শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
ইয়াহিয়ার পূর্ব পাকিস্তান আক্রমণ পূর্ব-পরিকল্পিত | বাল্টিমোর সান | ৩০ মার্চ, ১৯৭১ |
<১৪, ৫, ১১–১৭>
দ্য বাল্টিমোর সান, মঙ্গলবার, ৩০ মার্চ, ১৯৭১
ইয়াহিয়া পূর্ব পাকিস্তান আক্রমণের পরিকল্পনা করেছিলেন
একটি পরিভাষা তার মুজিবকে ফাঁদে ফেলার প্রয়াসকে লুকাতে পারে না
-জন ই. উডরাফ, সান স্টাফ করেস্পন্ডেন্ট
নয়া দিল্লি, ২৯ মার্চঃ প্রেসিডেন্ট এ, এম ইয়াহিয়া খানের পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের উপর তাদের সতর্ক ও সমন্বিত অতর্কিত আক্রমণের একটি আইনী পারিভাষিক ব্যাখ্যা প্রদান করছে।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এবং প্রধান প্রধান পশ্চিম পাকিস্তানী রাজনীতিকগণ আকস্মিকভাবে দুই সপ্তাহ ধরে চলা রাজনৈতিক সংলাপ বাতিল করা এবং তার পরপরই পূর্ব বাংলার অসহযোগ আন্দোলনের উপর কঠোর সামরিক দমনপ্রক্রিয়ার একই ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জাতির উদ্দেশ্যে তার রেডিওবার্তায় যে কারনটি উল্লেখ করেছেন, তা হল পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি নেতা শেখ মুজিবুর রহমান প্রস্তাবিত ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির সাক্ষাতের পূর্বেই ঘোষণার মাধ্যমে নির্বাচিত বেসামরিক প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানিয়েছিলেন।
একই ব্যাখ্যা
সংলাপে অংশগ্রহণকারী পশ্চিম পাকিস্তানভিত্তিক পাকিস্তান পিপলস পার্টির একজন সদস্য ওমর কসৌরি কড়া নিরাপত্তার মধ্যে শুক্রবার সকালে পিপলস পার্টি প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টোর সাথে ঢাকা কন্টিনেন্টাল হোটেল ত্যাগের সময় সাংবাদিকদের সাথে কথোপকথনে ঠিক একই ব্যাখ্যা প্রদান করেন।
জেনারেল ইয়াহিয়া শুক্রবার রাতে জাতির উদ্দেশ্যে বলেন, “এ ধরনের ঘোষণা যে কাগজে লেখা হত, সেই কাগজের সমান মূল্যও তা বহন করত না। এবং তিনি (শেখ মুজিব) এই অব্যাহতি (impunity) ব্যবহার করে যা ইচ্ছা তাই করতে পারতেন”।
ডিসেম্বরের নির্বাচন ও ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি, যাদের কিনা সামরিক বাহিনী কখনও সাক্ষাতের অনুমতি দেয় নি, তাদের একমাত্র অথোরিটি ‘লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার’ নামক দীর্ঘতর শিরোনামযুক্ত রাষ্ট্রপতির ঘোষণা থেকে উক্ত ঘোষণা কতটুকু ভিন্ন হবে, তা তিনি উল্লেখ করেন নি।
তার পরিবর্তে তিনি বলেছেন, সংরক্ষিত থাকা সত্ত্বেও তিনি সাময়িকভাবে পরিকল্পনাটি মেনে নিয়েছেন, কিন্তু এই শর্তে যে পশ্চিম পাকিস্তানী রাজনীতিকরা এমন একটি পরিকল্পনার প্রতি তাদের ‘দ্ব্যর্থহীন সম্মতি’ প্রদান করবে, যা কিনা শেখ মুজিবের বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে কার্যতঃ দেশের চালকের আসনে বসাবে।
