শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
জনগনের প্রতি সরকারের নির্দেশাবলী | বাংলাদেশ সরকার, প্রচার বিভাগ | সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ |
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের এক বিশেষ পর্যায়ে এসে গেছি আমরা। কার্যতঃ ভারতও আমাদের পরিপূর্ণ স্বীকৃতি দিয়ে ফেলেছে ৪ঠা ডিসেম্বরের এক বেতার প্রচারের মাধ্যমে। আকাশবাণী থেকে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের অত্যাধিক বাড়াবাড়ি পরিপ্রেক্ষিতে ভারত যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে; তবে তার কাজ হবে বাংলাদেশে বাঙালীদের উপর গত ৮ মাস ধরে অকথ্য নির্যাতনকারী নরপশু পাক-বাহিনীকে আত্মসমর্পণ করানো, তথা বাংলাদেশের সরকারের হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়া-ভারতের নিজস্ব স্বার্থে লরাই চালিয়ে যাওয়া নয়।
এ এক বিরাট সংবাদ। বুঝতে হবে আমাদের বিজয়ের সর্বশেষ পর্যায় এটাই। আর সেই জন্যেই এতদিনের সংগ্রামী বাঞালীকে এবারে যেতে হবে আরও কঠিন অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়ে। বিশ্বমানবতার শত্রু সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা একদিকে এ ক’মাস ধরে অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ দিয়ে সাহায্য করে এসেছে বর্বর ইয়াহিয়ার জঙ্গীশাহীকে এবং নেহায়েত দায়ে পড়া ভাবে ভারতে আশ্রিত এক কোটি মানুষের জন্য পাঠিয়েছে নামমাত্র সাহায্যদ্রব্য, কিন্তু একবারও বাংলার মানুষ আজ কেন বিদেশে শরণার্থী হ’ল?- এ বিষয়টি প্রতিয়াক্রে এগিয়ে আসেনি! আর যখন আমরা আমাদের চূড়ান্ত সাফল্য অর্জন করতে চলেছি, আমেরিকা এসেছে শান্তির বুলি নিয়ে। নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব উত্থাপন করেছে অবিলম্বে যেন পাক-ভারত যুদ্ধ বন্ধ হইয়ে যায়। আমাদের প্রশ্ন, এটা কি আদৌ পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধ? এ যুদ্ধ স্বাধীনতাকামী বাঙালীদের বিরুদ্ধে অত্যাচারী উপনিবেশবাদী পাকিস্তানের। কাজেই ভারতের এ থেকে সড়ে দাঁড়ানোর কোনই মানে হয় না। অবশ্য আমাদের অকৃত্রিম বন্ধু সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন আমেরিকার এ ধৃষ্টতাকে নাকচ করে দিয়েছে জাতিসংঘের দরবারে। মুনাফেক মার্কিনী দস্যু, যার হাত ভিয়েতনামী মা ও শিশুদের তাজা রক্তে ভেজা, সে চায় আজ নিরপত্তা পরিষদের মধ্যাস্থতা।
দেশবাসীগণ, আপনারা এ চক্রান্তের কখনও বিভ্রান্ত হবেন না। বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদী চক্রের তাঁবেদার ও পাঞ্জাবী ধনিকদের অস্ত্রধারী-পেয়াদা ইয়াহিয়ার জমজ আইয়ুবের সময়ে পাকিস্তান থেকে আরও একবার হামলা হয়েছিল শান্তিপ্রিয় ভারতের উপর; এবং দেশে জারী হয়েছিলো জরুরী আইন, দেশরক্ষা বিধি প্রভৃতি কালাকানুন- সবই জনসাধারণের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্যে। এবারও ইসলামের নামে সেই পুরানো ধুয়া তোলা হচ্ছে। এসব অপ্রচার থেকে সদা সতর্ক থাকুন। এ ছাড়াও রয়েছে তথাকথিত সমাজবাদী গণ-চীন। যখন গ্রাম বাংলার পথেঘাটে লক্ষ লক্ষ নিরীহ জনতা অসহায় শিকার হয়েছে পাক-দস্যুদের অত্যাচারের, তখন চীন বলেছে এটা নিতান্ত পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। সম্প্রতি সে আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের বিরুদ্ধেও প্রচারণা শুরু করেছে। কিন্তু আমরা ভুলে যাইনি ১৯৬২ সালের চীনই আকস্মিকভাবে আক্রমণ করেছিল ভারতকে; এবং মাত্র গত বছরও সে সোভিয়েত ইউনিয়নের সীমান্তে শুরু করেছিল ধ্বংসাত্মক অভিযান। অতএব চীন সম্পর্কেও সাবধান থাকুন; বস্তুতঃ সে আমেরিকারই দোসর।
জনগণের প্রতি নির্দেশাবলীঃ
১। গুজবের কান দেবেন না; গুজব রটনাকারীকে ধরিয়ে দিন।
২। মুক্তিযুদ্ধের পরিকল্পনার কথা গোপন রাখুন।
৩। পাক-বাহিনীর গতিবিধির খবর মুক্তিবাহিনীকে জানিয়ে দিন।
৪। শত্রুর সরবরাহ সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত করে দিন।
৫। বিমান আক্রমণের সময় নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিন।
৬। মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বতোভাবে সাহায্য করুন।
-মনে রাখবেন, শত্রুর প্রতিটি বুলেট আপনার পয়সার কেনা। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধে ব্যয়িত আপনার প্রতিটি পয়সা স্বাধীনতাকে এগয়ে নিয়ে আসছে।