শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১। ঢাকায় বিদ্রোহ দমনে কামান ব্যাবহার | নিউইয়র্ক টাইমস | ২৮ মার্চ ১৯৭১ |
<১৪, ১, ১–৩>
নিউইয়র্ক টাইমস- ২৮ মার্চ ১৯৭১
ঢাকায় বেসামরিক লোকের উপর গুলি
– সিডনি এইচ শ্যানবার্গ
জনাব শ্যানবার্গ ছিলেন সেই ৩৫ জন বিদেশী সাংবাদিকদের একজন যাকে পূর্ব পাকিস্তান থেকে শনিবার সকালে বহিষ্কার করা হয়। তিনি এই তারবার্তা ভারতের বোম্বে থেকে পাঠিয়েছেন।
পাকিস্তান আর্মি পূর্ব পাকিস্তানের নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিকদের উপর আর্টিলারি এবং ভারী মেশিনগান ব্যাবহার করে ৭৫ মিলিয়ন মানুষের স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন ধ্বংস করার চেষ্টা করছে।
হামলা কোন সতর্কবাণী ছাড়াই বৃহস্পতিবার গভীর রাতে শুরু হয়। পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা, যাদের সেনাবাহিনীতে প্রাধান্য ছিল, প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকার রাস্তায় নামে। স্বাধীনতা আন্দোলনের আস্তানাগুলো – যেমন বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করা ছিল তাদের উদ্যেশ্য।
কতজন বেসামরিক লোক নিহত বা আহত হয়েছে তা জানার কোন উপায়ও ছিল না। অন্যান্য এলাকায় কি ঘটছে সেটা জানারও উপায় ছিলোনা। যদিও ঢাকা আক্রমণের আগের কিছু সঙ্ঘর্ষের খবর আমরা জানি।
উত্তর ঢাকায় অবস্থিত হোটেল থেকে অনেক অঞ্চলের বিশাল আগুন দেখা যাচ্ছিল। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা এবং পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের ব্যারাক দেখা যাচ্ছিল। পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস একটি আধা-সামরিক বাহিনী যেখানে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের আধিক্য ছিল।
সকালে যখন ৩৫ জন সাংবাদিককে ঢাকা থেকে বের করে দেয়া হচ্ছিল তখনো অনেক জায়গায় আগুন জ্বলছিল এবং গুলির শব্দ আসছিল।
“হে ঈশ্বর, দে ঈশ্বর বলে একজন পাকিস্তানি ছাত্র চিৎকার করছিল – সে হোটেলের জানালা দিয়ে দৃশ্য দেখছিল আর অশ্রুসজল চোখে বলছিল, ‘ওরা তাদের মেরে ফেলছে, তাদের জবাই করছে।’
ঘরে আগুন
সামরিক ট্রাকের সুরক্ষিত বহরে এয়ারপোর্টে যেতে যেতে সাংবাদিকরা দেখতে পাচ্ছিল রাস্তার দুই পাশের দরিদ্র বাঙালিদের খড়ের ছাদে সৈন্যরা আগুন দিচ্ছিল কারণ তারা ছিল স্বাধীনতাকামী।
যখন বৃহস্পতিবার রাতে সামরিক একশন শুরু হল তখন সৈন্যরা বিজয় স্লোগান দিচ্ছিল। তারা স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, মেশিনগান ও গুলি ছুড়ে ঢাকার বহু অংশে আগুন দেয়।
যখন বিদেশী সাংবাদিকদরা পরিস্থিতি দেখার জন্য হোটেলের বাইরে যেতে চেয়েছে তখন সেনাবাহিনীর প্রহরীরা তাদের যেতে দেয়নি এবং বলেছে বের হলে তাদের গুলি করা হবে।
রাত ১টা ২৫ মিনিটে হোটেলের ফোন লাইন বিকল হয়ে যায়। হোটেলের বাইরের মিলিটারি গার্ড এটা বন্ধ করে দেয়। একই সময়ে টেলিগ্রাফ অফিসের আলো নিভে যায়।
বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এবং অন্যান্য এলাকায় ভারী স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের শব্দ শোনা যায়।
