শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১00। পত্র-পত্রিকায় রণাঙ্গন সংবাদ | —— | জুলাই – ডিসেম্বর ১৯৭১ |
কম্পাইল্ড বাই – Aparajita Neel
<১১, ১০০, ৬৪০–৭৭৩>
একজন পাকসেনা থাকা পর্যন্ত মুক্তিফৌজের সংগ্রাম চলবে
মুজিবনগর। মুক্তিফৌজের দুই রনাজ্ঞনের কমান্ডার দ্বয় মেজর খালেদ মোশাররফ ও মেজর জিয়াউর রহমান এক সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে বলেছেন, বাংলাদেশের পবিত্র মাটি থেকে পাক সামরিক বাহিনীর একেবারে চলে না যাওয়া পর্যন্ত দেশের পরিস্থিতি কখনো শান্ত হতে পারে না এবং ততদিন পর্যন্ত মুক্তি ফৌজ এর সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে।
তারা দুইজনেই ইয়াহিয়ার ভাষণকে ডাহা মিথ্যার ছড়াছড়ি বলে আখ্যায়িত করেন।
রণাঙ্গনে
যতোই দিন গড়িয়ে যাচ্ছে আমাদের মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যোদ্ধারা হানাদার পশ্চিম পাকসেনাদের ওপর আক্রমণাত্মক তৎপরতা ততই জোরদার করে তুলেছেন। গত তিন মাসে হানাদার সেনারা যেভাবে চরম মার খেয়েছে তাঁর একটা ছোট্ট প্রমাণ মেলে বি বি সি র প্রচারিত সংবাদ মাধ্যমে। গত ২৪ শে জুন সন্ধ্যা সোয়া আটটার সংবাদ প্রবাহে বি বি সি র সংবাদ দাটা ঢাকা থেকে বলেছেন, ‘বাংলাদেশে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পড় মুক্তিবাহিনী গেরিলাদের হাতে পাক বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতির যে তথ্য আমি সংগ্রহ করেছি তার ভগ্নাংশ সত্য হলে তা হবে ভয়াবহ।’ অন্যদিকে রয়টারের সংবাদ দাতা হাওয়ার্ড হুইটেন জানাচ্ছেন, ‘প্রতিদিন ৫০/৬০ জন আহত পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যকে চিকিৎসার জন্য ঢাকার হাসপাতালে নিয়ে আসা হচ্ছে। বিদেশী কূটনীতিকদের মতে বাংলাদেশের দখলকৃত ঢাকায় হানাদার পাকসেনাদের বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণাত্মক তৎপরতা প্রতিদিন জোরালো হচ্ছে।’
সাতক্ষিরায় ৬০০ জন নিশ্চিনহ
সাতক্ষিরায় মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে ৬০০ শত্রুসেনা নিহত হয়েছে। এছাড়া মোট ২৬ টি আক্রমণে তারা ৩০০ জন পাকসেনাকে খতম করেন। ভোমরা, পারুলিয়া, মাহমুদ পুর, খুস খুসকুলি, শ্রীপুর ও কাক ডাঙ্গায় আক্রমণ চালানো হয়।
ফেনীতে প্রচণ্ড সঙ্ঘর্ষে ৫ শতাধিক শত্রুসেনা খতম
পূর্বাঞ্চল সেক্টরের ফেনী মহকুমায় গত এক পক্ষ কালের প্রচণ্ড সঙ্ঘর্ষে স্বাধীনতাকামী তরুণ যোদ্ধাদের হাতে প্রায় পাঁচ শত পাকিস্তানী শত্রুসেনা খতম হয় এবং দু শ জন মারাত্মকভাবে আহত হয়।
স্বাধীন বাংলা বেতারের খবরে প্রকাশ, উক্ত সঙ্ঘর্ষে আমাদের মুক্তিসেনাদের ৫০ জন কমান্ডো আহত হন। গত ৪ঠা জুন খান সেনাদের গতিরোধ করারা উদ্যেশ্যে পাঠান নগরের বশিকপুর সেতুতে মুক্তি বাহিনীর পোঁতা মাইনে বিস্ফোরণের পর এ শঙ্ঘর্ষের সূত্রপাত হয় এবং এক পক্ষকাল ধরে এই শঙ্ঘর্ষ চলতে থাকে।
কুমিল্লা রণাঙ্গনে গেরিলা বাহিনীর হাতে প্রায় ৯০ জন খানসেনা নিহত হয়। পরে মুক্তিযোদ্ধাদের তাড়া খেয়ে পাক- ফৌজ কর্নেল বাজারে আশ্রয় নেয়। গত ২২ শে জুন কুমিল্লা মন্দভাগে ৫ জন সৈন্য নিহত হয়।
ঢাকায় বোমা বিস্ফোরণ অব্যাহত
রয়টারের সংবাদ দাতা জানাচ্ছেন, সম্প্রতি জাতিসঙ্ঘ উদ্বাস্তু হায় কমিশনার প্রিন্স সদ্রুদ্দিন আগা খানের ঢাকা সফরের সময় ঢাকায় আট টি বোমা বিস্ফোরিত হয়, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল এর সামনে গেরিলা যোদ্ধাদের গ্রেনেড আক্রমণে একজন আহত হয়। আরেকটি এক্রমনে ৩ জন খান সেনা নিহত হয়।
স্বাধীন বাংলা বেতারের খবরে প্রকাশ, গত ২৩ শে জুন ভোর চারটায় ঢাকা বিমান বন্দরে একটি বোমা বিস্ফোরণের পড় বন্দর পাহারা রত দখলদার দস্যু সৈন্যদের মধ্যে থমথমে ভাব বিরাজ করছে। আমাদের ঢাকা প্রতিনিধি জানাচ্ছে , ঢাকা বিমান বন্দরে বিদেশী সাংবাদিকদের নিয়ে একটি বিমান অবতরণ করার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে বিকট আওয়াজ করে একটি বোমা বিস্ফোরিত হয়। স্বাধীন বাংলাদশের দখলকৃত এলাকায় অবস্থা যে মোটেও স্বাভাবিক নয়, ঢাকার পাতিতে পা দিতেই বিদেশী সাংবাদিকগন তা প্রত্যক্ষ করলেন। হানাদের কড়া পাহাড়া সত্ত্বেও এ ধরনের বিস্ফোরণ হওয়ায় বর্বর পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা বিব্রত হয়ে পড়েছে।
গত সপ্তাহে রাজশাহীতে পর পর তিনদিন সারা শহরে বোমা বিস্ফোরিত হলে খান সেনারা ভীত বিহ্বল হয়ে পড়ে এবং তাদের বড় একটা ছাউনি থেকে বের হতে দেখা যাচ্ছেনা।
রাজশাহী শহর আক্রান্ত
আমাদের স্বাধীনতাকামী তরুণরা রাজশাহী শহরে ঢুকে প্রবল আক্রমণ চালিয়েছেন। মুক্তিবাহিনীর কমান্ডোরা গত রোববার তিন দিক থেকে শহরটিতে প্রবেশ করেন। এসব আক্রমণে পাক সেনাবাহিনী বড় বেকায়দায় পড়েছে। মুক্তিবাহিনী মীরগঞ্জ, চারঘাট ও নবাব গঞ্জ এই তিন দিক থেকে রাজশাহী শহরের মধ্যে ঢুকে পড়ে। এ আক্রমণকালে মুক্তিবাহিনী মর্টার, হাত বোমা ও হাল্কা মেশিন গান ব্যাবহার করেন।
এক খবরে প্রকাশ, মুক্তিবাহিনী ও পাকসেনাদের মধ্যে নোয়াখালী, সোনামুরি ও চট্টগ্রাম রণাঙ্গনেও প্রচণ্ড সঙ্ঘর্ষ হয়। গেরিলা বাহিনী পাকসেনাদের একটি জীপ উড়িয়ে দেয়। তাতে ৬ জন পাকসেনা নিহত হয়। চট্টগ্রামে ও নোয়াখালীতে পাক টহলদার বাহিনীর ৬ জন সৈন্য গেরিলাদের হাতে নিহত হয়।
