গোপালপুর সুগারমিলে গণহত্যা

৫৯| গোপালপুর সুগারমিলে গণহত্যা (৪৫৬-৪৫৭)

সুত্র – দৈনিক বাংলা, ২৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২

গোপালপুর সুগারমিলে গণহত্যাঃ আজিম সাহেব বাচেঁননি

তিনশ কর্মচারীকেও বাচাঁতে পারেননি

|| সাখাওয়াত আলী খান প্রদত্ত ||

মিসেস আজিম। তিন সন্তানের জননী। উনাকে খুব রোগা দেখাচ্ছিল। তিনি বললেন, প্রায় দশ মাস হয়ে গেছে সে নেই-এখন স্বপ্নের মতো মনে হয় সব। দুঃখ করবো কি বলেন, শুধু তাকেই তো মারে নি।

তিনশত মানুষকে- নিরপরাধ নিরস্ত্র তিনশত মানুষকে ঠিক পাশের কলোনিতে যাদের স্ত্রী-সন্তান আর আত্মীয়স্বজন রয়েছে কেউ কেউ হয়তো দাঁড়িয়ে দেখেছেও এক সময়ে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে মেরেছে। তারপর তাঁদের লাশ ফেলে দিয়েছে পাশের পুকুরে।

মিসেস আজিম আরো জানালেন, হানাদার বাহিনী দুটি দলে বিভক্ত হয়ে ঢুকেছিল গোপালপুরে নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলে। তাদের দোসর ছিল স্থানীয় অবাঙ্গালীরা। প্রথম দলটি ঢুকেছিল মুল মিলের অভ্যন্তরে, অপর দলটি একই সঙ্গে প্রবেশ করে মিলের পাশের কলোনিতে। প্রথম দলটি মিলে ঢুকে মিলের প্রশাসক জনাব আজিম, প্রশাসনিক অফিসার জনাব শহিদুল্লা, একাউনটেন্ট জনাব সাইফুদ্দিন আহমদ, ইক্ষু সুপারিনটেনডেন্ট জনাব গুলজার হোসেন তালুকদার, সহকারী একাউন্টেন্ট জনাব মান্নান ভুঁইয়া, কৃষি অফিসার জনাব কিবরিয়া, সহকারী ইক্ষু উন্নয়ন অফিসার জনাব হাসেম ও স্টেনোগ্রাফার জনাব রউফ সহ তিনশরও বেশী কর্মচারী ও শ্রমিককে মিলের পুকুরের পাশে লাইন করে দাঁড় করায়।তারপর তাদের গুলি করে হত্যা করে। মিসেস আজিম জানালেন, গোপালপুরে এই হত্যালীলার সঙ্গে যে সমস্ত পাক সামরিক অফিসার প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল তাঁরা হচ্ছে, মেজর শেরওয়ানী, ক্যাপ্টেন মোখতার ও মেজর ইউলিয়াম (প্রিন্টিং মিসটেক মনে হচ্ছে, উইলিয়াম হতে পারে)।

এদের মধ্যে প্রথমোক্ত দু’জন থাকতো নাটোরে আর তৃতীয়জন থাকতো ঈশ্বরদীতে। মিলের আবাঙ্গালি কর্মীদের যোগসাজদের কথা বলতে গিয়ে মিসেস আজিম জানালেন, ২৫ষে মার্চের কালো রাতের পর থেকেই এখানে আবাঙ্গালির উৎপাত বেড়ে গিয়েছিল। তাঁরা হিন্দুদের আর দেশপ্রেমিক অধিকার সচেতন মানুষের বাড়িঘর দখল করতো, লুটপাট করতো বিষয় সম্পত্তি, কিন্তু কিছু বলার উপায় ছিল না, কারন তখন তাঁরাই সর্বেসর্বা। কিছু বলতে গেলে বলতো- “ইয়েচীজ কো উপর হামলাগকা হক হ্যাঁয়।“

মিসেস আজিম বলেন, এসমস্ত যোগসাজশকারী যা করেছে তা ভাষায় বর্ণনা করা যায়না। হানাদার সৈন্যরা গুলি করে তিনশ’ বাঙ্গালীকে হত্যা করার পর মিলে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। কিন্তু এসব দালাল মৃত জনদের আত্মীয় স্বজনের লাশের কাছে যেতে দেয়নি। পুকুরে এসব হতভাগ্যের লাশ পচে যখন দুর্গন্ধ ছুটছিল তখন তারা গর্ত করে সেগুলোকে মাটিচাপা দিয়ে রাখে। এর আগে লাশের মধ্যেও ঘড়ি, আংটি, কলম ও অন্যান্য মূল্যবান দ্রব্য লুটপাট করে।

এছাড়া এই পশুরা বাঙালিদের ‘মিলিটারি ফের আয়েগা’ বলে বার বার ভয় দেখায়। ফলে মিল অঞ্চলের বাঙ্গালীরা সবকিছুর মায়া ত্যাগ করে কেবল প্রাণ হাতে করে যেতে বাধ্য হয়। মিসেস আজিমও তার এক ছোট ভাইও সন্তানদের সঙ্গে করে মিল এলাকা ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন গ্রামে। মিসেস আজিম জানালেন, আজিম সাহেব গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের মিলের গাড়ী ব্যবহার করতে দিয়েছেন, সাহায্য করতে চেষ্টা করেছিলেন নানাভাবে। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের প্রথম অবস্থায় হানাদার বাহিনীর মেজর আসলাম গোপালপুরে নিহত হয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে।

তাই মিলে হত্যাকাণ্ড চালাবার আগে হানাদাররা জানতে চেয়েছিল মেজর আসলামকে কে মেরেছে। মিলের নিরীহ কর্মচারীদের বাঁচাবার আশায় রিজার্ভ বাহিনীর সাবেক লেফটেন্যান্ট আজিম বলেছিলেন, “আমি মেরেছি, আমাকে ধরে নিয়ে চল তোমরা, কিন্তু মিলের নিরীহ কর্মচারীদের মেরো না।“

কিন্তু দোয়া বলে কোন বস্তু ছিল না পশুদের অন্তরে। তাই মেশিনগান চালিয়ে পাইকারি হত্যা করে পৈশাচিকতার দৃষ্টান্ত রেখে গেছে তাঁরা গোপালপুরের বুকে। যে পুকুরটিতে নরপশুরা ফেলে দিয়েছিল হতভাগ্য মানুষের লাশ, গোপালপুরের সহানুভূতিশীল জনগণ সে পুকুরটির নাম দিয়েছিল- শহীদ সাগর।

Scroll to Top