পত্রপত্রিকায় রণাঙ্গন সংবাদ

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১00। পত্র-পত্রিকায় রণাঙ্গন সংবাদ —— জুলাই – ডিসেম্বর ১৯৭১

 

কম্পাইল্ড বাই – Aparajita Neel

<১১, ১০০, ৬৪০৭৭৩>

 

একজন পাকসেনা থাকা পর্যন্ত মুক্তিফৌজের সংগ্রাম চলবে

 

মুজিবনগর। মুক্তিফৌজের দুই রনাজ্ঞনের কমান্ডার দ্বয় মেজর খালেদ মোশাররফ ও মেজর জিয়াউর রহমান এক সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে বলেছেন, বাংলাদেশের পবিত্র মাটি থেকে পাক সামরিক বাহিনীর একেবারে চলে না যাওয়া পর্যন্ত দেশের পরিস্থিতি কখনো শান্ত হতে পারে না এবং ততদিন পর্যন্ত মুক্তি ফৌজ এর সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে।

তারা দুইজনেই ইয়াহিয়ার ভাষণকে ডাহা মিথ্যার ছড়াছড়ি বলে আখ্যায়িত করেন।

 

 

রণাঙ্গনে

 

যতোই দিন গড়িয়ে যাচ্ছে আমাদের মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যোদ্ধারা হানাদার পশ্চিম পাকসেনাদের ওপর আক্রমণাত্মক তৎপরতা ততই জোরদার করে তুলেছেন। গত তিন মাসে হানাদার সেনারা যেভাবে চরম মার খেয়েছে তাঁর একটা ছোট্ট প্রমাণ মেলে বি বি সি র প্রচারিত সংবাদ মাধ্যমে। গত ২৪ শে জুন সন্ধ্যা সোয়া আটটার সংবাদ প্রবাহে বি বি সি র সংবাদ দাটা ঢাকা থেকে বলেছেন, ‘বাংলাদেশে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পড় মুক্তিবাহিনী গেরিলাদের হাতে পাক বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতির যে তথ্য আমি সংগ্রহ করেছি তার ভগ্নাংশ সত্য হলে তা হবে ভয়াবহ।’ অন্যদিকে রয়টারের সংবাদ দাতা হাওয়ার্ড হুইটেন জানাচ্ছেন, ‘প্রতিদিন ৫০/৬০ জন আহত পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যকে চিকিৎসার জন্য ঢাকার হাসপাতালে নিয়ে আসা হচ্ছে। বিদেশী কূটনীতিকদের মতে বাংলাদেশের দখলকৃত ঢাকায় হানাদার পাকসেনাদের বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণাত্মক তৎপরতা প্রতিদিন জোরালো হচ্ছে।’

 

 

সাতক্ষিরায় ৬০০ জন নিশ্চিনহ

 

সাতক্ষিরায় মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে ৬০০ শত্রুসেনা নিহত হয়েছে। এছাড়া মোট ২৬ টি আক্রমণে তারা ৩০০ জন পাকসেনাকে খতম করেন। ভোমরা, পারুলিয়া, মাহমুদ পুর, খুস খুসকুলি, শ্রীপুর ও কাক ডাঙ্গায় আক্রমণ চালানো হয়।

 

 

ফেনীতে প্রচণ্ড সঙ্ঘর্ষে ৫ শতাধিক শত্রুসেনা খতম

 

পূর্বাঞ্চল সেক্টরের ফেনী মহকুমায় গত এক পক্ষ কালের প্রচণ্ড সঙ্ঘর্ষে স্বাধীনতাকামী তরুণ যোদ্ধাদের হাতে প্রায় পাঁচ শত পাকিস্তানী শত্রুসেনা খতম হয় এবং দু শ জন মারাত্মকভাবে আহত হয়।

 

স্বাধীন বাংলা বেতারের খবরে প্রকাশ, উক্ত সঙ্ঘর্ষে আমাদের মুক্তিসেনাদের ৫০ জন কমান্ডো আহত হন। গত ৪ঠা জুন খান সেনাদের গতিরোধ করারা উদ্যেশ্যে পাঠান নগরের বশিকপুর সেতুতে মুক্তি বাহিনীর পোঁতা মাইনে বিস্ফোরণের পর এ শঙ্ঘর্ষের সূত্রপাত হয় এবং এক পক্ষকাল ধরে এই শঙ্ঘর্ষ চলতে থাকে।

 

কুমিল্লা রণাঙ্গনে গেরিলা বাহিনীর হাতে প্রায় ৯০ জন খানসেনা নিহত হয়। পরে মুক্তিযোদ্ধাদের তাড়া খেয়ে পাক- ফৌজ কর্নেল বাজারে আশ্রয় নেয়। গত ২২ শে জুন কুমিল্লা মন্দভাগে ৫ জন সৈন্য নিহত হয়। 

 

 

 

ঢাকায় বোমা বিস্ফোরণ অব্যাহত

 

রয়টারের সংবাদ দাতা  জানাচ্ছেন, সম্প্রতি জাতিসঙ্ঘ উদ্বাস্তু হায় কমিশনার প্রিন্স সদ্রুদ্দিন আগা খানের ঢাকা সফরের সময় ঢাকায় আট টি বোমা বিস্ফোরিত হয়, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল এর সামনে গেরিলা যোদ্ধাদের গ্রেনেড আক্রমণে একজন আহত হয়। আরেকটি এক্রমনে ৩ জন খান সেনা  নিহত হয়।

 

স্বাধীন বাংলা বেতারের খবরে প্রকাশ, গত ২৩ শে জুন ভোর চারটায় ঢাকা বিমান বন্দরে একটি বোমা বিস্ফোরণের পড় বন্দর পাহারা রত দখলদার দস্যু সৈন্যদের মধ্যে থমথমে ভাব বিরাজ করছে। আমাদের ঢাকা প্রতিনিধি জানাচ্ছে , ঢাকা বিমান বন্দরে বিদেশী সাংবাদিকদের নিয়ে একটি বিমান অবতরণ করার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে বিকট আওয়াজ করে একটি বোমা বিস্ফোরিত হয়। স্বাধীন বাংলাদশের দখলকৃত এলাকায় অবস্থা যে মোটেও স্বাভাবিক নয়, ঢাকার পাতিতে পা দিতেই বিদেশী সাংবাদিকগন তা প্রত্যক্ষ করলেন। হানাদের কড়া পাহাড়া সত্ত্বেও এ ধরনের বিস্ফোরণ হওয়ায় বর্বর পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা বিব্রত হয়ে পড়েছে।

 

গত সপ্তাহে রাজশাহীতে পর পর তিনদিন সারা শহরে বোমা বিস্ফোরিত হলে খান সেনারা ভীত বিহ্বল হয়ে পড়ে এবং তাদের বড় একটা ছাউনি থেকে বের হতে দেখা যাচ্ছেনা।

 

 

রাজশাহী শহর আক্রান্ত

 

আমাদের স্বাধীনতাকামী তরুণরা রাজশাহী শহরে ঢুকে প্রবল আক্রমণ চালিয়েছেন। মুক্তিবাহিনীর কমান্ডোরা গত রোববার তিন দিক থেকে শহরটিতে প্রবেশ করেন। এসব আক্রমণে পাক সেনাবাহিনী বড় বেকায়দায় পড়েছে। মুক্তিবাহিনী মীরগঞ্জ, চারঘাট ও নবাব গঞ্জ এই তিন দিক থেকে রাজশাহী শহরের মধ্যে ঢুকে পড়ে। এ আক্রমণকালে মুক্তিবাহিনী মর্টার, হাত বোমা ও হাল্কা মেশিন গান ব্যাবহার করেন।

 

এক খবরে প্রকাশ, মুক্তিবাহিনী ও পাকসেনাদের মধ্যে নোয়াখালী, সোনামুরি ও চট্টগ্রাম রণাঙ্গনেও প্রচণ্ড সঙ্ঘর্ষ হয়। গেরিলা বাহিনী পাকসেনাদের একটি জীপ উড়িয়ে দেয়। তাতে ৬ জন পাকসেনা নিহত হয়। চট্টগ্রামে ও নোয়াখালীতে পাক টহলদার বাহিনীর ৬ জন সৈন্য গেরিলাদের হাতে নিহত হয়।

 

 

শনিবারের সঙ্ঘর্ষে ৬০ জন সৈন্য নিশ্চিনহ

 

মুক্তিবাহিনী গত ২৬ শে জুন রণাঙ্গনে ব্যাপক আক্রমণ চালান। এর মধ্যে এর পূর্বাঞ্চল সেক্টরে কমপক্ষে ৬০ জন শত্রু সৈন্য নিহত হয় এবং আমাদের মুক্তিবাহিনী কিছু অস্ত্র শস্ত্র দখল করে নিয়েছেন।

 

গত ২২ শে জুন কুষ্টিয়ার একটি গ্রামে মুক্তিবাহিনী গেরিলাদের আক্রমণে ১৬ জন পাক হানাদার খতম হয়েছ। গেরিলাদের সঙ্গে বৈদ্যনাথ তোলা ও কৃষ্ণ নগরের কাছে দুটি আলাদা জায়গায় পাক হানাদারদের ৬ ঘণ্টা ব্যাপী গোলাবিনিময় হয়।  উভয় পক্ষই মর্টার নিয়ে আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণ চালায়। খুলনা জেলার গনরাখালিতে পাক সেনা ভর্তি ট্রাকের ওপর গেরিলা বাহিনী আক্রমণ করেন এবং এখানেও কিছু পাক সৈন্য নিহত হয়।

 

 

দালালরা খতম হচ্ছে

 

বিভিন্ন শহর গ্রাম থেকে মুসলিম লীগ ও জামাত ই ইসলামের গুণ্ডা ও হানাদার সৈন্যের পদলেহি দালালদের খতম করার কাজ ব্যাপক হারে শুরু হয়েছে। এর মধ্যে মুক্তিফৌজ পাটকেল ঘাটা, টালা, পাইকগাছা, আশা শুনি, বদর তোলা, কলারোয়া প্রভৃতি স্থানে ১৬ জন দালালকে গুলি করে হত্যা করেছেন।

 


 

বাংলাদেশই আমার পরিবার

 – মেজর খালেদ

 

লন্ডনের স্বাধীন টেলিভিশন ‘ওয়ার্ল্ড ইন একশন’ নামক নামক সাপ্তাহিক এক জনপ্রিয় অনুষ্ঠানে সম্প্রতি বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের এক বিবরণ দেয়া হয়েছে। মুক্তিফৌজ নেতা মেজর খালেদ টেলিভিশন রিপোর্টারদের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন – ‘বাংলাদেশে একটি লোকও জীবিত থাকা পর্যন্ত এই সংগ্রাম চলবে বাংলাদেশ থেকে পাকসেনা খতম করে তবে থামব।’

 

আমেরিকায় ট্রেনিংপ্রাপ্ত জনাব খালেদ গত ১৮ বছর ধরে পাক সামরিক বাহিনীতে ছিলেন। তিনি বলেছেন, ‘পাক বাহিনী হেলিকপ্টার এবং ভারি অস্ত্র শস্ত্র ব্যাবহার করে আমাদের লোকদের মনোবল ভেঙ্গে দিতে চাইছে।’

 

মেজর খালেদ বলেছেন, ‘পাক বাহিনী বাঙ্গালী মেয়েদের উপর অকথ্য অত্যাচার চালাচ্ছে এবং তাদের শ্লীলতাহানি করছে।’

 

মেজর খালেদ আরও বলেছেন, ‘মহান সংস্কৃতির ধারণ আমরা। দেশীয় কাব্য ও সাহিত্যের জন্য আমরা গর্বিত। আমরা কোন দিনই হিংসাপরায়ণ ছিলাম না। পাক বাহিনীর অত্যাচারের বদলা নেয়ার জন্যই আমরা হিংসার আশ্রয় নিয়েছি।’

 

তিনি বলেছেন, ‘বিশ্বাস ঘাতকদের আমরা হত্যা করব। বাংলাদেশে আমরা ক্রীড়ানক সরকার গঠন করেয়ে দেব না। আমরা ন্যায়ের জন্য সংগ্রাম করছি।’

 

নিজের পরিবার সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন যে, ‘অন্যান্য বহু পরিবারের ভাগ্যে কি হয়েছে আমি নিজের চোখেই দেখেছি। নিজের কথা চিন্তা করার অধিকার এখন আর আমার নেই। বাংলাদেশই আমার পরিবার।’

 

  • জয় বাংলা, ২ই জুলাই ১৯৭১

কুমিল্লা শহর অন্ধকার, বহু স্থানে গেরিলা লড়াই

 

ঢাকা, ২ রা জুলাই (রয়টার) – ত্রিপুরা সীমান্তের কাছে বাংলাদেশের কুমিল্লা শহরে কার্ফু জারি করা হয়েছে। রাতে সেখানে বিস্ফোরণের সন্দ শোনা যায়। এখানে আগত যাত্রীদের কাছে এই খবর জানা গেছে।

 

বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্র উড়িয়ে দেবার ফলে কুমিল্লা শহরে পাঁচ দিন ধরে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে।

 

মুক্তিফৌজ ঐ বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে উড়িয়ে দিয়েছেন বলে স্থানীয় লোকের ধারণা।

 

সোমবার ইয়াহিয়া যখন বয়েটার ভাষণ দিচ্ছিলেন, তখন কুমিল্লায় কয়েকবার বিস্ফোরণ এর শব্দ শোনা গেছে। ৪ টি প্রচণ্ড বিস্ফোরণের জন্য চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়।

 

বিমান বন্দর এলাকায় ঐ বিস্ফোরণ হয়েছে বলে প্রকাশ। গত রাত্রেও দশবার বোমা বিস্ফোরণ এর শব্দ হয়েছে।

 

 

গেরিলা অভিযান জোরদার

 

মুজিব নগর থেকে পি টি আই এর খবরে প্রকাশ, বাংলাদেশের সকল রণাঙ্গনে মুক্তিফৌজের গেরিলা অভিযান জোরদার হওয়ায় বহু পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়েছে।

 

যশোর এলাকায় ২৮ শে জুন মুক্তিফৌজ টহলদারি একদল সৈন্যকে অতর্কিতে আক্রমণ করে। কয়েকদিন আগে রংপুর এলাকার একটি সীমান্ত ঘাঁটি আক্রমণ করে মুক্তিফৌজ একজন পাক সৈন্যকে  খতম ও কয়েক জনকে আহত করে।

পাক সৈন্যদের সঙ্গে সহযোগিতা গেরিলারা মুসলিম লীগ ও জামাত ই ইসলামি দলের সমর্থকদের বাড়ি- ঘর জ্বালিয়ে দিয়েছেন। পাটনিতলার উত্তর পশ্চিম সীমান্তে এই ঘটনা ঘোতে। চিল্মারি এলাকার একটি গ্রাম থেকে মুক্তিফৌজ মুসলিম লীগের তিনজন সদস্যকে ধরে নিয়ে গেছেন।

 

মুক্তিফৌজ ২৬ শে জুন তারিখে একটি পাটের গুদামে আগুণ লাগিয়ে দেয়। সৈন্যদের তিনজন সহযোগী নহত হত।

 

ঠাকুওগাওয়ে উত্তর -পশ্চিম এলাকায় পাক সেনাঘাটির ওপর মুক্তিফৌজ ২৮ শে জুন আক্রমণ চালান।

 

 

শ্রী হট্টে গেরিলা তৎপরতা

 

জুড়ির কাছে একটি চা কাড়খানা গেরিলাদের দারা আক্রান্ত হয়। সৈন্যদের ৪ জন সহযোগী নিহত হয়েছে। শ্রীহট্টের উররত পূর্বে কোন এক এলাকায় মুক্তিফৌজ একটি সড়ক নষ্ট করে দেন।

 

কুলিম্মায় পাক সৈন্যরা রেল লাইনের কাছা কাছি গ্রাম থেকে লোকদের সরে যেতে বাধ্য করেছে। গেরিলাদের অতর্কিত আক্রমণ এড়ানোর জন্য এই ব্যাবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

 

কয়েকদিন পূর্বে কুমিল্লার কাছে একটি সামরিক প্রহরা ঘাঁটি আক্রমণ করে মুক্তিফৌজ ৬ জন পাক সৈন্যকে খতম করেন। আখাঊড়ার কাছে অতর্কিত ভাবে পাক সেনাদের আক্রমণ করায় কয়েকজন পাক সৈন্য হতাহত হয়।

হাজীগঞ্জের পুলিশ সার্কেলে কমান্ডরা সামরিক ঘাঁটি আক্রমণ করায় কয়েকজন আহত হয়।

 

–       যুগান্তর, ৩ জুলাই, ১৯৭১

 

 

মুক্তিফৌজ দখলে বহু এলাকা ফিরে আসছে

 

শিলং, ৩ রা জুলাই মুক্তিফৌজের বহু প্রতীক্ষিত বর্ষা এসে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের বিভিন্ন রণাঙ্গনে শুরু হয়েছে পাক বাহিনীর উপর প্রচণ্ড আক্রমণ। পাক সৈন্যকে এখন আত্মরক্ষার পথ খুঁজতে হচ্ছে। বিভিন্ন রণাঙ্গনে এখন মুক্তিফৌজের আধিপত্য বিরাজ করছে। প্রতিদিনের যুদ্ধে এখন মুক্তিফৌজ সাফল্য অর্জন করছে।

 

ভারতীয় সীমান্ত থেকে ২৫ কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকার পাক সৈন্যদের বিতাড়িত করায় বাংলাদেশের উত্তর প্রান্তের বহু এলাকা এখন মুক্তিফৌজদের দখলে এসেছে।

 

আওয়ামীলীগের জনৈক মুখমাত্র আজ বলেন যে, শ্রী হট্ট ও ময়মনসিংহ এলাকায় কমান্ডো আক্রমণে সম্প্রতি ৩০০ জন পাক সৈন্য নিহত হয়েছে।

 

প্রায় ৪০০ পাক্সইন্য গুরুতর আহত অবস্থায় শ্রী হট্ট অসামরিক হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। ঐ হাসপাতালটিকে এখন সামরিক হাসপাতালে রূপান্তরিত করা  হয়েছে।

 

ময়মনসিংহ জেলার টাঙ্গাইল এলাকার দক্ষিণে মুক্তিফৌজ ঢুকে পড়েছেন। চারটি থানার এলাকা এখন তাদের দখলে এসেছে। কয়েক দফা আক্রমণ চালিয়ে পাক সৈন্যরা সেখান থেকে মুক্তিফৌজকে হটাতে পারেনি।

 

বাংলাদেশের উত্তর রণাঙ্গনে প্রতিদিন মুক্তিফৌজ সাফল্য অর্জন করছে। আসাম- মেঘালয় সীমান্তের বিপরীত দিকে সকল সীমান্ত ঘাঁটি এখন মুক্তি ফৌজের দখলে এসে গেছে।

 

উপর্যুপরি কমান্ডো আক্রমণে পাক সৈন্যরা এখন ভয়ে সদা কম্পমান। তাদের মনোবল নেই বল্লেই চলে।

 

 

 

মুক্তিফৌজের আক্রমণে বহু পাক সৈন্য খতম

(নিজস্ব প্রতিনিধি)

 

রায়গঞ্জ, ৩ রা জুলাই – গতকাল রাত্রে দিনাজপুরের কাছে মুক্তিফৌজ কমান্ডো পাক বাহিনীর ঘাঁটি আক্রমণ করলে দশ জন পাক সৈন্য নিহত হয়। তারা প্রচুর অস্ত্র শস্ত্র সহ কয়েকটি মেশিন গান আটক করে।

গত বৃহস্পতিবার রাত্রে মুক্তিফৌজ দিনাজপুরে বোমাবর্ষন করে। ঐ দিন রাত্রে মর্টার ও মেশিন গান নিয়ে মুক্তিফৌজ বগুড়া আক্রমণ করে।

 

 

বিয়ানী বাজারে ৮ জন পাক সেনা খতম

 

আগরতলা থেকে ইউ এন আই এর খবরে বলা হয়েছে – গত সপ্তাহে মুক্তিফৌজ পাক বাহিনীর উপর আক্রমণ চালিয়ে ৮ জন পাকসেনাকে খতম করে এবং বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ধোনাই জুড়ি সড়কে দুটি সড়ক সেতু ধ্বংস করে। সীমান্তের ওপার থেকে পাওয়া খবরে একথা জানা গেছে।

 

অভিজ্ঞ মহল থেকে বলা হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধারা গত ২৮ শে জুন গুপ্তস্থান থেকে দুটি পাক বাহিনীর উপর আক্রমণ চালিয়ে বহু পাকসেনাকে খতম করে। ঐ মহল থেকে আরও বলা হয়েছে যে পাক জঙ্গিশাহী ইতিমধ্যে মিল ও শিল্প প্রতিষ্ঠানে নাশকতামূলক কাজ বন্ধ করার জন্য শিল্প নিরাপত্তা বাহিনী গঠন করেছে।

–       যুগান্তর, ৪ ঠা জুলাই, ১৯৭১

 

 

বাংলাদেশের বিভিন্ন খণ্ডে গেরিলা তৎপরতা বৃদ্ধি

(বিশেষ প্রতিনিধি প্রেরিত)

 

নয়াদিল্লী, ৭ জুলাই নির্ভরযোগ্য সূত্রে প্রাপ্ত সংবাদে যানা গিয়েছে যে, গত সপ্তাহে বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনী বাংলাদেশের বিস্তৃত অঞ্চলে তাদের গেরিলা তৎপরতা বৃদ্ধি করেছেন।

 

গেরিলা আক্রমণের একটা লক্ষণীয় বিশিষ্ট এই যে, মুক্তি বাহিনী কামান ও মর্টার ব্যাবহার করছেন।

 

মুক্তিফৌজের  গেরিলা আক্রমণের একটি সুফল হল – পাকিস্তানী সৈন্যরা সন্ত্রস্ত ও বিহ্বল  হয়ে পড়ছে। তারা ক্রমশ কি রকম নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। অবশ্য ক্ষয়ক্ষতির ঝাপটা তাদের ওপর দিয়ে কম যাচ্ছেনা।

 

জানা গিয়েছে যে, পূর্ব দিনাজপুরের পাঁচ গড়ের ৮ মাইল উত্তরে আমড়া খামা সীমান্ত চুক্তি গত ৪ঠা জুলাই থেকে মুক্তিফৌজের অধিকারে আছে।

 

মুক্তিবাহিনী ডাম্বার এর উত্তরে সৈয়দ পুর ও চিলা হাঁটির মধ্যে রেল যোগাযোগ ব্যাবস্থা বিপর্যস্ত করে দিয়েছে।

বয়ড়া অঞ্চলে মুক্তিবাহিনী পাক সৈন্যদের উপর কামান ও মর্টার নিয়ে আক্রমণ করে।

গত ৩ রা ও ৪ ঠা জুলাই মুক্তিফৌজ ঠাকুরগাঁওয়ের ১৪ মাইল উত্তর পশ্চিমে পাক বাহিনীর লাহিড় চৌকিটির উপর কামান ও মর্টার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

 

জানা গিয়েছে যে, পাক বাহিনী দিনাজপুর ও রংপুর খণ্ডে মুক্তিফৌজ অধিকৃত আতঙ্ক সৃষ্টিকারী বিভিন্ন সৈন্যদল পাঠাচ্ছে। এরকম একটি দল ভুরুংগমারির ৬ মাইল দক্ষিণে পাঠানো হয়।

 

ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও অন্যান্য গুরুত্তপূর্ণ অঞ্চলে গেরিলারা বিশেষ ভাবে তৎপর হয়ে উঠেছেন।

 

শিলিগুড়ি থিক আমাদের নিজস্ব সংবাদ দাতা জানাচ্ছেন যে, গত রবিবার মুক্তিফৌজ দিনাজপুরের কোয়াগ্রামে পাকসেনাদের উপর আকস্মিক আক্রমণ চালিয়ে ৬ জন পাকসেনাকে খতম করেছেন। এবং ১ জন কে গুরুতর আহত অবস্থায় বন্দী করেছেন। এর ফলে বোরাক্রাম অঞ্চলের অধিবাসীদের মনোবল বৃদ্ধি পেয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। আরেকটি সংবাদে জানা গিয়াছে যে বাংলাদেশ মুক্তি ফৌজ রবিবার রাত্রে বগুড়া জেলার ঘোড়া ঘাটে পাক সেনাবাহিনীর একটি অস্ত্রাগার উড়িয়ে দেন। ফলে পাক বাহিনীর বিপুল পরিমাণ গোলা বারুদ ধ্বংস হয়।

 

 

ঢাকা ময়মন সিংহ সংযোগ সেতু বিধ্বস্ত

 

নয়াদিল্লী – ৭ ই জুলাই বি বি সির সংবাদে প্রকাশ মুক্তিফৌজ গেরিলারা ঢাকা ময়মনসিংহ সংযোগ রক্ষাকারী একটি সেতু উড়িয়ে দিয়েছে।

 

বি বি সি র প্রতনিধি বলেন যে, পাক বাহিনী শিকার করেছে যে সঙ্ঘর্ষ এমন একটি স্থানে সঙ্ঘটিত হয়েছে যে যেখানে বিদ্রোহীরা অন্তর্ঘাতমূলক কার্যে লিপ্ত আছে।

 

-যুগান্তর – ৮ জুলাই, ১৯৭১

 

 

মুক্তিফৌজ পাক সেনাবাহিনী ট্রেন সহ রেল সেতু উড়িয়ে দিয়েছে

(নিজস্ব সংবাদ দাতা)

 

দিনহাটা – ৯ জুলাই সীমান্তের অপর পার থেকে প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ , গত বুধবার মুক্তিফৌজ লাল্মনির হাঁট খণ্ডে পাক সৈন্য সমেত একটি রেল সেতু উড়িয়ে দিয়েছে।

 

এদিকে মুক্তিফৌজের গেরিলা কমান্ডো বাহিনীর মোকাবিলা করার জন্য পাকিস্তানী সৈন্যরাও গেরিলা যুদ্ধ প্রস্তুতি অবলম্বন করেছে। গত কয়েক দিনে তারা মুক্তিফৌজের গেরিলাদের খতম করবার ব্যার্থ প্রয়াস করেছে। কিন্তু তৎসত্ত্বেও খোদ ঢাকা শহরেই পাক সেনাবাহিনীকে গ্রেনেড দিয়ে আক্রমণ করা হয়েছে।

 

সংবাদ প্রকাশ, মুক্তিফৌজের গেরিলারা লালমনিরহাঁট – পাটগ্রাম সেকশনে লালমনিরহাঁট স্টেশন থেকে ১ মাইল দূরে দোল বাজারের উপর একটি ডিনামাইট রেখেছিল। একটি সৈন্য বাহিনী ট্রেন পুলের ওপর দিয়ে লালমনির হাঁট থেকে হাতিবান্ধার দিকে অগ্রসর হবার সময় ডিনামাইট ফেটে যায় এবং সেতুটি ও ট্রেনটি উড়ে যায়।

 

 

তিনটি বগি বিচূর্ণ

 

কৃষ্ণ নগর, ৯ জুলাই – গত ৭ জুলাই কুষ্টিয়ায় জগতী রেল স্টেশনের নিকটে মুক্তি ফৌজের পোঁতা মাইনের ওপর দিয়ে একটি পাকিস্তানী ট্রেন চলার সময় ট্রেনের ৩ টি  বগি চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেছে এবং কয়েক ব্যাক্তি আহত হয়েছে।

 

এখানে প্রাপ্ত সংবাদে প্রকাশ, খুলনা থেকে গোয়ালন্দ যাওয়ার পথে এ ঘটনা ঘটে।  ট্রেনে পাকিস্তানী সৈন্য ও বেসামরিক লোক ছিল।

 

ওইদিন রাত্রিবেলায় মুক্তিফৌজ খুলনা- কুষ্টিয়া সেকশনে আলম ডাঙ্গার  নিকটে একটি গুরুত্তপূর্ন রেল সেতু উড়িয়ে দিয়েছে।

 

 

 

তরুণদের জোর করে রাজাকার বাহিনীতে ভর্তি করা হয়েছে

 

বাংলাদেশে পাক সৈন্যরা একটি আধা সামরিক বাহিনী গঠন করছে। তার নাম রাজাকার বাহিনী।। এতে বাঙ্গালী তরুণদের জোর করে ঢুকান হচ্ছে। কুষ্টিয়া জেলার জনৈক আওয়ামীলীগ নেতা জানাচ্ছেন যে, বল প্রয়োগে বাঁধা দিলে ঘর থেকে যুবতীদের টেনে বার করে ছাউনিতে নিয়ে যাওয়া হবে বলে পাকিস্তানীরা শাসাচ্ছে। এর ফলে নিরাপত্তার আশায় বহু তরুণ তরুণী সীমান্তের দিকে পালিয়ে আসছে।

–       পি টি আই

 

 

বহু পাক সৈন্য নিহত

 

আগরতলা থেকে পি টি আই জানাচ্ছেন , মুক্তিফৌজের গেরিলা বাহিনীর তৎপরতা সম্প্রতি সারা বাংলাদেশে ব্রিধি পেয়েছে। ঢাকা নতুন বাজার এলাকায় গত ৫  জুলাই টহলদারি পাক বাহিনীর উপর হাত বোমা নিক্ষেপ করলে বহু পাক সৈন্য হতাহত হয়। সীমান্তের ওপর থেকে পাওয়া সংবাদে জানা গেছে , এই আক্রমণে একজন অফিসার সহ ৭ জন পাক সৈন্য নিহত হয়েছে।

 

অন্য এক সংবাদে জান গেছে, গত ৭ জুলাই মুক্তিফৌজ শ্রী হট্টের তেলিয়াপাড়া চা বাগানে পাক সৈন্য শিবিরে হানা দিয়ে ১৫ জন পাকসেনাকে খতম করে। এই ১৫ জন সমেত ঐ রণাঙ্গনে মোট ৩৯ জন পাকসেনা খতম হয়েছে। গতকাল ও আজ করিমগঞ্জ সীমান্তেও মোট ৯ জন পাকসেনাকে মুক্তিফৌজ গেরিলারা হত্যা করেছে। গত ৬ জুলাই লাকসাম ও কুমিল্লার মসয়ে টেলিফোন লাইন মেরামতের সময় গেরিলা বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণে ৫ জন পাকসেনা নিহত হয়। মুক্তিফৌজ ঐ টেলিফোন লাইন বিকল করে দেয়।

 

গত ৪ ঠা জুলাই সলদার বাজারে মুক্তিফৌজের মর্টার আক্রমণে ৫০ জন পাকসেনা নিহত হয়েছে এবং প্রায় ১০০ সৈন্য আহত হয়েছে।

 

ওইদিন কুমিল্লা জেলার কোটেশ্বরএর কাছে মুক্তিফৌজের আক্রমণে বহু পাকসেনা হতাহত হয়েছে। মুক্তিফৌজের কাছ থেকে  পাকসেনার  কোটেশ্বর দখল করার চেষ্টা করছে। কিন্তু কোটেশ্বর এখনো মুক্তি সেনাদের দখলেই আছে।

ক্রিস নগরের এক সংবাদে বলা হয়েছে, মুক্তিফৌজ আলম ডাঙ্গা স্টেশনের কাছে একটি গুরুত্তপূর্ন রেল সেতু ধ্বংস করে দেয়াতে ঈশ্বরদী দর্শনা ও কুষ্টিয়া দর্শনা শাখায় ট্রেন চলাচল ব্যাবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।

 

–       যুগান্তর, ১০ জুলাই, ১৯৭১

 

 

 

বিভিন্ন রণাঙ্গনে মুক্তিফৌজের বিপুল সাফল্য

(নিজস্ব বার্তা পরিবেশক)

 

গত এক পক্ষকালের মধ্যে বাংলাদেশের মুক্তিফৌজ দখলকারী পাক বাহিনীর উপর আক্রমণের তীব্রতা ও ব্যাপকতা বিপুলভাবে বৃদ্ধি করেছে এবং বিভিন্ন রণাঙ্গনে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করিয়াছে। পর্যবেক্ষকগন ইহাকে ‘বর্ষা অভিযানের’ সূচনা বলিয়া মনে করিতেছেন।

 

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের খবরে প্রকাশ, চট্টগ্রামের বহু গ্রামাঞ্চলে এখন মুক্তিফৌজের দখলে এবং এইসব এলাকার গৃহ শীর্ষে স্বাধীন বাঙলার পতাকা শোভা পাইতেছে।

 

অপর এক সূত্রে প্রাপ্ত খবরে যানা যায় যে, ২ দিন ব্যাপী প্রচণ্ড লড়াইয়ের পর ৮ জুলাই মুক্তি ফৌজ দিনাজপুর জেলার ঠাকুরগাঁও মহকুমা শহর দখল করে। উল্লেখযোগ্য যে, ঠাকুরগাঁও এলাকা একটি কমিউনিস্ট প্রভাবিত এলাকা। এবং এখানকার লড়াইয়ে আওয়ামীলীগ ও ন্যাপ কর্মিদের সহিত কমিউনিস্ট কর্মি বৃন্দও সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন।

 

আমাদের সংবাদ দাতা জানাইতেছেন, ঢাকা জেলার নারায়ণগঞ্জ মহকুমার বিস্তীর্ণ গ্রামঅঞ্চলে মুক্তিফৌজ গত কিছু দিনে বহু সংখ্যক পাক হানাদার সেনা খতম করেন। এবং অনেক গুরুত্তপূর্ন রেল ও সড়ক সেতু ধ্বংস করেন। এই মুক্তিফৌজ ইউনিট টি নরসিংদীর একজন কুখ্যাত মুসলিম লিগ পন্থী বেইমানকে হত্যা করেন। এই এলাকার সংগ্রামে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ও কৃষক সমিতির কর্মিরা  নেতৃত্ব দেন।

 

বি বি সি র ক্ষবে শিকার করা হয়েছে যে, সাম্প্রতিক কালে মুক্তিফৌজের তৎপরতা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পাইয়াছে এবং ঢাকার অদূরে পাক বাহিনীর সহিত মুক্তিফৌজের বহু সঙ্ঘর্ষ ঘটে।

খোদ ঢাকা শহরে মুক্তিফৌজ কর্তৃক অভিজাত নিউ মার্কেট এলাকায় বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হইলে সামরিক কর্তৃপক্ষ গত সোম বার  হইতে পুনরায় সান্ধ্য আইনের কড়াকড়ি বৃদ্ধি করে বলিয়া বাংলাদেশ সরকার সূত্রে যানা গিয়াছে। উল্লেখযোগ্য যে ইতিপূর্বেও মুক্তিফৌজ ঢাকার বেতার কেন্দ্র, বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্রে ও ইন্টার কন্টিনেন্টাল হোটেলে এবং গভর্ণর ভবন ও সেক্রেটারিয়েটের সম্মুখে বোমা বিস্ফোরণ করে।

 

আকাশ বানীর এক খবরে বলা হয়, মুক্তি বাহিনী প্রচণ্ড আক্রমণ চালাইয়া ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল জেলার তিনটি থানাকে মুক্ত করে।

 

ইহা ছাড়াও বিভিন্ন রণাঙ্গন হইতে প্রাপ্ত খবর প্রকাশ, সিলেট, কুমিল্লা, ফেনী, কুষ্টিয়া, ময়মন সিংহ প্রভৃতি রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা উল্লেখযোগ্য রূপে বৃদ্ধি পাইয়াছে। এবং সর্বত্র ইয়াহিয়া খানের দস্যু বাহিনী নাস্তানাবুদ হইতেছে। বিপলসঙ্খ্যক পাকসেনা মুক্তিফৌজের হাতে নিহত হইয়াছে। বরিশাল ও পটুয়াখলির জল পথেও পাক ফৌজকে অতর্কিত আক্রমণের শিকার হইতে হইয়াছে। বরিশাল ও পটুয়াখালীর জল পথেও পাক ফৌজ কে অতর্কিত আক্রমণের শিকার হইতে হইয়াছে।

 

অপরদিকে পাক ফৌজ শহর ও গ্রাম অঞ্চলের নিরস্ত্র মানুষের উপর হামলা ও অগ্নি সংযোগ অব্যাহত রাখিয়াছে। এবং অগণিত ণর নারী ও শিশুকে হত্যা করিয়াছে। ঢাকা সফরকারী ব্রিটিশ পার্লামেন্টারি দলের নেতা লন্ডনে ফিরিয়া গিয়া মন্তব্য করেন যে, বাংলাদেশে গণহত্যা এখনো চলিতেছে।

 

 

মুক্তিফৌজের সাফল্য

 

গত ৩ মাসের লড়াইয়ের ফলাফল পর্যালোচনা করিলে দেখা যায় বাংলাদেশের মুক্তিফৌজের সাফল্য মোটেই সামান্য নয়।  মুজিব – ইয়াহিয়া আলোচনা চলিতে থাকা কালে ইয়াহিয়া বেইমানি করিয়া ২৫ শে মার্চ রাতের অন্ধকারে বাংলাদেশের জনগণের উপর যখন তাহার দস্যু বাহিনী লেলাইয়া দেয় তখনো জনগণের তরফে এইরূপ একটি সশস্ত্র ও সর্বাত্তক লড়াইয়ের বাস্তব প্রস্তুতি ছিলোনা বলিলেই চলে। অল্প সময়ে মধ্যে বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ই পি আর, পুলিশ প্রভৃতি অস্ত্র হাতে প্রতিরোধের জন্য রুখিয়া দাঁড়ায়। তবে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত ইয়াহিয়া দস্যুবাহিনির সহিত সম্মুখ যুদ্ধে বিজয় লাভ ছিল দুষ্কর। প্রথম দিকে বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ই পি আর এর বিভিন্ন অংশের পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগ কিংবা যুদ্ধ তৎপরতার সমন্বয় সাধনের ব্যাবস্থা ছিল না। তদুপরি অস্ত্র শস্ত্র গোলাবারুদ যানবাহন প্রভৃতির অভাব তো ছিলই। কিন্তু তাহা সত্ত্বেও মুক্তি ফৌজ অতুলনীয় বীরত্বের সহিত লড়াই করিয়া বহু শত্রু সৈন্য হতাহত করেন। বাংলাদেশের সর্বত্র ইয়াহিয়ার দস্যু সৈন্যরা মুক্তিফৌজ ও জনগণের নিকট হইতে বাঁধার সম্মুখিন হত এবং বিভিন্ন জিলা ও বিস্তীর্ন গ্রাম অঞ্চল দীর্ঘ দিন পর্যন্ত মুক্ত ছিল।

 

বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে মুক্তিফৌজ দ্রুত যুদ্ধ কৌশল পরিবর্তন করিয়া গেরিলা যুদ্ধের পদ্ধতি অবলম্বন করে। ইহার ফলে সর্বত্র ইয়াহিয়ার ফৌজ নাজেহাল হইতেছে। দখলকারী সেনাবাহিনীর ২০/২৫ হাজার সৈন্য ও কয়েক শত অফিসার নিহত হইয়াছে। আহতের সংখ্যা আরও বেশী। সৈন্যদের মনোবল ভাঙ্গিয়া পড়িতেছে। উহারা যুদ্ধ অপেক্ষা লুট তরাজেই অধিকতর উৎসাহী হইয়া উঠিয়াছে। ইয়াহিয়ার সৈন্য বাহিনী সময়ে  সময়ে গ্রাম অঞ্চলে গিয়া নিরীহ গ্রাম বাসীদের উপর অত্যাচার উৎপীড়ন চালাইলেও উহারা সাধারণভাবে বড় বড় শহর বাজারের ঘাঁটিগুলিতেই আবদ্ধ। যতোই দিন যাইতেছে, মুক্তিফৌজের সংখ্যা , ট্রেনিং এর সুযোগ সুবিধা ও দক্ষতা ততই বৃদ্ধি পাইতেছে এবং ইয়াহিয়া খানের ভাড়াটিয়া বাহিনী দেশপ্রেমিন মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নাস্তানাবুদ হইতেছে।

–       মুক্তিযুদ্ধ, ১১ ই জুলাই , ১৯৭১

 

 


 

রণাঙ্গন থেকে লিখছি

 

বিশ্বাস ঘাতক ইয়াহিয়ার দস্যু সেনাদের সাথে মুক্তি ফৌজের যেসব যুদ্ধ হয় নিম্নে তাঁর সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেয়া গেল।

 

চারান

বিগত ২২ শে মে ৫০ জন বর্বর হানাদার সেনা কালিহাতি থানার বলস্না গ্রামে নিরীহ জনসাধারণের ঘর বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। ফেরার পথে ১০ জন মুক্তি ফৌজ গেরিলা কায়দায় তাদের আরান গ্রামে আক্রমণ চালায়। ৪০ মিনিট স্থায়ী যুদ্ধে ২০ জন শত্রু সৈন্য নিহত ও বহু সংখ্যক আহত হয়। শত্রুসেনার গুলিতে ২ জন গ্রাম বাসী নিহত হয়। বিপুল ক্ষয় ক্ষতি শিকার করে বর্বর সেনারা কালিহাতির দিকে পালিয়ে যায়।

 

বইলামপুর

গত ৩ রা জুন বইলাম পুরে পাঞ্জাবিদের দালাল পুলিশ এবং মুক্তিবাহিনীর মধ্যে এক খণ্ড যুদ্ধ হয়। মুক্তিবাহিনী বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে  ৭ জন দালাল পুলিশ গ্রেফতার করেন।  

 

বল্লা

১২ই জুন বলস্না গ্রামে বর্বর তাতার বাহিনীর উপর মুক্তিবাহিনী প্রচণ্ড আঘাত হানেন এবং কমপক্ষে ৫৮ জন শত্রু খতম করেন। সুদীর্ঘ ৫ ঘণ্টা যুদ্ধের পড় পাকসেনারা পিছু হটে। মুক্তিফৌজ ৪ টি শত্রুপলা সহ বহু অস্ত্র শস্ত্র  এবং গোলাবারুদ উদ্ধার করেন।

 

কামুটিয়া

গত ১৬ ই জুন সকাল ১০ টা ১৫ মিনিট বাশাইল থানার কামুটিয়া গ্রামে মুক্তিবাহিনী এবং তথাকথিত পাকিস্তানী সেনার সাথে এক তুমুল যুদ্ধ সঙ্ঘটিত হত। এই যুদ্ধে ১৯ জন পাকসেনা নিহত ও ৬০ জন আহত হয়।

 

বিগত ১৮ জুন মুক্তিবাহিনী এবং হানাদার সৈন্যদের মধ্যে পুনরায় যুদ্ধ বাধে। এই যুদ্ধে ১৪ জন হানাদার সৈন্য নিহত হয়। মুক্তিবাহিনী ২ তি চিনা গান, ১ তি মেশিন গান ও ১ তি এল এম জি সহ বহু অস্ত্র শস্ত্র উদ্ধার করে।

 

 

ভালুকা

বিগত ২ রা জুন ময়মন সিংহ জেলার ভালুকা থানা ভাওয়াদিলাবাজু ঘাটে আমাদের মুক্তিবাহিনীর ৬ নং প্লাটুন এবং হানাদার দের সাথে সকাল ৯ টা থেকে ৪২ ঘণ্টা ব্যাপী তুমুল লড়াই হয়। এই লড়াইয়ে ১২৫ জন হানাদার সেনা খতম হত। এবং ৭৫ জন আহত হয়।

 

গত ২ রা জুন ভালুকা শত্রু ঘাঁটির উপর মুক্তিবাহিনী গ্রেনেড চার্জ করে। ফলে ১৭ জন শত্রু নিহত ও কয়েকজন গুরুতর আহত হয়।

 

–       রণাঙ্গন, ১৩ জুলাই, ১৯৭১

 

 


 

নারীর বেশে মুক্তিফৌজ

নওয়াবগঞ্জ (রাজশাহী) , ১০ জুলাই

 

সম্প্রতি রাজশাহী নওয়াবগঞ্জ মহকুমার সাপাহার নামক স্থানে নারী বেশে একজন মুক্তিফৌজ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। ১৬ থেকে ১৮ বছরের এক যুবক (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) পূর্ন যৌবনা এক যুবতির বেশ ধারণ করে মাথায় এক ঝুরি পাকা কলা নিয়ে সাপাহারের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল। এমন সময় জীপ গাড়ি নিয়ে ৫/৬ জন পাক ফৌজ সেখানে আসে। পক ফৌজ দেখে মেয়েটি ভয় পেয়েছে এমন ভাব দেখিয়ে সে মাঠের দিকে ছুটতে থাকে। লোভী জঙ্গিরা তাদের লোভ সংবরণ করতে না পেরে গাড়ি থামিয়ে মেয়েটির পেছনে ছুটতে থাকে। মেয়েটি কিছুদূর গিয়ে আলের ধারে শুয়ে পড়ে। এবং কলার ঝুড়ি থেকে গ্রেনেড ছুড়তে থাকে। অতর্কিত আক্রমণে উক্ত লোভী জঙ্গিরা অস্ফুট আর্তনাদে প্রাণ হারায়। ছদ্মবেশী যুবতি পাকিদের গাড়ি এবং অস্ত্র শস্ত্র হস্ত গত করেছে।

–       নিজস্ব সংবাদ দাতা

 

 

মেহেরপুর মুক্ত

মেহেরপুর (কুষ্টিয়া), ১১ জুলাই

 

অদ্য মুক্তি বাহিনী ও পাকসেনার মধ্যে প্রচণ্ড লড়াইয়ের পড় মুক্তিবাহিনী মেহেরপুর মহকুমা হতে পাকসেনাদের ঘাঁটি সম্পূর্ন ধ্বংস করে দিয়ে শহরটি  দখল করে নিয়েছে।

 

আওয়ামীলীগ সভাপতি এডভোকেট জনাব বয়তুল্লাহ এম এন এ আমাদের প্রতিনিধিকে জানিয়েছেন যে মুক্তিবাহিনী একটি ট্রান্সমিটার ও ৩ ট্রাক চিনা অস্ত্র শস্ত্র হস্তগত করেছে এবং দখল কৃত ভারি অস্ত্রের সাহায্যে পলায়মান সৈন্যদের তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এপর্যন্ত তারা ৬০ জন পাকসেনাকে নিহত ও শতাধিক কে আহত করেছে।

(পি পি আই )

–       স্বাধীন বাঙলা, ১২ জুলাই, ১৯৭১

 

 

চট্টগ্রাম সহ বিস্তীর্ন এলাকা এখন মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে

(ম মামুণ – বার্তা সম্পাদক রাজশাহী বেতার – পরিবেশিত)

 

জামান গঞ্জ (রাজশাহী) ১২ই জুলাই

 

বাংলাদেশের বিস্তির্ন এলাকা এখন মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। দেশ মাতৃকার সেবায় নিবেদিত প্রাণ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অসীম সাহসিকতাপূর্ণ তৎপরতার সামনে টিকতে না পেরে বিভিন্ন এলাকায় পাক ফৌজ পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে। চট্টগ্রামের বাড়িতে বাড়িতে গৃহ শীর্ষে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা শোভা পাচ্ছে। সমস্ত চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার আনাচে কানাচে পাক ফৌজ ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে তুমুল সঙ্ঘর্ষ হচ্ছে।  

 

সর্বত্র পাক শত্রুরা খতম হচ্ছে। সতস্ফুর্তভাবে জনতা মুক্তিবাহিনীর বিজয় অবধারিত জেনে বাংলাদেশের পতাকা গৃহে গৃহে উত্তোলন করছেন। কুমিল্লা শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত টাউনহল শীর্ষেও বাংলাদেশের পতাকা শোভা পাচ্ছে বলে জানা গেছে। কুমিল্লা এখন বিস্ফোরণের শহর। প্রায় প্রতি মূহুর্তে সেখানে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যাচ্ছে।

 

এমনকি ইয়াহিয়া খানের বেতার ভাষণের সময় কুমিল্লা বিমান বন্দরের দিক থেকে ডুটি বিস্ফোরণের শব্দ ভেসে আসে। জানা গেছে সামগ্রিক ভাবে কুমিল্লা জেলা পাক ফৌজের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলেগেছে। বাইরে থেকে প্রচুর সৈন্য সামন্ত আমদানি করেও তারা মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে এঁটে উঠতে পারছেনা। যশোরে গেরিলা তৎপরতার সামনে পাক ফৌজের সব প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়েছে।

 

গত এক সপ্তাহের খণ্ড খণ্ড যুদ্ধে পাক ফৌজ  যশোরের দুই শতাধিক প্রাণ খুইয়েছে। যশোরের বিভিন্ন এলাকা থেকে পাক ফৌজ হটে গেছে বলে জানা গেছে। টাঙ্গাইল এবং ময়মণ সিংহ এখনো মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তাছাড়া ফেনী মহকুমা, দিনাজপুর জেলার অমরখানা, সিলেটের সীমান্তবর্তী এলাকায় মুক্তিবাহিনীর অধিকার সু প্রতিষ্ঠিত রয়েছে।

–       স্বাধীন বাঙলা, ১২ জুলাই, ১৯৭১

মুক্তিফৌজের তৎপরতা

 

৩০শে জুন থেকে একমাত্র উত্তর খণ্ডেই পাক ঘাঁটিগুলির ওপর ক্রমাগত আক্রমণে ও টহলদার সেনাদলের ওপর গুপ্ত অভিযান চালনায় অন্তত ১৮ জন পাক ফৌজ নিহত হয়েছে বলে যানা গেছে।

 

 

শ্রী হট্ট খণ্ডে সাফল্য

মুক্তিফৌজ কম্পক্কে ৭ জন পাকিস্তানী সৈন্যকে খতম করেছেন শ্রী হট্ট জেলার জাকিগঞ্জ থানা এলাকায়। ঐ জেলারই জয়ন্তেয়াপুর অঞ্চলে আকস্মিক আক্রমণে ৩ জন পাকসেনা  নিহত হয়েছে।

 

 

রংপুরে মুক্তিফৌজ অভিযান

রংপুর জেলার মুক্তিফৌজ চিলাহাটির নিকটে একটি সামরিক ঘাঁটির ওপর আক্রমণ চালান এবং অন্তত ২ জন পাকসেনা নিহত ও অনেকে আহত করেন । একই জেলার ঠাকুরগাঁওয়ে একটি সেতু উড়িয়ে দেয়া হয়েছে।

দিনাজপুর, পালিতলা ও থিরগঞ্জ এলাকায় পাক সেনাবাহিনীর ওপর গোপন আক্রমণ চালানোর ব্যাপারে গেরিলারা বিশেষ তৎপর হয়ে উঠেছেন।

 

 

রাজশাহী ও দিনাজপুরে তৎপরতা

গেরিলা বাহিনী ৩০শে জুন রাত্রে রাজশাহীর একটি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি অচল হয়ে পড়েছে।

অদিকে গতকাল দিনাজপুর জেলায় মুক্তিফৌজ একটি পাক টহলদার বাহিনীর উপর গোপন আক্রমণ চালিয়ে ৬ জন খানসেনা খতম করে। এরপর পাকসেনারা পশ্চিম বংগের রাধিকার পুর গ্রামের বিপরীত দিকে দুইটি গ্রাম পুড়িয়ে দেয়।

 

 

শ্রী মঙ্গলের নিকট পাক ফৌজ হতাহত

পূর্ব রণাঙ্গনে মুক্তিফৌজ ৩০ শে জুন শ্রী মঙ্গলের নিকট পাক সামরিক ঘাঁটিতে গুলিবর্ষন করে। এবং বেশ কয়েকজন পাকসেনা হতাহত করেন।

চট্টগ্রাম জেলার সীতকুন্ড এলাকাতেও মুক্তিফৌজ নিতান্ত সক্রিয়।

 

 

কুমিল্লা রণাঙ্গনে

 

