শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৫। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে
মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে প্রচারিত অনুষ্ঠান ‘অগ্নিশিখা’ থেকে সংকলিত |
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের
দলিলপত্র |
…ডিসেম্বর ১৯৭১ |
এহিয়া বধ কাব্য
৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১
নারীঃ
কহ বীর তুরা করি কীবা সমাচার?
কিভাবে দলিছে, মিত্রসেনা রণাঙ্গনে
এহিয়া চমুরে? ভূপাতিত ইয়াহিয়া
গিরিশৃঙ্গ কিম্বা তরু যথা বজ্রাঘাতে?
পুরুষঃ
গহন কাননে যথা বিধি মৃগবরে
কিরাত অব্যর্থ-শরে, ধায় দ্রুতগতি
তার পানে; শত শত মিত্রসেনা বলী
তেমতি ধায় যশোর শত্রুদুর্গ পানে
চূর্ণিয়া বিচূর্ণ হত করিতে তাহারে।
যথা প্রভঞ্জন বলে উড়ে তুলারাশি
হেরি যমাকৃতি মুক্তিসেনা রখীদলে।
পলাইলা, পলাইয়া সত্ৰাসে চৌদিকে।
মহারোষে যমসম মুক্তি মিত্র সেনা
বেড়াজাল মাঝে যথা ক্ষীণপ্রাণ মীন।
সমৰ্পিল অস্ত্র যত দীন করজোড়ে
মাগিল জীবন ভিক্ষা নরাধম কুল।
যশোহর দুর্গশিরে বিজয় কেতন
বাঙ্গালার মুক্তিসেনা উড়ায় গৌরবে।
নারীঃ
যশোহর দুর্গ তবে হয়েছে পতন?
কহ বীর ত্বরা আর আর রণাঙ্গনে
কিভাবে যুঝিছে মিত্র অক্ষৌহিনী সেনা?
পুরুষঃ
সিলেট কুমিল্লা টাংগাইল নোয়াখালী
জিনি হেলাভরে, আন্দোলিয়া নীলাকাশে,
ঘোর রবে গরজিয়া ভীষন সরবে
চালিয়েছে মিত্রসেনা ঢাকা অভিমুখে
প্রলয়ের মেঘ কিম্বা করযুথ যথা।
অগ্নীময় আকাশ পুড়িছে কোলাহলে
যথা যাবে ভূকম্পন, ঘোর বজ্রনাদে
উগড়ে আগ্নেয়গিরি অগ্নিস্রোতরাশি
নিশীথে! আতঙ্কে শত্রু উঠিছে কাঁপিয়া
কাঁপিছে মালিক বিভীষন প্রাণভয়ে
থরথরি পিণ্ডিনাথ কাঁপে সিংহাসনে।
অলংঘ্য সাগর সম মিত্র অক্ষৌহিনী
বেড়িছে তাহারে। রক্ষা নাহি এবে তার।
বনের মাঝারে যথা শাখাদলে আগে
একে একে কাঠুরিয়া কাটি, সবশেষে
নাশে বৃক্ষ; মহারথী মিত্র অক্ষৌহিণী
তেমতি দুর্বল করে এহিয়া পামরে
নিরন্তর। অবিলম্বে সমূলে নির্মুল
হইবে কুমতি। রক্ষিবে না কভু তারে
চীন আমেরিকা; রক্ষিবে না খান সেনা
আপনার জন। তুরঙ্গে কুরঙ্গে যেবা
মৃগেন্দ্র কেশরী নখে ছিন্নভিন্ন করি
নাশে প্রাণ, শৃগালের পদতলে চাপি
পিষ্ট করি সংহারে ক্রোধান্ধ ঐরাবত
তেমতি নাশিবে প্রভঞ্জন-সেনা সম
মিত্রসেনা ঘোর রণে এহিয়া পামরে।
নারীঃ
ধর্ম-নাম লয়ে যেবা ধর্ম নাশিয়াছে,
ধর্ম তারে করিবে না ক্ষমা। ধর্ম কভু
ক্ষমিবে না ঘোর অধৰ্মীরে। নরহন্তা
পাশব শ্বাপদ লভিবে না প্রাণভিক্ষা।
পুরুষঃ
পৃথিবীর রাষ্ট্রপুঞ্জ যদি ছত্র ধরি
তারে রক্ষিবারে চাহে, বজ্রঘাত হতে
রক্ষা নাতি হার । লুকালে জলধিতলে
মিত্রসেনা জল সেচি অতল সলিল
আনিবে ধরিয়া তারে মৃত্যুদণ্ড লাগি।
অধর্মের পরাজয় জানো সুনিশ্চয়।
নারীঃ
জয় সত্যের জয়, জয় ধর্মের জয়
উভয় কষ্ঠেঃ
জয় মুক্তিবাহিনীর জয় জয় জয়
জী জীবনের জয়, জয় বাংলার জয়।
…ডিসেম্বর, ১৯৭১
পুরুষঃ
দুরাত্মা দানব দল মদমত্ত হয়ে
হানিয়াছে বঙ্গবক্ষে নিষ্ঠুর আঘাত
কাপুরুষ সম। সদা রুধিরাক্ত দেহে
কাঁদিছে জননী। হিংস্র হায়েনারা সবে
প্রমত্ত উল্লাশে ফেরে রাতের আঁধারে
প্রসারিত লোলজিহবা প্রেতের মতো।
দুগ্ধপোষ্য শিশুদের স্তুপ মৃতদেহ,
বিধাতার জয়গান গাহিছে দানব।
পাকিস্তানের গলিত শব কাঁধে বহি
ইসলাম বাচাইতে কতিছ বাসনা
পামর এহিয়া।
নারীঃ
ইসলাম কি বাঁচিবে তাহে?