বাজারে হামলা
রাত ২ টা ১৫ মিনিটে একটি মাউন্টেড মেশিন গান সহ একটি জীপ্ হোটেলের সামনে দিয়ে ময়মনসিংহ রোডের দিকে যায় এবং পাশে একটি বাজারের সামনে থামে। বন্দুক দ্বিতীয় তলায় জানালার দিকে তাক করা ছিল। প্রায় এক ডজন সেনা রকেট পিস সহ তাদের সাথে যোগ দেয়।
দ্বিতীয় তলা থেকে হঠাৎ শব্দ আসে “বাঙালিরা ঐক্যবদ্ধ!” এবং সৈন্যরা তখন মেশিনগান দিয়ে নির্বিচারে ভবনের দিকে এলোমেলো গুলি চালায়। সৈন্যরা তখন একটি সরু গলি দিয়ে বাজারের মধ্যে প্রবেশ করে গুলি চালায় এবং সরু গলি গাড়ি দিয়ে ব্লক করে। সৈন্যদের ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় সাংবাদিকরা ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের ১০ তলা থেকে এসব অবিশ্বাস্য ঘটনা দেখছিল।
সৈন্যরা গুলি শুরুর সাথে সাথে ২০০ গজ দূর থেকে প্রায় ১৫-২০ জন্য বাঙ্গালী যুবক রাস্তা দিয়ে তাদের দিকে আসতে থাকে – তারা চিৎকার করে সৈন্যদের দিকে আসছি
কিন্তু মনে হল তাদের হাতে কোন অস্ত্রই নেই।
জীপের উপর মেশিনগান থেকে তাদের দিকে প্রায় গুলিবর্ষণ শুরু হল এবং স্বয়ংক্রিয় রাইফেল দিয়ে সৈন্যরাও গুলি শুরু করল। যুবকের দল রাস্তার দুই পাশে ঢুকে পড়ল। তাদের কেউ আহত বা নিহত হয়েছে কিনা সেটা বলা অসম্ভব ছিল।
সৈন্যরা তখন তাদের মনোযোগ সরু গলির দিকে দিল। এরপর তারা একটি খুচরা যন্ত্রাংশের গ্যারেজে আগুন দিল এবং তারপর তাদের মূল টার্গেট – বিশেষ করে অফিস ও প্রেস, ইংরেজি দৈনিক – ইত্যাদি যারা মূলত শেখ মুজিবের সমর্থক ছিল সেগুলো ধ্বংস করতে শুরু করল।
উর্দুতে তারা চিৎকার করে বলছিল যেন তারা ঘর থেকে বাইরে এসে আত্মসমর্পন করে – অন্যথায় তাদের গুলি করা হবে। কিন্তু কোন শব্দ আসল না এবং কেউ বেরিয়ে আসল না। সৈন্যরা তখন ভেতরে একটি রকেট নিক্ষেপ করল এবং গুলি শুরু করল। তারপর তারা বিল্ডিংএ আগুন দিল এবং প্রেস ও অন্যান্য যন্ত্র ধ্বংস করল।
আরও এগিয়ে তারা সব দোকানপাট ও কুঁড়েঘরগুলোতে আগুন দিল এবং শীঘ্রই আগুণের শিখা দোতলার উপরে উঠে গেল।
৪ টার পর পর চিৎকার কিছুটা কম্বল, কিন্তু মাঝে মাঝে কামানের গুলি শোনা যেতে লাগল। দূর থেকে ট্রেচার বুলেট হোটেলের দিয়ে ছুটে আসল।
৪ টা ৪৫ মিনিটে আরেকটি বড় আগুন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস সদর দপ্তরে দেখা গেল।
৫ টা ৪৫ মিনিটে ভোরের অস্পষ্ট আলোয় দেখা গেল ছয়টি চীনের তৈরি টি-৫১ হালকা ট্যাংকে চড়ে সেনারা শহরের প্রধান রাস্তায় টহল দিচ্ছে।
সবিরাম অগ্নিসংযোগ এবং অনিয়মিত কামানের গোলা বিস্ফোরণ গতকাল থেকে আজ সাংবাদিকদের বহিষ্কার করার সময় পর্যন্ত অব্যাহত আছে।
গতকাল সকাল থেকে হেলিকপ্টার পরিদর্শন করছে এবং রেকি করছে। গত নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের সময় ত্রাণ কাজের জন্য সৌদি আরব পাকিস্তানকে ৪ টি হেলিকপ্টার দিয়েছিল। জানা যায় সেগুলো এই কাজে ব্যাবহ্রিত হচ্ছে।
পশ্চিম পাকিস্তানে ইয়াহিয়া
সকাল ৭ টায় সেনাবাহিনীর দখল করা ঢাকা রেডিওতে ঘোষণা করা হয় যে প্রেসিডেন্ট আগা মুহাম্মদ ইয়াহিয়া খান পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে এসেছেন এবং আজ রাত ৮ টার দিকে জাতির উদ্যেশ্যে ভাষণ দেবেন।