১লা জুলাই কুমিল্লা জেলার আমজেদ্গরে একটি পাকিস্তানী গোলন্দাজ বাহিনী আক্রান্ত হয়। প্রতিশোধ নিতে যেয়ে পাকসেনারা ১৫ জন বেসামরিক নাগরিককে নিহত করে।

 

 

দক্ষিণ – পূর্ব খণ্ডে ৭০ জন খান সেনা নিহত

 

আগরতলা মুক্তিফৌজ কমান্ডো সাফল্যের সঙ্গে অভিযান চালিয়ে ৩ রা জুলাই দক্ষিণ পূর্ব রণাঙ্গনে ৭০ জনের অধিক পাকসেনা নিহত করেছে।

 

মুহিব নগরে প্রাত সংবাদে জানা যায় উক্ত দিবসে কসবা অঞ্চলে এক প্রচণ্ড সংগ্রামে মুক্তিফৌজ কামানের হাতে খতম হয়েছে প্রায় ৫০ জন খান সেনা।

 

ঐদিন পাক সেনারা যখন সিঙ্গার বিল রেল ওয়ে সেতুটি মেরামত করছিল , সেই মুহুর্তে মুক্তিফৌজ কমান্ডো ভয়াবহ আক্রমণ  চালান এবং ৮ জন পাক ফৌজের প্রাণ নাশ করেন। কুমিল্লা খণ্ডের ঘোলাপারাতে ও মুক্তিফৌজের গোপন আক্রমণে অন্তত ৪ জন খানসেনা খতম হয়েছে।

 

 

সাতক্ষিরায় মুক্তিফৌজের তৎপরতা

 

সাতক্ষিরায় মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে ৬০০ শত্রু সেনা নিহত হয়েছে। এছাড়া মোট ২৬ টি আক্রমণে তারা ৩০০ জন পাকসেনাকে খতম করে। ভোমরা, পারুলিয়া, মাহমুদ পুর, কুশ খালি ও কাক ডাঙ্গায় আক্রমণ চালানো হয়। এছাড়া সাতক্ষিরার বিভিন্ন অঞ্চলে মুসলিম লিগ ও জামাতে ইসলামের গুণ্ডা ও হানাদার সৈন্যদের পদলেহি দালালদের খতম করার কাজ ব্যাপক হারে শুরু হয়েছে। এর মধ্যে মুক্তিফৌজ পাটকেল ঘাটা , তালা, পাইকগাছা, আশাশুনি, বদর তোলা, কলারোয়া প্রভৃতি স্থানে ১৬ জন দালাল কে গুলি করে হত্যা করেছে।

–       স্বদেশ, ১৪ জুলাই, ১৯৭১

 

 

বাংলাদেশের নানা অঞ্চলে পাকসৈন্যের চরম বিপর্যয়

নাভারন, ঝিকর গাছা ও অন্য অনেক জায়গা মুক্তিফৌজের দখলে

(নিজস্ব প্রতিনিধি)

 

মুজিবনগর, ১৪ জুলাই – এবার পাল্টা মারের পালা। মুক্তিফৌজ এখন বাংলাদেশের নানা অঞ্চলে খানসেনাদের জোড় মার দিচ্ছে। এ মারের চোটে পাকসেনারা যশোর অঞ্চলে নাভারন ও ঝিকর গাছা ছেড়ে চলে গেছে। এই এলাকা এখন মুক্তিসেনাদের কব্জায়। অদিকে খুলনার একটি ফাঁড়ি ও মুক্তিফৌজ দখল করে নিয়েছে। এখানকার পাকসেনাদের অস্ত্র শস্ত্র সব মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে। মেহেরপুর অঞ্চলে ও পাকসেনাদের চরম বিপর্যয়। এখানে ৫৬ জন খানসেনা নিহত হয়েছে। কুমিল্লায় পাক সরকার যে তাবেদার বাহিনী সৃষ্টি করেছিল তারা এখন স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দিয়েছে। এই এলাকাতেও মুক্তি ফৌজের সাফল্য অসামান্য।

 

আজ এক আকস্মিক আক্রমণে ভারত বাংলাদেশ সীমান্তের খুলনা জেলার খাঞ্জি ফাঁড়িটি মুক্তিফৌজ কমান্ডো দখল করে নেয়।

 

এখানে মুক্তিফৌজের সদর দপ্তর থেকে জানা গেছে,  মুক্তিফৌজ পশ্চিম পাকবাহিনীকে ফাঁড়ি থেকে সরে যেতে বাধ্য করে। পশ্চিম পাক বাহিনীর পরিত্যাক্ত প্রচুত অস্ত্র শস্ত্র মুক্তিফৌজএর দখলে আসে।

 

 

 

৫৬ জন পাকসেনা খতম

 

কৃষ্ণ নগর থেকে পি টি আই জানাচ্ছেন বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমে কুষ্টিয়া জেলার মেহের পুর এলাকায় মুক্তিফৌজএর বহুমুখী আক্রমণে অন্তত ৫৬ জন পাকসেনা নিহত হয়েছে।

 

আজ এখানে সীমান্তের ওপার থেকে পাওয়া সংবাদে জানা গেছে , গতকাল সন্ধ্যায় মেহেরপুর মুক্তিফৌজ এর গেরিলা বাহিনীর ব্যাপকভাবে মর্টার ও মেশিন গানের আক্রমণে পাকবাহিনীর সৈন্যরা নিহত হয়। মেহেরপুর শহরের ২০ মাইলের মধ্যে মহিশকুউন্ড, প্রাগপুর, কাঠলি, গোপাল পুর, শৈব নগর , ইছাখালি, কাম দেব পুর, কোলা নাতুধা, দর্শনা, শ্যামপুরে মুক্তি ফৌজের গেরিলারা পাক বাহিনীর উপর আক্রমণ চালায়।

 

 

ব্যুমেরাং

 

আগরতলা থেকে পি টি আই জানাচ্ছেন, সামরিক আইন প্রশাসন মুক্তিফৌজকে খতম করার জন্য বাংলাদেশের রাজাকার, মুজাহিদ ও আনসার – এই ৩ ধরনের আধা সামরিক বাহিনী তৈরি করেছিল। কিন্তু এখন এই বাহিনী গুলো পাক বাহিনীর পক্ষে ব্যুমেরাং হয়ে দাঁড়িয়েছে।

পাক কর্তৃপক্ষ এদের সেতু ও গুরুত্ব পূর্ন স্থান পাহাড় দেবার জন্য নিযুক্ত করেন। এবং মুক্তিযোদ্ধাদের অন্তর্ঘাত্মূলক কাজে বাঁধা দিতে না পারলে তাদের গুলো করা হবে, সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে ও তাদের বাড়ির মেয়েদের উপর অত্যাচার করা হবে বলে সতর্ক করে দেয়া হয়।

 

সীমান্তের ওপর থেকে পাওয়া খবরে জানা গেছে যে, এই আধা সামরিক বাহিনী অনেক অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে মুক্তিফৌজ ও স্বাধিনিতা সংগ্রামীদের সাথে যোগ দিয়েছে।

 

 

শ্রী হট্ট হাসপাতালে স্থান নেই

 

আগরতলা থেকে পি টি আই জানাচ্ছেন, শ্রী হট্ট হাসপাতালে জায়গা নেই বলে সাইন বোর্ড টাঙ্গিয়ে দেয়া হয়েছে। মুক্তিফৌজএর হাতে আহত পাকসেনারা এখানে রয়েছে।

 

আজ সীমান্তের ওপর থেকে পাওয়া যংবাদে জানা গেছে, সাঙ্ঘাতিকভাবে আহত হয়ে ৫০০ এর বেশী অফিসার ও সৈন্য চিকিৎসার জন্য ঐ হাসপাতালে রয়েছে।

 

 

গেরিলা তৎপরতা বৃদ্ধি

 

মুজিবনগর থেকে ইউ এন আই জানাচ্ছেন , মুক্তিফৌজএর গেরিলা তৎপরতা পুনরায় বৃদ্ধি পেয়েছে। সেনাবাহিনীর স্পেশাল ট্রেন যাতে চলতে না পারে তাঁর জন্য তারা রংপুরের উত্তরে কাকিনা এলাকায় রেল লাইন তুলে ফেলেছে।

 

মুক্তিফৌজএর পোঁতা মাইন বিস্ফোরণে ৪ জন পাকসেনা নিহত হয়েছে। রংপুর এলাকায় থানা আক্রমণ করে মুক্তিফৌজ গেরিলারা ৬ জন কনস্টেবলকে খতম করে এবং তাদের অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে নেয়। গেরিলারা কয়েকটি টেলিফোন লাইন কেটে দেয়।

 

শ্রী হট্ট এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা দুটি থানা আক্রমণ করে একজন ও সি কে খতম করে। এবং প্রচুর অস্ত্র শস্ত্র দখল করে।

 

কুমিল্লা এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা সেনাবাহিনীর উপর আকস্মিক আক্রমণ চালায়। তাদের পোতা মাইনে এই এলাকায় কিছু পাকসেনা নিহত হয়।

 

 

 

নাভারন মুক্তিফৌজএর দখলে

 

কৃষ্ণনগর থেকে নিজস্ব প্রতিনিধি জানাচ্ছেন, যশোর এলাকা থেকে পাওয়া খবরে জানা গেছে, মুক্তিযোদ্ধারা নাভারন ও জিকরগাছা দখল করে নিয়েছে। এখানকার অধিবাসীরা আশ্রয়ের জন্য ভারতে চলে এসেছে। অবশ্য এদের অধিকাংশই পাকসেনাদের হাতে নিহত হয়েছে।

 

পাকশি সেতুর অধিকার নিয়ে পাক বাহিনী বেকায়দায় পড়েছে। এদিকে কুষ্টিয়া জেলার কয়েকটি গ্রাম মুক্তিফৌজ অধিকার করে নিয়েছে। পাকশি সেতুর এক প্রান্তে জোর সঙ্ঘর্ষ চলছে। মুক্তিফৌজএর মতে এই অঞ্চলে অন্তত দুশ কমান্ডো সক্রিয় রয়েছে। আরা গোলাবর্ষনের দ্বারা পাক বাহিনীকে বেশ বিব্রত করে তুলেছে। মুক্তিফৌজ ভেড়ামাড়ার জল বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নষ্ট করে দিয়েছে। ফলে এর আশেপাশের এলাকা অন্ধকারে রয়েছে।

–       যুগান্তর, ১৫ জুলাই, ১৯৭১

 

 

 

ঢাকার কেন্দ্রে আক্রমণে মুক্তিফৌজ এগিয়ে

 

নয়া দিল্লি, ১৫ জুলাই – মুক্তিফৌজ এখন দিবালোকে  ঢাকা ও সিলেট শহরে পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্য দের আক্রমণ শুরু করেছে – সংস্থাগুলো জানায়।

 

বাংলাদেশ থেকে প্রাপ্ত একটি বিলম্বিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, সম্প্রতি মুক্তিযোদ্ধারা  একটি চলমান জীপ থেকে গভর্নর, ঢাকা লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান বাসভবনের গেটে গুলি করে একজন সেন্ট্রি ও নিহত এবং  অন্য একজন আহত করে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, গতরাতে ভৈরব নদীর পূর্ব তীরে কামদেবপুরে চার পাকিস্তানি সেনা নিহত করা হয়। এই যুদ্ধ তিন ঘন্টা চলে।

 

অন্য বর্ণনা মতে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীও মহিশকুন্ডি  এবং প্রাগপুর এবং সকালে শাহিনগরে মুক্তি বাহিনীকে আক্রমণ করে।  পরে তারা পিছু হটে।

 

পাকিস্তানি সেনারা গত দুইদিন কিছু কুষ্টিয়া জেলা থেকে ভারতে পালাবার সময় তাদের উপর গুলিবর্ষণ করে এবং কিছু নিহত ও ১৮ জন আহত করে।

 

আমাদের কুচবিহার করেসপন্ডেন্টস যোগ করেছেন: রংপুর জেলায় মুক্তিবাহিনীর কাউনিয়া পাকবাহিনীর ক্যাম্পে যেখানে তারা তিস্তা রেল সেতু পাহাড় দিচ্ছিল সেখানে আক্রমণ করে। ছয় পাক সেনা  এই অভিযানে নিহত হয়। হাতীবান্ধায় ৬০ জন  মুসলিম লীগের বন্দুক ধারী জোরপূর্বক স্থানীয় জনগণের ক্ষেত্র থেকে আউশ ধান কাটতে বাধ্য করে এবং তখন মুক্তিবাহিনী তাদের হালকা মেশিনগান দিয়ে হামলা চালায়।  এখানে সাত জন মুসলিম লীগার নিহত হয়। তাদের বন্দুক  ও তোলা ধান উদ্ধার করে আনা হয়।

 

সংস্থা আরও জানায় –  ভারতের পঞ্চানন মন্ডল (৫০) নামের একজন নাগরিক কে মঙ্গলবার সীমান্ত গ্রাম করিমপুর থানার তেইনপুরে মধ্যে আসলে  পাকিস্তানি সেনারা তাকে অপহরণ করে।

 

এদিকে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা সীমান্ত গ্রাম গেদের কাছাকাছি ছয়  জন সন্দেহভাজন পাকিস্তানি গুপ্তচরদের আটক করে।

জনাব মোহাম্মদ সালাম চৌধুরী, ঠাকুরগাঁও মহকুমার একজন বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা, সম্প্রতি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত হন।

 

রিপোর্টে বলা হয়, কিছু জামাত-ই-ইসলামী ও মুসলিম লীগ নেতা, যারা নৃশংস হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিল, তাদেরকেও ছাড়া হয়নি,  পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে মেশিন-গান দিয়ে গুলি করে হত্যা করে।

 

হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড, ১৬  জুলাই, ১৯৭১

 

 

 

 

 

সার্কিত হাউজ বিনষ্ট

(নিজস্ব প্রতিনিধি)

 

সম্প্রতি মুক্তিফৌজ অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়ে সিলেটের সার্কিট হাউজ, ডেপুটি কমিশনারের বাংলো ও মজুম দাঁড়ির একটি গৃহ বিনষ্ট করেন। এসমস্ত এলাকায় পাকসেনারা অবস্থান করত।

 

অপর এক সংবাদে জানা গেছে, জুড়ির নিকট বর্তি মুক্তিফৌজ কর্তৃক বিনসেক্তা সেতু পুনই নির্মানের জন্য পাক দস্যু বাহি ৫ তি হাতি কাজে লাগায়। মুক্তিফৌজ এই ৫ টি হাতি ধরে নিয়ে আসেন এবং সেতুর দুজন পাহারাদার কে নিহত করে কিছু অস্ত্র শস্ত্র দখল করেন।

 

 

৫১ জনের প্রাণ দণ্ড

 

কুমিল্লা জেলার চাঁদপুরে বাংলাদেশ মুক্তিফৌজ গন আদালত এ পর্যন্ত ৫১ জনকে প্রাণ দণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছে। এদের মধ্যে ইয়াহিয়া সৈন্যদের দালাল ২০ জন, ২৫ জন ডাকাত এবং ১ জন পাক গুপ্ত চর রয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশ না মানার অপরাধেও ৫ জনের মৃত্যু দণ্ড হয়।

 

 

মুক্তিফৌজএর তৎপরতা

 

গত ১৩ জুলাই সকাল সাড়ে ৬ টায় বিয়ানই বাজার থানা হেড কোয়ার্টারের দেড় মাইল উত্তরে সিলেট বড়ই গ্রামে সে এন্ড বি রাস্তায় অবস্থিত সড়ক ভাংনির পুল টি মুক্তিফৌজএর অতর্কিত আক্রমণে বিধসস্ত হয়ে গেছে। পুলের নিকটে পাহারারত ৬ জন রাজাকারকে হত্যা করে ৬ টি রাইফেল ও কিছু গোলাবারুদ মুক্তিফৌজএর হস্ত গত হয়েছে।

 

গত ১৪ জুলাই পাক বাহিনীর একটি জীপে গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হলে বিয়ানীবাজারের কুখ্যাত মুসলিম লিগের দালাল কালা মিয়া আহত হয়। ১৫ জুলাই শাহ বাজ পুর এলাকায় এক গেরিলা অভিযানে মুক্তিফৌজএর হাতে ১৩ জন খানসেনা মৃত্যুবরন করেছে। উল্লেখ যোগ্য যে গত ৭ জুলাই এখানে এক গেরিলা তৎপরতায় ৭ জন পাকসেনা খতম হয়। গত ৯ জুলাই বড়্গ্রাম বি ও পি তে এক অভিযান চালিয়ে মুক্তিফৌজ দুজন দস্যু কে নিহত করে। গত ৪ঠা জুলাই জাকিগঞ্জ থানার অধিনস্ত রহিমপুরে রাস্তার একটি পাকা সেতু মুক্তিফৌজ এর গ্রেনেডের ঘায়ে উড়ে গেছে। সেতুটি পাহারারত দুজন গার্ড এর দুটি রাইফেল ও মুক্তিফৌজ এর হাতে এসেছে।

 

সেতুগুলি বিনষ্ট হওয়ায় যোগাযোগের ক্ষেত্রে এক অচলাবস্থার সম্মুখীন হয়ে খান বাহিনী সংশ্লিষ্ট এলাকাসমূহে তীব্র সংকটের সম্মুখীন হয়ে পড়েছে।

 

 

শাহবাজপুরে মুক্তিফৌজএর হাতে ৯ খান সেনা নিহত

(বিশেষ সংবাদ দাতা)

 

গতকাল ভোর সাড়ে ৫ টায় মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে শাহ বাজ পুর রেল স্টেশনে অবস্থানরত ৯ জন পাকসেনা নিহত হয়েছে। স্টেশনের পাহারারত সেন্ট্রি ও নিহত হয়েছে। এ খণ্ড যুদ্ধে মুক্তিফৌজ ৩ ইঞ্চি মর্টার ব্যাবহার করে। অন্য একটি দল একই দিনে বড় গ্রাম বি ও পি তে (সুতার কান্দি) আক্রমণ চালিয়ে কিছু সংখ্যক পাকসেনা নিহত করে। প্রশংসনীয় তৎপরতার সাথে শাহবাজপুর বড়লেখা টেলিফোন লাইন বিনষ্ট করে টেলিফোনের তার ইত্যাদি মুক্তিফৌজ নিজেদের দখলে নিয়ে এসেছে।

–       জয় বাঙলা, ১৭ জুলাই, ১৯৭১

 

গেরিলা তৎপরতা সম্প্রসারিত

গত ১ সপ্তাহে সকল রণাঙ্গনে গেরিলা তৎপরতা সম্প্রসারিত ও তীব্রতর হইয়াছে। পাক হানাদার বাহিনীর বহু হতাহত হইয়াছে মুক্তিফৌজএর প্রবল আঘাতে। কুষ্টিয়ার মেহেরপুর এলাকায় পাক বাহিনী মুক্তিফৌজএর কাছে প্রচণ্ড মার খাইয়াছে। সিলেট, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, দিনাজপুর প্রভৃতি রণাঙ্গনে মুক্তিফৌজ হানাদার দস্যু বাহিনীকে নাস্তানাবুদ করিতেছে। বরিশাল জেলার মাধব পুর এলাকায় মুক্তিফৌজ একাধিক সঙ্ঘর্ষে বহু পাকসেনা কে হত্যা করিয়াছে।

–       মুক্তিযুদ্ধ, ১৮ ই জুলাই

 

 

 

কুমিল্লা রণাঙ্গনে ১৫ দিনে ২৫০ পাকসেনা খতম

 

দক্ষিণ পূর্ব বাংলাদেশের কুমিল্লা অঞ্চলে গত ১৪ দিনের মধ্যে মুক্তিফৌজএর হাতে ২৫০ জনেরও বেশী পাকসেনা নিহত হয়েছে। এদের মধ্যে কয়েকজন অফিসার ও আছেন ।

 

প্রতিনিধি প্রেরিত খবরে জানা গেছে, গত ১৩ জুলাই মুরাদ নগর অঞ্চলে ৪ টি নৌকা বোঝাই পাক সৈন্য একটি নদী পার হচ্ছিল। এই নৌকা গুলিতে ১০৩ জনের বেশী পাকসেনা ছিল। এমন সময় মুক্তিফৌজ কমান্ডো তাদের উপর গোলাবর্ষন করে। ৬০ জন সঙ্গে সঙ্গে জলে ডুবে খতম হয়। যারা বাঁচে তারা প্রতিশোধ নেয়ার জন্য একটি গ্রামের উপর আক্রমণ চালায় মুক্তিফৌজ প্রতিরোধ করে। এখানে ১ জন মেজর সহ ১৮ জন পাকসেনা নিহত হয়।

 

এছাড়া ঐ দিনই রামচন্দ্রপুর খেয়া ঘাটে মুক্তিফৌজ এর আক্রমণে ৩১ জন পাকসেনা নিহত ও অপর ৫০ জন আহত হয়।

 

 

পাক সৈন্যরা পিছু হটছে

মুক্তিফৌজের ইশতেহার

 

মুক্তিফৌজ ইশতেহার মারফত জনগণকে জানিয়ে দিয়েছেন যে, ইয়াহিয়ার সৈন্য ৭ কোটি বাঙ্গালীকে দমিয়ে রাখতে পারবেনা। সামরিক চক্রের দ্বারা বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্য মুক্তিফৌজ আবেদন জানিয়েছে। বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমানের আশ্বাস বানি স্মরণ করিয়ে দিয়ে ইশতেহারে বলা হয়েছে যে, সম্মিলিতভাবে সংগ্রাম করুন। শীঘ্রই স্বাধীনতা অর্জিত হবে।

 

 

পাক সৈন্যের নতুন পালানোর কৌশল

 

পাক সামরিক কর্তৃপক্ষ সেনাদের নির্দেশ দিয়েছেন, ‘পিছু হটা চলবে না।’ মুক্তিফৌজএর আক্রমণের মুখে সৈন্যরা তাদের কমান্ডিং অফিসারকে গুলি করে মেরে ফেলে এবং পরে পিছু হটে যায়।

–       সাপ্তাহিক বাংলাদেশ, ১৯ জুলাই, ১৯৭১

 

 

 

ঠাকুরগাঁর জগদলপুর থানা মুক্তিফৌজ এর হাতে

পাক দখলদার দের মনোবল ভাংছে

নিজস্ব প্রতিনিধি

 

শিলিগুড়ি, ১৮ জুলাই- গত কয়েকদিন ধরে প্রচণ্ড লড়াইয়ের পর মুক্তিফৌজ বৃহস্পতিবার পাক দখলদার বাহিনীর কবল থেকে ঠাকুরগাঁর জগদলপুর থানাটি ছিনিয়ে নিয়েছে। জগদলপুর ইসলাম পুর সীমান্তের উল্টো দিকে। গত কয়েকদিনের মুক্তিফৌজ ২৩ জন পাকসেনাকে খতম করে। আরও খবর, মাদারই পাড়া সীমান্ত ঘাঁটির উপর আক্রমণ চালিয়ে মুক্তিফৌজ বেশ কিছু পাক সেনাকে খতম করে। বাকি পাক সেনারা পালিয়ে যায়। সীমান্ত চৌকি দখল নেয়ার পর মুক্তিফৌজ সেখানে প্রচুর রসদ বিশেষ করে ৫০০ মন চাল পায়।

 

উত্তর রণাঙ্গন থেকে যেসব খবর আসছে তাতে পাক দখলদার বাহিনীর মনোবল ক্রমশই ভেঙ্গে পড়ছে এবং ঘাঁটি ছেড়ে ৫ থেকে ৭ মাইল ভেতরে দৌড়াচ্ছে। দিনহাতার উল্টোদিকে ভুরুং মারি এখন মুক্তিফৌজ এর দখলে।

এছাড়া গত কউএক সপ্তাহে মুক্তিফৌজ ও কমান্ডরা যুগপৎ আক্রমণ চালিয়ে দিনাজপুর ও রংপুর জেলার অন্তত ৪২ তি সীমান্ত চৌকি পুড়িয়ে দিয়েছে। উদ্যেশ্য হল, পাক দখলদার রা কোন ক্রমেই ওইসব সীমান্ত চৌকি যাতে ঘাঁটি হিসাবে ব্যাবহার করতে না পারে।

 

রংপুর সেক্টরে মগলহাট, হাতিবান্ধা, বড় খাতা, অদিকে দিনাজপুর সেক্টরে পাঁচ বাড়ি, পাঁচ বিবি, আত্যোয়ার, পাক হিলি ও গৌরীপুর এলাকায় মুক্তিফৌজ ও কম্নডোদের আক্রমণে দখলদাররা বিপর্যস্ত।

–       আনন্দবাজার, ১৯ জুলাই, ১৯৭১

 

 

পাকফৌজের জুজুর ভয়

(গৌহাটি অফিস থেকে)

 

১৯ জুলাই বাঙ্গালদেশে দখলদার পাক ফৌজ শ্রী হট্ট জেলায় চাষিদের বাঁশের টোকা (ছাতা) ব্যাবহার নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। পাকসেনাদের আতংকের কারণ হল যে, ইতিপূর্বে মুক্তিফৌজের লোকেরা টোকার মধ্যে অস্ত্র শস্ত্র ও গোলাবারুদ লুকিয়ে নিয়ে কিছু পাকসেনাকে খতম করেছে। এখন আতংক গ্রস্ত টোকা ব্যাবহার নিষিদ্ধ করে ঢালাও আদেশ জারি করেছে।

–       আনন্দ বাজার পত্রিকা, ২০ জুলাই, ১৯৭১

 

 

 

দিনাজপুর, 300 পাক সেনা নিহত, বগুড়া

 

কলকাতা , জুলাই 20- আমাদের রাজগঞ্জ সংবাদদাতার রিপোর্ট: মুক্তিফৌজ দিনাজপুর ও বগুড়া তে প্রচণ্ড ভাবে অপারেশন চালাচ্ছে।  গত পনেরো দিন সময়ে, 300 জনের বেশি পাক সেনা এবং 53 জন পাক গুপ্তচরদের জাগাদাল, গোঁগোঁর, ধান্তাল,  হরিপুর, পাতাগোরা, বারাগ্রাম,  চান্দিপুর এবং পঞ্চগড় দিনাজপুরে হত্যা করা হয়।

 

ধুপগুড়ি র প্রতিনিধি যোগ করেছেন: মুক্তিফৌজ 17 জুলাই নীলফামারীতে  এক পাকিস্তানি সেনা ইউনিট আক্রমণ করে এবং দুটি গাড়ি ধ্বংস করে।  ফলে 17 জন পাকসেনাকে হত্যা করা হয়েছে এবং আরও দুজন কর্মকর্তা গুরুতর অবস্থায় মারুগানি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সরানো হয়েছে।  কেতকিবাড়ি ইতিমধ্যে মুক্তিফৌজ দ্বারা দখল হয়েছে।  মুক্তিফৌজ অধিকৃত এলাকার থেকে হাট (সাপ্তাহিক বাজার) থেকে খাজনা সংগ্রহ করছে এবং বাংলাদেশ সরকারের ফান্ডে জমা দিচ্ছে।

 

পাকিস্তানি সেনারা ইতিমধ্যে ঠাকুরগাঁও থেকে পিছু হটেছে।  মুক্তিফৌজ  মুক্ত অঞ্চল থেকে বিপুল পরিমাণ পাট জব্দ করে।

পশ্চিম পাকিস্তানী রা মুক্তিফৌজ কর্ত্রিক ক্রমাগত নাজেহাল হচ্ছে। পাকসেনারা দিনাজপুর জেলার উত্তর-পশ্চিম তিনটি পল্লীতে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি করে এবং নারী ও শিশুসহ প্রায় 1,000 অধিবাসীদের, গুলি করে হত্যা করে।

 

ইউ এন আই –  কৃষ্ণনগর থেকে রিপোর্ট: মুজিবনগরে সূত্র অনুযায়ী.গত 25 দিনে, মুক্তি ফৌজ বাংলাদেশে দক্ষিণ পশ্চিম কমান্ডের কিছু অংশে  প্রায় 300 রাজাকার নিহত  করে।

খুলনা জেলায় কমপক্ষে 160 জন রাজাকার  নিহত হয়।

 

— হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড, 21 জুলাই, ৭১

 

 

 

শ্রী হট্ট, রাজশাহী, কুষ্টিয়া জেলার মুক্তিফৌজএর তৎপরতা

 

মুজিবনগর , ২২ জুলাই বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামীরা পূর্ব বাঙলার বিভিন্ন রণাঙ্গনে তাদের তৎপরতা বাড়িয়েছেন। আজ এখানে পাওয়া খবরে জানা যায়, মুক্তিফৌজ শ্রী হট্ট , রাজশাহী এবং কুষ্টিয়া জেলায় পাক সেনাবাহিনীর ঘাঁটির উপর ক্রমাগত চাপ দিয়ে চলেছেন। গত ২৪ ঘণ্টায় মুক্তিফৌজ এর আক্রমণে প্রচুর পাকসেনা নিহত ও আহত  হয়েছে । গুরুত্তপূর্ণ  অনেক সেতু ও যোগাযোগ ব্যাবস্থা ধ্বংস হয়েছে।

 

শ্রী হট্ট সেক্টরে মুক্তিফৌজ এর গেরিলারা বড়লেখায় একটি গুরুত্তপূর্ন সেতু উড়িয়ে দিয়েছে। সেই সঙ্গে ৮ জন দালাল সহ ২৪ জন পাকিস্তানী খতম হয়েছে।

 

গতকাল রাতে মুক্তিফৌজ রাজশাহী শহরের উপর অতর্কিতে আক্রমণ চালান এবং চারজন রাজাকার ও দুজন বিশ্বাস ঘাতক কে গ্রেফতার করে।

 

রাত্রিবেলা পাকিস্তানী সৈন্যরা সকলেই রাজশাহী ছাউনিতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুরের কাছে কালা চাঁদপুরেও গতকাল রাতে পাকসেনাদের সাথে মুক্তিফৌজ গেরিলাদের প্রচণ্ড গুলি বিনিময় হয়। সঙ্ঘর্ষে বহু পাক সৈন্য হতাহত হয়েছে। কুষ্টিয়া জেলার মুক্তিফৌজ কমান্ডোরা কুমারখালি, কক্সা চিত্রা এবং আলমডাঙ্গা পর্যন্ত এগিয়ে গিয়েছেন।

 

তৃতীয় এক আক্রমণে আখাউরার কিছু দূরে কাল্বেরায় আরও একদন শত্রুসেনাকে খতম করা হয়। এই অঞ্চলে একটি রেল সেতুর ও নিঃশেষ ক্ষতি করা হয়।

 

গত মঙ্গলবার কুমিল্লা শহরে মুক্তিবাহ্নির গেরিলা দল কয়েকটি পাকসেনা কেন্দ্রের উপর এক্রমন চালায় এবং এই আক্রমণে প্রাণ বাঁচাতে পাকসেনারা পাঁচ কিলোমিটার দূরে ময়নামতি সেনা শিবিরের দিকে চম্পট দেয়। সংবাদ পাওয়া গেছে, পাকসেনাদের মনোবল খুব ভেঙ্গে পড়েছে। অপরদিকে এইসব গেরিলা আক্রমণ বাংলাদেশের জনগণের মনে নতুন শক্তি ও সাহস যুগিয়েছে।

 

কুমিল্লা শহরের কর্ম চঞ্চল কাদির পারা অঞ্চলে গেরিলাদের মর্টার আক্রমণে একদল পাকসেনা আহত হয়।

মুক্তিবাহিনী রাজাগঞ্জ থানা, সার্কিট হাউজ এবং কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের অপর মর্টার আক্রমণ চালায়। এই সব সঙ্ঘর্ষ পাক সেনাদের বহু হতাহত হয়েছে।

 

 

শ্রী হট্ট, কুষ্টিয়া ও রাজশাহীতে তৎপরতা

 

মুজিবনগর, ২২ শে জুলাই আজ এখানে প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ, মুক্তিবাহিনী শ্রী হট্ট, রাজশাহী ও কুষ্টিয়া জেলার পাকিস্তানী ফৌজের অবস্থানের অপর অবিরাম চাপ অব্যাহত রেখেছে এবং গত ২৪ ঘণ্টায় ওইসব অঞ্চলে গুরুত্তপূর্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা ও বহু পুল ধ্বংস করেছে। মুক্তিফৌজ পদ্মার তীরস্থ তাদের ঘাঁটি থেকে নদী পার হয়ে গত রাতে রাজশাহী শহরের উপর আকস্মিক হানা দেয় এবং চারজন পাকিস্তানী আধা সামরিক ও ২ জন কুইস লিংকে পাকড়াও করে। গত রাতে কুষ্টিয়া জেলায় পাক সৈন্যদের সঙ্গে মুক্তিফৌজ গেরিলাদের জোড় সঙ্ঘর্ষ ও গুলি বিনিময় হয়।

 

 

রংপুরে সঙ্ঘর্ষ

 

গত ১৮ ও ১৮ জুলাই রংপুরে বরখাতা  ও চৌইলাদি এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাক সৈন্যদের দুই দুইবার ভয়াবহ সঙ্ঘর্ষ হয়। পার সেনারা সরে যেতে বাধ্য হয়।

 

 

এক ডজন পাক সৈন্য খতম

 

ময়মনসিংহে মুক্তিযোদ্ধারা ১৭ / ১৮ জুলাই রাতে সৈন্য বাহিনীর টেলিফোন লাইন কেটে দেয়। করিম গঞ্জের নিকটে এক সঙ্ঘর্ষে তারা ১২ জন পাকসেনাকে হত্যা করে।

 

 

মেহেরপুর পাওয়ার হাউজ আক্রমণ

 

কৃষ্ণনগর, ২২শে জুলাই , সীমান্তের অপর পার থেকে এখানে প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ, মুক্তিফৌজ গত রাতে কুষ্টিয়া জেলায় মেহেরপুর পাওয়ার হাউজের উপর আক্রমণ চালিয়ে উহার ট্রান্সফর্মারটি সম্পূর্ন ধ্বংস করে দেয়। গেরিলারা কুষ্টিয়ায় পাক মুসলিম লিগ অফিস আক্রমণ করে এবং একজন লিগ নেতাকে হত্যা করে।

গত রাতে কাঠুলি গাংরি সড়কে মুক্তিফৌজ অপর একজন লীগ পন্থীকে ও হত্যা করে।

–       যুহান্তর ২৩ জুলাই, ১৯৭১

 

বাংলাদেশের কনিষ্ঠতম মুক্তিসেনা

(নিজস্ব প্রতিনিধি)

 

ছেলেটা এখানে বসে টেবিলের এটা ওটা নাড়াচাড়া করছিল যেমন আমাদের ঘরের তের বছরের চঞ্চল ছেলেরা করে। এই তো কৈশোর তারুণ্যের সীমান্তে। এবং নামও তরুণ হোসেন জোয়ার্দার।

 

পাকসেনা অধিকৃত যশোর মাগুরায় ছিল বাড়ি। পড়ত চুয়াডাঙ্গা ডিজে গভর্ম্নমেন্ট হাই স্কুলে। নবম মানের ছাত্র। বাপকা বেটা তরুণ হোসেন। বাপ থাক তার নামটা ঊহ্য মুক্তিফৌজের সেনা। তরুণও তাই। কনিষ্ঠতম।

 

তরুণ তিন ভাইয়ের মেঝ। তার ছোট আছে। হবে সেও মুক্তিসেনা। মা আছেন।

 

তরুণ ট্রেনিং নিয়েছে লাইট মেশিন গান, স্টেনগান, রাইফেল চালাতে হাতবোমা ছুড়তে; নিয়েছে গেরিলা প্রশিক্ষণও; শিকছে স্কাউটিং। স্বাধীন বাংলাদেশ সেনামুক্ত করবেই এই তাঁর পণ। তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে একথা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়। তাঁর মুখে যেন সরল বিশ্বাসের দীপ্ত আভা।

 

একা তরুণ নয়। ওর সঙ্গে ১৬,১৭,১৮,২০,২২ বছরের আরও ১০০ তরুণ নিয়েছে রনশাস্ত্রের দীক্ষা। সবাই ছাত্র। তাদের আগে হাজার তিনেকের মত প্রশিক্ষণ পেয়ে গেছে। শিক্ষাকাল দেড় মাস।

 

জিজ্ঞেস করেছিলাম কেন, শুধু ছাত্র কেন? চাষী বা মজুর নয় কেন? বলল, তাড়াতাড়ি শিখতে হবে তো তাই একটু লেখা পড়া জানা দরকার।

 

বলিষ্ঠ আশা, শিগগির একটা কিছু হবে, বড় রকমের হবে। এখানকার শেখা শেষ হলে বাছাই করা অনেককে আরও বড় কিছু শেখাবার জন্যও নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ওর চোখের সামনে সেই বড় দিনটা ভাসছে।

 

স্বাধীন বাঙলা বেতার ও শোনে। অনেকে শোনে। বাংলাদেশেও। কিন্তু শুনছে জানলে মৃত্যুদণ্ড। হয়েছেও কয়েকজনের।

 

ছুটি নিয়ে কলকাতায় এসেছে  উৎসুক মেটাতে খোলাখুলিই বলল। হাওড়া ব্রিজ দেখবে, দেখবে সংবাদ পত্রের অফিস। দেখে এবার ফিরে যাবে। কিন্তু বেশ বুঝছি, মাঝে মাঝে নিজের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে। এর চোখে ফ্রন্টের স্বপ্ন। এখনো গাছ ছাড়া লক্ষ্যভেদ করেনি। এবার আসল লক্ষ্যভেদ শত্রুসেনা। হাতের টিপ ঠিক আছে, এবার ফ্রন্ট। ওর মুখে চোখে উল্লাস। ও ফ্রন্টে যাবে।

–       যুগান্তর, ২৪ জুলাই, ১৯৭১

 

 

 

বল্লা রনাজ্ঞনে প্রচণ্ড যুদ্ধ

৫১ জন হানাদার সেনা খতমঃ ক্যাপ্টেন সহ ৬০ জন ঘেরাও

 

গত ১৫ জুলাই থেকে বর্বর হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিফৌজের অবিরাম যুদ্ধ চলছে। দুর্বিনীত সাহস এবং অসীম মনোবল নিয়ে দস্যু হানাদারের খতম করার জন্য বল্লায় শত্রু ঘাঁটিতে মুক্তিবাহিনী তিনদিন থেকে সাঁড়াশী আক্রমণ অব্যাহত রেখেছেন। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত মুক্তিবাহিনীর দুঃসাহসিক বীর যোদ্ধারা শত্রুসেনাদের বিপুল ক্ষয় সাধন করে তাদের অবরোধ করে রেখেছেন। তারা পালিয়ে যাবার ব্যার্থ চেষ্টা করে নিজেদের ক্ষয়ক্ষতি শুধু বৃদ্ধি করেছে।
১৬ ই জুলাই বল্লাতে আটক সেনাদের উদ্ধারের জন্য ৫ টি নৌকা ভর্তি পাকসেনা বিপুল অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে বল্লার দিকে এগোতে থাকে। মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যোদ্ধারা চারানে পাকসেনাদের অতর্কিতে আক্রমণ করেন। এই অতর্কিত হামলায় দস্যু সেনারা দিশেহারা হয়ে পড়েন। মুক্তিবাহিনীর গুলিতে হানাদার সেনা ভর্তি তিনটি নৌকা বিধ্বস্ত হয়ে ডুবে যায় এবং প্রত্যেকটি সেনার সলিল সমাধি হয়। প্রচণ্ড গুলিবর্ষণ করে মুক্তিবাহিনী ১৫/১৬ জন শত্রু সেনা খতম করেন। পাকসেনাদের মধ্যে যারা নদীর তীর দিয়ে হেঁটে আসছিল তারা বল্লার দিকে ভাগতে চেষ্টা করে। বল্লার পাকসেনারা এই ভাগোয়াট পাকসেনাদের মুক্তিফৌজ মনে করে বৃষ্টির মত গুলিবর্ষন এবং মর্টারের শেলিং করে। প্রচুর গুলি বিনিময়ে বহু সংখ্যক পাকসেনা হতাহত হয়। সকাল ৭ টা থেকে শুরু করে বেলা ১১ টা পর্যন্ত এই যুদ্ধ স্থায়ী হয় । ওই দিনই সন্ধ্যা ৫ টা ৪৫ মিনিট পাকসেনাদের আরো একটি দল নৌকায় বলার দিকে এগোতে চেষ্টা করে এবং বৃষ্টির মত গুলি করতে থাকে। নৌকাগুলো যখন মাঝ নদীতে আসে মুক্তিবাহিনীর একটি শক্তিশালী স্কোয়াড সব কটি নৌকা পানিতে ডুবিয়ে দেয়। ঐদিনের যুদ্ধে ৫১ জন দুর্বৃত্ত সৈন্য নিহত ও বহু সংখ্যক আহত হয়। আমাদের প্রতিনিধি এক ট্রাক লাশ সন্ধ্যা ৭ টায় মধুপুরের দিকে নিয়ে যেতে দেখেছেন। ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিকীর নির্দেশ অনুযায়ী ঢাকা থেকে ৩১ বালুচের সৈন্য এনে আর্টিলারি ফায়ার করেও আটক সেনাদের উদ্ধার করতে সক্ষম হয়নি।

 

রণাঙ্গন থেকে লিখছি

থাকুইরা

 

২০ শে জুলাই মুক্তিবাহিনী এবং পাকসেনাদের মধ্যে থাকুইরায় সারা দিন ব্যাপী এক তুমুল যুদ্ধ সঙ্ঘটিত হয়। এই দিনের যুদ্ধে পাক বর্বর বাহিনী সবচেয়ে বেশী মর্টার শেলিং করে। বীর মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধে ১৭ জন পাকসেনা নিহত করেন। পরিশেষে দখলদার বাহিনী দাঁতভাঙ্গা জবাব পেয়ে সেদিন পিছু হটতে বাধ্য হয়।

 

 

ডেইলপাড়া

 

বিগত ১ লা জুলাই ভালুকা থানার সিটি স্টোর বাজারে দেশকে মুক্ত করার দৃঢ় সংকল্প বদ্ধ মুক্তিবাহিনী জোয়ানদের সাথে দখলদার বাহিনীর তুমুল লড়াই হয় রাত ৩ টা ২০ মিনিটে। এই লড়াইয়ে ২২ জন শত্রুসেনা নিহত এবং ১১ জন আহত হয়। মর্টারের  আঘাত হেনে আমাদের জোয়ানরা শত্রুঘাটি বিধ্বস্ত করে দেয়।

 

 

টাঙ্গাইল শহরে বোমাবাজি

 

হানাদার সৈন্যদের অধিকৃত টাঙ্গাইল শহরের একটি সিনেমা হলে গত ২৪ শে জুলাই রাত ৮ টা ৩০ মিনিট মুক্তিফৌজের গেরিলারা হাতবোমা ফাটান। ফলে শত্রুদের ৫ জন নিহত এবং ২০ জন আহত হয়। ২০ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। উল্লেখযোগ্য যে, গত ১৭ই জুলাই টাঙ্গাইল ওয়াপদা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে গেরিলারা গ্রেনেড চার্জ করেন । ফলে টাঙ্গাইল শহরে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। এখন অহরহ টাঙ্গাইল শহরে বোমা ফুটছে।

 

শেষ সংবাদ

আমাদের প্রতিনিধি জানিয়েছেন যে, কালিহাতি থানার ডেওরা পারায় মুক্তিবাহিনী গেরিলা আক্রমণ চালাচ্ছেন।

–       রণাঙ্গন

–       ২৫ জুলাই, ১৯৭১

 

 

মুক্তিবাহিনীর প্রবল আক্রমণের মুখে ঢাকা অন্ধকারাচ্ছন্নঃ

কুষ্টিয়ার পতন আসন্ন

(নিজস্ব বার্তা পরিবেশক)

 

ঢাকা শহরের তিনটি বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্রের উপর মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের ফলে ১৯ শে জুলাই রাতে শহরের একাংশ অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়। মার্কিন সংবাদ সরবরাহ প্রতিষ্ঠান এ পির খবরে প্রকাশ, ঐ রাতে মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা চামেলিবাগ ও শাহ বাগ বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্রে আঘাত হানিয়া কেন্দ্র দুটিকে বিকল করিয়া দেন। উহার ফলে বিদ্যুৎ কেন্দ্র দুইটির কয়েকজন প্রহরী আহত হয়। খবরে আরও বলা হয় যে, বিদ্যুৎ কেন্দ্র দুইটির কর্ত্রিপক্ষ মুক্তিফৌজের আক্রমণের ফলে ক্ষয় ক্ষতির কথা স্বীকার করেছেন।

 

গত এক পক্ষকালের মধ্যে মুক্তিবাহিনী গেরিলা তৎপরতা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি করিয়াছে। এই সময়ের মধ্যে মুক্তিবাহিনীর বাংলাদেশের শত্রুমুক্ত একালাগুলি কেবল ধরিয়াই রাখে নাই, উহাদের সীমা আরও সম্প্রসারিত করিয়াছে। খবরে আরও প্রকাশ মুক্তিফৌজ কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর হইতে পাকসেনাদের হটাইয়া দিয়া মেহেরপুর দখল করে এবং পাকসেনাদের ঘাঁটি ধ্বংস করে।

 

 

চুয়াডাঙ্গার পথে মুক্তিবাহিনী

 

পরবর্তি সংবাদে জানা যায়, মুক্তিবাহিনী চুয়াডাঙ্গা অভিমুখে আগাইয়া চলিয়াছে। কুষ্টিয়া জেলার বাদবাকি অধিকৃত এলাকার উপরও মুক্তিফৌজ প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করিয়াছে। কুষ্টিয়া শহরটিকে মুক্তিবাহিনী চতুর্দিক হইতে অবরোধ করিয়া রাখিয়াছেন। দখলকারী পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ আত্মরক্ষা মূলক ব্যাবস্থা হিসাবে কুষ্টিয়া শহরে নিষ্প্রদীপ ব্যাবস্থা চালু করিয়াছে।

 

কয়েকদিন পূর্বে মুক্তিবাহিনী কুষ্টিয়াতে পাক বাহিনী নির্মিত অস্থায়ী বিমান ঘাঁটি ধ্বংস করিয়া দিয়াছে।

 

মুক্তিফৌজ সূত্রে জানা যায়, নরসিংদী, ভৈরব বাজারের মধ্যবর্তি একটি গুরুত্তপূর্ণ রেল সেতু ধ্বংস করিয়া মুক্তিবাহিনী রেল চলাচল বিপর্যস্ত করিয়াছেন। ঢাকা, ময়মনসিংহ ও কুমিল্লা জেলার অন্যান্য স্থানেও সেতু, টেলি যোগাযোগ , বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যাবস্থা প্রভৃতি বিকল করিয়া দিয়াছেন। গত ১ সপ্তাহে মুক্তিবাহিনীর হাতে কয়েক শত পাক সৈন্য নিহত হইয়াছে।

 

-মুক্তিযুদ্ধ, ২৫ জুলাই, ১৯৭১

 

 

উত্তরাঞ্চলীয় সেক্টরে আক্রমণাত্মক মুক্তি ফৌজ

(আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক )

 

শিলিগুড়ি, ২৮ জুলাই-  হিট এন্ড রান  কৌশল মুক্তি ফৌজ কমান্ডো বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল বিশেষ করে রংপুর ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় ব্যাবহার  তীব্রতর করেছে।

 

কমান্ডো গ্রুপ  ২৩ জুলাই সেনানিবাসের ৩ টি  এলাকায়  অভিযান চালিয়ে প্রায় এক ডজন পাকসেনাকে হত্যা ও একটি পাকবাহিনীর গাড়ির ধ্বংস করে।

 

একই দিন কমান্ডোরা উপর আরো শক্তিশালী হ্যান্ড গ্রেনেড দিয়ে রংপুর শহরের উপকণ্ঠে আলমনগর  উপ শহর  আক্রমণ করে এবং এক ডজনেরও বেশি পাকবাহিনীর সমর্থক নিহত করে।

 

নীলফামারী সেক্টর কমান্ডোদের সাথে পরদিন পাকবাহিনীর সমর্থকরা কিশোরগঞ্জ পুলিশ স্টেশনের কাছে একটি জায়গা বৈঠক করছিল।  এই স্থানে আক্রমণ করে তাদের অনেক নিহত এবং আহত হয়।

 

২১ জুলাই মুক্তি ফৌজ গেরিলা ঠাকুরগাঁও এলাকায়  দুই সেনা টহল অ্যামবুশ করে ১৩ জন  পাক সেনা হত্যা করে।

-হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড, ২৯ জুলাই ১৯৭১

 

 

 

দিনাজপুরের ৫ টি অঞ্চল মুক্তিবাহিনীর দখলে

(নিজস্ব সংবাদ দাতা)

 

রায়গঞ্জ, ২৯ জুলাই- দিনাজপুর জেলার ঠাকুর গাও , পাঁচ গড়, বোদা, তেতুলিয়া এবং দেবীগঞ্জ এখন বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর সম্পূর্ন দখলে। দখলকৃত এইসব অঞ্চলে এবং সরকারী ও বেসরকারি ভবনগুলিতে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের পতাকা উড়ছে বলে মুক্তবাহিনির ঘনিস্ট মহলের খবর জানা যায়।

–       যুগান্তর, ২৯ জুলাই, ১৯৭১

 

 

শত্রুসেনারা ত্রাহি ত্রাহি ডাকছে

 

বাংলাদেশের বিভিন্ন রণাঙ্গনে বঙ্গশার্দুল মুক্তিযোদ্ধারা রণহুংকারে শত্রু বাহিনীর মধ্যে ত্রাহি ত্রাহি ডাক এবং রণাঙ্গন ছেড়ে পালাবার হিড়িক শুরু হয়েছে। বড় বড় মেজরকে পেছনে খুঁটি হিসেবে খারা করেও ভিত পাকসেনাদের যুদ্ধের ময়দানে ঠেকিয়ে রাখা যাচ্ছেনা। তারা মেজরকে মেরে অগত্যা পথ পরিষ্কার করে উর্ধশ্বাসে পিছু হটে যাচ্ছে। প্রতিদিন মুক্তিযোদ্ধাদের বেদম মারে শত শত শত্রুসেনাদের বিদায় দেহটা ঢলে পড়ার দৃশ্য চোখে ভেসে উঠেলে শরীর তাদের ঠাণ্ডা হয়ে যায়, পা তাদের সামনে বারতে চায় না। বাড়ির মা বাবা আত্মীয় স্বজন , ছেলে মেয়ে ও প্রিয়জনের কথা মনে পড়ে গেলে এমনিতেই শরীর অবশ হয়ে আসে, হাত থেকে মরনাস্ত্র পড়ে যায়।

 

বাংলাদেশের বিভিন্ন রণাঙ্গন থেকে প্রতিদিন পাক দস্যুদের পলায়নি মনোবৃত্তির এধরনের খবর পাওয়া যাবেই।

 

বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনী সদর দফতরের তথ্য বিভাগের বুলেটিনে প্রকাশ, হানাদার পাকবাহিনী মুক্তিযোদ্ধারা বেপরোয়া প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে নাজেহাল হয়ে পড়ে। বাংলার দখলীকৃত এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ আরও জোরালো হয়ে উঠেছে। তাদের শত শত পাকসেনা, রাজাকার এবং তাদের সহযোগী দেশীয় দালালরা হতাহত হচ্ছে। শত্রুদের চলাচল ও সরবরাহ ব্যাবস্থা অচল করার জন্য রেল লাইন, রেল সেতু ও সড়ক সেতু উড়িয়ে দেয়া হচ্ছে।

 