শনিবারের সঙ্ঘর্ষে ৬০ জন সৈন্য নিশ্চিনহ
মুক্তিবাহিনী গত ২৬ শে জুন রণাঙ্গনে ব্যাপক আক্রমণ চালান। এর মধ্যে এর পূর্বাঞ্চল সেক্টরে কমপক্ষে ৬০ জন শত্রু সৈন্য নিহত হয় এবং আমাদের মুক্তিবাহিনী কিছু অস্ত্র শস্ত্র দখল করে নিয়েছেন।
গত ২২ শে জুন কুষ্টিয়ার একটি গ্রামে মুক্তিবাহিনী গেরিলাদের আক্রমণে ১৬ জন পাক হানাদার খতম হয়েছ। গেরিলাদের সঙ্গে বৈদ্যনাথ তোলা ও কৃষ্ণ নগরের কাছে দুটি আলাদা জায়গায় পাক হানাদারদের ৬ ঘণ্টা ব্যাপী গোলাবিনিময় হয়। উভয় পক্ষই মর্টার নিয়ে আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণ চালায়। খুলনা জেলার গনরাখালিতে পাক সেনা ভর্তি ট্রাকের ওপর গেরিলা বাহিনী আক্রমণ করেন এবং এখানেও কিছু পাক সৈন্য নিহত হয়।
দালালরা খতম হচ্ছে
বিভিন্ন শহর গ্রাম থেকে মুসলিম লীগ ও জামাত ই ইসলামের গুণ্ডা ও হানাদার সৈন্যের পদলেহি দালালদের খতম করার কাজ ব্যাপক হারে শুরু হয়েছে। এর মধ্যে মুক্তিফৌজ পাটকেল ঘাটা, টালা, পাইকগাছা, আশা শুনি, বদর তোলা, কলারোয়া প্রভৃতি স্থানে ১৬ জন দালালকে গুলি করে হত্যা করেছেন।
বাংলাদেশই আমার পরিবার
– মেজর খালেদ
লন্ডনের স্বাধীন টেলিভিশন ‘ওয়ার্ল্ড ইন একশন’ নামক নামক সাপ্তাহিক এক জনপ্রিয় অনুষ্ঠানে সম্প্রতি বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের এক বিবরণ দেয়া হয়েছে। মুক্তিফৌজ নেতা মেজর খালেদ টেলিভিশন রিপোর্টারদের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন – ‘বাংলাদেশে একটি লোকও জীবিত থাকা পর্যন্ত এই সংগ্রাম চলবে বাংলাদেশ থেকে পাকসেনা খতম করে তবে থামব।’
আমেরিকায় ট্রেনিংপ্রাপ্ত জনাব খালেদ গত ১৮ বছর ধরে পাক সামরিক বাহিনীতে ছিলেন। তিনি বলেছেন, ‘পাক বাহিনী হেলিকপ্টার এবং ভারি অস্ত্র শস্ত্র ব্যাবহার করে আমাদের লোকদের মনোবল ভেঙ্গে দিতে চাইছে।’
মেজর খালেদ বলেছেন, ‘পাক বাহিনী বাঙ্গালী মেয়েদের উপর অকথ্য অত্যাচার চালাচ্ছে এবং তাদের শ্লীলতাহানি করছে।’
মেজর খালেদ আরও বলেছেন, ‘মহান সংস্কৃতির ধারণ আমরা। দেশীয় কাব্য ও সাহিত্যের জন্য আমরা গর্বিত। আমরা কোন দিনই হিংসাপরায়ণ ছিলাম না। পাক বাহিনীর অত্যাচারের বদলা নেয়ার জন্যই আমরা হিংসার আশ্রয় নিয়েছি।’
তিনি বলেছেন, ‘বিশ্বাস ঘাতকদের আমরা হত্যা করব। বাংলাদেশে আমরা ক্রীড়ানক সরকার গঠন করেয়ে দেব না। আমরা ন্যায়ের জন্য সংগ্রাম করছি।’
নিজের পরিবার সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন যে, ‘অন্যান্য বহু পরিবারের ভাগ্যে কি হয়েছে আমি নিজের চোখেই দেখেছি। নিজের কথা চিন্তা করার অধিকার এখন আর আমার নেই। বাংলাদেশই আমার পরিবার।’
- জয় বাংলা, ২ই জুলাই ১৯৭১
কুমিল্লা শহর অন্ধকার, বহু স্থানে গেরিলা লড়াই
ঢাকা, ২ রা জুলাই (রয়টার) – ত্রিপুরা সীমান্তের কাছে বাংলাদেশের কুমিল্লা শহরে কার্ফু জারি করা হয়েছে। রাতে সেখানে বিস্ফোরণের সন্দ শোনা যায়। এখানে আগত যাত্রীদের কাছে এই খবর জানা গেছে।
বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্র উড়িয়ে দেবার ফলে কুমিল্লা শহরে পাঁচ দিন ধরে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে।
মুক্তিফৌজ ঐ বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে উড়িয়ে দিয়েছেন বলে স্থানীয় লোকের ধারণা।
সোমবার ইয়াহিয়া যখন বয়েটার ভাষণ দিচ্ছিলেন, তখন কুমিল্লায় কয়েকবার বিস্ফোরণ এর শব্দ শোনা গেছে। ৪ টি প্রচণ্ড বিস্ফোরণের জন্য চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়।
বিমান বন্দর এলাকায় ঐ বিস্ফোরণ হয়েছে বলে প্রকাশ। গত রাত্রেও দশবার বোমা বিস্ফোরণ এর শব্দ হয়েছে।
গেরিলা অভিযান জোরদার
মুজিব নগর থেকে পি টি আই এর খবরে প্রকাশ, বাংলাদেশের সকল রণাঙ্গনে মুক্তিফৌজের গেরিলা অভিযান জোরদার হওয়ায় বহু পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়েছে।
যশোর এলাকায় ২৮ শে জুন মুক্তিফৌজ টহলদারি একদল সৈন্যকে অতর্কিতে আক্রমণ করে। কয়েকদিন আগে রংপুর এলাকার একটি সীমান্ত ঘাঁটি আক্রমণ করে মুক্তিফৌজ একজন পাক সৈন্যকে খতম ও কয়েক জনকে আহত করে।
পাক সৈন্যদের সঙ্গে সহযোগিতা গেরিলারা মুসলিম লীগ ও জামাত ই ইসলামি দলের সমর্থকদের বাড়ি- ঘর জ্বালিয়ে দিয়েছেন। পাটনিতলার উত্তর পশ্চিম সীমান্তে এই ঘটনা ঘোতে। চিল্মারি এলাকার একটি গ্রাম থেকে মুক্তিফৌজ মুসলিম লীগের তিনজন সদস্যকে ধরে নিয়ে গেছেন।
মুক্তিফৌজ ২৬ শে জুন তারিখে একটি পাটের গুদামে আগুণ লাগিয়ে দেয়। সৈন্যদের তিনজন সহযোগী নহত হত।
ঠাকুওগাওয়ে উত্তর -পশ্চিম এলাকায় পাক সেনাঘাটির ওপর মুক্তিফৌজ ২৮ শে জুন আক্রমণ চালান।
শ্রী হট্টে গেরিলা তৎপরতা
জুড়ির কাছে একটি চা কাড়খানা গেরিলাদের দারা আক্রান্ত হয়। সৈন্যদের ৪ জন সহযোগী নিহত হয়েছে। শ্রীহট্টের উররত পূর্বে কোন এক এলাকায় মুক্তিফৌজ একটি সড়ক নষ্ট করে দেন।
কুলিম্মায় পাক সৈন্যরা রেল লাইনের কাছা কাছি গ্রাম থেকে লোকদের সরে যেতে বাধ্য করেছে। গেরিলাদের অতর্কিত আক্রমণ এড়ানোর জন্য এই ব্যাবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
