শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৩১। একটি মুমুর্ষ আদর্শ | ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল | ২১ এপ্রিল , ১৯৭১ |
<১৪, ৩১, ৭০-৭৩>
ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, এপ্রিল ২১, ১৯৭১
একটি উজ্জ্বল সম্ভাবনা
পূর্ব পাকিস্তানিদের আমৃত্যু যুদ্ধের অঙ্গীকার
কিন্তু ওরা কি পারবে ?
তাদের বিপ্লবকে সামনে এগিয়ে নেবার মতো অস্ত্রের এবং নেতৃত্বের অভাব
অন্য কোন দেশ থেকে কোন সাহায্য নেই।
অনেক বেশি প্যাট্রিক হেনরি?
– পিটার আর. কান
(ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের স্টাফ রিপোর্টার)
মেহেরপুর, পূর্ব পাকিস্তান – মানুষ গরুর গাড়িতে , রিকশায় , বাইসাইকেলে, কেউ কেউ ট্রাকে, কিন্তু বেশিরভাগ লোক এবং মুক্তিযোদ্ধা বাংলাদেশ থেকে পায়ে হেঁটে ভারতের সীমান্তের দিকে ছুটছে। মেহেরপুর থেকে আধা মাইল পিছনে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্প থেকে মর্টার এবং ক্ষুদ্র অস্ত্রের গুলি ধেয়ে আসছে।
“পাঞ্জাবিরা (পশ্চিম পাকিস্তানি) মেহেরপুরে কামান এর গোলা এবং বোমা ফেলছে” একদল বাঙালি চিৎকার করে ভারত সংলগ্ন সীমান্তে একটা ট্রাক লক্ষ্য করে বললো, যেটা গ্রাম থেকে শুধু শেষ অস্ত্রধারী লোকদের নিয়ে সীমান্ত পারি দিচ্ছিল। ভারত সীমান্তের চার মাইল এর মতো পথ – খাঁখাঁ প্রায় জনমানবশূন্য গ্রাম। মেহেরপুরের অপেক্ষাকৃত ধনী ব্যক্তিগণ একদিন আগেই শহর ছেড়ে চলে গেছে। আজকে যারা যাচ্ছে, তাদের মধ্যে আছে খালি পায়ে শরণার্থী , ছয় বাচ্চা নিয়ে মলিন পোশাকে মহিলা , মাথায় মালসামান নিয়ে বোচকা বোঝাই করা লোকজন , বিছানা ভেঙে টেনে নিয়ে যাচ্ছে এমন দুইজন লোক, একজন অন্ধ লোক, যে কিনা তার অন্ধের যষ্ঠি গরু নিয়ে হেটে যাচ্ছে।
একটি দুর্বল যুদ্ধ চালনা
ভারতীয় সীমান্তে একটি মিলিটারি ক্যাম্পের আশেপাশে শ’খানেক বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্য মলিন মুখে ব্যাজ নামিয়ে বসে আছেন। ভারতীয় সীমানার ভিতরে আরো এক ডজন সেনাবাহিনীর জীপ আর একটা রিকোয়েলাস রাইফেল দেখা যাচ্ছে, সম্ভবত সেটাই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একমাত্র রিকোয়েলাস রাইফেল। পিছনের দিকে কয়েক মাইল দূরেই ভারতের সীমান্তবর্তী শহরে জটলা করে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ চলমান রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে এবং শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত লড়াই করে যাবার কথা আলোচনা করছে ।
পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ শুরু হবার পর থেকে নি:সন্দেহে প্রচুর বাঙালি মারা গেছে। কিন্তু নানাবিধ কারনে সেভাবে যুদ্ধ এখনো দেখা যায়নি। সেকারনে মনে হচ্ছে আমরা বাংলাদেশে সম্ভবত ইতিহাসের একটি দুর্বলতম এবং সময়ের হিসেবে স্বল্পতম বিপ্লব দেখতে যাচ্ছি। এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে ৫০০০০ এরও কম সেনা নিয়ে এবং সীমিত আগ্নেয়াস্ত্র, যুদ্ধ বিমান ব্যবহার করে সেনাবাহিনী ৭৫ মিলিয়ন বাঙালিকে দমন করতে সক্ষম হয়েছে।
স্বাধীনতার সুদীর্ঘ পথ
বলছি না যে, বাংলাদেশ হবার কারণগুলো এখন আর আবেদন নেই। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান যদি কোনদিন স্বাধীন হয়, সেটা কখনো গত চার সপ্তাহে যেই ধরনের “স্বতঃস্ফূর্ত বিপ্লব” দেখলাম, তার মাধ্যমে অন্তত সম্ভব না। স্বাধীনতা হয়তো আসবে, তবে কয়েক সপ্তাহে না, কয়েক বছরে, আরো কঠিন লড়াই এবং অল্প কাব্যের মাধ্যমে, প্রচলিত যুদ্ধের পরিবর্তে গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে এবং সম্ভবত আদর্শবাদের বুলি না কুপচিয়ে সশস্ত্র বামপন্থী গেরিলাদের মাধ্যমে ।
অনেকখানি আবার নির্ভর করবে ভারতের উপরে, তারা কতটুকু অস্ত্র এবং সীমান্তে সহযোগিতা দিবে দীর্ঘায়িত এই স্বাধীনতা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে। কিন্তু যাই হোক না কেন, পশ্চিম পাকিস্তান কঠিন সমস্যায় পড়বে। সামনে বর্ষার মৌসুম শুরু হবে, এই অবস্থায় তারা দখলকৃত সুদীর্ঘ গ্রাম বাংলায় কিভাবে তাদের সৈন্য মোতায়েন করবে। তাদের পুনরায় দখলকৃত কলোনিতে তারা প্রশাসনই বা কিভাবে চালাবে। পূর্ব পাকিস্তানের ভেঙে পড়া অর্থনীতিকে বা কিভাবে জোড়া লাগানো হবে আর কিভাবেই বা পূর্ব পাকিস্তানকে সীমিত পশ্চিম পাকিস্তানি সম্পদ এর আবর্জনার স্তূপ হবে থেকে বাঁচানো যাবে। বাঙালি প্রতিরোধ এর প্রতি ভারতের সমর্থনকেই বা কিভাবে মোকাবেলা করা হবে যাতে এই প্রতিরোধ লড়াইয়ে তাদের সমর্থন আরো না বাড়ে।
পাকিস্তানের সমস্যা আরো অনেকগুন বেড়ে যাবে যদি পশ্চিম পাকিস্তানের জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এর মধ্যেও অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে , অথবা এই দুর্দিনে পশ্চিম পাকিস্তান এর অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বী জেনারেল বা রাজনীতিবিদরা ঐক্যবদ্ধ না থাকে।
একটি সোজা–সাপ্টা সংগ্রাম
সংগ্রামের তীব্রতা এবং সংগ্রামের নৈতিক কারনের প্রশ্নে কিছু সংশয় থাকলেও মূল সমস্যার জায়গাগুলো মোটামোটি সোজাসাপ্টা। ১৯৪৭ সালে যখন ইংল্যান্ড তাদের ভারতীয় সাম্রাজ্যকে স্বাধীনতা প্রদান করে, জাতিগতভাবে অথবা ভৌগলিক ভাবে ভাগ না হয়ে ভারতীয় উপমহাদেশ ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হয়। মুসলিম পাকিস্তানের দুই ভাগ হিন্দু ভারতের দুই পাশে ১২০০ মাইল দূরে অবস্থিত ছিল। পাকিস্তানে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক দিক থেকে পাঞ্জাবিদের একছত্র আধিপত্য ছিল, এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিরা শোষণের স্বীকার বলে ভাবতে শুরু করল ।