দিনাজপুর, রংপুর, রাজশাহী সেক্টর থেকে প্রাপ্ত খবরে প্রাপ্ত খবরে জানা যায়, মুক্তিযোদ্ধারা ভুরুংমারি এলাকায় একটি পাকসেনাদলকে ঘিরে ফেলে। এখানে পাকসেনাদের একটি জিপ ধ্বংস করা হয়। ওপর একটি অতর্কিত হামলায় ১১ জন পাকসেনা খতম ও ৭ জন আহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা রাইস বাগ এলাকায় লাল্মনিরহাঁট ও কাকিনার মাঝামাঝি স্থানে রেল লাইন উড়িয়ে দেয়। পাকবাহিনীর একটি ট্রেন এখানে লাইন চ্যুত হলে ট্রেনের ২ টি বগি উড়ে যায়।

 

গত ১৭ জুলাই রাজশাহী জেলার শাহ পাড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড আক্রমণে ২২ জন পাকসেনা খতম হয়। প্রকাশ, এই দিন ৩০ জন পাকসেনা তাদের মহাদেব পুর শিবির থেকে ট্রাকে করে শাহ পাড়ে টহল দিতে আসে। এদের সাথে রাজাকার ও ছিল। খবর পেয়ে সতর্ক মুক্তিযোদ্ধারা তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পরে। ১৯ শে জুলাই রোহণ পুর এলাকায় ৩০ জন পাকসেনার একটি টহল পার্টির উপর হামলা করে মুক্তিযোদ্ধারা ১ জন ক্যাপ্টেন সহ ৯ জনকে হত্যা করে।

 

দিনাজপুর রানি নগরে পাকসেনাদের শিবিরে আকস্মিক হামলা করে ১০ জন খান সেনাকে খতম এবং মাঝারি ধরণের মেশিন গান এবং গোলাবারুদ দখল করেন। ২০ জুলাই মুক্তিযোদ্ধারা বগুড়া শহরে সার্কিট হাউজে পাকসেনাদের ক্যাম্পে হাতবোমা ফেলে একজন সেন্ট্রিকে হত্যা করেন। মুক্তিযোদ্ধারা এই জেলার গুরুত্তপূর্ণ সেতু উড়িয়ে দিয়েছেন।

 

-জয় বাংলা, ৩০ জুলাই, ১৯৭১

 

 

কুমিল্লা বাংলাদেশের থেকে বিচ্ছিন্ন

 

ঢাকা ১ আগস্ট,  কুমিল্লা  – ভারতের পূর্ব সীমান্তের এলাকা।  এর সাথে কার্যত বাংলাদেশের বাকি অংশ গতকাল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।  মুক্তিবাহিনী  পাওয়ার ট্রান্সমিশন পাইলন এবং একটি প্রধান সেতু ধ্বংস করে। এটি ঢাকার মেইন রোড থেকে পশ্চিমে ৪৮  কিলোমিটার দূরে।

 

নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, মেঘনা সেতু আক্রান্ত হওয়ায় ট্রাফিক স্থগিত ছিল।

শুক্রবার ভোরে এক মাসের মধ্যে দ্বিতীয় বারের জন্য বিদ্যুৎ বন্ধ হয়ে যায় কারণ একটি পাওয়ার  পাইলন বিস্ফোরণ হয়েছিল।

 

পাকিস্তান আর্মি, এদিকে একটি সম্ভাব্য হরতাল ও সহিংসতার  জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। মঙ্গলবার প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের আগমন উপলক্ষে ব্যাপক নাশকতা হবার সম্ভবনা আছে।  চার মাস আগে শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আর্মি নামানোর সময় শেষ তিনি এসেছিলেন।

 

সেনাবাহিনী সূত্র জানায়, শহরে অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন করা হয়েছে। পানির ট্যাঙ্ক, বিদ্যুৎ সাব স্টেশন এবং অন্যান্য ইনস্টলেশনের রক্ষা করার জন্য ব্যাবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

 

২৪ জুলাই থেকে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা পূগত ছয় দিন সময় ধরে র্বাঞ্চলের সিলেট, কুমিল্লা, নোয়াখালী ও চট্টগ্রামে কমপক্ষে ৮৮ জন পাকিস্তানি সেনা ও সহযোগী খুন করেছিল। পাওয়ার সাপ্লাই ধ্বংস, কয়লা ডিপো ধ্বংস এবং  একটি বিদেশী তেল ট্যাঙ্কার ক্ষতিগ্রস্ত করে।

 

উপরোক্ত তথ্য প্রদান করে , বাংলাদেশ সরকারের একজন  উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা বলেন রংপুর জেলার ২৫০  বর্গমাইল  এর  অধিক এলাকা মুক্তি ফৌজের দখলে এবং  খুব শীঘ্রই এখানে বেসামরিক প্রশাসনের পুনর্গঠন, পুলিশ বাহিনী ও ডাক ব্যবস্থা চালু করা হবে।

 

-হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড, ২  আগস্ট ৭১

 

 

বিভিন্ন রণাঙ্গনে মুক্তিফৌজের সাফল্য অব্যাহত

 

আগরতলা , ৩ রা আগস্ট, ইউ এন আই – মুক্তিবাহিনীর= আজ শ্বরই হট্ট রণাঙ্গনে কালচেরা টি এস্টেটের কাছে ৫০ জন পাকসেনাকে হত্যা ও ২ জন কে গ্রেফতার করেছে। এদের মধ্যে একজন বালুচিও আছে।

সীমান্তের ওপারে বাংলাদেশের মুক্তিফৌজ

 

এর সদর দপ্তর থেকে পাওয়া খবরে যানা যায় যে, মুক্তিফৌজ

পাক বাহিনীর কাছ থেকে একটি মেশিন গান, একটি এল এম জি, ৬ টি রাইফেল , ১৮ হাজার কার্তুজ এবং বিপুল পরিমাণ খাদ্য দ্রব্য কেড়ে নিয়েছে।

 

গতকাল মুক্তিবাহিনী গেরিলা ইউনিট কুমিল্লা অঞ্চলে সালেয়া নদীতে দেশী নৌকায় অগ্রসর রত ৭ টি পাকবাহিনীর গতিরোধ করে। এর ফলে ৯০ জন পাকসেনা নদীতে ডুবে মারা যায়। ২৮ শে জুলাই থেকে শুরু করে ৪ দিনে কুমিল্লার মন্দাভাগে ১০০ জনের বেশী পাকসেনা নিহত হয়েছে। ৩১ শে জুলাই গেরিলা বাহিনী কুমিল্লা জেলায় ২০ জন পাকসেনাকে খতম করেছে।

 

২৯ শে জুলাই নোয়াখালী জেলায় মুক্তিবাহিনী ও রাজাকারদের মধ্যে এক সশস্ত্র সংঘর্ষে ৮ জন রাজাকার নিহত হয়। এদের কাছ থেকে ২ টি রাইফেল ছিনিয়ে নেয়া হয়।

 

গতকাল কুমিল্লার আখাউড়া রণাঙ্গনের কাছে সিঙ্গেরঝিল অঞ্চলে ১২ জন পাকসেনা নিহত ও মুক্তিবাহিনী ১২ টি  রাইফেল ও কিছু গোলাবারুদ ছিনিয়ে নেয়। গেরিলা বাহিনী কুমিল্লা জেলায় ২৫ টি বিদ্যুৎ সরবরাহ যন্ত্র বিকল করে দেওয়ায় সমগ্র জেলা ও ময়না মতই ক্যান্টনমেন্ট অন্ধকারাচ্ছন হয়ে থাকে।

 

গতকাল সকালে কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার মুজিব নগর থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার দূরে কানিফ নগরে মুক্তিফৌজ ও পাকসেনাদের মধ্যে সঙ্ঘর্ষে অন্তত ৭ জন নিহত হয়েছে।

 

রায়গঞ্জ থেকে আমাদের নিজস্ব সংবাদ দাতা জানাচ্ছেন , গতকাল দিনাজউরের পাক হিলি অঞ্চলে আটপাড়ার কাছে মুক্তিফৌজ গেরিলারা তিনটি জায়গায় রেল লাইন উড়িয়ে দিয়েছে।

 

 

মুক্তিফৌজএর গুলিতে পাক বিমান ভূপাতিত

(সিলিং অফিস)

 

৩রা আগস্ট সালুটিগড় ( শ্বরই হট্ট) বিমান ঘাঁটির কাছে গত ৩১ শে জুলাই তারিখে মুক্তিফৌজ একখানি মাল বাহী বিমান গুলি করে ভূপতিত করে।

 

আমেরিকা কর্তৃক প্রদত্ত সি – ১৩০ বিমান টি পাকিস্তান বিমান ঘাঁটি থেকে আকাশে উড়বার পর ২০০ ফুটের মধ্য দিয়ে যাবার সময় মুক্তিফৌজ তাকে আক্রমণ করে।

–       যুগান্তর, ৪ঠা আগস্ট ১৯৭১

 

 

চট্টগ্রাম, কক্স বাজার নাজেহাল খান সেনারা বোমা ও গোলাবর্ষন

 

নয়াদিল্লী ৪ আগস্ট পশ্চিম পাকসেনারা মুক্তিফৌজএর কাছে প্রবল বাঁধা পাওয়ায় চট্টগ্রাম ও কক্স বাজারে কয়েকদিন আগে পাক বিমান থেকে বোমা এবং নৌ বহর থেকে গোলাগুলি করা হয়। তেহরানের দৈনিক পত্রিকা কায়হান ইন্টারন্যাশনাল -এ আওয়ামীলীগের একজন সক্রিয় সদস্যের বক্তব্য উল্লেখ করে ঐ খবর ছাপা হয়েছে।

 

ঐ পত্রিকার রাজনৈতিক সংবাদ দাতা শ্রী আমির তাহেরি হে আওয়ামীলীগ সদস্যের বক্তব্য উল্লেখ করে লিখেছেন বাংলাদেশের উত্তর পুর্বাঞ্চলের যুদ্ধ এখন প্রচণ্ড আকারে।

 

ঐ খবরে আরও প্রকাশ, লে জেনারেল টিক্কা খান শ্বরই তাহেরির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেছেন যে, পূর্ব বাংলার আইন ও শৃঙ্খলা মোটেই স্বাভাবিক নয়। তিনি আরও বলেন, বাঁধা আসছে চারিদিক থেকেই এবং অন্তর্ঘাত মূলক কাজ ও চলছে। পাটের গাড়ির উপর আক্রমণ প্রায় ই ঘটছে। ফলে বর্তমানে সেনাবাহিনীর পাহারায় চট্টগ্রামে পাট পাঠানো হচ্ছে।

জে টিক্কা ঢাকায় বোমা বর্ষনের কথাও স্বীকার করেছেন। এই খবর ইউ এন আইন্ড এর।

 

শিলং থেকে ইউ এন আইন্ড এর খবর – পূর্ব রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনী গত ৫ দিনে পাকসেনাদের অবস্থা সঙ্গিন করে তুলেছে। মুক্তিফৌজ গেরিলাদের আক্রমণে গুরুত্তপূর্ন ঢাকা ময়মন সিংহ রেল পথ বিপর্যস্ত এবং শ্বরই হটতে একটি মালবাহী বিমান ভেঙ্গে অচল হয়ে গিয়েছে। সীমান্তের ওপার থেকে এবং বিশ্বস্ত সূত্রে এই খবর পাওয়া যায়।

 

ঐ সূত্রে আরও জানা যায় যে, গেরিলারা শ্বরই হটতে সামরক বিমান বন্দরে ঝোপে জঙ্গলে লুকিয়ে থেকে সাড়ে ৮ কোটি টাকা দামের একটি বিমানের উপর গুলি চালায়। বিমান টি সেই মাত্র রান ওয়ে থেকে বড় জোর ২০০ গজ উঁচুতে উঠেছিল।

 

গেরিলা বাহিনী ময়মন সিংহ জেলায় ৩১ শে জুলাই  থেকে ২ আগস্ট সামনা সামনি লড়াই চালিয়ে বহু পাকসেনাদের হতাহত করেন। ছাত্র নেতা সিদ্দিকির নেতৃত্বে গেরিলা বাহিনী সমগ্র টাঙ্গাইল জেলা নিজেদের কব্জার মধ্যে নিয়ে এসেছেন।

 

 

 

রেল সংযোগ বিচ্ছিন্ন

 

ময়মন সিংহ ও কিশোর গঞ্জের মধ্যেও রেল যোগাযোগ মিচ্ছিন্ন। তারা বৈদ্যুতিক লাইন নষ্ট করে দেওয়ায় শ্বরই হট্ট শহরের অর্ধেক অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে পরে।

 

গেরিলা বাহিনী ৩১ জুলাই প্রথম কামাল পুরে সামনা সামনি লড়াই শুরু করেন। তারা ১০ জন পাকসেনাকে আঘাত হানে এবং পাকসেনা ভর্তি একটি ট্রেনের বগি আক্রমণ করে বহু পাকসেনাকে নিহত করেন। তাদের আক্রমণে দুটি রেল ইঞ্জিন , বেশ কয়েকটি ওয়াগন এবং যাত্রী বাহী কোচ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

ঐ একই গেরিলা বাহিনী ২ দিন বাদে ২ আগস্ট দেওয়ানগঞ্জ শহরে আক্রমণ করেন। যেখানে পাক সেনারা ছিল সেই রেল স্টেশন টি চুরমার করে দিয়ে তারা পালিয়ে যান। রাজাকারদের দুটি শিক্ষা কেন্দ্রে তারা ধ্বংস করে দেন। ঐ আক্রমণ চালাবার সময় মুক্তি বাহিনীর দুজন জওয়ান আহত হন বলে যানা যায়। গেরিলা বাহিনী ৩৮ জন রাজাকার কে ধরে নিয়ে আসেন কিন্তু পালাবার চেষ্টা করায় ৩৬ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

 

গেরিলাদের আক্রমণে সুনামগঞ্জে পাকসেনাদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। ঐ এলাকার পাকসেনাদের ভারপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন মারাত্মকভাবে আহত হয়। তাকে চিকিৎসার জন্য হেলিকপ্টার করে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।

 

–       আনন্দবাজার পত্রিকা , ৫ আগস্ট , ১৯৭১

 

 

কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্ট পাঠান পাঞ্জাবি সঙ্ঘর্ষ

অনেকের আত্মসমর্পণ

 

আহরতলা, ৭ আগস্ট ( পি পি আই) – এখানে সীমান্তের ওপার থেকে প্রাপ্ত সংবাদ প্রকাশ গত ৩ রা আগস্ট ঢাকায় কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্ট পাঞ্জাবি এবং পাঠান সৈন্যদের মধ্যে এক প্রচণ্ড সঙ্ঘর্ষে পাক বাহিনীর দুজন কর্নেল ও আরও কয়েকজন নিহত হয়।

 

সংবাদে বলা হয়, ঐ দিনই মুক্তিবাহিনী ফেনী সেক্টরে করের হাঁট পাক সৈন্যের ওপর আক্রমণ চালিয়ে একজন মেজর। দুজন ক্যাপ্টেন ও দুজন নন কমিশন্ড অফিসার সহ ৪২ জন পাকিস্তানী সৈন্যকে খতম করেছে। সঙ্ঘর্ষে ৫৫ জন রাজাকার ও নিহত হয়েছে। ৫ ঘণ্টা ধরে এই সঙ্ঘর্ষ চলে।

 

গত ৪ ঠা ও ৫ আগস্ট নারায়নপুর রেল ওয়ে স্টেশনের নিকট কয়েক দফা সঙ্ঘর্ষে ৪০ জন পাক সৈন্য মুক্তিফৌজ এর হাতে নিহত হয়েছে। মুক্তিবাহিনীর ৩ জন নিহত হয়েছে।

 

চট্টগ্রাম সেক্টরে পালিয়া, নোয়াখালী, রাঙ্গুনিয়া এবং রঞ্জন গ্রামে স্থানীয় লোকেরা কয়েকজন তহশিল অফিসারকে পুড়িয়ে মেরে ফেলেছে।

 

সংবাদে প্রকাশ, উপনিবেশিক সরকারকে কোন কর বা রাজস্ব না দেওয়ার জন্যে বাংলাদেশ সরকার যে আহবান জানিয়েছিলেন তাতে বেশ সাড়া পাওয়া যাচ্ছে।

 

 

পাঠান ও বালুচ সৈন্যের আত্ম সমর্পন

 

মুজিবনগর, ৭ আগস্ট (পি পি আই) – পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য বাহিনীর বেশ কিছু সংখ্যক অসন্তস্ট বালুচ ও পাঠান সৈন্য মুক্তিবাহিনীর নিকট আত্ম সমর্পন করেছে এবং তারা দেশে ফিরে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে এবং রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছে।

 

বাংলাদেশ বাহিনীর সদর দফতরের একজন মুখ পাত্র পি টি আই র সংবাদ দাতার নিকট বলেছেন যে, পাঞ্জাবি অফিসাররা বালুচ ও পাঠান সৈন্যদের সর্বদা কড়া নজরে রাখে। পাঞ্জাবিদের হাতে তাদের অমানুষিক অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে – এমন কি তাদের নিয়মিত ভাবে খাদ্যও দেয়া হয় না। পাঞ্জাবি সৈন্যরা সব সময়ই নিজেদের কে নিরাপদে রেখে বালুচ ও পাঠান সৈন্যদের মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের সম্মুখীন হওয়ার জন্য অগ্রভাগে ঠেলে দেয়। তাদের সাধারণত পশ্চিম পাকিস্তানে তাদের আত্মীয় স্বজনদের কাছে চিঠি লিখতে দেয়া হয়না। এবং কখনো কখনো দেয়া হলে চিঠি পত্র কঠোর ভাবে সেন্সর করে।

 

 

 

 

বোমাবর্ষনে অসামরিক বিমান

 

আগরতলা, ৭ আগস্ট ( ইউ এন আই) – এখানে খবর পাওয়া গেছে যে, পাক সৈন্য বাহিনী মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটির উপর বোমাবর্ষনের জন্য অসামরিক বিমান ব্যাবহার করছে। পাক সৈন্য বাহিনীর পূর্বে শস্যের উপর জীবাণুনাশক দ্রব্য ছড়াবার উদ্যেশ্যে ব্যাবহ্রিত এরূপ ১০ টি বিমান , দুটি হেলিকপ্টার নিয়ে নিয়েছে। হেলিকপ্টার দুটি গতবারের বন্যার্ত লোকদের জন্য ত্রাণ দ্রব্য সরবরাহের উদ্যেশ্যে সৌদি আরব থেকে পাওয়া গেছিল। এখন সেগুলোকে পরিবহন, মেশিন গান বহন ও মুক্তিফৌজ এর সমর্থকদের এলাকায় বোমাবর্ষনের কাজে ব্যাবহার করা হচ্ছে।

–       আনন্দ বাজার, ৮ আগস্ট, ১৯৭১

 

 

টাঙাইলে গেরিলা তৎপরতা বৃদ্ধি

বিভিন্ন স্থানে গ্রেনেড চার্জ

 

সম্প্রতি এদেশের শহরের ক্রমবর্ধমান গেরিলা তৎপরতার সঙ্গে টাঙ্গাইল শহরেও দুঃসাহসী গেরিলা তৎপরতার সংবাদ এসে পৌঁছেছে। গত ১ মাস ধরে ক্রমবর্ধমান গেরিলা তৎপরতার ফলে হানাদার দস্যু সেনাদের নাভিশ্বাস উঠবার উপক্রম হয়েছে। জুলাই মাসে তৃতীয় সপ্তাহ থেকে আজ পর্যন্ত দুঃসাহসী গেরিলারা কয়েক পর্যায়ে আক্রমণ চালিয়ে বেশ কিছু সংখ্যক রাজাকার কে বন্দি এবং প্রায় ২৫ জন হানাদার সৈন্য খতম করেছে। সম্প্রতি আমাদের অসীম সাহসী গেরিলারা টাঙ্গাইল ন্যাশনাল ব্যাংকের গেঁটে প্রহরা রত ১০ জন রাজাকারের উপর গ্রেনেড চার্জ করে ৬ জনকে হত্যা করেছে এবং বাকি চার জনকে গুরুতর আহত করেছে। ত্রুটিপূর্ণ প্রহরা অভিযোগে হানাদার মেজর আহতদের পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। গেরিলারা হাবিব ব্যাংক এবং একটি পেট্রোল পাম্পেও গ্রেনেড চার্জ করে। ফলে পেট্রোল পাম্প টি দারুণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রসুলপুরে একজন দুঃসাহসী গেরিলা একটি বাসের উপর গ্রেনেড চার্জ করে ১১ জন রাজাকার কে হত্যা করে। এছাড়া ঢাকা – টাঙ্গাইল রাস্তায় বাওই খোলায় গেরিলারা একটি বাস ও একটি ট্রাকের উপর গ্রেনেড চার্জ করে ১৩ জনকে হত্যা করে। এখানে রাজাক্রদের সঙ্গে খণ্ড যুদ্ধে ৭ জন রাজাকার নিহত হয়।

 

 

৫০ রাজাকার গ্রেফতার

দলে দলে আত্ম সমর্পন অব্যাহত

 

বিশ্বাস ঘাতক মীর জাফরের উত্তরসূরি স্বদেশী সৃষ্ট দালাল রাজাকারদের অত্যাচার, অনাচার আর ব্যাভিচারে সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। হাটে বাজারে শহরে ওলিতে গলিতে রাজাকাররা রাইফেল দেখিয়ে নিরীহ ও নিরস্ত্র জনগণকে অযথা হয়রানি করে তুলেছে এবং জোর জবরদস্তি করে টাকা, অলংকার, ঘড়ি, কলম এমনকি পকেট থেকে দু আনা পয়সা পর্যন্ত ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। পশ্চিমা সেনাদের পদ লেহন কারী এই সকল রাজাকারের গুপ্তচর বৃত্তি করতে এসে মুক্তিবাহিনীর নিকট এ পর্যন্ত ৫০ জন গ্রেফতার হয়েছে। এর মধ্যে ১৯ জনকে হত্যা করা হয়েছে। যারা আত্ম সমর্পন করেছে তাদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শন করা হচ্ছে।

 

 

বল্লার  শত্রু ঘাঁটিতে গেরিলা আক্রমণ

 

 গত ২৭ শে জুলাই মধ্য রাতে মুক্তিবাহিনীর একজন দুঃসাহসী গেরিলা বল্লার হানাদার ছাউনিতে ঢুকে পড়ে অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়ে ৬ জন শত্রু খতম করে।

 

 

দেওয়া পাড়ায় ৫৬ জন শত্রু সেনা খতম – হানাদার ঘাঁটিতে অগ্নি সংযোগ

 

বিগত ২১ শে জুলাই থেকে শেষ সংবাদ পাওয়া পর্যন্ত ঘাটাইল থানার দেওয়া পাড়া রণাঙ্গনে বর্বর পাক হানাদার দের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর যে প্রচণ্ড যুদ্ধ শুরু হয়েছে আজ পর্যন্ত তা অব্যাহত রয়েছে। মুক্তিবাহিনীর দুঃসাহসী গেরিলা যোদ্ধারা অমিত বিক্রমে জল্লাদ বাহিনীকে বিরামহীন আঘাত হেনে চলছেন। গেরিলা বাহিনী প্রবল আক্রমণাত্মক তৎপরতার সামনে পাক বাহিনী টিকতে না পেরে তাদের ছাউনিতে কচ্ছপের মত গুটিয়ে বসেছে। গত ২৭ জুলাই মুক্তিবাহিনীর একটি শক্তিশালী গেরিলা স্কোয়াড রাত্রি বেলা অতর্কিতে তাদের দেখে ছাউনি ঘিরে ফেলেন ও মধ্য রাত্রিতে তাদের অগ্নি সংযোগ করেন। অগ্নি বেষ্টনী থেকে বেরিয়ে আসার সময় দুঃসাহসিক গেরিলারা ১১ জন রাজাকার সহ ৩৭ জন শত্রুসেনা খতম করেন এবং ১৯ জনকে দারুণ ভাবে আহত করেন। এই অগ্নি সংযোগের ফলে শত্রু ছাউনি সম্পূর্ন ভস্মীভূত হয়। পরদিন ভোরে পাক হানাদার বাহিনী হেলিকপ্টারের সাহায্যে মৃত পাঞ্জাবি সেনাদের উঠিয়ে নেয় আর রাজাকার দের ১১ টি লাশ পানিতে ভাসিয়ে দেয়।

 

মুক্তিবাহিনী ১লা ও ২ রা আগস্ট অতর্কিত আক্রমণ করে বর্বর ইয়াহিয়ার দস্যু সেনাদের ১৯ জনকে নিহত ও যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে ৩ জন রাজাকার কে অস্ত্র সহ গ্রেফতার করেন। এই সব রাজাকার রা আমাদের প্রতিনিধির নিকট জানিয়েছে যে, তাদেরকে বল পূর্বক রাজাকারেভর্তি করা  হয়েছে। বল প্রয়োগ করে রাজাকারদের যুদ্ধে সামনে থেকে দেওয়া হয় কিন্তু যখন তারা মুক্তি বাহিনীর সঙ্গে এঁটে উঠতে না পেরে পিছু হটে, তখন পাঞ্জাবিরাই তাদের গুলি করে হত্যা করে। রাজাকারদের দিয়ে পাঞ্জাবি সৈন্যরা আহত হলে নার্সের কাজ করানো হয়। এমনকি জোর করে রাজাকারদের শরীর থেকে রক্ত নেয়া হয়। বছির উদ্দিন নামক রাজাকার করুন ভাবে আমাদের প্রতিনিধির নিকট বলেছে যে, তার চোখের সামনে পাঞ্জাবিরা তার মা, বোন ও তার ভাবির ইজ্জত নষ্ট করে এবং তাকে ধরে নিয়ে রাজাকার বাহিনীতে ভর্তি করে মুক্তিফৌজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাচ্ছে।

 

 

ভালুকা থানায় ২৫ জন পাকসেনা নিহত

 

গত ৪ঠা আগস্ট একদল পাকসেনা যখন আঙ্গারপাড়া থেকে ভালকায় ফিরছিল তখন মুক্তিফৌজ চাঁদপুরে তাদের আক্রমণ করে। ৯ ঘণ্টা স্থায়ী যুদ্ধে ২৫ জন হানাদার সৈন্য খতম ও বহু আহত হয়।

 

 

টাঙ্গাইল পশ্চিম রণাঙ্গনে তুমুল সংঘর্ষ

 

টাঙ্গাইল জেলার পশ্চিম রণাঙ্গনে আমাদের অসীম সাহসী মুক্তিবাহিনী আক্রমণাত্মক তৎপরতা আরও জোরদার করেছেন। গেরিলা কায়দায় আক্রমণ করে পাকবাহিনীকে কোণ ঠাসা করে ফেলছে।

 

গত ২৬ শে জুলাই ঘাটাইল থানার কালিদাস পাড়ায় ভোর ৫ তা থেকে ২ ঘণ্টা ব্যাপী এক খণ্ড যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে ১৯ জন রাজাকার নিহত ও ৭ জন আহত হয় । বাকি সবাই কোন রকমে পালিয়ে প্রাণ বাঁচায়।

 

গত ২৮ জুলাই মুক্তিবাহিনীর একটি শক্তিশালী স্কোয়াড বাঘুটিয়ায় বর্বর সেনা ভর্তি দুইটি জিপ সম্পুর্ণ বিধ্বস্ত করে দেন। এতে জিপ ভর্তি প্রতিটি শত্রু নিহত হয়।

 

হত ৩১ শে জুলাই ইছাপুরে মুক্তিবাহিনী পাকসেনা ভর্তি একটি পাবলিক বাস আক্রমণ করে সাতজন পশু সেনা নিহত এবং ১৩ জনকে দারুণ আহত করেন।

 

 

রাঙ্গামাটিতে তুমুল যুদ্ধ

 

বিগত ৫ ই আগস্ট দুপুর ১২ টায় ফুলবাড়িয়া থানার রাঙ্গা মাটিতে দস্যু জালিম সেনা এবং মুক্তি বাহিনীর মধ্যে সাড়ে তিন ঘণ্টা ব্যাপী তুমুল যুদ্ধ হয়। এই যুদ্দে ৩৫ জন দস্যু সেনা নিহত এবং ১৭ জন গুরুতর ভাবে আহত হয়। যুদ্ধ চলাকালীন অবস্থাতেই মুক্তিবাহিনী পাক সেনাদের সাহায্যকারী ৩৭ জন পাকসেনা ভর্তি একটি গাড়ি উড়িয়ে দেন।

 

 

বাবুল বাজারের প্রচণ্ড যুদ্ধ

 

গত ৭ আগস্ট ফুলবাড়িয়ে থানার বাবুল বাজারেও তুমুল যুদ্ধ হয়। পাক সেনারা মুক্তিবাহিনীর দাঁত ভাঙ্গা জবাব পেয়ে পিছু হটে যায়।

 

 

(শেষ সংবাদ)

 

শেষ সংবাদ প্রকাশ রাঙ্গামাটিতে ভীষণ যুদ্ধ অব্যাহত রয়েছে। শত্রু পক্ষে ৬৭ জন নিহত হয়েছে বলে জানা গেছে।

–       রণাঙ্গন , ৮ আগস্ট ১৯৭১

 

 

মুক্তিবাহিনী শত্রুর উপর মরণ ছোবল হানছে

 

বিভিন্ন রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনীর বীর যোদ্ধারা সফল আক্রমণ চালিয়ে বহু হানাদার শত্রুকে খতম করে চলেছে প্রতিদিন। পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা এখন মরিয়া হয়ে প্রাণ বাঁচাবার চেষ্টা করছে। ভিট সন্ত্রস্ত পাকিস্তানী সৈন্য বাহিনী দখলকৃত এলাকার বহু জায়গা থেকে হটে যেতে বাধ্য হচ্ছে।

 

মুক্তি বাহিনীর দুঃসাহসী যোদ্ধারা গত ১১ আগস্ট ঢাকার বিলাস বহুল হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে টাইম বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আমেরিকান টাইমস এর  সংবাদ দাতা ২০ জন সৈন্যকে গুরুতর রূপে আহত করে। শত্রু সৈন্য  পরিবেষ্টিত দখলকৃত ঢাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের নিত্য নৈমিত্তিক তৎপরতা দেখে বাঙ্গালী বীর যোদ্ধাদের প্রশংসায় উৎফুল্ল হয়ে উঠেছে সারা বিশ্বের স্বাধীনতাকামীরা। অন্যদিকে গত ১৪ আগস্ট সিলেটের ডেপুটি কমিশনারের বাংলোতে পট পট করে উড়ছে আমাদের গন প্রিজাতন্ত্রি বাংলাদেশের পতাকা। স্বাধীনতাকামীরা এমনি পতাকা উড়িয়ে দিয়েছেন সুনাম গঞ্জের অনেক গুলো বাসভবনের শীর্ষে।

 

মুক্তিযোদ্ধারা রাজশাহীতে পাকিস্তানী নৌ বাহিনীর একটি ছোট জাহাজ ডুবিয়ে দিয়েছেন। ফলে অস্ত্র ও গোলাবারুদ সহ বহু সংখ্যক দস্যু সৈন্য পদ্মা নদীতে ডুবে গেছে। এদিকে চট্টগ্রামের রামগড় মহকুমা হাকিমের দফতর গেরিলা যোদ্ধারা তছনছ করে দিয়েছেন।

 

সিলেট সেক্টরে মুক্তিবাহিনী গত ১২ ও ১৩ ই আগস্ট ১০০ হানাদার সৈন্য খতম করেছে। এর আগে মুক্তুযদ্ধারা জুরি, কালিহাতি, কাংলি ও সবুজপুরে তৎপরতা চালান। মুক্তিবাহিনী তাদের কাছ থেকে প্রচুর অস্ত্র শস্ত্র উদ্ধার করেছেন। গত ৯ আগস্ট অত্র এলাকার উত্তর পূর্ব এলাকায় শাহ বাজ পুর মুক্তিবাহিনীর সাফল্যজনক আক্রমণে প্রায় ৫০ জন পাক সৈন্য খতম করেছে। গেরিলা যোদ্ধারা ৪ জন পাকিস্তানী সৈন্যকে জীবন্ত অবস্থায় আটক করতে সক্ষম হয়েছেন।

 

গত ৮ আগস্ট ঝিকরগাছার নুলিয়ানি গ্রামে হানাদার সৈন্যরা লুটপাট করতে গেলে একজন মুক্তিযোদ্ধা একটি বাগান থেকে গ্রেনেড দিয়ে আক্রমণ চালিয়ে একজন হানাদারকে খতম করে। স্বাধীনতা কামী যোদ্ধারা হাল্কা মেশিন গান ও রাইফেল দিয়ে অন্য একটি আক্রমণে ৩ জন শত্রু সৈন্যকে হতাহত করেন। হানাদার সৈন্যরা এর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য উক্ত গ্রামে লুটপাট ও নির্যাতন চালাতে থাকে। গেরিলা যোদ্ধারা পুনরায় আক্রমণ চালিয়ে ২ জনকে খতম ও ২ জনকে আহত করে।

গত ৯ আগস্ট (সোমবার) যশোরের নাভারন এলাকায় গেরিলারা রাজাকারদের উপর এক অতর্কিত হামলা চালান। এতে ৯৩ জন শত্রু নিহত ও বহু আহত হয়। পরের দিন ভোর রাতে মুক্তিযোদ্ধারা একটি সেতু পাহারারত রাজাকারদের উপর আক্রমণ চালিয়ে ৪ জনকে হত্যা করে। অন্যান্যরা কোন রকমে পালিয়ে যায়।

 

স্বাধীন বাংলা বেতারের খবরে প্রকাশ, গত ৮ আগস্ট সিলেটের লাটু অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর বীর যোদ্ধাদের সাথে হানাদার পাকিস্তানী সৈন্যদের ৮ ঘণ্টা ব্যাপী প্রচণ্ড শঙ্ঘর্ষ হয়েছে। এই সঙ্ঘর্ষে মুক্তিযোদ্ধারা জীবন পণ করে হানাদার শত্রুদের উপর প্রবল আক্রমণ চালিয়ে যান এবং ৫৫ জন হানাদার কে খতম ও ৬৫ জনকে গুরুতর রূপে আহত করেন। সঙ্ঘর্ষে ৪ জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হয়।

 

সম্প্রতি সিলেটের কেরামন গড়, রহিম পুর, বিয়ানীবাজার ও মৌলিভি বাজারে বিভিন্ন সঙ্ঘর্ষে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ৬ জন পাকিস্তানী সৈন্য ও ১ জন রাজাকার খতম হয়েছে। শিব বাড়ি অঞ্চলে এত সঙ্ঘর্ষে ১১ জন পাকিস্তানী সৈন্য প্রাণ হারায় ও ১৩ জন মারাত্মকভাবে আহত হয়।

 

চিল্মারি থানার উপর আতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে গেরিলারা একজন অফিসার সহ ৫ জন পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ কে গুলি করে হত্যা করেন।

সম্প্রতি বিয়ানই বাজারে নদীর কাছে একটি লঞ্চ, দুটি স্পিড বোট ও ১৮ টি নৌকা নিয়ে পাকিস্তানী সৈন্যরা যাওয়ার সময় মুক্তিবাহিনী তাহের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে ৭৮ জন পাকসেনা নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা সৈন্য বাহি একটি স্পিড বোট ও ১৭ টি নৌকা ডুবিয়ে দিতে সক্ষম হয়। এই এলাকায় অন্য একটি সঙ্ঘর্ষে ২১০ জন শত্রু সেনা মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে প্রাণ হারায়। অন্য একটি সঙ্ঘর্ষে একজন দুঃসাহসী মুক্তিযোদ্ধা মেশিন গান হাতে নিয়ে শাত্রু বাঙ্কারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ১৫ জন হানাদার কে খতম করে।

 

টাঙাইলে গেরিলা যোদ্ধারা পাওয়ার হাইজের উপর সম্প্রতি গ্রেনেড আক্রমণ চালান। অন্য এক সঙ্ঘর্ষে গেরিলারা টাঙাইলে ৯ জন শত্রু সৈন্যকে খতম করেন । গত সপ্তাহে পাগলা দেওয়ান হাটে এক সঙ্ঘর্ষে মুক্তিযোদ্ধারা ৩ জন হানাদার কে খতম করেন।

 

আলনপুরে মুক্তিবাহিনীর সাথে গুলি বিনিময়ে ১৩ জন পাকিস্তানী সৈন্য নিহত ও ৭ জন গুরুতর আহত হয়।

রাজশাহী সেক্টর থেকে প্রাপ্ত সংবাদ প্রকাশ, মুক্তিবাহিনীর কমান্ডোরা ৪ ঠা গোস্ট রাজশাহী থেকে ৪০ মাইল উত্তর পূর্ব আড়ানি স্তেশিনে একটি রাজাকার বাহিনীর উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। মর্টার ও মেশিন গানের গুলিতে শত্রুদেনার ৩ জন নিহত হয়। আর অন্যান্যরা পালিয়ে যায়। মর্টারের গোলাতে স্টেশনটি ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কমান্ডোরা টেলিফোন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ফলে রাজশাহী – ঈশ্বরদী র মধ্যে টেলিফোন যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। এই আক্রমণের পড় পড় খান সেনাবাহিনী একটি ট্রেন উক্ত পথ দিয়ে গমন কালে দুঃসাহসী কমান্ডোরা মাইনের সাহায্যে ট্রেন টি উড়িয়ে দেয়। ফলে বহু শত্রু সেনা হতাহত হয়।  পরে কমান্ডোরা আড়ানি বাজারে একটি ব্যাংকে অবস্থান রত শত্রুসেনার পদলেহি দালাল দের উপর আক্রমণ চালিয়ে ৭ জন হত্যা করে। এর কাছে বাঙ্কারে অবস্থান রত খান  সেনারা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পালিয়ে গেলে মুক্তিযোদ্ধারা বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র দখল করেন।

 

সম্প্রতি তথাকথিত শান্তি কমিটির ১১ জন গুণ্ডা অনুপ নগরের জনৈক ডাক্তার কে হত্যা করতে গেলে বাঙলার অতন্দ্র প্রহরী গেরিলা যোদ্ধারা এক অতর্কিত হামলা চালিয়ে ৩ জনকে হত্যা করেন।

 

আমাদের সংবাদ দাতা জানাচ্ছেন যে, গত ৭ আগস্ট মুক্তিবাহিনী মর্টার, মেশিন গান ও হাত বোমা নিয়ে গোদা গাড়ি থানায় অতর্কিত হামলা চালায়। মর্টারের গোলার আঘাতে থানাটি বিধ্বস্ত হয় ও দখলদার বাহিনীর ৩ জন রাজাকার নিহত হয়।

 

গত ৫ আগস্ট কুমিল্লা সেক্টরে নয়নপুর শত্রু ঘাঁটিতে মুক্তিযোদ্ধারা এক অতর্কিত হামলা করে বহু খানসেনা হতাহত করে।

সম্প্রতি পাবনার শাহ জাদ পুরে খান সেনাদের পদলেহি দুইজন দালাল জামাতে ইসলামির তথাকথিত নেতা মাওলানা ওসমান গনি ও থানা ফুড ইন্সপেক্টরকে গেরিলা যোদ্ধারা হত্যা করেছেন। মওলানা অসমান গত নির্বাচনে ভরাডুবির প্রতিশোধ হিসেবে শত্রুসেনাদের সহযোগিতায় খুব তৎপর হয়ে উঠেছিল।

–       জয় বাঙলা, ১০ আগস্ট, ১৯৭১

 

দিনে জঙ্গি কবলে, রাতে মুক্তি সেনার

ঢাকায় অবিরাম গেরিলা আক্রমণে খান সেনাদের আতংক, মনোবল ভঙ্গ

 

মুজিবনগর , ১০ আগস্ট (পি টি আই) – ঢাকা শহরের মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের অবিশ্রান্ত আক্রমণের ফলে দখলদার খান সেনাদের মনে সর্বদার জন্য আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। তাদের মনব এখন কেবল ভাটির দিকে যাচ্ছে। এই খবর খোদ ঢাকা শহর থেকে পাঠিয়েছেন একজন সংবাদ দাতা।

 

উপরোক্ত সংবাদে আরও প্রকাশ, ঢাকা শহর দিনের বেলায় থাকে পাকিস্তানী সৈন্যদের অধিকারে কিন্তু সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গেই স্পম্পূর্ন চিত্রটি যায় বদলে। রাত্রি সমাগমের সঙ্গে সঙ্গে শোনা যায় কান ফাটান আওয়াজ, বোমা ও গ্রেনেড বিস্ফোরণ, মুক্তি সংগ্রামী দল ও পাকসেনাদের মসয়ে অবিরাম গুলি বিনিময়। দিনের উদ্বেগ পুর্ণ অবস্থা খান খান হয়ে যায় রাতের ভয়ংকর শব্দে। 

 

উপরোক্ত সংবাদ দাতা  ঢাকা শহরের বিভিন্ন অংশ ঘুরে দেখার সময় লক্ষ করেছেন, পাকবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ার গন বাংলাদেশের গেরিলাদের আক্রমণে বিধ্বস্ত সেতু, কাল্ভার্ট, বৈদ্যুতিক থাম প্রভৃতি সারাই করছে। কয়েকদিন আগে মুক্তি বাহিনী সিরাজগঞ্জ, বৈদ্যুতিক স্টেশন এবং গুলবাগের স্টেশনটিও ধ্বংস করে দিয়েছেন।

–       য্যগান্তর, ১১ আগস্ট, ১৯৭১

 

হেরিলাদের তৎপরতায় ঢাকায় কন্টিনেন্টাল হোটেল বিধ্বস্ত

 

ঢাকা ১২ আগস্ট (এ পি) – মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের বোমা বর্ষনের ফলে গত মঙ্গলবার ঢাকা শহরের ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের প্রচণ্ড ক্ষতি হয় এবং ওই হোটেলের ১৯ জন পাকিস্তানী ও ১ জন মার্কিন আবাসিক আহত হয়। বিস্ফোরণের ফলে হোটেলের লবির উপরের অংশ বিশেষ উড়ে যায়। এর পড় থেকে দখলদার সেনারা শহরের জনশূন্য পথে টহল দিতে থাকে।

 

জনৈক ফৌজি অফিসার বলেন, পুরুষদের শৌচাগারে রাখা একটি টাইম বোমা বিস্ফোরণের ফলে এই কাজ হয়।

মুক্তিফৌজ যে পাকসেনাদের উপর আক্রমণের মান বৃদ্ধি করে এই বোমা বিস্ফোরণ তাঁর একটি নিদর্শন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার শুরু হওয়ার সঙ্গে এই বোমা বিস্ফোরণের সংযোগ আছে।

 

আগামী শনিবার পাকিস্তানের ২৪ তম বার্ষিক স্বাধীনতা অনুষ্ঠান কে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদে মুখর করে তোলার জন্য ঢাকার বাঙ্গালী অধিবাসীদের উদ্যেশ্যে প্রচারপত্র বিলি করা হয়েছে। ঐদিন প্রতিরোধ আরও তীব্রতর করে তোলার কথাও প্রচার পত্রে বলা হচ্ছে।

 

 

সীমান্তে পাক তৎপরতা বৃদ্ধি

পি টি আই নয়াদিল্লী থেকে জানাচ্ছেন যে , মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা বৃদ্ধির সঙ্গে পাক জঙ্গি শাহী ও ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত বরাবর সেনাসজ্জার তৎপরতা বাড়িয়ে তুলেছে। উদ্যেশ্য ভারতের বিরুদ্ধে রণ উন্মাদনা বাড়িয়ে তোলা।

 

পাক জঙ্গি বাহিনী এখন সীমান্তের ৬০ টি চৌকিতে নিয়ন্ত্রণ ব্যাবস্থা জোরদার করেছে। কিন্তু সেনা কমান্ডের নির্দেশ সত্ত্বেও ভারত – বাংলাদেশ নদী, জলপথ, পাহাড়, চারণ ভূমি প্রভৃতির ভেতর দিয়ে বিস্তৃত ২৭০ টি সীমান্ত ফাঁড়ির উপর সফল নিয়ন্ত্রণ ব্যাবস্থা গড়ে তুলতে এখনো সফল হয়নি। এই সীমান্ত ফাঁড়িগুলো ভারতের পশ্চিম বংগ , আসাম , মেঘালয় ও ত্রিপুরা বরাবর।

 

অন্যদিকে মুক্তিবাহিনী সমগ্র সীমান্ত বরাবর বাংলাদেশের ৫০ কিলোমিটার ভিতর পর্যন্ত নিজ নিয়ন্ত্রণে এনেছে এবং নানা অঞ্চনে অনেক খানি অভ্যন্তরেও ঢুকে পড়েছে।

–       যুগান্তর , ১৩ আগস্ট, ১৯৭১

মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা

 

গত ২৫ শে জুলাই রাতে ঢাকার উপকণ্ঠে ডায়না সিনেমার কাচগে মুক্তিফৌজ দুইটি ট্রাক ভর্তি পাকসেনাকে হাত বোমা দাঁড়া আক্রমণ করিয়া ২৫/৩০ জনকে নিহত ও ট্রাক দুইটিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ইহার পরের দিন কয়েকশত সৈন্য আসিয়া প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার উদ্যেশ্যে প্রায় ৫০০ নিরীহ নাগরিক কে হত্যা করে।  এবং দুই পাশের গ্রাম ভস্মীভূত করে। এইরূপ অত্যাচার সত্ত্বেও জনগণ গেরিলা যোদ্ধাদের আশ্রয় ও সহযোগিতা দান করিতেছেন।

 

২৯ শে জুলাই মুক্তিবাহিনী সন্ধ্যা ৭ টা হইতে কার্ফ্যু জারির ঘোষণা সম্বলত প্রচার পত্র বিলি করে। ফলে ৬ টা বাজিতে না বাজিতেই রাস্তা ঘাট জনশূন্য হইয়া পড়ে ও দোকান পাট বন্ধ হইয়া যায়। পুলিশ বহু চেষ্টা করিয়া দোকান পাট খোলাইতে পারেনাই।

 

 

বিরাট এলাকা শত্রু কবল মুক্ত

 

বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে মুক্তিবাহিনী এঁকের পর এক শত্রুঘাটি দখল করিয়া দুর্বার গতিতে আগাইয়া চলিয়াছে। গত কয়েকদিনে মুক্তি বাহিনী কাকিনা, হাতি বান্ধা, ভুরুংগমারি, দহগ্রাম, বোরখাটা, বারা, পাটগ্রাম প্রভৃতি জায়গার পাক ঘাঁটি ঘুলি দখল করিয়া নেয়। এবং আনুষ্ঠানিক কুচকাওয়াজের মাধ্যমে ওইসব অঞ্চলে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করে।

 

আমাদের রাজশাহী প্রতিনিধি জানাইতেছেন যে, মুক্তিফৌজ রাজশাহী জেলার কয়েকটি গুরুত্তপূর্ন স্থান সহ প্রায় ২০০০ বর্গ মাইল এলাকা সম্পূর্ণ নিজেদের কর্তৃত্বে আনিয়াছেন।

–       মুক্তিযুদ্ধ, ১৫ আগস্ট, ১৯৭১

 

 

বাংলাদেশের দরিয়ায় বিস্ফোরণ

বিদেশী জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত

 

মুক্তিফৌজ জলের তলায়  বিস্ফোরণ ঘটানোয় বাংলাদেশের বন্দরে সোমবার সকালে একটি বিদেশী জাহাজ দারুণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জাহাজ থেকে পাঠানো এক জরুরি বেতার বার্তায় ( এস ও এস ) এই খবর পাওয়া গিয়েছে। বেতার বার্তা টি কলকাতায় ধরা পড়ে।

 

সোমালিল্যান্ডের একটি জাহাজ বাংলাদেশের বন্দরে নঙ্গর করা ছিল। সেখানে জলের নিচে তিনটি বিস্ফোরণ ঘটে। জাহাজ থেকে পাঠানো বার্তায় বলা হয় , তাঁর দারুণ ক্ষতি হয়েছে, জাহাজের খোলে জল ঢুকেছে এবং নঙ্গর ছেড়া অবস্থায় নিরুদ্দেশের দিকে ভেসে চলেছে।

 

মুজিব নগর থেকে পাওয়া খবরে জানা গেছে, মুক্তিফৌজ রাজশাহীতে গ্রেনেড নিয়ে পাক নৌ বহরের উপর আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে নৌযানের নাবিকরা ও নৌসেনা নিহত হয়।

অস্ত্রশস্ত্র ডুবে যায়।

–       আনন্দবাজার, ১৭ আগস্ট, ১৯৭১

 

 

 

স্বাধীনতা দিবসে ঢাকার সভায় বোমা বিস্ফোরণ

 

মুজিবনগর, ১৬ আগস্ট, – গেরিলা তৎপরতায় ঢাকা শহর ও শহর তলি এলাকা এখনো আংশিক নিষ্প্রদীপ অবস্থায় রয়েছে।

 

মুক্তিবাহিনীর সফল আক্রমণে শহরের প্রধান জেনারেটর অকেজো হয়ে পরায় ঢাকা ও তাঁর সংলগ্ন এলাকাকে অতরিক্ত বিদ্যুৎ সূত্রের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে।

 

আর এখানে পাওয়া সংবাদে জানা গেছে, সাহায্যকারী জেনারেটর সম্পূর্ণ ভার গ্রহণে অক্ষম হওয়ায় সারাদিন ধরে মুহুর্মুহু বোমা বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। সংবাদে বলা হয়েছে, ঢাকা মৃত  শহরে পরিণত হয়েছে, শুধু রাজাকাররা টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে, আপক্ব সৈন্যরা তাদের নিরাপত্তার জন্য ব্যারাকের মধ্যেই রয়েছে।

–       যুগান্তর, ১৯ আগস্ট ১৯৭১

 

 

পাকিস্তান শেরপুরে আরও সেনা মোতায়েন করছে

 

মুজিবনগর, ১৯ আগস্ট, ইউ এন আই রিপোর্ট মতে, পাকিস্তান ময়মনসিংহ জেলার শেরপুর ও  টাঙ্গাইল এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের কাজ তীব্রতর হওয়ায় আরও সেনা মোতায়েন করে। 

 

ময়মনসিংহ জেলায় ১৪ আগস্ট জামালপুর নিকটবর্তী একটি সেনা অবস্থানে হামলা করে অন্তত অর্ধ ডজন পাকিস্তানি সেনারা হত্যা করা হয়। 

 

১৬ আগস্ট খুলনা ৪০ কিলোমিটার দক্ষিণে মোরেলগঞ্জ  অভিযান চালিয়ে ১৫  জন রাজাকার ও অন্যান্য ১০ সহযোগীদের হত্যা করে।

 

সিলেট সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধারা একটি চলমান সেনাবাহিনীর বিশেষ ট্রেন খারাপভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং কিছু সৈন্যদের হত্যা করা হয়।

 

আগস্ট ১৩-১৪ ,  মুক্তিযোদ্ধারা রাতে চট্টগ্রাম সেক্টরে  একটি প্রধান সম্মুখযুদ্ধে প্রায় ১০ জন  পাকিস্তানি সৈন্য, এক ডজনেরও বেশী রাজাকার ও কিছু মিজো-  যারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে সহযোগী হিসাবে ছিল তাদের হত্যা করে।

ইংরেজি সাপ্তাহিক পত্রিকা  অনুসারে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে শীর্ষ পাকিস্তানী আর্মি অফিসার দের আত্মীয়দের  গেরিলারা  হত্যা করে।

 

ক্যাপ্টেন সারোয়ার, লেফটেন্যান্ট জেনারেল আজহারের পুত্র কুমিল্লা সেক্টরে নিহত হয় এবং ক্যাপ্টেন হাশেম খান নিহত হন, লে  জেনারেল রিয়াজ এর জামাতা – সিলেট সেক্টরে নিহত হন।

 