কয়েকদিন পূর্বে কুমিল্লার কাছে একটি সামরিক প্রহরা ঘাঁটি আক্রমণ করে মুক্তিফৌজ ৬ জন পাক সৈন্যকে খতম করেন। আখাঊড়ার কাছে অতর্কিত ভাবে পাক সেনাদের আক্রমণ করায় কয়েকজন পাক সৈন্য হতাহত হয়।
হাজীগঞ্জের পুলিশ সার্কেলে কমান্ডরা সামরিক ঘাঁটি আক্রমণ করায় কয়েকজন আহত হয়।
– যুগান্তর, ৩ জুলাই, ১৯৭১
মুক্তিফৌজ দখলে বহু এলাকা ফিরে আসছে
শিলং, ৩ রা জুলাই মুক্তিফৌজের বহু প্রতীক্ষিত বর্ষা এসে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের বিভিন্ন রণাঙ্গনে শুরু হয়েছে পাক বাহিনীর উপর প্রচণ্ড আক্রমণ। পাক সৈন্যকে এখন আত্মরক্ষার পথ খুঁজতে হচ্ছে। বিভিন্ন রণাঙ্গনে এখন মুক্তিফৌজের আধিপত্য বিরাজ করছে। প্রতিদিনের যুদ্ধে এখন মুক্তিফৌজ সাফল্য অর্জন করছে।
ভারতীয় সীমান্ত থেকে ২৫ কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকার পাক সৈন্যদের বিতাড়িত করায় বাংলাদেশের উত্তর প্রান্তের বহু এলাকা এখন মুক্তিফৌজদের দখলে এসেছে।
আওয়ামীলীগের জনৈক মুখমাত্র আজ বলেন যে, শ্রী হট্ট ও ময়মনসিংহ এলাকায় কমান্ডো আক্রমণে সম্প্রতি ৩০০ জন পাক সৈন্য নিহত হয়েছে।
প্রায় ৪০০ পাক্সইন্য গুরুতর আহত অবস্থায় শ্রী হট্ট অসামরিক হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। ঐ হাসপাতালটিকে এখন সামরিক হাসপাতালে রূপান্তরিত করা হয়েছে।
ময়মনসিংহ জেলার টাঙ্গাইল এলাকার দক্ষিণে মুক্তিফৌজ ঢুকে পড়েছেন। চারটি থানার এলাকা এখন তাদের দখলে এসেছে। কয়েক দফা আক্রমণ চালিয়ে পাক সৈন্যরা সেখান থেকে মুক্তিফৌজকে হটাতে পারেনি।
বাংলাদেশের উত্তর রণাঙ্গনে প্রতিদিন মুক্তিফৌজ সাফল্য অর্জন করছে। আসাম- মেঘালয় সীমান্তের বিপরীত দিকে সকল সীমান্ত ঘাঁটি এখন মুক্তি ফৌজের দখলে এসে গেছে।
উপর্যুপরি কমান্ডো আক্রমণে পাক সৈন্যরা এখন ভয়ে সদা কম্পমান। তাদের মনোবল নেই বল্লেই চলে।
মুক্তিফৌজের আক্রমণে বহু পাক সৈন্য খতম
(নিজস্ব প্রতিনিধি)
রায়গঞ্জ, ৩ রা জুলাই – গতকাল রাত্রে দিনাজপুরের কাছে মুক্তিফৌজ কমান্ডো পাক বাহিনীর ঘাঁটি আক্রমণ করলে দশ জন পাক সৈন্য নিহত হয়। তারা প্রচুর অস্ত্র শস্ত্র সহ কয়েকটি মেশিন গান আটক করে।
গত বৃহস্পতিবার রাত্রে মুক্তিফৌজ দিনাজপুরে বোমাবর্ষন করে। ঐ দিন রাত্রে মর্টার ও মেশিন গান নিয়ে মুক্তিফৌজ বগুড়া আক্রমণ করে।
বিয়ানী বাজারে ৮ জন পাক সেনা খতম
আগরতলা থেকে ইউ এন আই এর খবরে বলা হয়েছে – গত সপ্তাহে মুক্তিফৌজ পাক বাহিনীর উপর আক্রমণ চালিয়ে ৮ জন পাকসেনাকে খতম করে এবং বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ধোনাই জুড়ি সড়কে দুটি সড়ক সেতু ধ্বংস করে। সীমান্তের ওপার থেকে পাওয়া খবরে একথা জানা গেছে।
অভিজ্ঞ মহল থেকে বলা হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধারা গত ২৮ শে জুন গুপ্তস্থান থেকে দুটি পাক বাহিনীর উপর আক্রমণ চালিয়ে বহু পাকসেনাকে খতম করে। ঐ মহল থেকে আরও বলা হয়েছে যে পাক জঙ্গিশাহী ইতিমধ্যে মিল ও শিল্প প্রতিষ্ঠানে নাশকতামূলক কাজ বন্ধ করার জন্য শিল্প নিরাপত্তা বাহিনী গঠন করেছে।
– যুগান্তর, ৪ ঠা জুলাই, ১৯৭১
বাংলাদেশের বিভিন্ন খণ্ডে গেরিলা তৎপরতা বৃদ্ধি
(বিশেষ প্রতিনিধি প্রেরিত)
নয়াদিল্লী, ৭ জুলাই নির্ভরযোগ্য সূত্রে প্রাপ্ত সংবাদে যানা গিয়েছে যে, গত সপ্তাহে বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনী বাংলাদেশের বিস্তৃত অঞ্চলে তাদের গেরিলা তৎপরতা বৃদ্ধি করেছেন।
গেরিলা আক্রমণের একটা লক্ষণীয় বিশিষ্ট এই যে, মুক্তি বাহিনী কামান ও মর্টার ব্যাবহার করছেন।
মুক্তিফৌজের গেরিলা আক্রমণের একটি সুফল হল – পাকিস্তানী সৈন্যরা সন্ত্রস্ত ও বিহ্বল হয়ে পড়ছে। তারা ক্রমশ কি রকম নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। অবশ্য ক্ষয়ক্ষতির ঝাপটা তাদের ওপর দিয়ে কম যাচ্ছেনা।
জানা গিয়েছে যে, পূর্ব দিনাজপুরের পাঁচ গড়ের ৮ মাইল উত্তরে আমড়া খামা সীমান্ত চুক্তি গত ৪ঠা জুলাই থেকে মুক্তিফৌজের অধিকারে আছে।
মুক্তিবাহিনী ডাম্বার এর উত্তরে সৈয়দ পুর ও চিলা হাঁটির মধ্যে রেল যোগাযোগ ব্যাবস্থা বিপর্যস্ত করে দিয়েছে।
বয়ড়া অঞ্চলে মুক্তিবাহিনী পাক সৈন্যদের উপর কামান ও মর্টার নিয়ে আক্রমণ করে।
গত ৩ রা ও ৪ ঠা জুলাই মুক্তিফৌজ ঠাকুরগাঁওয়ের ১৪ মাইল উত্তর পশ্চিমে পাক বাহিনীর লাহিড় চৌকিটির উপর কামান ও মর্টার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
জানা গিয়েছে যে, পাক বাহিনী দিনাজপুর ও রংপুর খণ্ডে মুক্তিফৌজ অধিকৃত আতঙ্ক সৃষ্টিকারী বিভিন্ন সৈন্যদল পাঠাচ্ছে। এরকম একটি দল ভুরুংগমারির ৬ মাইল দক্ষিণে পাঠানো হয়।
ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও অন্যান্য গুরুত্তপূর্ণ অঞ্চলে গেরিলারা বিশেষ ভাবে তৎপর হয়ে উঠেছেন।
শিলিগুড়ি থিক আমাদের নিজস্ব সংবাদ দাতা জানাচ্ছেন যে, গত রবিবার মুক্তিফৌজ দিনাজপুরের কোয়াগ্রামে পাকসেনাদের উপর আকস্মিক আক্রমণ চালিয়ে ৬ জন পাকসেনাকে খতম করেছেন। এবং ১ জন কে গুরুতর আহত অবস্থায় বন্দী করেছেন। এর ফলে বোরাক্রাম অঞ্চলের অধিবাসীদের মনোবল বৃদ্ধি পেয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। আরেকটি সংবাদে জানা গিয়াছে যে বাংলাদেশ মুক্তি ফৌজ রবিবার রাত্রে বগুড়া জেলার ঘোড়া ঘাটে পাক সেনাবাহিনীর একটি অস্ত্রাগার উড়িয়ে দেন। ফলে পাক বাহিনীর বিপুল পরিমাণ গোলা বারুদ ধ্বংস হয়।
