দেশবাসী সমীপে নিবেদন
১৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
বাংলাদেশবাসী ভাই-বোনেরা,
কী বুকফাটা আহাজারী আর কান্নার দরিয়া সাঁতরে সাঁতরে আমাদের দিন কাটছে, তা ইসলামাবাদের দুৰ্বত্তেরা না জানলেও, পৃথিবীর মানুষ জানে। অনেকেই আজ একে অপরের কাছ থেকে ছিটকে পড়েছে। লক্ষ মানুষ ছিটকে পড়েছে দিগ্বিদিক-স্বদেশহারা, গৃহহীন, আত্মীয়স্বজনহারা। একদিন যার কাছে ছিল, আজ নেই।
শুধু মানুষ নয়, আমাদের অতি মেহনতে-গড়া শহর- সবুজের ভাঁড়ার ঘর আমাদের গ্রাম-যেখানে ছোটখাট সুখ-দুঃখ নিয়ে হাসিকান্নায় দিন কাটত- পরম শান্তির নিবাস আমাদের বহু গ্রামও ধ্বংস হয়ে গেছে। আগুনে আওয়াজ মানুষের গোঙানি- রমণীর আর্তনাদ। বেঁচে যাওয়াটা এদেশে দৈবী ব্যাপার। ছোট ছেলেমেয়ে, এমন দৈবীভাবেই যারা বেঁচে গেছে, আজ তাদের মুখে স্বাভাবিক হাসি নেই। কান্না ভুলে স্তব্ধ হয়ে গেছে। শুধু ফ্যালফ্যাল চেয়ে আছে সেই রাস্তার দিকে যে-পথে ঘরবাড়ি তছনছ করার পর বুটপরা খাকী লেবাস জানোয়ারেরা কুচকাওয়াজ করে যাচ্ছে। এরা কেউ বাংলার বাসিন্দা নয়। বাংলাদেশের দুঃখ-আনন্দের শরীক তারা কী করে হবে? লুটতরাজের মালে পকেট বোঝাই এইসব জানোয়ারদের কাছে কিন্তু আমাদের পরীক্ষা দিতে হয়েছে।
কিসের পরীক্ষা? তা আপনাদের জানা। অনেককে ব্যক্তিগতভাবে এই মসিবৎ পার হতে হয়েছে। পরীক্ষাআমরা বাঙালীরা মুসলমান কি না। তাই চার-কলেমা পড়তে হয়েছে উদ্যত সঙ্গীন বা রাইফেলের মুখে। অদৃষ্টের কী নির্মম পরিহাস! যে বাঙালীর তাগদ ও তাগিদের জোরে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যে বাঙালী নিজ প্রদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশের মুসলমানদের প্রতি প্রীতি-পরবশ পাকিস্তান চেয়েছিল, যে বাঙালী শাসনতন্ত্র পরিষদে লিয়াকত আলি প্রমুখ অবাঙালীদের বাংলাদেশ থেকে নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ দিয়েছিল, নেহয়েৎ বাঙালীসুলভ উদারতায় এবং নিজে সংখ্যালঘিষ্ঠ বা মাইনরিটি হয়েছিল শাসনতন্ত্র পরিষদে- সেই বাঙালীকে পরীক্ষা দিতে হয়েছে ও হচ্ছেঃ সে মুসলমান কি না। অদৃষ্টের পরিহাস বটে!
পরীক্ষা দিতে হচ্ছে বা হয়েছে কার কাছে? যে পাঞ্জাবী সৈন্য লুটতরাজ করে, নিরীহ নিরস্ত্রকে হত্যা-খুন করে, জুলুমের চাকা নির্দয় চালিয়ে যায়, বোনকে ভাইয়ের সামনে বলাৎকার করে- এমন জন্তুর কাছে। পশু ইসলামের ফর্মাবরদার। আর আমি আমার ভালমানুষিয়ানা এবং উদারতা নিয়ে মুসলমান নই। অদৃষ্টের পরিহাস বটে।
ভাইবোনেরা আমার, আমাদের ভালুমানুষিয়ানার দাম দিচ্ছি। বড় চড়া দাম। রক্ত অশ্র অসহ্য মানসিক যন্ত্রণা প্রাণের বিনিময়ে- বড় চড়া দাম। অথচ বাংলাদেশের পাটচাষী তার ফসলের দাম পায় না। রোদেবৃষ্টিতে অমানুষিক পরিশ্রমের পর তাদের আবাস জীর্ণ কুঁড়েঘর। ভরপেটে দু’বেলা অন্ন তাদের কাছে স্বপ্ন। ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যতের কথা তারা ভাবে না, যেহেতু কুলকিনারা অসম্ভব। সেই পাটে আদমজী ইস্পাহানীরা শুধু ধুনকুবের হয় না, ঐ ফসলজাত বৈদেশিক মুদ্রায় কেনা অস্ত্রে সজ্জিত হয় পাঞ্জাবী সেনাবাহিনী। সেই অস্ত্র আজ আমাদের বুকে বিধছে। ভালমানুষিয়ানার দাম এইভাবে দিতে হয় কি না? কেউ কোথায় দিয়েছে?
পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী আমাদের ভালমানুষিয়ানা ও সরলতার সুযোগ নিয়েছিল। আজও তার কামাই নেই। পূর্বে আমাদের তারা বাঙালী হতে দেয়নি। মুসলমান বানানোর চেষ্টা নিয়েছে। এর উপর ফিরিস্তি আজ দেয়া সম্ভব নয়। আপনারা জানেন। মিসর, ইরান, তুরানে মুসলমান থাকতে পারে- মিশরী ইরানী তুরানী হয়েও। কিন্তু আপনি আমি বাঙালী হলে আর মুসলমন থাকতে পারি না। শোষণের চাকা সদা সচল রাখতে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী ও তাদের তাঁবেদার কিছু দেশী দালাল সব সময় এই দাগাবাজির আশ্রয় নিয়েছে। এমন কি আমাদের প্রতি কটাক্ষ করতে জিন্না সাহেবের পর্যন্ত এতটুকু বাধেনি।
ওদরে জারিজুরি ধরা পড়ে গেছে। তাই তো হাতে অস্ত্র তুলে নিতে বাধ্য হয়েছি। কিন্তু মাদারীর পুরাতন খেল চালু করতে ওদের কসুর নেই।
পঁচিশে মার্চের রাত থেকে নেকড়ের মত যখন বাংলদেশের নিরীহ-নিরস্ত্রের উপর পোষা জন্তুরা ঝাঁপিয়ে পড়লো তখন তারা জাতিধর্ম নির্বিশেষে বাঞালী হত্যা করতে লাগলো। মনে রাখবেন, এই হত্যা খুচরো
নয়। পাইকারী। কতলে আম! ধর্ম ছাড়া আরও হাজার রকম মানবিকতার মিল বাংলার হিন্দু-মুসলমানেরা মধ্যে বর্ণের দিক থেকে এক দেখতে একই রকম। পচিশে মার্চ থেকে নামটা উচ্চারণ করতে ঘৃণা হয়, টিক্কা খান ও অনুচরেরা বাঙালী ধ্বংস করতে নামল। এক মাস পরে যখন নিজেদের কৃতকর্মের চেহারা ওরা দেখতে পেল, তখন আবার সেই পুরাতন ফন্দি-সাম্প্রদায়িকতায় ফিরে গেল। প্রথম কিস্তি, হিন্দু মুসলমানকে নির্যাতন করছে, তাদের ঘরে আগুন দিয়েছে। কিন্তু শয়তানের জন্মগত খাসলৎ অভ্যাস কি সহজে যায়? জনসাধারণের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির ফন্দি পুনরায় চালু হলো। এবার বেছে বেছে হিন্দু হত্যা, হিন্দুর গৃহদাহ ওরা শুরু করল। তাই বলে কেউ মনে করবেন না, মুসলমানদের তখন টিক্কা খান ভগ্নিপতির আদরে আপ্যায়িত করছিল। হিন্দুর ক্ষেত্রে প্রকাশ্যে, মুসলমানের ক্ষেত্রে অপ্রকাশ্যে। তফাৎ এতটুকু। বাঙালী ধ্বংসের পরিকল্পনা থেকে পাঞ্চাবী মুসলমান (হায় মুসলমানদের নামধারী!) সেনারা এতটুকু নড়েনি। কৌশল বদলেছিল, নীতি যথারীতি অব্যাহত । এইভাবে মুসলমানদের কাছে গোঁসাই ঠাকুর সাজার ফন্দি। নিজেদের অপরাধের বোঝা হাল্কা করার অপচেষ্টা ওরা নিয়েছিল। এইভাবে আমার মৃত সাম্প্রদায়িকতাকে খুঁচিয়ে তোলার চেষ্টা চলে।
কিছুটা সফল হলো বৈকি পাঞ্জাবাগত এই হানাদারের দল নেজামে ইমাম ইসলাম, জামাতে ইসলামীর ধর্মান্ধ পশুর দল যারা এতদিন গণঅভ্যুত্থানের সামনে কেচোর মত মাটিতে মিশেছিল, তারা তাদের মিলিটারী আব্বাজানের ডাকে এবং উৎসাহে কেউটের মত তৎপর হয়ে উঠল। নেজামে ইসলাম, জামাতে ইসলামীর গুণ্ডারা বাঙালী নয়। পাঞ্জাবী মিলিটারীরা সত্যি ওদের বাবা ও বাপজান। নচেত বাংলাদেশের মাটিতে জন্মে, বাংলার মা-বোনের বেইজ্জতি দেখেও ওরা কীভাবে মিলিটারীর সঙ্গে হাত মিলায়? যারা দেশকে বিদেশীর হাতে বিকিয়ে দিতে পারে, তারা মা-বোনকেও বিদেশীর হাতে বিকিয়ে দিতে সক্ষম। বাংলাদেশের যুদ্ধে বুদ্ধিজীবী, কবি, লেখক-আশা করি এই কথাটা স্মরণ রাখবেন।
