নিরাপত্তা পরিষদে পাকিস্তানী প্রতিনিধি আগাশাহীর বিবৃতি

৭.১১৪.২৩৯ ২৫৩

শিরোনামঃ ১১৪। নিরাপত্তা পরিষদে পাকিস্তান প্রতিনিধি আগাশাহীর বিবৃতি

সূত্রঃ জাতিসংঘ দলিলপত্র উদ্ধৃতিঃ বাংলাদেশ ডকুমেন্টস

তারিখঃ ৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১

.

পাকিস্তানের প্রতিনিধি আগা শাহীর বিবৃতি
ডিসেম্বর ৪, ১৯৭১

 

পরিষদের এই বৈঠকে পাকিস্তানের প্রতিনিধি দলকে আমন্ত্রন জানানোর জন্য আমি জনাব রাষ্ট্রপতি এবং নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি। নিরাপত্তা পরিষদের এই বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে জাতিসংঘের ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পরিস্থিতি নিয়ে। জাতিসংঘের একটি সদস্য রাষ্ট্র হয়েও ভারত অপর একটি সদস্য রাষ্ট্র পাকিস্তানের মাটিতে কেবল উস্কানীমূলক হামলাই চালাচ্ছে না, বরং তারা চায় পাকিস্তানে জাতিসংঘের সদস্যপদ নিজে থেকে ছেড়ে দিক, এবং দেশের সেই অংশ ছেড়ে দিক যেখানে দেশের সবচেয়ে বেশি জনগনের বাস।

এটা কেবলই একটি অভিযোগ নয়, যা আমি পরিষদের সামনে উপস্থাপন করছি। সারা বিশ্বই জানে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বিবৃতি সম্পর্কে, ১ ডিসেম্বর দেয়া যে বিবৃতিতে তিনি বলেছেন দেশের পূর্ব অংশ থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করা উচিৎ পাকিস্তানের। বিশ্ব এটাও জানে যে, ভারতীয় সেনারা পাকিস্তানের মাটিতে প্রবেশ করে আগ্রাসন চালাচ্ছে ২১ নভেম্বর থেকে। এই বিষয় দুটি কোনভাবেই এড়িয়ে যাওয়া যায় না এবং ভারত এগুলো স্বীকারও করেছে। বর্তমান পরিস্থিতি অপরিহার্য এই দুই সত্যকে বিবেচনায় রাখা নিরাপত্তা পরিষদের ভিত্তি হওয়া উচিৎ। কেননা সমকালীন সময়ে এইরকম পরিস্থিতি আর উদ্ভূত হয় নি।

জাতিসংঘের আর কোন সদস্য রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এমন উদাহরন খুজে পাওয়া যাবে না, যেখানে সাধারন কূটনৈতিক সম্পর্কের মধ্যেই একটী আরেক দেশকে তার নিজ এলাকা থেকে সেনা প্রত্যাহার করতে চিঠি দিয়েছে, এমন দখলদারিত্ব আর কতৃত্ব ফলানোর নজিরও আর নেই। ভারত কেবল এমন চাহিদাই জানাচ্ছে না, বরং তারই ধারাবাহিকতায় পাকিস্তানের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টিতে আগ্রাসনও ছড়িয়ে দিচ্ছে। এই অবস্থায় পাকিস্তানের দিকে এক ধরনের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়া হয়েছে এবং পাকিস্তান তার মোকাবেলা করবে বলেই ঠিক করেছে।

এই দিক দিয়ে দেখতে গেলে, নিরাপত্তা পরিষদের সামনে যে পরিস্থিতির কথা উপস্থাপন করা হয়েছে, সেখানে পাকিস্তান কেবল একাই জড়িত নয়। এখানে সেইসব রাষ্ট্রও জড়িয়ে পড়ে, যারা একটি রাষ্ট্র এর সীমানার অখন্ডতায় বিশ্বাসী, আর এটা জাতিসংঘ সনদের অন্যতম মৌলিক বিষয়ও বটে। এর মধ্যে দিয়ে তারাও সচেতন হবে, যারা তাদের তুলনায় বড়, অধিক শক্তিশালী আর লুন্ঠনকারী রাষ্ট্র দ্বারা পদদলিত হয়ে আসছে।

যদিও বিষয়টি নিয়ে পাকিস্তান উদ্বিগ্ন, তবে আমি অংগীকার করছি যে পাকিস্তান আত্মসমর্পণ করবে না। কালকে যে পরিস্থিতিই আসুক না কেন, তা পাকিস্তানের আত্মসমর্পণ হবে না। আমাদের স্বাধীনতা আমাদের কাছে বহু মূল্যবান, এটা নিয়ে দর কষাকষি চলে না। জাতীয় অখণ্ডতা রক্ষায় আমাদের পণ আমাদের কাছে অনেক বড়, এটাকে আমরা কোনভাবেই হোচট খেতে কিংবা হেরে যেতে দিতে পারি না। যাই হোক, এই অবস্থায়ও যদি পরিস্থিতি নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদ আজকাল করে, যদি বাকচাতুরী করে, যদি পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়, যদি এই আগ্রাসন থামাতে ব্যর্থ হয়, তাহলে একটি ব্যাপার অবশ্যই ঘটবে। জাতিসংঘ সনদ বন্ধ হয়ে যাবে।

জাতিসংঘ পরিচালনায় যে মূল বিষয়গুলো কাজ করে তা ধ্বংস হয়ে যাবে। আন্তর্জাতিক নির্দেশনাবলীর ক্ষেত্রে জাতিসংঘের যে নীতি রয়েছে তার এমন ক্ষতি হবে যা কখনই ঠিক করা সম্ভব হবে না। এটাই ভারত, যে কিনা জাতিসংঘ সনদের সম্পূর্ণ বিরোধে গিয়ে পাকিস্তানের আঞ্চলিক অখণ্ডতা আর রাজনৈতিক স্বাধীনতার বিরুদ্ধে বড় আকারে সৈন্য নিয়োগ করেছে, সেই তারাই এখন পাকিস্তানের পূর্ন আক্রমনের বিরুদ্ধে কথা বলছে। তাই ২১ নভেম্বর এর পর গেল দুই সপ্তাহের ঘটনা পরম্পরা মাথায় রাখা দরকার।

গত ২১ নভেম্বর থেকে পাকিস্তানের পূর্ব প্রদেশ ভারতের সেনা, ট্যাংক আর বিমান দিয়ে বড় আকারের আক্রমনের শিকার হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তান ঘিরে ভারতীয় স্থল সীমানার তিন দিক থেকে একই সময়ে অন্তত ৬টি পয়েন্টে এই আক্রমন চালানো হয়েছে।

ভারতের এই হামলা ছিল কোন ধরনের উস্কানী ছাড়াই; এটা ছিল বড় মাত্রায়, এটা ছিল পরিকল্পনামাফিক; হামলা হয়েছে ভারী কামানের গোলা দিয়ে এবং এটা করা হয়েছে আকাশ সীমায় নিরাপত্তা রেখেই। এটা অবশ্যই সেই অবস্থায় নেই, যেখানে প্রাথমিকভাবে ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী গেরিলাদের লেলিয়ে দিয়ে পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে চেয়েছে। ভারত এবং পাকিস্তানের সেনাবাহিনী মুখোমুখি মোকাবেলায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর অন্তত কয়েকটি ইউনিটের অস্তিত্ব আমরা পেয়েছি, তাদের হত্যা করে বা আটক করে।

২১ নভেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনী যে আক্রমনগুলো চালিয়েছে তা হলো। পূর্ব পাকিস্তানের দক্ষিন-পূর্ব অংশে পার্বত্য চট্টগ্রামে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি ব্যাটালিয়ন গ্রুপ প্রবেশ করেছে। তাদের নিরাপত্তা দিয়েছে অস্ত্রবাহী হেলিকপ্টার। তারা আমাদের সীমান্ত চৌকি দখল করে পাকিস্তানের সীমানার অন্তত ১০ মাইল অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে। একই সেক্টরের উত্তরে পাকিস্তান সীমানার ৮ মাইল অভ্যন্তরে প্রবেশ করে নোয়াখালী জেলার বিলোনিয়ায় বহির্মূখী আক্রমন চালায় ভারতীয় ২৩ ডিভিশনের এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য। বিলোনিয়ার উত্তর-পশ্চিম অংশে ব্রাক্ষনবাড়িয়া সাব-ডিভিশনে আমাদের তিউকান্দি ও সালদন্দি সীমান্ত চৌকিতে ভারতীয় ৫৭ ডিভিশনের একটী ব্যাটালিয়ন হামলা চালিয়ে দখল করে নেয়। এছাড়া উত্তরদিকে ময়মনসিংহের যেটা মমিনশাহি জেলা নামেও পরিচিত সেখানকার কারিটোলা সীমান্ত চৌকিতে পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ব ফ্রন্টের ওপর হামলা চালায় ভারতীয় বাহিনী। পূর্ব পাকিস্তানের উত্তর-পুর্ব কোনে সিলেট জেলার মৌলভীবাজার সাব-ডিভিশনের ধলই, আটগ্রাম এবং জকিগঞ্জ সীমান্ত চৌকিতে অন্তত দুটি ভারতীয় ব্যাটালিয়ন হামলা চালায়। এই ভারতীয় বাহিনীর সাথে গুর্খাদের অন্তত দুটি কোম্পানীও ছিল। পূর্ব পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম অংশে ভারতীয় বাহিনী আরেক হামলা চালায় রংপুর জেলায়। ভুরুংগামারী সীমান্ত দিয়ে ভারতীয় সেনারা পাকিস্তানের মধ্যে অন্তত ১৫ মাইল অনুপ্রবেশ ঘটীয়ে নাগেশ্বরী পর্যন্ত চলে আসে। দক্ষিন-পশ্চিম সীমান্তে যশোরেও হামলা চালানো হয়। চৌগাছার বিপরীত দিকে ঐ হামলায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর নবম ডিভিশনের একটি দল অংশ নেয়, তাদের সমর্থন দেয় অস্ত্রবাহী যুদ্ধবিমান। ভারতীয় ট্যাংকও পাকিস্তান সীমান্তের আট মাইল অভ্যন্তরে অনুপ্রবেশ করে। ভারতীয় বিমান বাহিনীর একটি হামলা ঠেকিয়ে দেয় পাকিস্তান বিমান বাহিনী। যেখানে ভারতীয় বাহিনীর একটি বিমান বিধ্বস্ত হয়। আর আমরা আমাদের এলাকায় দুটি বিমান হারিয়েছি। ঐ সম্মূখ যুদ্ধে ভারতের ৬ টী ট্যাংক ধ্বংশ হয়েছে, আর আমাদের ৮টি ট্যাংক অচল হয়ে যায়। যশোর বিমান বাহিনীর এলাকায় শেলিং চালিয়েছে ভারত। গত ২১ নভেম্বর এই সব হামলা একই সময়ে এবং বিরাট একটি এলাকাজুড়ে চালানো হয়েছে।