ক্যাপ্টেন. কমর আব্বাস, জামাতা , কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা পরিচালক জনাব রিজভী, হত্যা করা হয় ময়মনসিংহ তে ও মেজর কাজিম খান, ন্যাভাল কমোডোর কামাল এর ভাই – তাকে টাঙ্গাইল হত্যা করা হয়।

 

– হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড, ২০ আগস্ট, ৭১

 

 

মুক্তিফৌজএর তৎপরতা বৃদ্ধি

চট্টগ্রাম বন্দরে বোমার আঘাতে জাহাজ ঘায়েল

 

মুজিবনগর, ২০ শে আগস্ট ( ইউ আন আই) – আজ এখানে প্রাপ্ত এক খবরে আরও জানা গেছে যে, গত ১৭ আগস্ট বাংলাদেশের মুক্তিফৌজ বাহিনী চট্টগ্রাম বন্দরে বোমা নিয়ে আক্রমণ করায় বন্দরে নোঙ্গর করা পাক বাণিজ্য জাহাজ আল আব্বাস দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আক্রমণের পরে বন্দরের কাজকর্ম বন্ধ রাখা হয় এবং পরিস্থিতি আয়ত্তে রাখার জন্য সৈন্য আমদানি করা হয়।

 

রীপোর্টে আরও বলা হয় যে, খুলনা, চালনা ও বরিশালের উপকূল ভাগে মুক্তিবাহিনীর ক্রমবর্ধমান তৎপরতার ফলে সৈন্য বাহিনীর জনৈক সিনিয়র অফিসার সহ প্রায় ৫৪ জন পাক সৈন্য নিহত হয়েছে।

 

পি টি আই – এর এক খবরে বলা হয়েছে যে, গত ৫ দিনে বাংলাদেশের পূর্ব খণ্ডের বিভিন্ন অঞ্চলে মুক্তিফৌজ গেরিলাদের আক্রমণে পাক সৈন্যবাহিনীর জনৈক সিনিয়র অফিসার সহ প্রায় ৫৪ জন পাক সৈন্য নিহত হয়েছে।

 

 

চারখানা স্টিমার ধ্বংস

 

এখানে মুক্তিবাহিনীর সদর ঘাঁটি কার্যালয়ে প্রাপ্ত সংবাদে জানা গেছে যে, গড় ১৭ আগস্ট মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধারা নারায়ণগঞ্জ নদীতে পাট, কয়লা ও পাক সৈন্য দের জন্য রেশম বোঝাই চারখানা স্টিমার সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছেন।

 

নোয়াখালী জেলায় সোনাগাজির নিকটে সৈন্য বাহিনীর একটি জীপ মাইন দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ায় ৪ জন পাকসেনা নিহত হয়। অপর ৫০ জন পাকসেনা নিহত হয়েছে কুমিল্লা জেলার মন্দাভাগ ও শশিদলে গেরিলাদের তৎপরতার ফলে।

 

আর একটি অতি বিশ্বস্ত সূত্রের খবরে জানা যায়, গত সপ্তাহে কুমিল্লা জেলার মান্দাভাগ, নউগাও, লক্ষ্মীপুর, ডিওফ, রসুলপুর, নারায়ণ পুর প্রভৃতি অঞ্চলে বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের আচমকা আক্রমণে বহুসংখ্যক পাকসেনা ও কিছু রাজাকার নিহত হয়েছে। গেরিলারা মান্দাভাগ ৬ টি বাঙ্কার ও নব নির্মিত একটি সেতুও ধ্বংস করেছেন।

 

ঢাকা থেকে এখানে প্রাপ্ত এক খবরে বলা হয়েছে যে, মুক্তিযোদ্ধারা গ্রেনেড নিয়ে আক্রমণ চালালে পুবালি জুট মিলের দুটি পাট গুদামে আগুণ লেগে সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়েছে। শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে গেরিলার ৭ জন সমাজ বিরোধী ও সৈন্যদের দালাল কে খতম করেছেন। খবরে আরও বলা হয়েছে যে, ঢাকা ও ইহার চার পাশে পাশক সৈন্য শিবির সমূহে মুক্তিবাহিনী আচমকা আঘাত  হানা এখন নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

 

 

৪৯ টি পাক সীমান্ত ঘাঁটি ধ্বংস

 

শিলং থেকে ইউ এন আই জানিয়েছে মুক্তিবাহিনী মহল থেকে আজ বলা হয়েছে যে, শ্রী হট্ট ও ময়মন সিংহ খণ্ডে তিনটি বাদে  সমস্ত পাক সীমান্ত ফাঁড়ি মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা ধ্বংস করে দিয়েছে।

 

২৫ মার্চ পাক সেনাবাহিনীর আক্রমণ আরম্ভের পূর্বে আসাম ও মেঘালয়ের সঙ্গে সিমান্তবর্তী এই ডুটি জেলায় মোট ৫২ টি পাক সীমান্ত ফাঁড়ি ছিল। এখন যে তিনটি ফাঁড়ি পাক দখলে আছে সেগুলো শ্রী হট্ট জেলায় অবস্থিত।

 

 

দোতলা স্টিমার ডুবিয়ে দেয়া হল

 

শিলং থেকে ইউ এন আই এর খবরে প্রকাশ, এ মাসের প্রথম দিকে মুক্তিফৌজের গেরিলারা স্রীহট্ট অঞ্চলে পাকিস্তানী সৈন্য বাহিনীর একটি দোতলা স্টিমার ডুবিয়ে দিয়েছে। ডুবিয়ে দেয়ার আগে মুক্তিফৌজ সেটি থেকে গোলাগুলি নামিয়ে নেয়।

–       যুগান্তর, ২১ আগস্ট, ১৯৭১

 

 

খুলনার যে কোন স্থানে মুক্তিফৌজ আঘাত হানিতে সক্ষম

 

খুলনায় মুক্তিফৌজ তৎপরতা বিপুলভাবে বৃদ্ধি পাইয়াছে। কোন জায়গাই যে মুক্তিফৌজের দুঃসাহসী গেরিলাদের অগম্য নয় উহার প্রকৃষ্ট প্রমাণ খুলনা শহরে সদর ডাক বাংলোতে তথাকথিত শান্তি কমিটির বৈঠকে বোমা বিস্ফোরণ। মুক্তিযোদ্ধারা ইয়াহিয়ার দালালদের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালাইয়া স্থানীয় জন সাধারণের সহায়তায় নিরাপদে পালাইয়া যায়। পরে পাক দস্যুসেনারা আসিয়া ডাক বাংলোর আঁশে পাশে ব্যাপক তল্লাসি ও নির্বিচারে গুলি বর্ষন করিলে ও গেরিলাদের টিকটিকির নাগাল পায় নাই।

 

 

চালনা বন্দর মৃত

 

আমাদের খুলনা প্রতিনিধি জানাইতেছেন যে, পাক সেনারা শহরে এখনো স্বাভাবিক অবস্থা প্রতিষ্ঠা করিতে পারেনাই। রোজ সকালে ৯ টা হইতে ১২ টা পর্যন্ত শহরে লোকজন আসে। জিনিস পত্র ক্রয় বিক্রয় হয়। পরে রাস্তাঘাট জনশূন্য হয়ে পড়ে। আফিসে কিছু কিছু কর্মচারি আসে – কিন্তু কাজ কর্ম হয় না।

 

বাজারে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস পত্রের দাম খুব ই বেশী। কাপড়- চোপড় , কেরোসিন তেল, ঔষধ পত্র দুষ্প্রাপ্য। কিন্তু ধান – চাউল খুব সস্তা। লুট পাট , হয়রানি প্রভৃতির ভয়ে স্বাভাবিক ব্যাবসা বাণিজ্যে অচলাবস্থা চলিতেছে।

 

চালনা বন্দর এখনো মৃত। শ্রমিকের অভাবে বন্দরের কাজ কর্ম বন্ধ। পাকসেনারা প্রধানত খুলনা, বয়রা ও মংলা ঘাঁটিতে থাকে। বাইরে বড় বেশী ঘোরাঘুরি করেনা। কোথাও যাইতে হলে বড় বড় দলে খুলনা হতে ট্রাক যোগে , কিংবা মংলা হতে গান বোটে যাতায়াত করে।

 

 


 

সাতক্ষিরা

 

সাতক্ষিরায় মুক্তিবাহিনী কয়েকদিন আগে সীমান্ত এলাকার দুইটি পাক ঘাঁটি দখল করিয়া বাংলাদেশের পতাকা উড়াইয়া দিয়াছে। ঘাঁটি দুইটি হইল কাক ডাঙ্গা ও বৈকারি। ইতিপূর্বে মুক্তিবাহিনী তলুই গাছা চান্দুরিয়া ক্যাম্প ও হিজলদি ক্যাম্প দখল করিয়া নেয়। চান্দুরিয়া হইতে বৈকারি এই সমগ্র এলাকা এখন মুক্তিবাহিনীর করতল গত।

 

কাক ডাঙ্গা ক্যাম্প হইতে পলায়নের সময় পাকসেনারা বিপুল পরিমাণ অস্ত্র শস্ত্র ও রসদ ফেলিয়া যায়। মুক্তিবাহিনী উহা দখল করিয়াছে।

 

কাক ডাঙ্গা হইতে পলায়নের পড় পাকসেনারা হঠাত গঞ্জে আস্তানা গড়ে। মুক্তিবাহিনী তলুইগাছা হইতে পিছন দিক দিয়া পাক বাহিনীকে আক্রমণ করে অ ১৬ জন সৈন্য অ ৫ জন রাজাকার হত্যা করে।

–       মুক্তিযুদ্ধ, ২২ আগস্ট, ১৯৭১

 

 

রণাঙ্গনের খবর

চৌদ্দ গ্রাম

 

আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ গত ১০ আগস্ট পাকবাহিনীর স্থানীয় হেড কোয়ার্টারে অদূরে আমান গণ্ডা গ্রামে অতর্কিত হামলা চালিয়ে ১৩ জন হানাদার সৈন্যকে খতম অ ১৭ জনকে মারাত্মক ভাবে আহত করে।

 

আর খবরে প্রকাশ, চৌদ্দ গ্রাম , লাকসাম সড়কে মাইন বসিয়ে আমাদের মুক্তিবাহিনী একজন পদস্থ অফিসার সহ মোট ৬ জন শত্রু সৈন্যের একটি জীপ উড়িয়ে দিয়েছেন । একই দিনে ট্রাঙ্ক রোডের বালিজুরি পুলের নিকট একদল শত্রু বাহিনীর উপর গেরিলা আক্রমণ চালিয়ে মুক্তিফৌজ ৯ জন হানাদার কে যমঘরে পাঠিয়ে দিতে সমর্থ হয়েছেন।

 

 

/ দেবীদ্বার /

 

কুমিল্লার দেবীদ্বার ও মুরাদ নগর থানার সংযোগস্থলে মুক্তিবাহিনী এবং পাক বাহিনীর এক সঙ্ঘর্ষে ১৬ জন সৈন্য সহ ২৪ জন রাজাকার নিহত হয়েছে। প্রকাশ, ৪ জন শত্রু সৈন্য ঘটনাস্থল থেকে প্রাণ নিয়ে পালিয়েছে।

আমাদের প্রতিনিধি জানিয়েছেন, দেবীদ্বার থানার লাতাসীয় গ্রামে পাঞ্জাবি সৈন্য ও তাহাদের পাঁচটা রাজাকার বাহিনী ৭ জন নিরীহ গ্রাম বাসীকে হত্যা করেছে। হানাদার রা অতঃপর গ্রামটি সম্পূর্ন ভাবে ভস্মীভূত করে ও ধন সম্পত্তি লুটপাট করে।

 

/সোনাগাজি/

 

গত ১৫ আগস্ট মুক্তিফৌজের এন্টি ট্যাঙ্ক মাইনের ঘায়ে নোয়াখালীর সোনাগাজিতে পাক বাহিনীর একটি জীপ উড়ে যায়। ফলে পাক বাহিনীর ৪ জন অফিসার নিহত হয়।

 

 

/দাউদ কান্দি/

 

/বাংলাদেশের ‘ রণাঙ্গন প্রতনিধি লিখেছেন যে, গত ১৫ আগস্ট মধ্যরাত্রে কুমিল্লায় দাউদ কান্দি ফেরি ঘাট টি মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছে। ফলে কুমিল্লা – নোয়াখালী – চট্টগ্রাম সড়ক যোগাযোগ ব্যাবস্থা সম্পূর্ন বিপর্যস্ত হয়ে গেছে। গেরিলারা একটি ফেরি নৌকা ( ২০০ ফুট দৈর্ঘ, একসাথে ৮ টি গাড়ি বহন করে ) ডিনামাইট দিয়ে ডুবিয়ে দিয়েছেন। নিকটস্থ ফেরি গুদামটি ধ্বংস হয়েছে। ফেরি ঘাটে টহলদার রত ৬ জন রাজাকার ও ১ জন পাক পুলিশ ও সঙ্ঘর্ষে নিহত হয়েছে।

 

 

 

/শালদা নদী/

 

শালদা নদী অঞ্চলে পাক হানাদার রা ভৌগলিক ও রণকৌশল গত অবস্থান হিসাবে গুরুত্তপূর্ণ ও সুবিধাজনকভাবে প্রচুর সৈন্য মোতায়েন করেছিল। এই রণাঙ্গনে মুক্তিফৌজ প্রায় ৪৪৫ বর্গমাইল এলাকা মুক্ত করে নয়া পর্যায়ে আক্রমণ অব্যাহত রেখেছেন। হানাদার রা এ এলাকা করার জন্য উজানিসার, কুঠি চৌমুহুনি, শশিদল, ভাগড়া এবং সি এন্ড বি রোড থেকে মুক্তাঞ্চলের মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের উপর কামান থেকে গোলাব্বর্ষন করছে। কুমিল্লার সাথে রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় হানাদারদের চলাচল পথ একমাত্র সি এন্ড বি। হানাদাররা নদীপথে তিনটি দিক দিয়ে মুক্ত অঞ্চলে প্রবেশ করারা চেষ্টা করছে। মুক্তিফৌজ সতর্কতা ও সাহসিকতার সাথে তা ব্যার্থ করেছেন।

–       বাংলাদেশ, ২৩ আগস্ট, ১৯৭১

 

 

চুয়াডাঙ্গার অদূরে ৭০ জন পাক সৈন্য খতম

 

কৃষ্ণ নগর – ২৩ শে আগস্ট – মুক্তিফৌজ গত শুক্রবার কুষ্টিয়া জেলার চুয়াডাঙ্গার ২২ কিলোমিটার উত্তরে আলম ডাঙ্গায় পাক বাহিনীর সরবরাহ ঘাঁটি আক্রমণ করে ৭০ জন পাকসেনা খতম করে। আহত পাকসেনার সংখ্যা ৩০ জন। মুক্তিফৌজ সূত্র থেকে এ খবর পাওয়া গেছে।

 

মুক্তিফৌজদের আক্রমণে বেসামাল হয়ে পাক বাহিনী অস্ত্র শস্ত্র ফেলে ঘাঁটি ত্যাগ করে। পাকবাহিনীর এই সব অস্ত্র শস্ত্র মুক্তিফৌজ  দখল করে। সরবরাহ ঘাঁটি টি সম্পূর্নভাবে নষ্ট হয়েছে।

–       যুগান্তর, ২৪ আগস্ট, ১৯৭১

—————————————————————————–

 

মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে পাকসেনাদের বিপর্যয়

 

মুজিবনগর, ২৬ আগস্ট ( ইউ এন আই) – আজ বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে  প্রচারিত এক বুলেটিনে বলা হয় মুক্তিবাহিনী ২২ শে আগস্ট থেকে বিভিন্ন রণাঙ্গনে তৎপরতা চালিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য রাজাকার ও মুসলিম লিগ সমর্থক সহ ১৫০ জনকে খতম করেছেন।

 

আহতদের মধ্যে পাক সেনাবাহিনীর ও আধা সামরিক বহু অফিসাররাও আছেন। শুধু শ্রী হট্টের সিভিল হাসপাতালেই ১৫০ জন রাজাকারের চিকিৎসা করা হচ্ছে।

 

এছাড়া মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা রেল লাইন ও সেতু উড়িয়ে দিয়েছেন। তারা গাড়ি ও বৈদ্যুতিক পাইলন ধ্বংস ও টেলিফোন লাইন বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছেন।

 

 

চট্টগ্রাম বন্দরে তৎপরতা

 

চট্টগ্রাম বন্দরে ১৬ আগস্ট হাজার টন ওজনের ‘আল আব্বাস ‘ ও ১২৫০০ টনের আরেকটি জাহাজ ডুবানর সংবাদ সমর্থিত হয়েছে। মালবাহী বড় বজরা কেও ডুবিয়ে দেয়া হয়েছে।

 

 

পাক সৈন্যের ঈগল বাহিনী

 

যশোর পাক সৈন্যরা ঈগল বাহিনী নামে একটি নতুন বাহিনী গঠন করেছে। বর্ষা শেষ মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যাপক আক্রমণ চালানোর জন্য এই বাহিনী গঠন করা হয়েছে।

 

রংপুরের রায়গঞ্জ এলাকায় ২২ আগস্ট গেরিলারা ডুটি সেতু ধ্বংস করেছে। পরের দিন ভুরুংমারি ও বাগবান্দা এলাকায় পাকসেনাদের সাথে মুক্তবাহিনির সঙ্ঘর্ষ হয়।

শ্রী হট্টে ১৯ আগস্ট মুক্তিবাহিনী জাফ্লং এলাকা থেকে পাকসেনাদের হটিয়ে দেন। সুনামগঞ্জ এলাকা থেকে আটার অস্ত্র সহ দুজন রাজাকার আটক করেন। পাকসেনাদের যাতায়াত বিঘ্নিত করারা জন্য জকিগঞ্জ এলাকায় কুশিয়ারা নদীর বাধটিকে ও উড়িয়ে দেয়া হয়েছে।

 

 

ঢাকায় মাইন বিস্ফোরণ

 

ঢাকার বৈদ্যের বাজারে ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী মাইন বিস্ফোরণে ডুটি সামরিক জীপ ও একটি বেবি ট্যাক্সি ধ্বংস হয়েছে। ১১ জন পাকসেনা ও ৩ জন রাজাকার খতম হয়েছে।

 

ব্রাম্মহনবাড়িয়ার সরাইলে সোমবার ৩ জন রাজাকার খতম হয়েছে। ও দুটি রাইফেল উদ্ধার করা গেছে।

 

সরাইল মুসলিম লিগের পাণ্ডা ও পাক সৈন্যের সাগরেদ মান্নান মিয়াকেও গেরিলারা খতম করে দিয়েছেন।

 

শ্রী হট্ট শহরে একাংশে নিষ্প্রদীপ অবস্থা বিরাজ করছে। কারণ মুক্তিবাহিনী বৈদ্যুতিক পাইলন ধ্বংস করে দিয়েছে।

 

 

ধলেশ্বরীতে জাহাজ ডুবি

 

টাঙ্গাইল জেলায় কাকুয়ার কাছে ধলেশ্বরীতে মুক্তিবাহিনী ৪ টি জাহাজ ডুবিয়ে দিয়েছে।

 

মুক্তিবাহিনী ১৯ আগস্ট ঢাকার সাটুরিয়া থানা আক্রমণ করে ৪ জন খানসেনা ও ৫ জন পুলিশ কে খতম করে।

তারা ১৪ জনকে গ্রেফতার করে ও কিছু অস্ত্র উদ্ধার করে।

 

 

কুমিল্লায় অতর্কিত আক্রমণ

 

আগরতলা থেকে নিজস্ব প্রতিনিধি জানাচ্ছেন, মুক্তিবাহিনী কুমিলার সালদা নদীতে পাক সৈন্যবাহিনী একটি মোটর লঞ্চ আক্রমণ করে ৮ জন খানসেনাকে খতম করেছে। নয়নপুর ও মওলা ভাগের অর্ধাংশ সম্প্রতি মুক্ত এলাকায় পরিণত হয়েছে। মউলাভাগে বাজারের পাক সৈন্য শিবির ও আক্রান্ত হয়েছে।

 

মুক্ত এলাকায় দখল করার জন্য পাকসেনার ২৩ শে আগস্ট থেকে গ্রামে গোলাবর্ষন করেছে। মুক্তিবাহিনী ও পাল্টা আক্রমণ করেছেন। পক্সেনারা রঘু রামপুর, কাশীরাম পুর , কুলা পাথর, চারউয়া, চাদখোলা, মন্দ ভাগ, কাইম্পুর, মনিপুর, কমলপুর, দাউশ, গিকরা, জৈকালি প্রভৃতি এলাকায় গোলাবর্ষন করে জনসাধারণের ব্যাপক ক্ষতি করেছে। বহু লোক আহত হয়েছেন।

–       আনন্দ বাজার, ২৫ আগস্ট, ১৯৭১

 

 

 

মুক্তিবাহিনীর সাফল্য

 

পাক হানাদার বাহিনী আজ বিপর্যস্ত। চারিদিকে। সর্বত্র নদীতে, বন্দরে। শহরে, গঞ্জে। হাটে ঘাঁটে বাংলার এক প্রান্ত থেকে ওপর প্রান্ত পর্যন্ত।

 

পাক দস্যুদের জাহাজ ডুবেছে। জাহাজের পশুগুলো তলিয়ে যাচ্ছে বাংলার নদীতে। অতলে। সড়কে জিপ উড়ে যাচ্ছে কত শার্দুল মুক্তিযোদ্ধাদের মাইনে। মস্তক চলে যাচ্ছে মেশিন গানে, মর্টারে। ছাউনিতে উড়ে যাচ্ছে আঘাতে ছাই কুটার মত। চারিদিকে একই অবস্থা। হানাদার বাহিনীর পরাজউ আসন্ন। মীর জাফরের গোষ্ঠীকে শেষ করতে হচ্ছে শয়তানের সাথে। নির্মূল হচ্ছে অবাঞ্ছিতের দল। এদিকে মুক্তাঞ্চল গড়ে উঠেছে একের পর এক। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের পতাকা উড়ছে সেখানে।

বেসামরিক প্রশাসন নেবে এসব এলাকা। অন্যান্য স্বাধীন সার্বভৌম দেশের মত বাংলাদেশ সরকারকে দিচ্ছে ট্যাক্স খাজনা। এসব এলাকায় গড়ে উঠছে এক বলিষ্ঠ শক্তিশালী জনগোষ্ঠী। সামরিক- বেসামরিক।

 

খুলনা, সাতক্ষিরা মহকুমা আজ সম্পূর্ন মুক্ত। গত ১৯ আগস্ট মুক্তিযোদ্ধারা অর্ধ ডজন দেশী বিদেশী জাহাজ তলিয়ে দিয়েছে মংলার বন্দরে পথে জ্বলে। হত্যা করেছে শতাধিক হানাদার বাহিনী। ধরে নিয়ে এসেছে বনবালা নামে দুটি অস্ত্র বোঝাই লঞ্চ। গ্রেফতার করেছে ৪ জন দালাল ফরেস্ট অফিসার। তাদের সাথে আগ্নেয়াস্ত্রগুলো বাদ যায়নি। এ ছিল রণাঙ্গনের সর্ব বৃহৎ সাফল্য।

 

খুলনার শ্যাম নগরে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়ছে। এ অঞ্চল এখন মুক্ত। এছাড়া এ জেলার সাতক্ষিরা, পাইকগাছা, আশা মুখি , বাগেরহাটও মুক্ত।

 

ফরিদপুরের রাজবাড়ি, আলফাডাঙ্গা, গোপাকান্ড হানাদার বাহিনী নিসচিনহ হয়ে গেছে। জনগণ স্বাধীন সার্বভৌম জীবন যাপন করছে এসব এলাকায়।

 

বরিশালে গৌরনদী, উজিপুর এসব এলাকার প্রায় ৪০ বর্গ মাইল মুক্ত।

 

পটুয়াখালীর গৌরনদী, উজিপুর এসব এলাকার প্রায় ৪০ বর্গ্মাইল মুক্ত।

 

পটুয়াখালীর জেলা সড়ক ছাড় সর্বত্র মুক্ত। জেলা সদরে মুক্তিযোদ্ধারা হানাদার পাক দস্যুদের উপর আঘাত হেনে যাচ্ছে। পতন আসন্ন।

 

গত ১৮-১৯ শে আগস্ট রাতে শ্যামনগরে হানাদার বাহিনীর ৩৩ জন দস্যু নিহত হয়। ১৭ আগস্ট কালীগঞ্জ দিয়ে যাবার সময় মুক্তিবাহিনীর সাথে হানাদার বাহিনীর ৬ ঘণ্টা ব্যাপী এক সঙ্ঘর্ষ বাঁধে। এখানে তাদের ভীষণ ক্ষতি হয়। কালীগঞ্জের সঙ্ঘর্ষের পর কিছু সংখ্যক পালিয়ে যাবার সময় কালীগঞ্জ শ্যাম নগরের রোডে মাইনের চার্জে জিপ সহ উড়ে যায়। শ্যাম নগরে তাদের উপরে মেশিন গান দিয়ে আক্রমণ চালানো হয়। এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের কিছু ক্ষতি হয়।

 

১৪ আগস্ট সাতক্ষিরায় মুক্তিবাহিনী পাক হানাদার ও ৩৬ জন রাজাকার কে খতম করে। একটি বড় ঘরে ১০০ জনের মত ছিল রাজাকার। বাকিগুলো পালিয়ে যায়। এখানে ৮ টি রাইফেল দখল করা হয়।

 

কপিল মুনি। ১৫ আগস্ট। লঞ্চে যাচ্ছিল হানাদার বাহিনীর একটি দল। মুক্তিযোদ্ধারা চ্যালেঞ্জ  করে দস্যু গুলোকে । সিভিল ড্রেসে ছিল ২৫ জনের মত। লঞ্চের উপড়ে। এগুলো সব পানিতে ডুবে মারা যায়। বাকিগুলোর সাথে মুক্তিবাহিনীর ৩/৪ ঘণ্টা ব্যাপী সঙ্ঘর্ষ চলে। তাদের অনেক ক্ষতি হয়। অবশ্য দস্যু বাহিনীর মৃত্যু সংখ্যা জানা যায়নি।

 

গত ২ র আগস্ট থেকে পাইগোদার মুক্তিবাহিনী বিশেষ তৎপরতার সাথে কাজ করে ২ রা আগস্ট শান্তি কমিটির ত্রাস সৃষ্টিকারী সদস্য হত্যা করে।  ৬ তারিখে হামলা চালিয়ে মুক্তিবাহিনী ১৩ টি রাইফেল ও ২২২ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করে। ৩ জন কুখ্যাত ডাকাত কে হত্যা করা হয়। এদের হত্যা করা হয় খুলনার ক্ষারই ঘাঁটিতে। এরাডাম ইউনিয়নের শান্তি বাহিনীর চেয়ারম্যান মকবুল আহমেদ। ভীতি সন্ত্রাসে প্রতিষ্ঠিত। মুক্তিবাহিনী তাকেও খতম করেছে।

 

পাইকগাছা থানায় হামলা চালিয়ে ৯ টি রাইফেল ও ১৭৭ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়। তাছাড়া কপিল মুনিতে একদন ডাকাতের সর্দার কে নিহত করা হয়। ১ টা রাইফেল ও এখান থেকে উদ্ধার করা হয়েছে।

–       বাংলার মুখ, ২৭ আগস্ট, ১৯৭১

 

………………………………………………………………………………………………………………………।

 

 

 

 

মুক্তিবাহিনীর অভিযানে 400 পাক সেনা নিহত

 

মুজিব নগর, ২৭ আগস্ট- গত ২০ থেকে ২৫ শে আগস্টের মধ্যে বাংলাদেশর বিভিন্ন খণ্ডে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা আক্রমণে দুজন সামরিক অফিসার সহ চার শতাধিক পাকিস্তানী সৈন্য এবং প্রায় ৪০ জন রাজাকার নিহত হয়েছে বলে এখানে মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তরে খবর এসেছে।

 

রিপোর্ট এ আরও বলা হয়, মুক্তিযোদ্ধারা  19 জন  পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগী নিহত করে এবং তাদের হেফাজতে ৫ জন  শত্রু সৈন্য আটক করে।

 

এই সময়কালে গেরিলারা ৯ টি  সেনা যানবাহন, চার টি রাস্তা ব্রীজ, দুই টি  ঘর, দুই টি স্পিড বোট, দুই টি গানবোট এবং দুই টি পাকিস্তানি সৈন্যদের দ্বারা ব্যবহৃত দেশী নৌকা ধ্বংস করে।

 

গেরিলারা যেসব অস্ত্র ও যান বাহন দখল করেছে তার মধ্যে আছে ৭ টি রাইফেল, ১ টি মেশিনগান, ৮ টি বন্দুক ও ৮ টি দেশী নৌকা। কৃষ্ণ নগরের খবরে প্রকাশ সীমান্তের ওপর পাড় থেকে সেখানে খবর এসেছে যে, ২২ আগস্ট কুষ্টিয়া জেলার দর্শনার কাছে মেটনা নামক এক জায়গায় একটি পাকিস্তানী প্লাটুনের ওপর মুক্তিবাহিনীর অতর্কিত আক্রমণের ফলে একজন অফিসার সহ  ১১ জন পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়েছে।

 

খবরে বলা হয়েছে যে, ঐ আক্রমণে মুক্তিবাহিনীর তরফ থেকে কেউ হতাহত হয়নি।

-হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড, আগস্ট 28, 1971

 

 

 

বিভিন্ন খণ্ডে চার শতাধিক পাক সৈন্য নিহত

 

মুজিব নগর, ২৭ আগস্ট- গত ২০ থেকে ২৫ শে আগস্টের মধ্যে বাংলাদেশর বিভিন্ন খণ্ডে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা আক্রমণে দুজন সামরিক অফিসার সহ চার শতাধিক পাকিস্তানী সৈন্য এবং প্রায় ৪০ জন রাজাকার নিহত হয়েছে বলে এখানে মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তরে খবর এসেছে।

 

খবরে বলা হয়েছে যে, মুক্তিযোদ্ধারা পাক বাহিনীর ১৯ জন সহযোগীকে হত্যা করেছে ও ৫ জন শত্রু সৈন্য কে আটক করেছে।

 

গেরিলারা এই সময় সৈন্য বাহিনীর ৯ টি যান, ৪ টি সড়ক সেতু , ৭ টি রাইফেল, ১ টি মেশিন গান, ৮ টি নৌকা, ২ টি গান বোট ও পাকসেনাদের ব্যাবহ্রিত ২ টি দেশী নৌকা ধ্বংস করে দিয়েছে।

 

গেরিলারা যেসব অস্ত্র ও যান বাহন দখল করেছে তার মধ্যে আছে ৭ টি রাইফেল, ১ টি মেশিনগান, ৮ টি বন্দুক ও ৮ টি দেশী নৌকা। কৃষ্ণ নগরের খবরে প্রকাশ সীমান্তের ওপর পাড় থেকে সেখানে খবর এসেছে যে, ২২ আগস্ট কুষ্টিয়া জেলার দর্শনার কাছে মেটনা নামক এক জায়গায় একটি পাকিস্তানী প্লাটুনের ওপর মুক্তিবাহিনীর অতর্কিত আক্রমণের ফলে একজন অফিসার সহ  ১১ জন পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়েছে।

 

খবরে বলা হয়েছে যে, ঐ আক্রমণে মুক্তিবাহিনীর তরফ থেকে কেউ হতাহত হয়নি।

গতকাল সীমান্তের ওপর পার থেকে কৃষ্ণ নগরে প্রাপ্ত আরেকটি প্রকাশ ২৪ শে আগস্ট ভারতের স্বীকার পুর সীমানা থেকে ৯ কিলোমিটার দূরে কুষ্টিয়া জেলার দৌলত পুর থানার অন্তর্গত একটি জায়গায় পাকিস্তানী সৈন্যদের একটি ঘাঁটির উপর মুক্তি বাহিনীর আক্রমনে ১৭ জন পাকসেনা নিহত হয়েছে।

 

খবরে প্রকাশ, মুক্তিবাহিনী ঘাট টি দখল করে এবং সেখানে শত্রু সৈন্যদের ফেলে যাওয়া অস্ত্র দখল করে।

–       আনন্দ বাজার , ২৮ আগস্ট, ১৯৭১

 

 

 

মুক্তিফৌজের তৎপরতা

চট্টগ্রাম বন্দরের প্রবেশ পথ বন্ধ

 

মুজিব নগর, ৩০ আগস্ট (ইউ এন আই) – এজ এখানে প্রাপ্ত সংবাদে জানা গেছে যে, বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা কর্নফুলি নদীতে মালবাহী একটি বড় বজরা ডুবিয়ে দেবার ফলে চট্টগ্রাম বন্দরের প্রবেশ পথ বন্ধ হয়ে গেছে। ১৩ নং জেটির ঠিক উলটো দিকে বজরা টি ডুবানো হয়েছে।

 

গত ১৬ ও ১৭ আগস্ট মুক্তিবাহিনীর অভিযানের সময় বজরা টি ডুবে যায়। ঐ সময়ে বন্দরে অবস্থিত কয়েক খানা জাহাজ ও ডুবিয়ে দেয়া হয়। এ সকল জাহাজ ডুবিয়ে দেবার ফলে বন্দরে কাজ কর্ম সুম্পূর্ন বন্ধ হয়ে যায়।

 

 

 

৬ দিনে ১৯০ জন পাকসেনা ও রাজাকার খতম

 

আগরতলা থেকে প্রেরিত পি টি আই এর খবরে প্রকাশ – গত ২৩ থেকে ২৮ আগস্টের মধ্যে মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা ময়মন সিংহ , কুমিল্লা ও  নোয়াখালীর বিভিন্ন অঞ্চলে অন্তত ১০০ রাজাকার ও ১০ জন খান সেনাকে নিহত করেছে। রাজাকার ও শত্রু ঘাঁটির উপর গেরিলাদের আক্রমণের বিশদ বিবরণ দিতে গিয়ে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডো বলেছেন , গত ২৩ আগস্ট কমান্ডাররা মেশিন গান ও মর্টার নিয়ে কুমিল্লায় বসুর হাটের কাছে একটি রাজাকার ঘাঁটি তে আক্রমণ চালিয়ে ১৫ জন আধা সামরিক স্বেচ্ছা সেবক সহ ৫০ জন রাজাকারকে হত্যা করে।

 

২৪ আগস্ট যে গ্রামে পুর্বোক্ত তরুণদের হত্যা করা হয় সেই হোসেন পুর গ্রামেই গেরিলারা আকস্মিকভাবে একটি রাজাকার ঘাঁটির উপর তীব্র আক্রমণ চালিয়ে ২৫ জনকে খতম করে। পরের দিন ময়মন সিংহ জেলার কুলিয়ার চর গ্রামে আরও ৬ জন রাজাকার কে হত্যা করা হয়।

 

২৬ শে আগস্ট মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা রাজাকারদের সন্ধানে নোয়াখালী জেলার চৌমুহনী রেল স্টেশনে প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। সেখানে ৮ রাজাকার খতম হয় এরপর মুক্তিযোদ্ধারা একটি বড় গ্যারেজের উপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। এখানে রাজাকার রা একটি শিবির স্থাপন করেছিল। এই আক্রমণে ১৬ জন রাজাকার নিহত হয়।

 

ঐ একই দিনে মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধারা দোয়াক বাজারে ২০ জন রাজাকারকে খতম করেন। প্রায় একই সঙ্গে শত্রু ঘাঁটির উপর অতর্কিত আক্রমন চালিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা বেগম গঞ্জে ৫০ জন পাকসেনাকে খতম করেন।

 

২৮ আগস্ট কুমিল্লা খণ্ডে সালদা নদীতে মুক্তিযোদ্ধারা ১৯ জন খান সেনাকে হত্যা করে।

 

গত শুক্রবার রংপুর জেলার পচাগড়ে মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা শত্রু ঘাঁটির উপর দ্বিমুখী আক্রমণ চালান। ২০ জন পাকিস্তানী ও কয়েকজন রাজাকারকে হত্যা করে মুক্তিবাহিনী শত্রু শিবিরকে ধ্বংস করে দেন।

পরের দিন তুরি হাটে গেরিলারা ছদ্মবেশে পাক সৈন্যদের ১০ জন সাগরেদকে খতম করে।

–       যুগান্তর, ৩১ আগস্ট, ১৯৭১

 

 

 

মুক্তিবাহিনী কর্তৃক  পাক সেনার হয়রানি

 

মুজিবনগরে, ৩০ আগস্ট  – সীমান্ত থেকে এখানে পৌঁছনো রিপোর্ট অনুযায়ী মুক্তিবাহিনী বাংলাদেশে অনেক  স্থানে পাকিস্তানি সেনাদের  হয়রানি অব্যাহত রেখেছে।

 

গেরিলা অপারেশন  এনকাউন্টার এ পাকিস্তানি বাহিনীর বিপুল সংখ্যক সৈন্য  নিহত হয়েছে।

 

অনেক রাজাকার,  বিপুলসংখ্যক মুসলিম লীগ স্বেচ্ছাসেবক এবং সহযোগীদের হত্যা করা হয়েছে।

এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সেনা কর্তৃপক্ষ জনাব নুরুল আমিনকে – যিনি  জাতীয় পরিষদের আওয়ামীলীগের বাইরে থেকে নির্বাচিত ২ জনের একজন – তাকে চাপ দিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তানের পক্ষে দেশের বাইরে কিছু সম্মেলনে যুক্তি  উপস্থাপন করার জন্য।

 

কর্তৃপক্ষ তাদের পরিবার ও সম্পদ গেরিলা আক্রমণ থেকে রক্ষা করবে বলে কথা দেয়।

 

রিপোর্টে বেসামরিক ও সশস্ত্র সেবায়  প্রচুর ক্ষয় ক্ষতির কথা উল্লেখ আছে।

 

কর্তৃপক্ষ গেরিলাদের  প্রতিপোষক সন্দেহে  কিছু পুলিশকে  গ্রেফতার করেছে। অন্য স্থানের  পুলিশ স্টেশন মুক্তিবাহিনীর প্রধান লক্ষ্য।

-হিন্দউুস্তানস্ট্যান্ডার্ড, 31 আগস্ট, 1971

 

 

রঙ ও রণাঙ্গন

 

বাংলাদেশ আজ রণাঙ্গন। সুজলা সুফলা , শস্য শ্যামলা বাংলা আজ রক্তাক্ত। রক্তের লাল রং দিয়ে রচিত হচ্ছে বাংলার বর্তমান ইতিহাস। বাংলার সমস্ত কাজের একটি মাত্র নাম ‘ রণ। ‘ আজ বাঙ্গালীরা যাই করছে সম্পুর্ন রণের জন্য। টি সারা বাংলা রণাঙ্গন আজ। আর সমস্ত বাঙ্গালীই রনবির।

 

বাংলাদেশে এই রণ পরিচালনা করছেন ৯ টি সেক্টরের কমান্ডারদের সহযীগিতায় জন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ও প্রধান সেনাপতি জনাব ওসমানী সাহেব চট্টগ্রাম এলাকা।

 

১৭ আগস্ট চাঁদপুরে ৩ জন পাকসেনাকে খতম করেন। ১৮ আগস্ট কুমল্লা জেলার মান্ডাবাগ, নওগাঁও, লক্ষ্মীপুর, জিওফ, রসুলপুর , নারায়নপুর, প্রভৃতি অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে বহু সংখ্যক পাকসেনা ও রাজাকার নিহত হয়।

 

 

টাঙ্গাইল এলাকা

 

টাঙাইলের গেরিলা গোষ্ঠীর হাতে ৩ জনের বেশী পাকসেনা নিহত হয়। গেরিলা বাহিনীকে মারার জন্য পাক ব্রিগেড , পাক পদাতিক সেনা ও বোমারু বিমান কাজে লাগায়। টাঙাইলের মুক্তিসেনারা একটি পাকসেনা জাহাজ ডুবিয়ে দেয়। ফলে ১৫০ জন পাকসেনা নিহত হয়। তাদের কাছ থেকে ২০০ বাক্স গুলি দখল করেন।

 

 

 

মউমন সিংহ ও শ্বরই হট্ট এলাকা

 

১৭ আগস্ট ময়মনসিংহ ও শ্বরই হট্ট এলাকার প্রায় আড়াই হাজার বর্গ্মাইল এলাকা মুক্তিবাহিনীর দখলে। গত ১৫ দিনে এই স্থানে পাকবাহিনীর একজন লে কর্নেল সহ প্রায় ১৮৫ পাকসেনা মুক্তিবাহিনীর হাতে নিহত হয়। মুক্তিবাহিনী ১০০ টি রাইফেল ও ৪ টি স্টেনগান সহ প্রচুর অস্ত্র শস্ত্র দখল করেন। মুক্তিবাহিনী শ্বরই হট্ট জেলার ১৭ টি চা বাগান ধ্বংস করেন। ময়মন সিংহ অঞ্চলে কামলপুর, বকশিগঞ্জ, কাছার এবং নাকাশিতে মুক্তিবাহিনী এই সময়ে আক্রমণ চালিয়ে ৫০ জন পাকসেনা খতম করে।

 

 

ঢাকা এলাকা

১৭ আগস্ট গেরিলা বাহিনীর তৎপরতায় ঢাকা শহরের জেনারেটর অকেজো হওয়ায় ঢাকা শহর ও শহর তলী এলাকা আংশিক নিষ্প্রদীপ থাকে। শীতলক্ষ্যা নদীতে পাট, কয়লা বোঝাই ৪ খানা লঞ্চ জাহাজ মুক্তিবাহিনী ধ্বংস করেছে। মুক্তিবাহিনী গ্রেনেড দিয়ে ঢাকা শহরের পুবালি জুট মিলের দুটি গুদাম উড়াতে গেলে আগুন লেগে তা ভস্মীভূত হয়। শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে ৭ জন দালাল কে খতম করেছে। ২৪ আগস্ট সোনাপুর, বেদের বাজার প্রভৃতি এলাকা সম্পূর্ন মুক্ত হয়।

 

খুলনা এলাকা

 

১৭ আগস্ট খুলনা সেক্টর এলাকার মুক্তিবাহিনী ১০০ জন রাজাকারের উপর আক্রমণ চালিয়ে ৭০ জনকে খতম করেন। ১৪ জনকে জীবিত বন্দি করতে সক্ষম হন এবং তাদের সমস্ত গোলাবারুদ দখল করেন।

 

১৮,১৯,২০ আগস্ট এই এলাকার মুক্তিবাহিনী বসন্ত পুর, কালীগঞ্জ, শ্যাম নগর, মৌ তলা, ঈশ্বর পুর ও পাইকগাছা মুক্ত করেছেন। পাইকগাছায় একটি লঞ্চ আক্রমন করে ২৬ জন পাকসেনাকে হত্যা করেন।

 

১৬ আগস্ট শত প্রচারিত পাক মার্কিন হৃদয় সম পদ্মা জাহাজ কে মুক্তিবাহিনী চালনা বন্দরে সম্পূর্নভাবে নিশ্চিনহ করে দেয়। ঐ একই দিন চট্টগ্রাম, চালনা, ঢাকা, মংলা বন্দর, পদ্মা, মেঘনা নদীতে জাহাজ, স্টিমার, গান বোট, সামরিক লঞ্চ সব মিলিয়ে মোট ৩৬ জলযান ডুবিয়ে দেয়।

 

২৪ আগস্ট মুক্তিযোদ্ধারা খুলনা জেলার মংলা বন্দরে গেরিলা আক্রমণ চালিয়ে ৬ টি জাহাজ ডুবিয়েছে ও ২ টি আটক করেছে। ৬ টির মধ্যে ২ টি মার্কিন, ২ টি চিনা, ১ টি জাপানী ও ১ টি পাকিস্তানী।

 

 

রংপুর এলাকা

 

১৭ আগস্ট তারাপুর ঘাঁটে ৩৫ পাকসেনা নিহত হয়েছে। রংপুর জেলার জেলা থানা মুক্তিবাহিনীর দখলে।

 

 

বগুড়া এলাকা

 

মুক্তিবাহিনীর মাইন বিস্ফোরণে সৈন্য বোঝাই দুটি পাক ট্রাক ধ্বংস হয়। তারা একটি পাক গান বোট ও কয়েকটি মোটর লঞ্চ ধ্বংস করে।

 

 

রাজশাহী এলাকা

আগস্ট, (তারিখ বলা নাই) , মুক্তিবাহিনী কালীগঞ্জের একটি রাজাকার শিবির আক্রমণ করে ৩ জনকে খতম করে।

 

 

যশোর এলাকা

১৮ আগস্ট থেকে ৩ দিনের মধ্যে জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে ৪৯ জন রাজাকার খতম হয়েছে। যশোর – চুয়াডাঙ্গা ও যশোর – বেনাপোল রোডে কাল্ভার্ট সেতু এবং পাকসেনা শিবির ধ্বংস করেছে।

–       বাংলাদেশ। ১ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

 

 

মুন্সিগঞ্জ মহকুমার একাংশ মুক্ত

(নিজস্ব সংবাদ দাতা)

 

ঢাকা জেলার মুন্সগঞ্জ সাব ডিভিশনের বিভিন্ন থানাতে গত জুন মাসের প্রথম দিকে ইয়াহিয়ার জল্লাদ বাহিনী প্রবেশ করে। এবং নবাবগঞ্জ ও দোহার থানাতেই অন্তত পক্ষে আড়াই শত লোককে হত্যা করে। এবং নির্বিচারে বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে ও নারী নির্যাতন চালায়।

 

সিরাজদিখান, কেরানীগঞ্জ, জিঞ্জিরা, গজারিয়া, শুভাড্যা, কালীগঞ্জ, লৌহজং প্রভৃতি থানাতে ব্যাপক গণহত্যা , লুট তরাজ, অগ্নি সংযোগ ও নির্যাতন চালয়।

 

জুলাই মাসের শেষের দিকে এই অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর প্রথম তৎপরতা শুরু হয়। মুক্তিবাহিনীর বীর যোদ্ধারা দোহার থানার ন্যাশনাল ব্যাংক, থানা ও ২ টি ওয়ারলেস স্টেশনের উপর আক্রমণ চালাইয়া এইগুলি ধ্বংস করিয়া দেয়।

আগস্ট মাসের দিকে মুক্তিবাহিনীর বীরযোদ্ধারা শ্রীনগর থানায় ব্যাংক, থানা এবং পোস্ট অফিসের উপর আক্রমণ চালায়।

 

 

ওরা চরণে দলে দলে মরণ শঙ্কারে

(নিজস্ব বার্তা পরিবেশক)

 

সিলেট জেলার অন্তর্গত মৌলভীবাজার মহকুমার বিভিন্ন স্থানের মুক্তিযুদ্ধে পার্টির আরও ৩ জন সমর্থক শহীদ হইয়াছেন। পাকিস্তানী হানাদার সৈন্যদের বিরুদ্ধে অসম সাহসিক লড়াইয়ে তারা বীরের মর্ম মৃত্যুবরণ করেন। ইহাদের সাহসিকরা ও দেশ প্রেম চিরদিন মুক্তিবাহিনীকে অনুপ্রাণিত করবে।

 

১। সম্প্রতি কমলপুর সেক্টরে এক  গেরিলা অভিযানে শহীদ হন সিলেট সদর থানার জামালপুরের সুরুজ। তিনি কালিপুর- চা বাগানে গেরিলা অভিযানে গিয়েছিলেন।

 

২। ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানায় অভিযান চালাইতে গিয়া নেওয়ার আলি গ্রেফতার হন। স্থানীয় দালালরা তাকে ধরাইয়া দিয়াছিল। পরে পাকসেনারা তাকে নির্মম্ভাবে হত্যা করে। শহীদ নেওয়ার আলির বাড়ি সিলেট সদর থানার কালিমুগ বাজারে।

 

৩। বিয়ানীবাজার থানা ন্যাপের সহ সভাপতি আব্দুল খালেক সম্প্রতি পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন। এবং পরে তাকে পিটাইয়া মারিয়া ফেলা হয়।

 

ওপর একজন ছাত্র ইউনিয়ন কর্মি বড়লেখা থানার দিল্কুশা চা বাগানে গেরিলা অভিযানে যাইয়া গুরুতর আহত হন।

–       মুক্তিযুদ্ধ , ৪ সেপ্টেম্বর, ১৯১৭

 

 

 

যশোর কুষ্টিয়া এবং খুলনার বিস্তির্ন এলাকা মুক্ত

যশোরঃ

 

২ আগস্ট – মুক্তিবাহিনী যশোরের লেবু তলা, রায়পুর ও হাসিম পুর থেকে পাক বাহিনীকে তাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন। আমাদের রণাঙ্গন প্রতিনিধি মুক্তাঙ্গন ঘুরে এসে বলেছেন এখানে গত কয়েক দিনের যুদ্ধে প্রচুর খানসেনা খতম হয়েছে। মুক্তিবাহিনীর ব্যাপক আক্রমণে পাক দখলদার সেনারা পালিয়ে যায়। এই সমস্ত এলাকা এখন মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। এখানে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়ে স্বাধীনতা রক্ষার অতন্দ্র প্রহরীরা ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আর এক খবরে জানা গেছে, গত ২৯ আগস্ট রাতে মুক্তিসেনারা নগ হাঁটার পাক ছাউনি  আক্রমণ করে ১৩০ জন পাকসেনাকে খতম করেছে।

 

শেষ সংবাদ –

৩ আগস্ট খুলনা বসন্ত পুরে মুক্তিফৌজ একটি গান বোট ধ্বংস করে দিয়েছে।

 

 

উকসা – গোবিন্দ পুরে ৯ ঘণ্টা যুদ্ধ – গোবিন্দ পুর মুক্ত

খুলনা –

 

৩০ আগস্ট – উকসা গোবিন্দ পুরে মুক্তিবাহিনীর শক্তিশালী ঘাঁটির উপর প্রায় ৪০০ পাকসেনা আক্রমণ চালালে তুমিল যুদ্ধ হয়। সকাল ৯ তা থেকে বিকাল ৪ তা পর্যন্ত যুদ্ধ চলে। বাংলাদেশের বীর বিপ্লবী মুক্তিবাহিনীরা দির্ঘ ৯ ঘণ্টা যুদ্ধের পর শত্রুসেনাদের তাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়।

–       বিপ্লবী বাংলাদেশ, ৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

গেরিলা আক্রমণে সিলেটে বহু খানসেনা হত্যা

 

মুজিবনগর, ২ সেপ্টেম্বর, আমাদের বিশেষ সংবাদ দাতা জানিয়েছেন গত কয়েকদিন সিলেট জেলার বিভিন্ন স্থানে মুক্তিবাহিনীর অতর্কিত গেরিলা আক্রমণে ফলে প্রায় ১৫০ জন খানসেনা নিহত হয়েছে। বিয়ানীবাজার, বড়লেখা, লাতু, জাফ্লং এলাকায়। এছাড়া বহু রাজাকারদের গেরিলারা খতম করে দিয়েছে। সিলেটের এই সফল আক্রমণে মুক্তিবাহিনী শত্রুসেনাদের বহু অস্ত্র শস্ত্র দখল করেছে।

 

 

চট্টগ্রাম বন্দরের প্রবেশ পথ বন্ধ

 

মুজিবনগর ৩১ আগস্ট মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে কর্নফুলি নদীতে একটি বড় বজরা ডুবিয়ে দেবার ফলে চট্টগ্রাম বন্দরের প্রবেশ পথ বন্ধ হয়ে যায়। জেটির উলটো দিকে বজরাটি ডুবানো হয়েছিল। বন্দরে অবস্থিত ১২ টি জাহাজ ডুবানোর ফলে চট্টগ্রাম বন্দরের প্রবেশ পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জাহাজ চলাচল স্থগিত রাখা হয়েছে।

 

 

কুমিল্লার নয়নপুরে জলযান আক্রমণ

 

