কয়েকটি ছবি- একটি ইতিহাস
৩ নভেম্বর, ১৯৭১
– কি ভাই, কি দেখছেন? ও, ছবিগুলো? আচ্ছা দেখুন। একের পর এক ছবিগুলো দেখে যাচ্ছিলাম আমি।
প্রথম ছবিটি একটা তুলসী গাছের। অবশ্য এতে দেখার কিছু নেই। শুধু উপলব্ধি ছবিটি তোলা হয়েছিলো ১৩ই এপ্রিল। ময়মনসিংহ শহরের কোন এক হিন্দুপারা থেকে। ক্ষতবিক্ষত একটি দোতলা দালানের পাশে দেখা যাচ্ছে গাছটি, বোবার মতো দাঁড়িয়ে। বাড়িতে কোন লোকজন নেই। হয়তো তাদের সবাই প্রাণ হারিয়েছে পাকস্তানী সৈন্যদের মেশিনগানের গুলিতে। অথবা সবাই প্রাণভয়ে পালিয়েছে ওপার বাংলায় শরণার্থী হয়ে। ছবিটি দেখে মনে হচ্ছিলো, কেউ আর মাথা নীচু করে, নতজানু হয়ে পূজা দেবে না সকাল -সাঁঝে-তুলসী তলায় বসে প্রার্থনা জানাবে না হরি-মাধবের কাছে আর কোনদিন।
দ্বিতীয় ছবিটি কোন এক নবদম্পতির-মুখোমুখি অবস্থায়। তবে জীবিত নয়, মৃত। হাতে মেহেদীর কাঁচা রং। তরুণের মুখটা থ্যাবড়া হয়ে গেছে-চেনার জো নেই। তরুণীর বুকের পাঁজর ভেঙ্গে গেছে-টকটকে লাল রক্তিম কলজেটা দেখা যায় শুধু! এদের বিয়ে হয়েছিলো ২৪শে মার্চ। আর ছবিটি তোলা হয়েছিলো ২৬শে মার্চ-ঢাকা মিটফোর্ড থেকে। ২৫শে মার্চ গভীর রাতের নির্জন নিস্তব্ধতায় এ নবদম্পতির মাঝে ছিলো এক মধুময় পরিবেশ। কিন্তু অকস্মাৎ গর্জে উঠলো পশ্চিমা বর্বর সেনাদের কামান। মুহুর্তে স্তব্ধ হয়ে গেল ওরা। চিরদিনের মতো নিঃশেষ হলো ওদের পরস্পরের সকল চাওয়া-পাওয়া।
তৃতীয় ছবিতে বুড়ীগঙ্গার সীমাহীন জলরাশি। একটি বৃদ্ধ সাঁতরে যাচ্ছেন প্রাণপণে। কিন্তু জানা নেই কোথায় যাবে, কখন যাবে বা আদৌ কোথাও গিয়ে উঠতে পারবে কিনা। ছবিটি ২৯শে মার্চ সকালে তোলা। হয়তো এ বৃদ্ধ ছিল রাজধানীর কোন এক ঝাড়ুদার, সরকারী অফিসের পিয়ন, নিম্ন বেতনভুক্ত কর্মচারী- নতুবা কোনমতে রক্ষা পেয়ে অতি সন্তপণে পালাচ্ছেন। শহর ছেড়ে, তার সর্বস্ব ত্যাগ করে। হয়তো চলে যাচ্ছেন কোন এক দূরপল্লীতে, অথবা অতি কষ্টে দেশ ছেড়ে বিদেশে। যেখানে আর দেখা যাবে না পশ্চিম জল্লাদ বাহিনীর চেহারা- শোনা যাবে না সন্তানহারা জননীর অথবা বেয়নেট উচিয়ে আসবে না কেউ হৃদপিণ্ডটি বিধে ফেলতে।
এটি চতুর্থ ছবি। তোলা হয়েছিলো ২৭শে এপ্রিল ভৈরবের পুলের উপর থেকে। ছবিতে অসংখ্য মরা লাশভেসে যাচ্ছে নদীর স্রোতে। কে জানে কতদিন এরা নদীতে ভেসে চলেছে এমনি করে। ফুলে ওঠা বীভৎস দেহ ওদের। কতকগুলো কাক-শকুন বসে আছে এদের উপর।
এর পরের ছবিটি তোলা হয়েছিল কুমিল্লা শহরে। ৪ঠা মে সকালে। ছবিটির একপাশে দেখা যাচ্ছে একদল লোক লুট করছে দোকানের মাল। অপর পাশে খাকী পোশাক পরা একজন লোক ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলছেঃ ঠিক এর পরে ছবিতেও এরাই। ব্যতিক্রম শুধু এ্যাকশনে। কারণ এটিতে লুটেরার দল হ্যাণ্ডস-আপ হয়ে একলাইনে দাঁড়িয়ে। আর সেই ক্যামেরাম্যান ষ্টেনগানের ট্রিগারে আঙ্গুল রেখে তখনও অপেক্ষমাণ । হয়তোবা কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রিগারে চাপ পড়বে। কড় কড় করে উঠবে ষ্টেনগান। অসহনীয় যন্ত্রণায় গড়াগড়ি দিতে থাকবে লুটেরার দল। এরপরের দৃশ্যে হয়তোবা এরা পড়ে থাকবে অবাঞ্ছিত আৰ্বজনার মতো কপালে হাত রেখে। ওদের প্রাণবায়ু তখন অনন্ত অসীমের সন্ধানে উর্ধ্বগামী।
