৩০। কুমিল্লা ও রাজশাহীতে ( রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়) গণহত্যার স্বরূপ (৪০৭-৪০৮)
সূত্র – সংবাদ, তারিখঃ ৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২
কুমিল্লা ও রাজশাহীতে (বিশ্ববিদ্যালয়) গণহত্যার স্বরূপ
কুমিল্লা, ৫ই ফেব্রুয়ারী (বি, এস, এস)। বিভিন্ন সূত্রের খবর থেকে জানা গেছে, ইয়াহিয়ার জল্লাদবাহিনী ও তার অনুগত চররা বিগত ৯ মাস ধরে এখানে ত্রাসের রাজত্ব চালিয়ে কমপক্ষে ২০,০০০ লোককে হত্যা করে। হাজার হাজার বাড়ী পুড়িয়ে দেয় এবং অগণিত পরিবারকে গৃহহারা করে দখলদার বাহিনী বাংলাদেশ ভারত সীমান্তের তিন মাইলের মধ্যে সমস্ত সম্পত্তি এবং বাড়ীঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে অথবা ধ্বংস করেছে।
এসব এলাকার মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়ীয়া এবং আখাউড়া সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। জেলার প্রায় সকল হাট-বাজার লুট ও ধ্বংস করাতে সারা জেলায় চরম আর্থিক সংকট দেখা দিয়েছে। ক্ষতির পরিমাণ সম্পূর্ণরূপে নির্ধারণ করার কাজ সম্পন্ন হলে হত্যা এবং ধ্বংসের পরিমাণ বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
পাক- হানাদার বাহিনী এবং অনুচররা বিভিন্ন হাট-বাজার, ঘরবাড়ী রেল এবং বাস থেকে বহু সংখ্যক যুবককে ধরে এনে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছে সে সম্পর্কে এখনো কিছু বলা যায়নি। যাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাদের মধ্যে একমাত্র বিষ্ণুপুরের জনাব আলী আকবার নামের এক যুবক জীবন্ত ফিরে আসতে সক্ষম হয়েছেন।
বিএসএস-এর প্রতিনিধির নিকট তিনি জল্লাদ বাহিনীর নির্মম অত্যাচারের কাহিনী বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, এপ্রিল মাসের ৮ তারিখে তাদের বাড়ী ঘেরাও করে তল্লাসী চালানো হয় এবং ২৩ বৎসর বয়স্ক বাসেতকে হত্যা করা হয় তার বাড়ী লুট করে সমস্ত কিছু সার্কিট হাউজে নিয়ে যায় এবং তাকেও ধরে নিয়ে যায়। সার্কিট হাউজে আরো ১২ জনকে ঐ সময় ধরে আনা হয় এবং সারারাত ধরে তাদের আটক রাখা হয়। পরদিন সকালে চোখ এবং হাত বেঁধে ট্রাকে করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়।
একটি গুদাম ঘরে তাদের নিয়ে আসা ও চোখ খুলে দেওয়া হয়। সেখানে তিনি বহু হতভাগ্যকে পা বাঁধা হাত বাঁধা অবস্থায় মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখতে পান। ঐ সব হতভাগ্যদের মধ্যে শহরের নামকরা আইনজীবী শ্রী যতীন্দ্র ভদ্রকে তিনি দেখতে পান। তাঁর গায়ে যথেষ্ট ক্ষত চিহ্নও তিনি দেখেছিলেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ঃ
সুদীর্ঘ নয় মাস পাক বাহিনীর অত্যাচারের জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩ জন শিক্ষকসহ ১৮ জন পার্সোনেলের কর্মচারী হত্যা। পাক বাহিনীর হাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব জিনিসপত্র নষ্ট হয়েছে তার মূল্যের পরিমাণ প্রায় ২২ লাখ ৬৪ হাজার টাকা।
বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার বিশেষ প্রতিনিধিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিষ্ট্রার জানান যে পাক বাহিনী কতৃক ধ্বংসকৃত জিনিসপত্রের মূল্যের পরিমাণ যথাযত নিরুপণ করতে একটি কমিটি নিয়োগ করা হয়েছে। গত এপ্রিল মাসের তৃতীয় সপ্তাহে পাক বাহিনী বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে প্রবেশ করে বিভিন্ন হল এবং স্টাফ কোয়ার্টারে ক্যাম্প স্থাপন করে। প্রথমেই বর্বর বাহিনী শহীদ মিনারটি ধ্বংস করে দেয়।
পরে জোহা হলসহ অন্যান্য অনেক হল সম্পূর্ণ ধ্বংস করে ফেলে। সকল হল স্টাফ কোয়ার্টার ও অন্যান্য কর্মচারীর বাসা এমনকি লাইব্রেরী ও লেবরেটরী পর্যন্ত হানাদার বাহিনী লুটপাট করে। সংবাদ দাতা পরিসংখ্যান বিভাগের প্রধান ডঃ হোসেন, অর্থনীতি বিভাগের প্রধান ডঃ মোশারফ হোসেন, বাংলা বিভাগের রীডার ডঃ আবু হেনা মোস্তফা কামাল এবং অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মচারীর সাক্ষাৎ গ্রহণ করেন এবং হানাদার বাহিনীর নানা প্রকার চাঞ্চল্যকর কাহিনী শোনেন।
এপ্রিল মাসে ১৪, ১৫ তারিখে যথাক্রমে অংক বিভাগের এসোসিয়েট প্রফেসর জনাব হাবিবুর রহমান, বাংলা বিভাগের এসোসিয়েট প্রফেসর শ্রী সুখরঞ্জন সমাদ্দার এবং মনস্তত্ত্ব বিভাগের ডেমনেসট্রেটর জনাব মীর আব্দুল কাইয়ুমকে বাসভবন থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করা হয়। বর্বররা কী ধরণের নিষ্ঠুর ছিল তার এক নজীর পাওয়া যায় একজন অধ্যাপককে হত্যা করার পর তার মেয়েকে একজন মিলিটারি অফিসারের সাথে বাস করতে বাধ্য করার দৃষ্টান্ত থেকে।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায় যে, প্রাক্তন উপচার্য জনাব সাজ্জাদ হোসেনই ৩০ জন অধ্যাপক এবং অন্য দু’জন অফিসারকে হত্যার একটি তালিকা প্রস্তুত করেছিলেন। একে ৪ টি ভাগে ভাগ করা হয়েছিল। প্রথম শাস্তি মৃত্যুদন্ড, দ্বিতীয় কারাবরণ, তৃতীয় পদ হতে অপসারণ, চতুর্থ বেত্রাঘাত। তাছাড়া আরো জানা গেছে যে, ৪ জন অধ্যাপক ট্রাক ভর্তি করে মালপত্র নিয়ে ২৮শে এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে যায়। কিন্তু তারা আর ফিরে আসে নি। তারা পশ্চিম পাকিস্তানে চলে গেছে বলে অনুমান করা হচ্ছে। আবুল বাশার নামের এক পিয়ন সাংবাদদাতাকে জানায় যে, কেবলমাত্র জোহা হলের নিকটেই ৩ হাজার লোককে সমাধিস্থ করা হয়েছে।