শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
২০/ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত ইংরেজি অনুষ্ঠান : নিউজ কমেন্টারি | স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দলিল পত্র | জুন-সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ |
নিউজ কমেন্টারি
[ অনুবাদকের ভাষ্য: পূর্ব পৃষ্ঠা থেকে]
হিংস্র, ধর্মান্ধ, ফ্যাসিবাদী ও সামন্তবাদী সামরিকজান্তার অঘোষিত অনৈতিক যুদ্ধ আঘাত করেছে সমগ্র জাতিকে। আমাদের স্বাধীনতার জন্য আমরা সর্বাধিক মূল্য দিয়েছি। এখন আমরা উপলব্ধি করেছি, আমাদের টিকে থাকার একমাত্র শর্ত সম্পূর্ণ স্বাধীনতা, এর চেয়ে কম কিছু নয়। এবং আমরা স্বাধীনতা অর্জন করবই – নিজ শক্তিতেই অর্জন করব। আমরা বৃহৎ শক্তির কাছে সাহায্যও চাই না, অস্ত্রও চাই না। এই নরঘাতকরা যাতে অর্থ এবং অস্ত্র সাহায্য না পায়, আমরা শুধু এটুকু চাই। ইতিহাস এদের ক্ষমা করবে না।
২১ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
প্রায় দশ দিন চুপ করে থাকার পর পাকিস্তানি বেতার শেখ মুজিবুর রহমানের প্রহসনমূলক বিচার বিষয়ে আরও একটি নির্লজ্জ্ব মিথ্যা বক্তব্য প্রদান করেছে। গতকাল প্রচারিত সংবাদে দাবি করা হয়েছে যে, শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁর বিচার করার এখতিয়ারবিহীন আদালতে যিনি এর আগে আত্মপক্ষ সমর্থনে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন বলে এক সূত্রে প্রকাশ করা হয়েছিল, সেই একই সূত্রে প্রকাশ পেয়েছে যে তিনি তাঁর মামলায় লড়ার জন্য তিনজন আইনজীবীর একটি প্যানেল দাবি করেছেন। রেডিওতে আরও দাবি করা হয়েছে যে, শেখ সাহেবের কথিত পছন্দের তিনজন আইনজীবীর একজন এ কে ব্রহী তাঁর (রেডিওতে দাবিকৃত) পূর্বের অঙ্গীকারবদ্ধ মামলাগুলোর ব্রিফিং নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। রেডিও অসচেতনভাবে অন্য দু’জন আইনজীবীর নাম উল্লেখ করতে ভুলে গেছে। নাকি সেটা সচেতনভাবেই করা হয়েছে?
এ সংবাদটি, পাকিস্তানি সামরিকজান্তার পক্ষ থেকে যেটি বাংলাদেশে গণহত্যার অপরাধের বিষয়ে প্রদত্ত লিখিত বিবৃতির পরের জঘন্যতম মিথ্যাচার, এ প্রহসনমূলক বিচারে বিক্ষুব্ধ বিশ্ববাসীর মতামতকে ধোঁকা দেয়ার ষড়যন্ত্রের প্রয়োজনেই তৈরি করা হয়েছে। পূর্বে প্রকাশিত ‘মিথ্যা’, অর্থাৎ শেখ সাহেব আত্মপক্ষ সমর্থন করবেন না, এটিকে সামাল দেয়ার জন্য সর্বশেষ মিথ্যাচারটি তৈরি করা হয়েছে। আমাদের নেতা এ ধরণের বিচারের প্রস্তাবনার মুখোমুখি হলে কীরকম আচরণ করবেন সে সম্পর্কে আমরা যথেষ্ট অবগত। সামরিকজান্তার কেউ এটা জেনেশুনেই সারা বিশ্বকে এভাবে বোঝাতে চাচ্ছে যে শেখ সাহেব আসলে জীবিত আছেন, তিনি সচরাচর যেভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতেন তেমনটি করানোর জন্য তাঁকে বন্দি করে রাখা অমানুষদেরকে অত্যাচারের আশ্রয় নিতে হয় নি।