গত ডিসেম্বরে যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাতে পূর্ব পাকিস্তানিরা শেখ মুজিবর রহমানের জাতীয়তাবাদী আওয়ামীলীগকে অভূতপূর্ব ভাবে ভোট দিয়ে বিজয়ী করে। আ :লীগ এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে, যার অর্থ দাঁড়ায় গণতন্ত্রের নিয়ম অনুসারে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করার কথা। পশ্চিমাঘেঁষা এবং মধ্যপন্থী সমাজতন্ত্রী বলে পরিচিত শেখ মুজিবর রহমান পররাষ্ট্র আর প্রতিরক্ষা বাদে অন্য সব বিষয়ে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্বশাসন এর দাবি করেছেন। অর্থনৈতিক এবং অন্যান্য নানা কারনে পশ্চিম পাকিস্তানী রাজনীতিবিদ এবং জেনারেলরা এই প্রস্তাবের কঠোর বিরোধিতা করছেন।
আলোচনার নাম করে সময় ক্ষেপন করে পূর্ব পাকিস্তানে বিপুল পরিমানে পশ্চিম পাকিস্তানী সেনা এবং ভারী অস্ত্র নিয়ে আসা হয়েছে। ২৫মার্চ রাতে এই সেনারা ক্ষিপ্রতা এবং নৃশংসতার সাথে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় আঘাত হেনেছে এবং জঘন্য বর্বর ভাবে বাঙালি আন্দোলনকারীদেরকে দমন করেছে । পাকিস্তান মিলিটারি ঢাকা এবং বন্দর নগরী চিটাগাং এর দখল নেয়, এবং যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটে।
অন্যান্য শহর গুলোতে বাঙালিরা প্রতিরোধ গড়ে তুলে এবং সেগুলো স্বাধীন আছে বলে প্রচার করছে। এই বিপ্লবটা খনিকটা গল্পের বই এর মতো, যেখানে হাজার হাজার প্যাট্রিক হেনরি জ্বালাময়ী বক্তিতা দিচ্ছে অস্ত্র ধারণ করে দেশ স্বাধীন করে ফেলতে এবং হাজার হাজার বেটসি রোজেরা লাল , সবুজ এবং হালকা সোনালী রঙের বাংলাদেশের পতাকা বানাচ্ছে। বেসামরিক প্রশাসন , ইপিআর (বাঙালি রেজিমেন্ট , যা আসলে পাকিস্তান আর্মির একটা অংশ ছিল ) এবং সর্বস্তরের সাধারণ বাঙালিরা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা কুঁড়েঘর থেকে অফিস আদালত, গরুর গাড়ি থেকে আধুনিক জীপ্ সর্বত্র পতপত করে উড়ছে। বিপ্লবের স্লোগান “জয় বাংলা” অবুঝ শিশু থেকে রাজনীতিবিদ পর্যন্ত সবার মুখে মুখে ঘুরে ফিরছে।
অস্ত্রবিহীন একটি সেনাবাহিনী