কিন্তু সকলেই তো নেজামে ইসলাম ও জামাতে ইসলামীর অনুচর নয়। সাড়ে সাত কোটির মানবজননী বাংলাদেশের কি সাচ্চা সন্তান নেই, জন্মভূমির অপমান যাদের বুকে যন্ত্রণার ঝড় তোলে; দেশের চাষীমজুর ও অন্যান্য সকলের দুঃখ-কষ্ট যাদের বিচলিত করে। তারা এগিয়ে এসেছে বৈকি। শুধু এগিয়ে আসেনি অন্যায়ের নিজেদের ভবিষ্যতের কথা ভাবেননি। ইষ্ট পাকিস্তান রাইফেল, পুলিশ ভায়েদের গৃহসুখ , স্নেহমমতা ঘরে আটকে রাখতে পারেনি। জন্মভূমি প্রেমের বেদীতে সবকিছু বিসর্জন দিয়েছেন। আর আছে আমাদের দেশের তরুণেরা-যাদের অধিকাংশ স্কুল-কলেজের ছেলে। নিজেদের সকল সাধ-আরাম-আয়েস হারাম ভেবে যারা সৈনিকজীবনের কঠিন ব্রত গ্রহণ করেছে। হিন্দু-মুসলমান এখানে এক-কাতার। যে বিভেদ মারফৎ বাংলাদেশকে পশ্চিম পাকিস্তানের কায়েমী স্বাৰ্থ বছরের পর বছর শোষণ করেছে, তা মুছে দিয়ে এক-কাতারে দাঁড়িয়েছে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্ৰীষ্টান। নতুন বাংলাদেশ জন্ম নিয়েছে। নতুন আদর্শের প্রদীপ জ্বালিয়েছে আমাদের মুক্তিবাহিনী। সেই প্রদীপের শিখা-রোশনাই অনির্বাণ রাখার দায়িত্ব আমাদের, আমার যারা ঠিক লড়াইয়ের ময়দানে নেই, তারাও জন্মভূমির মুক্তিসংগ্রামে শরীক মনে রাখবেন, এই লড়াই সর্বাত্মক লড়াইয়ের পর্যায়ে পড়ে। আজ আমরা প্রত্যেকেরই সৈনক- হাতে হাতিয়ার থাক বা না থাক। পশ্চিম পাকিস্তানে তৈরি সামগ্রী যে কেনেনা সেও লড়াইয়ের ময়দানে আছে বৈকি। শত্রুক সেও ঘায়েল করছে। আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব আছে। যে পাটচাষী পাট চাষ করে না, ধান চাষ করে সেও লড়াইয়ে শরীক কোন সভ্য দেশে নজীর নেই, দুশমনেরা আমাদের প্রতিটি বাজারে চাল-ডাল ধ্বংস করে দিয়েছে, যেন আমাদের অন্ন না জোটে এবং দুর্ভিক্ষ আমাদের মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়- যার ফলে গোলামি আমরা শেষ পর্যন্ত মেনে নেব। এই চালেঞ্জ-তালু-ঠুকা-স্পর্ধার মোকাবিলা করছে সেই চাষী যে প্রচুর পরিমাণ ফসল ফলানোর চেষ্টায় কোমল বেঁধেছে এবং বৈদেশিক মুদ্রা যাতে শত্রু না পায় তার জন্যে সতর্ক-সে পাট করছে না। এই কৃষক কোন সৈনিকের চেয়ে কম নয় যদিও স্রেফ কাস্তেধারী, অস্ত্রধারী নয়। এমনিভাবে জন্মভূমির স্বাধীনতার লড়াইয়ে আমরা সকলেই শরীক হতে পারি।
আমরা লড়ব বৈকি। যতদিন একটি হানাদার সেনা (আশ্চর্য, এগুলো আবার ধর্মে মুসলমান) আমাদের জন্মভূমির মাটির উপর থাকবে ততদিন আমাদের সংগ্রামের বিরতি নেই। বৃটিশের শিকল ছিড়ে আমরা গোলামির নতুন জিঞ্জির পরেছিলাম- এতদিন পশ্চিমের শাসকগোষ্ঠী যাকে ইসলামী জেওর বা অলঙ্কার বলে জাহির করেছে। সেই জিঞ্জির ছিন্ন না হওয়া পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম চলবেই চলবে। আমার আর ধোঁকাবাজির শিকার হবো না।
আমরা স্বাধীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ব- যেখানে শোষণ চিরতরে নির্বাসিত- যেখানে প্রতিটি মানুষ নিজের মেহনতের দাম পায় যথাযথ মর্যাদায়- যেখানে জাগতিক অসহায়ত কারো মনুষ্যত্বের বিকাশ-পথে বাধা নয়। আমরা গড়বো সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পমুক্ত শ্ৰেয়বোধ প্রিয়বোধে দীপ্ত খাড়া শিরদাড়া নাগরিকের কলকণ্ঠস্কৃত নতুন বাংলাদেশ। জয় বাংলা ।
(শওকত ওসমান রচিত)