“ইয়াহিয়া এর আগে কিছু বিস্ময়কর রাজনৈতিক সরলতা প্রদর্শন করেছেন”, ঢাকার সকল বিদেশি সাংবাদিকদের দেশের বাইরে পাঠানোর উদ্দেশ্যে বিমানবন্দরে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতকৃত সামরিক বাহিনীর ট্রাকের রেডিওতে শুক্রবারের সম্প্রচার শুনে এমনই মন্তব্য করেছেন পাকিস্তানের অন্যতম অভিজ্ঞ এক বিদেশি সংবাদদাতা।
“কিন্তু পরিস্থিতি এত সরল নয়, পরিস্থিতি অনেক জটিল। এতে এটাই প্রমাণিত হবে যে আলোচনার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল ইচ্ছাকৃত বিলম্ব করা, আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তারা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আরও সৈন্য নিয়ে এসেছিল”।
প্রতারণার পুনঃপরিকল্পনা
আলোচনা যে সময়ক্ষেপনের পন্থা ছিল, এই মন্তব্যই তার প্রথম অর্থবহ ইংগিত ছিল না। একজন ঘনিষ্ট সম্পর্কযুক্ত ভ্রমণকারী ধ্বংসযজ্ঞের এক সপ্তাহ পূর্বে করাচি থেকে ঢাকা পৌছে সাংবাদিকদের বিস্মিত করেছেন এই বলে যে অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য দুই জেনারেল তাকে বলেছেন সামরিক বাহিনীর পরিকল্পনা ছিল বাঙালি নেতৃবৃন্দকে বিশ্বাস করানো যে আলোচনা সফল হতে পারে এবং তারপর পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই কঠোর ব্যবস্থা নেয়া।
কেউই তখন এ বিষয়ে কিছু লেখেন নি, কেননা এই খবরকে সমর্থন করার মত সমানভাবে নির্ভরযোগ্য অন্য কোন সূত্র ছিল না। এবং সত্যিকার অর্থে কেউই এমন ধারণা পোষণ করতে চান নি যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া নির্বাচিত বেসামরিক প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়ার পরিকল্পনার পিছনে দুটি বছর নিজের জনপ্রিয়তা বাজি রাখার পর এমন কোন পদক্ষেপের অনুমোদন দেবেন।
যদিও এখনও সামরিক জান্তার অভিপ্রায় সম্পর্কে কোন ইস্পাতকঠিন নিশ্চয়তা প্রদান করা সম্ভব নয়, তবুও বৃহস্পতিবারের ঘটনাপ্রবাহের প্রত্যক্ষদর্শী কেউই দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পারবে না যে এটি পূর্ব পরিকল্পিত ছিল না।
যতক্ষনে অত্র অঞ্চলে সামরিক এবং বেসামরিক জনগণের মধ্যে সংঘর্ষের প্রতিবাদস্বরূপ শনিবার হরতালের আহ্বানসম্বলিত শেখ মুজিবের বিবৃতি বৃহস্পতিবার রাতে সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে, ততক্ষনে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তার নজিরবিহীন নিরাপত্তার বলয়ে ঘেরা বাড়ি ত্যাগ করেছেন। তার এবং ভুট্টোর উপদেষ্টামন্ডলীর সর্বশেষ মিটিং শেষ হওয়া থেকে একজন বাঙালি সাংবাদিক কর্তৃক প্রেসিডেন্টের গৃহত্যাগ অবলোকনের মাঝে তেমন কোন সময়ের পার্থক্য ছিল না।
ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের এগারো তলা, যাকে কিনা হাফ ডজন সয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে মিঃ ভুট্টো একটি দুর্গে পরিণত করেছেন, সেখানে সন্ধ্যা ৭টার মধ্যে লিফটের মাধ্যমে মিনিটে দুইজন করে সৈন্য ওঠানামা শুরু হয়।
এধরণের কর্মকান্ড প্রায় এক ঘন্টা ধরে চলতে থাকে। এরপর একটি বড় সৈন্যদল কালো রঙের পুরাতন কার্ডবোর্ডের একটি স্যুটকেস নিয়ে নেমে আসে। স্যুটকেসটি পরে প্রায় বিশ জনের এক প্লাটুন সৈন্যের হাতে হস্তান্তর করা হয়, যারা সেটিকে রাষ্ট্রপতির ভবণে নিয়ে যায়। সেখানে তখনও কিছু গার্ড ডিউটিরত ছিল। সেই কালো স্যুটকেসে কি ছিল, তা কখনও জানা যায় নি।
একটি অশুভ সময়
রাষ্ট্রপতির মুখপাত্র, যিনি সর্বদা সাংবাদিকদের অভ্যর্থনা জানানোর জন্য উপস্থিত থাকতেন, তার অবস্থান জানতে চাইলে গার্ড বলেন, “তিনি কোথাও গিয়েছেন এবং কখন ফিরে আসবেন, তা আমার জানা নেই। দয়া করে আপনারা আপাতত চলে যান এবং কাল সকাল দশটায় আসুন”।
এদিকে রাষ্ট্রপতির ভবন থেকে মাত্র দুই ব্লক দূরত্বে অবস্থিত হোটেলের নিরাপত্তাকর্মী পূর্বের অন্য যেকোন রাতের তুলনায় সংখ্যায় দ্বিগুণ মনে হচ্ছিল। রবিবার থেকে মিঃ ভুট্টোর নিরাপত্তায় নিয়োজিত পরিচিত কোন মুখকেই ঐ রাতে ডিউটিতে দেখা গেল না।
পরিচিত নিরাপত্তাকর্মীরা ছিল ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস-এর একটি কন্টিনজেন্ট, একটি বাঙালি অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বাহিনী। যদিও তারা সেনাবাহিনীর অধীনস্ত ছিল, তবুও ধারনা করা হত তারা আওয়ামী লীগের প্রতি অনুগত। নতুন বাহিনীর পোশাকে কোন ইউনিট বা পরিচয় বহনকারি ব্যাজ ছিল না, শুধু পদমর্যাদা, পরিচয় এবং যুদ্ধকালীন অর্জিত রিবন ছিল। তারা পাঞ্জাবীদের মত লম্বা ছিল, বাঙালিদের মত খাঁটো ছিল না।
অপরিচিত মুখ
হোটেলের সামনে এক ক্যাপ্টেন বললেন, “আমাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যেন রাত ১১টার পর কেউ হোটেল ত্যাগ করার চেষ্টা করলে তাকে গুলি করা হয়। দয়া করে ভিতরে যান। আমি আপনাদের কোন ক্ষতি করতে চাই না”।
‘দয়া করে বাইরে যাবেন না’ লেখা একটি নোটিশ লবিতে টানানো ছিল। কিছুক্ষন ক্যাপ্টেনকে বোঝানোর চেষ্টা করার পর কেউ আর বাইরে গেল না।
শুরু হল গোলাগুলি
কয়েক মিনিটের মধ্যে সয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রের বিক্ষিপ্ত গোলাগুলির শব্দ সমস্ত শহর জুড়ে শোনা যেতে লাগল। একটার দিকে ভারী মেশিনগান এবং কামানের শব্দ শোনা গেল, বিক্ষিপ্ত অগ্নিকান্ড দৃশ্যমান হল। গোলাগুলি ও ধ্বংসযজ্ঞের প্রথম রাত শুরু হল।