সকাল ৮ টার পর একটি কালো Chevrশেভ্রতlet 1959 জীপ এক ট্রাক সশস্ত্র সৈন্য পাহারায় হোটেলের সামনে থামে। এই বহর জুলফিকার আলী ভুট্টো ও তার দলকে এয়ারপোর্টে নিয়ে যেতে এসেছে। তারা পশ্চিম পাকিস্তান ফিরবে।
জনাব ভুট্টো পশ্চিম পাকিস্তানের প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা যিনি পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের জন্য শেখ মুজিবের দাবীর বিরোধিতা করেন।
তার বিরোধীদল পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনী সমর্থিত এবং তার পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যবসাও সেনা সমর্থিত। জনাব ভুট্টো অবগত আছেন যে বাঙালিরা তাদের বর্তমান সমস্যার জন্য তাকে দোষ দেয়। তথাপি তাকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র সহ বেসামরিক ও সেনাবাহিনীর দেহরক্ষী গার্ড দিচ্ছে। তিনি ভীত হয়ে সব সাংবাদিকদের প্রশ্নের একই জবাব দিচ্ছেন, বলছেন “আমি কোন মন্তব্য করতে রাজি নই।’
সকাল ১০ টায় রেডিও নতুন সামরিক আদেশ ঘোষণা করে।
হোটেলে সাংবাদিকরা কোন তথ্য জিজ্ঞেস করলে প্রত্যেকবার তাদের প্রত্যাখাত করা হয়। সকল কূটনৈতিক মিশন প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। এক পর্যায়ে একজন ক্যাপ্টেন সাংবাদিকদের একটি গ্রুপ যখন তার সাথে কথা বলতে সামনের দরজা দিয়ে আসছিল, তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে গেলেন। তিনি তাঁদের ভবনে প্রবেশ করতে বললেন এবং দেশে ফিরে যেতে বললেন। তিনি চিৎকার করে বললেন, “আমি তোমাদের হ্যান্ডেল করতে পারি, আমি যদি আমার নিজের লোকদের হত্যা করতে পারি তাহলে তোমাদেরও পারি।’
ক্রাইসিস নিয়ন্ত্রন
এর অল্প কিছুক্ষণ পরে, সামরিক সরকার হোটেলে খবর পাঠালেন যে বিদেশী সাংবাদিকদের সন্ধ্যা সোয়া ৬ টার মধ্যে হোটেল ছেড়ে যেতে প্রস্তুত হতে হবে। সাংবাদিকরা তাদের জিনিসপত্র গোছাতে গোছাতে এবং বিল পরিশোধ করতে করতে রাত ৮ টা ২০ মিনিট বেজে গেল। তখন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ভাষণ শেষ হবার পরপর সৈন্য ভর্তি ৫ টি ট্রাক সামনে- পেছনে পাহারা দিয়ে সাংবাদিকদের এয়ারপোর্ট নিয়ে গেল।
ছাড়ার আগে আগে, ইনচার্জ লে কর্নেলকে একজন সংবাদকর্মী জিজ্ঞেস করলেন কেন বিদেশী সাংবাদিকদের বের করে দেয়া হচ্ছে? তিনি বলেন, “আমরা তোমাদের ছেড়ে যেতে বলছি কারণ এখানে থাকাটা তোমাদের জন্য খুবই বিপজ্জনক হবে।” “খুবই রক্তাক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হবে।” হোটেলের সকল কর্মচারী ও অন্যান্য বিদেশীরা বিশ্বাস করত যে, সাংবাদিকরা চলে যাবার পর হত্যাকাণ্ড শুরু হবে।
“এটা আর হোটেল থাকছে না – এটা হতে যাচ্ছে একটি রক্তাক্ত হাসপাতাল।’ – একজন হোটেল কর্মি জানালেন।
বিমানবন্দরে অবস্থানকালে যেখা যাচ্ছিল যে দূরে অগ্নিসংযোগ চলছে। সাংবাদিকদের এর জিনিসপত্র কঠোরভাবে চেক করা হয় এবং কিছু ভিডিও ফিল্ম, বিশেষ করে ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন এর ফিল্ম বাজেয়াপ্ত করা হয়।