ঢাকা ময়মন সিংহ সংযোগ সেতু বিধ্বস্ত
নয়াদিল্লী – ৭ ই জুলাই বি বি সির সংবাদে প্রকাশ মুক্তিফৌজ গেরিলারা ঢাকা ময়মনসিংহ সংযোগ রক্ষাকারী একটি সেতু উড়িয়ে দিয়েছে।
বি বি সি র প্রতনিধি বলেন যে, পাক বাহিনী শিকার করেছে যে সঙ্ঘর্ষ এমন একটি স্থানে সঙ্ঘটিত হয়েছে যে যেখানে বিদ্রোহীরা অন্তর্ঘাতমূলক কার্যে লিপ্ত আছে।
-যুগান্তর – ৮ জুলাই, ১৯৭১
মুক্তিফৌজ পাক সেনাবাহিনী ট্রেন সহ রেল সেতু উড়িয়ে দিয়েছে
(নিজস্ব সংবাদ দাতা)
দিনহাটা – ৯ জুলাই সীমান্তের অপর পার থেকে প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ , গত বুধবার মুক্তিফৌজ লাল্মনির হাঁট খণ্ডে পাক সৈন্য সমেত একটি রেল সেতু উড়িয়ে দিয়েছে।
এদিকে মুক্তিফৌজের গেরিলা কমান্ডো বাহিনীর মোকাবিলা করার জন্য পাকিস্তানী সৈন্যরাও গেরিলা যুদ্ধ প্রস্তুতি অবলম্বন করেছে। গত কয়েক দিনে তারা মুক্তিফৌজের গেরিলাদের খতম করবার ব্যার্থ প্রয়াস করেছে। কিন্তু তৎসত্ত্বেও খোদ ঢাকা শহরেই পাক সেনাবাহিনীকে গ্রেনেড দিয়ে আক্রমণ করা হয়েছে।
সংবাদ প্রকাশ, মুক্তিফৌজের গেরিলারা লালমনিরহাঁট – পাটগ্রাম সেকশনে লালমনিরহাঁট স্টেশন থেকে ১ মাইল দূরে দোল বাজারের উপর একটি ডিনামাইট রেখেছিল। একটি সৈন্য বাহিনী ট্রেন পুলের ওপর দিয়ে লালমনির হাঁট থেকে হাতিবান্ধার দিকে অগ্রসর হবার সময় ডিনামাইট ফেটে যায় এবং সেতুটি ও ট্রেনটি উড়ে যায়।
তিনটি বগি বিচূর্ণ
কৃষ্ণ নগর, ৯ জুলাই – গত ৭ জুলাই কুষ্টিয়ায় জগতী রেল স্টেশনের নিকটে মুক্তি ফৌজের পোঁতা মাইনের ওপর দিয়ে একটি পাকিস্তানী ট্রেন চলার সময় ট্রেনের ৩ টি বগি চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেছে এবং কয়েক ব্যাক্তি আহত হয়েছে।
এখানে প্রাপ্ত সংবাদে প্রকাশ, খুলনা থেকে গোয়ালন্দ যাওয়ার পথে এ ঘটনা ঘটে। ট্রেনে পাকিস্তানী সৈন্য ও বেসামরিক লোক ছিল।
ওইদিন রাত্রিবেলায় মুক্তিফৌজ খুলনা- কুষ্টিয়া সেকশনে আলম ডাঙ্গার নিকটে একটি গুরুত্তপূর্ন রেল সেতু উড়িয়ে দিয়েছে।
তরুণদের জোর করে রাজাকার বাহিনীতে ভর্তি করা হয়েছে
বাংলাদেশে পাক সৈন্যরা একটি আধা সামরিক বাহিনী গঠন করছে। তার নাম রাজাকার বাহিনী।। এতে বাঙ্গালী তরুণদের জোর করে ঢুকান হচ্ছে। কুষ্টিয়া জেলার জনৈক আওয়ামীলীগ নেতা জানাচ্ছেন যে, বল প্রয়োগে বাঁধা দিলে ঘর থেকে যুবতীদের টেনে বার করে ছাউনিতে নিয়ে যাওয়া হবে বলে পাকিস্তানীরা শাসাচ্ছে। এর ফলে নিরাপত্তার আশায় বহু তরুণ তরুণী সীমান্তের দিকে পালিয়ে আসছে।
– পি টি আই
বহু পাক সৈন্য নিহত
আগরতলা থেকে পি টি আই জানাচ্ছেন , মুক্তিফৌজের গেরিলা বাহিনীর তৎপরতা সম্প্রতি সারা বাংলাদেশে ব্রিধি পেয়েছে। ঢাকা নতুন বাজার এলাকায় গত ৫ জুলাই টহলদারি পাক বাহিনীর উপর হাত বোমা নিক্ষেপ করলে বহু পাক সৈন্য হতাহত হয়। সীমান্তের ওপর থেকে পাওয়া সংবাদে জানা গেছে , এই আক্রমণে একজন অফিসার সহ ৭ জন পাক সৈন্য নিহত হয়েছে।
অন্য এক সংবাদে জান গেছে, গত ৭ জুলাই মুক্তিফৌজ শ্রী হট্টের তেলিয়াপাড়া চা বাগানে পাক সৈন্য শিবিরে হানা দিয়ে ১৫ জন পাকসেনাকে খতম করে। এই ১৫ জন সমেত ঐ রণাঙ্গনে মোট ৩৯ জন পাকসেনা খতম হয়েছে। গতকাল ও আজ করিমগঞ্জ সীমান্তেও মোট ৯ জন পাকসেনাকে মুক্তিফৌজ গেরিলারা হত্যা করেছে। গত ৬ জুলাই লাকসাম ও কুমিল্লার মসয়ে টেলিফোন লাইন মেরামতের সময় গেরিলা বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণে ৫ জন পাকসেনা নিহত হয়। মুক্তিফৌজ ঐ টেলিফোন লাইন বিকল করে দেয়।
গত ৪ ঠা জুলাই সলদার বাজারে মুক্তিফৌজের মর্টার আক্রমণে ৫০ জন পাকসেনা নিহত হয়েছে এবং প্রায় ১০০ সৈন্য আহত হয়েছে।
ওইদিন কুমিল্লা জেলার কোটেশ্বরএর কাছে মুক্তিফৌজের আক্রমণে বহু পাকসেনা হতাহত হয়েছে। মুক্তিফৌজের কাছ থেকে পাকসেনার কোটেশ্বর দখল করার চেষ্টা করছে। কিন্তু কোটেশ্বর এখনো মুক্তি সেনাদের দখলেই আছে।
ক্রিস নগরের এক সংবাদে বলা হয়েছে, মুক্তিফৌজ আলম ডাঙ্গা স্টেশনের কাছে একটি গুরুত্তপূর্ন রেল সেতু ধ্বংস করে দেয়াতে ঈশ্বরদী দর্শনা ও কুষ্টিয়া দর্শনা শাখায় ট্রেন চলাচল ব্যাবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
– যুগান্তর, ১০ জুলাই, ১৯৭১
বিভিন্ন রণাঙ্গনে মুক্তিফৌজের বিপুল সাফল্য
(নিজস্ব বার্তা পরিবেশক)
গত এক পক্ষকালের মধ্যে বাংলাদেশের মুক্তিফৌজ দখলকারী পাক বাহিনীর উপর আক্রমণের তীব্রতা ও ব্যাপকতা বিপুলভাবে বৃদ্ধি করেছে এবং বিভিন্ন রণাঙ্গনে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করিয়াছে। পর্যবেক্ষকগন ইহাকে ‘বর্ষা অভিযানের’ সূচনা বলিয়া মনে করিতেছেন।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের খবরে প্রকাশ, চট্টগ্রামের বহু গ্রামাঞ্চলে এখন মুক্তিফৌজের দখলে এবং এইসব এলাকার গৃহ শীর্ষে স্বাধীন বাঙলার পতাকা শোভা পাইতেছে।
অপর এক সূত্রে প্রাপ্ত খবরে যানা যায় যে, ২ দিন ব্যাপী প্রচণ্ড লড়াইয়ের পর ৮ জুলাই মুক্তি ফৌজ দিনাজপুর জেলার ঠাকুরগাঁও মহকুমা শহর দখল করে। উল্লেখযোগ্য যে, ঠাকুরগাঁও এলাকা একটি কমিউনিস্ট প্রভাবিত এলাকা। এবং এখানকার লড়াইয়ে আওয়ামীলীগ ও ন্যাপ কর্মিদের সহিত কমিউনিস্ট কর্মি বৃন্দও সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন।