ঐ রাতের ঘটনাপ্রবাহকে শুধুমাত্র একটি উপায়েই ব্যাখ্যা করা সম্ভব- একটি অহিংস ও অসহযোগ আন্দোলনকে ধ্বংস করার জন্য নিরস্ত্র জনসাধারনের উপর একটি আনন্দচিত্তে সমন্বিত ও পূর্ব পরিকল্পিত আক্রমণ।
আক্রমণ চালানো হয়েছে কোন প্রকার সম্প্রচারিত বা প্রকাশিত সতর্কবাণী ছাড়াই, যদিও অফিসাররা দাবি করেছেন তারা লাউডস্পিকার ব্যবহার করে বেসামরিক জনগণকে রাজপথ ত্যাগ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
কারফিউ ঘোষণা করে প্রথম রেডিওবার্তা প্রচার করা হয়েছিল মধ্যবেলায়, বিক্ষোপ করতে করতে এগিয়ে আসা পনের জন নিরস্ত্র যুবকের উপর কোন সতর্কবাণী ছাড়াই সৈন্যবাহিনী কর্তৃক একটি জীপের সঙ্গে লাগোয়া মেশিনগান থেকে গোলাবর্ষণের ঘটনা বিদেশি সাংবাদিকদের অবলোকনের প্রায় আট ঘন্টা পর।
দশ ঘন্টা পর
কারফিউ ঘোষণার দশ ঘন্টা পর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া আলোচনা ভেঙে যাওয়ার আইনগত ব্যাখ্যা দিয়ে এবং যে ব্যক্তিটির সঙ্গে আলোচনা চলছিল, পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পৃথক করার মত ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতা’র অপবাদ দিয়ে সেই শেখ মুজিবের সমালোচনা করে রেডিওতে ভাষণ দেন।
শেখ মুজিবের দাবিদাওয়া সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার বক্তব্য এমন বিশ্বাসযোগ্যতা প্রদান করে যে এই আওয়ামী লীগ নেতা স্বায়ত্তশাসনের শর্তসমূহকে এমন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, যা কার্যত স্বাধীনতার সমপর্যায়ের হত।
ছাত্র-জাতীয়তাবাদ ও অন্যান্য মৌলিক রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে শেখ মুজিবের উপর যে চাপ ছিল, তাতে তাঁর পক্ষে ইয়াহিয়া যা যা বলেছেন সেগুলো দাবি করা সম্ভব। যদিও প্রেসিডেন্ট খুব সাবধানে এই বিষয়টিকে আলোচনা ভঙ্গের কারন হিসেবে তালিকাবদ্ধ করা থেকে বিরত থেকেছেন।
সবসময় চরমপন্থা নয়
শেষের দিকে তাঁর (বঙ্গবন্ধুর) দাবিদাওয়া যতটা অসংযত ছিল বলে প্রেসিডেন্ট দাবি করেন, সবসময় তা তেমনটি ছিল না।
পাঁচ বছর ধরে আওয়ামী লীগ একটিমাত্র কার্যক্রমকেই প্রধান করে দেখে এসেছে, আর তা হল এমন একটি সংবিধান প্রণয়ন, যা কিনা পূর্ব পাকিস্তানকে তার বৈদেশিক সাহায্য, বৈদেশিক বাণিজ্য এবং করের উপর নিয়ন্ত্রন প্রদান করে। সেই কার্যক্রম এবং সেই সাথে দেশের ক্রমাগত সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের ফলস্বরূপ শেখ মুজিবের ছয় বার জেল খাটার রোমান্টিকতায় পূর্ণ গল্প পূর্ব বাংলায় আওয়ামী লীগকে প্রচন্ড জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছিল।