মুজিব নগর ২ সেপ্টেম্বর, মুক্তিবাহিনী গত সপ্তাহে কুমিল্লার নয়ন পুরে অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে পাকসেনাদের একটি জলযান সহ ৫ টি নৌকা ধ্বংস কোরয়েড এই। সৈন্য ও যুদ্ধ সামগ্রী বহনকারী ৩ টি নৌকা ধ্বংস করে ৫ জন খান সেনাকে খতম ও আরও ২ টি নৌকা আক্রমণ করে মুক্তিবাহিনী ৩০ জন খানসেনাকে হত্যা করেছে। নয়ন পুরে আর এক সঙ্ঘর্ষে ৪ জন খানসেনাকে মুক্তিবাহিনী খতম করেছে।

 

 

মুক্তিযোদ্ধাদের মাইন বিস্ফোরণে শত্রু সেনাদের ট্রেন ধ্বংস

(জন্মভূমি রণাঙ্গন প্রতিনিধি)

 

মুজিবনগর, ৫ সেপ্টেম্বর – মুক্তিবাহিনীর সদর দফতর থেকে জানা গেছে যে, গত সোমবার মুক্তিবাহিনীদের ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী মাইন বিস্ফোরণের ফলে চট্টগ্রাম ও ফেনী স্টেশনের মধ্যে মহারাজ খণ্ড স্টেশনে খান সেনাদের একটি ট্রেন ধ্বংস হয়েছে। এই বিস্ফোরণের ফলে ট্রেনটি সম্পুর্ন ধ্বংস হয়ে যায় এবং যাত্রী সহ ১০০ জন ঘটনা স্থলে নিহত হয়েছে।

 

এছাড়া মুক্তিবাহিনী ময়মন সিংহের গৌরীপুরে রেল অফিস, পোস্ট অফিস, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ধ্বংস করে দিয়েছে। মুক্তিবাহিনীর সাথে এই জেলায় বিশেষ সুবিধা করতে না পেরে প্রায় জায়গাই জঙ্গি সেনারা পিছু হটতে বাধ্য হচ্ছে। জেলায় সর্বত্র মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে শত্রু সেনারা ভীত সন্ত্রস্ত।

–       জন্মভূমি, ৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

 

 

মুক্তিসেনার আক্রমণে দিশেহারা পাক ফৌজ বিমান ব্যাবহার করছে

 

মুজিব নগর – ৬ সেপ্টেম্বর – গত ১ সপ্তাহ যাবত মুক্তিবাহিনী এমন দৃঢ়তা , আত্মবিশ্বাস ও সাফল্য এর সঙ্গে দখলদার পাকফৌজ কে পিটুনি দিচ্ছে যার ফলে ইয়াহিয়ার অনুচররা দিশেহারা। হানাদাররা নিরুপায় হয়ে আবার দির্ঘদিন যাবত বিমান বাহিনীকে কাজে লাগাচ্ছে। বোমা ফেলছে যত্রতত্র। মুক্তিবাহিনীর এতে কোন ক্ষতি হচ্ছেনা । কারণ লড়াইয়ের এই নতুন পর্যায়ে তাদের প্রস্তুতি ও রণকৌশল তারা নিখুঁত করেছে।

 

গত ৭ দিন ধরে পাক ফৌজ মুক্তিবাহিনীর হাতে দারুণ মার খাচ্ছে। পাক ফৌজ আর রাজাকার মিলিয়ে নিহতের সংখ্যা এই কয়সিন রায় দুশ। কয়েকজন পাকসেনা বন্দিও হয়েছে। পাক ফৌজ এখন বিমান বাহিনীর সমর্থন ছাড়া মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে তৎপরতায় নামতে ভয় পাচ্ছে।

 

উঃ পুঃ সেক্টরে মুক্তিবাহিনী ৩২ ঘণ্টা ধরে পাক ফৌজ কে নিযুক্ত রাকে। ঐ লড়াইয়ে একজন পাক মেজর সহ ৩২ জন পাকসেনা ও ৫০ জন রাজাকার নিহত হয়। যশোরে ধুলিয়ান ঘাটে এক সঙ্ঘর্ষে ৫ জন পাকসেনা নিহত হয়েছে। স্রীহট্ট ও কুমিল্লায় ৫৭ জন পাকসেনা ও ২৪ জন রাজাকার, কুষ্টিয়া ও রাজশাহী জেলায় ১০ জন পাকসেনা ও ২০ জন রাজাকার নিহত হয়েছে। মুক্তিবাহিনী সরাসরি পাক শিবির গুলির উপর আক্রমণ চালিয়ে তারপর গেরিলা কায়দায় নিজেদের গুপ্ত ঘাঁটিতে ফিরে যাচ্ছে। পাকফৌজ তাদের পাত্তা পাচ্ছেনা।

রাজশাহী বেতার কেন্দ্রটি মুক্তিবাহিনী ২ বার স্তন্ধ করে দেয়। চট্টগ্রামেও তারা সক্রিয়।

–       পি টি আই

–       – যুগান্তর, ৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

 

 

 

কাউখালি থানা, কাঁঠালিয়া থানা, ভাবডারিয়া থানা ধ্বংস – ৮৭ জন পাঞ্জাবি

পাক পুলিশ নিহত – প্রচুর অস্ত্র শস্ত্র উদ্ধার

 

 

বরিশালঃ

বিলম্বে প্রাপ্ত এক খবরে জানা গেছে, মুক্তিবাহিনী কাউখালি থানা আক্রমণ করে থানাটি ধ্বংস করে দিয়েছে। থানার সমস্ত রাইফেল মুক্তিবাহিনী হস্তগত করেছে। স্থানীয় জনসাধারণের কাছ থেকে  জানা যায় কাউখালির কোন এক স্থানে  মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটি ছিল। এই সংবাদ স্থানীয় থানার দারগা  এবং শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান জানতে পেরে কিছু দালাল পুলিশ এবং রাজাকার নিয়ে ঘাঁটির উপর হামলা চালায়। মুক্তি কমান্ডোদের প্রচণ্ড মারের মুখে হানাদাররা পালিয়ে যায়। কিন্তু দারগা ও চেয়ারম্যান মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পরে। সংবাদ পেয়ে পরের দিন  বরিশাল থেকে পাক বর্বর সৈন্যরা গান বোট নিয়ে কাউখালির উপর ব্যাপক হামলা চালায়। এতে প্রায় ৫০০ নিরীহ মানুষ নিহত হয়। মুক্তিবাহিনী কিছুটা সরে এসে আবার আঘাত হানার প্রস্তুতি চালাচ্ছে। আর এক খবরে যানা যায়, মুক্তিবাহিনী কাঁঠালিয়া এবং ভান্ডারিয়া থানা আক্রমণ করে ৮৭ জন পাঞ্জাবি খতম করে।

 

 

পটুয়াখালীঃ

জানা গেছে, আমাদের অসম সাহসী মুক্তিবাহিনী বেতাগী থানার কুখ্যাত দালাল কাদের ও জেন্নাত কে হত্যা করেছে। এছাড়া সমাজ বিরোধী কাজের জন্য শান্তি কমটির সদস্য ফজলু, বাখ্রুদ্দিন, হামিদ ও আমু কেরানির সমস্ত সম্পত্তি গরিবদের মধ্যে বিতরণ করে দিয়েছে। মুক্তিবাহিনী মঠবাড়িয়া থানার কুখ্যাত মুসলিম লিগ দালাল সামাদ মাস্টার ও মানানকে হত্যা করেছে। এছাড়া দাউখালি দেলোয়ার সহ ৫ জন ডাকাতকে হত্যা করেছে।

 

খুলনাঃ

আমাদের রণাঙ্গন প্রতিনিধি খুলনার বিভিন্ন শহর ঘুরে এসে জানিয়েছেন, মুক্ত অঞ্চল স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে। এই সফর কালীন সময়ে আমাদের প্রতিনিধি মুক্তাঞ্চলে কতিপয় মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি তে প্রবেশ করার সুযোগ পান। এসকল স্থানে ক্যাপ্টেন নুরুল হুদা (হিরু) , ক্যাপ্টেন মাহবুব, লে মোহাম্মাদ খুরশিদ (নেভাল ফোর্স) প্রভৃতি সামরিক অফিসারের সাথে সাক্ষাত ঘটে। প্রতিটি ঘাঁটি তে বীর মুক্তিবাহিনী আমাদের রণাঙ্গন প্রতিনিধিকে হাসি মুখে অভ্যর্থনা জানান।

 

নোয়াখালীঃ

৯ সেপ্টেম্বর মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা নোয়াখালী শহরের কুখ্যাত দালাল নায়ক গোলাম সরয়ার কে হত্যা করেছেন। হ্যান্ড গ্রেনেড দিয়ে কমান্ডোরা এই ১৯৪৬  সালের নায়ক কে হত্যা করেছেন। এতে স্থানীয় জনসাধারণ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন।

–       বিপ্লবী বংলাদেশ । ১২ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

 

 

 

মুক্তিবাহিনীর সাফল্য

দুজন কর্নেল সহ ৭ জন পাক অফিসার ধৃত

 

গত কয়েক মাস্যা বাংলাদেশের মুক্তিফৌজ পাকিস্তানের দুজন কর্নেল সহ ৭ জন পদস্থ সামরিক অফিসারকে আটক করেছে। আটক পাক সামরিক অফিসারদের মধ্যে আছে লে ক খিজির হায়াত খান, মেজর সাদেক নওয়াজ, লে আতাউল হাসান। এই অফিসাররা সকলেই বর্তমানে মুক্তিফৌজের হাতে বন্দি রয়েছে।

–       সাপ্তাহিক বাংলাদেশ, ১৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

 

 

ঢাকা বিচ্ছিন্ন নগরী

 

মুজিবনগর ১২ সেপ্টেম্বর – মুক্তিবাহিনী ঢাকার সঙ্গে বাংলাদেশের অবশিষ্ট অংশের রেল ও সড়ক পথের যোগাযোগ সম্পুর্ন রূপে বিছিন্ন করে দিয়েছে। সেনাবাহিনীর কঠোর নিয়ন্ত্রণের ফলেও ঢাকার সঙ্গে বিভিন্ন জেলার রেল যোগাযোগ প্রায় বন্ধ। বাংলাদেশের ভিতরে সন্ধ্যার পর থেকে সড়ক ও জল পথে সব রকম যানবাহন সম্পুর্ন রূপে বন্ধ হয়ে গেছে।

 

জানা গেছে পাক বাহিনী শহরে কঠোর নিরাপত্তা ব্যাবস্থা গ্রহণ করেছে। শহরের বাইরে যাবার সড়ক ও জলপথে ‘ফটক প্রথা’ প্রবরররতন করা হয়েছে। সশস্ত্র জঙ্গি প্রহরী মোতায়েন রাখা হয়েছে।

 

ট্যাংক ও ইলেক্ট্রিসিটির স্টেশন গুলিতে সেনাবাহিনী সদা সর্বদা প্রহরা দিচ্ছে। শহরে অসংখ্য নলকূপ বসানো হয়েছে।

ঢাকা টেলিভিশন সেন্টার ও রেডিও পাকিস্তান প্রাঙ্গলে কঠোর প্রহরার ব্যাবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

 

 

ফরিদপুরের থানা জ্বালিয়েছে

মুজিবনগর – ৯ সেপ্টেম্বর – মুক্তিবাহিনীর গেরিলা তৎপরতার ফলে ফরিদপুরের নারা থানাটি জ্বালিয়ে দিয়ে এখানে পশ্চিম পাকিস্তানী একজন পুলিশ অফসার, তিনজন কনস্টেবল ও ১৬ জন রাজাকারকে হত্যা করা হয়েছে। এবং অনেক অস্ত্রশস্ত্র দখল করা হয়েছে।

 

সিলেট রঙাগণের জয়ন্তিপুর থানার একজন পুলিশ অফিসার ও ২ জন কনস্টেবলকে গেরিলারা হত্যা করেছে।

রংপুর রণাঙ্গনে এইদিন হাতিবান্ধা, কালীঘাট ও চিল্মারিতে গেরিলা বাহিনী অতর্কিত আক্রমণ চালাইয়া বহু খান সেনা হত্যা করেছে।

 

এছাড়া চট্টগ্রাম ও ঢাকায় বর্তমানে মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে জঙ্গি শাহীর খানসেনাদের বন্দুক লড়াই জোর গতিতে এগিয়ে চলছে।

 

 

আদালতে টাইম বোমা বিস্ফোরণ

 

ঢালা, ১০ সেপ্টেম্বর (রয়টার) – গত কয়েকদিন আগে চট্টগ্রাম আদালতে একটি টাইম বোমা বিস্ফোরণ ঘটে। এতে ঘটনা স্থলেই ২ ব্যাকই নিহত ও ১৭ জন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে ৩ জনের অবস্থা গুরুতর থাকায় চট্টগ্রাম হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আদালত ভবনের দ্বিতলে বিস্ফোরণ ঘটে।

 

এখানে প্রকাশ, ভবনের নিচে এক কোনে একটি ছাতার নিচে টাইম বোমা টি লুকানো ছিল।

 

 

যশোরের শ্রীপুর থানা দখল

 

মুজিবনগর, ৯ সেপ্টেম্বর – গত সপ্তাহে অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা যশোর জেলার শ্রীপুর থানাটি সম্পুর্ন রূপে শত্রু কবল মুক্ত করেছে। মুক্তিবাহিনী ও জনতার তুমুল হর্ষ ধনীর মধ্যে সেখানে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়েছে। শ্রীপুরের এই অতর্কিত আক্রমণে পাক বাহিনীর খান সেনা সহ প্রায় ১২৫ জন রাজাকার হত্যা করা হয়েছে। এই আক্রমণের ফলে আমাদের মুক্তিবাহিনী ১৪ টি রাইফেল, ১ টি ব্রিটিশ রিভলবাড়, ১০ টি শিরস্ত্রাণ এবং বহু কার্তুজ দখল করেছে।

 

 

কর্নেল সরফরাজ নিহত

 

মুজিবনগর, ৮ সেপ্টেম্বর – মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের পেতে রাখা মাইন বিস্ফোরণের ফলে সম্প্রতি পাকিস্তানের পাঞ্জাব বাহিনীর সেনাদক্ষ ও সিলেটের পূর্বতন সামরিক আইন প্রশাসক কর্নেল সরফরাজ খা এক জীপ দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। বাঙ্গালী মুক্তিফৌজের মাইন বিস্ফোরণেই মাইন টি বিস্ফোরিত হয়। জীপটির অন্য দুইজন আরোহী জীপ থেকে লাফিয়ে পরে দৌড়াতে আরম্ভ করলে গেরিলাদের গুপ্ত আক্রমণের ফলে ঘটনা স্থলেই আরোহী অফসার দুইজনকে হত্যা করা হয়।

–       জন্মভূমি, ১৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

 

 

ঢাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপক তৎপরতা

হানাদার কসাই বাহিনী ভীত সন্ত্রস্ত

/নিজস্ব প্রতিনিধি/

 

ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে খানসেনাদের শিবির স্থাপন  করা হইয়াছে। কিছু যাহাদিগকে এই সব শিবিরে প্রেরণ করা হইতেছে তাহারা তাহাদের কর্মকর্তাদের উপর খুবই অসন্তস্ট হইয়া উঠিতেছে। কারণ তাহাদের ফেলিয়া বড় কর্তারা সকলে সূর্যাস্তের পূর্বেই কুর্মিটোলার সুরক্ষিত ছাউনিতে ঢুকিয়া পরে আর ইহাদিগকে ঢাকার বিভিন্ন ছাউনিতে ডিউটিতে নিযুক্ত করে। কুর্মিটোলার ছাউনি ছাড়িয়া ইহারা শহরের শিবিরে মোটেই নিরাপদ বোধ করেনা। কারণ সন্ধ্যার পর হইতেই শুরু হয় মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতা। মাইন ও বোমা বিস্ফোরণের শব্দে প্রতি রাত্রে ঢাকা শহর প্রকম্পিত হইয়া উঠে।

সম্প্রতি গ্রিন রোড ও সেগুণ বাগিচা সঙ্গীত কলেজে খান সেনাদের শিবিরে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে কয়েকজন খান সেনা খতম হওয়ার পড় হইতেই খানসেনারা কুর্মিটোলার বাহিরে শহরের শিবিরে থাকিতে আর সাহস পাইতেছেনা। নির্ভরযোগ্য সূত্র হইতে প্রাপ্ত খবরে যানা যায়, সম্প্রতি একদল হানাদার সেনা শহরের শিবিরে যাইতে অস্বীকার করিলে সামরিক কর্তৃপক্ষ ইহাদিগকে শাস্তি প্রদান করে।

 

 

 

সাবাস!

(বিশেষ প্রতিনিধি)

 

বাংলাদেশের ঘরে শর্বে আজ মুক্তিযোদ্ধা। পথে ঘাটে হোটেল রেস্তোরায় সর্বত্র ছড়াইয়া আছেন শেষ মুজিবের বিপ্লবী সেনারা। যখনই তাদের সামনে দস্যু সৈন্য খতম করার সুযোগ আসিয়া উপস্থিত হয় তখনি নির্মম নিয়তির মত মুক্তিযোদ্ধারা ঝাপাইয়া পড়েন দুশমনের উপর।

 

বাংলাদেশের দখলকৃত এলাকার রাজধানী ঢাকা হইতে প্রাপ্ত এক খবরে প্রকাশ, সম্প্রতি হানাদার বাহিনীর দুইজন কর্নেল ও একজন মেজর ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের ৯১০ নং কক্ষে অতিরিক্ত মদ্যপান করিয়া বেহুশ হইয়া পরিয়া থাকে। সেই সুযোগে মুজিবের অনুসারী জনৈক হোটেল বেয়ারা উক্ত কক্ষে ঢুকিয়া স্টেনগানের সাহায্যে গুলি করিয়া বর্বর খানসেনাদের উক্ত তিনজন অফিসারকেই খতম করিয়া তাহাদের মদ্যপানের তৃষ্ণা চিরতরে মিটাইয়া দেন।

–       বাংলার বানি, ১৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

 

 

ময়মনসিংহে পাক বিমান থেকে নাপাম বোমা বর্ষন

 

শিলং, ১৪ অক্টোবর (ইউ আন আই) – গত ১ ম্যাস ধরে ময়মন সিংহ জেলার কিশোরগঞ্জ ও টাঙ্গাইল এলাকায় পাক বিমান বাহিনী নিরীহ  বেসামরিক জনতার উপর নাপাম বোমা বর্ষন করছে। মুক্তিফৌজের গেরিলা বাহিনীর তৎপরতায় বেসামাল হয়ে পাক বাহিনী এই কাণ্ড  করেছে।

করিমগঞ্জ থেকে পি টি আই জানাচ্ছে, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যায় এই ভয়ে পাক সামরিক কর্তৃপক্ষ পাকিস্তানের অস্তিত্ব সংক্রান্ত কথাবার্তা বন্ধ করার জন্য ফৌজি বিধির ৮০ ধারা আবার নতুন করে চালু করেছেন।

 

–       যুগান্তর, ১৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

 

 

রণাঙ্গনে দখলকৃত অঞ্চলের সর্বত্র গেরিলা আক্রমণের প্রচণ্ডতা বৃদ্ধি

 

গত ৮ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম আদালত ভবনের দোতালার অপর মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যোদ্ধাদের একটি টাইম বোমা বিস্ফোরণ ঘটলে ২ ব্যাক্তি নিহত ও ১৭ জন গুরুতর আহত হয়। এদের মধ্যে ৩ জনের অবস্থা মরণাপন্ন।

 

একটি বিদেশী সংস্থা জানাচ্ছে যে, গেরিলা যোদ্ধারা উক্ত টাইম বোমা একটি ছাতার ভেতর লুকিয়ে রাখে।

 

এদিকে প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ, বাংলাদেশের গেরিলা বাহিনী গত ২ সপ্তাহে যশোর জেলার শ্রীপুর থানার বিস্তীর্ন এলাকা শত্রু কবল মুক্ত করেছে।

 

ফরিদপুর থানা আক্রমণ

 

গত ৫ সেপ্টেম্বর ফরিদপুর জেলার নাড়িয়া থানার উপর আক্রমণ চালিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা একজন পাকিস্তানী পুলিশ অফিসার সহ ৩ জন পুলিশ এবং ১৬ জন রাজাকারকে হত্যা করে।

 

 

ট্রেন ধ্বংস

 

ফেনীর কাছে মহুরিগঞ্জ গেরিলা যোদ্ধারা একটি ট্রেন উড়িয়ে দেয়। ফলে ট্রেনের ড্রাইভার সহ বহু সৈন্য খতম হয়।

অন্যদিকে ময়মন সিংহ অঞ্চলে গেরিলা কায়দায় মুক্তিবাহিনীরা হানাদার সৈন্যদের একেবারে নাজেহাল করে ছাড়ছে। টাঙাইলে গেরিলারা দুটি সৈন্য বোঝাই স্টিমার পুড়িয়ে দেন। এতে বেশ কিছু পাকসেনা খতম হয়েছে।

 

ঢাকায় পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে গেরিলা যোদ্ধাদের জোর সঙ্ঘর্ষ চলছে বলে খবর পাওয়া গিয়েছে।

 

গত ৭ সেপ্টেম্বর পশ্চিম পাকিস্তান স্টার পত্রিকার খবরে প্রকাশ, গেরিলা যোদ্ধারা গত ৩ সেপ্টেম্বর শেষ রাত্রে ঢাকা ও খুলনার মধ্যে চলাচলকারী একটি স্টিমার আক্রমণ করে ৫ জনকে গুরুতর আহত করে।

 

উক্ত খবরে প্রকাশ, শুক্রবার শেষ রাতে ঢাকার ৬৫ মাইল দূরে বরিশাল এলাকা দিয়ে যাবার সময় উক্ত স্টিমারের উপর গেরিলা যোদ্ধারা গুলি বর্ষন করে।

–       জয়বাংলা, ১৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

 

 

গত ১৫ দিনে সাতক্ষিরার সাড়ে ৬৩ মাইল মুক্ত

(স্টাফ রীপোর্টার)

 

কলকাতা, ১৬ সেপ্টেম্বর – গত ১৫ দিনে খুলনা জেলার সাতক্ষিরা মহকুমার সাড়ে ৬৩ বর্গ মাইল অঞ্চল থেকে মুক্তিবাহিনী খান সেনাদের হটিতে দিয়ে মুক্ত এলাকা স্থাপন করেছে। গতকাল টাকিতে এই তথ্য বিশ্বস্ত সূত্রে পাওয়া গেল। ওই একই সমকালের মধ্যে মুক্তিবাহিনী ১৯৭ টি এ পি মাইন ( যেগুলি পাক বাহিনী পুতে রেখেছিল) তুলে নিয়ে এসেছে, ৩ টন ওজনের ৪ টি পাক সামরিক গাড়ি ধ্বংস করেছে এবং ৩ টি সীমান্ত চৌকি দখল করেছে।

 

তাছাড়া আরও জানা গেছে, মুক্তিবাহিনীর হাতে ১৭ টি রাইফেল ও ২০০০ টি ৩০৩ বুলেট সহ ৩০ জন রাজাকার বন্দী হয়েছে। এই ঘটনার পড় থেকে ওই অঞ্চলের রাজাকাররা মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে মোটামুটি সহযোগিতা করছে।

–       কালান্তর, ১৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

 

রণাঙ্গনের খবর

(রণ-বার্তা পরিবেশক)

 

বাংলাদেশের বিভিন্ন রণাঙ্গনে দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধাদের অপ্রতিহত অগ্রযাত্রা অব্যাহত রয়েছে। মুক্তিবাহিনীর মেশিন গান আর মর্টারে গোলার অব্যার্থ আঘাতে খান সেনাদের প্রাণহীন দেহ মাটিতে লুটাইয়া পড়িতেছে। স্থল ও জলপথে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মোকাবিলায় ব্যার্থ হইয়া হানাদার সেনারা দখলীকৃত এলাকার বিভিন্ন স্থানে বিমান আক্রমণ শুরু করিয়াছে বলিয়া খবর পাওয়া যাইতেছে।

 

বীর মুক্তিবাহিনী বিভিন্ন রণাঙ্গনে হানাদার সেনাদের ব্যাতিব্যাস্থ রাখা ছাড়াও ইহাদের নানা ভাবে হয়রানি করিয়া চলিয়াছেন।

 

অপরদিকে হানাদারদের সাহায্যকারী রাজাকার বাহিনীও মুক্তিবাহিনীর অগ্রযাত্রার মুখে সাবাড় হইয়া যাইতেছে। বিভিন্ন রণাঙ্গন হইতে প্রাপ্ত খবরে যানা যায়, খান সেনাদের রাজাকার বাহিনী দলে দলে অস্ত্র শস্ত্র সহ মুক্তিবাহিনীর নিকট আত্ম সমর্পন করিতেছে।

 

খুলনা- যশোর- কুষ্টিয়া রণাঙ্গনে খুলনা জেলার হরি নগরে মুক্তিবাহিনীরা গত ১৩ সেপ্টেম্বর হানাদার সেনাবাহিনীর ৪ তো লঞ্চ ও বরিশাল জেলার বানারিপাড়ায় ৩ টি লঞ্চ ডুবাইয়া দেন। বানারিপাড়ায় মুক্তিবাহিনীর অতর্কিত আক্রমণে লঞ্চ নিমজ্জিত হওয়ার ফলে প্রায় ৪০ জন দস্যু সেনার সলিল সমাধি ঘটে। হরিনগর এলাকায় পাকসেনাদের গানবোটের চালক ও মুক্তিবাহিনীর হাতে খতম হয়।

 

গত কয়েক দিনে কুষ্টিয়া জেলার প্রায় ২২ জন রাজাকার অস্ত্র সহ মুক্তিবাহিনীর নিকট আত্ম সমর্পন করে। ইহাদের মধ্যে কোন একটি ইউনিয়ন শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান রহিয়াছে। ১২ সেপ্টেম্বর মুক্তিবাহিনীরা কুমিল্লা জেলার গুথুমা নদীতে টহল রত খানসেনাদের উপর অতর্কিত মর্টার আক্রমণ চালাইয়া ৪ জনকে হতাহত করে। গত ১৩ সেপ্টেম্বর মুক্তিবাহিনীরা নোয়াখালী জেলার লক্ষ্মীপুর এলাকায় হানাদার সেনাদের উপর মর্টার যোগে গোলাবর্ষন করিয়া ৪ জনকে হত্যা করে। তাহার লক্ষ্মীপুরে খান সেনাদের ৪ টি বাঙ্কার ও ধ্বংস করিয়া দেন।

 

ফেনী এলাকায় তাহারা সম্প্রতি ৫৮ জন খানসেনাকে খতম করেন।

 

ঢাকা কুমিল্লা চট্টগ্রাম রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা তৎপরতা সেনাদের দিশেহারা করিয়া তুলিয়াছে।

 

১২ সেপ্টেম্বর তাহারা কুমিল্লা জেলার মান্দাবাগ এলাকায় হানাদার খানসেনাদের উপর অতর্কিত ঝাপাইয়া পড়িয়া কমপক্ষে ১৫ জন খানসেনা নিহত করেন। প্রাপ্ত খবরে জানা যায়, খানসেনারা মান্দাবাগ এলাকায় নৌকা যোগে টহল দিয়ে বেড়াইতেছিল। খানসেনাদের নৌকা দুটি নিমজ্জিত করা হয় । ১১ সেপ্টেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা আখাউরার নিকটে খানসেনাদের ট্রেন আক্রমণ করিয়া ট্রেন টি বিধ্বস্ত করে। ট্রেনের আরোহী পাক সামরিক অফিসার, ইঞ্জিন ড্রাইভার ও বহু সংখ্যক রাজাকার খতম হয়।

 

১১ সেপ্টেম্বর সাতাপারার উত্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের পুঁতিয়া রাখা মাইন বিস্ফোরণে হানাদার সেনাদের একটি জীপ চূর্ন বিচূর্ন হইয়া যায়। জীপের ৪ জন আরোহী খানসেনা আর সূর্যালোক দেখিবার সুযোগ পায় নাই। মুক্তিযোদ্ধারা লাকসাম কুমিল্লার মধ্যে একটি গুরুত্তপূর্ণ রেল সেতু ধ্বংস করিয়া দেন।

 

ময়মন সিংহ সিলেট রণাঙ্গনে হানাদার খানসেনাদের সহিত মুক্তিযোদ্ধাদের তুমুল যুদ্ধ চলিতেছে। ময়মন সিংহ জেলার কামড়াইল জেলায় মুক্তিযোদ্ধারা গত ১৪ সেপ্টেম্বর পাক হানাদার সেনাদের অবস্থানের উপর আক্রমণ করিয়া ২ জনকে হত্যা করেন। ১৫ সেপ্টেম্বর বাগুরামারি এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের পুঁতিয়া রাখা মাইন বিস্ফোরণে কয়েকজন পাকসেনা আহত হয়।

 

সম্প্রতি মুক্তিযোদ্ধারা ময়মন সিংহ জেলার বাউমি স্টেশন এলাকায় ভয়াবহ গেরিলা আক্রমণ চালান। তাহারা জামালপুর জগন্নাথ ঘাটের মধ্যে রেল লাইন ধ্বংস করিয়া রেল যোগাযোগ সম্পূর্ন রূপে বিপর্যস্ত করিয়া দেন।

রংপুর- দিনাজপুর- রাজশাহী রণাঙ্গনের দিনাজপুর জেলার পচা পগর, দেবীগঞ্জ , ঠাকুরগাঁও এলাকায় হানাদার বাহিনীর সহিত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড লড়াই চলিতেছে। জানা যায় গত কয়েকদিনে মুক্তিযোদ্ধারা দিনাজপুর জেলার টৌকাপারা , ডানাকাটা, তেতুলিয়া, ঠাকুরগাঁও এলাকায় ১০ জনেরও বেশী খানসেনা খতম করেন।

 

ঠাকুরগাঁও অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধারা হানাদার খান সেনা সাফ করিয়া দিয়া বিস্তীর্ন এলাকা মুক্ত করেন। এখানে তাহারা ১৫ জন রাজাকার গ্রেফতার করেন।

 

বহু সংখ্যক খানসেনা এবং ইহাদের সাহায্যকারী রাজাকার খতম করেন। তাহার পার্বতিপুর , শান্তাহারের মধ্যে রেল যোগাযোগ সম্পূর্ন বিচ্ছিন্ন করিয়া দিয়াছেন। ১৫ সেপ্টেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা শীতল ডাঙ্গায় পাকসেনাদের সহিত প্রচণ্ড সঙ্ঘর্ষে লিপক হইয়া ৪ জন পাকসেনা খতম ও ২ জন আহত করেন। একই দিনে তাহারা ঘুঘু ডাঙ্গা এলাকায় ৮ জন পাকসেনা খতম করেন।

 

১৪ সেপ্টেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা পাগলা, দেওয়ান হাট এলাকায় ৬ জন খানসেনা খতম করেন। কারিয়া এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের

ব্যাপক পুঁতিয়া রাখা মাইন বিস্ফোরণে ৪ জন খানসেনা ও ৮জন রাজাকার খতম হয়।

 

ইহা ছাড়া মুক্তিযোদ্ধারা ঠাকুর গাও সেতাবগঞ্জে তাঁর যোগাযোগ ব্যাবস্থা সম্পূর্ন রূপে ধ্বংস করিয়া দিয়াছেন। এই অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপক তৎপরতা বৃদ্ধি পাওয়ায় খানসেনারা নদীপথেও চলাচল করিতে সাহস পায়না।

 

গত ১৭ সেপ্টেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা রাজশাহী নাটোরের মধ্যে ২ টি বর্ব মাইন চার্জ করিয়া একটি মাল বাহি ট্রেনের ১২ টি ওয়াগন লাইন চ্যুত করিয়া দেন। মালবাহী ট্রেন ওয়াগনের খানসেনারাও ছিল। ইহাদের মধ্যে প্রায় ৫০ জন খতম ও ৩০ জনা আহত হয়।

 

বাংলাদেশের বিভিন্ন রণাঙ্গনে খানসেনাদের সহিত মুক্তিযোদ্ধাদের তুমুল লড়াই চলিতেছে বলিয়া সর্বশেষ প্রাপ্ত খবরে জানা গিয়াছে।

 

বিলম্বে প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ, মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকা শহর ও উহার আঁশে পাশে গেরিলা তৎপরতা জোরদার করিয়াছেন। গত মাসের শেষ সপ্তাহে হানাদার পাকিস্তানী সেনারা ঢাকার ইস্কাটন এলাকার একটি বাড়িতে আকস্মিক হানা দেয় এবং গৃহ কর্তাকে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্ধান দিতে আদেশ দেয়। এমন হময় কয়েকজন দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা ঘটনা স্থলে আসিয়া উপস্থিত হন। তাহারা সকলকে বিস্মিত করিয়া দিয়া হানাদার খান সেনাদের উপর ঝাপাইয়া পড়িয়া তাহাদের নিকট হইতে স্টেনগান ছিনিয়া নেন। এই ঘটনায় ৪ জন পাকসেনা খতম হয়। অতঃপর   মুক্তিযোদ্ধারা ঘটনা স্থল ত্যাগ করেন। প্রকাশ, সম্প্রতি হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল আক্রমণর সহিত জড়িত মুক্তিযোদ্ধাদের অনুসন্ধানে খান সেনারা ইস্কাটনের এই বাড়িটিতে হানা দেয়।

 

চলটি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বাসাবো এলাকায় খানসেনাদের একটি ক্যাম্পে দুঃসাহসিক মুক্তিযোদ্ধারা প্রকাশ্য দিবালোকে আক্রমণ চালাইয়া খানসেনা ও পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ সহ ১৪ জন শত্রু খতম করেন। প্রকাশ, ঘটনার দিন খানসেনারা যখ দুপুরের ভোজনে লিপ্ত , তখন দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাম্পের জানালা দিয়া মেশিন গানের সাহায্যে গোলাবর্ষন করেন। মাত্র সপ্তাহের ব্যাবধানে খানসেনাদের সুরক্ষিত সদর দপ্তর ঢাকা নগরীতে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ১৮ জন শত্রুসেনা নিহত হওয়ায় ইসলামাবাদের ঢাকাস্থ অসুর পুরিতে মহা আতংকের সঞ্চার হইয়াছে। স্মরণ থাকিতে পারে যে, আগস্ট মাসের প্রথম দিকে সেগুণ বাগিচাস্থ মিউজিক কলেজে খান সেনাদের ক্যাম্পে অতর্কিত আক্রমণ চালাইয়া ৬ জন হানাদার সৈন্য খতম করেন।

 

চলটি মাসের প্রথম সপ্তাহে মুক্তিযোদ্ধারা নরসিংদীর নিকট পাট বোঝাই একটি কার্গো বার্জ ডুবাইয়া দেন। ৮ সেপ্টেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা ময়মন সিংহ জেলার মোহনগঞ্জ এলাকায় নদীপথে পাকসেনাদের উপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালান। প্রচুর অস্ত্র বোঝাই ৩ টি নৌকা ফেলিয়া কাপুরুষ পাকসেনারা পলায়ন করে। মুক্তিযোদ্ধারা এই সকল অস্ত্র ও নৌকা দখল করে। ৫ সেপ্টেম্বর সিলেট ময়মনসিংহ সীমান্তে ধর্ম পাশা এলাকায় খানসেনা বাহিন কয়েকটি নৌকার উপর আকস্মিক আক্রমণ চালাইয়া প্রায় ৬২ জন খানসেনা নিহত হয়। এহাদের মধ্যে ১ জন মেজর ও রহিয়াছে।

 

সর্বশেষ খবরে জানা যায়, গত ৫ দিনে কুমিল্লা, নোয়াখালী ও কুষ্টিয়ায় প্রায় ৪০০ জন হানাদার দস্যু খতম হয়েছে।

সেপ্টেম্বর ১৪ তারিখে একমাত্র কুষ্টিয়া শহরের  মুক্তিযোদ্ধারা খতম করিয়াছেন ১৩০ জন হানাদার দুশমন কে । ইহার পড় হানাদারদের সাহায্যার্থে নতুন পাকিস্তানী সৈন্য আসিলে মুক্তিযোদ্ধারা তাহাদের উপর প্রচণ্ড ভাবে আক্রমণ চালান। প্রচুর ক্ষয় ক্ষতি শিকার করিয়া শত্রু সৈন্যরা পশ্চাদ পসারণ করিতে বাধ্য হয়। অতঃপর পাকিস্তানী বিমান বাহিনী তাহাদের সাহায্যে আগাইয়া আসিয়া নির্বিচারে বোমা বর্ষন করে।

 

মুক্তিবাহিনীর দুর্ধর্ষ গেরিলা যোদ্ধারা গত আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহ হইতে ঢাকা শহর ও শহর তলি এলাকায় ব্যাপক গেরিলা আক্রমণ চালাইয়া যাইতেছেন। বাসাবো এলাকার একটি পাকিস্তানী ঘাঁটির উপর গেরিলারা অতর্কিত আক্রমণ চালান এই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে। ইস্কাটন এলাকায় গেরিলারা এই সময়ে আরেকটি আক্রমণ চালান। এই ২ টি আক্রমণে প্রায় ২০ জন পাকসেনা নিহত হয়।

 

ইহা ছাড়া গেরিলারা চট্টগ্রামে একটি পাকিস্তানী মালবাহী বার্জ ডুবাইয়া দেন এবং বার্জের চালক কে বন্দী করেন।

মুক্তিযোদ্ধারা কুমিল্লাম নোয়াখালী, যশোর, খুলনা, ময়মনসিংহ ও সিলেট অঞ্চলে ব্যাপক আক্রমণ চালাইয়া শত্রু সৈন্যদের নাজেহাল করেন।

–       বাংলার বানি, ২১ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

 

 

রণাঙ্গনে

মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে সিলেটে ২ টি শত্রু সৈন্য বাহি লঞ্চ নিমজ্জিত

৪০০ খানসেনা নিহত

 

আমাদের যোদ্ধারা গত সপ্তাহে সবচেয়ে বেশী সাফল্য অর্জন করেন সুনামগঞ্জ অঞ্চলে। ছাতক ও সুনামগঞ্জের মধ্য বর্তি একটি এলাকায় গেরিলা যোদ্ধারা শত্রু সৈন্য বাহি ৪ টি লঞ্চের একটি কনভয়ের উপর প্রচণ্ড চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে ২ টি লঞ্চ ডুবিয়ে দিয়েছে। এই আক্রমণে কমপক্ষে ৪০০ সৈন্য নিহত হয়েছে। এছাড়া কয়েকদিন আগে তারা ছাতকের উত্তর দিকে শত্রু ব্যবস্থানের উপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালান। এই আক্রমণে শত্রু পক্ষের হতাহতের সংখ্যা নির্নয় না করা গেলেও রেড ক্রসের গাড়িতে করে খানসেনাদের লাশ সরাতে দেখা যায়। নিল্পর গ্রামের নিকট মুক্তিযোদ্ধাদের পোঁতা মাইনে অস্ত্র বোঝাই একটি পাক সামরিক যান বিধ্বস্ত হয়।

 

জলিল্পুরে মুক্তিবাহিনী ও পাক ফৌজের সাথে গুলি বিনিময়ের ফলে ৬ জন খানসেনা নিহত ও ৭ জন আহত হয়।

 

 

খুলনায় ২ জন পাকসেনা খতম

 

গত ১৩ সেপ্টেম্বর খুলনা জেলার হরি নগরে গেরিলা যোদ্ধারা একটি পাকিস্তানী গানবোটের উপর হাট বোমা নিক্ষেপ করে ২ জন পাকসেনা হত্যা করে। গানবোট টি পানিতে ডুবে যায়।

 

 

বানারিপাড়ায় ২৮ জন পাকসেনা নিহত

 

বিলম্বে প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ, বরিশাল জেলার বানারিপারা থানায় এক সঙ্ঘর্ষে মুক্তিযোদ্ধারা গত ৯ সেপ্টেম্বর ২৮ জন পাকসেনা ও রাজাকারকে হত্যা করেন।

 

প্রকাশ বাংলাদেশের গেরিলা যোদ্ধারা থানা সংলগ্ন একটি পুকুর সাঁতার কেটে পার হয়ে বোমা ও আগ্নেয়াস্ত্র সহ শত্রু সৈন্যদের আক্রমণ করেন। এবং ট্রেঞ্চ ও প্রাচীর ধ্বংস করে তাদের হত্যা করেন।

 

 

দিনাজপুরে ৪২ জন শত্রু সৈন্য ও রাজাকার খতম

 

গত ১৫ সেপ্টেম্বর রাতে দিনাজপুরের বুরিমারি গ্রামে মুক্তিযোদ্ধারা একজন ক্যাপ্টেন সহ ১৩ জন হানাদার সেনাকে খতম করে। ওই রাতেই মুক্তিযোদ্ধারা আরেকটি সফল অভিযান চালিয়ে হেম কুমারীতে ৯ জন রাজাকার কে হত্যা করে।

গত ১৭ সেপ্টেম্বর জলপাইগুড়ি জেলার চাউল হাতী সীমান্তের নিকট দিনাজপুরের পচাগর, দেবীগঞ্জ ও ঠাকুরগাঁও খণ্ডে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাকফৌজের প্রচণ্ড সঙ্ঘর্ষ হয়। কিছুদিন আগে অত্র এলাকায় মুক্তিবাহিনী কমপক্ষে ২০ জন পাকসেনা খতম করে।

 

স্বাধীনতা কামীরা পার্বতিপুর ও শান্তাহারের মধ্যে টেলি যোগাযোগ নষ্ট করে দিয়েছে।

 

 

রংপুরে ১২ জন খতম

 

গত ১৩ সেপ্টেম্বর রংপুরের ডিম্লা এলাকায় গেরিলা যোদ্ধারা মাইন দিয়ে একটি ট্রাক উড়িয়ে দেয়। ফলে ১২ জন হানাদার সৈন্য নিসচিনহ হয়। গেরিলা যোদ্ধারা আলিনগর এলাকায় কয়েকজন তাবেদারের বাড়ি আক্রমণ করে বহু অস্ত্র উদ্ধার করেছেন।

 

মুক্তিযোদ্ধারা চিল মারিতে একটি পাক টহলদার দলের উপর হামলা করলে কয়েকজন দস্যু সৈন্য হতাহত হয়।

 

গেরিলা যোদ্ধারা ১৩ ও ১৪ সেপ্টেম্বর রানি সংকের ও ভুরুংমারি অঞ্চলে কয়েকজন সামরিক ও তাবেদার বেসামরিক সশস্ত্র লোক কে হতাহত করেন।

 

 

রাজশাহীতে ৮০ জন খানসেনা হতাহত

 

স্বাধীনতাকামীরা গত ১৭ সেপ্টেম্বর ভরে রাজশাহী ও নাটোরের মধ্যে দুটি বর্ব মাইন চার্জ করে একটি মালবাহী ট্রেনের ১২ তো ওয়াগন লাইন চ্যুত করে। ফলে প্রায় ৫০ জন পাকিস্তানী সৈন্য নিহত ও আরও ৩০ জন আহত হয়।

 

 

চট্টগ্রামে টাগবোট ক্ষতিগ্রস্ত

 

চট্টগ্রামে গেরিলা যোদ্ধারা ১১ সেপ্টেম্বর শত্রুবাহিনীর একটি টাগ বট আক্রমণ করেন। তারা বোটের পাইলট কে অপহরণ করে নিয়ে যান। বোটটি ভীষণ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

 

 

নোয়াখালীতে ৮৪ জন শত্রু সৈন্য নিহত

 

গত ১৩ সেপ্টেম্বর আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা নোয়াখালীর একটি এলাকায় শত্রু অবস্থানের উপর এক অতর্কিত অভিযান চালিয়ে কমপক্ষে ১০৯ জন কে খতম ও ১৬ জন কে গুরুতর রূপে আহত করেছেন।

সম্প্রতি ফেনীতে ৬ ঘণ্টা ব্যাপী শঙ্ঘর্ষে একজন মেজর সহ ৫৮ জন পাকসেনা মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে খতম হয়েছে।

 

 

কুমিল্লা সেক্টরে ৭২ জন পাকসেনা নিহত

 

গত ১৩ ও ১৪ সেপ্টেম্বর বিভিন্ন এলাকায় মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যোদ্ধারা সফল আক্রমণ চালিয়ে ৬০ জন পাকসেনা নিহত ও ২৪ জনকে গুরুতর আহত করে। কুমিল্লার সালদার,  কায়েম্পুর, লক্ষ্মীপুর, মির্জানগর, রঘুরাম পুর ও জগন্নাথ দিঘিতে শত্রু সেনার উপর উপরোক্ত ক্ষয় ক্ষতি হয়।

 

গত ১২ সেপ্টেম্বর আখাউরার উত্তর পূর্ব মুকুন্দপুরে মুক্তিবাহিনী শত্রু সেনাবাহি একটি ট্রেন আক্রমণ করে বিধ্বস্ত করে দিয়েছেন। এতে ট্রেনের যাত্রী, একজন পাকিস্তানী সামরিক অফিসার, ইঞ্জিন ড্রাইভার ও ১ ডজনের উপর রাজাকার নিহত হয়েছে।

 

চলতিমাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের গোঁড়ার দিকে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে হানাদার সেনাদের কয়েকটি বিচ্ছিন্ন সঙ্ঘর্ষে রাজাকার সহ প্রায় দুশ পাকিস্তানী সৈন্য খতম হয়েছে।

 

মুক্তিযোদ্ধারা কুমিল্লা অঞ্চলে শত্রুপক্ষের ৫ টি গুরুত্তপুর্ন বাঙ্কার উড়িয়ে দেন ও প্রচুর পরিমাণ অস্ত্র ও গুলি উদ্ধার করেন। মুক্তিযোদ্ধারা গ্রাম অঞ্চলে সৈন্য বাহিনীর সরবরাহ লাইনটি সাফল্যের সাথে বানচাল করে দিয়েছেন

 

 

 

রাজাকারেরা দলে দলে ধরা দিচ্ছে

 

হানাদার খানসেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপক তৎপরতা প্রতিহত করার জন্য লুট পাটের লোভ দেখিয়ে মাত্র ২ সপ্তাহের ট্রেনিং দিয়ে যে রাজাকার দল গঠন করেছিল তারা এখন প্রতিদিন দলবদ্ধভাবে আমাদের মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্ম সমর্পন করছে।

 

গত ১৬ সেপ্টেম্বর কুষ্টিয়ায় বাবলা চরা ইউনিয়ন শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান তার অধীনে ২২ জন রাজাকারকে সঙ্গে নিয়ে মুক্তিবাহিনীর হাতে আত্ম সমর্পন করেছে। সেই সঙ্গে উক্ত দলটি তাদের কাছে রক্ষিত সমস্ত রসদ দহ রাইফেল, হাল্কা মেশিন গান, শটগান, স্টেনগান প্রভৃতি বিপুল অস্ত্র মুক্তবাহিনির হাতে তুলে দেয়।

 

এধরনের বেশ কয়েকটি রাজাকার দল মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে ধরা দিয়েছে। একমাত্র খুলনা জেলাতেই এই ধরনের দলত্যাগির সংখ্যা ৬০। তারা তাদের সব অস্ত্র সহ মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্ম সমর্পন করেছে।

–       জয় বাংলা, ২৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

 

 

রণাঙ্গন থেকে

 

মুক্তিযোদ্ধাদের সদর দপ্তর থেকে প্রচারিত বুলেটিনে প্রকাশ, গত ২ সপ্তাহে বাংলাদেশের বিভিন্ন রণাঙ্গনে কয়েক শত হানাদার সৈন্য খতম হয়েছে। বিশেষত সিলেট, ময়মন সিংহ, ঢাকা, নোয়াখালী ও চট্টগ্রামে গেরিলাদের অবিরাম তৎপরতায় হানাদারদের নাভিশ্বাস উঠিয়াছে।

 

গত সপ্তাহে মুক্তিযোদ্ধাদের মাইনের সাহায্যে বুরিচং এর কাছে ৩০ জন শত্রু সৈন্য নিহত হয়।

 

চট্টগ্রামে মুক্তিবাহিনী গত ২৭ সেপ্টেম্বর রাঙ্গামাটি থানা ও জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র আক্রমণ করে ও থানার অস্ত্রশস্ত্র দখল করে।

সিলেট রণাঙ্গনে গত সপ্তাহে মুক্তিবাহিনী সুরমা নদীতে শত্রুপক্ষের ২ টি স্পিড বোট ধ্বংস করে। মুক্তিযোদ্ধারা মাইনের সাহায্যে সিলেট শহরে একটি পাওয়ার সাব স্টেশন উড়াইয়া দেয় ও কয়েকটি সামরিক গাড়ি ধ্বংস করে। রাধানগর, জয়ন্তিয়াপুর, জাফ্লং , নুমাঘজ ও সুরমা নদীপথে কয়েকটি তৎপরতায় গেরিলারা কমপক্ষে ৪০ জন পাকসেনা ও রাজাকারকে হত্যা করে।

 

গত সপ্তাহে ময়মন সিংহ জেলার বিরিশিরি, বিজয়পুর, বন্দর কাটা ও শেরপুর এলাকায় ৯ জন শত্রু সৈন্য খতম হয়।

মুক্তিবাহিনী এই জেলায় ব্রহ্মপুত্রের পুর্ব পারে রাহুমারি ও মিড় গঞ্জ এলাকায় নিজেদের দৃঢ় কর্তৃত্ব স্থাপন করিয়াছে।

 

গত ২ সপ্তাহে বিভিন্ন অভিযানে মুক্তিবাহিনী নোয়াখালীর ছাগল নাইয়ায় ৫ জন, মনোহরপুর, আজমপুর ও জাম্বারিতে ২০ জন , কোটেশ্বর ৩ জন ও ছদিয়া গ্রামে ১২ জন সহ বহু শত্রু সৈন্য খতম ও আহত করেছে।

 

গত ২৮ সেপ্টেম্বর কুমিল্লার কষবার কাছে কাউয়ুম্পুরে শত্রু ঘাঁটির উপর মর্টার দাঁড়া আক্রমণ চালাইয়া মুক্তিযোদ্ধারা ৩৫ জন শত্রু সৈন্যকে খতম ও ১৫ জনকে আহত করে। কিছু অস্ত্রপাতি দখল করে। এই সংঘর্ষে মাত্র ১ জন গেরিলা আহত হন।

 

 

 

সাবাস!