যতদূর জানা যায় ২১ নভেম্বর পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে হামলায় ভারতীয় বাহিনীর অন্তত ১২ ডিভিশন অংশ নেয়। এছাড়া সেখানে ভারতীয় সীমান্তবর্তী বাহিনীর ৩৮টি ব্যাটালিয়নও জড়িত ছিল। ভারতীয় মাউন্ট ডিভিশনের ২য় ও ৫ম দল যারা আগে ভারতীয় উত্তর-পূর্ব ফ্রন্টিয়ার এজেন্সির ছিলো, তারাও পূর্ব পাকিস্তানে হামলায় অংশ নেয়। ছয়টি ব্রিগেড নিয়ে গঠিত মাউন্টেন ডিভিশনের ৮ম দলকে পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তের সিলেটে নিয়ে আসা হয় নাগাল্যান্ড থেকে। ভারতীয় বিমানবাহিনীর ১২ টী স্কোয়াড্রন পূর্ব পাকিস্তান ঘিরে মোতায়েন করে হয়েছে। ভারতীয় নৌবাহিনীর একটি বিমানবাহী ফ্রিগেট, যুদ্ধ জাহাজ এবং ২টি সাবমেরিন বঙ্গোপসাগরের নিকটে ভিশাকাপত্তমে নিয়োগ করা হয়েছে, যা চট্টগ্রাম এবং চালনা বন্দরের জন্যে মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করেছে। চালনা বন্দরে মাইন হামলা চালিয়েছে ভারতীয় বাহিনী। যার ফলশ্রুতিতে দুটী পণ্যবাহী জাহাজের ক্ষতিসাধন হয়েছে। ঐ জাহাজ দুটিতে পূর্ব পাকিস্তানের বিপর্যস্ত খাদ্য পরিবহন ঠিক করতে ছিল প্রচুর পরিমানে খাদ্য পণ্য এবং প্রয়োজনীয় আরো অনেক পণ্য।

এই হলো ২১শে নভেম্বর এর পরিস্থিতি। সেই তখন থেকে ভারতীয় বাহিনী আমাদের আন্তর্জাতিক সীমান্ত লংঘন করে তাদের আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে এবং আমাদের মাটির ওপর শত্রুতামূলক ব্যবস্থা নিয়েছে। গত দুই সপ্তাহ ধরে পাকিস্তানী বাহিনী সবগুলো সেক্টরেই ভারতীয় আগ্রাসন রুখে দিয়েছে। বর্তমান যুদ্ধবিগ্রহমূলক অবস্থা বুঝতে হলে ঐ যুদ্ধটি সম্পর্কে মাথায় রাখতে হবে যেটি অগ্রবর্তী হয়ে এবং চরম আকার ধারন করে ৩ ডিসেম্বর পুর্ণ মাত্রায় যুদ্ধে পরিণত হয়েছে।

আমার প্রথমেই যশোর কথা উল্ল্যেখ করা দরকার। পূর্ব পাকিস্তানের এই দক্ষিন-পশ্চিম ফ্রন্টে ২১ নভেম্বর থেকে ভারতীয় বাহিনী ট্যাংক এবং ভারী কামানের গোলার মাধ্যমে আক্রমন চালাচ্ছে। এর মধ্যে কয়েকটি হামলার ধরণ ছিল ব্রিগেড আকারে। পাকিস্তানি বাহিনীর অল্প বিস্তার থাকা কয়েকটি অঞ্চলে ভারতীয় বাহিনী সফলও হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে চৌগাছা, যেটা আমাদের সীমান্তের ৬ মেইল অভ্যন্তরে এবং জীবন নগরও। এছাড়া বুইন্দা, শিমুলিয়া, কৃষাণপুর, জামালপুর এবং নবগ্রামে তাদের হামলাগুলো ছিল ভোতা ধরনের। যশোর সেকশনে সংঘর্ষে অন্তত দেড়শ’ ভারতীয় সেনা নিহত হয়েছে, আহত হয়েছে পাচ শতাধিক। বেশ কয়েকটি ভারতীয় ট্যাংক ধ্বংস হয়েছে। যশোর সেক্টরে বেশ কয়েকটি ভারতীয় ইউনিটকে শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, ১৪ তম পাঞ্জাব রেজিমেন্ত, ১ম জোম্মূ ও কাশ্মীর ব্যাটালিয়ন, নবম ভারতীয় পদাতিক বাহিনীর ৩৫০ তম ব্রিগেড। অপরদিকে উত্তর-পূর্ব ফ্রন্টে দিনাজপুর-রংপুর সেক্টোরে হিলিতে গেল কয়েকদিন যাবত উপর্যুপরি হামলা চালাচ্ছে ভারত। এছাড়াও যেসব এলাকায় সংঘর্ষ চলছে তার মধ্যে রয়েছে পঞ্চগড়, নাগেশ্বরী, বাদতারা এবং মির্জাপুর। এসব হামলায় ভারতীয় ট্যাংক এবং যুদ্ধবিমান ব্যবহার করা হয়েছে। দিনাজপির-রংপুর সেক্টরে যেসব ভারতীয় ইউনিট সনাক্ত করা হয়েছে তার মধয়ে রয়েছে দশম ভারতীয় মাইন্টেন ডিভিশনের ১৬৫ তম মাউন্টেন ব্রিগেড, চতুর্থ রাজপুত রেজিমেন্ট, সপ্তম মারহাট্টা হালকা পদাতিক বাহিনী এবং নবম ভারতীয় মাউন্টেন ডিভিশন।

পূর্ব পাকিস্তানে হামলা শুরুর প্রথম দিন থেকেই উত্তর-পূর্ব অংশের সিলেট সেক্টরে জোরালো প্রেশার সৃষ্টি করেছে ভারত। সেখানে বড় আকারের যুদ্ধ হয়েছে পাকিস্তান সীমান্তের দুই মেইল ভেতরের আটগ্রামে। এছাড়া যুদ্ধ হয়েছে জকিগঞ্জ, রাধানগর, কানাইঘাট, গৌরিপুর, চান্দেরপুর, লক্ষীপুর, লাটুমূড়া এবং শমশেরনগরে। এসব হামলায় ২২৫ জনেরও বেশি ভারতীয় নিহত হয়েছে, আহত হয়েছে কয়েকশ’। সিলেটে সেক্টরে যেসব ভারতীয় ইউনিট শনাক্ত করা হয়েছে তার মাঝে রয়েছে, ৮১ তম মাউন্ট ব্রিগেডের ৪র্থ কুমাওন এবং ৮২৫ তম ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী।

কুমিল্লা সেক্টর, পূর্ব পাকিস্তানের এই অংশে ভারতীয়রা প্রচন্ড বল প্রয়োগ করেছে কশবা, আখাউড়া, অংগদার বাজার, ফাতাবানগর, গাজীপুর, চৌদ্দগ্রাম এবং মোরাচালে। এর মধ্যে একটি যুদ্ধে ৫৭ তম মাউন্টেন ডিভিশনের ১৯ তম পাঞ্জাব ডিভিশন এর অন্তত ১৯৭ ভারতীয় সেনা নিহত হয়। এছাড়া কুমিল্লা সেক্টরে আর যেসব ভারতীয় ইউনিট শনাক্ত করা হয়েছে তার মধ্যে জম্মুতে বেড়ে ওঠা দগ্রা ব্যাটালিয়ন। এছাড়া এই সেক্টরে গেল কয়েকদিনে ভারতীয় বাহিনীর নতুন একটি ইউনিট পদাচরণ করছে এমন প্রমাণ আমরা পেয়েছি।

পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ব ফ্রন্টে ময়মনসিংহ জেলায়, যেটা মমিনশাহী নামেও পরিচিত, সেখানকার কামালপুর এলাকায় যুদ্ধে অংশ নিয়েছে ভারতীয় বাহিনীর ব্যাটালিয়ন অব থার্টিন গার্ডস। এছাড়া ২ ডিসেম্বর এই সেক্টরে নতুন করে ভারতীয় সেনারা প্রবেশ করে।

পূর্ব পাকিস্তানের দক্ষিন-পূর্ব অংশের পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় মূল যুদ্ধটা হয়েছে ছোটা হরিণা এলাকায়। ঐ যুদ্ধে নবম গুর্খা ব্যাটালিয়নকে শনাক্ত করা হয়েছে।

গেল দুই সপ্তাহে পাকিস্তানের পূর্ব অংশে ভারতের আগ্রাসন এবং আমাদের সীমান্তের মধ্যে ও সম্মূখভাগে ভারতীয়  সেনাদের আক্রমণের বিস্তারিত উপাত্ত এগুলো। এই বিষয়টি প্রতিস্থাপিত হয়ে গেছে যে, ২১ নভেম্বর থেকে ভারতীয় বাহিনী তাদের বিমান বাহিনীর ছত্রছায়ায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যে আগ্রাসন চালাচ্ছে তা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। ভারত-পাকিস্তান এবং উপমহাদেশের উন্নয়নে যেসব সরকার রয়েছে তারা তাদের নিজস্ব তথ্যের মাধ্যমেই এই উস্কানিবিহীন বড় আকারের হামলা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়েছে।

৩ ডিসেম্বর বিকেলে ভারত তাদের বাহিনীর নতুন ফ্রন্ট খুলেছে, এবার পশ্চিম পাকিস্তনের বিরুদ্ধে। এই হামলা চালানো হয়েছে বিমান বাহিনীর সহায়তায় ভারতের স্থল বাহিনীর দ্বারা এবং টানা চারদিন পশ্চিম পাকিস্তান জুড়ে আগ্রাসনমূলক বিমান হামলা চালানো হয়েছে। বিকেলের দিকে ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তান সীমান্তের দিকে অগ্রসর হয়। এসময় পাকিস্তানী রেঞ্জাররা বাধা দিলে তারা হালকা অস্ত্র দিয়ে গুলি চালায়। এতে আমাদের বেশ কয়েকজন আহত হয়। আত্মরক্ষার্থেই রেঞ্জাররা ভারতীয়দের উপর গুলি চালায়। এমন ঘটনা পর্যায়ক্রমে ঘটেছে শাকারগড়, কাসুর, হুসাইনিওয়ালা এবং ভারতের রাজস্থান প্রদেশের বিপরীতে রহিম ইয়ার খানে।