দাবিটি করা হয়েছিল দুই যুগের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, যেখানে পঞ্চান্ন মিলিয়ন পশ্চিম পাকিস্তানী তাদের নিয়ন্ত্রিত সামরিক বাহিনী ব্যবহার করে পঁচাত্তর মিলিয়ন বাঙালিকে শোষণ করেছে।
অধিকাংশ কর, অধিকাংশ আয়কৃত বৈদেশিক মুদ্রা এবং অধিকাংশ জনগণ ছিল পূর্ব পাকিস্তানের।
অধিকাংশ কর, অধিকাংশ বৈদেশিক মুদ্রা এবং অধিকাংশ বৈদেশিক সাহায্য যেত পশ্চিম পাকিস্তানে।
যে সামরিক বাহিনী এখন বাঙালিদের বশে আনার চেষ্টা করে যাচ্ছে, দেশের মোট বাজেটের শতকরা ষাট ভাগ তারা ভোগ করে, যার প্রধান উৎস বাঙালিদের করের টাকা। বিষয়টি উল্লেখ করতে বাঙালিরা কখনও ভোলে না।
আর একটি বিষয়, যা বাঙালিরা সবসময় উল্লেখ করে, শতকরা দশ ভাগেরও কম সৈনিক এবং তার চেয়েও কম অফিসার বাঙালি।
কিন্তু অর্থনৈতিক বৈষম্যই পাকিস্তানের দুই অংশের ভিতর একমাত্র বৈষম্য নয়। পশ্চিমাংশ মূলত নিয়ন্ত্রন করে লম্বাকৃতির পাঞ্জাবীরা, যারা কিনা ঐ অঞ্চলে আরও অনেক জাতি ও ভাষাভাষীর সাথে বসবাস করে। অপরদিকে পূর্বাংশে জাতি ও ভাষার দিক থেকে বাঙালিরাই মূলত বসবাস করে।
এই দুই জাতিগত গোষ্ঠী শুধু ভাষার দিক থেকেই আলাদা নয়। খাদ্য, পোশাক, এমনকি যে ধর্মের দোহাই দিয়ে ভারতীয় বৃটিশ সাম্রাজ্য থেকে স্বাধীনতা লাভ করেছিল পাকিস্তান, সেই ধর্মচর্চায়ও রয়েছে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য।
দাম্ভিকতাই যার পরিচয়
একজন পাঞ্জাবী সেনাকে চেনা যায় খাট, ময়লা, স্বল্পঋজু বাঙালিদের মধ্য দিয়ে হাটার সময় তার দাম্ভিকতা পূর্ণ হাতের দোল দেখে।
এসকল পার্থক্য সত্ত্বেও, পশ্চিমের জাতিগত বৈষম্যের তুলনায় বাঙালিদের জাতিগত ঐক্য সত্ত্বেও সেনাবাহিনী এমন ধারনা মাথায় নিয়ে নির্বাচিত বেসামরিক শাসনের দিকে তাদের সাবধানী পদক্ষেপ শুরু করেছে যেন জোটবদ্ধ পশ্চিমা নির্বাচকমন্ডলী বহুবিধ দলে বিভক্ত ও জর্জরিত পূর্বের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারবে।
“আমরা বিশ্বাস করেছিলাম অ্যাসেম্বলিতে যতই আঞ্চলিক পার্থক্য থাকুক না কেন, পশ্চিমের পুরাতনপন্থি রাজনীতিকরা সহজেই বহুধাবিভক্ত পূর্বের বিপক্ষে জয়লাভ করবে”, দুই সপ্তাহ আগে এমনটাই বলেছেন একজন গুরুত্বপূর্ণ পশ্চিমা রাজনীতিক।
“কিন্তু বাস্তবে ভুট্টো হঠাৎ করেই একটি সমাজতান্ত্রিক আবেদন নিয়ে এসে আমাদের সবাইকে পরাস্ত করলেন। এবং মুজিব ঐ অভিশপ্ত ঘুর্ণিঝড়ে ভর করে সম্পূর্ণ পূর্ব পাকিস্তান জিতে নিলেন”।
নির্বাচন যখন নিকটবর্তী, ইসলামাবাদ সরকারের কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিই গত শরতে নির্বাচনের ঠিক পূর্বমুহূর্তে হয়ে যাওয়া ঘুর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে বেঁচে যাওয়া মানুষদের ব্যাপারে কোন প্রকার উদ্বেগ প্রকাশ করেন নি, যে জলোচ্ছ্বাসে লাখ লাখ বাঙালি প্রাণ হারিয়েছিল।
