৩৪। চাঁদপুরে ৮ মাসের বিভীষিকা (৪১৫-৪১৬)
সূত্র – দৈনিক বাংলা, ৭ ফেব্রুয়ারী, ১৯৭২
জ্যান্ত মানুষগুলোকে হাত-পা বেঁধে গায়ে সিগারেটের আগুন দেওয়া হতো
কখনোবা নদীতে ফেলা হতো
চোখ তুলে নেয়া হতো
দাঁত ভেঙ্গে ফেলা হতো
চাঁদপুরবাসী দীর্ঘ আট মাসের সেই বিভীষিকাময় দিনগুলোর কথা আজও ভুলতে পারেনি নরঘাতক পিশাচ পাঞ্জাবী মেজর তৈমুর ও তার দোসর সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের শওকতের অত্যাচারের কথা। তাদের বীভৎস নারকীয় তান্ডবে বহু মা সন্তানকে হারিয়েছে। বিধবা হয়েছে বহু নারী, ধর্ষিতা হয়েছে কয়েক’শ অবলা।
কচি খুকীটিও এদের বিলাস লালসার কামনা থেকে বাঁচতে পারেনি। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। মুক্তিবাহিনী, ভারতীয় দালাল ইত্যাদি আখ্যায়িত করে প্রায় পাঁচ হাজার লোকের প্রাণ নিয়েছে। মানুষকে এরা পিটিয়ে মারত। ইট ও পাথর ছুড়ে হত্যা করত।
হাত-পা বেঁধে জ্যান্ত মানুষগুলোকে নদীতে ছুড়ে ফেলত। চোখ উঠিয়ে নিত। দাঁত ভেঙ্গে দিত। মাথা নিচু করে পা বেঁধে ঝুলিয়ে রাখত। নরপশু এই মেজর শওকত মানুষ হত্যার সময় উল্লাসে মেতে উঠত। হত্যাটি ছিল তার কাছে আনন্দদায়ক। এই ঘৃণ্য চরিত্রহীন শয়তানের একান্ত প্রিয় ছিল নারী ও সুরা। নারীদের দেখলে সে পাগলা কুকুরের ন্যায় ঝাঁপিয়ে পড়ত। সে মুক্তিবাহিনীর সহায়ক ও আওয়ামীলীগের সমর্থক বলে নিরীহ লোকদের মৃত্যুর ভয় দেখিয়ে বহু টাকা আদায় করে।
এছাড়া অগ্নিদগ্ধ দোকানপাট ও ঘরবাড়ীগুলো জঙ্গী শাহীর মেজর মাসুদের কীর্তির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। সেই হলো লুটেরাদের নায়ক। তার নির্দেশেই লুন্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশের প্রখ্যাত বাণিজ্যকেন্দ্র পুরান রাজাদের লক্ষ লক্ষ টাকার সম্পদ। ৭১- এর ৭ই এপ্রিল থেকে শুরু হয় চাঁদপুরে জল্লাদ বাহিনীর নরমেধযজ্ঞ।
সেদিন সকাল ৯টা ৪৫ মিনিটে দুইটি রঙের স্যাবর জেট চাঁদপুরবাসীকে আতংকিত করে তোলে। শুরু হয় একটানা ৪০ মিনিট গুলিবর্ষণ। নিমিষের মধ্যে আকাশ ছেয়ে যায় ধোঁয়ায়। চারদিকে ধ্বনিত হয় হতভাগ্যের আর্তচিৎকার। হতাহত হয় প্রায় ৫০০ লোক। আর তারই সাথে ছুটে চলে নিরীহ মানুষের কাফেলা গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে।