বিরোধপুর্ণ জম্মু ও কাশ্মীরের পুঞ্চ এলাকায় পাহাড়ে সেনা একশন চালায় ভারতীয়রা। দুই ঘন্টা বাদে ভারতীয়রা ভারী কামান নিয়ে বড় আকারের হামলা চালায়। এই হামলা সরাসরি চালানো হয়েছিল বিরোধপূর্ণ জম্মু ও কাশ্মীরের ছাম্ব এলাকায়, এবং আন্তর্জারিক সীমানা তিন এর শিয়ালকোট এলাকায়। হামলা চালানো হয়েছে জাশার ব্রিজ ও লাহোরের মধ্যবর্তী এলাকায়ও। এছাড়া রাজস্থানে সীমান্তের বিপরীত দিকে রহিম ইয়ার খানেও। ভারতীয় সেনাবাহিনীর এই হামলা চালানো হয়েছে ভারতীয় বিমানবাহিনীর ছত্রছায়ায়।

৫শ’ মাইল সীমানাজুড়ে এই পূর্বপরিকল্পিত হামলার জবাবে বাধ্য হয়েই বিপরীত হামলা চালিয়েছে পাকিস্তানী বাহিনী। পরবর্তীতে বিমান বাহিনী পাকিস্তান সীমান্তের শ্রীনগর এবং ভারত অধিকৃত কাশ্মীরে এবং পাঠানকোট ও অমৃতসরের বিমানফিল্ডে হামলা চালায়।

এই অবিশ্বাস্য ভারতীয় আগ্রাসন থেকে এটা পরিস্কার যে এই হামলার পরও ভারত অনধিকার এবং দায়িত্বহীন মিথ্যা ব্যাখ্যা চালিয়ে যাচ্ছে। ২১ নভেম্বর থেকে পাকিস্তানের মাটিতে ভারতীয়দের আগ্রাসন অস্বীকার করার মধ্য দিয়েই এই মিথ্যা বলছে তারা। ২২ নভেম্বর ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয়ের এক মুখপাত্র বলেন, আমাদের সেনাদের সীমান্ত অতিক্রম না করতে কঠোর নির্দেশ দেয়া আছে।

এই বিবৃতি এমন একটি সময়ে দেয়া হয়েছে, যখন ভারতীয় সেনারা এরই মধ্যে সীমান্ত অতিক্রম করে ফেলেছে এবং সংঘর্ষ চালিয়েছে পাকিস্তানের এলাকারই বিভিন্ন অংশে। ২৪ নভেম্বর রয়টার্সে ডাকে পাঠানো একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছেঃ

“ভারত সরকারের একজন মুখপাত্র আজ জানিয়েছেন, গেল রোববার (যেটা ২১ নভেম্বর) ভারতীয় ট্যাংক পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তে প্রবেশ করেছে, যেখানে তারা ১৩টি পাকিস্তানী ট্যাংক ধ্বংস করেছে। ঐ মুখপাত্র আরো বলেন, ভারতীয় সেনাদের দেয়া নির্দেশনায় সংশোধন আনা হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে, আত্মরক্ষার্থে তারা সীমান্ত অতিক্রম করতে পারবে। তিনি নিশ্চিত করেছেন, আমাদের (ভারত) ট্যাংক রোববার আত্মরক্ষার্থেই যুদ্ধে অংশ নেয়। তাকে যখন প্রশ্ন করা হয়, তারা পুর্ব পাকিস্তানে গিয়েছে কি না, তখন জবাবে তিনি বলেন স্বাভাবিকভাবেই তারা সীমান্ত অতিক্রম করতে বাধ্য হয়েছে।“

মিস্টার প্রেসিডেন্ট এবং নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের প্রতি আমি অনুরোধ জানাবো ভারতের অস্বীকার এবং স্বীকারের প্রতি যেটা স্পষ্টতই প্রতীয়মান তার প্রতি এই চতুর্মূখী প্রতিরোধ বজায়ে রাখুন।

যখন তারা বাধ্য হল তখনই কেবল স্বীকার করল যে তারা পাকিস্তানের সীমানায় যুদ্ধ করেছে। ভারত যদিও বলছে এটা তাদের আত্মরক্ষার্থে। কিন্তু যখন থেকে জাতিসংঘ সনদ অনুমোদন হয়েছে, তারপর কি জাতিসংঘের কোন সদস্য রাষ্ট্র আত্মরক্ষার নামে অন্য কোন দেশে আক্রমন চালাতে পারে? এটা খুবই চমকপ্রদ যে, পাকিস্তান যা আকারে ভারতের চারভাগের একভাগ, যাদের সেনাবাহিনী ভারতের সেনাবাহিনী থেকে পিছিয়ে আছে কি জনশক্তি কিংবা অস্ত্র শক্তিতে, যে দেশ বর্তমানে নিজেই প্রবল আভ্যন্তরীন সংকটে ভুগছে, তারা কিভাবে নভেম্বরে ভারতের উপর আক্রমন চালায়। পূর্ব পাকিস্তানের ভূমি, যা তিনিদিক থেকে ভারতীয় সীমান্ত দিয়ে ঘেরা এবং পুরো উত্তর ভারতের মাত্র ১.১১ শতাংশ ঘিরে রয়েছে পশ্চিম অঞ্চলে। অবৈধভাবে আকাশপথ বন্ধ করে দেয়ার মধ্য দিয়ে গেল ফেব্রুয়ারীতে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে সরাসরি আকাশ যোগাযোগ ভারত বন্ধ করে দেয়।

তাছাড়া আমাদের সেনাবাহিনীর খুব ক্ষুদ্র একটি অংশ পূর্ব পাকিস্তানে নিয়োজিত রয়েছে। এই অবস্থায় পাকিস্তানী বাহিনীর পক্ষে ভারতে আক্রমন করার মত যুক্তি কি ই বা হতে পারে? অবশ্য এটা অনুমান করাই কঠিন যে সামান্য ছুতা ধরে আত্মরক্ষার নামে অদ্ভূত পদক্ষেপ নিতে পারে।

স্বাভাবিকভাবেই এটা প্রত্যাশিত ছিল যে, ভারত পাকিস্তানে হামলা চালানোর জন্যে যুক্তি দাড় করাবে যে, পাকিস্তানের বাহিনী ভারতীয় সীমান্তের নির্দিষ্ট স্থানে ও সময়ে অনুপ্রবেশ করেছে। মিথ্যা হওয়া সত্তেও এসব অভিযোগ আমলে নেবার সময় নিরাপত্তা পরিষদকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে তাদের সেই মূলনীতিকে, যেখানে বলা হয়েছে, একটি রাষ্ট্র যে তার নিজের এলাকাতেই অনিয়মিতভাবে অন্য দেশের সরাসরি প্ররোচনায় এবং সহায়তায় পরিচালিত সন্ত্রাসীদের দ্বারা নির্যাতিত, সেই রাষ্ট্র তার অস্তিত্ত্ব রক্ষায় এবং তার প্রতিষ্ঠান রক্ষায় যে কোন ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারে। এই নীতিটি আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত, বিভিন্ন মহাদেশের বিভিন্ন রাষ্ট্র এবং রাজনৈতিক মিত্রদের কাছে আগ্রাসনের সংজ্ঞা হিশেবে জ্ঞাত।

পাকিস্তান কোন অর্থেই সশস্ত্র ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে দমনে এমন পদক্ষেপ নেয়নি যার উদ্দ্যেশ্য ছিল দেশের বিভাজন। ৩ ডিসেম্বরের পূর্বে ঘটে যাওয়া ঘটোনাবলীর মাধ্যে বিতর্কের উর্ধ্বে থাকা সত্য বিষয়গুলো হলঃ

প্রথমত, ভারতের প্ররোচনায় সশস্ত্র গোষ্ঠীর মাধ্যমে যুদ্ধ, ধ্বংস এবং সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের শিকার হয়েছে পাকিস্তান।

দ্বিতীয়ত, এই কর্মকান্ডে যেই সব নিষিদ্ধ সংগঠন অংশ নিচ্ছে তাদের পরিচালনা করা হচ্ছে ভারতীয় অঞ্চল থেকে এবং তাদের ভিত্তিও ভারতে।

তৃতীয়ত, পাকিস্তানের আভ্যন্তরীন নিরাপত্তার জন্য, ঐসব নিষিদ্ধদের ধরা এবং নির্বাসনে পাঠানো জরুরী হয়ে পড়েছিল। আমি নির্দ্বিধায় এবং পূর্ণ দায়িত্বের সাথে বলতে পারি, কোন সময়ে এবং কোন স্থানে আত্মরক্ষা এবং আভ্যন্তরীন নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ছাড়া পাকিস্তানী বাহিনী পূর্ব অংশে কোন ধরনের পদক্ষেপ নেয়নি।

তারপরও বাস্তবতার বিপরীতে গিয়ে যদি এটাও ধরে নেয়া হয় যে, কিছু ক্ষেত্রে আঞ্চলিক আক্রমন ঠেকাতে সীমান্ত জুড়ে কোথাও বাড়তি পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। তারপরও ভারতের কোন ক্ষমতা নেই আত্মরক্ষার নামে পাকিস্তানে চালানো হামলাকে স্বীকৃতি দেবে।