বাঙালিদের কিছু জিনিস ছিল না বা তারা কিছু কাজ করার চেষ্টা করেনি যা তারা করতে পারত। ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস এর আধা সামরিক বাহিনীর সদস্যরা ছাড়া মুক্তিবাহিনীর অন্য কারো অস্ত্র বা প্রশিক্ষণ দুটোরই মারাত্বক অভাব ছিল। এমনকি ইপিআর এর কাছেও খুব হালকা এবং পুরানো যুগের অস্ত্র ছিল। এই অস্ত্রের স্বল্পতা হয়তো দেশে বানানো সম্ভব এমন অস্ত্র, যেমন দেশে তৈরী মলোটভ ককটেল বা সাধারণ মাইন দিয়ে কিছুটা দূর করা যেত, কিন্তু বাঙালিরা এক্ষেত্রে খুব সামান্য কাজ করেছে।
বাঙালিরা বিস্ময়করভাবে যুদ্ধের জন্য একেবারে অপ্রস্তুত ছিল, অথচ যুদ্ধ যে কোন সময় শুরু হতে পারে, এমন আশঙ্কা অনেক বাঙালিই এমনকি কয়েক বছর ধরে করে আসছে। বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য যে, তাদের কোন ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থা বা লিয়াজো বা বোঝাপড়া ছিল না, যেকারনে গ্রামের পর গ্রাম, জেলার পর জেলা তাদেরকে ভুগতে হচ্ছে । নেতৃত্ব সাধারণভাবে আওয়ামীলীগ নেতাদের হাতে এবং কিছু ক্ষেত্রে সরকারি চাকুরী করা লোকের হাতে ছিল।
তাদের শহরে বসে থাকার একটা প্রবণতা দেখা যায়, যেখানে বসে তারা প্রথমে তাদের লোকদের নিয়ে উদ্দীপক কথা বার্তা বলে, এবং পরে হাহুতাশ করে কেন তাদের যুদ্ধ বিমান, আর্টিলারি , গোলাবারুদ ইত্যাদি নেই এসব বলে। শেখ মুজিবর রহমান, যিনি কিনা এখন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি বলে ধারণা করা হচ্ছে, তিনি একজন টিপিক্যাল বাঙালি। তার একজন কট্টর সমালোচক, যিনি নিজেও একজন বাঙালি, শেখ মুজিবের সম্পর্কে বলেছেন “একজন অসম্ভব লোক ! যখনই তাকে কোন প্রশ্ন করা হোক না কেন, তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর একটা উক্তি দিয়ে তার জবাব শুরু করবেন। ” ঠাকুর হলো বাঙালিদের সর্বোৎকৃষ্ঠ লেখক।
পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বেকুবের মতো ভেবেছিল ৭৫মিলিয়ন শত্রুভাবাপন্ন লোক ৫৫০০০ বর্গ মেইল এলাকায় ছড়িয়ে আছে (বাংলাদেশের আয়তন কমবেশি আরাকান এর মতো।) তাই তারা প্রথম ২ সপ্তাহ শহর এলাকাতে মিলিটারি ক্যান্টনমেন্ট এর আশেপাশে তাদের অভিযান চালায়। কিন্তু যখন তারা বিমান বাহিনীর সাহায্য নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলো, তারা খুব অল্পই প্রতিরোধ পেয়েছিল।
একটি চ্যালেঞ্জহীন সেনাভিযান
গত সপ্তাহের শেষের দিক থেকে বাংলাদেশের বাহিনী শহর খালি করে চলে যাচ্ছে আর পাকিস্তানি মিলিটারি রাস্তায় নামছে প্রায় কোন রকম প্রতিরোধ ছাড়াই। আমাদের কাছে কিছু প্রতিবেদন আছে যে, বাংলাদেশী নেতারা এবং যোদ্ধারা গ্রামের দিকে সরে যাচ্ছে গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি নেবার জন্য। কিন্তু মেহেরপুর বা এরকম কিছু জায়গা, যেখান থেকে ভারতের পশ্চিম বাংলার সরাসরি সীমান্ত আছে, সেখানে লোকজন সোজাসোজি ভারতে চলে যাচ্ছে।