যেখানে অন্যান্য দেশ বন্যার মত সাহায্য নিয়ে এসেছে, যেখানে পশ্চিম পাকিস্তান তাদের হেলিকপ্টারগুলো ভারতের সাথে যুদ্ধের ভয়ে রেখে দিয়েছে। সরকার থেকে বলা হয়েছে, যে অঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাৎসরিক চক্রের একটি অনুমিত ঘটনা, রাজনৈতিক সন্ধিক্ষন এমন এক পর্যায়ে ছিল যে সে অঞ্চলে অন্য একটি আরও ভয়াবহ দুর্যোগ ঘটে যেতে পারত।
“মুজিব যদিও শক্তিশালী ছিলেন, কিন্তু এই প্রাকৃতিক দুর্যোগটি তাকে অপ্রতিরোধ্য করেছে”, বলছিলেন এক আমেরিকান বিশ্লেষক, “এটাই ঘটনার মোড় ঘুড়িয়ে দিয়েছে”।
সব স্পষ্ট হয়ে যায়
যখন একদিকে শেখ মুজিব অ্যাসেম্বলিতে নিরঙ্কুশ সসংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেন, অন্য দিকে ভুট্টো পশ্চিমের সিটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেন, তখন ভুলের ব্যাপ্তি স্পষ্ট হয়ে উঠল।
এটা ছিল একটি বোধগম্য ভুলঃ পাকিস্তানে এর আগে সত্যিকার অর্থে কোন অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় নি যার উপর ভিত্তি করে ধারনা করা সম্ভব।
কিন্তু এটি পশ্চিম পাকিস্তানকে একটি অসম্ভব বিপজ্জনক অবস্থায় ফেলে দেয়। কেননা পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতি মূলত নির্ভরশীল ছিল পূর্ব পাকিস্তান থেকে নানা উপায়ে লভ্যাংশ আত্মসাৎ করার ক্ষমতার উপর, এবং আওয়ামী লীগের কার্যক্রম তা চিরতরে বন্ধ করে দেবে।
শেখকে দোষারোপ করা হল
শেখ মুজিব যদি বৈদেশিক সাহায্য এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের উপর স্থানীয় নিয়ন্ত্রনের ব্যাপারে আওয়ামী লীগের অনড় অবস্থান থেকে সরে না আসেন, তাহলে অ্যাসেম্বলি বয়কট করে হরতাল ডাকার হুমকি দিয়েছেন মিঃ ভুট্টো। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতা শপথ নিয়েছেন তাঁর সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে ব্যবহার করে উক্ত কার্যক্রম বলবত করার, যা তাকে নির্বাচিত হতে সাহায্য করেছে।
নিশ্চিত ব্যর্থতার মুখোমুখি হয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ৩ মার্চ পূর্ব-নির্ধারিত অ্যাসেম্বলির অধিবেশন মুলতবি করেন এবং এই মুলতবির ফলশ্রুতিতে সৃষ্ট অস্থিতিশীলতার জন্য ৬ মার্চ রেডিওতে শেখ মুজিবকে দোষারোপ করেন।
পূর্ব বাংলায় এই অভিযোগের পক্ষে কোন প্রমাণ ছিল না। অবশ্য প্রেসিডেন্ট, যিনি কিনা এর মাত্র নয় দিন পরই পূর্ব পাকিস্তানে আসেন, তার পক্ষে হয়ত এটা জানার কোন উপায় ছিল না।