ভারতের অভিযোগ এবং তার সমর্থনে পাকিস্তানের আক্রমন অসাড় আর অনৈতিক ছাড়া কিছুই নয়, কেননা তারাই পাকিস্তানের সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন দিচ্ছে। যদি এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো ভারত দ্বারা এবং ভারতের মাটি থেকে পরিচালিত না হয়, তবুও ভারত তাদের সম্পর্কে জানে, তাদেরকে অস্ত্র এবং অন্যান্যভাবে সহায়তা করা পাকিস্তানের আভ্যন্তরীন ব্যাপারে কেবল নাক গলানই নয় বরং পরোক্ষভাবে এটা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আগ্রাসনও বটে। তখন থেকেই এই ব্যাপারটা সুনিশ্চিত যে, এইসব সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর প্রশিক্ষন, সংগঠিত হওয়া, অর্থ, অস্ত্র এবং অন্যান্য সব সরঞ্জামই ভারত দিয়েছে। এমনকি তাদের অভিযানগুলোও সরাসরি ভারত দ্বারা পরিচালিত হয়েছে, তারা আর কিছুই না বরং অনিয়মিত ভারতীয় বাহিনী। তারা নিয়মিতভাবে অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকান্ড এবং আক্রমন চালিয়ে যাচ্ছে এবং ভারতের নিয়মিত সেনাবাহিনীর সেনা কর্মকান্ড দ্বারা সমর্থিত হচ্ছে। এসব সন্ত্রাসী গোষ্ঠী যে ভারতের দ্বারা সমর্থিত, সংগঠিত এবং পরিচালিত হচ্ছে তা প্রমান করতে আমাকে কোন উদ্দৃতি দিতে হবে না। এটা তারা নিজেরাই স্বীকার করে নিয়েছে। ২০ জুলাই ভারতের পার্লামেন্টে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “ভারত তার সামর্থ্যের সবকিছু করছে, আমি আবারো বলছি সামর্থ্যের সবকিছু মুক্তিবাহিনীকে সমরত্থন দিতে”।

নিরাপত্তা পরিষদের সামনে যে পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে তা হল শুরুতে যেমন বলছি, শান্তির লংঘন হচ্ছে। এটা আর কিছুই নয় পাকিস্তানের আভ্যন্তরীন বিষয়ে ভারতের নাক গলানো এবং একের পর এক ভয় প্রদর্শনমূলক কর্মকান্ড। পাকিস্তানের আভ্যন্তরীন সংকট নিরাপত্তা পরিষদের চিন্তার বাহিরে। নয়াদিল্লী সরকারের পাতা কোন ফাদে পা দেয়া আমার উচিৎ নয়, যে কিনা তার নাক গলানো আর আগ্রাসনকে বৈধতা দিচ্ছে পাকিস্তানের আভ্যন্তরীন সংকটে হস্তক্ষেপের মধ্য দিয়ে। আমি আশা করি এবং আস্থা রাখি যে নিরাপত্তা পরিষদ একইভাবে জাতিসংঘের বিচারব্যবস্থার আওতার বাইরের ক্ষেত্রবিশেষ নিয়ে উঠতি বিতর্কের দিকেও নজর রাখবে।

পরিষদ একইভাবে জাতিসংঘের বিচারব্যবস্থার আওতার বাইরের ক্ষেত্রবিশেষ নিয়ে উঠতি বিতর্কের দিকেও নজর রাখবে।

নিম্নে ৩ ডিসেম্বর এর পূর্ববর্তি অবস্থা সম্পর্কে কিছু তথ্য তুলে ধরা হলো। উল্লেখ্য, এগুলো সম্পর্কে বিতর্ক বা সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।

প্রথমত, পাকিস্তান বিভিন্ন সশস্ত্র দলের নাশকতা এবং সন্ত্রাসী কার্যক্রমের শিকার। আর এদের সংগঠিত করার পিছনে দায়ী ভারত।

দ্বিতীয়ত, এ সব নাশকতামূলক কার্যক্রমের মাঝে ছিল বহিরাগত কিছু গোষ্ঠীর অনুপ্রবেশ , যাদের ঘাঁটি ছিল ভারতে এবং সেখান থেকেই তারা তাদের কার্যক্রম চালাতো।

তৃতীয়ত, অভ্যন্তরীন নিরাপত্তা রক্ষার জন্য সর্বপ্রথমেই যে পদক্ষেপটি নেয়া দরকার তা হলো, এ সমস্ত দলগুলোকে আটক অথবা পাকিস্তান থেকে বহিষ্কার।

আমি সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিয়েই বলতে চাই, পাকিস্তানে অবস্থানরত সামরিক বাহিনীর সদস্যবৃন্দঅভ্যন্তরিন নিরাপত্তা এবং দেশের সীমান্ত রক্ষার জন্য যা প্রয়োজন তার বাইরে একটি পদক্ষেপও নেয় নি।

কিছু না ঘটা সত্ত্বেও শুধুমাত্র যদি তর্কের খাতিরে ধরে নেই যে সীমান্তের কিছু জায়গাতে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু সীমালংঘনের ঘটনা ঘটেছে, তারপরও ভারতের এই দাবি কোনভাবেই সমর্থনযোগ্য নয় যে আত্মরক্ষার খাতিরেই পাকিস্তানের অভ্যন্তরে আক্রমণ চালাতে হয়েছে।

ভারতিয়দের আরেকটি উদ্ভট ও অগ্রহণযোগ্য দাবি হলো, তাদের এই আক্রমণ যুক্তিসংগত কারণ তারা পাকিস্তানের অভ্যন্তরে বিদ্রোহিদের সমর্থন দিচ্ছে। কিন্তু এই বিদ্রোহিরা যে ভারতের অভ্যন্তরে অবস্থান করছে বা সেখান থেকে তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে, এমনটি কিন্তু নয়। উপরন্তু, ভারত তাদের অস্ত্র দিয়ে এবং বিভিন্ন উপায়ে সাহায্য করে চলেছে-তাদের এই স্বীকারোক্তি থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে তারা যে শুধুমাত্র পাকিস্তানের অভ্যন্তরিন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেছে তাই নয়,পরোক্ষভাবে তারা আগ্রাসনও চালাচ্ছে। এ বাহিনীগুলো ভারতের দ্বারা প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত,সংগঠিত,আর্থিকভাবে সাহায্যপ্রাপ্ত। তাদেরকে অস্ত্র ও বিভিন্ন সরঞ্জাম সরবরাহ করে এবং ঘাঁটি তৈরি করে দিয়েও সাহায্য করেছে ভারত। এমনকি তাদের কার্যক্রমও ভারতের দ্বারাই নির্দেশিত-যা থেকে স্পষ্টই বোঝা যায় এরা ভারতের এক প্রকার অনিয়মিত বাহিনী ছাড়া আর কিছুই নয়।ভারতিয় সামরিক বাহিনী দ্বারা সমর্থিত তাদের এই উপর্যুপরি আক্রমণ এবং অনুপ্রবেশ আসলে ভারতের নিয়মিত সামরিক বাহিনি দ্বারা সরাসরি আক্রমণেরই নামান্তর।

ভারতিয়রা যে বিদ্রোহিদের অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করছে এবং নিয়মিত দিক নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছে, আমার মনে হয় না আমার এই দাবির পিছনে কোন প্রমাণ এখানে তুলে ধরার প্রয়োজন আছে। কেননা, তারা নিজেই তা স্বীকার করেছে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রি ২০ জুলাই পার্লামেন্টে বলেন,

“মুক্তিবাহিনিকে সাহায্য করার জন্য ভারতের পক্ষে যা যা করা সম্ভব,সব ই করছে।” আমি আবার বলছি, “যা যা করা সম্ভব, সব ই করছে।”

নিরাপত্তা পরিষদের সামনে শুরুতেই আমি একটি ঘটনা তুলে ধরেছিলাম,যা আসলে একের পর এক শান্তি লংঘনকারি ঘটনা সমূহের মাঝে মাত্র একটি ঘটনা। ইহা আসলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতিয়দের দ্বারা সংঘটিত একের পর এক নাশকতামূলক কার্যক্রমসমূহেরই ফসল, যার উদ্দেশ্যই ছিল পাকিস্তানের অভ্যন্তরিন কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটানো।ভারত তার অযাচিত হস্তক্ষেপ এবং আগ্রাসনকে বৈধতা দিতে চাইছে পাকিস্তানের অভ্যন্তরিন সংকটকে অজুহাত হিসেবে দেখিয়ে। নয়াদিল্লি সরকারের তৈরি করা এই ফাঁদে পা দিতে আমি রাজি নই। পাকিস্তানের অভ্যন্তরিন সংকট নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের হস্তক্ষেপের কোন প্রয়োজন নেই। আমি আশা করবো, জাতিসংঘের এক্তিয়ারের বাইরের বিষয় নিয়ে অহেতুক বিতর্ককে নিরাপত্তা পরিষদ নিরুৎসাহিত করবে।  নিরাপত্তা পরিষদের কাজ আন্তর্জাতিক শান্তির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, কোন সদস্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরিন শান্তি বা রাজনিতির সাথে নয়। পাকিস্তানের অভ্যন্তরে যা ঘটছে এ নিয়ে কারো ব্যক্তিগত মতামত যাই হোক না কেন, কোন কাজগুলো ভুল বা সঠিক হয়েছে এ নিয়ে যে যেমনটাই ভেবে থাকেন না কেন, তার কোন কিছুই ভারতের অযাচিত হস্তক্ষেপকে বৈধতা দেয় না।

বিশ্ব শান্তি বজায় রাখার অন্যতম একটি শর্ত হলো, কোন রাজনৈতিক,অর্থনৈতিক,কৌশলগত,সামাজিক বা আদর্শগত বিবেচনা দ্বারা এক রাষ্ট্রের প্রতি অন্য রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ আক্রমণ অথবা অভ্যন্তরিন বিষয়ে অযাচিত হস্তক্ষেপকে বৈধতা দেয়া যাবে না। আমরা জানি সাধারণ পরিষদের অনেকগুলো ঘোষণাও এই নীতিকে মেনে নিয়েছে। আমি এখানে সবগুলোর কথা উল্লেখ করবো না কারণ এই নীতির স্বীকৃতি এবং জাতিসংঘে তার আইনগত প্রয়োগ ঐ সমস্ত ঘোষণাসমূহের উপর নির্ভর করে না।  ‘কোন দেশের অভ্যন্তরিন বিষয়ে হস্তক্ষেপের অগ্রহণযোগ্যতা’ এবং তাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য ১৯৬৫ সালে সাধারণ পরিষদ যে ঘোষণা দিয়েছে, আমার মনে হয় শুধুমাত্র তার উল্লেখ করাই এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট হবে।(General Assembly Resolution 2131(XX))

উক্ত ঘোষণার কার্যকরি অনুচ্ছেদ ১ এ উল্লেখ আছেঃ

“কোন রাষ্ট্রই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অন্য কোন রাষ্ট্রের বাহ্যিক বা অভ্যন্তরিন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না,কারণ যাই হোক না কেন। সেই সাথে সশস্ত্র বা যে কোন ধরণের আগ্রাসন অথবা কোন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বা তার রাজনিতি,অর্থনিতি বা সংস্কৃতির বিরুদ্ধে কোন ধরণের হুমকি প্রদান সম্পূর্ণরুপে অগ্রহণযোগ্য।”

