<৪,৭৪,১৩০-১৩২>
অনুবাদকঃ ইফতি
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৭৪। নেদারল্যান্ডের দৈনিক ‘DE TIJD’-এ প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিস্থিতির উপর নিবন্ধের অনুবাদ সংবলিত ‘ফ্যাকট শীট-১৮’ | বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের বুলেটিন | ৩০ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১। |
বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গ্রেট বৃটেন
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ
৩৫ গ্যামেজ বিল্ডিং
১২০ হলবর্ন, লন্ডনইসি১
ফোন: ০১–৪০৫৫১৭
তারিখ: ৩০.৯.৭১
ঘটনার বিবরণ–১৮
নিচে অ্যামস্টারড্যাম এর দে টাইড(নেদারল্যান্ডস-এ সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক)- এ ১৪ই সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্রকাশিত একটি কলামের অনুবাদ প্রকাশিত হলো।
আন্তরিক শ্রদ্ধা?
আইরি কুইপার
দে টাইড, অ্যামস্টারড্যাম
শিরোনাম: আন্তরিক শ্রদ্ধা? (মন্তব্যে আইরি কুইপার)
কলাম: বিভিন্ন সময়ে।
১৪-৯-৭১
“পাকিস্তান দূতাবাস রাজতান্ত্রিক ডাচ সরকারের পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন এবং দে টাইড ,অ্যামস্টারড্যাম-এ এপ্রিল ২২, ১৯৭১ ‘বিভিন্ন সময়ে’ শিরোনামে প্রকাশিত নিবন্ধটি মন্ত্রণালয়ের নজরে আনতে পেরেছেন। এই নিবন্ধটি পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য দেয় এবং আর্টিকেলটির লেখক পাক রাষ্ট্রপতি সম্পর্কে সবচেয়ে দুর্বিনীত, অবমাননাকর এবং মানহানিকর ভাষা ব্যবহার করেছেন। এবং তিনি পাক সরকারের বিরুদ্ধে ঘৃণার বীজ বপন করেছেন। নেদারল্যান্ডসের মতো একটি দেশ যার সাথে পাকিস্তান বন্ধুত্বপূর্ণ ও সুখী সম্পর্ক বজায় রাখে, তাতে এমন একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হতে পারে, এ ব্যাপারে পাক দূতাবাস ‘আহত ও ব্যথিত’। পাক দূতাবাস এই কলামের প্রকাশনার বিরুদ্ধে দৃঢ় প্রতিবাদ জানাচ্ছে এবং আশা করছে যে এই বিষয়ে মন্ত্রণালয় ‘যথাযথ ব্যবস্থা’ গ্রহণ করবেন।
“পাক দূতাবাস রাজতান্ত্রিক ডাচ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাথে এর সুসম্পর্ক নিশ্চিত করতে এই সুযোগ লুফে নিচ্ছে।”
পাক দূতাবাস পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কাছে কয়েক মাস আগে এই চিঠিটি পাঠিয়েছে। মাননীয় রাষ্ট্রদূত “কেউ যদি তা ব্যাখ্যা করতে পারেন” শিরোনামে আমার লেখা একটি নিবন্ধে রুষ্ট হয়েছিলেন।
আমার শেষ বক্তব্য ছিলো: “ভবিষ্যত যদি গৌরবান্বিতও হয়, শান্তি, সুখ ও ন্যায়বিচারে পরিপূর্ণ হয় বিশ্ব, তারপরও তা পূর্ব পাকিস্তান, বায়াফ্রা এবং ভিয়েতনামের জনগণের কোনোই কাজে আসবেনা। তারা কেবল একবারই বাঁচবে এবং কেন তাদের এভাবে ভুগতে হবে তা কেউই তাদের কাছে ব্যাখ্যা করতে পারবেনা।”