এখনকার একজন স্কুল এর প্রিন্সিপাল যিনি গত সপ্তাহেই সাংবাদিকদের বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানীতে (মেহেরপুর) স্বাগত জানিয়েছিলেন, তিনি এখন ভারতের একটি সীমান্তবর্তী শহর গেড়েতে একটি অতিথিশালায় যেয়ে উঠেছেন। তিনি বললেন “আমাদের ৭৫ মিলিয়ন লোক শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত লড়াই করে যাবে। ”
আর একজন শরণার্থীর সাথে কথা হলো। তাকে বেশ নৈরাশ্যবাদী শোনালেও তিনি সত্যি কথাটাই বলার চেষ্টা করেছেন : ” রক্ত পিপাসু পাঞ্জাবীরা আমাদেরকে শাসন করবে, তা যে কোন মূল্যের বিনিময়েই হোক না কেন। তারা আমাদের হাজার হাজার মানুষ মেরে ফেলছে। আমরা কিই বা করতে পারি ? আমাদের হাতে তেমন কোন অস্ত্র নেই। ইন্ডিয়ানরা আমাদেরকে কিছু ব্রিটিশ আমলের বন্দুক দিয়েছে। কিন্তু পাঞ্জাবীরা কিন্তু কোন অকেজো বন্দুক নিয়ে বসে নেই। গতকালকেই আমরা আমাদের জমিতে কৃষিকাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম কিন্তু আজকে আমাদের গেরিলা হবা ছাড়া কোন উপায় নেই । কিন্তু কিভাবে সেটা হবে ? অনেকে বলছেন, বর্ষাকাল শুরু হলে আমাদের সুবিধা হবে। কিন্তু কিভাবে আমরা সেটার সদ্ব্যবহার করব ? আমাদের কাছে পেন্সিল কাটার ছুরি আর নৌকা চালানোর বৈঠা, বর্ষা এসব আছে। সেগুলো নিয়ে আমরা নৌকা ভাষায় চলব আর ওদের কাছে আছে যুদ্ধ বিমান, কামান, আর্টিলারি, ট্যাংক। আমরা কি করে পেরে উঠব ওদের সাথে ?”
পূর্ব পাকিস্তানের দর্শনা শহর সীমান্ত থেকে ৩ মাইল দূরে অবস্থিত । বেশ কিছু বাংলাদেশী সমর্থক একটি পরিত্যক্ত পুলিশ ফাঁড়িতে উদ্বিগ্ন হয়ে বসে পরস্পরের চোখ চাওয়া চাওয়ি করছে। পাঞ্জাবিদের হাতে এখন থেকে ১০ মাইল দূরে অবস্থিত জেলা শহর চুয়াডাঙ্গার পতন ঘটেছে, এরকম একটি অসমর্থিত খবর নিয়ে তারা আলাপ করছে। ” ২টি পাকিস্তানী যুদ্ধ বিমান চুয়াডাঙ্গার উপরে বোমা বর্ষণ করেছে। একাধিক বাঙালি মারা গেছে। পাঞ্জাবিরা শহর থেকে মাত্র ৩ মাইল দূরে আছে। তাদের প্রতিরোধ করার জন্য কোন বাংলাদেশী মুক্তি বাহিনী শহরে নেই। সবাই শহর ছেড়ে চলে গেছে। “
“আমরা মারা যাব“
একজন রাজনীতিবিদ বক্তিতা দিচ্ছে যে বাংলাদেশের সমর্থনে বহি:বিশ্বের কেউ এগিয়ে আসছে না, যেটা আসলেই সত্যি কথা । কিছু লোক তার কথা শুনছে। আর একজন স্থানীয় নেতা জিজ্ঞেস করছে, পাকিস্তানী বাহিনীর মোকাবেলায় বাংলাদেশী মুক্তি বাহিনীর প্ল্যান কি ? কেউ একজন বললো “আমরা সবাই মারা পড়ব”.. অন্য একজন হতাশভাবে মাথা নেড়ে সায় দিল। কিন্তু পরের দিন পাকিস্তানী বাহিনী কোন প্রতিরোধ ছাড়াই চুয়াডাঙ্গা শহরে প্রবেশ করল।