কার্যকরি অনুচ্ছেদ ২ এ উল্লেখ আছেঃ

“………… সন্ত্রাসি বা ধ্বংসাত্মক কাজের মাধ্যমে কোন রাষ্ট্রের সরকার উৎখাতের চেষ্টা হলে তাতে অন্য কোন রাষ্ট্র কোন প্রকার আর্থিক বা সাংগঠনিকবা অন্য কোন প্রকার সাহায্য দিতে পারবে না। এমনকি কোন রাষ্ট্রের অভ্যন্তরিন কোন দ্বন্দ্বেও অন্য কোন রাষ্ট্র কোন প্রকার হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। ”

কার্যকরি অনুচ্ছেদ ৪ এ উল্লেখ আছেঃ

“……… অযাচিত হস্তক্ষেপের এই চর্চা যে যে শুধুমাত্র জাতিসংঘের মূলনিতি বা এর সনদের অবমাননা তা নয়, উপরন্তু এ থেকে এমন সব পরিস্থিতির উদ্ভব হবে যা “আন্তর্জাতিক শান্তি এবং নিরাপত্তা”কে ও বিঘ্নিত করবে।

আমার মনে পড়ছে, ‘কোন রাষ্ট্রের অভ্যন্তরিন বিষয়ে হস্তক্ষেপের অগ্রহণযোগ্যতা  বিষয়ক ঘোষণা’ তৈরিতে যে কমিটি ভূমিকা রেখেছিল তাতে ভারত ও উপস্থিত ছিল। অন্যের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার নীতি সমর্থনের জন্যও জাতিসংঘের মাঝে ভারত বেশ সুপরিচিত। এই নীতি মেনে চলার ব্যাপারে কেন তাদের এত আগ্রহ তা কারও কাছেই গোপন নয়, এবং আমরা পাকিস্তানিরা তা বেশ ভাল করেই জানি। তারা ভুলে যাচ্ছে যে জম্মু এবং কাশ্মির ততক্ষন পর্যন্ত ভারতের অংশ হিসেবে গণ্য হবে না যতক্ষন পর্যন্ত নিরপেক্ষ গণভোটের মাধ্যমে রাষ্ট্র তাদেরকে ভারতের সাথে যুক্ত হওয়ার জন্য রায় দেবে। এমনকি জম্মুর জনগণের জন্য পকিস্তানের পক্ষ থেকে নৈতিক এবং রাজনৈতিক সাহায্য পৌঁছানোর রাস্তাও ভারত বন্ধ করে দিয়েছে।যাই হোক, এই মূহুর্তে আমি এসব বিষয়ের অবতারণা করতে চাচ্ছি না। লক্ষণীয় বিষয় হলো, এ বিষয়ে ভারতের আগ্রহ এত বেশি যে ভারত যে সমস্ত পরাশক্তিকে তার বন্ধু বলে দাবি করে তাদের সাথে সুসম্পর্কের চেয়েও বিষয়টিতে নাক গলানো তাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ১৯৬৮ সালের ২১ আগস্ট তারিখে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যার বিষয়সমূহের মাঝে ছিল চেকোস্লোভাকিয়ার উন্নয়ন। উক্ত সভায় ভারতিয় প্রধানমন্ত্রির লিখিত একটি বিবৃতি পাঠ করেন ভারতিয় প্রতিনিধি। নিম্নে তার কিছু অংশ তুলে ধরা হলোঃ

“রাষ্ট্রসমূহের মাঝে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য প্রধান শর্ত হলো একে অপরের অভ্যন্তরিন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকা। আমরা বিশ্বাস করি,ছোট বা বড় যে কোন রাষ্ট্রেরই স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বজায় রাখা উচিৎ। কোন রাষ্ট্র যাতে তার নিজস্ব ঐতিহ্যের উপর ভিত্তি করে এবং তার নিজস্ব মেধার উপর নির্ভর করে একটি পৃথক সত্ত্বা হিসেবে গড়ে উঠতে পারে,সে বিষয়ে আমরা সর্বদাই সচেতন। যখনই কোথাও এই নীতির ব্যত্যয় ঘটেছে ভারত তখনই এর প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছে।

অন্যান্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরিন বিষয়ে হস্তক্ষেপের ব্যাপারে এই ছিল ভারতিয় প্রধানমন্ত্রির বক্তব্য।

উপরোক্ত বক্তব্য প্রদান সত্ত্বেও শুরু থেকেই ভারত নির্লজ্জের মত পাকিস্তানের অভ্যন্তরিন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে আসছে। এ বছরের শুরু থেকে তা বেশ গুরুতর আকার ধারণ করে যা পাকিস্তানের অভ্যন্তরিন সমস্যার জন্যও দায়ি। উদ্দেশ্য একদম স্পষ্ট, পাকিস্তানের রাজনৈতিক এবং সাংবিধানিক অবস্থার পরিবর্তনের ফলাফল যেন পাকিস্তানের বিভক্তিকরণের মধ্য দিয়েই শেষ হয়।

পাকিস্তানের অভ্যন্তরিন বিষয়ে ভারতের কিছু অযাচিত হস্তক্ষেপের কথা আমি সংক্ষেপে তুলে ধরছিঃ

প্রথমত,১৯৭০ সালে পাকিস্তানে নির্বাচনের পূর্বেই ভারত এদেশের বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদিদের সাথে অস্ত্র এবং গোলাবারুদ সরবরাহের জন্য যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে তোলে।

দ্বিতীয়ত,১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জম্মু এবং কাশ্মির হতে আগত একটি বিমান ছিনতাই করে ভারত। ছিনতাইকারিরা ছিল ভারতিয় গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভারত তার ভূখন্ডের উপর দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান হতে পূর্ব পাকিস্তানে বিমান চলাচল বন্ধ করে দেয়। সম্পুর্ণ অবৈধ এই নিষেধাজ্ঞার কারণে পাকিস্তানের দুই অংশের মাঝে আকাশপথে সরাসরি যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ভারতের সরকারি সূত্রে এমনটিও বলা হয়েছে যে,যদি আকাশপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনরায় চালু করে দেয়া হয় তবে তা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মনে সন্দেহের উদ্রেক করবে।

তৃতীয়ত,পাকিস্তানের সংবিধানের ভবিষ্যৎ নিয়ে রাজনৈতিক মতৈক্যে পৌঁছানোর জন্য যে আলোচনা চলছিল তা ব্যর্থ হওয়ার পরপরই ভারত তার পার্লামেন্টে একটি বিশেষ দলকে সমর্থন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আমি নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের সামনে একটি প্রশ্ন রাখতে চাই, আপনাদের প্রতিবেশি কোন রাষ্ট্রের এরকম কোন অভ্যন্তরিন সমস্যার ক্ষেত্রে কি আপনাদের সরকার কি এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা ভাবতে পারতো?

চতুর্থত, পূর্ব পাকিস্তানের এই অভ্যুত্থানে সাহায্য করে ভারতের মিথ্যা প্রচারণা, যার জন্য এই অভ্যুত্থান মারাত্মক আকার ধারণ করে। ভারতিয় প্রচার মাধ্যমের এসব প্রচারণা ছিল সম্পূর্ণ অতিরঞ্জিত। আর এই অতিরঞ্জিত প্রচারণার ফলে বিদেশি সংবাদ মাধ্যমও এ নিয়ে প্রচার শুরু করে দেয়। ভারতিয় সংবাদ মাধ্যমের সাথে বিদেশি সংবাদ মাধ্যমেরও প্রচারণা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মাঝে ব্যাপক ভীতির সঞ্চার করে এবং যার ফলাফল স্বরুপ বিপুল সংখ্যক মানুষ দেশ ছেড়ে চলে যায়।

পঞ্চমত,ভারত এই শরণার্থি সমস্যা থেকে সামরিক,রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক সুবিধা নেয়া শুরু করে। সামরিকভাবে নেয়া সুবিধাটি হলো, দেশ ছেড়ে আসা এসব মানুষদের নিয়ে ভারত একটি অনিয়মিত সশস্ত্র বাহিনী তৈরি করে।

রাজনৈতিকভাবে নেয়া ফায়দাটি হলো,শরণার্থিদের মাঝে ভারত একটি ধারণা ঢুকিয়ে দেয়-তারা যখন দেশে ফিরে যাবে তখন তারা পাকিস্তানের কোন একটি অংশে ফিরে যাবে না, তারা ফিরে যাবে একটি সম্পূর্ণ নতুন সার্বভৌম রাষ্ট্রে। ভারতের কেন্দ্রিয় সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রিরা প্রকাশ্যে এরকম বহু উক্তি করেছেন।কূটনৈতিকভাবে, শরণার্থি সমস্যাকে কাজে লাগিয়ে পাকিস্তানে সব ধরণের আর্থিক সাহায্য পাঠানো বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছে ভারত।

ষষ্ঠত, পাকিস্তানের সমস্যা যাই হোক না কেন, ভারতের জন্য তা মোটেও হুমকি ছিল না। কিন্তু ভারত পাকিস্তানের অভ্যন্তরে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হওয়ার পর বিন্দুমাত্র দেরি করে নি। অত্যন্ত দ্রুততার সাথে তারা ৫টি ডিভিশন পুর্ব পাকিস্তানের সীমান্তে বা তার কাছাকাছি এলাকায় মোতায়েন করে ফেলে।পূর্ব পাকিস্তানের গ্যারিসনে মোতায়েন করা সৈন্যরা যখন সশস্ত্র বিদ্রোহ সামলাতে ব্যস্ত, ঠিক তখনই ভারত তার সামরিক শক্তি প্রদর্শন শুরু করে। পাকিস্তানকে পরোক্ষভাবে হুমকি দেয়া এবং নাশকতাকারি ও বিদ্রোহিদের উৎসাহ দেয়া ছাড়া ভারতের এই পদক্ষেপের আর কোন উদ্দেশ্য থাকতে পারে কি?