আমাদের সংবাদ দাতা জানাইতেছেন, ঢাকা জেলার নারায়ণগঞ্জ মহকুমার বিস্তীর্ণ গ্রামঅঞ্চলে মুক্তিফৌজ গত কিছু দিনে বহু সংখ্যক পাক হানাদার সেনা খতম করেন। এবং অনেক গুরুত্তপূর্ন রেল ও সড়ক সেতু ধ্বংস করেন। এই মুক্তিফৌজ ইউনিট টি নরসিংদীর একজন কুখ্যাত মুসলিম লিগ পন্থী বেইমানকে হত্যা করেন। এই এলাকার সংগ্রামে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ও কৃষক সমিতির কর্মিরা নেতৃত্ব দেন।
বি বি সি র ক্ষবে শিকার করা হয়েছে যে, সাম্প্রতিক কালে মুক্তিফৌজের তৎপরতা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পাইয়াছে এবং ঢাকার অদূরে পাক বাহিনীর সহিত মুক্তিফৌজের বহু সঙ্ঘর্ষ ঘটে।
খোদ ঢাকা শহরে মুক্তিফৌজ কর্তৃক অভিজাত নিউ মার্কেট এলাকায় বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হইলে সামরিক কর্তৃপক্ষ গত সোম বার হইতে পুনরায় সান্ধ্য আইনের কড়াকড়ি বৃদ্ধি করে বলিয়া বাংলাদেশ সরকার সূত্রে যানা গিয়াছে। উল্লেখযোগ্য যে ইতিপূর্বেও মুক্তিফৌজ ঢাকার বেতার কেন্দ্র, বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্রে ও ইন্টার কন্টিনেন্টাল হোটেলে এবং গভর্ণর ভবন ও সেক্রেটারিয়েটের সম্মুখে বোমা বিস্ফোরণ করে।
আকাশ বানীর এক খবরে বলা হয়, মুক্তি বাহিনী প্রচণ্ড আক্রমণ চালাইয়া ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল জেলার তিনটি থানাকে মুক্ত করে।
ইহা ছাড়াও বিভিন্ন রণাঙ্গন হইতে প্রাপ্ত খবর প্রকাশ, সিলেট, কুমিল্লা, ফেনী, কুষ্টিয়া, ময়মন সিংহ প্রভৃতি রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা উল্লেখযোগ্য রূপে বৃদ্ধি পাইয়াছে। এবং সর্বত্র ইয়াহিয়া খানের দস্যু বাহিনী নাস্তানাবুদ হইতেছে। বিপলসঙ্খ্যক পাকসেনা মুক্তিফৌজের হাতে নিহত হইয়াছে। বরিশাল ও পটুয়াখলির জল পথেও পাক ফৌজকে অতর্কিত আক্রমণের শিকার হইতে হইয়াছে। বরিশাল ও পটুয়াখালীর জল পথেও পাক ফৌজ কে অতর্কিত আক্রমণের শিকার হইতে হইয়াছে।
অপরদিকে পাক ফৌজ শহর ও গ্রাম অঞ্চলের নিরস্ত্র মানুষের উপর হামলা ও অগ্নি সংযোগ অব্যাহত রাখিয়াছে। এবং অগণিত ণর নারী ও শিশুকে হত্যা করিয়াছে। ঢাকা সফরকারী ব্রিটিশ পার্লামেন্টারি দলের নেতা লন্ডনে ফিরিয়া গিয়া মন্তব্য করেন যে, বাংলাদেশে গণহত্যা এখনো চলিতেছে।
মুক্তিফৌজের সাফল্য
গত ৩ মাসের লড়াইয়ের ফলাফল পর্যালোচনা করিলে দেখা যায় বাংলাদেশের মুক্তিফৌজের সাফল্য মোটেই সামান্য নয়। মুজিব – ইয়াহিয়া আলোচনা চলিতে থাকা কালে ইয়াহিয়া বেইমানি করিয়া ২৫ শে মার্চ রাতের অন্ধকারে বাংলাদেশের জনগণের উপর যখন তাহার দস্যু বাহিনী লেলাইয়া দেয় তখনো জনগণের তরফে এইরূপ একটি সশস্ত্র ও সর্বাত্তক লড়াইয়ের বাস্তব প্রস্তুতি ছিলোনা বলিলেই চলে। অল্প সময়ে মধ্যে বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ই পি আর, পুলিশ প্রভৃতি অস্ত্র হাতে প্রতিরোধের জন্য রুখিয়া দাঁড়ায়। তবে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত ইয়াহিয়া দস্যুবাহিনির সহিত সম্মুখ যুদ্ধে বিজয় লাভ ছিল দুষ্কর। প্রথম দিকে বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ই পি আর এর বিভিন্ন অংশের পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগ কিংবা যুদ্ধ তৎপরতার সমন্বয় সাধনের ব্যাবস্থা ছিল না। তদুপরি অস্ত্র শস্ত্র গোলাবারুদ যানবাহন প্রভৃতির অভাব তো ছিলই। কিন্তু তাহা সত্ত্বেও মুক্তি ফৌজ অতুলনীয় বীরত্বের সহিত লড়াই করিয়া বহু শত্রু সৈন্য হতাহত করেন। বাংলাদেশের সর্বত্র ইয়াহিয়ার দস্যু সৈন্যরা মুক্তিফৌজ ও জনগণের নিকট হইতে বাঁধার সম্মুখিন হত এবং বিভিন্ন জিলা ও বিস্তীর্ন গ্রাম অঞ্চল দীর্ঘ দিন পর্যন্ত মুক্ত ছিল।
বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে মুক্তিফৌজ দ্রুত যুদ্ধ কৌশল পরিবর্তন করিয়া গেরিলা যুদ্ধের পদ্ধতি অবলম্বন করে। ইহার ফলে সর্বত্র ইয়াহিয়ার ফৌজ নাজেহাল হইতেছে। দখলকারী সেনাবাহিনীর ২০/২৫ হাজার সৈন্য ও কয়েক শত অফিসার নিহত হইয়াছে। আহতের সংখ্যা আরও বেশী। সৈন্যদের মনোবল ভাঙ্গিয়া পড়িতেছে। উহারা যুদ্ধ অপেক্ষা লুট তরাজেই অধিকতর উৎসাহী হইয়া উঠিয়াছে। ইয়াহিয়ার সৈন্য বাহিনী সময়ে সময়ে গ্রাম অঞ্চলে গিয়া নিরীহ গ্রাম বাসীদের উপর অত্যাচার উৎপীড়ন চালাইলেও উহারা সাধারণভাবে বড় বড় শহর বাজারের ঘাঁটিগুলিতেই আবদ্ধ। যতোই দিন যাইতেছে, মুক্তিফৌজের সংখ্যা , ট্রেনিং এর সুযোগ সুবিধা ও দক্ষতা ততই বৃদ্ধি পাইতেছে এবং ইয়াহিয়া খানের ভাড়াটিয়া বাহিনী দেশপ্রেমিন মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নাস্তানাবুদ হইতেছে।
– মুক্তিযুদ্ধ, ১১ ই জুলাই , ১৯৭১
রণাঙ্গন থেকে লিখছি
বিশ্বাস ঘাতক ইয়াহিয়ার দস্যু সেনাদের সাথে মুক্তি ফৌজের যেসব যুদ্ধ হয় নিম্নে তাঁর সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেয়া গেল।
চারান