 

ঢাকা শহরের বুকের উপর প্রকাশ্য দিবালোকে শত্রু হনন চলিতেছে। গত ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা শহরের বাসাবো এলাকায় শত্রুদের একটি চেক পোস্টে ১১ জন পাঞ্জাবি পুলিস ও কয়েকজন রাজাকারকে হত্যা করিয়া মুক্তিযোদ্ধাদের একদল তরুণ যোদ্ধা চমকপ্রদ গেরিলা কৌশলের নজির স্থাপন করিয়াছে।

 

ঢাকা শহরে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেবেশ ও গেরিলা আক্রমণ ঠেকাইবার জন্য পাকসেনারা শহরের বিভিন্ন স্থানে অনেক গুলি ক্যাম্প ও চেক পোস্ট বাসিয়াছে। বাসাবো এলাকায় এইরূপ একটি ক্যাম্পে একদল পাঞ্জাবি পুলিশ ও রাজাকার পাহারায় ছিল। গেরিলাদের কয়েকজন সাধারণ বেশে ‘ ভালো মানুষের মত’ প্রতিদিন ইহাদের সাথে আলাপ করিতে করিতে ভাব জমাইয়া ফেলে।

 

ঘটনার দিন ওইরূপ ৫ জন আলাপী গেরিলা বেলা ২ তায় পুলিশ ও রাজাকারদের সহিত দিপ্রহরিক বিশ্রাম আলাপ জুড়িয়া দেয়। এবং সুযোগ বুঝিয়া হঠাত এক সময় শত্রুদের অস্ত্র কারিয়া লইয়া গুলি চালাইতে শুরু করে। আশেপাশে লুকাইয়া থাকা গেরিলারাও শত্রুর উপর ঝাপাইয়া পরে। এই সঙ্ঘর্ষে ১১ জন পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিস ও কয়েকজন রাজাকার খতম হয় ও বাকিরা ক্যাম্প ছাড়িয়া চম্পট দেয়।

–       মুক্তিযুদ্ধ, ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

 

 

ঢাকায় বোমা বিস্ফোরণ ইয়াহিয়ার নুরুল হুদা খতম

(নিজস্ব সংবাদ দাতা)

 

ঢাকা, ২৫ সেপ্টেম্বর – বাঙ্গাদেশ মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে জঙ্গি শাহীর সমর্থক ও দালাল মুসলিম লিগ নেতা নুরুল হুদা খতম হয়েছে। সে বাংলাদেশ আইন সভার প্রাক্তন মুসলিম লিগ সদস্য। তার নিজ গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের মেশিন গানের গুলিতে এই শান্তি কমিটির বড় দালাল ‘এন্তেকাল ফরমাইয়াছে’।

 

ইয়াহিয়ার নব নিযুক্ত দালাল স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন মন্ত্রী মৌলানা মুহাম্মদ ইসহাক আজ ঢাকায় নিজ মোটরে একটি টাইম বোমা বিস্ফোরণে গুরুতর ভাবে আহত হয়েছে।

 

একটি সভা থেকে ফেরবার পথে সি ঘটনা ঘটে বলে জানা যায়। আহত অবস্থায় মোটরের চালক ও ইসহাক কে ঢাকা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

–       সাপ্তাহিক বাংলা, ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

 

 

মুক্তিবাহিনীর সাফল্য অব্যাহত

 

২৫ সেপ্টেম্বর মুক্তিবাহিনী গত কয় দিনে পাক হানাদার দের উপর কতগুলো উল্লেখযোগ্য আক্রমণ পরিচালনা করে।

 

রংপুর, দিনাজউর ও রাজশাহী সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের গেরিলা আক্রমণ আরও তীব্র করে। রংপুর ক্যান্টনমেন্ট ও রেল ওয়ে স্টেশনে প্রবল আক্রমণ চালিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীকে ব্যাতিব্যাস্ত করে তুলেছেন। গত ১৬ সেপ্টেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল রংপুরের একটি দোকানে গ্রেনেড ছুড়ে মারে। ওই দোকানের মালিক পাকবাহিনীকে তাদের বর্বর হামলার সব সময়ই মদদ যোগাত। মুক্তিযোদ্ধারা ওই দোকানের প্রচুর ক্ষতি সাধন করে ও বহু রাজাকারকে হত্যা করে।

গত ১৯ সেপ্টেম্বর রাজশাহী জেলার চক্রমারি এলাকায় পাকসেনা ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে প্রচুর গুলি বিনিময় হয়। ৫ জন পাকসেনা নিহত হয়।

 

ওই একই দিনে বাওল্লি এলাকায় পাক হানাদারদের সঙ্গে অন্য এক সংঘর্ষে মুক্তিযোদ্ধারা আরও ৬ জন পাকসেনা নিহত করে।

 

১৮ সেপ্টেম্বর শত্রু কবলিত ফারসি পারা এলাকায় গুলি বিনিময়ের সময় আরও ৬ জন পাকসেনা নিহত হয়। ওই একই দিনে লাহিড়ী এলাকায় শত্রু সেনাদের উপর সাড়াশি আক্রমণ চালানো হয়।  ওই আক্রমণে আরও দুজন পাকসেনা নিহত হয়। ১৯ সেপ্টেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা দিবর এলাকায় শত্রুদের ঘিরে ফেলে ও বিপুল সংখ্যক পাকসেনা খতম করে। খাঁদ খাই এলাকায় ও মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের উপর প্রবল আক্রমণ চালায়। এতে ৩ জন শত্রুসেনা আহত হয় বলে জানা যায়।

১৯ সেপ্টেম্বর রংপুর জেলার নাগেশ্বরী ও ভোতিমারি এলাকায় বেশ কয়েকটি সফল আক্রমণ চালিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা রেল পথ, সেতু ও কাল্ভার্ট উড়িয়ে দিয়ে ওই এলাকায় রেল যোগাযোগ সুম্পুর্ন রূপে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছেন।

 

তাছাড়া মুক্তিযোদ্ধারা রংপুর জেলার ভুরুংগমারি, মহেন্দ্রনগর, নাগেশ্বরী ও লালমনিরহাট এলাকায় ব্যাপক গেরিলা তৎপরতা চালিয়েছেন।

 

ঢাকা, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম সেক্টর থেকে যুদ্ধের যে খবর পাওয়া গেছে তাতে জানা যায়, গত ১৩ সেপ্টেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা কুমিল্লার আরিয়া বাড়িতে ২ জন পাকসেনা হত্যা করে। পরদিন ১৪ সেপ্টেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা কসবায় শত্রু সৈন্যের অবস্থানের উপর প্রবল গোলাবর্ষন করে আরও ২ জন পাকসেনা খতম করে। ১৬ সেপ্টেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা পাঞ্চাড়ায় দুজন হানাদার সৈন্যকে হত্যা করে।

 

১৭ সেপ্টেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা বেশ কোটি আক্রমণ পরিচালনা করে। লহইমারি ও যদিসার এলাকায় সঙ্ঘর্ষে মুক্তিযোদ্ধারা ৩ জন পাকসেনা খতম করে। তাছাড়া ওই একই দিনে মুক্তিযোদ্ধারা কুমিল্লার মোটেসশর, হাস মঙ্গল ও চলন এলাকায় পাক বাহিনীর অবস্থানকে সম্পুর্ন ঘিরে ফেলে প্রচুত গোলা বর্ষন করে। এতে ৬ জন শত্রু সৈন্য নিহত হয় বলে জানা যায়।

 

ময়মন সিংহ সেক্টরে মুক্তিবাহিনী গত ১৫ সেপ্টেম্বর সিলেটের শ্রীমঙ্গলে একটি পাকিস্তানী সামরিক জীপ উড়িয়ে দেয়। মাইন বিস্ফোরণের দরুন জীপটি সম্পূর্ন ধ্বংস হয়ে যায়। গত ১৭ সেপ্টেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা নোওকুচি এলাকায় মাইন পুতে রাখলে সেটি বিস্ফোরণের ফলে ১ জন পাকসেনা নিহত ও ১ জন আহত হয়। ২০ সেপ্টেম্বর সিলেটের ছড়ি পাড়া এবং বেয়ইগাও এলাকায় অসম সাহসী আক্রমণ চালিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ২০ জন শত্রুকে খতম করে।

 

নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে পাওয়া এক খবরে জানাযায় যে, মুক্তিযোদ্ধারা গত ২০ সেপ্টেম্বর যশোরের কামদেবপুর এলাকায় ১ জন পাকসেনা খতম করে। তাছাড়া ২০ সেপ্টেম্বর মানিকনগর এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা আরও ২ জন পাকসেনা খতম করে।

–       দাবানল, ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

 

 

রণাঙ্গনের খবর

(রনবার্তা পরিবেশক)

 

বাংলাদেশের অগ্নিসন্তান মুক্তিযোদ্ধারা হানাদার ইসলাম বাদী জানোয়ার বাহিনীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন রণাঙ্গনে প্রচণ্ড আঘাত হেনে চলেছে। গত শনিবার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাফল্যজনক ৬ মাস অতিক্রান্ত হয়।

 

এদিকে বিভিন্ন রণাঙ্গন থেকে প্রাপ্ত খবরে জানা যায় যে, গত ১ সপ্তাহে মুক্তিযোদ্ধারা ৫ শতাধিক হানাদার সৈন্য খতম করেছে। গত সপ্তাহে দুঃসাহসিক মুক্তিযোদ্ধারা বেপরোয়া আক্রমণ চালাইয়া মংলা বন্দরে ইউ এস এম লাইটনিং নামক একটি মার্কিন জাহাজ সম্পুর্ন ধ্বংস করিয়া দেয়। তাহার বন্দরের অপর একটি বিদেশী জাহাজেরও ক্ষতি সাধন করে।

ইহা ছাড়া মুক্তিযোদ্ধারা গেরিলা অভিযান চালাইয়া খান সেনাদের ২ টি নৌকা দখল করে।

 

জমের ভয়ে ভিত কাপুরুষ খান সেনাদের নিরাপত্তার আবরণ রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে কচু কাটা হইতে আতঙ্ক গ্রস্ত হইয়া পরিয়াছে। বিভিন্ন রণাঙ্গনে রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট অস্ত্র সহ আত্ম সমর্পন করিতেছে। গত সপ্তাহে কুমিল্লা এলাকায় ১ দিনে ৬৩ জন রাজাকার মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট আত্ম সমর্পন করে।

 

কুমিল্লা জেলার মেহারি নামক স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ৬৫ জন পাকসেনা খতম হয়।

 

বাংলাদেশের উত্তর রণাঙ্গন হয়তে প্রাপ্ত এক খবর হইতে জানা যায়, দিনাজপুর জেলার ঠাকুর গাও ও রংপুর ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা অভিযানের ব্যাপক তৎপরতা বৃদ্ধি পাইয়াছে।

২০ সেপ্টেম্বর ঠাকুরগাঁও শহরের উত্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের অতর্কিত আক্রমণে ৬ জন খানসেনা নিহত হয়।

 

কুমিল্লা জেলার নবীনগর ও কসবা এলাকায় জল্লাদ খানসেনারা নতুনভাবে গন হত্যা এবং লুট তরাজ শুরু করিয়াছে বলিয়া খবর পাওয়া গিয়াছে। জানা যায় চলটি মাসের প্রথম পক্ষে এইসব এলাকায় খান সেনারা ৫০০ ঘর বাড়ি আগুণ দিয়ে ভস্মীভূত করিয়া দেয়। ৩০ জন গ্রামবাসী নহয় হয়।

 

নবীনগর থানার মিরপুর এলাকায় জল্লাদ সেনারা লুট তরাজ চালায়। বাংলার অতন্দ্র প্রহরী মুক্তিযোদ্ধারা তাদেরকে উপযুক্ত জবাব দেন। তাহারা শত্রু বাহিনীর উপর ঝাপাইয়া পড়িয়া গ্রাম বাসীদের সহায়তায় ৩১ জন খান সেনা নিহত করেন। ইহার পরে লঞ্চ যোগে আরও একদল খানসেনা ঘটনাস্থলে আগমন করিয়া গ্রামে আক্রমণ করে। ইহা ছাড়া দাফুনিয়া, বিদ্যাকোট প্রভৃতি গ্রামেও জল্লাদ সেনারা আক্রমণ করে।

 

কসবা থানার চরগরা এলাকার খানসেনারা আরাইশত ঘর বাড়ি আগিন দিয়া পোড়াইয়া দেয়। ইহারা এই এলাকা হইতে গরু বাছুর ছিনাইয়া যায়। ইহা ছাড়া বাইও না গ্রামে ৩ শ বাড়ি পোড়াইয়া দেয়। খান সেনারা কসবা থানার সিম্রাইল গ্রামেও হামলা চালায়। বীর  মুক্তিযোদ্ধারা ইহার প্রতিরোধ করিতে শুরু করিলে খান সেনারা এই এলাকা ছাড়িয়া যাইতে বাধ্য হয়।

 

একই দিনে মুক্তিযোদ্ধারা এই এলাকায় প্রায় ১০০ খানসেনা হত্যা করেন। তারা নৌকা যোগে এই এলাকায় আসিয়াছিল। মুক্তিযোদ্ধারা নৌকাগুলি ডুবাইয়া দেন।

 

খুলনা জেলার চালনা হইতে প্রাপ্ত খবরে জানা যায়, চালনা বন্দরে মুক্তিযোদ্ধারা একটি ব্রিটিশ জাহাজের ক্ষতি সাধন করিয়াছেন। জাহাজটিতে পাট বোঝাই ছিল বলিয়া জানা যায়।

 

ইহা ছাড়া, সকল রণাঙ্গনেই মুক্তিযোদ্ধারা তাহাদের গেরিলা তৎপরতা জোরদার করুয়াছেন।

 

বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকার মোট ২২৮ টি চেকপোস্টের মধ্যে এখন ১৭৫ টি পোস্ট মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে। দিন দিন মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠন ও আক্রমণ সুসংহত হওয়ার মুখে জল্লাদ খাসেনাদের মনোবল দারুণভাবে ভাঙ্গিয়া পরিয়াছে। তাই ইহারা সম্প্রতি বিভিন্ন স্থানে বিমান হামলা চালাইতেছে। এবং নির্মোহ নিরস্ত্র জনসাধারণ হত্যা ও তাদের বাড়ি ঘর জ্বালাইয়া দিতেছে।

 

সম্প্রতি করাচী হইতে এক জাহাজ বোঝাই খানসেনাকে চট্টগ্রাম লইয়া আসার পড় ইহারা ভয়ে জাহাজ হইতে নিচে নামে নাই। পরে তাহাদিগকে সামরিক কর্তৃপক্ষ পুনরায় করাচী পাঠাইয়া দিতে বাধ্য হয়।

 

 

 

কর্নেল ওসমানী

 

গত ৬ মাস্যা সাফল্য পর্যালচনা করিয়া প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানী বলে যে,  গত ৬ মাসে বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধারা কম করিয়া হইলেও ২৫ হাজার ইসলামাবাদী শত্রু সেনা খতম করিয়াছেন। তিনি বলেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও গণচীন প্রদত্ত সর্বাধুনিক অস্ত্র সজ্জিত এবং সংখ্যার দিক দিয়া অধিক পাকিস্তানী সেনা ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে নিহতের গড় পড়তা অনুপাতের হার প্রতি একজন মুক্তিযোদ্ধার বিনিময়ে ৪০ জন হানাদার সেনা।

 

দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধারা জলে স্থলে অপরিমিত বিক্রমের সহিত হানাদার খান সেনাদের মোকাবিলা করিয়া চলিয়াছেন বলিয়া উল্লেখ করিয়া তিনি বলেন যে, এপর্যন্ত বাংলার সিংহ শাবক মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশের দখলকৃত এলাকার বিভিন্ন বন্দরে হানাদার বাহিনীর সাহায্যের জন্য অনিত অস্ত্র ও অন্যান্য সামগ্রী বোঝাই ১৫ টি বিদেশী জাহাজ নিমজ্জিত অথবা ক্ষতি সাধন করিয়াছেন। ইহা ছাড়া শত্রু সেনাদের চলাচল সরবরাহ ব্যাবস্থা পঙ্গু করিয়া দেয়ার উদ্যেশ্যে মুক্তিযোদ্ধারা প্রথম সুযোগেই দখলকৃত এলাকার গুরুত্তপূর্ন সড়ক ও রেল সেতু ধ্বংস করিয়া দিয়াছে।

–       বাংলার বানি, ২৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

 

রণাঙ্গনের খবর (রনবার্তা পরিবেশক)

 

ঢাকা হইতে প্রাপ্ত খবরে জানা যায়, বাংলাদেশর দখলকৃত এলাকায় ইসলামাবাদের অসুর বাহিনীর সুরক্ষিত সদর দফতর বলিয়া কথিত খোদ ঢাকা নগরী সহ উহার চারপাশে এবং ঢাকা জেলার বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক গেরিলা আক্রমণ চলিতেছে। মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকা হইতে শত্রুসেনা বাহির হওয়ার সব কয়টি গুরুত্তপূর্ন রেল, সড়ক ও জলপথে ব্যাপক তৎপরতা বৃদ্ধি করিয়াছেন। ঢাকা নগরীর সহিত স্থল পথে রেল ও সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করিয়া দিয়া দুঃসাহসিক মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুসেনাদের অবাধ গতিবিধি ও রসদ সরবরাহ ব্যাহত করিয়া চলিয়াছিল। ঢাকা নগরীতেও খণ্ড খণ্ড শঙ্ঘর্ষের মাধ্যমে তাহারা খানসেনাদের ব্যাস্ত রাখিয়া  তাহাদের নাস্তা নাবুদ করিতেছেন।

 

ঢাকা হইতে আমাদের প্রতিনিধি জানান, সেদিন খোদ ঢাকা নগরীতেই প্রকাশ্য দিবালোকে চলন্ত মোটর হইতে মেশিনগানের সাহায্যে মুক্তিযোদ্ধারা ৫ জন খানসেনা খতম করেন। মুক্তিযোদ্ধারা একটি প্রাইভেট ট্যাক্সি যোগে শহরের কোন একটি এলাকায় ঘোরাফেরার সময় টহল রত খানসেনারা মুক্তিফৌজ সন্দেহে তাদের অনুসরণ করে। খানসেনারা জীপ হইতে গর্জন করিয়া মোটরটিকে থামিতে নির্দেশ দেওয়া মাত্রই ইহাদের সম্মুখে ট্যাক্সির পিছনের কাঁচ ভাঙ্গিয়া মুক্তিযোদ্ধাদের মেশিনগান গর্জিয়া উঠে। হতভম্ভ খানসেনাদের হাতের মেশিন গানের ট্রিগারে আঙ্গুল আঙ্গুল স্পর্শ লাগিবার পূর্বেই তাহাদের রক্তাক্ত দেহ লুটাইয়া পরে ঢাকার পিচ ঢালা কালো রাস্তায়। সম্মুখে গাড়িটি ততোক্ষণে নিরুদ্দেশ হইয়া যায়।

 

এইতো সেই দিন, খানসেনাদের কঠোর প্রহরায় একটি ট্রেন ঢাকা হইতে ময়মন সিংহ যাইতেছিল। কিন্তু ঢাকা নগরী হইতে প্রায় ৩০ মাইল উত্তরে ঢাকা জেলার সীমান্ত কাওরাইদ অতিক্রম করার পূর্বেই ট্রেনের ইঞ্জিন টি একটি প্রচণ্ড বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে খান হইয়া যায়। ত্রিনর বগি কয়টি উলটাইয়া পরে। ব্যাপার বুঝিবার পুর্বেই খানসেনাদের বুক ঝাঁঝরা হইয়া যায় মেশিনগান আর রাইফেলের গুলিতে।

 

সেপ্টেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে খানসেনারা লঞ্চ যোগে যাইতেছিল নবাবগঞ্জ ও দোহার থানা দখল করার জন্য। ঢাকা হইতে বুড়িগঙ্গা দিয়া বাহির হইয়া ইছামতীকুলের বান্দুরায় লঞ্চটি পুঁছিলে মুক্তিযোদ্ধারা ইহার উপর প্রচণ্ড গোলাগুলি বর্ষন করেন ফলে ৩৪ জন খানসেনা মারা যায়। অন্যান্যদের আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। লঞ্চটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

 

এই দিনই নবাবগঞ্জের নিকট মুক্তিযোদ্ধারা খানসেনাদের অন্য একটি লঞ্চের উপর আক্রমণ চালাইয়া প্রায় ২৫ জন পাকসেনা খতম করে। ইহাদের লঞ্চটির ও ক্ষতি সাধন করা হয়।

 

গত মাসের শেষ সপ্তাহে মুক্তিযোদ্ধারা খুলনা জেলার সাতক্ষিরা মহকুমার অন্তর্গত কাক দাঙ্গা, মাদ্রা ও বোয়ালিয়া এলাকায় প্রায় ১ ব্রিগেড পাকসেনাদের একটানা ৩ দিন ব্যাপী যুদ্ধে লিপ্ত রাখেন।

 

এই খণ্ডে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে প্রায় ৪০০ খানসেনা খতম হয় বলিয়া স্থানীয় গ্রামবাসীর নিকট হইতে যানা যায়। মুক্তিযোদ্ধারা এই রণাঙ্গন হইতে ৬ জন পাকসেনা গ্রেফতার করে। এছাড়া প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ দখল করে। প্রায় ৪০০ খানসেনা নিহত হওয়ার পর অন্যান্য খানসেনারা পলায়ন করে।

 

 

রংপুর ও সাতক্ষিরায় সাড়ে ছয় শত শত্রু সৈন্য খতম

 

জঙ্গি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে তীব্র লড়াই চালাইয়া মুক্তিযোদ্ধারা রংপুর জেলার বক্সিগঞ্জ পুনর্দখল করিয়াছেন। গত ২৩ সেপ্টেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা কোডার কাটিতে পাক জঙ্গি শাহীতে তীব্র আক্রমণ প্রতিরোধ করিয়া অন্তত সাড়ে তিন শ পাক সৈন্য খতম করিয়াছে। বাংলাদেশের বীর গেরিলারা রংপুর জেলায় গত সপ্তাহে বর্বর ইয়াহিয়া বাহিনীর তিনটি জলযান ডুবাইয়া দিয়াছেন।

 

মুজিবনগরে প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ, খুলনা জেলার সাতক্ষিরা মহকুমার কোন এক স্থানে সম্প্রতি মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সঙ্ঘর্ষে ৩০০ জন পাকসেনা নিহত হইয়াছে। ৬ জন খানসেনাকে ধরিয়া আনা হইয়াছে।

 

বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধাদের সদর দপ্তর হইতে প্রচারিত এক বুলেটিনে বলা হইয়াছে যে, সম্প্রতি ঢাকা, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধারা মহরিতে অবস্থিত পাক সৈন্যদের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালান। ইহাতে ৫ জন পাকসেনা নিহত ও ৩ জন আহত হইয়াছে।

মুক্তিযোদ্ধারা গত শনিবার ময়মন সিংহ স্রীহট্ট অঞ্চলের দেয়ানই বাজারে শত্রুদেনাসের উপর তীব্র আক্রমণ চালান। ফলে ২০ পাকসেনা হতাহত হইয়াছে। ঐদিন জয়মতিনপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের মর্টার আক্রমণে ৩ জন পাকসেনা খতম হয়।

মুক্তিযোদ্ধারা উত্তর – পশ্চিম অঞ্চলে মাইন বিস্ফোরণ ঘটাইয়া পাক সৈন্যের একটি সামরিক জীপ উড়াইয়া দেয়। এখানে ২ জন পাকসেনা নিহত হয়। ওই এলাকায় শত্রুদের একটি ঘাঁটি আক্রমণ করিয়া ৫ জন শত্রু সেনাকে খতম করা হইয়াছে।

–       বাংলার বানি , ৫ অক্টোবর, ১৯৭১

 

 

খানসেনা ও মুক্তিফৌজের কামানের লড়াই

 

কৃষ্ণ নগর , ৫ অক্টোবর – গত ১ অক্টোবর সন্ধ্যার দিলে বাংলাদেশের খুলনা সেক্টরের সাতক্ষিরার অধীনে উক্সাতে খানসেনা মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে প্রচণ্ড কামানের লড়াই হয়। ঘন ঘন কামানের সন্দ ভারতীয় সীমান্ত এলাকা থেকেও শোনা যায়।

 

মুক্তিযোদ্ধাদের সূত্রে প্রাপ্ত বিশদ বিবরণে জানা গেছে যে, এক ব্রিগেড খানসেনা ( সংখ্যায় প্রায় ৬০০ জন) ২৩ টি ট্রাকে করে সাতক্ষিরা থেকে উক্ত মহকুমার কালিগঞ্জ থানার অন্তর্গত উক্সায় মুক্তিযোদ্ধার ঘাঁটি আক্রমণ করার জন্য অগ্রসর হয়। ভারি কামান থই গোলাবর্ষন শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধারাও তাদের মর্টার থেকে গোলাবর্ষন শুরু করে তার উপযুক্ত জবাব দেয়। মুহুর্মুহু কামানের গোলার  শব্দে ভারতীয় সীমান্ত এলাকাও কেঁপে উঠতে থাকে।

 

মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড প্রতিরোধের মুখ টিকতে না পেরে পাকসেনারা উক্সার কিছু দূরে পিছিয়ে যায় এবং সেখানে অবস্থান নেয়। এই লড়াইয়ের ক্ষয় ক্ষতির বিবরণ এখনো না পাওয়া গেলেও কয়েকজন খানসেনা নিহত হয়েছে এবং ১ জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হয়েছে বলে জানা যায়।

 

অন্য এক সংবাদে জানা গেছে, গত  ২৮ সেপ্টেম্বর সাতক্ষিরার শ্যাম নগরের কাছে একস্থানে একটি পাকিস্তানী গানবোট মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ঘাঁটির উপর গলাবর্ষন করলে উভয় পক্ষে প্রচণ্ড গুলি বিনময়ের পর পাক গানবোট পশ্চাদ পসারণ করে। পাকসেনাদের ক্ষয় ক্ষতির পরিমাণ জানা যায়নি। মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে ৩ জন অল্প বিস্তর আহত হয়।

 

 

খুলনা সেক্টরে ৫০০ খানসেনা নিহত

 

মুক্তিযোদ্ধাদের হিসাবে দেখা গেছে যে, গত দুমাসে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে খুলনা সেক্টরে বিভিন্ন স্থানে লড়াইয়ে ৫০০ খানসেনা ও ২০০ রাজাকার নিহত হয়েছে। তাছাড়া ৬০০ টি পাক রাইফেল দখল করা হয়েছে। ও ৬০ জন রাজাকার মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্ম সমর্পন করেছে।

 

পাঞ্জাবি পুলিশ (বাংলাদেশে এখন পাঞ্জাবি পুলিশ আমদানি করা হয়েছে) ও ৮ জন খান পুলিশ নিহত হয়েছে। তাছাড়া ৬৬ টি খানসেনাদের রাইফেল মুক্তিযোদ্ধাদের হসগত হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা খানসেনাদের ২ টি লঞ্চ ও ১ টি গানবোট ধ্বংস করেছে ও ১ টি লঞ্চ হস্তগত করেছে।

 

 

বরিশালের বিভিন্ন স্থানে লড়াই চলছে

 

মুজিবনগরে আগত খুলনা সেক্টরের বরিশালে লড়াই রত মুক্তিযোদ্ধাদের জনৈক মুখপাত্রের কাছ থেকে জানা গেছে যে, বরিশালের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করিয়া দোয়ারিকা, রহমত পুড়, উজিরপুর, হবিবপুর, বানারিপারা, মুলাদি প্রভৃতি স্থানে খণ্ড খণ্ড ভাবে গেরিলা লড়াই চলেছে।

–       আনন্দ বাজার পত্রিকা, ৬ অক্টোবর, ১৯৭১

 

 

 

 

মুক্তিবাহিনীর দুর্বার অভিযান অব্যাহত

(নিজস্ব সংবাদ দাতা)

 

পালং এ শত্রুঘাটি বিধ্বস্ত

গত মাসে ফরিদপুরে একটি দুর্বার অভিযানএ  মুক্তিযোদ্ধারা উল্লেখযোগ্য সাফল্য লাভ করিয়াছে। মাদারীপুরের পালং থানায় পাকিস্তানী মিলিটারি পুলিশ ও রাজাকারদের একটি শত্রু ঘাঁটি মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়।

 

ওই ঘাঁটি তে ৭০ জন পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ ও কিছু সংখ্যক রাজাকার ছিল। মধ্যরাত্রিতে মুক্তিযোদ্ধারা তিন দিন থেকে থানাটি আক্রমণ করে এবং ৮ ঘণ্টা তুমুল লড়াইয়ের পর শত্রুরা প্রায় সম্পুর্ন নিশ্চিনহ হয়। ৬৮ জন পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ ও রাজাকার খতম হয়। মুক্তিযোদ্ধারা থানাটি ভাঙ্গিয়া পুনরায় ঘাঁটি স্থাপনের অযোগ্য করিয়া ফেলে। মুক্তিযোদ্ধারা এখানে ৫ টি চিনা অটোমেটিক সহ ৬০ টি রাইফেল  ও প্রচুর গোলাবারুদ উদ্ধার করে। এই বিরত্তপূর্ন সংগ্রামে ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা শহিদ হইয়াছেন।

 

আরও একটি খবরে প্রকাশ, গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ার কাছে ২ টিপাট বোঝাই ফ্ল্যাট মুক্তিযোদ্ধারা দখল করিয়াছে। ইহার প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য বর্বর হানাদার বাহিনী ৯ টি লঞ্চের এক বহর লইয়া কোটালিপাড়া বিলে যায় এবং ডহরপারা, মদন পার, পশ্চিম পার প্রভৃতি গ্রামে আগুণ লাগায়। কলাবারি গ্রামে জল্লাদ রা ২২ জন গ্রাম বাসীকে হত্যা করে।

মুক্তিবাহিনী সম্প্রতি মানিদহ গ্রামের দালাল আসাদ বিশ্বাসকে খতম করিয়াছে।

 

মানিকগঞ্জে বিরাট সাফল্য

গত ২৩ সেপ্টেম্বর মানিক গঞ্জের দৌলতপুর থানায় এক অভিযান চালাইয়া মুক্তিযোদ্ধারা ৭৫ জন পুলিশ ও রাজাকারকে বন্দী ও বিপুল পরিমাণ অস্ত্র দখল করে। কিছুদিন যাবত এই থানার ঘাঁটি হইতে পুলিশ ও রাজাকার রা পার্শবর্তি গ্রামগুলির উপর নির্যাতন চালাইয়া আসিতেছিল।

ঘটনার দিন মধ্য রাত্রিতে দুই দিক হইতে থানাটির উপর আক্রমণ করিলে শত্রুপক্ষ কিছুক্ষণ গোলা ছোড়ে। কিন্তু অল্পক্ষণের মধ্যে পুলিশদের অনেকে চম্পট দিয়া আত্ম রক্ষা করে আর যুদ্ধ ক্ষেত্রে নাবালক রাজাকার রা প্রায় সকলেই ধরা পড়ে।

এখানে মুক্তিযোদ্ধারা প্রায় শ খানেক রাইফেল  , ৫ টি অটোমেটিক চিনা রাইফেল ও ১০ হাজার রাউন্ড গুলি দখল করিয়াছে।

গত ২১ সেপ্টেম্বর হানাদার পাকিস্তানী সৈন্যরা হরিরামপুর থানার বলা গ্রামে লুটপাট করিতে আসিলে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ২ জন খতম হয়। কিন্তু হানাদার বর্বর রা কাপুরুষের মত এর প্রতিশোধ নেয় নিরস্ত্র গ্রাম বাসীদের উপর। বলা, মাচাইন ও পার্শ বর্তি গ্রামে তারা ১৬ জন গ্রামবাসীকে হত্যা করে।

 

 

নারায়ণগঞ্জ

বিলম্বে প্রাপ্ত খবরে জানা গিয়াছে, মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকা নারায়ণগঞ্জ সড়কের নলখলি ব্রিজ মাইন দিয়া উড়াইয়া দিয়াছে।

রূপগঞ্জ থানার দাড়িপারায় পাক দখলদার বাহিনীর ক্যাম্পরে গ্রেনেড চার্জ করিয়া  মুক্তিযোদ্ধারা ৪ জন পাকসেনা খতম করিয়াছে।

উভয় স্থানেই হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র গ্রাম বাসীদের উপর হামলা করিয়া মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতার জবাব দেয়ার চেষ্টা করে।

 

 

চট্টগ্রাম

গত ১২ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম জেলার আনোয়ার থানার উশখাইল গ্রামে মুক্তিযোদ্ধারা এক অভিনব কৌশল করিয়া মুসলিম লিগের একজন কুখ্যাত দালালকে প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা করে। আব্দুল হাকিম নামে উক্ত দালালটি ইউনিয়ন কাউন্সিলের ও তথাকথিত শান্তি কমিটির একজন সদস্য ছিল। গত ১২ সেপ্টেম্বর উক্ত দালালটির মেয়ের বিবাহের তারিখ স্থির করার অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা বর পক্ষের ছদ্মবেশে মিষ্টির হাঁড়ী সহ তাঁর বাড়িতে হাজির হয়। দালালটি বর পক্ষের অভ্য্ররথনা করতে ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিলে মুক্তি সেনারা তাহাকে গুলি করিয়া হত্যা করে।

গত ১৫ সেপ্টেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা সকাল ৮ টায় পটিয়া থানার অন্তর্গত কালার পোল পুলিশ ফাঁড়ি আক্রমণ করিয়া একজন পুলিশ ও ১ জন রাজাকার কে হত্যা করে। গত ১০ সেপ্টেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা পটিয়া থানার মালিয়া পারা গ্রামে ১১ জন মুসলিম লিগ দালাল কে হত্যা করিতে সমর্থ হয়।

 

কুমিল্লা

১০ সেপ্টেম্বর হাজীগঞ্জে একটি গেরিলা দলের সঙ্গে পাক বাহিনীর সঙ্ঘর্ষ হয়। গেরিলা বাহিনী পাক হানাদারদের হঠাত দুই দিক হইতে আক্রমণ করিয়া বিপর্যস্ত করিয়া দেয় ও আনুমানিক ৩০ জন পাকসেনা হত্যা করে। গেরিলা বাহিনীর আক্রমণের মুখে পাক দস্যু বাহিনী টিকতে না পারিয়া নিহতদের ফেলিয়া পালাইয়া যায়। গেরিলারা হানাদারদের ফেলিয়া যাওয়া প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ দখল করে।

৭ সেপ্টেম্বর নবীনগর থানার রাইতলা গ্রামের কাছে  মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ৪ জন পাকসেনা নিহত হয়। দস্যুদের এই দলটি নৌকা যোগে রাইতলা দিয়া যাইতেছিল। এমন সময় গেরিলারা উহাদের আক্রমণ করিয়া নিহত করে।

 

ঢাকা

১১ সেপ্টেম্বর রায়পুরা অঞ্চলে গেরিলারা জয়নগরে তিতাস গ্যাস লাইন উড়াইয়া দেয় ও ৩ টি পাওয়ার লাইন ধ্বংস করে।

–       মুক্তিযুদ্ধ, ১০ অক্টোবর, ১৯৭১

মেজর মঞ্জুরের ৯ নং সেক্টর সফর

 

সম্প্রতি ৮ নং সেক্টর কমান্ডার মেজর মঞ্জুর ৯ নং সেক্টর সফর করে মুক্তিযোদ্ধাদের কর্ম তৎপরতা দেখে মুগ্ধ হন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্যেশ্যে বলেন। আপনাদের বীরত্বে অতি শীঘ্রই বাংলাদেশ থেকে হানাদার বর্বররা বিতাড়িত হবে।

 

 

মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক ওসমানীর রণাঙ্গন সফর

 

২ অক্টোবর , বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম এ জি ওসমানী পুর্ব রণাঙ্গনের অগ্রবর্তি অঞ্চল , বিভিন্ন হাসপাতাল ও মুক্তিযোদ্ধাদের শিবির পরিদর্শন করে বিপুল প্রতিকুল আবহাওয়ার মধ্যে ৫ দিন ব্যাপী সফরের পর আজ মুজিবনগরের মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তরে ফিরে আসেন। তিনি রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্যেশ্যে বিভিন্ন স্থানে ভাষণ দেন।

 

মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি মুক্তিযোদ্ধাদের কঠোর মনোবল, অসম সাহস, দুর্জয় আত্ম বিশ্বাস ও আত্ততসর্গের বিপুল প্রেরণা দেখে গর্ব বোধ করেন। তিনি তাদেরকে আরও তৎপর হতে ও ত্যাগ স্বীকারের আহবান জানান। তিনি ভাষণ দান কালে মুক্তিযোদ্ধাদের অসম সাহসিকতা ও দেশাত্মবোধের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। সমগ্র জাতী তাদের এই দুঃসাহসের জন্য গর্বিত বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি আরও বলেন যে, আপনারা এই মুক্তিসংগ্রামের ভেতর দিয়ে একটি নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করে চলেছেন। প্রধান সেনাপতি তাদের একথা স্মরণ করিয়ে দেন, বাঙ্গালীরা নাকি যোদ্ধা জাতী নয়, এই ভ্রান্ত ধারণা আপনারা একদম পালটে দিয়েছেন। তিনি তাঁর ভাষণে আরও বলেন যে, ৬ মাসের যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা যে সাহসিকতা দেখিয়েছেন তাতে করে আমাদের জনসাধারণের আত্ম বিশ্বাস আরও বেড়ে গেছে।

 

 

 

শ্যামনগর – কালীগঞ্জ দুর্জয় ঘাঁটি কিন্তু —-

–       মিন্টু বসু

 

শারদীয় ছুটি। অতএব হাতে প্রচুর সময়। কেনোনা এবার তো আর পুজোর ব্যাবস্থা নেই। তাই ভেবে চিন্তে ঠিক করলাম মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি পরিদর্শন করতে যাব। ২৭ সেপ্টেম্বর বিকাল ৪ টায় আমরা ৪ জন বেরিয়ে পড়লাম। সম্পাদক নুরুল আলম ফরিদ, কর্মাধ্যক্ষ মোহাম্মদ ইউসুফ, একজন মুক্তিযোদ্ধা ফিরোজ বাঙ্গালী এবং আমি। কিছুদূর এগোতেই শেলিং এর শব্দ শুনতে পেলাম। গ্রামের লোকমুখে শুনলাম মুক্তিবাহিনী বসন্তপুরের পাক ছাউনি আক্রমণ করেছে। মনে হল ওই বিকট শব্দগুলো আমাদের সাদর সম্ভাষণ দিচ্ছে। রাত তখন ৮ টা। ঘাঁটির কাছাকাছি এসে পৌছালাম। এবার আমাদেরকে অতি সন্তর্পনে এগোতে হবে। কেনোনা দুপক্ষেই গোলাগুলি হচ্ছে। তাই আমরা ক্রলিং করে এগোতে লাগলাম। এভাবে কিছু এগোনোর পর ঘাঁটিতে এসে পৌছালাম।

এর কিছুক্ষণ বাদেই গোলাগুলি থেমে গেল। আরও পরে ক্যাপ্টেন হুদা ও ১১ জন মুক্তিযোদ্ধা সমস্ত গায়ে কাঁদামাখা অবস্থায় ক্যাম্পে ফিরে এলেন, তাঁর মুখেই শুনলাম বসনপুরে তিনি ও তাঁর দল স্বাধীন বাংলার পতাকা তুলতে সক্ষম হয়েছেন, দুঃসাহসী ক্যাপ্টেন ও তাঁর সেনাদের প্রতি শ্রদ্ধায় স্বভাবতই মাথাটা নুয়ে এল। মনে মনে বললাম, বাংলাদেশ আজ আর দুর্বল নয়। বাংলার এই দুর্জয় শক্তি আমার জননী জন্মভূমিকে মুক্ত করবেই।

 

কয়েকশত মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে লাইনে বসে আহার পর্ব সমাধা করে তাঁবুর নিচে রাতের মত আশ্রয় নিলাম।

 

ভোরের ঘুম ভাঙল আবার সেই শব্দে। শুনলাম শ্যামনগর ও কালীগঞ্জ দখল করার জন্য পাকসেনারা আমাদের উপর আক্রমণ করেছে। মুখ হাত ঢুতে আসতেই ক্যাপ্টেন সাহেবের চায়ের টেবিলে ডাক পড়ল আমাদের। সবে গিয়ে বসেছি – ঠিক তখনি সংবাদ এল পাকসেনারা পিরোজপুরের বাঙ্কার দখল করে নিয়েছে। তাই ৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা ও গোলাবারুদ পাঠাতে হবে। দেখলাম মুহুর্তের মধ্যে ৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ক্যাপ্টেন সাহেব যাবার জন্য প্রস্তুত হয়েছেন।

 

হথাত আমরা স্থির করলাম এ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করব। ক্যাপ্টেন সাহেব কে বলায় তিনি সব ব্যাবস্থা করে দিলেন।

 

বেলা ১ও টায় গিয়ে পৌছালাম শ্যামনগর থানার পিরোজপুরে। আমাদের যেখানে ডিফেন্স ছিল তাঁর থেকে দুশ গজ দূরে শত্রু সৈন্য। দাঁড়িয়ে দেখলাম দুশ গজ দূরে আমাদের বাঙ্কারের  মধ্যে খান সেনারা। দুপক্ষেই সমানে গোলাগুলি চলছে। শুনলাম এর মধ্যেই ৫০/৬০ জন রাজাকার সহ পাকসেনা খতম হয়েছে আমাদের অসম সাহসী মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে।

 

ক্যাপ্টেনের নির্দেশে আমরা ৫০০ গজ পিছনে সরে এলাম ঠিক চৌমাথার ওখানে। সেখান থেকেই ৩ ইঞ্চি মর্টার থেকে শেলিং শুরু করলেন ক্যাপ্টেন সাহেব। সমস্ত দিন তা সেখানেই কেটে গেল।

 

সবচেয়ে আশ্চর্যের যে, দুপক্ষ সমানে গোলাগুলি চলছে আর তাঁর মধ্যেও গ্রামের জনগণ বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে ভদের সাহায্য করে চলছে। কেউ গোলাবারুদ মাথায় বোয়ে নিয়ে যাচ্ছে, কেউ মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার তৈরি করছে, আবার কেউ ডিফেন্স থেকে সংবাদ এনে দিচ্ছে। প্রতিটি জনগণের দৃঢ় বিশ্বাস মুক্তিযোদ্ধারা হানাদারদের বিতাড়িত করতে সক্ষম হবে।

 

হটাত দেখলাম, জনৈক মুক্তিযোদ্ধা কালীগঞ্জের দিক থেকে ছুঁটে আসছেন। কাছে আসতে জানতে পারলাম কালীগঞ্জে ৪ জন পাকসেনা খতম হয়েছে। ক্যাপ্টেন হুদা ধন্যবাদ জানালেন এই সময় সাহসী মুক্তিযোদ্ধাকে।

 

এক বৃদ্ধ এলেন কয়েকটি ডাব নিয়ে। এই বৃদ্ধের একমাত্র ছেলে ডিফেন্সে যুদ্ধ করছে। ছেলেকে না পেয়ে ডাবগুলো সব আমাদের মাঝে বিতরণ করে দিলেন। ছেলের জন্য একটা রাখতে বলায় তিনি বললেন, ‘আপনারাও তো আমার ছেলে’। বৃদ্ধের দৃঢ় এই মনোবল সবাইকে মুগ্ধ করল।

 

একজন তরুণ মুক্তিযোদ্ধা আহত হয়েছে – তারাটারই পৌঁছে দিতে হবে তাকে হাসপাতালে। ভার পড়ল আমাদের ৩ জনের উপর। অনিচ্ছা সত্ত্বেও আহত সৈনিক কে নিয়ে ফিরে চললাম দুর্জয় ঘাঁটি শ্যামনগর পরিত্যাগ করে।

 

হএ দুর্জয় ঘাঁটি শ্যামনগর, তোমায় অভিনন্দন – অভিনন্দন বাংলার শক্তিকে, যারা শ্যামনগর মুক্ত করার জন্য জীবন পণ যুদ্ধ করে চলেছে – বাংলার স্বাধীনতার লাল সূর্যকে।

 

কয়েকদিন পড় জনৈক মুক্তিযোদ্ধা সংবাদ বহন করে নিয়ে এলেন, শ্যামনগর কালীগঞ্জ হানাদাররা দখল করেছে। শোনার সঙ্গে সঙ্গে পাথরের মত স্তব্ধ হয়ে গেছিলাম। আমার সোনার বাংলা কি তবে দখলদার থেকে মুক্ত হবেনা? ভাবনার অবসান করলেন মুক্তিযোদ্ধাই , ‘ভাবছেন কেন, এ তো সাময়িক পরাজয়, দেখবেন কয়েকদিনের মধ্যেই আমরা হানাদারদের বিতাড়িত করতে সক্ষম হব। তাছাড়া গেরিলা যুদ্ধের নিয়ম তো এমনই।’

 

এরপর শ্যামনগর , কালীগঞ্জ থেকে কি কারণে মুক্তিযোদ্ধারা সরে এলেন সে সম্পর্কে জানতে চাইলাম- উত্তরে বললেন, ‘ আমাদের সবচেয়ে অস্ত্রের অভাব, যার জন্য এই সাময়িক পরাজয়। আমাদের কাছে অস্ত্র বলতে রাইফেল, এল এম জি ও দু একটা ৩ ইঞ্চি মর্টার আর ওরা আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত , কাজেই ওদের মত যদি আমাদের আধুনিক অস্ত্র থাকত তো বুঝিয়ে দিতাম মুক্তিযোদ্ধারা কত দুর্বার। ‘

–       বিপ্লবি বাংলাদেশ, ১০ অক্টোবর, ১৯৭১

 

 

রণাঙ্গনের খবর

(রনবার্তা পরিবেশক)

 

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এত তাতপর্যপূর্ন পর্যায়ে উপনিত হইয়াছে। দখলকৃত একালার সকল স্থানে সকল স্তরে মুক্তিযোদ্ধারা তাহাদের অবস্থা দিন দিন সুদৃঢ় করিয়া চলিয়াছেন।

 

দখলকৃত এলাকার প্রতিটি জেলা সদর দপ্তর সহ জেলার সর্বত্র তাহার বিপুল সংখ্যায় ছড়াইয়া পড়িয়া দিকে দিকে শত্রুবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়িয়া শত্রুদের খতম, জখম ও হয়রানি করিয়া চলিয়াছেন।

 

সর্বত্রই তাহার অসীম সাহসিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করিয়া হানাদার সৈন্যদের মনোবল ভাঙ্গিয়া দিয়া তাহাদের চরমহতাশ করিয়া চলিয়াছেন।

 

শত্রু বাহিনীর চরম হতাশা ও তাহাদের মধ্যকার বেলুচ পাঠান সিদ্ধি ও পাঞ্জাবিদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান পারস্পরিক অন্তর্বিরোধ , মতবিরোধ, অবিশ্বাস ও হিংসা প্রতিহিংসা বিদ্বেষের মুখে  মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তি দিন দিন বৃদ্ধি পাইয়া চলিয়াছে। বর্বর হানাদার বাহিনীর প্রায় ১ ডিভিশন সৈন্য বাংলাদেশের দখলকৃত এলাকা ছাড়িয়া  চোরের মত ইসলামাবাদে পলায়নের মুখে গড় শনিবার মুক্তিযোদ্ধাদের সদ্য ট্রেনিং সমাপ্ত অফিসারদের প্রথম দলটি বিভিন্ন রণাঙ্গনে ছড়াইয়া পড়েন। এদিকে নৌ বাহিনীর ইউনিট ও দিন দিন জোরদার হইয়া উঠিয়াছে।

 

বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপক প্রস্তুতি ও প্রচণ্ড আঘাতের মুখে শত্রুরা দিশেহারা হইয়া শেষ পর্যায়ে নিরাপদে পলায়নের পথ সুরক্ষিত করার দিকে সর্ব শক্তি নিয়োগ করিয়াছে বলিয়া খবর পাওয়া গিয়াছে।

 

বাংলাদেশ হইতে সংকট কালে বিমানে জল্লাদ সেনাদের পলায়নের সম্ভবনা না দেখিয়া জংগি চক্র ঢাকা হইতে চট্টগ্রাম ও চালনা পর্যন্ত বিস্তৃত নৌপথের উপর দখল জোরদার করিতেছে বলিয়া জানা গেছে।

 

এদিকে বিভিন্ন রণাঙ্গন হইতে প্রাপ্ত খবরে জানা যায় যে, স্থল ও নৌপথে বাংলার দুর্জয় অগ্নিসন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে টিকিতে না পারিয়া বর্বর খান সেনারা বিমানের সাহায্য গ্রহণ করিতেছে ও প্রায় ই পোড়া মাটি নীতি অবলম্বন করিয়া বেসামরিক নিরস্ত্র জনগণকে হত্যা করিয়া চলিয়াছে।

 

দখলীকৃত এলাকায় উহাদের সদর দফতর ঢাকা শহর হইতে শুরু করিয়া প্রতিটি জেলা শহর মুক্তিযোদ্ধাদের গোলাগুলি ও তাদের দৃপ্ত পদভারে থর থর করিয়া কাঁপিতেছে। জেলার সর্বত্র হানাদার  বাহিনী ও উহাদের দালালদের তাহারা উৎখাত করিয়া চলিয়াছেন। পরিস্থিতির ভয়াবহতা ও প্রচণ্ডতা আচ করিতে পারিয়া ইসলামাবাদের জঙ্গি শাহী বাংলাদেশের দখল কৃত এলাকায় তথাকথিত উপনির্বাচনের পরিকল্পনা আরও পিছাইয়া দিয়াছে।

 

রণাঙ্গন হইতে প্রাপ্ত খবরে জানা যায়, দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রাভিযান সর্বত্র অব্যাহত রহিয়াছে। দখলীকৃত এলাকার নোয়াখালী জেলার ফেনী, পরশুরাম, অনন্ত পুড়, বেলুনিয়া ও টাঙাইলে হানাদার বাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে প্রচণ্ড শঙ্ঘর্ষ চলিতেছে।

 

ঢাকা ময়মন সিংহের মধ্যে স্থানে স্থানে রেলপথ উঠাইয়া ফেলায় ও গুরুত্ব পূর্ন রেল সেতু গুলি মুক্তিযোদ্ধারা মাইনের সাহায্যে সম্পুর্ন ধ্বংস করিয়া দেওয়ায় ট্রেন চলাচল ব্যাহত হইয়াছে।

 

টাঙ্গাইল এলাকায় বর্তমানে প্রচণ্ড লড়াই চলিতেছে। হানাদার সৈন্যরা এই স্থানে জঙ্গি বিমানের সাহায্য গ্রহণ করিতেছে বলিয়া খবর পাওয়া গিয়াছে। অবশ্য ইতিমধ্যেই মুক্তিযোদ্ধারা টাঙ্গাইল শহরের উপকণ্ঠে কাগমারিতে ৫ জন খানসেনাকে খতম করিয়াছেন।

 

নোয়াখালী জেলায় ও ফেনী বেলুনিয়া এলাকায় ঢাকা চট্টগ্রাম রোড নিরাপদ করার জন্য হানাদার বাহিনী মরিয়া হইয়া  প্রচেষ্টা চালাইতেছে। কিন্তু বীর  মুক্তিযোদ্ধারা আঘাতের পড় আঘাত হানিয়া উহাদের সকল প্রচেষ্টা ধুলিস্মাত করিয়া অগ্রসর হইয়া চলিয়াছেন।

ফেনী হইতে প্রাপ্ত খবরে জানা যায় এমাসের প্রথম দিকে মুক্তিযোদ্ধারা মহুরি নদী অতিক্রম করিয়া পরশুরাম ও অনন্তপুরে শক্তিশালী প্রতিরোধ সৃষ্টি করেন। খান সেনারা মরিয়া হইয়া যুদ্ধ করিয়া উহাদের ১৯ জনকে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে হারাইয়া পিছনে হটিয়া যাইতে বাধ্য হয়। মুক্তিযোদ্ধারা খানসেনাদের পিছু ধাওয়া করিয়া ৪০ জনকে খতম করে।

 

অনন্তপুরে অষ্টাদশ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ৩০ জন খানসেনা মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে খতম হয়। বেলুনিয়া এলাকায় সঙ্ঘর্ষে খানসেনাদের ১ জন অফিসার সহ ২৭ জন মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে গত সপ্তাহে খতম হত।

 

কুমিল্লা রণাঙ্গন হইতে প্রাপ্ত খবরে জানা যায় যে, তৃতীয় পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সৈন্য বোঝাই একটি লঞ্চ গত ৪ অক্টোবর মুক্তিযোদ্ধারা কসবা এলাকায় নৌপথে ডুবাইয়া দেন। এতে দুশ খানসেনা খতম হয় ও লঞ্চ বোঝাই অস্ত্র নিমজিত হইয়া যায়। ইহার আগের দিন মুক্তিযোদ্ধারা বাঞ্ছারামপুর এলাকায় এরও একটি লঞ্চ ডুবাইয়া দেয় ও ১০ জন পাকসেনা খতম করে। এই এলাকাতে মুক্তিযোদ্ধারা খানসেনাদের ৩ টি স্পিড বোট ও ১০ টি নৌকা ডুবাইয়া দেয়। একজন লে কর্নেল ও একজন ক্যাপ্টেন  সহ ১৪ জনকে হত্যা করেন।

