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রী। সুতরাং আপনার যে জনগণের রায়কে সম্মান দেওয়ার ইচ্ছা ছিল, তা বোঝা যায়। আর কথাটা আপনি মুখ দিয়ে বলেননি আর কোন জায়গা দিয়ে বাতাসে বের করেছিলেন? তার প্রমাণ তখন ছিল না। আপনি মুখই ব্যবহার করেছিলেন।
তবে ওয়াদার খেলাফ করলেন কেন আগা মোহাম্মদ এহিয়া খান? তার ফলাফল কি আপনি জানেন না? জেগে ঘুমাচ্ছেন? আপনার নাম নারীঘাতী, শিশুঘাতী- অন্ধকারে আগুন-লাগানো চণ্ডাল নামে দুনিয়ায় পরিচিত যারা বেঁচে আছে, তারা নিজের বাপ-দাদার বাস্তভিটা থেকে খারিজ। আর কোথাও মাথা গোঁজার ঠাই খুঁজে হয়রান। তাদের বুকফাটা আহাজারী, দুর্দশা-সব আপনার ওয়াদা খেলাফের ফল।
অথচ নির্বাচন বা ইলেকশানের পর কী আপনি বগল বাজাননি? নিজের ঈমানদারী দুনিয়ার কাছে জানাতে বুক টান টান করে ফুলিয়ে দাঁড়াননি? আপনার বোধ হয় খেয়াল নেই? একটু শলা দিয়ে উস্কে দিচ্ছি। আপনার প্রচার বিভাগের পুস্তিকা মানে ছোট কেতাব -Election in the world’s third largest democracy- “দুনিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাজ্যে নির্বাচন” এর পাতায় পাতায় কী নিজের সাফাই গাননি? বইটা এবার
খুলে দেখুন। বাংলা তর্জমা করে বলছি, কান খুলে শুনুন দেখিঃ সেনাবাহিনী সাধারণত বেসামরিক শাসনভার গ্রহণ করে সমস্ত গণতান্ত্রিক অধিকার ছিনিয়ে নেয়। এই নির্বাচন ঠিক নাটকীয়ভাবে তার বিপরীত। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জনগণের কাছে তার কথা, প্রতিশ্রুতি, ঈমান ঠিক রেখেছেন, স্বাধীন এবং ন্যায্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছেই তিনি ক্ষমতা ফিরিয়ে দেবেন।”
শুনলেন ত? আপনার প্রচার বিভাগের কেতাব এ কথা বলছে। আরো জানিয়েছে, ঐ বইয়ের দ্বিতীয় পাতা C-TGF, “The Election results underlined the political maturity, sound commonsense and practicality of the average voter……Parties preching regionalism, tribalism, racialism and religious Bigorty have been short shrift. অর্থাৎ “এই নির্বাচন থেকে বোঝা যায়, জনসাধারণ রাজনৈতিক দিক থেকে কত পাকা। তাদের সাধারণ জ্ঞান কত খাঁটি। যেসব পার্টি আঞ্চলিক, বর্ণবিদ্বেষ, ধর্মীয় গোঁড়ামির কথা বলেছে, সাধারণ মানুষ তাদের তওবা করার সময় পর্যন্ত দেয়নি।
এরপরও কী আপনি বলতে পারেন শেখ মুজিব দেশকে বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছিল? যা ঘটছে সব হিন্দুদের কারসাজি? সব গণ্ডগোল ভারতের ফন্দী- এসব ধুয়া আপনি তুলতে পারেন? না তোলার কোন সুযোগ আছে, আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান?
আজ সর্বদা আমানুল্লাহ খান যে বাংলাদেশে আপনার জনসংযোগ-অফিসার, তিনিই তা ঐ পুস্তিকা লখেছিলেন তার দপ্তর থেকে প্রকাশিত।
সর্দার আমানুল্লাহ পাঠানের বাচ্চা। তাকেও আপনি ঝুটটা বানিয়ে ছেড়েছেন। এ-ই ঘটে দুনিয়ায়। মিথ্যেবাদীর সঙ্গে যে বসবাস করে, সেও সিথু্যকে পরিণত হয়। সঙ্গ দোষ।
ইয়াহিয়া, জাবব দাও, তুমি কেন ওয়াদা খেলাপ করলে?
(শওকত ওসমান রচিত)