এবারের ছবিতে ছনের ছাউনি দেয়া একটা ঘর। দুটো কুকুর মুখোমুখি বসে। মনের সুখে লেজ নাড়ছে ওরা। আর একটি ছাগল ওদিকে তাকিয়ে হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছে। ইস। এ ঘরটা তৈরি না হলে বেচারা ছাগল আর এ কুকুর দুটো ভর দুপুরের এ কাঠফাটা রোদে কি মুসকিলেই না পড়তো। ছবিটি ভারত সীমান্তের কাছাকাছি পাক জঙ্গীশাহীর কোন এক অভ্যর্থনা শিবিরের সম্মুখভাগ থেকে নেয়া। কিছুদিন আগে ঢাকঢোল পিটিয়ে তৈরি করা হয়েছিল এ অভ্যর্থনা শিবির। শক্র কবলিত ঢাকা বেতার অহরহ মিনতির ফাঁদ পেতে চাইছিলো শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। কিন্তু এতোই দুর্ভাগ্য যে, কেউ গেলো না পাক-জঙ্গীশাহীর অভ্যর্থনা কুড়াতে, এতো সাধের শিবিরে এক রাত ঘুমাতে, বিষ মেশানো তাদের দুধ-কলা খেতে।
এ ছবিটি একদল তরুণ রাইফেল হাতে ট্রেনিং নিচ্ছে। চেহারায় তাদের দারুণ জিজ্ঞাসার ভাব। চোখে সংগ্রামের সীমাহীন দীপ্তি হয়তো এরাই হবে বাঙালী মুক্তিবাহিনী। উপযুক্ত শিক্ষা নিয়ে আক্রমণ চালাবে গেরিলা কায়দায়, নতুবা অবতীর্ণ হবে সম্মুখসমরে। আজ হোক বা কাল হোক বাংলাদেশকে সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত করবেই এরা। মায়ের বুকে ফিরে আসবে সান্তুনা-প্রিয়ার মুখে হাসি। ছবিটি তোলা হয়েছিল বাংলাদেশের কোন এক মুক্ত এলাকা থেকে।
এর পরের ছবিতে পাক-তস্করদের ২০টি শবদেহ পড়ে আছে বুলেটবিদ্ধ হয়ে। বঙ্গশার্দুল মুক্তিসেনাদেরই এ কাজ হয়তোবা এদের কোন এক গেরিলা ইউনিট লুকিয়ে ছিলো ঝোপের আড়ালে , টহলদার পাকসেনাদের গতিবিধি লক্ষ্য করে আক্রমণ চালিয়েছিলো ওরা। শত্রুকে সম্পূর্ণ খতম করে ওদের অস্ত্র-গোলাবারুদ দখল করে নিয়ে নিমিষেই উধাও হয়ে গিয়েছিলো ওরা। আর পাক-সেনারা পড়ে রইলো বাংলার কুকুরশেয়ালের খাবার হিবেবে। ছবিটি তোলা হয়েছিল পূর্ব রণাঙ্গনের কসবা এলাকা থেকে।
ছবিগুলো দেখা হলে চলে এলাম আমি। পথে এক পা দু’পা করে হাটছিলাম, আর ভাবছিলাম শুধু ভাবছিলাম। ভাবছিলাম, সে অনেক কথা! হয়তো বন্ধুটি ক্যাপশন লিখবে ছবিগুলোর। এরপর তার এ্যালবামে সাজিয়ে রাখবে একে একে। বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হবে। এরপর চলে যাবে এক বছর, দু’বছর- দশ বছর, বিশ্ব বছর বা আরও কয়েক বছর। কিন্তু ছবিগুলো? এগুলো ঠিকই থেকে যাবে এ্যালবামে। এরপর হঠাৎ একদিন এ্যালবামটা পড়বে বন্ধুটির কোন এক ভবিষ্যৎ বংশধরের হাতে। সে ছবিগুলো দেখে যাবে, তা থেকে শিক্ষা নেনে- তরে ঠিক ছবি হিসেবে নয়, বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে হিসেবে।
(জাহাঙ্গীর আলম রচিত)