মানবতা হত্যাকারী জল্লাদের
হাতে ধর্ম কভু লভিবে কি প্রাণসুধা?
পুরুষঃ
ধর্ম কহে না কভু নিষ্পাপ শিশুদেহে
করিতে আঘাত। ধর্ম কভু কহে নাই
নারীদেহ পশুসম করিতে দলন৷
ধর্ম কভু কহে নাই সুতীক্ষ্ম শাণিত
অস্ত্রে নারীদেহ খণ্ডবিখণ্ডিত করি
রক্তমাখা মুখে গাহিতে ধর্মের গান।
যদি কেহ অস্ত্রাঘাতে শিশুহত্যা করে
যদি কেহ মদমত্ত পাশব ক্ষুধায়
নারীদেহে করিবে দলন তার লাগি
রহিয়াছে অনির্বা অনন্ত নরকণ।
নারীঃ
ইয়াহিয়া পাক্সেনা মুখে ভাই বলি
ভ্রাতৃবক্ষে হানিয়াছে পাশব আঘাত
নারীরক্তে করিয়াছে ক্ষমাহীন পাপ
বাংলার বুকে।
পুরুষঃ
তারি লাগি দৃড়পদে
চলিয়াছে মুক্তিসেনা ক্ষমাহীন ক্রোধে
বিধাতার বজ্ৰসম করিতে সংহার
পাক পশু সেনা । ক্ষিপ্ত কেশরী যেমতি
বনভূমি প্রকম্পিয়া প্রচণ্ড গর্জনে পশুদেহ
ছিন্নভিন্ন করি তপ্তরক্তে করে
তৃষ্ণা নিবারণ, মদমত্ত করি
যথা শঠ শৃগালের পদতলে দলি
প্রতিহিংসার আগুন যত করে প্রশমন
তেমতি দুরন্ত ক্রোধে বীর মুক্তিসেনা
সুতীক্ষ্ণ অস্ত্র প্রহরে জর্জিরিত করি
পাক সেনা যত, প্রতিশোধ বহ্নি করে
নির্বাপণ। শত্রুরক্তে করি স্নান সদা
নিভাইছে প্রতিহিংসার প্রজ্বলিত চিতা।
ক্রদ্ধ সিংহসম মুক্তিসেনা আগমনে
দানবের দল ভীত শ্বাপদের মতো
পুচ্ছ নামাইয়া প্রাণভয়ে ছুটিয়াছে
আত্মরক্ষা লাগি দিকে দিকে ধ্বনিতেছে
গগন বিদারী কণ্ঠে বাংলার জয়,
নারীঃ
জয় সত্যের জয়, জয় ধর্মের জয়-
উভয় কষ্ঠেঃ
জয় মুক্তিবাহিনীর জয়, জয় জয়
জয় জীবনের জয়, জয় মানবতার জয়।
১০ ডিসেম্বর, ১৯৭১
নারীঃ
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ মাঝে
কিবা খেলা চলিয়াছে কহ সমাচার
পুরুষঃ
নিরাপত্তা পরিষদে চীন আমেরিকা
স্বীয় স্বার্থে অন্ধ হয়ে কুকীতি স্থাপিল
ধরা মাজে। স্বর্ণ বঙ্গে দুরাত্মা এহিয়া
কনক কমল বনে ঐরাবত যথা
লণ্ডভণ্ড করে সব বিস্মারিল তাহা।
বিস্মরিল দানবের প্রচণ্ড ক্ষুধায়
জ্বলিতেছে এবে বাংলার জনপদ।
স্বীয় ক্ষুদ্র স্বার্থ লাগি তোষণ করিছে
দুরাত্মা দানবে। ভারত আগ্রাসী কহি
মুক্তিযুদ্ধ দংশিবার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে
উঠিয়াছে মাতি, আনিয়াছে পরিষদে
প্ৰগলভ প্রস্তাব ক্ষান্ত হও, ক্ষান্ত হও
মহান ভারত। অস্ত্র করো সংবরণ।
নারীঃ
অতঃপর কি করিল মহান রাশিয়া?
