ঘুরে এলাম মুক্তাঞ্চল
৮ ডিসেম্বর, ১৯৭১
অনেক ঝড়ঝাপ্টার পরেও- দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে বিধ্বস্ত হওয়া সত্বেও সহজ স্বাভাবিক সবুজ শ্যামলিমা সর্বত্র অক্ষুন্ন। চারিদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ। গ্রামবাংলার সেই চিরন্তন দৃশ্যই দেখছিলাম দু’চোখ ভরে, আর পায়ে পায়ে এগিয়ে চলছিলাম সামনের দিকে। পথে ছোট একটি খাল পড়ল। এটি পার হয়ে যেতে হবে। দেখলাম খালের পুলটি ভেঙ্গে পড়ে আছে আর তার পাশ দিয়েই নতুন একটি বাঁশের সাঁকো তৈরি করা হয়েছে। হানাদার বাহিনী গ্রামে প্রবেশ করার আগে গ্রামবাসীরা পুলটি ভেঙ্গে দিয়েছিল। এখন আবার তারাই নতুন করে সাঁকো তৈরী করেছে।
খালের ওপারে গিয়ে থমকে দাঁড়ালাম। সামনে বিধ্বস্ত একটি বাড়ি। না, কোন ঝড়ের তাণ্ডবে ওটি বিধ্বস্ত হয়নি। ইতিহাসের কলঙ্ক ইয়াহিয়ার উন্মত্ত জানোয়ারগুলো বাড়িটিকে জুলিয়ে দিয়েছে। এগিয়ে গেলাম বাড়িটির ভিতরে। কোন মানুষ নেই, আছে শুধু চাপ চাপ রক্ত। বাঁধানো উঠোনের এক প্রান্তে একটি কুকুরের মৃতদেহ পড়ে আছে। ওটির পায়ে গুলির চিহ্ন দেখতে পেলাম, পশুগুলোর হিংস্রতার কাছে কুকুরটিও রেহাই পায়নি।
হ্যাঁ, বলছিলাম খুলনা জেলার একটি মুক্তাঞ্চলের কথা। ওই ফ্রন্টের মুক্তিবাহিনীর একটি ছোট দলের অধিনায়ক আমার বন্ধু আনোয়ার। গত পরশুদিন গিয়েছিলাম ওর ক্যাম্পে। পথ চিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন স্থানীয় কয়েকজন অধিবাসী। তাদের মধ্যে একজন বললেন, যে বাড়িটি দেখলেন ওটি স্থানীয় হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষকের বাড়ি। পশুগুলো তাকে এবং তার দুই পুত্রকে হত্যা করেছে এবং তার একমাত্র মেয়েকে ধরে নিয়ে গিয়েছে। সবচেয়ে মর্মান্তিক যা শুনলাম তা হল, মাস্টার সাহেবের এক বছরের শিশুপুত্রটির পা ধরে একটি জানোয়ার সিমেন্ট বাঁধানো উঠানে সজোরে নিক্ষেপ করে শিশুটির মাথাটিকে চৌচির করে ফেলেছে। তখন আর একটি জানোয়ার পাকিস্তানী পতাকা একখণ্ড বাঁশের মাথায় লাগিয়ে শিশুটির মাথার ভিতরে পুতে দিয়ে পৈশাচিক আনন্দে পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বলে চিৎকার করে উঠেছিল।
এ ধরনের শত শত জল্লাদী তাণ্ডবের কথা শুনতে শুনতে উপস্থিত হলাম স্থানীয় বাজারে। সেখানে দেখলাম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা পতপত করে উড়ছে। বাজারে বেশ লোক সমাগম হয়েছে। কেনাকাটার মাঝে আলাপ হচ্ছে কোন কোন এলাকা মুক্ত হলো, কটা জানোয়ার খতম হল ইত্যাদি হরেক রকমের কথা। প্রতিটি মানুষের দৃঢ় মনোবল দেখে সেদিন অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। বীর প্রসবিনী বাংলার আজ এক অভূতপূর্ব সাজ।