আসলে যা হয়েছিল, তা হল, পুলিশ অধিকাংশ স্থানে দাঙ্গাবাজদের হাতে রাস্তা ছেড়ে দিয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের সেচ্ছাসেবকগণ বহুল প্রচারিত শেখ মুজিবের অহিংস আন্দোলনের সাহায্যে মাত্র দুই দিনে শুধুমাত্র বাঁশের লাঠি হাতে দাঙ্গাবাজদের নিয়ন্ত্রনে নিয়ে এসেছিল।
স্থবিরতা
৯ মার্চের মধ্যে দুই দিন আগে বিশাল এক জনসমাবেশে শেখ মুজিবের দেয়া অসহযোগ আন্দোলনের ডাক সরকার ও সরকারের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে স্থবির করে দিয়েছিল এবং বহু বছর পর প্রথমবারের মত পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানকে শাসন করার ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত হল।
পর্যায়ক্রমে আওয়ামী লীগের উচ্চমহল যেসব অফিস ও প্রতিষ্ঠানকে পর্যাপ্ত পরিমানে নিয়ন্ত্রন করতে পারবে বলে মনে করল, শেখ মুজিব সেগুলো খুলে দেয়া শুরু করলেন।
অনেক প্রতিষ্ঠানের উপর আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রন ছিল সন্তোসজনক। কিন্তু এমন কিছু প্রতিষ্ঠান ছিল, যেগুলো খুলে দেয়ার ব্যাপারে আওয়ামী লীগ কখনোই পুরোপুরি নিশ্চিত ছিল না। স্কুল এবং আদালত ছিল তাদের মধ্যে অন্যতম।
অন্যান্য মূলত বেসামরিক কিছু সেবা, যেমন অভিবাসন ও কাস্টমস, এগুলো কখনোই হুমকির মুখে ছিল না। আর চেকপয়েন্টগুলোতে আর্মির সশস্ত্র নিয়ন্ত্রন সম্পর্কে আওয়ামীলীগ কখনোই প্রশ্ন তোলে নি।
কিন্তু কিছু ঘনিষ্ট সম্পর্কযুক্ত সেবা, যেমন সড়ক ও রেলপথ এবং চট্টগ্রামের জাহাজের কুলিদের উপর আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রন এই কাস্টমস ও অভিবাসন চেকপয়েন্টের উপর সরকারের নিয়ন্ত্রনকে অর্থহীন করে তুলেছিল।
এমনকি এক সপ্তাহ পরে আওয়ামী লীগ বেশকিছু কর আদায়ও শুরু করেছিল, যদিও আয়করকে কখনোই আর চালু করা হয় নি।
পশ্চিম পাকিস্তানে মিঃ ভুট্টোর সাথে লম্বা সময় অতিবাহিত করার পর যতদিনে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া শেখ মুজিবের সাথে আলোচনার জন্য ঢাকায় আসেন, ততদিনে সরকারের নিয়ন্ত্রন এতটাই ভেঙে পরেছে যে, নতুন সামরিক গভর্নর তাকে শপথ পড়ানোর জন্যও কাউকে খুঁজে পান নি।
নতুন গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানকে বাঙালিরা মনে করত শক্ত মনের বাজপাখি। ষাটের দশকে পশ্চিম পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের নাগরিকদের একটি বিদ্রোহ দমনে টিক্কা খানের ভূমিকার জন্য বাঙালিরা তাকে ডাকত ‘বেলুচিস্তানের কসাই’ নামে।
বাঙালিদের গুপ্ত রেডিও এখন প্রতিদিনই উৎসাহের সাথে একটি খবর প্রচার করছে যে একটি দাঙ্গাবাজ দল কোন উপায়ে জেনারেল টিক্কা খানের বাড়িতে গিয়ে তাকে হত্যা করেছে। কিন্তু কোন ব্যাখ্যা ছাড়া কাউকে তার স্থলাভিষিক্ত না করা পর্যন্ত এই রিপোর্টের সত্যতা সম্পর্কে জানার উপায় নেই।