এরপরদিন সন্ধ্যায় মেজর ইফতেখারের নেতৃত্বে ৫০০ সৈন্য ও অস্ত্র বোঝাই ৭৮টি ছোট বড় সামরিক অসামরিক যান চাঁদপুরে প্রবেশ করে। কুমিল্লা থেকে চাঁদপুরে আসার পথে রাস্তার দু’ধারে তারা নির্বিবাদে গুলি চালায়। চাঁদপুরে এসে টেকনিক্যাল স্কুলে আস্তানা গাড়ে। আসার অব্যহতির পর এক বৃদ্ধা গরু নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে গরুটি ছিনিয়ে রাখে এবং বৃদ্ধাকে গুলি করে হত্যা করে। এদিকে স্বাধীনতা সংগ্রামীরা তাদের আস্তানা ঘিরে ফেলে গুলি ছুড়তে থাকে।
তখন দখলদার বাহিনী মর্টার ও কামান থেকে গোলাবর্ষণ শুরু করে। রাত্রি প্রভাতেই তারা বেড়িয়ে পড়ে রাস্তায়। পুড়িয়ে দেয় পার্শ্বস্থ গ্রামের কুড়ি-পঁচিশটি বাড়ি। এরপরই ছুটে যায় শহরের অভ্যন্তরে। কয়েকঘন্টা টহল দিয়ে এরা শহরের বিভিন্ন রাস্তায় কাউকে বেয়নেট কাউকে গুলি করে মারে। সেদিন চাঁদপুর কলেজের জনৈক ছাত্রসহ ৫ জনকে খুন করে।
১০ই এপ্রিল থেকে শুরু হয় এদের কারফিউ এর পালা। কারফিউ-এর সঠিক সময়সীমা এরা জনসাধারণের কাছ থেকে গোপন রাখত। আর এ সুযোগে তাদের স্বয়ংক্রিয় রাইফেলগুলো সক্রিয় হয়ে নিধনযজ্ঞে মেতে উঠত। সেদিনই কারা ডিনামাইট দিয়ে শহরের কয়েকটি এলাকার ঘর উড়িয়ে দেয়।
শুধু তারাই নয়- কুখ্যাত আল বদর, আল শামস, রাজাকার ও দালাল কমিটির অকথ্য নির্যাতনে অতিষ্ট হয়ে পড়ে শান্তিপ্রিয় জনসাধারণ। এরা কাউকে শান্তিতে থাকতে দেয়নি। জুলুম আর অত্যাচারই ছিল এদের প্রধান ধর্ম। এরাই অধিকাংশ সম্পদ লুন্ঠন করেছে। লুন্ঠন করেছে শহরের হিন্দু অধ্যুষিত এলাকার ঘরগুলো। দালান থেকে দরজা জানালা খুলে নিয়েছে। শুধু রেখে গেছে ভিটে মাটিটুকু।
এদের ইঙ্গিতে প্রাণ হারিয়েছে দশ হাজার নিরীহ লোক। মেঘনা তীরবর্তী চাঁদপুর রেলওয়ে ষ্টেশন এলাকা ছিল খুনিদের কসাইখানা। একবার কাউকে সেখানে নিয়ে গেলে আর কোনদিন খোঁজ পাওয়া যেত না। এ এলাকা ছিল চাঁদপুরবাসীর আতংকের স্থান। প্রয়োজনেও কেউ সেই এলাকায় যেতে সাহস পেত না।
জনৈক প্রত্যক্ষদর্শী আমাকে বলেন, ওরা নির্মমভাবে চাবুক দিয়ে পিটিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করে সিগারেটের আগুন লাগিয়ে দিত, পরে হাত-পা বেঁধে ওয়াগনের মধ্যে দু’চারদিন আবদ্ধ করে রাখত। এরপরেও যদি প্রাণ না যেত তাহলে ফেলে দিত নদীতে। এছাড়া পানিতে দাঁড় করিয়েও গুলি করা হত। এমনি সুপরিকল্পিতভাবে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে কমপক্ষে দু’হাজার লোককে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। সেইখানে হানাদার বাহিনীর এরূপ অসংখ্য বর্বরোচিত ঘটনার নীরব সাক্ষী হয়ে রয়েছে চাঁদপুর রেলওয়ে স্টেশন।