এ অংশটি অবশ্যই রাষ্ট্রদূতের ক্রোধের কারণ নয়। তিনি সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি নিয়ে অসন্তুষ্ট ছিলেন; কিন্তু সত্যি বলতে, তা মোটেই আমার উদ্দেশ্য ছিলো না। লেখাটিকে কেবল তখনই খারাপ বলা যেত, যদি তিনি তাতে সন্তুষ্ট হতেন।
বিশেষত পাক রাষ্ট্রপতি জেনারেল ইয়াহিয়া খান সম্পর্কে আমি যা লিখেছিলাম, মহামান্য রাষ্ট্রদূত তাতেই ক্ষুব্ধ। নিজের লেখার উদ্ধৃতি দেওয়া অসারত্বের পরিচায়ক, কিন্তু এবার আমার সপক্ষে একটি ভালো যুক্তি আছে। আমি লিখেছিলাম: “ইয়াহিয়া সেই ব্যাক্তি যে পূর্ব পাকিস্তানিদের অবদমিত রাখতে তার সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন। আমরা তাকে একজন খলনায়ক হিসেবেই বিবেচনা করে থাকি, একজন বিশৃঙ্খল অপরাধী যাকে গ্রেফতার করা উচিত, যাকে যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত করা উচিত, অথবা অন্ততপক্ষে পাগলাগারদে রাখা উচিত, কারণ তিনি উম্মাদ হয়ে থাকতে পারেন, তা নাহলে তিনি এমন নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিতে পারতেন না: হাজার হাজার, লাখ লাখ স্বদেশী জনগণের ওপর ঠান্ডা মাথায় খুনো মনোবৃত্তি নিয়ে আক্রমণ চালানো, রাষ্ট্রপতি হিসেবে যাদেরকে কিনা তার রক্ষা করার কথা! প্রকৃতপক্ষেই, এমন একজন মানুষ অবশ্যই অপরাধী।”
এছাড়াও আমি সানডে টাইমস-এর একজন সাংবাদিককে উদ্ধৃত করেছিলাম, যার মতে ইয়াহিয়া বাস্তবিকই এই ধারণায় বিশ্বাসী ছিলেন যে, যেকোনো মূল্যে পাক একতা রক্ষা করা তার দায়িত্ব। আমি লিখেছিলাম: “তিনি অনুধাবনই করতে পারছেন না যে তিনি কোনো অপরাধে অপরাধী। ক্ষমতার সর্বোচ্চ শিখরে থেকেও তিনি ক্ষমতার ব্যবহার সম্বন্ধে অবগত নন”। এবং: “বিশ্বের বর্তমান অরাজক পরিস্থিতির কারণেই তা সম্ভব হচ্ছে।“
এরই মধ্যে আমরা পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি সম্পর্কে বহু কিছু জানতে পেরেছি। আমি ২২ এপ্রিল যা ভেবেছিলাম, পরিস্থিতি তার চেয়েও অনেক খারাপ। শরণার্থীর সংখ্যা আনুমানিকভাবে প্রায় আশি লাখ, বা এক কোটি। শত শত মানুষ প্রত্যক্ষদর্শী; পাক রাষ্ট্রপতি পূর্ব পাক জনগণের প্রতি কেমন আচরণ করেছে, তা তারা বিশ্বকে জানিয়ে দিয়েছে।
আমেরিকান সাপ্তাহিক নিউজউইক “পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা” শিরোনামে পাক রাষ্ট্রপতির কর্মকান্ড বিষয়ে এক বিশাল প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। মলাটে ছিলো রুগ্ন এক পূর্ব পাকিস্তানি শিশু, পিতৃমাতৃহীন, ভুখা-নিরন্ন, নিরাশ (আমরা কেনো বেঁচে থাকি, যদি আমরা শিশুদের ভোগান্তির শিকার হতে দেই?)- কিন্তু মহামান্য রাষ্ট্রদূত বিন্দুমাত্র মাথা ঘামান না এ ব্যাপারে। তিনি শুধু চান ডাচ সরকার “যথাযথ ব্যবস্থা” নিক, চান না পূর্ব পাকিস্তানি শিশুদের দুর্দশার কবল থেকে বাঁচাতে, চান শুধু এই নষ্ট পৃথিবীর অগণিত মানুষের অনুভূতি: ক্রোধ ও হতাশা প্রকাশে একজন সাংবাদিককে বাধা দিতে, কারণ এ সব আমাদের চোখের সামনেই ঘটছে অথচ আমরা কিছুই করতে পারছি না।