 

উত্তর রণাঙ্গনে ভুরুংমারি, মোঘলাহাট, নওয়াব গঞ্জ, খঞ্জন পুড় এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা খানসেনাদের উপর বিভিন্ন আঘাত হানিয়া প্রায় ৬০ জনকে খতম করেন গত ১ সপ্তাহে।

 

ঢাক হইতে সর্বশেষ প্রাপ্ত খবরে জানা যায়, ঢাকা ও আঁশেপাশের বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যাবস্থা বিপর্যস্ত করা হইয়াছে।

 

 

বঙ্গবন্ধু নৌবহর উদ্বোধন

(রনবার্তা পরিবেশক)

 

গত শুক্রবার বাংলাদেশের কোন এক মুক্ত এলাকাত নৌ ঘাঁটিতে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধাদের নৌবিভাগের একটি নৌবহরের আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়। স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে এই নৌ বহরের নামকরণ করা হইয়াছে বঙ্গবন্ধু নৌবহর এক। উল্লেখযোগ্য যে, মুক্তিযোদ্ধাদের নৌ ইউনিটের দুর্ধর্ষ গেরিলারা বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে দখলীকৃত জল এলাকা হইতে ৫ টি লঞ্চ হানাদার সৈন্যদের কবল হইতে দখল করেন। সেই ৫ টি লঞ্চ কে লইয়া প্রাথমিক পর্যায়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে এই নৌ বহরটি গঠন করা হয়।

 

 

মুক্তিযোদ্ধাদের কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে সৈয়দ নজরুলের ভাষণ

(রাজনৈতিক সংবাদ দাতা)

 

গত শনিবার বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চলের কোন এক স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের অফিসার ট্রেনিং কোর্সের প্রথম দলের আনুষ্ঠানিক অভিষেক ( পাসিং আউট সিরিমনি) উৎসবে বক্তৃতা কালে গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম এই মন্তব্য করেন যে, ‘ স্বাধীন বাংলার জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজ শত্রুর কারাগারে। যেদিন তিনি শত্রুমুক্ত ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বাংলাদেশ আপনাদের অভিবাদন গ্রহণ করিতে পারিবেন সেই দিনই অর্জিত হইবে মুক্তি সংগ্রামের চূড়ান্ত সাফল্য। ‘ তিনি ও প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম এ জি ওসমানী এই অনুষ্ঠানে ট্রেনিং প্রাপ্ত তরুণ অফিসারদের অভিবাদন গ্রহণ ও তাহাদের কুচকাওয়াজ পরিদর্শন করেন।

 

অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি অফিসারদের কুচকাওয়াজ পরিদর্শন ও তাহাদের উদ্যেশ্যে অনলবর্ষী ভাষায় ভাষণ দান করেন। এই ভাষণে তিনি হানাদার বাহিনীর কবল হইতে দেশ মাতৃকার মুক্তির ব্যাপারে তাহাদের গুরুদায়িত্ব ও কর্তব্যের কথা স্মরণ করাইয়া দেন।  এই প্রসঙ্গে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের ঐপনিবেশিক শাসক গোষ্ঠী কর্তৃক বাংলাদেশের মানুষকে পাকিস্তানের নামে ধোঁকা দেওয়ার এবং স্বাধীনতার নামে নিষ্ঠুর শোষণ ও নির্যাতন নিপীড়নের মর্মন্তদ কাহিনী তুলিয়া ধরেন। তিনি বাংলাদেশে হানাদার সৈন্যদের ঘৃণ্যতম গণহত্যার বর্ননা দিয়ে গিয়ে হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য অফিসারদের প্রতি আহবান জানান।

 

অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি  বাঙ্গালীর শৌর্যবীর্য ও বীরত্বের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করিতে গিয়া বলেন, মুক্তিযোদের উপর মুক্তিকারি ৭ কোটি মানুষের অটল আস্থা ও সমর্থন রহিয়াছে। পূর্বানহে প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম এ জি ওসমানী অফিসারদের উদ্যেশ্যে ভাষণদান কালে তাহাদিগকে শৃঙ্খলা ও ন্যায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার আহবান জানান।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ, জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের বহুসংখ্যক সদস্য, গন প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের উচ্চ পদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মচারি ও বিশিষ্ট ব্যাক্তিবর্গ এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

 

বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধাদের অফিসার পথে ট্রেনিং প্রাপ্তদের আনুষ্ঠানিক অভিষেক উৎসব ও গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ হইতে তাহাদিগকে সনদ প্রদান অনুষ্ঠান ইহাই প্রথম।

 

অভিষেক অনুষ্ঠান উপলক্ষে নির্মিত মনোরম মঞ্চে প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম এ জি ওসমানী ও সামরিক একাডেমীর অধ্যক্ষ অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অভ্যর্থনা জ্ঞ্যাপন করেন।

–       বাংলার বানি, ১২ অক্টোবর, ১৯৭১

 

 


 

ঢাকা চট্টগ্রাম রোডের গুরুত্তপূর্ন সেতু ধ্বংস

 

গত এক পক্ষকাল স্বাধিনতাকারি বীর যোদ্ধারা ময়মনসিংহ সেক্টরের জগন্নাথগঞ্জ ঘাটের নিকট একটি গ্রামে প্রায়  ১০০ রাজাকারকে খতম করেছেন। এই আক্রমণে কয়েকজন ভিত বিহ্বল হয়ে অস্ত্র সহ মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্ম সমর্পন করে।

 

 

নোয়াখালী

 

নোয়াখালীতে ফেনী অঞ্চলে এ মাসের গোড়ার  দিকে গেরিলা যোদ্ধার নতুন কৌশল অবলম্বন করে শত্রু উপর মারাত্মক হামলা চালান। গত ৩ অক্টোবর দুঃসাহসী যোদ্ধারা ফেনীর কাছে মহুরি নদী পেরিয়ে পরশুরাম ও অনন্তপুর ছাউনি ফেলেন। পাকিস্তানীরা এ অবস্থায় মরিয়া হয়ে নিকট থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের উপর আক্রমণের সাহস দেখায়। গেরিলারা অত্যান্ত ক্ষিপ্রতার সাথে নিজেদের মধ্যে আশ্চর্য সমন্বয় সাধন করে বীর মুক্তি সেনানীরা মর্টার সহ ছোট ভারি অস্ত্র নিয়ে প্রবল আক্রমণ হানে। প্রচণ্ড লড়াইয়ের পড় ১৯ জন পাকসেনা নিহত হয়।

নোয়াখালীর অনন্ত পুরে মুক্তিবাহিনীর ৩ টি ঘাঁটিতে পাকসেনারা আক্রমণের দুঃসাহস দেখালে আমাদের বীর যোদ্ধারা তা প্রতিহত করতে এগিয়ে গেলে দুপক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড সঙ্ঘর্ষ বাদে – পরে এ আক্রমণে শত্রুপক্ষের ৩০ সৈন্য নিহত হয়।

 

 

 

কুষ্টিয়ায় উভয় পক্ষের মধ্যে মুখোমুখি এক সঙ্ঘর্ষ

 

গত ২২ সেপ্টেম্বর দুই কোম্পানি পাকফৌজ তেঁতুল বাড়িয়া গ্রামের আওয়ামীলীগ দলীয় চেয়ারম্যানের বাড়িতে আগুণ ধরিয়ে দিলে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ঘিরে ফেলে। মুখোমুখি এই সঙ্ঘর্ষে পাকসেনাদের ৩ জন খতম হয় ও ৫ জন গুরুতর আহত হয়। ভীত সন্ত্রস্ত খানসেনারা পার খেয়ে পলায়নকালে প্রচুর অস্ত্র ও পোশাক ফেলে কেটে পরে।

 

ওই দিন দুঃসাহসী  মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুদের ওপর আরও একটি আক্রমণ চালায়। ফলে ৩ জন সৈন্য নিহত ও ১৩ জন আহত হয়।

 

কুষ্টিয়া জেলার টংটর কাছে বেলগাছিয়া গ্রামে পাকসেনারা হামলা করে ১০ জন নিরীহ নাগরিক নির্মম্ভাবে নিহত করে।

মুক্তিযোদ্ধারা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন ও ৫ জন খানসেনা নিহত করে ।

 

যশোর – খুলনা – পাজিঘাট, কার্মার, যশোর – খুলনা খণ্ডের পশ্চিম বাগ ও শ্যাম পুকুর গ্রামের পাকিস্তানী ঘাঁটির উপর মুক্তিযোদ্ধারা প্রচণ্ড আক্রমণ করে। এতে বীর যোদ্ধারা হাল্কা মেশিন গান ও ভারী মর্টার ব্যাবহার করেন। ফলে ১০০ জন খানসেনা নিহত হয় । মুক্তিবাহিনীর মর্টারে ৩ টি বাঙ্কার ধ্বংস হয়।

 

 

রংপুর খণ্ডে প্রচণ্ড সঙ্ঘর্ষ

মুক্তিবাহিনীর অসম সাহসী যোদ্ধারা দুর্বার গতিতে ওয়াক সামরিক ঘাঁটি গুলিতে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। গত ৩০ সেপ্টেম্বর রংপুর – দিনাজপুর – রাজশাহী অঞ্চলে ভূত মারিতে গেরিলা যোদ্ধারা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে পাকসেনাদের আক্রমণ করে ৪ জন নিহত করে।

 

গত সপ্তাহে গেরিলারা রৌমারি এলাকায় আক্রমণ করে ১০০ সৈন্য ও রাজাকার নিহত করে। এছাড়া ২০০ রাজাকার গুরুতর আহত হয়।

 

 

প্রধান সেনাপতির পূর্ব রণাঙ্গন সফর

 

গত সপ্তাহে বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম এ জি ওসমানী পূর্ব রণাঙ্গনের অগ্রবর্তী অঞ্চল, বিভিন্ন হাসপাতাল ও মুক্ত সেনাদের হইবির পরিদর্শন করেন। তিনি রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্যেশ্যে বিভিন্ন স্থানে ভাষণ দেন। 

মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি মুক্তিযোদ্ধাদের কঠোর মনোবল, অসম সাহস, দুর্জয় আত্ম বিশ্বাস ও আত্ততসর্গের বিপুল প্রেরণা দেখে গর্ব বোধ করেন। তিনি তাদেরকে আরও তৎপর হতে ও ত্যাগ স্বীকারের আহবান জানান। তিনি ভাষণ দান কালে মুক্তিযোদ্ধাদের অসম সাহসিকতা ও দেশাত্মবোধের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। সমগ্র জাতী তাদের এই দুঃসাহসের জন্য গর্বিত বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি আরও বলেন যে, ৬ মাসের যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা যে সাহসিকতা দেখিয়েছেন তাতে করে আমাদের জনসাধারণের আত্ম বিশ্বাস আরও বেড়ে গেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের অপূর্ব গেরিলা রণ কৌশলের প্রশংসা করে তিনি একথা বলেন, ‘ আপনারা একটি জাতী হিসেবে বেঁচে থাকার প্রশ্নে আজ এই লড়াইয়ে অবতীর্ন হয়েছেন। ‘ কঠোর আত্ম প্রত্যয় ও সাহসিকতা নিয়ে প্রচণ্ড দুর্যোগের মধ্যে দাঁড়িয়ে আপনারা রণক্ষেত্রে এক নজির বিহীন সাফল্য অর্জন করছেন। এই প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন যে, আপনারা যদি শৃঙ্খলার সাথে এভাবে লরে যান তাহলে সারা পৃথিবীতে একটি অন্যতম সৈন্য বাহিনী হিসাবে নিজেদেরকে চিনহিত করতে পারবেন। কর্নেল ওসমানী অগ্রবর্তি হাসপাতাল গুলো পরিদর্শঙ্কালে রোগীদের শয্যা পাশে গিয়ে প্রাণ খুলে কথা বার্তা বলেন। তিনি কর্মরত চিকিৎসক ও নার্সদের হাসপাতালের কর্ম তৎপরতা ও রোগীদের অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তিনি তাদেরকে স্বাধীনতার কাজে তাদের নিশার্থ সেবা ও ত্যাগ স্বীকারের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

 

এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, অগ্রবর্তী হাসপাতাল গুলোর চিকিৎসক ও নার্স সকলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রী।

–       জয় বাংলা, ১৫ অক্টোবর, ১৯৭১

 

 

 

রণাঙ্গন থেকে বলছি

 

গত ৬ মাসে স্বাধীনতাকামী মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের তৎপরতা দিনের পর দিন সাফল্যের সিংহ দ্বারে গিয়ে পৌছতে আরম্ভ করেছে। সম্প্রতি পাক বাহিনী তাদের বহু ঘাঁটি থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে।

 

কুমিল্লা – গেরিলারা কুমিল্লা শহরের বিচিন্ন অঞ্চলে সাফল্য জনকভাবে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি কুমিল্লা জিলা স্কুল ও কান্দির পাড়ে গ্রেনেড চার্জ করে ও দখলদার বাহিনীর ক্ষতি সাধন করে।

 

অন্য একটি সংবাদে প্রকাশ, গেরিলারা জালুয়ার পারায় একজন পাক মেজর ও তার ৬ সঙ্গীকে খতম করে ও তাদের অস্ত্র নিয়ে আসে।

 

কুমিল্লায় রেল যোগাযোগ ব্যাবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। কুমিল্লা খণ্ডে ফেনী ও বেলোনিয়ার মধ্যবর্তী ফুল্গাজি রেল সেতুটি গেরিলাদের হাতে বিধ্বস্ত হয়। এসপ্তাহের গোড়াতে এই ঘটনা ঘটেছে বলে বাংলাদেশ বাহিনীর হেড কোয়ার্টার থেকে প্রকাশিত যুদ্ধ বুলেটিনে বলা হয়েছে।

 

ফেনী ও বিলোনিয়াতে এখন পর্যন্ত পাক জল্লাদের সঙ্গে গেরিলাদের প্রচণ্ড লড়াই চলছে।

গত ৪ অক্টোবর কুমিল্লার কষবার কাছে তৃতীয় পাঞ্জাব রেজিমেন্টের একটি লঞ্চ গেরিলারা দুনিয়ে দেয়। এতে বুহু পাকসেনা খতম হয়।

 

বাঞ্ছারামপুরে আরেকটি লঞ্চ গেরিলারা ডুবিয়ে দেয়। এতে ১০ জন পাকসেনা মারা যায়।

ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, একই অঞ্চলে গেরিলারা ৩ টি দ্রুত গামী স্টিমার ডুবিয়ে দিয়েছে। এছাড়া পাকসেনারা ১০ টি নৌকার ও ক্ষতি করেছে।

 

গত সপ্তাহে কুমিল্লার কষবার কাছে মুক্তিযোদ্ধারা অতর্কিত একটি পাক সৈন্যবাহিনী লঞ্চ আক্রমণ করে ২০০ পাঞ্জাবি সৈন্য খতম করে। বাঞ্ছারামপুরেও পাকসেনাদের আরেকটি লঞ্চ ডুবিয়ে দিয়ে ১০ জন ও ওই এলাকায় আরেক আক্রমণে ৩ টি গানবোট ডুবিয়ে ও ১০ টি নৌকার ক্ষতিসাধন করে একজন লে কর্নেল ও ১ জন ক্যাপ্টেন সহ ১৪ জন পাকসেনা খতম করে। আম্রাতলিতে নয়নপুরে রেল স্টেশনের কাছে  ৩ জন পাক হানাদারকে খতম করে।

 

নোয়াখালীতে – ফেনী অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের উপর দুর্বার আক্রমণের জন্য পরশুরাম ও অনন্ত পুরে ঘাঁটি গড়ে। নিজেদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে মুক্তিযোদ্ধারা মর্টার সহ ছোট ও ভারি অস্ত্র নিয়ে প্রবল আক্রমণের পর ১৯ জন পাকসেনা খতম করে। এতে পাকসেনারা পিছনে হততে থাকলে মুক্তিযোদ্ধারা এগিয়ে সরাসরি আক্রমণ লিপ্ত হয়ে আরও ৪০ জনকে খতম করে। এরপর অনন্তপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি আক্রমণ করলে তারা ৩০ জনকে ঘায়েল করে। গেরিলা রণকৌশল অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধারা সাময়িক পিছিয়ে যায়। কিন্তু কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই নতুন উত্যম নিয়ে আবার অধিকতর শক্তিতে আক্রমণ করলে অষ্টাদশ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ৩০ সৈন্য খতম হয়। আবার পুনিরায় নিজেদের ঘাঁটি দখল করে।

 

বর্তমান খবর অনুসারে ফেনী ও বিলোনিয়ার গেরিলা ও পাক হানাদারদের মধ্যে প্রবল যুদ্ধ চলাকালে একজন জে সি ও সহ ২৭ জন শত্রু সৈন্য খতম হয় এবং গেরিলারা ফেনী ও বিলনিয়ার সংযোগ রক্ষাকারী ফুল্গাজি রেল সেতুটি উড়িয়ে দেয়।

 

রাজশাহী – এমাসের প্রথম সপ্তাহে রাজশাহী ও নবাব গঞ্জের মধ্যবর্তী রেলপথে গেরিলারা আক্রমণ করে একটি সইন্যবাহি ট্রেন বিধ্বস্ত করে ২৩ পাকসেনা নিহত করে।

 

খঞ্জল্পুর ও শিবরামপুরে গেরিলারা পাকসেনাদের উপর ঝটিকা আক্রমণ করে আরও ২১ জন নিহত করে।

 

রংপুর – এই জেলার পশ্চিম ভুরুংগমারিতে পাকসেনারা যখন পরিখা খনন করছিল তখন মুক্তিযোদ্ধারা তাদের উপর ঝটিকা আক্রমণ করে ও তাদের ২ টি গাড়ি বিধ্বস্ত করে।

 

দিনাজপুর – এমাসের প্রথম সপ্তাহে মোগলহাটিতে মুক্তিবাহিনী ও পাকসেনাদের মধ্যে গুলি বিনিময় হয়, ৭ জন হতাহত হয়। এতে মুক্তিযোদ্ধাদের ৭ জন সামান্য আঘাত পায়।

 

চট্টগ্রাম – ৬ অক্টোবর শাকা চট্টগ্রামের মধ্যবর্তী পথে যখন পাকসেনারা একটি গাড়িতে মাল বোঝাই করছিল তখন গেরিলারা তাদের উপর হ্যান্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে । ফলে ৩ জন পাকসেনার মৃত্যু ঘটে।

 

সিলেট – গত ৭ অক্টোবর রাতে গেরিলারা কামদেব পুরে পাকসেনাদের চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলে ও তাদের ১ মেজর সহ ২৫ জন পাকসেনাকে খতম করে।

 

চম্পকনগরে মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের বিব্রত করে তোলে ও ৩ জনকে খতম করে।

 

টাঙ্গাইল – গত ৮ চটবের কাগ মারি অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের উপর সজোরে আক্রমণ চালিয়ে ৫ জন কে খতম করে ও টাঙাইলের এক বিস্তীর্ন এলাকায় হানাদার ও মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে প্রচণ্ড লড়াই চলছে।

–       সাপ্তাহিক বাংলাদেশ, ১৫ অক্টোবর , ১৯৭১

 

 

গেরিলাদের অব্যার্থ গুলিতে মোনেম খাঁ খতম

(নিজস্ব সংবাদ দাতা পরিবেশক)

 

জল্লাদ ইয়াহিয়ার পূর্ব সুরী আইয়ুবের কুখ্যাত সহচর মোনায়েম খাঁ মুক্তিযোদ্ধাদের অব্যার্থ গুলিতে খতম হইয়াছে।

গত ১৩ অক্টোবর মনায়েম খাঁ ঢাকায় গুলিবিদ্ধ হয়। পরে তাকে হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হলে সেখানেই তার মৃত্যু ঘটে।

 

মোনায়েম খাঁ ১৯৬৪ সাল হইতে ১৯৬৯ সালের মার্চ পর্যন্ত তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসাবে আইয়ুবের সকল দুস্কর্মের সাথী ছিল। ফলে সে বাঙ্গালীদের তীব্র ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়। গভর্নরের পদ হইতে অপসারণ হবার পরেও মনায়েম খাঁর পক্ষে প্রকাশ্যে চলাফেরা কিংবা জনসমাজে মেলামেশা করা সম্ভব ছিলোনা। ইয়াহিয়ার আমলে সে পুনরায় মাথা চারা দিয়ে ওঠার চেষ্টা করে।

 

২৫ মার্চের পড় সে জল্লাদ ইয়াহিয়া চক্রের দালালিতে আত্ম নিয়োগ করিয়াছিল। কিন্তু বাঙ্গালদেশের বীর স্বাধীনতা সংগ্রামীরা তাহার মীর জাফরির উচিৎ সাজা দিয়াছে।

–       মুক্তিযুদ্ধ, ১৭ অক্টোবর, ১৯৭১

 

 

 

 

স্রীহট্টে ছাতক শহরে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন

 

১৬ অক্টোবর মুক্তিযোদ্ধারা ছাতক সিমেন্ট কাড়খানা ও শহরের ওপর বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেছে। স্রীহট্ট জেলার সুরমা নদীর উত্তর তীরে এই শিল্প নগরীটিকে পুনরায় অধিকার করার পড় এই পতাকা উত্তোলন করা হয়।

দক্ষিণ তীরে ছাতক বাজারের জন্য তুমুল যুদ্ধ চলছে। সীমান্তের ওপার থেকে এই খবর এসে পৌঁছেছে।

 

মুক্তিযোদ্ধারা ছাতক ও জেলা সদর কার্যালয় শহর শ্রী হট্ট টাউনের  মধ্যে রেল ও সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। ছাতক বাজার মুক্তিযোদ্ধারা দখল করবে মনে হচ্ছে।

 

মুজিবনগর থেকে ইউ এন আই এর খবরে প্রকাশ, চলটি মাসের প্রথম সপ্তাহে গেরিলারা চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ, মাদির বাড়ি, মাদিন ঘাট, চাঁদপুর এ ৪ টি পাওয়ার সাব  স্টেশন ধ্বংস করে দিয়েছে। ফলে টাউন ও মধ্যবর্তী অঞ্চল অন্ধকারে ঢেকে গেছে। এখানে বাংলাদেশ বাহিনীর সদর কার্যালয়ে এক যুদ্ধ বুলেটিনে এ খবর জানা গেছে।

 

৭ অক্টোবর চট্টগ্রামের কাপতাই লাইনে গেরিলা বাহিনী বৈদ্যুতিক লাইন ধ্বংস করে দিয়েছে।

 

১২ অক্টোবর পাক বাহিনীর সঙ্গে এক সঙ্ঘর্ষে মুক্তিযোদ্ধারা ৩ জন পাকসেনাকে খতম করে। গুথুমা ও পূর্ব দেবপুরে পাকসেনাদের উপর দুটি পৃথক আক্রমণে ২ জন নিহত ও ৮ জন আহত হয়।

 

নোয়াখালী জেলার ছাগল নাইয়া থানায় হানা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ৪ জন পাকসেনা খতম করে। গত সপ্তাহে ঢাকা জেলায় হরি রামপুর ও মালুচিম বাজারে তারা ২৫ জন পাকসেনাকে খতম করে।

 

 

 

মুক্তিবাহিনী মার মুখি – নিজস্ব নৌ বহর তৈরি, বৈমানিকরা সংগঠিত

 

কৃষ্ণ নগর, ১৬ অক্টোবর – বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনী এখন মারমুখী। আর শুধু গেরিলা লড়াই নয়, অ্যামবুশ বা চোরাগুপ্তা গুলি চালানো নয়, তারা এনকাউন্টার বা সম্মুখ সমরের জন্য তৈরি। প্রমাণ? প্রমাণ পশ্চিম সেক্টরের ২ জায়গায় তারা ২৪ ঘণ্টায় ৬৬ জন পাকসেনাকে নিহত করেছে। ঢাকাতে এক জায়গায় ২৫ জন পাকসেনা তাদের হাতে প্রাণ হারিয়েছে।

কুমিল্লা চট্টগ্রাম সেক্টরেও মুক্তিবাহিনী দারুণ সক্রিয়। পাকসেনারা মরছে তাদের হাতে। এই অঞ্চলে তাদের মৃত্যু হাড় এখনো খুচরা ধরণের। কোথাও ২ কোথাও ৪। জখম হচ্ছে অনেক।

 

নৌবহর, বৈমানিক সমিতি। মুজিবনগর থেকে দুটি তাতপর্যপূর্ণ খবর এসেছে। একটি হল বাংলাদেশের কোন এক জায়গায় মুক্তিবাহিনীর নিজস্ব নৌবহর সঙ্ঘটিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর নামে এই নৌ বহরের নাম দেয়া হয়েছে। আপাতত এতে আছে ৫ টি মোটর বোট – সব কয়টি পাক ফৌজের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া।

 

দ্বিতীয় সংবাদ টি হল – বাংলাদেশের বিমান কর্মি ও বৈমানিকরা মিলত হয়ে একটি সংস্থা গঠন করেছেন। তার কোওর্ডিনেটর হয়েছেন শ্বরই এস এ হোসেন। এর আগে পাক বিমান বহর ও পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ওয়েজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

 

উপরের সব কয়টি পি টি আই ও ইউ এন আই এর সূত্রে পাওয়া।

–       আনন্দ বাজার পত্রিকা, ১৭ অক্টোবর, ১৯৭১

 

 

 

রণাঙ্গন থেকে

(নিজস্ব প্রতিনিধি)

 

গত ২০ সেপ্টেম্বর রংপুর জেলার ডিম্লা থানার অন্তর্গত সুটিবাড়ি হটের পশ্চিমে জোড়জিগা গ্রামে মুক্তবাহিনির অতর্কিত আক্রমণে ৯ জন পাকসেনা নিহত হয়। কয়েকজন উক্ত অঞ্চল হতে অস্ত্র রাখিয়া কোন রকমে পলায়ন করে।

 

উক্ত থানর বালাপাড়া গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা কর্তৃক মাইন বিস্ফোরণে ৬ পাকসেনা নিহত হয়। প্রকাশ মুক্তিযোদ্ধারা রাস্তায় মাইন পুঁতিয়া রাখিয়াছিল। সকালে মহিষের গাড়ীতে চড়িয়া ৬ জন পাকসেনা যাওয়ার সময় মাইন বিস্ফোরিত হয় ও গাড়ওয়ান সমেত ৭ জন নিহত হয়। পরবর্তিকালে বর্বর পাকবাহিনী বালাপাড়া গ্রামকে সম্পূর্ন ভাবে জ্বালাইয়া দেয়।

 

গত ২১ সেপ্টেম্বর বর্বর পাক ফৌজ ডিম্লা থানার অন্তর্গত খড়িবাড়ি গ্রামের তূণীর হাট জ্বালাইয়া দেয়।  ফলে স্থানীয় অনেক  ব্যাবসায়ীর বহু সম্পত্তি বিনষ্ট হয়। উক্ত এলাকায় মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা বৃদ্ধি পাইয়াছে।

 

গত ২৮ তারিখ রাতে ছাত্নাই গ্রামে ৭০ বছরের এক বৃদ্ধাকে হানাদার পিশাচরা নির্মম ভাবে হত্যা করিয়াছে। জানা গিয়াছে যে, উক্ত বৃদ্ধার পুত্র মকবুল হোসেন কে মারার জন্য সেদিন রাতে জানালা দিয়া গুলি করে , কিন্তু সে ঘরে না থাকায় তাহার বৃদ্ধা মাতা গুলিবিদ্ধ হইয়া মৃত্যুবরণ করেন।

 

দিনাজপুর – গত ২৬ সেপ্টেম্বর রবিবার দিনাজপুরের বোদা থানার অন্তর্গত মারেয়া গ্রামে একদল পাহফৌজ ও রাজাকার বাহিনী স্থানীয় ন্যাপ ও আওয়ামীলীগের কর্মিদের একটি পাড়া পোড়াইয়া দেয়। সেই সময়ে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের কমান্ডার  মাহবুবের নেতৃত্বে উক্ত পাক বাহিনীকে পাল্টা আক্রমণ করে এবং একজন রাজাকার কে জীবিত অবস্থায় অস্ত্র সহ গ্রেফতার করিতে সক্ষম হয়। আরও প্রকাশ থাকে যে, উক্ত গ্রামে ঠাকুরগাঁও মহকুমা নয়ায়ের যুগ্ম সম্পাদক শফিকুল আলম চৌধুরী ও বোদা থানা ন্যাপের সম্পাদক আব্দুর রউফ কে জীবিত অবস্থায় তাহাদের হাট হইতে উদ্ধার করে।

 

১ অক্টোবর বোদা থানার অন্তর্গত পাক ফৌজ অধিকৃত নয়াদিঘিতে অতর্কিত আক্রমণ চালাইয়া পাকফৌজের ঘাঁটি ও ইউনিয়ন কাউন্সিল অফিস সম্পূর্ণ রূপে বিধ্বস্ত করিয়া দেয়। নয়াদিঘি ও বোদার মধ্যে সংযোগ কারী ৪০ ফুট দির্ঘ একটি পুল মুক্তিবাহিনী সম্পুর্ন রূপে ধ্বংস করিয়া ফেলে। ফলে ভিত সন্ত্রস্ত পাক হানাদাররা উক্ত এলাকা থেকে পিছি হটতে বাধ্য হয়। নয়াদিঘি বর্তমানে মুক্তিবাহিনীর পূর্ন দখলে।

 

বিলম্বে প্রাপ্ত খবরে জানা যায়, গত মাসের প্রথম দিকে গেরিলারা ঢাকা জেলার রায়পুরা থানায় কয়েকটি অভিযানে শতাধিক শত্রুসেনা খতম করেছে।

 

গত ৩ সেপ্টেম্বর রায়পুরা থানার টি ডি সেক্টরই অবস্থিত শত্রু ঘাঁটিটি গেরিলারা গভীর রাতে চতুর্দিক হইতে ঘিরিয়া ফেলে। উভয় পক্ষে ৬ ঘণ্টা তুমুল সঙ্ঘর্ষে ৫০ জন পাকসেনা ও ৬০/৭০ জন রাজাকার নিহত হয়। প্রায় ৩৪ জন দালাল অবাঙ্গালী ই পি আর ও রাজাকার আত্ম সমর্পন করে। এই সঙ্ঘর্ষে ৭ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হইয়াছেন।

 

গত ২৪ সেপ্টেম্বর রায়পুরার আমির গঞ্জে রেল স্টেশনের কাছে মাইনের সাহায্যে মুক্তিবাহিনী ২ টি রেল সেতু উড়াইয়া দেয়।

 

চট্টগ্রাম – গতমাসে চট্টগ্রামের ৩ জন কুখ্যাত দালাল খতম হইয়াছে। ইহাদের মধ্যে ফ কা চৌধুরির ঘনিস্ট সহচর তাজুল ইসলাম প্রকাশ্য দিবালোকে আদালতে সাক্ষ্য দিতে আসিলে জনৈক গেরিলার বোমার আঘাতে নিহত হয়। অপর দুইজন হইতেছে কুসুমপুরের শান্তি কমিটির হোতা মুসলিম লিগের দালাল আব্দুল হাফিজ ও নুরুল হক।

–       মুক্তিযুদ্ধ , ১৭ অক্টোবর, ১৯৭১

 

 

 

 

 

পাক সরকারের স্বীকারোক্তি

 

বাংলাদেশের জনজীবন স্বাভাবিক ও সাবলীল ভাবে চলছে বলে পাক সরকারের বিভ্রান্তি কর মিথ্যে প্রচার কার্যে বাংলাদেশ তথা বিশ্ববাসীকে কীভাবে ধাপ্পা দিচ্ছে নিম্নে প্রদত্ত পাক সরকারের কয়েকটি ‘গোপনীয়’ ‘ সার্কুলার’ তারা ফাঁস করে দিয়েছে –

 

অনুলিপি –

ন- ৮৪২ (১৫৮) ন্ড পোল/৫ (১) পূর্ব পাকিস্তান সরকার স্বরাষ্ট্র দপ্তর (রাজনৈতিক) – পূর্ব পাকিস্তানে আগস্ট ১৯৭১ এর  প্রথমার্ধে সঙ্ঘটিত অবস্থা নিয়ে পাক্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন  –

১৭ নং

 

কুমিল্লা, রাজশাহী, যশোর বোর্ড কর্তৃক অনুষ্ঠিত স্কুল ফাইন্যান্স ও উচ্চ মাধ্যমক পরীক্ষা গত ৫-৮-৭১ তারিখে ও ঢাকা বোর্ডের পরীক্ষা ১২-৮-৭১ তারিখে অনুষ্ঠিত হয়েছে কিন্তু উপস্থিত পরিক্ষার্থির সংখ্যা খুব ই কম।

 

১৯ নং

পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ গুলো গত ২-৮-৭১ তারিখ হতে খোলা হয়েছে – কিন্তু ছাত্র ছাত্রীর উপস্থিতি নেই। ধারনা করা হচ্ছে অধিকাংশ ছাত্র ও আওয়ামীলীগের ব্যয়গত অসহযোগ আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করেছিল এবং কত্রিপক্ষ কর্তৃক তারা কারারুদ্ধ হয়েছে।

 

বিবিধ –

বিভিন্ন জেলায় বিপ্লবীদের একপক্ষ কালের ক্ষয়ক্ষতির খতিয়ান –

 

2- খুলনার পারুলিয়া অঞ্চলে ‘হাই ওয়ে ব্রিজ’ পাহারারত একজন এ এস আই ও ২ জন কনস্টেবল মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে নিহত হন। 

 

৪-গত ৬-৮-৭১ তারিখ রাত ৩ টায় ৪০ জন মুক্তিবাহিনী যশোরের শৈলকুপা থানা আক্রমণ করে , সি ও , এস আই ও কয়েকজন কনস্টেবল কে ধরে নিয়ে যায় ও থানার প্রভূত ক্ষতি সাধন করে।

 

১৫- গত ১০-৮-৭১ তারিখ আনুমানিক ১২-১৫ মিনিটের সময় মুক্তিবাহিনীর এক  অতর্কিত আক্রমণে ৯১ নং বৈদ্যুতিক টাওয়ার সম্পূর্ন ধ্বংস করে দেয়। ইহা ছাড়া ঢাকার অন্তর্গত জয়দেবপুর সড়কের উপরিস্থিত কয়েকটি বৈদ্যুতিক পোল বিনষ্ট করে দেয়।

 

যথাক্রমে ২-৮-৭১, ৬-৮-৭১ ও ১১-৮-৭১ তারিখে ঢাকার জিন্না এভিনিউ , নিউ মার্কেট বাস স্ট্যান্ড ও হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল মুক্তিবাহিনীর হাট বোমা ও গ্রেনেড আক্রমণে বিশেষ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

 

–       বিপ্লিবি বাংলাদেশ, ১৭ অক্টোবর, ১৯৭১

 

 

 

খুলনা সেক্টরে ৫০০ খানসেনা নিহত

 

মুক্তিযোদ্ধাদের হিসাবে দেখা গেছে যে, গত দুমাসে তাদের হাতে খুলনা সেক্টরের বিভিন্ন স্থানে লড়াইয়ে ৫০০ খানসেনা ও ২০০ রাজাকার নিহত হয়েছে। তাছাড়া ৬০০ টি পাক রাইফেল দখল করা হয়েছে ও ৬০ জন রাজাকার মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্ম সমর্পন করেছে।

 

কুমিল্লা জেলার কসবা এলাকায় ৩ ঘণ্টা ব্যাপী এক তুমুল সঙ্ঘর্ষে ৩৫ জন পাকসেনা নিহত ও ১৫ জন আহত হয়েছে।

 

সংবাদে প্রকাশ, মর্টার ও মেশিনগানে সজ্জিত বাংলাদেশ গেরিলাদের অতর্কিত আক্রমণে বহু পাকসেনা হতাহত হয়েছে। মুক্তিবাহিনী ৫ টি বেয়নেট ও ২৫০ রাউন্ড চিনা বুলেট দখল করে নিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের একজন কমান্ডো আহত হয়েছে বলে সংবাদে বলা হয়েছে।

 

অন্য এক সংবাদে জানা গেছে, গত ২৮ সেপ্টেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা মর্টার ও হাতবোমা নিয়ে আধার মানিক এলাকায় পাক ঘাঁটিতে আঘাত হানে। ময়মন সিংহ অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধারা বাহাদুরাবাদে পাকসেনাদের একটি লঞ্চ ধ্বংস করায় ২০ জন সৈন্য হতাহত হয়েছে।

 

 

মুক্তিফৌজে যোগদান

 

খুলনা সেক্টরের মুক্তিফৌজ সূত্রে প্রাপ্ত সংবাদে জানা গেছে যে, বাংলাদেশে দলে দলে লোক মুক্তবাহিনিতে যোগদান করার জন্য এগিয়ে আসছেন। তাছাড়া অনেক অসামরিক ব্যাক্তি মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সাহায্য করছেন। বরিশালের উজিরপুরে বাংলাদেশের জনৈক নাগরিক মুক্তিযোদ্ধাদের এক লক্ষ টকা নগদ দিতে চাইলে মুক্তিযোদ্ধারা তা গ্রহণ না করে ঐ টাকার পরিবর্তে খাদ্য সামগ্রী দেবার জন্য অনুরোধ করেন।

 

মুক্তিফৌজ যোগদানেচ্ছু ব্যাক্তিদের মধ্যে অধিকাংশই ছাত্র ও প্রাক্তন সৈন্য বিভাগের লোক।

 

 

 

৮ টি মালবাহী জাহাজ নিমজ্জিত

 

চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরে সম্প্রতি যে ৮ টি মালবাহী জাহাজ ডুবিয়ে দেয়া হয়েছে সে সম্পর্কে আরও বিস্তারিত সংবাদ জানা গেছে। নিমজ্জিত ৮ টি জাহাজের মধ্যে ৬ টি বিদেশী ও ২ টি পাকিস্তানী জাহাজ।

 

মুক্তিযোদ্ধাদের জনৈক মুখপাত্র বলেন যে, মংলা বন্দরে মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতায় সমুদ্রগামী ২ টি মার্কিন, ২ টি চিনা, ১ টি পাকিস্তানী ও ১ টি জাপানী জাহাজ নিমজ্জিত হয়েছে।

 

 

 

১০ কোটি টাকার পাক জাহাজ নষ্ট

 

চট্টগ্রাম বন্দরে মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতায় ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ১৫ হাজার তোঁ ওজনের পাকিস্তানী হাজাজ আল আব্বাস জ্বলে দুনে গেছে। পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খাঁ ১৯৬৮ সালে এই জাহাজটি যাত্রার উদ্বোধন করেছিলেন।

 

মালবাহী একটি লঞ্চ সহ ১৫০০০ টন ওজন বাহী জাহাজ ফরমোজা ও ১৫/১৬ আগস্ট গেরিলা আক্রমণের ফলে জ্বলে ডুবে গেছে।

 

 

মাতৃভূমি বাংলাদেশের রণাঙ্গনে

 

মুজিবনগর, ৬ অক্টোবর – পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর ২২ জন অফিসার ও ৪০০০ এর বেশী সৈন্য , রাজাকার ও বদর বাহিনীর লোক নিহত হয়েছে। বীর মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন রণাঙ্গনে প্রায় ২৫০০ কমান্ডো আক্রমণে উক্ত শত্রুদের খতম করেছে। অন্যদিলে রসদ ও অস্ত্রের অভাবে অগ্রবর্তি ঘাঁটিতে পাকসেনাদের মনোবল উল্লেখযগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। আগরতলা থেকে সীমান্তের ওপারের খবর একথা জানা যায়।

–       সংগ্রামী বাংলা, ১৮ অক্টোবর, ১৯৭১

 

 

দিশেহারা জঙ্গিশাহির জেট বিমান ব্যাবহার

 

মুজিবনগর, ১৮ অক্টোবর – গতকাল ও পরশুদিন দিনাজপুর ও বগুড়া জেলায় কয়েকটি অভিযান চালিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ৩২ জন পাকসেনা খতম করেছে বলে খবর পাওয়া যায়। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধারা একটি রেল লাইন উড়িয়ে দিয়েছে।

 

বাংলাদেশ বাহিনীর হেড কোয়ার্টারে পাওয়া সংবাদে জানা গিয়াছে, গত পরশু বগুড়া জেলার হিলই ও পাঁচবিবির মাঝখানে একটি রেল লাইন উড়িয়ে দিয়ে ফেরার পথে পাকসেনাদের সাথে মুখোমুখি সঙ্ঘর্ষে ১ জন ক্যাপ্টেন সহ ৫ জন পাকসেনা খতম করেন। এইদিন রাতেই দিনাজপুরের ভয়াল গঞ্জের কাছে মর্মরটার চালিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা আরও ১৭ জন পাকসেনা হত্যা করে।

 

কৃষ্ণ নগর থেকে আমদের সংবাদ দাতা জানিয়েছেন , মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে সীমান্তের নিকতবর্তী অঞ্চলে আরও ৭ কোন পাকসেনা খতম হয়েছে।

 

দিনাজপুরের কাছে অস্ত্র সহ রাজাকারদের আত্ম সমর্পনের খবর পাওয়া গিয়েছে।

 

শিলং থেকে পাওয়া খবরে জানা গিয়েছে যে, ছাতকের আসে পাশে মুক্তিযোদ্ধা ও পাকসেনাদের সাথে জোর লড়াই চলছে।

মুক্তিযোদ্ধাদের সূত্রে বলা হয়েছে, এই লড়াইয়ে আহত ১ জন পাক ব্রিগেডিয়ারকে হেলিকপ্টারে অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়েছে। আহতদের মধ্যে একজন মেজর ও সুবেদার আছেন। দুদিনের লড়াইয়ে মোট ৫০ জন পাকসেনা খতম হয়েছেন । ডুবে যাওয়া পাক মোটর লঞ্চের সংখ্যা ৩।

–       পি টি আই, ইউ এন আই

 

 

পাক বাহিনীর স্যাবর জেট ব্যাবহার

 

গতকা স্রীহট্ট জেলার সিমেন্ট শিল্প নগরী ছাতকের কাছে মুক্তিবাহিনীর অপ্রতিহত গতিরোধের উদ্যেশ্যে পাক্স জঙ্গি শাহি স্যাবর জেট বিমান ব্যাবহার করেছে। ছাতক শহরকে কেন্দ্রে করে মুক্তিযোদ্ধা ও পাকসেনাদের মধ্যে প্রচণ্ড লড়াই চলছে।

–       আনন্দ বাজার পত্রিকা, ১৯ অক্টোবর ১৯৭১

 

 

রণাঙ্গন সংবাদ – চিল্মারি রণাঙ্গন (রংপুর)

 

রৌমারি -১৮ অক্টোবর – আমাদের বিশেষ প্রতিনিধির পরিবেশিত সংবাদে প্রকাশ, গত ১৬ অক্টোবর অতি প্রত্যুষে বাংলার কৃতি সন্তান , মাতৃভূমির নিঃস্বার্থ সেবক ও অন্যতম ত্রাণকর্তা মেজর আবু তাহেরের নেতৃত্বে বাংমাতার মুক্তিপাগল সন্তানরা ছোট্ট একটি দল অতি সামান্য কিছু অস্ত্র সহ চিল্মারি গমন করে ও সেখানে গিয়ে আরও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে চিল্মারি বাজার, রসনা, থানার হাঁট, বালাবারি হাতে দস্যু পাক বাহিনীর বড় বড় ঘাঁটি গুলি আক্রমণ করে। ৭২ জন পাকসেনা ( সি এ এফ) ও ১৬ জন রাজাকার নিহত করে। তারপর ৬৩ জন রাজাকারকে বন্দি করে ৫৩ টি রাইফেল, ২ টি স্টেনগান ও প্রায় ৬০০ গুলি হস্তগত করে। এই সব মুক্তাঞ্চলে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করার সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার লোক মুক্তিফৌজের নিকট ছুটে আসে এবং জয় বাংলা , জয় শেখ মুজিব ধ্বনি দিতে থাকে।

 

বন্দি রাজাকার গণকে তাদের প্রধান পরিচালক কুখ্যাত পাক দালাল ও অত্যাচারী ওয়ালি মোহাম্মদকে এই অভিযানে প্রাপ্ত অস্ত্র সহ মুক্তিফৌজের অঞ্চলিক সদর দপ্তর রৌমারিতে বেলা ১১ টার সময় আনা হলে হাজার হাজার লোক ছুটে আসে ও বাংলার এইসব বৈরী সন্তানদের দেখার জন্য ঘিরে ফেলে। ওয়ালি মোহাম্মদের অত্যাচার ও কুকীর্তির আলোচনা করতে দর্শক জনতা কিছুক্ষণের মধ্যে মারমুখো হয়ে ওঠে। অবস্থা বেগতিক বুঝে কর্তৃপক্ষ তাকে ও অন্যান্য রাজাকারদের জনতার অগোচরে প্রেরণ করেন।

 

একই দিনে নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে একদল মুক্তিফৌজ রাজার ভিটায় আক্রমণ চালিয়ে  তিনজন পাকসেনাকে (সি এ এফ ) ও ১৫ জন রাজাকার কে খতম করে এবং কুখ্যাত দলাল পঞ্চু মিয়া সহ ২৬ জন রাজাকারকে গ্রেফতার করে। এই অভিযানে ৩৫ টি রাইফেল ও তিন সহস্রাধিক গুলি-বারুদ মুক্তিবাহিনীর হস্তগত হয়।

সংবাদে আরও প্রকাশ অদ্য দুপুর বেলা অন্য একজন রাজাকার চিলমারির অন্য এক শত্রুঘাটি থেকে ৬ টি রাইফেল সহ পলায়ন করে ও সন্ধ্যার কিছু পূর্বেই মুক্তিফৌজ অধিনায়কের কাছে এসে আত্মসমর্পন করে।

 

 

 

ময়মন সিংহ রণাঙ্গন

(হারুন হাবিব প্রদত্ত)

 

আনন্দবাড়ি – ১৭ অক্টোবর – মুক্তিফৌজ গেরিলাগণ গত ১২ অক্টোবর মোমেনশাহী জেলার ইসলাম পুর জুট ট্রেডিং কর্পোরেশন গুদামে অগ্নি সংযোগ করে ৭৫ হাজার মন পাট পুড়িয়ে দেয়। প্রকাশ থাকে যে, যোগাযোগ ব্যাবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার ফলে বহুদিন যাবত পাট গুদাম জাত ছিল।

 

এই তারিখে জামালপুরের উত্তরাংশের ধনুয়ার মুক্ত অঞ্চলের দিকে পাকসেনারা রাতের অন্ধকারে অগ্রসর হলে প্রহরারত স্বাধীনতা যোদ্ধাদের গুলিতে ২৭ জন পাকসেনা নিহত হয় ও বেশ কিছু অস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে আসে। গত ১৪ অক্টোবর গেরিলারা বাহাদুরাবাদ ঘাঁটের পাক ঘাঁটিতে অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে ১০ জন দস্যু সেনা ও ১৩ জন রাজাকারকে হত্যা করে। এই আক্রমণে পাকসেনাদের বহু সংখ্যক গোলাবারুদ মুক্তিসেনারা ধ্বংস করে দেয়।

 

অপরদিকে নেত্রকোনা মহকুমার কলমাকান্দা, মদন , বারারই ও গফরগাঁও স্টেশনে অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে কমপক্ষে ৫০ জন পাকসেনা ও দালাল কে হত্যা করে।

 

 

 

(জয়নাল আবেদিন প্রদত্ত)

 

মোল্লার চর , ১৭ অক্টোবর – পাক জল্লাদ বাহিনীর ১৯ টি বিরাট নৌকা আনুমানিক ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা মূল্যের রসদপত্র নিয়ে ঢাকার সাভার থেকে রওনা দিয়ে ফুলছড়ি ঘাঁটের কাছাকাছি পৌঁছালে আমাদের জলপথের অতন্দ্র প্রহরারত মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাপ্টেন আব্দুল হামিদের নেতৃত্বে উক্ত রসদ বোঝাই নৌকাগুলিতে অবরোধ করে ও মুক্ত অঞ্চলের প্রশাসকের নিকট অর্পন করেছে বলে প্রকাশ।

–       অগ্রদূত, ২০ অক্টোবর, ১৯৭১

 

 

হিসাব

(বিশেষ প্রতিনিধি)

 

গত মাসে পাকবাহিনীর ২২ জন অফিসার ও চার হাজারের বেশী সৈন্য, রাজাকার ও বদর বাহিনীর লোক নিহত হয়েছে। বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন রণাঙ্গনে প্রায় আড়াই হাজার কমান্ডো আক্রমণে উক্ত শত্রুদের খতম করেছেন।

 

প্রাথমিক খবরে জানা যায় যে, গেরিলা যোদ্ধারা ওই সময়ের মধ্যে ৯৩ টি গুরুত্তপূর্ণ সড়ক ও রেল সেতু উড়িয়ে দিয়েছে ও ৪৯ টি ট্রাক ই জীপ ধ্বংস করে দিয়েছে। বিভিন্ন স্থানে সেনাবাহিনির ৯ টি  ট্রেন লাইনচ্যুত করে দিয়েছে।

 

চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দরে মুক্তিযোদ্ধারা ৩ টি বর্ব জাহাজ ও ১ তো ট্যাংকার ডুবিয়ে দিয়েছেন। সৈন্য বাহি ১ টি বর্ব স্টিমার , ১১ তো লঞ্চ ও কয়েকটি গানবোটের ক্ষতি করা হয়েছে অথবা অকেজো করা হয়েছে। এই সময় গেরিলারা ৯১৮ টি রাইফেল সহ প্রচুর গোলাবারুদ দখল করে।

 

 

 

 

 

মুক্ত অঞ্চলের কথা

/পর্যটক/

 

পাক হানাদেরদের মনোবল হিমাংকে নেমে এসেছে – রংপুর জেলার কোন একটি মুক্তাঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর কমান্ড্যান্ট জানান। তিনি আরও বলেন , ওদের মনোবল যতোই ভেঙ্গে পড়ছে আমাদের মনোবল ততই দীপ্ত হচ্ছে। দলে দলে বাংলাদেশের যুবকরা মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিচ্ছে। প্রয়ঞ্জন অনুসারে ব্যাপক ভাবে প্রশিক্ষণ শিবির স্থাপন করতে না পারায় কয়েক হাজার শিক্ষণ গ্রহণেচ্ছু যবক কে ওয়েটিং লিস্টে অন্তর্ভূক্ত রাখা হয়েছে।

 

গেরিলা প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত মুক্তিবাহিনীর সৈনিকদের তৎপর আক্রমণের ফলে রংপুর সেক্টরে বিভিন্ন সংঘর্ষে খানসেনা ও মুক্তিবাহিনী দের তুলনামূলক আহত ও নিহতের হার যথাক্রমে ১০০-৫ জন। বাউরা ও পাটগ্রামের মুক্তাঞ্চলে কয়েকটি চিকিৎসা কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এখানে সবচেয়ে অভাব রয়েছে ওষুধপত্রের।  মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে সৈনিকদের প্রয়োজন অনুসারে যে রক্তের প্রয়োজন তারও অভাব দেখলাম। জনৈক নেতৃস্থানীয় ব্যাক্তি বলেন, বাংলাদেশ তথা তার নিপীড়িত নাগরিকদের প্রতি সহানুভূতিশীল রাষ্ট্র চিকিৎসায় একজন মুক্তিবাহিনী সৈনিকের মৃত্যু দশ খানসেনার নিরাপত্তা লাভের কারণ হবে। কারণ ১০ জন খানসেনার মোকাবেলা একজন মুক্তিবাহিনীর সদস্য আজ নিতে পারে। স্বাধীন দেশের সেচ্ছাসেবী প্রতিটি সৈন্যের মনোবল ভাড়াটে খানসেনাদের চেয়ে অনেক বেশী।