জেনারেল টিক্কার পূর্ববর্তী গভর্নর, যিনি কিনা বাঙালিদের কাছে পরিচিত ছিলেন এমন একজন হিসেবে, যিনি তাদের আন্দোলনের অর্থ উপলব্ধি করতে পারেন, কোন প্রকাশ্য ব্যাখ্যা ছাড়াই তিনি ঢাকা ছেড়ে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে গেছেন। তাকে যেসব বাঙালি চিনত, তারা বলেন, ১ মার্চ অ্যাসেম্বলি স্থগিত করার পরপরই কঠোর সামরিক পদক্ষেপের প্রস্তুতি গ্রহন করার জন্য তাকে আদেশ করা হলে তিনি পদত্যাগ করেন। একটি স্বাভাবিক বদলি প্রক্রিয়ায় যেমনটি করা হয়, তেমনভাবে তার কোন সহকারীকেই বদলি করা হয় নি।
প্রেসিডেন্ট ১৫ মার্চ ঢাকা পৌছালে তার অভ্যর্থনাও সন্তোসজনক ছিল না। উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের স্বাভাবিক প্রতিনিধিদল বিমানবন্দরে তাকে অভ্যর্থনা জানাতে যেতে ব্যর্থ হল।
শেখ মুজিবের চেয়েও দ্রুততর
কিন্তু আন্দোলন এমন এক শক্তির সঞ্চার করেছে, যা শেখ মুজিবের চেয়েও দ্রুতগতিতে ধাবমান। একটি সত্যিকারের বাঙালি জাতীয়তাবাদ, যা পূর্ব পাকিস্তানের অন্য কোন আন্দোলন থেকে তৈরি হয় নি।
বাঙালিরা পশ্চিম পাকিস্তানী ‘বিদেশি’ সৈন্যদের হত্যা করার কথা বলছে। এমনকি ঢাকার রাস্তায় পাকিস্তানের পতাকা এবং ‘পাকিস্তানের জনক’ মোহম্মদ আলী জিন্নাহর ছবি পুড়িয়েছে।
পাকিস্তান দিবসে তারা সর্বত্র একটি নতুন জাতিরাষ্ট্র ‘বাংলাদেশ’ এর নতুন পতাকা উত্তোলন করেছে এবং চীনা দূতাবাস থেকে পাকিস্তানের পতাকা ছিঁড়ে নামিয়ে ফেলেছে।
তারপরও শান্তি সম্ভব
তবুও অধিকাংশ বাঙালি এ ব্যাপারে একমত হয়েছেন যে শেখ মুজিব চাইলে আন্দোলনকে তাঁর দাবিকৃত বৃহদাকার স্বায়ত্তশাসনের পথে ফিরিয়ে আনতে পারতেন এবং পাকিস্তানকে দুটি আলাদা রাষ্ট্রে চুড়ান্ত বিভক্তির হাত থেকে রক্ষা করতে পারতেন, যদি তিনি পশ্চিমাদের তাঁর দাবি মেনে নিতে রাজি করাতে পারতেন।
তিনি পারতেন কিনা, রাজনৈতিক সমস্যাগুলোর কোন মিমাংসা করা যেত কিনা, এসব কিছুই কেতাবি প্রশ্নে পরিণত হয়েছে তখনই, যখন সামরিক বাহিনী ও মিঃ ভুট্টো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে বাস্তব রাজনৈতিক সমস্যাগুলোর চেয়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের পদ্ধতিই অধিক গুরুত্বপূর্ণ।
সামরিক বাহিনীই অবশেষে কতটি পাকিস্তান হবে, সেইই প্রশ্নের শেষ উত্তর দিয়ে দিল।
গত কয়েকদিনের গণহত্যার পর একটি সত্যিকারের একীভূত পাকিস্তানের আর কোন আশাই রইল না।
কারন চলমান যুদ্ধের দুটি মাত্র পরিণতি হতে পারে। একটি হল পঁচাত্তর মিলিয়ন বাঙালির একটি স্বাধীন দেশ, অন্যটি একটি সম্পূর্ণরূপে দলিত ও অন্ধকারাচ্ছন্ন উপনিবেশ, যা শুধুমাত্র মানচিত্রেই পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিতি পাবে।