পাকিস্তানের যেসব অভ্যন্তরিন বিষয়ে ভারত হস্তক্ষেপ করেছে,উপরোক্ত ঘটনাগুলো তার ক্ষুদ্র অংশ মাত্র, বর্তমানে যা গুরুতর আকার ধারণ করে আগ্রাসনে রুপ নিয়েছে। পাকিস্তানের অন্তর্দ্বন্দ্বের ফসল স্বরুপ এমন একটি সমস্যার উদ্ভব হয়েছে যা সত্যিকার অর্থেই একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা এবং আমরা তা স্বীকার করতেও প্রস্তুত। আর তা হলো বিপুল সংখ্যক মানুষের পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে ভারতের মটিতে আশ্রয় নেয়া। সমস্যাটা আন্তর্জাতিক হলেও কিন্তু রাজনৈতিক নয়। পাকিস্তান যদি এ সমস্ত ছিন্নমূল মানুষদের বাড়ি ফেরার অধিকার কেড়ে নিত, ভিটেবাড়ি ফিরিয়ে না দিত কিংবা নিজ দেশে সম্মান এবং নিরাপত্তার সাথে বেচে থাকার অধিকার না দিত-তখন তাকে আন্তর্জাতিক সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করা যেত। এই মানুষগুলোকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার তো প্রশ্নই আসে না, উপরন্তু পাকিস্তান যত দ্রুত সম্ভব তাদেরকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে প্রস্তুত। এছাড়াও পাকিস্তান জাতিসংঘের সাথে যৌথভাবে কাজ করছে স্বেচ্ছায় স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকারিদের যত দ্রুত সম্ভব পুনর্বাসনের জন্য। এ সব কিছু থেকে স্পষ্টই বোঝা যায়, সমস্যাটি সম্পূর্ণই মানবিক-যার সমাধান সমবেদনা এবং সহানুভূতির দ্বারাও সম্ভব। শুধু তাই নয়, এ সমস্যা সমাধানের জন্য ভারত ও পাকিস্তানের মাঝে এবং জাতিসংঘ ও দুই দেশের মাঝেও সহায়তা প্রয়োজন। আর যাই হোক, অন্তত এই সমস্যাটি নিয়ে রাজনিতি কোন ভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।

কিন্তু ঠিক এই কাজটিই করে যাচ্ছে ভারত। বাস্তুচ্যুত মানুষগুলোর পাকিস্তান ফেরার পথ রুদ্ধ করার মাধ্যমে ভারত পাকিস্তানকে বিভক্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

বলা হয়ে থাকে, বাস্তুচ্যুত মানুষদের ঘরে ফিরিয়ে আনার জন্য এমন পরিবেশ প্রয়োজন যা দেখে সে ভরসা করতে পারে। এই বক্তব্যকে ভুল বোঝার কোন অবকাশ নেই, যদি “এমন পরিবেশ প্রয়োজন যা দেখে সে ভরসা করতে পারে” কথাটির অর্থ কেউ বুঝে থাকে। পাকিস্তান সরকার তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে সেরকম পরিবেশ তৈরি করার। এই চেষ্টাগুলো কি আরও ফলপ্রসূ হতো না যদি ভারত তাদের সাহায্য করতো? জাতিসংঘ এবং পূর্ব পাকিস্তানে জাতিসংঘের অবস্থান কি আরও শক্ত হতো না যদি ভারত তাদের সহযোগিতা করতো?  তাদের এই সহযোগিতা কি দেশে ফেরার মত পরিবেশ পাওয়ার ব্যাপারে শরণার্থিদের আরও আশ্বস্ত হত সাহায্য করতো না? ভারত যদি তার একরোখা নীতিতে অটল না থাকতো তাহলে বর্তমান পরিস্থিতি কতটা ভিন্ন হতে পারতো তা বিবেচনার ভার আমি নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের হাতে ছেড়ে দিলাম।

সংক্ষেপে বলতে গেলে, পাকিস্তানের প্রতি ভারতের এই শত্রুভাবাপন্নতা আন্তর্জাতিক শান্তি এবং নিরাপত্তাকেই হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। এই শত্রুতা কিন্তু পাকিস্তানের অন্তর্দ্বন্দ্ব থেকে শুরু হয় নি। পাকিস্তানের এই দুঃসময় ভারতকে তার পরিকল্পনাসমূহ বাস্তবায়নের জন্য এক অভূতপূর্ব সময় ও সুযোগ এনে দিয়েছে মাত্র।  Indian Institute of Defense Studies and Analysis এর প্রধান বলেছেন,

“ভারতের বোঝা উচিৎ, পাকিস্তানের ভাঙন আমাদের স্বার্থের অনুকূলেই যাবে। এমন সুযোগ কিন্তু দ্বিতীয়বার আর আসবে না।”

একজন ভারতিয় রাজনীতি বিষয়ক লেখক, জনাব এস. এস. সোয়ামি,নয়াদিল্লী থেকে প্রকাশিত “Motherland” নামক পত্রিকায় ১৫ জুন একটি কলামে লিখেনঃ

“পাকিস্তানের ভাঙন শুধুমাত্র আমাদের বাইরের নিরাপত্তার স্বার্থের সাথেই সম্পর্কযুক্ত নয়, আমাদের অভ্যন্তরিন নিরাপত্তার স্বার্থের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলে ভারত একটি পরাশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারবে এবং সেজন্য জনগণকে জাতিয়ভাবে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। তার জন্য সর্বপ্রথমে পাকিস্তানের ভাঙন অত্যন্ত জরুরি।”

আরেকজন লেখক, জনাব জে. এ. নাইক, পাকিস্তানের ভাঙ্গনকে এই অঞ্চলে ভারতের পরাশক্তি হিসেবে উত্থানের পথ হিসেবে দেখছেন। পাকিস্তানে অভ্যন্তরিন সংকট দেখা দেওয়ার পরপরই ১ এপ্রিল নয়াদিল্লীতে এক রাজনৈতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সে সম্মেলনের উপর হিন্দুস্তান টাইমসের রিপোর্টে দেখা যায়  সম্মেলনে সবাই একটি ব্যাপারে একমত হয়েছিলেন। তা হলো-“এই শতাব্দির শ্রেষ্ঠ সুযোগটিকে যেভাবেই হোক কাজে লাগাতে হবে।”

এ কথা মনে করার কোন কারণ নেই যে এগুলো তাত্ত্বিক রাজনিতিবিদদের অবাস্তব কল্পনা। নিম্নে আমি ভারতের কিছু সরকারি কর্মকর্তাদের বক্তব্যের কথা তুলে ধরছিঃ

“The Statesmen” পত্রিকার খবর অনুযায়ী, ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রি জনাব জগজীবন রাম,১১ আগস্ট নয়াদিল্লীতে রোটারি ক্লাবের উদ্দেশ্যে বলেন,

“বাংলাদেশকে বাস্তব রুপ দিতেই হবে এবং তা বাস্তবায়িত হবেই, নয়তোবা ভারতের উপর বিপদ কিন্তু অবশ্যম্ভাবি।” এ দ্বারা স্পষ্টই বোঝা যায়, পাকিস্তানের অখন্ডতাকে ভারত হুমকি স্বরুপ মনে করে। এমনকি ১ ডিসেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রি পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান সেনাবাহিনির উপস্থিতিকে ভারতের নিরাপত্তার জন্য হুমকি স্বরুপ বলে উল্লেখ করেন, যদিও তারা পাকিস্তান এর নিজস্ব এলাকার ভিতরেই ছিল।

১৮ সেপ্টেম্বর,ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রি কিছু কথা বলেন, যা ১৯ সেপ্টেম্বর এর“The Statesmen” পত্রিকায় প্রকাশিত হয়”

“পাকিস্তান সহজেই বাংলাদেশকে স্বাধীনতা দিয়ে দেবে, এটা অতি কল্পনা। তাই আমাদেরকে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে হবে যাতে করে পাকিস্তানের সামনে আর কোন উপায় না থাকে।”

সেই পরিস্থিতি ঠিক কেমন হবে তা Indian Institute of Defense Studies and Analysis  ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিয়েছে, যা আমি একটু আগেই উল্লেখ করেছি। ১৫ আগস্ট উক্ত সংস্থাটির প্রধান “Illustrated Weekly of India” নামক সাপ্তাহিকে একটি কলাম লিখেন, যার শিরোনাম ছিল “যুদ্ধই কি আমাদের সামনে একমাত্র পথ?” সেখানে বলা ছিল, “পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ হলে তা হবে ক্ষণস্থায়ি।” যদি কখনও এরকম ক্ষণস্থায়ি যুদ্ধের সম্মুখীন হতে হয় তাহলে তার ঘটনাপ্রবাহ কেমন হবে তার একটা খসড়া তৈরি করে Indian Institute for Defense Studies । আমি নিশ্চিত, নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যবৃন্দ উক্ত খসড়ার কিছু অংশ পড়ে বেশ আগ্রহ বোধ করবেনঃ

“নিরাপত্তা পরিষদ দুই দেশের সাথে সাক্ষাৎ করবে এবং দুই দেশের প্রতিই আহবান জানাবে যুদ্ধ থামানোর জন্য। যুদ্ধ দ্রুত শেষ হয়ে যাবে নাকি দীর্ঘ সময় ধরে চলবে তা নির্ভর করবে ভারতের উপর। এই পর্যায়ে ভারতের চেষ্টা করতে হবে যাতে করে বাংলাদেশ এই দ্বন্দ্বের মাঝে একটি স্বীকৃত পক্ষ হিসেবে পরিচিতি পায়। প্রকৃতপক্ষে, এটাই বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার যথাযথ উপায়। আর একটা জিনিস সবার কাছে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিতে হবে,যুদ্ধবিরতি চুক্তি ততক্ষন পর্যন্ত স্বাক্ষর হবে না যতক্ষন পর্যন্ত না বাংলাদেশের কমান্ডারকে একজন স্বাধীন সেক্টর কমান্ডার হিসেবে গন্য করা হচ্ছে। সেই সাথে বাংলাদেশ সরকারকে একটি স্বতন্ত্র পক্ষ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যবস্থাও করতে হবে।”

 

১৩ই জুলাই,”লন্ডন টাইমস” পত্রিকাটি থেকে উদ্বৃতিটি সম্পূর্ণরূপে রিপোর্ট করা হয়েছিল। পুনরায় বলছি, এখানে সন্দেহ করার কোন অবকাশই নেই যে সরকারী নীতির সাথে কোন সামঞ্জস্য ছিল।

অক্টোবরে, ইন্ডিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রী, মিঃ জাগজিভান রাম এর কাছে উদ্বৃতি  করার জন্য পুনঃ পুনরায় ক্ষমা পারথি, যদিও তার বাচালতায় কিছু দরকারি উপাদান দিয়ে সাজানো কিন্তু এখানে চিন্তা করা যাবে না যে বিষয়গুলো সরকারের চিন্তাভাবনা প্রকাশ করেছে , যদিও তিনি রাষ্ট্রের একজন বিশিষ্ট সদস্য! তার বক্তব্য অনুযায়ী পাকিস্তানের নিজের মাটিতে যে কোন যুদ্ধে এবং ইন্ডিয়া উক্ত সমস্যার সময় দখলকৃত অঞ্ছল খালি করবে না। তিনি আরও বলেন , “ আমরা প্রয়োজনে লাহোর এবং শিয়ালকোট পর্যন্ত যাব এবং যে কোন ফলাফলেই পিছনে ফিরে আসব না।“