বিগত ২২ শে মে ৫০ জন বর্বর হানাদার সেনা কালিহাতি থানার বলস্না গ্রামে নিরীহ জনসাধারণের ঘর বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। ফেরার পথে ১০ জন মুক্তি ফৌজ গেরিলা কায়দায় তাদের আরান গ্রামে আক্রমণ চালায়। ৪০ মিনিট স্থায়ী যুদ্ধে ২০ জন শত্রু সৈন্য নিহত ও বহু সংখ্যক আহত হয়। শত্রুসেনার গুলিতে ২ জন গ্রাম বাসী নিহত হয়। বিপুল ক্ষয় ক্ষতি শিকার করে বর্বর সেনারা কালিহাতির দিকে পালিয়ে যায়।
বইলামপুর
গত ৩ রা জুন বইলাম পুরে পাঞ্জাবিদের দালাল পুলিশ এবং মুক্তিবাহিনীর মধ্যে এক খণ্ড যুদ্ধ হয়। মুক্তিবাহিনী বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে ৭ জন দালাল পুলিশ গ্রেফতার করেন।
বল্লা
১২ই জুন বলস্না গ্রামে বর্বর তাতার বাহিনীর উপর মুক্তিবাহিনী প্রচণ্ড আঘাত হানেন এবং কমপক্ষে ৫৮ জন শত্রু খতম করেন। সুদীর্ঘ ৫ ঘণ্টা যুদ্ধের পড় পাকসেনারা পিছু হটে। মুক্তিফৌজ ৪ টি শত্রুপলা সহ বহু অস্ত্র শস্ত্র এবং গোলাবারুদ উদ্ধার করেন।
কামুটিয়া
গত ১৬ ই জুন সকাল ১০ টা ১৫ মিনিট বাশাইল থানার কামুটিয়া গ্রামে মুক্তিবাহিনী এবং তথাকথিত পাকিস্তানী সেনার সাথে এক তুমুল যুদ্ধ সঙ্ঘটিত হত। এই যুদ্ধে ১৯ জন পাকসেনা নিহত ও ৬০ জন আহত হয়।
বিগত ১৮ জুন মুক্তিবাহিনী এবং হানাদার সৈন্যদের মধ্যে পুনরায় যুদ্ধ বাধে। এই যুদ্ধে ১৪ জন হানাদার সৈন্য নিহত হয়। মুক্তিবাহিনী ২ তি চিনা গান, ১ তি মেশিন গান ও ১ তি এল এম জি সহ বহু অস্ত্র শস্ত্র উদ্ধার করে।
ভালুকা
বিগত ২ রা জুন ময়মন সিংহ জেলার ভালুকা থানা ভাওয়াদিলাবাজু ঘাটে আমাদের মুক্তিবাহিনীর ৬ নং প্লাটুন এবং হানাদার দের সাথে সকাল ৯ টা থেকে ৪২ ঘণ্টা ব্যাপী তুমুল লড়াই হয়। এই লড়াইয়ে ১২৫ জন হানাদার সেনা খতম হত। এবং ৭৫ জন আহত হয়।
গত ২ রা জুন ভালুকা শত্রু ঘাঁটির উপর মুক্তিবাহিনী গ্রেনেড চার্জ করে। ফলে ১৭ জন শত্রু নিহত ও কয়েকজন গুরুতর আহত হয়।
– রণাঙ্গন, ১৩ জুলাই, ১৯৭১
নারীর বেশে মুক্তিফৌজ
নওয়াবগঞ্জ (রাজশাহী) , ১০ জুলাই
সম্প্রতি রাজশাহী নওয়াবগঞ্জ মহকুমার সাপাহার নামক স্থানে নারী বেশে একজন মুক্তিফৌজ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। ১৬ থেকে ১৮ বছরের এক যুবক (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) পূর্ন যৌবনা এক যুবতির বেশ ধারণ করে মাথায় এক ঝুরি পাকা কলা নিয়ে সাপাহারের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল। এমন সময় জীপ গাড়ি নিয়ে ৫/৬ জন পাক ফৌজ সেখানে আসে। পক ফৌজ দেখে মেয়েটি ভয় পেয়েছে এমন ভাব দেখিয়ে সে মাঠের দিকে ছুটতে থাকে। লোভী জঙ্গিরা তাদের লোভ সংবরণ করতে না পেরে গাড়ি থামিয়ে মেয়েটির পেছনে ছুটতে থাকে। মেয়েটি কিছুদূর গিয়ে আলের ধারে শুয়ে পড়ে। এবং কলার ঝুড়ি থেকে গ্রেনেড ছুড়তে থাকে। অতর্কিত আক্রমণে উক্ত লোভী জঙ্গিরা অস্ফুট আর্তনাদে প্রাণ হারায়। ছদ্মবেশী যুবতি পাকিদের গাড়ি এবং অস্ত্র শস্ত্র হস্ত গত করেছে।
– নিজস্ব সংবাদ দাতা
মেহেরপুর মুক্ত
মেহেরপুর (কুষ্টিয়া), ১১ জুলাই
অদ্য মুক্তি বাহিনী ও পাকসেনার মধ্যে প্রচণ্ড লড়াইয়ের পড় মুক্তিবাহিনী মেহেরপুর মহকুমা হতে পাকসেনাদের ঘাঁটি সম্পূর্ন ধ্বংস করে দিয়ে শহরটি দখল করে নিয়েছে।
আওয়ামীলীগ সভাপতি এডভোকেট জনাব বয়তুল্লাহ এম এন এ আমাদের প্রতিনিধিকে জানিয়েছেন যে মুক্তিবাহিনী একটি ট্রান্সমিটার ও ৩ ট্রাক চিনা অস্ত্র শস্ত্র হস্তগত করেছে এবং দখল কৃত ভারি অস্ত্রের সাহায্যে পলায়মান সৈন্যদের তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এপর্যন্ত তারা ৬০ জন পাকসেনাকে নিহত ও শতাধিক কে আহত করেছে।
(পি পি আই )
– স্বাধীন বাঙলা, ১২ জুলাই, ১৯৭১
চট্টগ্রাম সহ বিস্তীর্ন এলাকা এখন মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে
(ম মামুণ – বার্তা সম্পাদক রাজশাহী বেতার – পরিবেশিত)
জামান গঞ্জ (রাজশাহী) ১২ই জুলাই
বাংলাদেশের বিস্তির্ন এলাকা এখন মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। দেশ মাতৃকার সেবায় নিবেদিত প্রাণ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অসীম সাহসিকতাপূর্ণ তৎপরতার সামনে টিকতে না পেরে বিভিন্ন এলাকায় পাক ফৌজ পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে। চট্টগ্রামের বাড়িতে বাড়িতে গৃহ শীর্ষে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা শোভা পাচ্ছে। সমস্ত চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার আনাচে কানাচে পাক ফৌজ ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে তুমুল সঙ্ঘর্ষ হচ্ছে।
সর্বত্র পাক শত্রুরা খতম হচ্ছে। সতস্ফুর্তভাবে জনতা মুক্তিবাহিনীর বিজয় অবধারিত জেনে বাংলাদেশের পতাকা গৃহে গৃহে উত্তোলন করছেন। কুমিল্লা শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত টাউনহল শীর্ষেও বাংলাদেশের পতাকা শোভা পাচ্ছে বলে জানা গেছে। কুমিল্লা এখন বিস্ফোরণের শহর। প্রায় প্রতি মূহুর্তে সেখানে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যাচ্ছে।