পুরুষঃ
গর্জিয়া উঠিল রাশিয়ার প্রতিনিধি
ধূর্ত শৃগালেরে দেখি সঘনে গর্জিয়া
যেমতি কেশরী ধায় বিদ্যুৎ গতিতে
ধরিতে তাহারে, পাপিষ্ঠ ভ্ৰমিছে দেখি
যেমতি গর্জিয়া ওঠে সুর, সুরপতি
হানে বজ্র পাপিষ্ঠের শির লক্ষ্য করি
রাশিয়ার প্রতিনিধি তেমনি গর্জিয়া
হানিল বজ্রের প্রচণ্ড আঘাত। ভেটো দিয়া
কহিল অশনি স্বরে, পাপী পাকিস্তান
মহাপাপ করিয়াছে পামর এহিয়া।
শৃগাল হইয়া সিংহে করিছে আঘাত
ভারত সীমান্ত দেশ করি আক্রমণ।
জল্লাদ বাহিনী যবে হিংস্র হয়ে
ছিন্নভিন্ন করেছিল বাংলার দেহ?
কোথা ছিলে তুমি বীর চীন আমেরিকা
জল্লাদ বাহিনী যবে ক্রুর লালসায়
আহুতি দিছিল ভোগে লক্ষ লক্ষ নারী?
মানবতা বিসর্জিয়া আসিয়াছ এবে
পশু লাগি করিতে ক্ৰন্দন, দানবের
রক্ষা করিবারে? কিন্তু হীন ইচ্ছা তব
হবে না সাধিত। যতদিন পাক সেনা
না ছাড়িবে বাংলার মাটি যতদিন
গলবস্ত্রে পামর এহিয়া চাহিবে না
ক্ষমা ভারতের পায়ে, অস্ত্র ততদিন
কোষবদ্ধ করিবে না ভারত কেশরী।
নারীঃ
ভেটো লভি দিশেহারা হইয়াছে তারা
কলংক জর্জর মুখে কথা নাহি আর।
হীনতার পরিচয় সর্ব অঙ্গে মাখি
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে যাচে
দস্যুর জীবন ভিক্ষা লজ্জা নাহি পায়
নিক্সন সরকার। নির্লজ্জ হয়েছে
চীন প্ৰগলভ কুমতি। এতদিন ধরি
গণতন্ত্র গণতন্ত্র বলি ভিয়েৎনামে
লক্ষ লক্ষ লোক হত্যা করি আমেরিকা
বাংলার গণতন্ত্র হত্যা অনুষ্ঠান
করিবার ষড়যন্ত্রে রত। বিসর্জিয়া
মানবতা, সাম্যবাদ বুলি প্রকাশিছে
চীন আপনার ক্রর গৃঢ় অভিলাষ
ভারত বিদ্বেষ। মানবতা নিয়াছে সে
বলি আপনার হীন স্বার্থ বেদিমূলে
রক্ষা কি পাইবে তাহে পামর এহিয়া?
পুরুষঃ
পৃতিবীর শক্তি যদি ছত্র ধরি থাকে
এহিয়া শিরের উপর রক্ষা নাহি
রক্ষা নাহি তার। লুকাইয়া থাকে যাদি
সমুদ্রে পর্বতে কিম্বা মরুভূমি মাঝে
কভু এহিয়া চমুর। যশোহর জিনিয়াছে,
চলিয়াছে বীর সেনা বীর পদভারে
করিতে হেলায় জয় ঢাকার অংগন,
ব্যুহ ভাঙ্গি পলায়িত এহিয়া চমুর
এস্তভীত শ্বাপদ যথা মহা শংকায়
সন্দর্শিয়া বীরেন্দ্র কেশরী প্রাণভয়ে
উর্ধ্বশ্বাসে করে পলায়ন। সূর্যকর
মুক্ত হবে রাহুগ্রস হতে, ধ্বনিতেছে
গগন বিদারী কণ্ঠ, বাংলার জয়-
নারীঃ
জয় ন্যায়ের জয়, জয় ধর্মের জয়
উভয় কণ্ঠেঃ
জয় মিত্রবাহিনীর জয়, জয় জয়
জয় বাঙালীর জয়, জয় সত্যের জয়।
(রচনাঃ গাজিউল হক। আবৃত্তিঃ উম্মে কুলসুম ও আশফাকুর রহমান।)