৩২। খান সেনারা ওকে বাঘের খাঁচায় ঢুকিয়েছিল (৪১১-৪১২)
সূত্র -দৈনিক বাংলা, ৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২।
খান সেনারা ওকে বাঘের খাঁচায় ঢুকিয়েছিল
বলিষ্ট দেহের অধিকারী জনাব সিরাজুদ্দৌলা ঠাকুরগাঁ শহরেরই অধিবাসী। দিনটি ছিল ২২শে জুলাই। বিকাল ৪টা। দোকানে বসেছিলেন সিরাজুদ্দৌলা। এমন সময় ৭/৮ জন খান সেনা এসে তাকে ধরে ফেলল। তিনি কথা বলার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু খান সেনারা তার কোন কথাই শুনলো না। ওরা ওকে জুতা পরতেও দেয়নি। তখনই শুরু হলো মার।
ঘুষি, কিল, চড়, থাপ্পড়। এক নাগাড়ে, বিরামহীন। ওদের একজন তার হাত দু’টো বেঁধে ফেলল। মার খেতে খেতে তিনি ধরাশায়ী হয়ে গেলেন। কে কত মারতে পারে তার প্রতিযোগিতা শুরু হলো। চলতে থাকলো সরু পায়ের লাথি। আর মুখখিস্তি। ওদের ক্যাম্পে যাওয়ার আগে চেকপোস্ট। পশুদের সেকি উল্লাস। মুখ ব্যাদান করা হাসি।
একে অপরকে বলছে, “বহুত উদমা শিকার মিল গিয়া”। সাথে সাথে পরম সুখে মারধোর চলতেই থাকলো। ওদের পায়ে পায়ে ফুটবলের মত গড়াতে গড়াতে ক্যাম্পে গিয়ে পৌঁছলাম। ক্যাম্পে আরো বিরাট চেহারার গাট্টা গোট্টা খান সেনা এগিয়ে এলো তখনো জ্ঞান হারাইনি। মনে হলো এদের মার আমি হজম করতে পারবো না। আজ আমার এখানেই শেষ।
কেন জানি, ওরা মারলো না। ঘরের বারান্দায় শুন্য পাটাতনের উপর আমাকে বসতে বললো। সাহস সঞ্চয় করে বললাম, আমি একজন মেডিকেল ছাত্র, শিক্ষিত মানুষ। চেয়ার দাও। যেন ভূত দেখেছে। এমনি দৃষ্টিতে তাকিয়ে অট্টোহাসিতে ফেটে পড়লো পশুর দল। বলল, চেয়ার? বাঙ্গালী সে অধিকার হারিয়েছে। খুঁটির সাথে আমার হাত বেঁধে ফেলা হলো।
তখন আসরের নামাজের সময় হয়েছে। তিনি অজুর পানি চাইলেন। এনে দিল, বাঁধা হাত ছাড়িয়েও দিল।
নামাজের আধঘন্টা খানেক পর থেকে শুরু হলো ওদের জিজ্ঞাসাবাদ। আমি নাকি অনেক অবাঙ্গালী হত্যা করেছি, আমি একজন সামরিক অফিসার। আমি ছেলেদের রাইফেল ট্রেনিং দিয়েছি ইত্যাদি। ওরা আমাকে খুবই পীড়াপীড়ি করতে থাকে আমি যেন সবকিছু স্বীকার করি। এরপর মনে হলো, সিকিউরিটির কিছু অফিসার এলো। তারাও একই ধরণের প্রশ্ন করতে থাকে। আমি সবকিছুই অস্বীকার করি। এবার ভয় দেখালো ওরা আমাকে মেরে ফেলবে।
এরপর ওরা কোত্থেকে একটা বানর জোগাড় করে আনলো। ওরা বানরটা আমার উপর ছেড়ে দিল। চলল বানরের অত্যাচার। কামড়, আঁচর, থাপ্পড়। একসময় বানরও শ্রান্ত হয়ে গেল। সন্ধ্যা নেমে এলো। এরপর ওরা আমাকে বাঘের খাঁচায় ঢুকিয়ে দিল। কী মর্জি হলো। ওরা আমাকে খাঁচা থেকে বের করে নিয়ে এলো।
সেই মুহুর্তে মনের অবস্থা আমি ভাষায় বোঝাতে পারবো না। নিশ্চিত বুঝতে পারছি, আমি মরছি। দেশের স্বাধীনতার জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি। খাঁচা থেকে বের করে নিয়ে এসে ওরা আমাকে পাশেই একটি কক্ষে ঢুকিয়ে দিল। খাঁচা আর কক্ষটার মাঝে শুধু একটি রেলিং। সেখান থেকে খাঁচার মধ্যে শুকিয়ে থাকা রক্তের দাগ দেখতে পাচ্ছিলাম। আচমকা বাঘটা রেলিং টপকে এসে আমাকে আক্রমণ করে বসল।
ডান হাত, ডান উরু ও ডান দিকের পিঠে তার তীক্ষ্ণ নখর বসিয়ে দিল। আবার তার স্থানে ফিরে গেল। রাত ৮ টার দিকে আমাকে সে ঘর থেকে ওরা বের করে আনলো। ভাবলাম এবার হয়ত মেরে ফেলবে। না মারলো না। নিজের হাতও দেখতে পাচ্ছিনা এমন একটি অন্ধকার ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে একজন সিপাহী বলল, দেখ বিছানা আছে-শুয়ে পড়। হাত দিয়ে যা পেলাম তা হলো একটি চটের ছালা আর ইলেক্ট্রিক হিটার। হাত দু’টো জানালার সাথে বাঁধাই রইল।
সকালে ওরা আমাকে মেজর রাজার কাছে নিয়ে গেল। সেখানে আমার বাবাকেও দেখলাম। অদ্ভুত সব প্রশ্ন মেজর রাজার। কোন জেলায় বাড়ীর সংখ্যা বেশি? বললাম, জানিনা।
ঠাকুরগাঁয়ে কত মেয়ে আছে? বললাম, আপনি বলুন।
মেজরের জবাব ঠাকুরগাঁয়ে মেয়ে বেশ, কেননা তার মতে বাঙ্গালী মেয়েরাই নাকি সেখানে অবাঙ্গালীদের মেরে ফেলেছে। এরপর কর্ণেলের কাছে আমাকে পাঠানো হলো। অনেক সদুপদেশ দিয়ে কর্ণেল আমাকে ছেড়ে দিল।
এরপর আরও একবার মেজর তাকে তলব করেছিল।