এমনকি ইয়াহিয়া খানের বেতার ভাষণের সময় কুমিল্লা বিমান বন্দরের দিক থেকে ডুটি বিস্ফোরণের শব্দ ভেসে আসে। জানা গেছে সামগ্রিক ভাবে কুমিল্লা জেলা পাক ফৌজের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলেগেছে। বাইরে থেকে প্রচুর সৈন্য সামন্ত আমদানি করেও তারা মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে এঁটে উঠতে পারছেনা। যশোরে গেরিলা তৎপরতার সামনে পাক ফৌজের সব প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়েছে।
গত এক সপ্তাহের খণ্ড খণ্ড যুদ্ধে পাক ফৌজ যশোরের দুই শতাধিক প্রাণ খুইয়েছে। যশোরের বিভিন্ন এলাকা থেকে পাক ফৌজ হটে গেছে বলে জানা গেছে। টাঙ্গাইল এবং ময়মণ সিংহ এখনো মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তাছাড়া ফেনী মহকুমা, দিনাজপুর জেলার অমরখানা, সিলেটের সীমান্তবর্তী এলাকায় মুক্তিবাহিনীর অধিকার সু প্রতিষ্ঠিত রয়েছে।
– স্বাধীন বাঙলা, ১২ জুলাই, ১৯৭১
মুক্তিফৌজের তৎপরতা
৩০শে জুন থেকে একমাত্র উত্তর খণ্ডেই পাক ঘাঁটিগুলির ওপর ক্রমাগত আক্রমণে ও টহলদার সেনাদলের ওপর গুপ্ত অভিযান চালনায় অন্তত ১৮ জন পাক ফৌজ নিহত হয়েছে বলে যানা গেছে।
শ্রী হট্ট খণ্ডে সাফল্য
মুক্তিফৌজ কম্পক্কে ৭ জন পাকিস্তানী সৈন্যকে খতম করেছেন শ্রী হট্ট জেলার জাকিগঞ্জ থানা এলাকায়। ঐ জেলারই জয়ন্তেয়াপুর অঞ্চলে আকস্মিক আক্রমণে ৩ জন পাকসেনা নিহত হয়েছে।
রংপুরে মুক্তিফৌজ অভিযান
রংপুর জেলার মুক্তিফৌজ চিলাহাটির নিকটে একটি সামরিক ঘাঁটির ওপর আক্রমণ চালান এবং অন্তত ২ জন পাকসেনা নিহত ও অনেকে আহত করেন । একই জেলার ঠাকুরগাঁওয়ে একটি সেতু উড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
দিনাজপুর, পালিতলা ও থিরগঞ্জ এলাকায় পাক সেনাবাহিনীর ওপর গোপন আক্রমণ চালানোর ব্যাপারে গেরিলারা বিশেষ তৎপর হয়ে উঠেছেন।
রাজশাহী ও দিনাজপুরে তৎপরতা
গেরিলা বাহিনী ৩০শে জুন রাত্রে রাজশাহীর একটি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি অচল হয়ে পড়েছে।
অদিকে গতকাল দিনাজপুর জেলায় মুক্তিফৌজ একটি পাক টহলদার বাহিনীর উপর গোপন আক্রমণ চালিয়ে ৬ জন খানসেনা খতম করে। এরপর পাকসেনারা পশ্চিম বংগের রাধিকার পুর গ্রামের বিপরীত দিকে দুইটি গ্রাম পুড়িয়ে দেয়।
শ্রী মঙ্গলের নিকট পাক ফৌজ হতাহত
পূর্ব রণাঙ্গনে মুক্তিফৌজ ৩০ শে জুন শ্রী মঙ্গলের নিকট পাক সামরিক ঘাঁটিতে গুলিবর্ষন করে। এবং বেশ কয়েকজন পাকসেনা হতাহত করেন।
চট্টগ্রাম জেলার সীতকুন্ড এলাকাতেও মুক্তিফৌজ নিতান্ত সক্রিয়।
কুমিল্লা রণাঙ্গনে
১লা জুলাই কুমিল্লা জেলার আমজেদ্গরে একটি পাকিস্তানী গোলন্দাজ বাহিনী আক্রান্ত হয়। প্রতিশোধ নিতে যেয়ে পাকসেনারা ১৫ জন বেসামরিক নাগরিককে নিহত করে।
দক্ষিণ – পূর্ব খণ্ডে ৭০ জন খান সেনা নিহত
আগরতলা মুক্তিফৌজ কমান্ডো সাফল্যের সঙ্গে অভিযান চালিয়ে ৩ রা জুলাই দক্ষিণ পূর্ব রণাঙ্গনে ৭০ জনের অধিক পাকসেনা নিহত করেছে।
মুহিব নগরে প্রাত সংবাদে জানা যায় উক্ত দিবসে কসবা অঞ্চলে এক প্রচণ্ড সংগ্রামে মুক্তিফৌজ কামানের হাতে খতম হয়েছে প্রায় ৫০ জন খান সেনা।
ঐদিন পাক সেনারা যখন সিঙ্গার বিল রেল ওয়ে সেতুটি মেরামত করছিল , সেই মুহুর্তে মুক্তিফৌজ কমান্ডো ভয়াবহ আক্রমণ চালান এবং ৮ জন পাক ফৌজের প্রাণ নাশ করেন। কুমিল্লা খণ্ডের ঘোলাপারাতে ও মুক্তিফৌজের গোপন আক্রমণে অন্তত ৪ জন খানসেনা খতম হয়েছে।
সাতক্ষিরায় মুক্তিফৌজের তৎপরতা
সাতক্ষিরায় মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে ৬০০ শত্রু সেনা নিহত হয়েছে। এছাড়া মোট ২৬ টি আক্রমণে তারা ৩০০ জন পাকসেনাকে খতম করে। ভোমরা, পারুলিয়া, মাহমুদ পুর, কুশ খালি ও কাক ডাঙ্গায় আক্রমণ চালানো হয়। এছাড়া সাতক্ষিরার বিভিন্ন অঞ্চলে মুসলিম লিগ ও জামাতে ইসলামের গুণ্ডা ও হানাদার সৈন্যদের পদলেহি দালালদের খতম করার কাজ ব্যাপক হারে শুরু হয়েছে। এর মধ্যে মুক্তিফৌজ পাটকেল ঘাটা , তালা, পাইকগাছা, আশাশুনি, বদর তোলা, কলারোয়া প্রভৃতি স্থানে ১৬ জন দালাল কে গুলি করে হত্যা করেছে।
– স্বদেশ, ১৪ জুলাই, ১৯৭১
বাংলাদেশের নানা অঞ্চলে পাকসৈন্যের চরম বিপর্যয়
নাভারন, ঝিকর গাছা ও অন্য অনেক জায়গা মুক্তিফৌজের দখলে
(নিজস্ব প্রতিনিধি)
মুজিবনগর, ১৪ জুলাই – এবার পাল্টা মারের পালা। মুক্তিফৌজ এখন বাংলাদেশের নানা অঞ্চলে খানসেনাদের জোড় মার দিচ্ছে। এ মারের চোটে পাকসেনারা যশোর অঞ্চলে নাভারন ও ঝিকর গাছা ছেড়ে চলে গেছে। এই এলাকা এখন মুক্তিসেনাদের কব্জায়। অদিকে খুলনার একটি ফাঁড়ি ও মুক্তিফৌজ দখল করে নিয়েছে। এখানকার পাকসেনাদের অস্ত্র শস্ত্র সব মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে। মেহেরপুর অঞ্চলে ও পাকসেনাদের চরম বিপর্যয়। এখানে ৫৬ জন খানসেনা নিহত হয়েছে। কুমিল্লায় পাক সরকার যে তাবেদার বাহিনী সৃষ্টি করেছিল তারা এখন স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দিয়েছে। এই এলাকাতেও মুক্তি ফৌজের সাফল্য অসামান্য।
আজ এক আকস্মিক আক্রমণে ভারত বাংলাদেশ সীমান্তের খুলনা জেলার খাঞ্জি ফাঁড়িটি মুক্তিফৌজ কমান্ডো দখল করে নেয়।
এখানে মুক্তিফৌজের সদর দপ্তর থেকে জানা গেছে, মুক্তিফৌজ পশ্চিম পাকবাহিনীকে ফাঁড়ি থেকে সরে যেতে বাধ্য করে। পশ্চিম পাক বাহিনীর পরিত্যাক্ত প্রচুত অস্ত্র শস্ত্র মুক্তিফৌজএর দখলে আসে।
৫৬ জন পাকসেনা খতম
কৃষ্ণ নগর থেকে পি টি আই জানাচ্ছেন বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমে কুষ্টিয়া জেলার মেহের পুর এলাকায় মুক্তিফৌজএর বহুমুখী আক্রমণে অন্তত ৫৬ জন পাকসেনা নিহত হয়েছে।