একটা হতাশা বাংলাদেশের মানুষকে গ্রাস করছিল যে বাইরের বিশ্বের কেউ পাকিস্তানকে থামাতে এগিয়ে আসছে না। বাংলাদেশিদের আশা করাটা হয়তো খুবই স্বাভাবিক, কিন্তু এমনকি চরম বাস্তববাদী কোন মানুষও বাংলাদেশের ব্যাপারে বিশ্বের অন্যান্য দেশের ভূমিকায় হতাশ হতো। বাঙালিরা, যারা কিনা পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এবং আক্রান্ত হয়ে বাধ্য হয়ে এখন স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছে, তাদের সাহায্যে পৃথিবীর কোন শক্তিশালী দেশ এগিয়ে আসছে না।
রাশিয়া পশ্চিম পাকিস্তানকে হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করতে আহবান জানিয়ে বাংলাদেশকে শুধু হালকা মৌখিক সমর্থন দিয়েছে। অন্য দিকে কমিউনিস্ট চীন যাদের কিনা নিজেদের সংগ্রামের ইতিহাস আছে, তারা পশ্চিম পাকিস্তানকে পুরো সমর্থন দিয়ে বসে আছে।
শুধুমাত্র ভারত, যে কিনা পাকিস্তানের প্রতিবেশী এবং শত্রু, সে বাংলাদেশ কে দৃঢ়ভাবে মৌখিক সমর্থন দিয়েছে। ভারত অঘোষিতভাবে পূর্ব পাকিস্তানের সীমানার মধ্যে প্রবেশ করে এখানকার লোকদের এবং মুক্তিবাহিনীকে যথা সম্ভব সাহায্য দেওয়া এবং অন্ততপক্ষে আপাদত শরণার্থী নেবার নীতি গ্রহণ করেছে। কিন্তু এমনকি ভারতও সরাসরিভাবে কূটনৈতিকভাবে বাংলাদেশকে স্বীকার করা অথবা সংগঠিত মিলিটারি সাহায্য দেবার মতো কোন কিছু করছে না।
বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ার ভয়
এখন পর্যন্ত ভারত এবং পাকিস্তান উভয়ই পরস্পর এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন তিক্ত অভিযোগ এবং পাল্টা অভিযোগ করলেও, মনে হচ্ছে উভয় দেশই উদ্বিগ্ন যেন দুই দেশের মধ্যে সর্বাত্বক যুদ্ধ শুরু না হয়ে যায়। কিন্তু যদি সামান্যও ধৈর্যচ্যুতি ঘটে, যে কোন সময় পূর্ব পাকিস্তানের গোলযোগ সারা উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
গত শনিবারে ভারতীয় সীমানার থেকে মাত্র কয়েক গজের মধ্যে অবস্থিত মুজিবনগরের আম্রকাননে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার শপথ নেয়। এই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে গণমাধ্যমে উপস্থাপন করা হয় এবং বক্তারা দেশপ্রেম মূলক বক্তব্য দেন।
কিন্তু বাংলাদেশের গরিমা খুব দ্রুত মলিন হতে সময় লাগল না । অনুষ্ঠানের পরদিনই এক ডজনের মতো লোক বাদে ওই গ্রামকে সম্পূর্ণ ধুলায় মিশিয়ে দেওয়া হলো। অনুষ্ঠানের মঞ্চ এর একটা স্ট্যান্ড আম্রকাননে ঠিকই দাঁড়িয়ে রইল কিন্তু কিছু হাঁস আর রাজঁহাস ছাড়া কাউকেই তার আশেপাশে দেখা গেল না।
ভারতের সীমান্তের অভ্যন্তরে সেই গরিমার কিছু লেস খুঁজে পাওয়া গেল। একজন বাংলাদেশী কর্মকর্তা আগের দিনের স্মৃতিচারণ করলেন, “সেটা একটা অসাধারন দিন ছিল। ” তিনি বললেন, “সাতজন মন্ত্রী , ২৭ জন বিশিষ্ঠ ব্যক্তি। কি অসাধারন বক্তিতা। একটি স্মরণীয় অনুষ্ঠান ”