বাজার থেকে অল্প দূরেই মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প । সেখানে গিয়ে শুনলাম আনোয়ার ক্যাম্পে নেই, রণাঙ্গনে। তার দলের একজন যোদ্ধা আহত হয়ে ক্যাম্পে শুয়ে আছেন। তার কাছে গিয়ে বসলাম, চারিদিক থেকে অনবরত গোলাগুলির শব্দ হচ্ছিল। এক-একটি প্রচণ্ড শব্দের সাথে আহত তরুণটি চঞ্চল হয়ে উঠছিলেন। আমাকে দুঃখ করে বললেন, সামান্য আঘাতের জন্য তাকে শুয়ে থাকতে হচ্ছে। এতক্ষণ রণাঙ্গনে থাকলে নিশ্চয়ই সে কয়েকটি হায়েনার জীবন নিতে পারতো। ডাক্তার তাকে বিশ্রাম নিতে বলেছে। কিন্তু সে বিশ্রাম চায় না। তার ইচ্ছা কালই সে যুদ্ধে যাবে। কিন্তু আমি দেখেছি তার আঘাত বেশ গুরুতর। কম করে আর ৩/৪ দিন তাকে বিশ্রাম নিতে হবে। সত্যি, বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য অনুসারী আজ এক-একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গে পরিণত হয়েছে। এই আগুনের দুর্জয় শক্তির স্পর্শে শত্রুর সকল প্রতিরোধ খান খান হয়ে ভেঙ্গে পড়ছে। মৃত্যু তাদের কাছে আজ খেলা মাত্র। আহত যোদ্ধাটির উজ্জ্বল চোখের দিকে তাকিয়ে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে গেল।
ক্যাম্প থেকে আর একজন তরুণের সাথে এগিয়ে গেলাম রণাঙ্গনের দিকে। কানে আসছিল শুধু শব্দ আর শব্দ। যাবার পথে গ্রামবাসীদের দেখলাম কেউ চাষ করেছেন, কেউবা মাছ ধরছেন, আবার কিছু লোককে দেখলাম তাদের বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি মেরামত করতে। ওদের চোখ-মুখে ভয়ের কোন চিহ্ন দেখতে পেলাম না। মুক্তিবাহিনীর উপর অগাধ বিশ্বাস রেখে বিনা দ্বিধায় তারা দৈনন্দিন কাজ করে যাচ্ছেন। মানব ইতিহাসের ঘৃণ্যতম জল্লাদ ইয়াহিয়া ডালকুত্তা বাহিনীর আক্রমণে যারা আত্মীয়-পরিজন হারিয়ে, নিজ নিজ ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন তারা একে একে ফিরে আসছেন। কবরের মাঝে আবার গড়ে উঠেছে জনবসতি।
যেতে যেতে গ্রামের শেষপ্রান্তে গিয়ে উপস্থিত হলাম। সেখানে পরিখা খনন করে তার ভিতর মুক্তিবাহিনীর কয়েকজন জওয়ান তৈরী হয়ে আছেন যে-কোন বিপদের মোকাবিলা করার জন্য। ওদের দিকে তাকিয়ে দেখলাম বিজয়ের গর্বে তারা প্রত্যেকে গর্বিত। স্বাধীনতার পবিত্র আলোকে ওদের মুখ-চোখ উদ্ভাসিত। তারা জানালেন হানাদার বিতাড়িত হওয়ার পর মুক্ত এলাকা রক্ষার ভার তাদের উপর পড়েছে। এবং তারা দৃঢ়তার সাথে সে দায়িত্ব পালন করছেন। আর ওদের সহযোদ্ধারা প্রচণ্ডতম আক্রমণে কচুকাটা করে চলছেন পররাজ্যলোভী ডালকুত্তাদের। তাদের এই আক্রমণে মনোবলহীন ভাড়াটিয়া হায়েনার দল পরাজয়ের বিভীষিকায় আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পিছু হটছে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পতাকাবাহী এই দুর্ধর্ষ যোদ্ধারা বাংলার দশদিগন্তে ছড়িয়ে দিচ্ছে বিজয়ের বার্তা। চূড়ান্ত আঘাত হেনে শেষ হানাদারটিকে খতম করার দুর্জয় সংকল্পে অটল বঙ্গশার্দুল এই বীরবাহিনী সাড়ে সাত কোটি বাঙালীকে জানিয়ে দিচ্ছে- তাদের সম্পূর্ণ মুক্তির দিন সমাগত।
আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আলাপ করছিলাম তার দুই মাইলের ভিতরেই তখন প্রচণ্ড যুদ্ধ চলছিল। কাজেই আর সামনে যাওয়া যাবে না। এবার ফিরতে হবে। ফিরে এলাম ক্যাম্পে। একটু আগেই আনোয়ার ফিরে এসেছে। শুয়ে আছে ওর ক্যাম্পখাটে। কিন্তু ওরে পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখি ব্যাণ্ডেজ বাঁধা। শুনলাম যুদ্ধ করার সময় ওর পায়ে হঠাৎ গুলি লাগে। কিন্তু ও কাউকে না বলে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু যখন হানাদারেরা পিছু হটে গিয়েছে, মুক্তিযোদ্ধাদের এগিয়ে যাবার পালা তখন আনোয়ার ওর দুজন সহযোদ্ধাকে বলেছিল ওকে সামনে নিয়ে যাবার জন্য। কিন্তু তারা ওকে ক্যাম্পে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে। তাদেরকে দেখলাম তখনও তারা দাঁড়িয়ে আছে। পরনে লুঙ্গি-গেঞ্জি, কাঁধে ষ্টেনগান আর চোখে উজ্জ্বল দীপ্তি। ওরা চলে গেল ওদের অগ্রবর্তী ঘাঁটিতে। আনোয়ারের কাছে যুদ্ধের খবর শুনলাম। ওই দিনই আরও তিনটি থানা শত্রুমুক্ত হয়েছে, আর ও নিজেই ৪টি হানাদারকে খতম করেছে। পশ্চিমারা এখন আক্রমণের চেয়ে আত্মরক্ষায় বেশী তৎপর। কাজেই পালানোর সময় অধিকাংশই মারা পড়ে। রেডিওতে স্বাধীন বাংলা বেতারের অনুষ্ঠান হচ্ছিল। “বজ্রকণ্ঠ অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর বাণী শোনা যেতেই আনোয়ার কঠিন হয়ে উঠল। ভালভাবে লক্ষ্য করে দেখলাম ওর চোখেমুখে এক কঠিন শপথের ছায়া। বজ্রকণ্ঠ শেষ হয়ে যেতেই আমাকে বলল, বঙ্গবন্ধু আজ শত্রুর হাতে বন্দী। কিন্তু সবসময় মনে
হয় তিনি আমাদের সাথেই আছেন, নির্দেশ দিয়ে চলছেন সামনে এগিয়ে যাবার, জননী বাংলার শৃঙ্খল মোচন করার। তিনি যতই দূরে থাকুন আর যেখানেই থাকুন না কেন, আশীৰ্বাদই আমাদের প্রেরণা দিচ্ছে মৃত্যুভয়কে হরণ করে সামনে এগিয়ে যাবার। এমনি অনেক কথা বলতে বলতে আনোয়ার উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল। হঠাৎ গুম গুম করে প্রচণ্ড দুটো শব্দ হল একেবারে কাছেই। আমাকে বিস্মিত করে ওর খাটের পাশে রাখা রাইফেলটা নিয়ে ও উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো। কিন্তু পরক্ষণেই পায়ের যন্ত্রণায় কুকিয়ে উঠল। ততক্ষণে আমি ওকে ধরে ফেলেছি। আমি ধরতেই ও সম্বিত ফিরে পেল। আমাকে বলল, মনে ছিল না আমি আহত। ওই শব্দ শুনলে কিছুতেই নিজেকে ঠিক রাখতে পারি না। আবার ওকে শুইয়ে দিলাম।
(তপন ভট্টাচার্য রচিত)