আজ এখানে সীমান্তের ওপার থেকে পাওয়া সংবাদে জানা গেছে , গতকাল সন্ধ্যায় মেহেরপুর মুক্তিফৌজ এর গেরিলা বাহিনীর ব্যাপকভাবে মর্টার ও মেশিন গানের আক্রমণে পাকবাহিনীর সৈন্যরা নিহত হয়। মেহেরপুর শহরের ২০ মাইলের মধ্যে মহিশকুউন্ড, প্রাগপুর, কাঠলি, গোপাল পুর, শৈব নগর , ইছাখালি, কাম দেব পুর, কোলা নাতুধা, দর্শনা, শ্যামপুরে মুক্তি ফৌজের গেরিলারা পাক বাহিনীর উপর আক্রমণ চালায়।
ব্যুমেরাং
আগরতলা থেকে পি টি আই জানাচ্ছেন, সামরিক আইন প্রশাসন মুক্তিফৌজকে খতম করার জন্য বাংলাদেশের রাজাকার, মুজাহিদ ও আনসার – এই ৩ ধরনের আধা সামরিক বাহিনী তৈরি করেছিল। কিন্তু এখন এই বাহিনী গুলো পাক বাহিনীর পক্ষে ব্যুমেরাং হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পাক কর্তৃপক্ষ এদের সেতু ও গুরুত্ব পূর্ন স্থান পাহাড় দেবার জন্য নিযুক্ত করেন। এবং মুক্তিযোদ্ধাদের অন্তর্ঘাত্মূলক কাজে বাঁধা দিতে না পারলে তাদের গুলো করা হবে, সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে ও তাদের বাড়ির মেয়েদের উপর অত্যাচার করা হবে বলে সতর্ক করে দেয়া হয়।
সীমান্তের ওপর থেকে পাওয়া খবরে জানা গেছে যে, এই আধা সামরিক বাহিনী অনেক অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে মুক্তিফৌজ ও স্বাধিনিতা সংগ্রামীদের সাথে যোগ দিয়েছে।
শ্রী হট্ট হাসপাতালে স্থান নেই
আগরতলা থেকে পি টি আই জানাচ্ছেন, শ্রী হট্ট হাসপাতালে জায়গা নেই বলে সাইন বোর্ড টাঙ্গিয়ে দেয়া হয়েছে। মুক্তিফৌজএর হাতে আহত পাকসেনারা এখানে রয়েছে।
আজ সীমান্তের ওপর থেকে পাওয়া যংবাদে জানা গেছে, সাঙ্ঘাতিকভাবে আহত হয়ে ৫০০ এর বেশী অফিসার ও সৈন্য চিকিৎসার জন্য ঐ হাসপাতালে রয়েছে।
গেরিলা তৎপরতা বৃদ্ধি
মুজিবনগর থেকে ইউ এন আই জানাচ্ছেন , মুক্তিফৌজএর গেরিলা তৎপরতা পুনরায় বৃদ্ধি পেয়েছে। সেনাবাহিনীর স্পেশাল ট্রেন যাতে চলতে না পারে তাঁর জন্য তারা রংপুরের উত্তরে কাকিনা এলাকায় রেল লাইন তুলে ফেলেছে।
মুক্তিফৌজএর পোঁতা মাইন বিস্ফোরণে ৪ জন পাকসেনা নিহত হয়েছে। রংপুর এলাকায় থানা আক্রমণ করে মুক্তিফৌজ গেরিলারা ৬ জন কনস্টেবলকে খতম করে এবং তাদের অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে নেয়। গেরিলারা কয়েকটি টেলিফোন লাইন কেটে দেয়।
শ্রী হট্ট এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা দুটি থানা আক্রমণ করে একজন ও সি কে খতম করে। এবং প্রচুর অস্ত্র শস্ত্র দখল করে।
কুমিল্লা এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা সেনাবাহিনীর উপর আকস্মিক আক্রমণ চালায়। তাদের পোতা মাইনে এই এলাকায় কিছু পাকসেনা নিহত হয়।
নাভারন মুক্তিফৌজএর দখলে
কৃষ্ণনগর থেকে নিজস্ব প্রতিনিধি জানাচ্ছেন, যশোর এলাকা থেকে পাওয়া খবরে জানা গেছে, মুক্তিযোদ্ধারা নাভারন ও জিকরগাছা দখল করে নিয়েছে। এখানকার অধিবাসীরা আশ্রয়ের জন্য ভারতে চলে এসেছে। অবশ্য এদের অধিকাংশই পাকসেনাদের হাতে নিহত হয়েছে।
পাকশি সেতুর অধিকার নিয়ে পাক বাহিনী বেকায়দায় পড়েছে। এদিকে কুষ্টিয়া জেলার কয়েকটি গ্রাম মুক্তিফৌজ অধিকার করে নিয়েছে। পাকশি সেতুর এক প্রান্তে জোর সঙ্ঘর্ষ চলছে। মুক্তিফৌজএর মতে এই অঞ্চলে অন্তত দুশ কমান্ডো সক্রিয় রয়েছে। আরা গোলাবর্ষনের দ্বারা পাক বাহিনীকে বেশ বিব্রত করে তুলেছে। মুক্তিফৌজ ভেড়ামাড়ার জল বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নষ্ট করে দিয়েছে। ফলে এর আশেপাশের এলাকা অন্ধকারে রয়েছে।
– যুগান্তর, ১৫ জুলাই, ১৯৭১
ঢাকার কেন্দ্রে আক্রমণে মুক্তিফৌজ এগিয়ে
নয়া দিল্লি, ১৫ জুলাই – মুক্তিফৌজ এখন দিবালোকে ঢাকা ও সিলেট শহরে পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্য দের আক্রমণ শুরু করেছে – সংস্থাগুলো জানায়।
বাংলাদেশ থেকে প্রাপ্ত একটি বিলম্বিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, সম্প্রতি মুক্তিযোদ্ধারা একটি চলমান জীপ থেকে গভর্নর, ঢাকা লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান বাসভবনের গেটে গুলি করে একজন সেন্ট্রি ও নিহত এবং অন্য একজন আহত করে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, গতরাতে ভৈরব নদীর পূর্ব তীরে কামদেবপুরে চার পাকিস্তানি সেনা নিহত করা হয়। এই যুদ্ধ তিন ঘন্টা চলে।
অন্য বর্ণনা মতে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীও মহিশকুন্ডি এবং প্রাগপুর এবং সকালে শাহিনগরে মুক্তি বাহিনীকে আক্রমণ করে। পরে তারা পিছু হটে।
পাকিস্তানি সেনারা গত দুইদিন কিছু কুষ্টিয়া জেলা থেকে ভারতে পালাবার সময় তাদের উপর গুলিবর্ষণ করে এবং কিছু নিহত ও ১৮ জন আহত করে।
আমাদের কুচবিহার করেসপন্ডেন্টস যোগ করেছেন: রংপুর জেলায় মুক্তিবাহিনীর কাউনিয়া পাকবাহিনীর ক্যাম্পে যেখানে তারা তিস্তা রেল সেতু পাহাড় দিচ্ছিল সেখানে আক্রমণ করে। ছয় পাক সেনা এই অভিযানে নিহত হয়। হাতীবান্ধায় ৬০ জন মুসলিম লীগের বন্দুক ধারী জোরপূর্বক স্থানীয় জনগণের ক্ষেত্র থেকে আউশ ধান কাটতে বাধ্য করে এবং তখন মুক্তিবাহিনী তাদের হালকা মেশিনগান দিয়ে হামলা চালায