একটি কাজই শুধু আমাদের করার আছে, তা হলো বিশ্ববিবেক, ৩০০ কোটি মানুষের বিবেককে নাড়া দেওয়া, যতক্ষণ না পর্যন্ত বিশ্ববিবেক এতোটা দৃঢ় ও অদম্য হয়ে উঠবে যে তা ইয়াহিয়া খানের মতো অযোগ্য রাজনীতিবিদদের কর্মকাণ্ড থামাতে সফল হবে। কিন্তু তারপরও: “এসব মানুষ শুধু একবারই বাঁচবে, এবং কেনো তাদের এমন ভোগান্তির শিকার হতে হবে তা কেউই তাদের কাছে ব্যাখ্যা করতে পারবেনা।”
যদি পাকিস্তান সরকার হেগ-এ তাদের দূতাবাসের প্রতিনিধিত্বে আমাকে অভিযুক্ত করতে চায়, একই সাথে তাদের অভিযুক্ত করতে হবে নিউজউইক (উদাহরণ হিসেবে বলছি), নিউ ইয়র্ক টাইমস-কেও, যারা ১ আগস্ট ইয়াহিয়ার “অমানবিক নীতি” এবং “নিয়মতান্ত্রিক গণহত্যা, ধর্ষণ এবং হিন্দুদের ভারতে নির্বাসন” নিয়ে লিখেছে।
এছাড়াও তাদের অভিযুক্ত করতে হবে সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি-কে, যিনি ১৬ আগস্ট নয়াদিল্লীতে ঘোষণা করেছেন যে পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা চালাচ্ছে। এবং বিশ্ব চার্চ কাউন্সিল-কে, যারা ভারতে শরণার্থীদের প্রত্যক্ষ করেছে এবং নিশ্চিত করেছে যে পাক বাহিনী “সবচেয়ে ভয়াবহ নির্দয়তা” সংঘটন করেছে।
কিন্তু নিম্নসাক্ষরিত এবং দে টাইড-কে সম্ভবত অভিযুক্ত করা হবে না। অ্যামস্টারড্যামে পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রণালয় একজন পাবলিক প্রসিকিউটরের কাছে চিঠিটি পাঠিয়ে দিয়েছে। তিনি আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য সিআইডি-কে নির্দেশ দিয়েছেন। আমি সিআইডি অফিসারদের তাদের প্রতিবেদনে অন্তর্ভুক্ত করতে বলেছি যে, নিবন্ধে আমার মতামত “পাক রাষ্ট্রপতির প্রতি অপমান নয়, বরং তার নীতির একটি সংজ্ঞায়িত সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ।”
এ ঘটনা ঘটেছে ছয় সপ্তাহ আগে এবং তখন থেকে আমি তাদের কাছ থেকে আর কোনো খবর পাইনি।
কেসটি সম্ভবত তুলে রাখা হয়েছে। দু;খের বিষয়, কারণ আমি বিচারকের কাছে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছিলাম যে, পাক দূতাবাস পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য দিচ্ছে, এছাড়াও আমি “আহত ও ব্যথিত” এ ব্যাপারে যে, এমন নির্লজ্জ অপমানজনক ও মানহানিকর নীতি পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি অনুসরণ করতে পারেন, যার সাথে নেদাল্যান্ডস এমন বন্ধুত্বপূর্ণ এবং সুখী সম্পর্ক বজায় রাখে।
আমি এছাড়াও বলতে চেয়েছিলাম যে, রাষ্ট্রপতি খান আমার সবচাইতে প্রাথমিক মানবিক অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছেন, যে তিনি পাক সরকারের বিরুদ্ধে ঘৃণার বীজ বপন করছেন। তার নীতির বিরুদ্ধে আমি দৃঢ় প্রতিবাদ জানাতাম এবং এই আশা ব্যক্ত করতাম যে এ ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
কিন্তু আমি হয়তো তাতে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতের সাথে আমার সুসম্পর্ক নবায়নের সুযোগ হারাতাম।”