এটা পরিষ্কার যে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যায় ইন্ডিয়া যুদ্ধমান অবস্থার মাত্রা দিয়েছে অন্যথায় যা কখনোই হতো না। বলা যায় এই সমস্যাটি আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির আলোকে করা। এই সঙ্কটটি যা আমরা এই বছর সম্মুখীন হয়েছি তা আমাদের দেশের জন্য সর্বোচ্চ সমস্যা। কিন্তু আমি কি প্রশ্নও করতে পারি না যে অন্য জাতিটি যারা এখন সংযোগের মডেল তারা নিজেরাও অতীতে একই আঘাতমূলক অভিজ্ঞতার মাঝে অতিবাহিত করেছে ? একটাই পার্থক্য যেতারা আন্তর্জাতিক প্রচারের বিকৃতি থেকে পলায়ন করতে পেরেছে যার শিকার আজ পাকিস্তান। অন্য এবং বৃহত্তর পার্থক্য হলও তারা তাদের প্রতিবেশী দ্বারা আক্রান্ত হয়নি। যারা প্রথমে তাদের অসামরিক বিবাদ কে উদ্দিপিত করে এবং তা আরও বর্ধিত করে এবং পরবর্তীতে আগ্রাসন সংঘটিত হয় যেমনটি ইন্ডিয়া আমাদের বিষয়ে করেছে।

২০শে জুলাইয়ের স্মারক লিপিতে সাধারণ- সচিব, নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতিকে উল্লেখ করে বলেন,……………

“…………সমস্যাটি দীর্ঘকাল স্থায়ী এবং অমীমাংসিত ভাবে ইন্ডিয়া –পাকিস্তানের মাঝে বিছানো হয় যার ফলে যুদ্ধ বিগ্রহ খেলা বৃদ্ধি পেয়েছে, এবং তা শুরু হয় মাত্র ছয় বছর আগে।“

১৯৪৮ সাল থেকে নিরাপত্তা কাউন্সিলের কাছে ইন্ডিয়া- পাকিস্তান প্রশ্নটি একটি বিষয়সূচি হয়ে আছে। জম্মু এবং কাশ্মীর রাজ্যের উপর দুই রাষ্ট্রের বিন্যাসের অসমাপ্ত বিষয়ে বিরোধ নিরাপত্তা কাউন্সিলে শতাধিক সভা আলোচনা করা হয়েছে এবং এই বিষয়ে ২২টির অধিক রেজুলেশন এবং ২ টি বিবৃতিতে নিরাপত্তা কাউন্সিলের ঐক্যমত দেওয়া হয়। আমাকে বিষয়টি পরিষ্কার করে বলতে দিন যে ভারত পাকিস্তানের মাঝে কখনোই শান্তি স্থাপিত হবে না এবং  হ্যাঁ আমি “শান্তি” শব্দটি ব্যবহার করছি। যুদ্ধের অনুপুস্থিতিতে এই বিতর্ক সমাধান ইন্ডিয়া পাকিস্তানের ইচ্ছায় হবে না; না কোন বৈদেশিক শক্তির অথবা জোট শক্তির ইচ্ছায় হবে । কিন্তু জাম্মু এবং কাশ্মিরের ইচ্ছায় তা সমাধান হবে। একটি বিদ্যমান আন্তর্জাতিক চুক্তি যা জাতিসংঘের পৃষ্ঠপোষকতায় সমাপ্ত হয়। জাতিসংঘের পৃষ্ঠপোষকতায় রাষ্ট্রের বিন্যাস নির্ধারণ করা হবে নিরপেক্ষ গণভোটের দ্বারা। ইন্ডিয়া এই চুক্তি বাস্তবায়নে নিরবিচ্ছিন্নভাবে অস্বীকার করেছে। এই সহজ কারনে ইন্ডিয়া –পাকিস্তান গত ২৩ বছরে কখনো সহজ হতে পারে নি যদিও পুরো পৃথিবী হয়ত কাশ্মীর বিতর্ক ভুলে গেছে কিন্তু তা না কাশ্মিরের জনগন ভুলেছে আর না তা পাকিস্তানের সহধর্মীরা কখনো তা ভুলবে। যদিও বিতর্কটি কিছুই না কিন্তু ইন্ডিয়ার উগ্র জাতিয়তাবাদ এবং পাকিস্তানের সাথে ন্যায়সঙ্গত বন্দোবস্ত অস্বীকার যা স্থায়িত্তের ভিত্তিতে দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক তৈরি করত।

এই বছর এর ঘটনাগুলিই ইন্ডিয়া -পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ বিগ্রহের মুল কারন নয়। যেমন, পাকিস্তানের আন্তর্জাতিক অধিকার এবং প্যাসিফিক উপনিবেশের পরিচিত পদ্ধতি অনুসারে দুই দেশের মধ্যে অসামান্য বিষয় সমাধান করতে অস্বীকার। দক্ষিণ এশিয়ার এই দুই প্রতিবেশীর মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক অবস্থায় একটি জাদুর কাঠির তরঙ্গের মাধ্যমে আসবে না, ঘোষণার সঙ্গেও না, কোন না- যুদ্ধ চুক্তির সঙ্গেও; কিন্তু উভয় পক্ষের ঘর্ষণ পরিস্থিতির সমাধানে তৈরি থাকাই বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য নামমাত্র উপায়। জাতি সংঘে পদ্ধতি ৩৩ নিযুক্ত করা হয়েছিল তালিকা তৈরির জন্য।

পাকিস্তান সরকার ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দ্বারা যুদ্ধ বিগ্রহের অগ্ন্যুৎপাত এড়াতে সকল পস্তাব অবশ্যই উত্তর দিয়েছিল যার দ্বারা ইন্ডিয়া- পাকিস্তানের পরিস্তিতির শান্তি পূর্ণ সমাধান হবে। কিছু মাস পূর্বে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ইন্ডিয়ার প্রধান মন্ত্রীর সাথে যেকোনো সময় যে কোন স্থানে দেখা করার জন্য তৈরি ছিলেন। ইন্ডিয়ার  কাছ থেকে এর প্রত্রিক্রিয়া সম্পূর্ণে নেতিবাচক ছিল। ২০শে নভেম্বর, পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ইন্ডিয়ার জন্য বন্ধুতের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল এবং এর উত্তরে তার পরের দিন থেকে পাকিস্তানের উপর সশস্ত্র হামলা চালু করেছিল।

 সর্বশেষ, ২০শে অক্টোবর , নিরাপত্তা পরিষদ থেকে সচেতন হয়ে সাধারণ সচিব পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি এবং ইন্ডিয়ার প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে একটি চিঠি পাঠান যেখানে তিনি বলেন,

“ এই সম্ভাবনাময় বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে সাধারণ সচিব হিসাবে  আমি মনে করি এটা আমার কর্তব্য তাৎক্ষনিক ভাবে সরকারকে সাহায্য করা যাতে দূযোগ হতে পারে টাইপ অবস্থায় যে কোন ধরনের বিপর্যয় এড়ানো যায়। আপনার মহত্ত জানতে আমি ইচ্ছুক, যে আমার দক্ষ দপ্তর আপনার কর্মে সম্পুরনভাবে আছে, যদি আপনি বিশ্বাস করেন যে তারা যে কোন সময় সহায়ক।

পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি অবিলম্বে প্রস্তাবটিকে স্বাগত জানানসাধারন-সচিবকে আলোচনা করার জন্য , এবং ইন্ডিয়া- পাকিস্তান সফর এবং উভয় পক্ষের উভয় সীমা থেকে শক্তি সমূহকে তুলে নেয়ার জন্য। কিন্তু কি প্রতিক্রিয়া ছিল ইন্ডিয়ার ? ১০ই নভেম্বর , সাধারণ সচিব চিঠির উত্তর দেন। প্রতিদিন বৃদ্ধিমান চাপা উত্তেজনাময় পরিস্থির ২৭ দিন পরে এবং তার চিঠিতে অভিযোগ ছিল যে “ পাকিস্তান গুরুতর ভাবে ইন্ডিয়ার সাথে বড় আকারের সংঘাতের প্রস্তুতি নিচ্ছে।”

এখন যদি অভিযোগটা সঠিক হয় তাহলে উপমহাদেশ পরিদর্শন করতে সাধারণ সচিবকে আমন্ত্রন করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রন করাটা আরও যুক্তিপূর্ণ হতো। কিন্তু ইন্ডিয়ার প্রধান মন্ত্রী ঐ আবস্থায় সাধারণ সচিবের দক্ষ সহায়তায় সমস্যা অতিক্রম করতে পারত। তিনি সনিনয়ে কিন্তু ভ্রান্ত ভাবে দাবী করেন, সাধারণ সচিব এর “সমস্যাটি দৃষ্টান্ত রুপে দেখা এবং তিনি পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেছেন পূর্ব পাকিস্তানে সমঝোতা তৈরির মাধ্যমে।  বলা বাহুল্য , বার্তাটি ছিল, সাধারণ সচিব তখনই আমন্ত্রিত যদি তিনি ইন্ডিয়ার রাজনৈতিক পরিকল্পনা সম্পাদন করতে পারেন, অন্যথায় নয়।

কিছু সপ্তাহ ভারতীয় ঘোষণাগুলোর মধ্যে বিরত ছিল যে, ভারতের সঙ্গে পাকিস্তান বড় মাপের সংঘর্ষের প্রস্তুতি নিচ্ছে ।কিন্তু অক্টোবরে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি উভয় দেশের সীমানা থেকে পারস্পরিকভাবে পিছিয়ে আসার প্রস্তাব করেন। যদি ইন্ডিয়ার নেতাদের  তাদের নিজেদের তৈরি প্রচারনার উপর বিশ্বাস থাকে তাহলে তাদের অবশ্যই প্রস্তাবটি স্বাগত জানানো উচিত। কিন্তু ইন্ডিয়ার প্রধানমন্ত্রী এই ভিত্তিতে সংক্ষেপে বাতিল করেছিলেন যে “ সীমান্তে পাকিস্তানের যোগাযোগের লাইন ভারতের লাইনের চেয়ে সংক্ষিপ্ত ছিল।”