কিন্তু জান্তারা একটা ভুল করে ফেলে। বার্তাটি প্রচারিত হবার পর সারা বিশ্বের সন্দেহের সম্মুখীন হয়েছে এটি। এমনটিও সন্দেহ করা হয়েছে যে শেখ সাহেবকে সম্ভবত মেরে ফেলা হয়েছে, এখন তাঁর এ অস্বীকৃতি জানানোর খবরটি রটানো হয়েছে পুরো ব্যাপারটিকে সামরিক আবহ দেয়ার জন্য। এরকম সন্দেহ খুব সম্ভবত সেনাবাহিনীতে কর্মরত পেশাদার মিথ্যাবাদীদেরকে গতিপথ পাল্টাতে বাধ্য করেছে। তারা খুব শীঘ্রই শেখ মুজিবের মামলায় লড়ার সিদ্ধান্তের গল্প ফেঁদে বসে।
ব্রোহীর শেখ মুজিবের পক্ষে লড়তে অস্বীকৃতি জানানোর খবরটিও বেশ বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়। ব্রোহী, অথবা এ ক্ষেত্রে যে কারও জন্য দশ হাতের প্রয়োজন পড়বে শেখ মুজিবের মামলার ব্রিফ নেয়ার জন্য। কারণ তিনি আসামী পক্ষে উপদেষ্টার দায়িত্ব পালনে পেশাগত সততা দেখাতে গিয়ে প্রায় নিশ্চিতভাবেই বিশাল বিপদে পড়বেন। এমনকি রহস্যজনক মৃত্যুর শিকারও হতে পারেন তিনি। ব্রোহী এ মূহুর্তে শেখ মুজিবের সাহায্যে এগিয়ে আসবেন না। এমনকি, যখন আইয়ুবশাহী শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে, তখনও তিনি বিবাদী পক্ষের কৌসুলী হিসেবে দাঁড়াতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। এ থেকে বোঝাই যায়, ইয়াহিয়ার খোঁড়া ঘোড়ায় সওয়ার হবেন এমন বোকা তিনি নন। যদি ধরে নেয়া যায় যে শেখ মুজিব জীবিত রয়েছেন এবং হোয়াইট হাউজ থেকে ক্রেমলিনে, মহাসচিব উ থান্ট থেকে খান আবদুল গাফফার খান, পৃথিবীর যেখানেই এ বিচার করা হোক না কেন, ইয়াহিয়ার সেনা জান্তাকে সবদিক সামাল দেয়ার জন্য বিবাদী পক্ষে একজন কৌসুলী নিয়োগ দিতেই হবে। আইনানুসারে, যে মামলায় আসামীপক্ষের মৃত্যুদণ্ড হতে পারে, সেক্ষেত্রে আসামীপক্ষকে দরকার হলে রাষ্ট্রপক্ষের খরচে একজন কৌসুলী দিতে হবে। আসামীপক্ষের পছন্দ হোক না হোক, বিবাদী পক্ষের কৌসুলী থাকবেই।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা এখনও এমন কোন বাস্তব প্রমাণ পান নি যা থেকে আশা করা যায় যে শেখ মুজিবকে এখনও মেরে ফেলা হয় নি। এমনকি শেখ মুজিবের বিবাদী প্যানেল বাছাই করা সংক্রান্ত সর্বশেষ মিথ্যাচার থেকেও এমনটা প্রমাণিত হয় না যে তিনি বেঁচে আছেন। পাকিস্তান রেডিও আরও দু’জন আইনজীবীর নাম উল্লেখ করেছে, যারা হয়তো এ প্রহসনমূলক বিচারে জান্তার সাথে সহযোগিতা করবেন। শেখ মুজিবুর রহমানের প্রাণদণ্ড কার্যকর করার আগে ন্যায়বিচার দাবি করে এমন দলিলপত্রে স্বাক্ষর করতে সেনাবাহিনী তাঁদেরকে ব্যবহার করবে। এটা খুবই সম্ভব যে, এ ব্যক্তিরা বেঁচে থাকলে এ ঘটনার বেশি এক্সপোজার ঘটবে, এমন ঝুঁকি সেনাবাহিনী নেবে না। এটাই হচ্ছে খুনের রাজনীতির অসঙ্গতি, খুন না করে পার পাওয়া অসম্ভব।
সারা বিশ্বকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে চাপ দিয়ে সত্য প্রকাশে বাধ্য করতে হবে। যদি শেখ মুজিব বেঁচে থাকেন, তাহলে বিশ্বকে চাপ প্রয়োগ করতে হবে যাতে করে তাঁকে সেনাবাহিনী ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।