ঢাকার পিলখানার কথা
সাক্ষাৎকারঃ মেজর দেলোয়ার হোসেন
১৯ নভেম্বর ১৯৭৩
মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহের দিকে ২২ জন বেলুচকে পিলখানাতে আনা হয়েছিলো। তাদেরকে এখানে থাকার জায়গা দেয়া হয়েছিলো। এবং পিলখানার ইপিআর’এর সাথে ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় ইন্টারনাল সিকিউরিটি ডিউটি করার জন্য ভার দেয়া হয়েছিলো। ওরা এখানে আসাতে ইপিআরদের মাঝে সন্দেহ অবিশ্বাস আরো ঘনীভূত হয়। ওরা এখানে আসাতে আমরা বুঝতে পারলাম যে হয়তো কিছু একটা ঘটতে পারে। ক্যাপ্টেন গিয়াসের সাথেও আমার এ ব্যাপারে কথাবার্তা হয়েছিলো।
২৫ মার্চ বেলা একটার সময় মেজর জামিল (পশ্চিম পাকিস্তানী, জেনারেল স্টাফ অফিসার- ইপিআর হেড কোয়ার্টার) আমাকে তার অফিসে ডেকে পাঠান। তিন ঘন্টা পর্যন্ত আমি তার অফিসে বসে অফিশিয়াল কথাবার্তা বলেছি। তারপর তিনি আমাকে বলেন যে, তোমাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রহরী এসে আমাকে নিয়ে যায়।
রাত আনুমানিক ১২টার দিকে চারিদিকে গোলাগুলি শুরু হয়ে যায়। আমি অনুমান করেছি যে, ২২ বেলুচ বাঙালি ইপিআরদের উপর আক্রমণ করেছে। আমাকে যে ঘরে বন্দী করে রাখা হয়েছিলো সেদিকেও গুলি এসে পড়ছিলো। রাত তিন চারটার দিকে গোলাগুলি একটু কমে যায়। আমাদের যে সমস্ত বাঙালি ইপিআর পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলো তারা নিরাপদ জায়গায় গিয়ে গুলি ছুঁড়ছিলো। জানালা দিয়ে দেখতে পেলাম তারা অনেককে বন্দী করে নিয়ে যাচ্ছে। ২৬ মার্চেও ঠুসঠাস গুলির শব্দ শুনতে পেলাম।
২৭ মার্চ সকালে ক্যাপ্টেন আরেফ (পাঞ্জাবী) যে এই হেড কোয়ার্টারে কাজ করতো সে আমাকে এসে বললো, “ইউ আর এ গাদ্দার, ইউর আংকেল ক্যাপ্টেন রফিক ইজ অলসো এ গাদ্দার। উই আর গোইং শুট ইউ আউট বোথ।”
১৭ এপ্রিল পর্যন্ত আমাকে এখানে বন্দী অবস্থায় রাখা হয়। বন্দী অবস্থায় আমাকে অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিলো। কিন্তু কোনো নির্যাতন চালানো হয় নি। পরে আমাকে পাকিস্তান পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ঐ রাতে বহু বাঙালি ইপিআরকে হত্যা করা হয়। বন্দী অবস্থায়ও অনেককে হত্যা করা হয়।
মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহে পিলখানার বাঙালি ইপিআর’রা বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেছিলো প্যারেড গ্রাউন্ডের মাঝখানে দণ্ডায়মান বটবৃক্ষের শীর্ষে। বাংলাদেশ সেনানিবাস সমূহের মধ্যে প্রথম জাতীয় পতাকা পিলখানাতেই উত্তোলিত হয়েছিলো। ল্যান্স নায়েক বাশার এ পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। পরে তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। পিলখানায় অবস্থিত প্রায় ২৫০০ বাঙালি সৈন্যের মধ্যে মাত্র ৬ শতাধিক সৈন্য রাতের অন্ধকারে পালাতে সক্ষম হয়েছিলো। বাকি সবাই বন্দী হয় আর তাদের পাঠানো হয় নৃশংস অত্যাচার ও হত্যার বধ্যভুমি মোহাম্মদপুর বন্দী শিবিরে। পরবর্তীকালে জিসিও/এসসিও এবং সুশিক্ষিত প্রায় ৭ শতাধিক বাঙালি সৈনিককে হত্যা করা হয়েছিলো বুলেট ও বেয়নটের নির্মম আঘাতে। ঐ রাতে যারা পালাতে পেরেছিলো তাদের অনেকে স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দিয়েছিলো। তারা প্রতি এলাকায় অমিতবিক্রমে সম্মুখযুদ্ধে পর্যুদস্ত করেছিলো পাকিস্তানীদের।
বাংলাদেশের দীর্ঘ নয় মাসে এই বাহিনীর ১ হাজারের মতো সদস্য স্বাধীনতার জন্য নিজেদের মূল্যবান জীবন উৎসর্গ করেছিলো। অনেকে পঙ্গু অবস্থায় দিন যাপন করছে।
স্বাক্ষরঃ দেলোয়ার হোসেন
১৯-১১-৭৩