বিতর্ক এড়াতে মঙ্গলকামী পাকিস্তানী রাষ্ট্রপতি তার পরামর্শ পরিবর্তন করেন এবং তিনি বলেন যে যদি শান্তির সময় ঘাটি প্রত্যাহার করা সম্ভব না হয়ে থাকে তাহলে অন্তত সৈন্য ও তার সাথে সাথে অস্ত্রশস্ত্র এবং কামান উভয় পাশের সীমান্তের সম্মতিতে নিরাপদ দূরতে সরিয়ে রাখা যেতে পারে যা উভয় পক্ষেরই নিরাপত্তা প্রদান করে।

এর চেয়ে কিছু ন্যায্য হতে পারে? আরও ভালো কোন জামিন প্রমান করতে পারে যে পাকিস্তান ইন্ডিয়া র সঙ্গে যুদ্ধ এড়াতে চাচ্ছে ? সংক্ষেপে বলা যায় বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবেলায় নিরাপত্তা পরিষদের এক সদস্য রাষ্ট্র সকল ধারনা অবলম্বন করে সর্বোতমউপায়ে সশস্ত্র আক্রমন করে অন্য সদস্য রাস্ত্রকে ভেঙ্গে ফেলেছে। ইন্ডিয়ার আক্রমন সফল হতে পারত যদি না পাকিস্তান তার বিরোধিতা করত । পাকিস্তান তার অধিকার পরিত্যাগ না করে উপযুক্ত পাল্টা ব্যবস্তা গ্রহন করে। এখন নিরাপত্তা পরিষদ ইন্ডিয়ার আগ্রাসী যুদ্ধ ক্ষান্ত করতে উপায় খুজছে । একমাত্র নিরাপত্তা পরিষদ চিন্তিত আমাদের স্বাধীনতা, সারভোমত্ত ও অখণ্ডতা নিয়ে এবং সঙ্গে সঙ্গে সামঞ্জস্য পূর্ণ সদস্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার নীতি  যা আমার সরকারকে সমর্থন ও সহযোগিতার আদেশ দিচ্ছে।

শেষ করার পূর্বে আমি কিছু বিতর্কের উপর পর্যবেক্ষণ করতে বাধ্য হচ্ছি যে এই কাউন্সিলে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিনিধির প্রস্তাব উঠেছিল যেখানে তথাকথিত অস্তিত্তের জন্য প্রতিনিধিদের আমন্ত্রন করা হয়। ……… ভারতের প্রতিনিধি অকেজো ছিল যখন সে এই প্রশ্নে হস্তক্ষেপ করে কারন একমাত্র নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য পদ্ধতিগতবিতর্কে অংশ গ্রহন করতে পারেন । কার্যপ্রণালী রুল ৩৯ আমন্ত্রন প্রসারিত করতে উদ্যত হয়েছে। কিন্তু আমি নিরাপত্তা পরিষদকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে কার্যপ্রণালী রুল অবশ্যই অধস্তন এবং অনুগত হতে হবে জাতিসংঘের সনদ প্রবন্ধের এবং সনদের একটি মৌলিক নীতি হল যে সদস্য রাষ্ট্রের অখণ্ডতা । কার্যপ্রণালী কাউন্সিলের নিয়ম ৩৯ এর অধীনে কোন পদক্ষেপ যা এই মৌলিক জাতিসংঘের এবং নিরাপত্তা পরিষদের সনদের নীতি কে বিপরীত দিকে পরিচালিত করে কারন নিরাপত্তা পরিষদকে তার নিয়ম ব্যাখ্যা করতে হবে সনদের মৌলিক বিধান দৃঢ়তা করতে ।

তথাকথিত প্রতিনিধিদলকে প্রস্তাব প্রশ্নে আমন্ত্রন জানানো আপাতদৃষ্টিতে শুধুমাত্র তা নির্দোষ মনে হয় । আমাদেরকে বলা হয়েছে যে কাউন্সিলের তথ্য দ্বারা নেতৃত্ব স্থানীয় অধোগামী ইন্ডিয়া পাকিস্তানের মধ্যে সংঘর্ষের পরিস্থিতি বিষয়ে উপকৃত হবে।

কিন্তু এই ধরনের তথ্য দিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের সব সদস্য এবং সাধারণ পরিষদ এবং বেসরকারি  সংগঠনের উপচিয়ে উপাদান তথাকথিত বিশেষ সত্তার প্রতিনিধিদের কাছে উপস্থাপিত হয়েছে এবং প্রেসের কাছে যে কোন উদ্দেশে কার্যকরী ভাবে স্বীকৃতি দান এবং নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য দ্বারা নথি পরিবেশিত ।

আমি বলছি যে এই প্রস্তাব আপাতত দৃষ্টিতে নির্দোষ ,  কারন মৌলিক ভাবে এটার অর্থ হবে যে একটি আঘাত। এই ধরনের তথাকথিত প্রতিনিধিদের দ্বারা নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য রাষ্ট্রের অখণ্ডতা আঘাত পাবে এবং পাকিস্তানকে স্বীকৃত এই ধরন অনুসারেই বিভাজন করার চেষ্টা করেছিল।

ইন্ডিয়ার প্রতিনিধি দলের পক্ষ থেকে এই সত্তা তাদের প্রচারিত নথি যা এখন এই কাউন্সিল টেবিলে উপবিষ্ট করা এবং শুনানির দাবী করা হচ্ছে ? এটা ইন্ডিয়ার কিছু মানুষদ্বারা মতলব করা , সংগঠিত করা এবং প্রতিষ্ঠিত করা । একটি দেশ যারা ধংস বহন করে আনছে, এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অপসরন এবং বিরুধাচরন করেছে। এবং  এই দলের মানুষদের কোলকাতায় আসন আছে। আমরা আরও জানি নিউ ইয়র্ক ঠিক এখানে সংগঠনের আরও কিছু সংখ্যা আছে এবং এর সত্তা নিশ্চিত ভাবে বৈধ সরকারের নাম গুলোতে কথা বলতে দাবী করে অথবা তথাকথিত বৈধ সরকার তারা আমাদেরকে উপচিয়ে পড়া  উপাদান এবং অনুরোধ করে যাতে জাতি সংঘের বিভিন্ন সরকারী ডকুমেন্ট হিসাবে প্রচার করা হয়।আমাদের কি এই লঙ্ঘনের এই নীতিগুলো তাদের অনুরোধের সঙ্গে মেনে চলার এই অনুশীলনটি অবলম্বন করতে শুরু করা উচিত ?

এই বিবাদটি করা হয়েছে যে নিরাপত্তা পরিষদের একটি মিটিং এর জন্য। নয় (৯) প্রতিনিধিদলকে জিজ্ঞাসা করে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে……… সম্প্রতি নিম্নগামী পরিস্থিতি যেটি ইন্ডিয়া এবং পাকিস্তানের মধ্যে সশস্ত্র সংঘর্ষের নেতৃত্ব দিয়েছে  (এস / ১০৪১১ )। নয়(৯) প্রতিনিধিদলকে মিটিঙের জন্য করার পরিস্থিতি কি ছিল? পাকিস্তানের পরিস্তিতি ২০শে জুলাই এর স্মারক লিপিতে নিরাপত্তা পরিষদ (বি)} সাধারণ সচিব এর সদস্য বৃন্দের মনোযোগ আনা হয়েছিল, নভেম্বরে পুনরায় নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য বৃন্দের তথ্যের ভিত্তিতে দেখা করতে অস্বীকার করেছিল যে এবং সেই ঘটনা সাধারণ সচিব দ্বারা সরবরাহ করা হয়েছিল যদিও স্পষ্টভাবে তা ছিল না বরং সনদের দ্বারা ৯৯ এর অধীনে তার দায়িত্ব পালন করেছে, দলিলের অধীনে তার দায়িত্ব পালন করেছে, দলিলের অধীনে আর কোন বিধান নেই যাতে সাধারণ সচিব এই পরিস্থিতিতে শান্তি এবং নিরাপত্তার জন্য কোন অনুভুতি আনতে পারেন। পরিস্থিতি এখন (৯) প্রতিনিধি দলের চিঠির উপলক্ষ ছিল। যা গতকাল বিস্ফোরণ হয় এর কারন ইন্ডিয়া পাকিস্তানের মাঝে পূর্ণ পাত্রার শত্রুতা। আমি দাখিল করব যে নিরাপত্তা পরিষদের এই ডকুমেন্টটি যথাযথভাবে ব্যাখ্যা করা উচিত এবং শুধুমাত্র অতীত ঘটনা সম্পরকের প্রভাবে নয় কারন এটা চিন্তা করা হয়নি যে সাধারণ সচিবের দ্বারা নিরাপত্তা পরিষদ এই অবস্থাটি বিবেচনা করা হবে।

পরিশেষে আমারা বিশ্বাস করি উদ্বাস্তু সমস্যা একটি মানবিক সমস্যা। আমরা যে কোন কিছু করতে তৈরি আছি যা আন্তর্জাতিক সংস্থা আমাদেরকে করতে অনুরোধ করেছে  মানবিকতার ভিত্তিতে যাতে সম্মানের সাথে তাদের প্রত্যাবাসন এবং জীবনের নিরাপত্তা ও  সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়। এখন বলতে হয় যে উপমহাদেশের এই পরিস্থিতিতে যখন ৭০০ মিলিয়ন জনগণকে যুদ্ধের শিখায় আচ্ছাদন করা হয়।  উদ্বাস্তু যারা ইন্ডিয়া তে  আছে তাদেরকে নিরাপত্তা পরিষদের পূর্বের প্রতিনিধিত্তের সাথে এর ধরন একই হওয়া উচিত। এই বিষয়টি যা খুবই  অভূতপূর্ব যে নিরাপত্তা পরিষদ এর কার্যের ফলাফল গভীর ভাবে বিবেচনা করা হবে। আমি একটি দাখিল তৈরি করেছি যে নিরাপত্তা পরিষদের কার্যকর্ম সনদের মৌলিক নীতির দায়িত্ব এবং সম্মানের সাথে চিন্তা রেখে পরিচালিত হয়। এবং একটি বিপজ্জনক নজির নিযুক্ত করা উচিত  এবং পাকিস্তান নিরাপত্তা পরিষদ এবং জাতি সংঘের কো -অপারেশন  গুরুতরভাবে পুনরায় মূল্যায়ন করবে।

Scroll to Top