 

রংপুর জেলার কয়েক শত বর্গ মাইল মুক্ত এলাকায় অসামরিক প্রশাসক গন বিশেষ যোগ্যতার সাথে প্রশাসন ব্যাবস্থাকে জোরদার করে তুলেছেন। থানা শহর পাটগ্রাম ও রেল বন্দর বাঊড়ার দোকান পাট যথারীতি খোলা দেখলাম। পুর্ব নির্দিস্ত বারে পাটগ্রাম বাঊড়া ও বুড়ি মারিতে সপ্তাহে দুবার হাট বসছে। ঐ সহ হাটে বাজারে ভারতীয় মুদ্রা অবাধে চলছে। এমন বহু দোকানদার দেখলাম যারা পাক মুদ্রা গ্রহণ করতে চাইছেনা।

 

বুড়িমারি, ধবল সুতি, বাউড়ায় বাংলাদেশ সরকার কাস্টম চেকপোস্ট স্থাপন করে আমদানি ও রপ্তানি দ্রব্যের উপর কাস্টম চার্জ নিচ্ছে। কয়েক মাসের হিসাব দেখলাম। এইসব চেক পোস্টে মাসে  গড়ে প্রায় ৬ হাজার টাকা পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকার আমদানি ও রপ্তানি কর হিসাবে পাচ্ছে। ধবলসূতি ক্যাম্প ইন চার্জ প্রাক্তন পাক – এক্সসাইজ অফিসার – জনৈক হিন্দু ধর্মাবলম্বি মি সরকার জানালেন যে আর কিছু ছোট ছোট চেক পোস্ট স্থাপন করলে ট্যাক্স আদায় অনেক গুন বেড়ে যাবে।

 

বর্তমানে তামাকের উপর মন প্রতি ট্যাক্স দশ টাকা,  হাস মুরগি প্রভৃতির উপর ওইসবের বাজার দ্রব্যের দুই শতাংশ ট্যাক্স হিসাবে গ্রহণ করা হয়ে থাকে। বর্তমানে দেখলাম ৩২ টি আইটেমের উপর ট্যাক্স নির্দিস্ট করে দেয়া আছে। 

–       স্বদেশ, ২১ অক্টোবর, ১৯৭১

 

 

 

ময়মনসিংহের উত্তরাঞ্চলে মুক্তি ফৌজের বীরত্তপূর্ণ লড়াই

(বিশেষ সংবাদ দাতা)

 

ময়মন সিংহ রণাঙ্গনে অবস্থিত বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির লিয়াজো অফিস হইতে ময়নন সিংহের উত্তরাঞ্চলের কলমাকান্দা, হালুয়া ঘাট, নলিতাবাড়ি, নখলা প্রভৃতি থানার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বিরত্তপূর্ন লড়াইয়ের কয়েকটি খবর আমাদের নিকট আসিয়া পৌঁছিয়াছে এইসব থানায় উপর্যুপরি মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে পাকসেনারা বিপর্যস্ত হইয়া পরিয়াছে। প্রায় ২০০ পাকসেনা ও রাজাকার খতম ও বহু অস্ত্র ছিনাইয়া লওয়া হইয়াছে।

 

মেশিনগান, রাইফেল ও গ্রেনেড সজ্জিত হইয়া মুক্তিযোদ্ধাদের ৭০ জনের একটি দল এক অভিযানে ঠাকুরাকানার একটি পুল উড়াইয়া দিয়াছে। একই দিনে বেড়াইলে একটি পুলিশ বাহিনীর উপর আক্রমণ চালাইয়া থানার দারোগা, আনসার এডজুডেন্ট প্রভৃতিকে গ্রেফতার ও ৬ টি রাইফেল হস্তগত করা হয়। বিকাল বেলায় অতর্কিত আক্রমণ চালাইয়া ১৭ পাকসেনা খতম করা হয়।

 

 

 

কমলা কান্দা

 

মুক্তিযোদ্ধাদের উপরোক্ত দল কমলাকান্দা থানা আক্রমণ করিয়া ৪ টি রাইফেল , ১০ হাজার টাকার ঔষধ, নগদ ১৩৬৫ টাকা দখল করে। এতে ৫ জন রাজাকার নিহত ও থানার ছোট দারোগা আত্তসমর্পন করেন। থানা আক্রমণের পর নাজিরপুর যাওয়ার পথে পাকসেনারা তাদের আক্রমণ করে। এতে পাক বাহিনীর একজন মেজর সহ ১৭ জন পাকসেনা ও রাজাকার খতম হয়।

 

পাকসেনারা কমলা কান্দা থানা পুনরায় দখল করিলে মুক্তিফৌজ সাড়াশি আক্রমণ চালায়। কয়েন ঘণ্টা স্থায়ী সঙ্ঘর্ষে ১ জন কর্নেল সহ ২৭ জন পাকসেনা নিহত হয়। একই দিনে মুক্তিফৌজ নাজিরপুরে পাকসেনাদের ঘাঁটি আক্রমণ করিয়া ১৯ পাকসেনা নিহত ও রাজাকার খতম করে। মুক্তিফৌজদের কাছে মার খাইয়া পাকসেনারা আরও শক্তি বৃদ্ধ করিয়া ঝাপাইয়া পরে। তীব্র সঙ্ঘর্ষে আবার ১৪ জন পাকসেনাকে জীবন দিতে হয়। অপরপক্ষে মুক্তিফৌজএর ১- নুরুজ্জামান ২- ভবেশ দাস ৩- দ্বিজেন্দ্র চন্দ্র বিশ্বাস ৪- জামালুদ্দিন ৫- ইয়ার মাহমুদ ৬- ফজলুল হোক ৭- ডাঃ আজিজুর হোক শহিদ হন।

 

 

আটপাড়া থানা

 

মুক্তিফৌজ আটপাড়া থানা আক্রমণ করিলে পুলিশ আত্ম সমর্পন করে ও স্থানীয় জনসাধারণের সহায়তায় ৯ রাজাকার ও ১৭ টি রাইফেল দখল করে।

 

পাকসেনারা মুক্তিফৌজকে জব্দ করার জন্য রামপুর বাজারে অত পাতিয়া থাকে। কিন্তু জনসাধারণ মুক্তিফৌজকে এই খবর জানাইয়া দেয়। ফলে মুক্তিফৌজ উল্টা পাকসেনাদের উপর আক্রমণ করিয়ায় ৭ জন পাকসেনা ও ১৬ জন রাজাকার খতম করে।

 

পাক বাহিনী তাদের লেঙরা বাজার ঘাঁটি সুরক্ষিত রাখার উদ্যেশ্যে রাম পুড়, গৌরি পুড়, রাজনগরে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি গুলির উপর আক্রমণ চালাইলে কয়েক ঘণ্টা ব্যাপী তুমুল যুদ্ধের পর ২৬ জন পাকসেনা ও রাজকার্য খতম হয়। ইহার পর মুক্তিফৌজ পাকসেনাদের ওই ঘাঁটির উপড়েই আক্রমণ চালায় ও ৩৫ জনকে খতম করে ও ৩ জন আহত করে। এই যুদ্ধে মুক্তিফৌজএর ১- আব্দুল আজিজ ২- রিয়াজুদ্দিন ৩- আবুল হোসেন ৪০ আব্দুল হাকিম মোল্লা ৫- পরিমল দে ৬- আব্দুস সামাদ শহিদ হন ও ৬ জন আহত হয়।

 

মুক্তিফৌজ বাসাই তোলার পুল টি উড়াইয়া দিয়াছে। রাজাকার রা বাঁধা দেয়ার চেষ্টা করলে মুক্তিফৌজএর ঠেলায় একজন অস্ত্র সহ আত্ম সমর্পন করে। বাকিরা শ্রী চরণ ভরসা করিয়া পালাইয়া যায়।

 

 

নলিতা বাড়ি – হালিয়া ঘাট

 

৩০ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল নলিতাবারি ও হালিয়া ঘাটের সংযোগ রক্ষাকারী একটি ৩০ ফুট লম্বা ব্রিজ ধ্বংস করিয়া দিয়াছে। রাজাকার রা বাঁধা দিলে মুক্তিযোদ্ধারা একটি গুলিও খরচ না করিয়া ১ টা রাইফেল সহ ৩ জনকে পাকড়াও করে।

 

মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি দল গামাইরতলা, চেতাখালি ও চিরইভাষিণী ব্রিজ গুলি উড়াইয় দিয়াছে।

 

 

রণাঙ্গন – হাজারো আঘাতেও মাথা নোয়াবার নয়

(রণাঙ্গন প্রতনিধি)

 

জল্লাদ বাহিনীর করা প্রহরা ও নিয়ন্ত্রণ উপেক্ষা করিয়া দেশ প্রেমের অগ্নি মন্ত্রে উজ্জীবিত বীর মুক্তিযোদ্ধারা ও দেশপ্রেমিক জনগণ ঢাকার সর্বাংশে তথা ঢাকা শহর, নারায়ণগঞ্জ ও ডেমরা শিল্পাঞ্চল এবং বিস্তির্ন গ্রামাঞ্চলে সাহসিকতাপূর্ণ অভিযান চালাইয়া যাইতেছে। হাজারো আঘাতে ক্ষতবিক্ষত ঢাকা মাথা নত করে নাই।

 

ঢাকা শহর

গত ২৩ সেপ্টেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল ঢাকা শহরের কেন্দ্রস্থলে পলাশী ব্যারাকে অবস্থিত পাকসেনাদের ক্যাম্পে আকস্মিক আক্রমণ চালাইয়া ২৯ জন কে খতম করে। বাদ বাকি সেনারা প্রাণ ভয়ে পালাইয়া যায়। পূর্ব রণাঙ্গনে অবস্থিত বাংলাদেশ ন্যাপের লিয়াজো অফিস এই খবর সরবরাহ করিয়াছে।

 

গোদনাইল

সম্প্রতি গোদনাইল শিল্প এলাকায় এক অসম সাহসী করুন গ্রেনেড চাঋজ করিয়া ২ শত্রু সেনাকে খতম ২ টি রাইফেল ও গোলাবারুদ দখল করে। পরদিন দখলদার বাহিনী গদনাইল বাজারটি পুড়াইয়া ছারখার করিয়া তাহাদের ‘ বীরত্বের/ পরিচয় দেয়।

 

 

বাবুরাইল

22 শে সেপ্টেম্বর বাবুরাইলে এক অভিযানে মুক্তিফৌজ ৪ জন রাজাকার খতম করে। এছাড়া ঢাকা নারায়ণ গঞ্জের নলখারি ব্রিজটি মুক্তিফৌজ উড়াইয়া দিয়াছে। প্রতিশোধে পাক বাহিনী একই নিয়মে পার্শবর্তি গ্রাম আইল খালি ও সস্তা খালি সম্পূর্ন রূপে পুড়াইয়া ‘বীরত্ব’ প্রদর্শন করে। তাহারা শতাধিক গ্রাম বাসীকে গুলি করিয়া এবং ১৫ থেকে ২০ যুবতিকে পাশবিক নির্যাতন চালাইয়া হত্যা করে ও এইভাবে ‘ইসলামি জেহাদ’ পরিচালনার পরিচয় দেয়।

 

রূপসী

১৫ সেপ্টেম্বর মুক্তিফৌজ রূপসী বাজারের পাশ দিয়া গানবোটে অগ্রসরমান ১৫ জন পাকসেনাকে আক্রমণ করিলে তাড়া পিছু হটিয়া পালাইয়া যায়। পরে আসিয়া রূপসী বাজারে লুত তরাজ চালায়। এখানেই শেষ নয়, পরদিন তাড়া ন্যাপারা ও রূপসী গ্রামে অনেক বাড়ি ভস্মীভূত , সম্পত্তি লুট, নারী ধর্ষন চালায়।

 

 

মনহরদি

সম্প্রতি মনহরদি কাছারি হইতে চালাক চরে আসার পথে প্রায় ১০০ পাকসেনা মুক্তিফৌজএর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। মুক্তিফৌজ তাদের খবর আগেই জানিতে পারিয়া ‘পজিশন’ লইয়া বসিয়া থাকে। এই খবর আবার দালালরা পাক বাহিনীকে জানায়। ফলে পাক বাহিনী দুই ভাগে বিভক্ত হইয়া অগ্রসর হইতে থাকে। মুক্তিফৌজ এই চালাকি ধরিয়া ফেলে। তারা আরও দূরে চালাক চরে গিয়া পজিশন নেয়। ফলে মুক্তিফৌজকে ঘেরাও করার জন্য যে বুহ্য রচনা করে পাকসেনারা উলটো সেই ফাঁদেই পরে। ৭ জন পাকসেনা ঘটনা স্থলে নিহত হয়, ৪ জন আহত হয়। ইহা ছাড়া, ১০/১২ জন গ্রাম বাসী শহিদ হয়।

 

মুক্তিফৌজ ওই এলাকায় কুখ্যাত দালাল হাছেন গুণ্ডাকে খতম করিয়াছে। তাহাকে হত্যা করায় স্থানীয় জনমনে স্বস্তি ফিরিয়া আসিয়াছে।

–       নতুন বাংলা, ২১ অক্টোবর, ১৯৭১

 

 


 

প্রচণ্ড যুদ্ধের পর পাকসেনাদের ছাতক শহর ত্যাগ

 

মুজিবনগর, ২১ অক্টোবর (পি টি আই) – বাংলাদেশের শ্রী হট্টে ও রংপুর অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। সীমান্তের ওপার থেকে এই খবর পাওয়া গেছে।

 

মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে পাকসেনারা এখন অধিক সংখ্যক বিমান কাজে লাগাচ্ছে। বিমান গুলি ব্যাপক ভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটির উপর বোমা বর্ষন করছে।

 

রংপুর খণ্ডে মুক্তিযোদ্ধারা গত ১৭ অক্টোবর চিল মারি এলাকায় পাক ঘাঁটির উপর আক্রমণ চালালে তারা সেখান থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়। গেরিলারা শান্তাহার ও পার্বতিপুরের মধ্যে রেল লাইন উড়িয়ে দেয়। গত ১৬ ও ১৮ অক্টোবর মুক্তিযোদ্ধারা ভুরুংগমারি এলাকায় পাক ঘাঁটির উপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়।

 

শ্রী হট্ট খণ্ডে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে প্রচণ্ড যুদ্ধের পর পাকসেনা ও রাজাকাররা ছাতক থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়। এতে ৫০ জনের বেশী পাকসেনা ও ৬০ জন রাজাকার নিহত হয়েছে বলে সংবাদ পাওয়া গেছে। এখানে কয়েকজন নাগরিক ও মুক্তিযোদ্ধা প্রাণ হারিয়েছে বলে জানা গেছে। ওপর একটি সংবাদে প্রকাশ, মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল সুনামগঞ্জের ৬০ কিলোমিটার উত্তরে এগিয়ে গেছে। মৌলভীবাজারের ৪০ কিলোমিটার উত্তর – পশ্চিম মুক্ত হয়েছে বলেও খবর এসেছে।

 

চট্টগ্রাম খণ্ড এখানে  মুক্তিযোদ্ধারা প্রবল চাপ সৃষ্টি করে পাক অসামরিক বাহিনীকে নাজেহাল করে তুলেছে। গত ১৭ অক্টোবর গেরিলারা পাক অসামরিক বাহিনীর একটি ইউনিট কে ঘিরে ফেলে। এতে বহু পাকসেনা নিহত হয়।

 

 

কসবায় আরও এলাকা উদ্ধার

 

মুক্তিযোদ্ধাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে জানা গেছে যে, মুক্তিযোদ্ধারা কুমিল্লা জেলার কসবা খণ্ডে আরও এলাকা খানসেনাদের কবল মুক্ত করেছে।

 

এই জেলার সালদা নদী এলাকার সাম্প্রতিক যুদ্ধ সম্পর্কে আরও জানা যায়, মুক্তিযোদ্ধাদের কেন্দ্র আক্রমণের যুদ্ধে পাক সেনাপতিরা সমগ্র ৩৩ নং বেলুচ রেজিমেন্ট ও গোলন্দাজ বাহিনী ও বিমানবাহিনী ব্যাবহার করেছিল। কিন্তু দুঃসাহসী বাংলাদেশ গেরিলা বাহিনী সাফল্যের সাথে আক্রমণ মোকাবিলা করে ও প্রতি আক্রমণ চালিয়ে পাকসেনাদের ৭০ কঞ্জে হত্যা করে।

 

আঘাতের ফলে পাক বাহিনী প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ ফেলে পিছিয়ে যায়। মুক্তিবাহিনী ৬ টি মেশিন গান দখল করে।

পাক লে পারভেজ ও দুজন সেনা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্ম সমর্পন করে।

 

শেষ সংবাদে প্রকাশ, পাক বিমান ছাতক শহরের ওপর বোমা বর্ষন করেছে।

মেহেরপুর শহরের কাছে প্রচণ্ড লড়াই

 

কৃষ্ণ নগর, ২১ অক্টোবর ( পি টি আই) – কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর শহরের বাইরে কাথুলি থেকে কামদেবপুর পর্যন্ত এলাকা জুড়ে আজ সন্ধ্যা পৌনে ৭ টায় মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে খানসেনাদের প্রচণ্ড লড়াই হয়েছে।

 

নির্ভরযগ্য সূত্রে জানা গেছে, এখান থেকে প্রায় ৭৫ কিলোমিটার দূরে সীমান্তের ওপারে প্রচণ্ড গোলাগুলি , গ্রেনেড ও মেশিন গান চলার শব্দ পাওয়া গেছে।

 

লড়াইয়ের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া না গেলেও জানা গেছে যে মুক্তিযোদ্ধারা এগিয়ে চলেছে।

 

 

ঢাকায় গেরিলা তৎপরতা

 

ঢাকা, ২১ অক্টোবর – একদল সশস্ত্র ব্যাক্তি সম্ভবত মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা দল মঙ্গলবার রাতে পূর্ব বংগের বৃহত্তম মোড়কের কারখানাটিতে অগ্নি সংযোগ করে সম্পূর্ন ভস্মীভূত করে।

 

পুলিশ এই সংবাদ দিয়ে জানায় যে, প্রাক্তন পররাষ্ট্র মন্ত্রী হামিদুল হোক চৌধুরীর মালিকানাধীন এই কাড়খানা আক্রমণ করে শেষ করে দেয়।

 

তিনি বর্তমানে জেনেভায় সপরিবারে বাস করছেন বলে জানা গেছে।

-যুগান্তর, ২২ অক্টোবর, ১৯৭১

 

 

রাজশাহী রঙ্গনের একটি রক্তাক্ত অধ্যায়

 

পাকসেনারা যখন সীমান্তের যুদ্ধ প্রস্তুতিতে ব্যাস্ত, তখন বাংলাদেশের অভ্যন্তর ভাগে প্রধানত রাজাকাররাই মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে লড়াই করছে, আগুণ লাগাচ্ছে, লুট করছে ও পাকসেনাদের সঙ্গে থেকে জায়গায় জায়গায় দেশবাসীর উড় নৃশংস অত্যাচার করে তাদের মনোবল ভাঙতে চেষ্টা করছে। মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দাতাদের সন্ধানে তারা গ্রামে গ্রামে হন্যে কুকুরের মত ঘুরে বেড়াচ্ছে ও যেসব গ্রাম মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি সেগুলিকে তারা জ্বালিয়ে পুরিয়ে ছারখার করে দিচ্ছে।

 

সম্প্রতি রাজশাহীর মীরগঞ্জ, আলাইপুর, চরঘাট, বাঘা প্রভৃতি অঞ্চলে রাজাকাররা পাকসেনাদের সহায়তায় আগুণ লাগাচ্ছে। গত সপ্তাহে আড়ানি, বাউসা, রুস্তমপুড় বাজার, কালুহাটি, বাকরা প্রভৃতি অঞ্চলে তারা আগুণ লাগিয়েছে, খুন করেছে ও মেয়েদের উপর অমানুষিক অত্যাচার করেছে। সেই অত্যাচারের খবর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছেছিল , আর সেই সঙ্গে তারা আরও জেনেছিলেন যে, ডাঃ আইনুদ্দিন, নহির চেয়ারম্যান, ডাঃ নইমুদ্দিন, এহিয়া, মাসুদ মিয়া ও আবুল হোসেন – এই কয়েকজন পাক দালালের সংবাদের ভিত্তিতেই তারা এই সব এলাকা বেছে নিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা এই অত্যাচারের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। তারা ঘাঁটি গেড়েছিলেন আড়ানি কলেজের এক মাইলের মধ্যে। একদিন সকালে তারা দেখতে পেলেন, তাদেরই আশ্রয়দাতাদের বেঁধে নিয়ে চলছে। পরে তাদেরকে হত্যা করার সংবাদ পেয়েও মুক্তিযোদ্ধাদের কমান্ডরা কিছু করেননি, তারা সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন।

 

মুক্তিযোদ্ধাদের গুপ্তচররা খবর নিয়ে এলেন, পরের দিন রাজাকার ও পাকসেনারা বাকরা গ্রামে তল্লাসি চালাবে। মুক্তিযোদ্ধারা সেই রাতেই বাকরা গ্রামের কাছাকাছি একটি গ্রামে ঘাঁটি গাড়লেন। পরের দিন দুপুর সাড়ে ১২ টার সময় হঠাত পাকসেনা ও রাজাকাররা তাদের পুর্ব পরিকল্পনা মত বাকরা বাজার আক্রমণ করল। মুক্তিযোদ্ধারাও প্রস্তুত ছিল। তারা চোখের নিমেষে শত্রু বাহিনীকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলল। সেদিনের সেই রক্তাক্ত সংগ্রাম হয়েছিল মাত্র ৪০-৫০ গজ দূর থেকে। দিনের আলোয়, বাংলাদেশের সমতল ভূমিতে শত্রুর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের এই সংগ্রাম চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে। মুক্তিযোদ্ধারা যখন বীর বিক্রমে শত্রু নিধন করে চলেছে তখন একজন খবর পাঠালেন যে, সারদা থেকে আরও ২৫ জন পাক পাঞ্জাবি ফৌজ আড়ানি রেল ব্রিজের কাছে এসে হাজির হয়েছে। কিন্তু সেদিনের এই সংগ্রামের অলেখা ইতিহাস বলছে, মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিবৃষ্টির মধ্যে খান সেনারা গুলি ছুড়তে ছুড়তে সারদার দিকে পিছু হতে চলে যায়। সন্ধ্যার তরল অন্ধকারে দেখা গেল রণক্ষেত্রের প্রায় আধা মাইল জায়গায় শত্রু সৈন্যের রক্ত আর শব দেহে সমাকীর্ন। যেসব মৃতদেহ সনাক্ত করা  সম্ভব হয়েছিল তাদের ১৫ জন ছিল রাজাকার, ১ জন পুলিশের বিহারি সুবেদার, ফ্রন্টিয়ার ফোর্স ও পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ৫ জন এবং আরও ২২ জনের মৃতদেহ বিক্ষিপ্তভাবে আখের জমিতে, বাঁশবনে, আমবাগানে পরে ছিল। টার কিছু দূরে যে মৃতদেহটি পরে ছিল সেটি ছিল রাজশাহীর সর্ব্জন পরিচিত পাক দালাল গোচর আড়ানির চেয়ারম্যান আবুল হোসেনের লাশ। একটি জীবনও না খুইয়ে মুখোমুখি এত বড় সংগ্রামে বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধারা সেদিন উৎসাহিত হয়েছিলান, শত্রু মনোবল তেমনি হারিয়ে ফেলেছিল।

 

মুক্তিযোদ্ধারা রাত্রি শেষ হবার আগেই মুক্ত অঞ্চলে চলে গিয়েছিল, আর পাকসেনারা পরের দিন তাদের এই পরাজয়ের উসুল তুলতে বাকরা ও পাল্লা পারায় আগুণ লাগিয়েছিল।

 

 

 

 

মুক্তিফৌজ ২ টি সামরিক ট্রেন উড়িয়ে দিয়েছে

 

মুজিবনগর, ২৩ অক্টোবর ( ইউ, এন আই) – মুক্তিবাহিনী পূর্বের সংবাদে প্রকাশ, গত ৫ দিনে মুক্তিযোদ্ধারা কুষ্টিয়া জেলায় ডিনামাইট ও মাইনের সাহায্যে দুটি সামরিক স্পেশাল ট্রেন ও একটি গাড়ি উড়িয়ে দিয়েছে এবং অন্তত ৮৩ জন পাক সৈন্য নিহত ও ওপর কয়েকজন আহত হয়েছে।

 

গত ২১ অক্টোবর মেহেরপুরের নিকট কাদেম্পুর ও কালাচাদপুরে মুক্তিবাহিনীর সাথে সংঘর্ষে একজন ক্যাপ্টেন সহ ৬ জন পাকসেনা নিহত হয়েছে।

 

গেরিলারা কুষ্টিয়া জেলায় জীবন নগর ও গঞ্জারই এলাকায় টার সরিয়ে ও খাম্বা তুলে ফেলে টেলিযোগাযোগ বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। ২১ অক্টোবর কুষ্টিয়া টেলিফোন এক্সচেঞ্জে বোমা বিস্ফোরণের ফলে কুষ্টিয়া ও ঢাকার মধ্যে টেলিযোগাযোগ প্রায় আধ ঘণ্টা বিচ্ছিন্ন থাকে ও এক্সচেঞ্জের বিশেষ ক্ষতি হয়।

 

 

শান্তি কমিটির সভাপতি নিহত

 

করিমগঞ্জ, ২৩ অক্টোবর – আজ সীমান্তের ওপার থেকে প্রাপ্ত সংবাদে প্রকাশ, মুক্তিযোদ্ধারা ২১ অক্টোবর রাতে বাংলাদেশের সুলতানপুরে তথাকথিত শান্তি কমিটির সভাপতি আব্দুল ওয়াহিদ চৌধুরীকে হত্যা করেছে।

 

প্রকাশ, মিঃ চৌধুরী করিমগঞ্জ সীমান্তের পাক নাশকতাকারিদের পরিচালিত করছিলেন ও গুপ্তচরদের শিক্ষণের ব্যাবস্থা করছিলেন।

 

গত ২০ অক্টোবর পাকিস্তানী সৈন্যরা যখন ডিগবাইল সারি নদী পার হচ্ছিল, তখন মুক্তিযোদ্ধারা অতর্কিত আক্রমণ করে গানবোট ডুবিয়ে দেয়। ৫ জন পাকসেনা মারা যায়। ১৮ অক্টোবর দক্ষিণ ছাতক এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা ৩ টি লঞ্চ ও ৩ টি স্পিড বোট ডুবিয়ে দেয় ও বহু পাকসেনা হতাহত হয়।

 

ঢাকা- কুমিল্লা- চট্টগ্রাম সেক্টরে গেরিলারা মিরপুর এলাকায় অতর্কিতে একটি  সামরিক টহল দাড় দলকে আক্রমণ করে ২ জন সেনা হত্যা করে। মাতুয়া এলাকায় হানা দিয়েও তারা ২ জন পাকসেনা খতম করে। গত ১৬ অক্টোবর নোয়াখালী জেলার ছাগল নাইয়ায় ৭ পাকসেনা নিহত ও ৭ জন আহত হয়।

 

রংপুর- দিনাজপুর – রাজশাহী এলাকায় গেরিলারা অমরখান এলাকায় ৪ জন পাকসেনা হত্যা করে। যশোরের শিমলা এলাকায় ২ জন পাকসেনা নিহত ও ২ টি রাইফেল উদ্ধার করা হয়েছে।

–       যুগান্তর, ২৪ অক্টোবর, ১৯৭১

 

 

 

ফেনী এলাকা মুক্তিবাহিনীর দখলে, কুমিল্লার কয়েকটি অঞ্চল মুক্ত

 

মুজিব নগর, ২৪ অক্টোবর- এখানে প্রাপ্ত সংবাদে জানা যায় যে, মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানী সৈন্যদের মধ্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাক ঘাঁটি হানা দিয়ে প্রায় ৮০ জন পাকসেনা খতম করেছে। এছাড়া কুষ্টিয়া, দর্শনা, চুয়াডাঙ্গা ও ভেরামারা অঞ্চলে কয়েকটি আক্রমণ চালিয়ে পাক বাহিনীর সরবরাহ ব্যাবস্থার ওপর গুরুতর আঘাত হেনেছে। সীমান্তের ওপার থেকে পাওয়া সংবাদে জানা যায় যে, মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের ফলে এইসব অঞ্চলে যোগাযোগ ব্যাবস্থা ও নতুন সৈন্য পাঠানোর ব্যাবস্থা বানচাল হয়ে গেছে। পদ্মা ও মাথা ভাঙ্গা নদী দিয়ে সরবরাহ ব্যাবস্থা অটুট রাখার চেষ্টায় গত কয়েকদিনে পাক বাহিনীর বহু সৈন্য হতাহত হয়েছে। গেরিলারা কৃষ্ণ নগর থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরে ভেরামারায় সামরিক অস্ত্র ও গোলাবারুদবাহি দুটি স্পিড বোট আক্রমণ করে ডুবিয়ে দেয়। ১০ জন পাকসেনা নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা চুয়াডাঙ্গায় একটি রেল লাইন উড়িয়ে দেয়, ফলে পাক সেনাদের জন্য খাদ্য বহনকারী মালগাড়ি লাইনচ্যুত হয়। পাকসেনারা বেপরোয়া গুলি চালায়, ফলে কিছু বাঙ্গালী কুলি নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা কুষ্টিয়া ও দর্শনার মধ্যে টেলিফোন লাইন নষ্ট করে দিয়েছে।

 

 

 

কুমিল্লা রণাঙ্গনে

 

আগরতলা ২৪ অক্টোবর – বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী কুমিল্লা জেলার মান্দাবাগ অঞ্চলের ব্যাপক এলাকা মুক্ত করেছে। মুক্তিযোদ্ধারা কসবা খণ্ডে আরাইবারি দখল করেছে জানা গেছে।

 

মুক্তিযোদ্ধারা কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মধ্যে সংযোগ রক্ষাকারী সড়ক টি অতিক্রম করেছে ও মুক্ত করেছে। এই সার্থক অভিযান কুমিল্লার উত্তর ও দক্ষিণ অঞ্চলকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে।

 

মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে পাক বাহিনীর বহু নিয়মিত সৈন্য হতাহত হয়েছে। হানাদাররা সড়ক ত্যাগের পূর্বে ১২ টি মৃতদেহ ফেলে গেছে।

 

 

মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাক সৈন্যের প্রচণ্ড সঙ্ঘর্ষ

 

বাংলাদেশের নোয়াখালী জেলার ফেনী মহকুমায় গত ১ মাসে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ১ জন মেজর, ১ জন ক্যাপ্টেন ও ১ জন লে সহ ৬০০ জনের বেশী পাকসেনা প্রচণ্ড সঙ্ঘর্ষের মুখোমুখি হয়েছে।

 

এই মহকুমায় একটি বিরাট অঞ্চল এখন মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা গত ১ মাস ধরে পাকসেনাদের বার বার তাড়াতে পেরেছে বলে সীমান্তের ওপার থেকে পাওয়া কর্তৃপক্ষ মহলের খবর থেকে জানা গেছে।

 

মুক্তিযোদ্ধাদের হিসাব অনুযায়ী এই মহকুমার পএশু রাম, চিতোলিয়া ও সালালারে একজন জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার সহ অন্তত ৮৪ জন সৈন্য ও রাজাকার নিহত হয়েছে।

–       যুগান্তর, ২৫ অক্টোবর, ১৯৭১

 

 

নাগরপুর থানা আক্রমণ – রাজাকার সহ ২৭ পাকসেনা নিহত

 

গত ১৬ অক্টোবর মুক্তিযোদ্ধারা ভোর ৪ টায় নাগরপুর থানা আক্রমণ করে। এই আক্রমণে রাজাকাররা শুধু ভীত সন্ত্রস্তই হয়নি , দলে দলে আত্মসমর্পন করা শুরু করেছে। অপর পক্ষে জনমত এত শক্তিশালী হয়েছে যে, রাজাকাররা এখন আর গ্রামে প্রবেশ করে ধন সম্পদ লুট করারা সাহস পায়না। এই সফল আক্রমণে রাজাকার সহ কমপক্ষে ২৭ পাকসেনা নিহত হয়েছে। আহতদের সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি। যুদ্ধ চলাকালীন নাগর পুড় থানার উত্তর দিকে বিস্তির্ন ধান ক্ষেতের মধ্য দিয়ে রাজাকাররা পাকিয়ে যেতে থাকে। পলায়নপর রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট আত্মসমর্পন করেছে বলে জানা গেছে।

 

 

 

হানাদারদের শ্মশান – ৪২ জন নিহত

 

বিগত ২৩ অক্টোবর কালিহাতি থানার চারানে মিলিশিয়া সহ রাজাকার ও মুক্তিবাহিনীর মধ্যে তুমুল যুদ্ধ সঙ্ঘটিত হয়। প্রতি সপ্তাহে রাজাকারদের এক ঘাঁটি থেকে অন্য ঘাঁটিতে বদলি করা হয়। বল্লা শত্রু ঘাঁটি থেকে রাজাকারদের এমন বদলির সময় এই যুদ্ধ হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের অকস্মাৎ আক্রমণে মিলিশিয়া ও রাজাকাররা দিশেহারা হয়ে পরে। মুক্তিযোদ্ধাদের এই সাফল্যজনক আক্রমণাত্মক যুদ্ধে ৩৯ জন রাজাকার ও ৩ জন মিলিশিয়া নিহত হয়। মুক্তিবাহিনীর কেউ হতাহত হয়নি।

 

 

 

 

 

পাথরঘাটায় মর্টার আক্রমণ

 

অক্টোবর এঁর দ্বিতীয় সপ্তাহে মুক্তিযোদ্ধাদের মর্টার দল মির্জাপুর থানার পাথর ঘাটায় ৩ ইঞ্চি মর্টার থেকে দশ রাউন্ড গুলি বর্ষন করে। ঘাঁটির শত্রু সেনা পালিয়ে জীবন বাঁচায়। মুক্তিযোদ্ধারা পাথরঘাটা থেকে ৬ টি রাইফেল ও ৮০০ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করে।

 

 

এলাসিন ঘাটে ৬ জন হানাদার সেনা নিহত

 

সম্প্রতি নাগরপুর থানার এলাসিনে ১১ জন পাঞ্জাবি সেনার সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের এক সম্মুখ যুদ্ধ হত। জামাতে ইসলামের একজন কাঠমোল্লা পাঞ্জাবিদের পথ দেখিয়ে নিয়ে আসে। মুক্তিযোদ্ধারা প্রথমে এই কাঠমোল্লাকে নিশানা করে গুলি করে। এই যুদ্ধে কাঠমোল্লা সহ ৬ জন পাঞ্জাবি হানাদার দস্যু নিহত হয়। এবং পিছিনে হটতে বাধ্য হয়। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের অনেক দূরে পিছু ধাওয়া করে।

 

 

সিঙ্গুরিয়ায় রাজাকার নিহত – ৪ জন গুরুতর আহত

 

সম্প্রতি কুদ্দুস নগর ( ভুয়াপুর) থানার সিঙ্গারিয়ায়  মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তিশালী গেরিলা স্কোয়াড একদল রাজাকারকে আক্রমণ করে। আকস্মিক আক্রমণে ফলে ১১ জন রাজাকার নিহত ও ৪ জন গুরুতর আহত হয়।

 

 

রতনগঞ্জ ঘোনাবাড়িতে বেয়নেট হীন যুদ্ধ

 

২২ অক্টোবর কালিহাতি থানার রতণগঞ্জ ঘোনাবাড়িতে মুক্তিযোদ্ধা ও পাকসেনাদের মধ্যে যুদ্ধ হয়। ২১ অক্টোবর সারারাত পাহারারত থাকার পর ভোর রাতে মুক্তিযোদ্ধারা ঘোনাবাড়ির একটি পরিত্যাক্ত বাড়িতে ঘুমিয়ে পড়েন। প্রকাশ, ঘোনাবাড়ির একজন চোর রাজাকারে ভর্তি হয়েছিল। তাঁরই এক নিকট আত্মীয় এই সংবাদ বল্লার শত্রু ঘাঁটিতে পৌঁছে দেয়। রাজাকার সহ দেড়শ মিলিশিয়া ঘোনাবাড়ির ৩০ জন জোয়ানকে ঘিরে ফেলে। সকাল ৯ টা থেকে এই যুদ্ধ শুরু হয় ও বিকেল ৪ তা পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এই আশ্চর্য যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত হাতাহাতিতে পরিণত হয়। উভয় পক্ষের গুলি ফুরিয়ে গেলেই এই হাতাহাতি যুদ্ধ শুরু হয়। এতে রাজাকার সহ কমপক্ষে ৪০ জন মিলিশিয়া নিহত হয়। বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে ২ জন অসম সাহসী জোয়ান শাহাদত বরন করেন। হাতাহাতি যুদ্ধে আমাদের মুক্তিবাহিনীর সি আই নামক একজন যোদ্ধা ২ জন মিলিশিয়াকে রাইফেলের বাট দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেন। উল্লেখ্য যে, উভয় পক্ষের কারো রাইফেলেই কোন বেয়োনেট ছিল না।

 

 

হানাদার সেনাদের রসদ বাহি ৩ টি নৌকা করতল গত

 

গত ১৯ অক্টোবর ভোর ৫ টায় জল্লাদ সেনাদের রসদ বাহি ৩ টি নৌকা মুক্তিযোদ্ধাদের কব্জা গত হয়। এতে তিন হাজার তিন শত এক  মন গম ছিল। ঢাকা থেকে ধলেশ্বরী নদী দিয়ে টাঙাইলের চারাবারই এই গম অপসারণের কথা ছিল।

 

সিরাজগঞ্জ পাক ছাউনিতে আক্রমণ – ৪ জন নিহত

 

গত ২৪ অক্টোবর মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা স্কোয়াড সিরাজগঞ্জের পাক হানাদার দস্যু সেনাদের ছাউনিতে অকস্মাৎ আক্রমণ চালিয়ে ৪ জন নিহত ও ৬ জনকে আহত করে। পরে স্কোয়াড টি নিরাপদে ঘাঁটিতে প্রত্যাবর্তন করে।

–       রণাঙ্গন, ২৪ অক্টোবর, ১৯৭১

 

 

 
বিজয় বার্তা – কুষ্টিয়া যশোর ও খুলনা রণাঙ্গন

 

২৪ অক্টোবর দুঃসাহসিক মুক্তিযোদ্ধারা খুলনা ‘চাউলাহাসানের’ বিউটি অফ খুলনা’ লঞ্চ কোন এক গ্রাম থেকে হাইজ্যাক করে মুক্তাঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি তে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়। এছাড়া খুলনার দুজন কুখ্যাত মুসলিমলিগ দালাল কে বন্দী করে নিয়ে আসে। উক্ত দালাল দুজন বন্দী হওয়ায় স্থানীয় গ্রামের জনগণ এতদিনের নির্যাতন থেকে মুক্তি পেল। এজন্য জনগণ মুক্তিযোদ্ধাদের অভিনন্দন জানিয়েছেন।

 

ঘটনার বিবরণে প্রকাশ, উক্ত দালাল দুজন লঞ্চ যোগে খুলনা যাচ্ছিল – রাজাকার ও পাকসেনা নিয়ে আসতে – এই সংবাদ পেয়ে একদল মুক্তিযোদ্ধা অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে এই সাফল্য অর্জন করে।

 

৯ অক্টোবর খুলনা জেলার অন্তর্গত বাগেরহাট মহকুমায় পাকসেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা আকস্মিকভাবে আক্রান্ত হয় – এবং এতে অফিসার সহ ১০ জন পাকসেনা নিহত ও অনেকে আহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা এখান থেকে অনেক অস্ত্র দখল করেন।

 

 

বঙ্গবন্ধু নৌ বহরে আলোচনা সভা

 

২৩ অক্টোবর বাঙ্গালদেশের ৯ নং সেক্টরের কোন এক স্থানে বঙ্গবন্ধু নৌ বহর ১ এ একটি নৌযানে এক আলোচনা সভার আয়োজন করেন। এই আলোচনায় বাংলাদেশের প্রতিনিধিগন, সরকারের উচ্চতম পদের কর্মচারি গন ও মুক্তিবাহিনীর অধিনায়কগন অংশগ্রহণ করেন, অতিথি গন বঙ্গবন্ধু নৌবহর নং ১ পরিদর্শন করেন।

 

প্রকাশ থাকে যে, এই সকল নৌযান ৯ নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অঞ্চল হতে পাকসেনাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে এনেছিল। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, চলটি মাসের তৃতীয় সপ্তাহের শেষ দিকে মুক্তিযোদ্ধারা একখানা বৃহৎ নৌযান হানাদারদের কাছ থেকে ছিনিয়ে এনে বঙ্গবন্ধু নৌ বহরের সাথে যোগ করেছে।

 

 

রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন – ময়মন সিংহ ও শ্রী হট্ট রণাঙ্গন

 

ময়মন সিংহ জেলার হাতিবাগান অঞ্চলে পাকসেনাদের উপর মুক্তিযোদ্ধারা এক প্রবল আক্রমণে ২০ জন সেনা নিহত করে। মুক্তিযোদ্ধারা এই অঞ্চলে কিশরগঞ্জ ও ময়মন সিংহ এর মধ্যকার টেলিযোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।কৌশলী গেরিলারা ১৩  অক্টোবর গৌরীপুর থানা আক্রমণ করে বেশ কিছু আগ্নেয়াস্ত্র দখল করেন। বিলম্বে প্রাপ্ত খবরে যানা যায়, টাঙ্গাইল জেলার মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতা বিশেষ ভাবে বৃদ্ধি পায়। গোপাল পুড় থানায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল আক্রমণে ২৫ পাকসেনা নিহত হয়। ঢাকার কালিয়াকৈর অঞ্চলে রাজাকারদের ঘাঁটি আক্রমণে সম্পুর্ন ধ্বংস হয়। ময়মন সিংহের সরিষাবাড়ি হতে ৬০ জন রাজাকার অস্ত্র সহ মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্ম সমর্পন করতে বাধ্য হয়। ঢাকা ও টাঙ্গাইল সড়ক পথের মধ্যকার অনেকগুলো সেতু গেরিলারা ধ্বংস করে দেন। এতে যাতায়াত ব্যাবস্থা ধ্বংস হয়।

 

বিস্তারিত খবরে প্রকাশ, বরিশালের বিভিন্ন অঞ্চলে সমবেত মুক্তিযোদ্ধারা শহরের সন্নিকটে কোন এক ময়দানে সমবেত হন। সন্ধ্যা বেলায় প্রায় ১০০০ মুক্তিযোদ্ধাদের সশস্ত্র সেনানী পাক বিরোধী বিভিন্ন ধ্বনি সহকারে শহরের কয়েকটি প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করেন। হানাদার বাহিনী ভিত সন্ত্রস্ত হয়ে এ সময় ছাউনিতে আশ্রয় গ্রহণ করে। শহরের কোন এক সড়কে পাহারারত ৭ জন হানাদার শত্রু সৈন্যমুক্তিযোদ্ধাদের হাতে খতম হয়।

 

বিলম্বে প্রাপ্ত এক খবরে জানা গেছে, চলটি মাসের প্রথম সপ্তাহে মুক্তিযোদ্ধারা বরিশাল জেলার নেহেদিগঞ্জ  নামক পাকসেনাদের ডুখানা লঞ্চ ডুবিয়ে দেয়। এতে ১৯ পাকসেনা খতম হয়। উল্যেখ্য জ্যাম এই থানার প্রায় সকল রাজাকার ও পাক দালাল বহু পূর্বেই খতম করা হয়েছে – মেহদিগঞ্জ থানার সমুদয় অঞ্চল মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে।

 

 

 

রাজাকার কমান্ডারের আত্ম সমর্পন – রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী রণাঙ্গন

 

৯ অক্টোবর পুলিশ গাও অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের অতর্কিত আক্রমণে ৩ জন পাকসেনা খতম হত। অদিতমারির উত্তরাঞ্চলে ভুতেশ পুড় পাক ঘাঁটি মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করে। এতে ৩ জন পাকসেনা নিহত ও ৫ জন আহত হয়। ৯ অক্টোবর গাইবান্ধা অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে বিপুল সংখ্যক রাজাকার যত সমর্পন করে। এছাড়া রংপুর জেলার হলিদাবারি অঞ্চলের রাজাকার কমান্ডার হাবিবির রহমান মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে অনেক অস্ত্র সহ আত্ম সমর্পন করতে বাধ্য হয়। ১৬ অক্টোবর মর্টার আক্রমণে দিনাজপুর জেলার ভাওয়াল গড় অঞ্চলের পাক ঘাঁটির বিপুল ক্ষতি সাধিত হয়। এতে ১৭ জন পাকসেনা নিহত হয়।

–       বিপ্লবি বাংলাদেশ, ২৪ অক্টোবর, ১৯৭১

 

 

মুক্তবাহিনির জোর প্রস্তুতি

 

ঢাকা – ২১ অক্টোবর – পবিত্র রমজান মাসের প্রাক্বালে প্রদত্ত এক বানিতে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন যে, মুক্তিবাহিনী এখন শত্রুর ওপর কঠোরতম আক্রমণ অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

তিনি বলেছেন, মাত্রুভুমিকে শত্রুমুক্ত করার লক্ষ্যের দিকে আমরা এখন দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছি। মুক্তিবাহিনী অচিরেই হানাদারদের নির্মুল করতে পারবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেছেন।

 

 

 

মন্দাভাগ অঞ্চলে মুক্তিফৌজের বিরাট সাফল্য

 

ঢাকা – ১৯ অক্টোবর – গতকাল রাত ৩ টায় মুক্তিযোদ্ধারা এক দুঃসাহসিক আক্রমণ চালিয়ে কুমিল্লা সেক্টরের মন্দাভাগ অঞ্চলের হানাদারদের একটি প্রচণ্ড শক্তিশালী ঘটি দখল করে নিয়েছে বলে বিশ্বস্ত সূত্রে খবর পাওয়া গিয়েছে।

 

প্রকাশ, এর আগের দিন মুক্তিযোদ্ধাদের টহল দাড় বাহিনী ৫ জন রাজাকার গ্রেফতার করে। তাদের কাছ থেকে খবর পেয়ে সাঁজোয়া বাহিনী সহ ওই ঘাঁটির দুই পাশ থেকে প্রচণ্ড বিক্রমে আক্রমণ চালায়। তীব্র সংঘর্ষের পড় ঘাঁটি টি মুক্তিযোদ্ধারা অধিকার করে নেয়। বাঙ্কারের মধ্যে তখন ১৬৫ জন হানাদারের মৃতদেহ, আর ৫ জন আহত অবস্থায় কাতরাচ্ছে। বিপুল পরিমাণ অস্ত্র মুক্তিযোদ্ধারা সেখানে পায়।

 

মৃতদেহ, ৫ জন ধৃত হানাদার ও অস্ত্র সহ মুক্তিযোদ্ধারা তাদের হেড কোয়ার্টারে নিয়ে আসে। এই ঘাঁটি দখলে ফলে কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মধ্যবর্তি বিস্তীর্ন ভূখণ্ড হানাদার মুক্ত হয়েছে।

 

এই ঘাঁটির পতনের সংবাদ পেয়ে আজ বেলা ৩ টায় পাক জঙ্গি বিমানগুলো উন্মাদের মত ওই ঘাঁটি লক্ষ করে নাকি বোমা নিক্ষেপ করে। কিন্তু বিমান আক্রমণের আভাসা পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ঘাঁটির পাশে নিরাপদে আশ্রয় নেয়। ফলে সরাসরি বোমা বর্ষনেও মুক্তিযোদ্ধাদের আদৌ কোন ক্ষতি হয়নি। পার্শ্বস্থ একটি গ্রামে বোমা পড়ায় ৩ জন শিশু ও ২ জন বেসামরিক ব্যাক্তি নিহত হয়েছে বলে জানা গেছে।

 

নির্ভরযগ্য সূত্রে জানা যায়, কুমিল্লা জেলার চান্দিনা থানার অন্তর্গত জোর পুকুরিয়া গ্রামে ইয়াহিয়া বিশিষ্ট কুখ্যাত দালাল আব্দুর রহমান কে মুক্তিযোদ্ধারা চলন্ত বাস হতে নামিয়ে প্রকাশ্যে হত্যা করে।

 

 

পাক অস্ত্র বাহি দুটি জাহাজ বাংলাদেশ নৌবাহিনী ডুবিয়ে দিয়েছে

 

ঢাকা, ২০ অক্টোবর – এখানে বিলম্বে প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ, গত ৮ অক্টোবর বাংলাদেশ নৌ বাহিনী চট্টগ্রামের নিকট পাকসেনাদের জন্যে অস্ত্র বহনকারী দুটি বড় জাহাজ ডুবিয়ে দিয়েছে। এর মধ্যে একটি পাকিস্তানী জাহাজ , নাম- ‘ নাসিম’। এতে দুটি ট্যাঙ্ক ও অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র ছিল। অন্যটি গ্রিসের – নাম ‘এল্ভোস’ ।

–       সাপ্তাহিক বাংলাদেশ, ২৫ অক্টোবর, ১৯৭১

 

রণাঙ্গন থেকে লিখছি

 

স্বাধীনতা রক্ষার অতন্দ্র প্রহরী দুঃসাহসী তরুণ মুক্তিযোদ্ধারা ( মনহরদি ও কাপাসিয়া থানার) সেখানকার পাক ঘাঁটিতে চতুর্মুখি আক্রমণে গত ২১ অক্টোবর সম্পুর্ন ধ্বংস ও ঘটনা স্থলে ২১ জন হানাদার সৈন্য নিহত হয়। মনহরদি ও কাপাসিয়ার মুক্তিযোদ্ধারা ঘটনা স্থল হইতে যথাক্রমে ২ জন ও ৩ জন দস্যু সেনা বন্দী করে ও বহু অস্ত্র হস্তগত করে। বাকই পলায়ন রত ইয়াহিয়া সেনাদের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন খণ্ড যুদ্ধে ১১ জন কে হত্যা করে ও ৬ জন জন সাধারণের হাতে ধৃত হয়। এখন তাহারা মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে বন্দী আছে।

 

কাপাসিয়া থানায় – গোসিঙ্গাস্থিত শত্রু ঘাঁটি তে মুক্তিযোদ্ধাদের আচমকা হামলায় ৭ পাকসেনা নিহত হয় । ১৯ অক্টোবর এই ঘটনার দিনেই শত্রুরা ছাউনি ছাড়িয়া দিতে বাধ্য হয়।

 

রায়পুর থানা – ১৮ অক্টোবর হাঁটুভাঙ্গাতে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড আক্রমণে ৩৫ জন পাকসেনা নিহত ও ৩৮ জন আহত হয়।

 

কালীগঞ্জ, জয় দেব পুড়, শ্রীপুর ও শিব পুড়ের তরুণ মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুর উপর প্রচণ্ড চাপ অব্যাহত রেখেছে।

–       মুক্ত বাংলা, ২৫ অক্টোবর, ১৯৭১

 

 

রণাঙ্গন সংবাদ

(মুক্তিফৌজ সূত্র)

 

চিল্মারি রণাঙ্গনে গত ১ সপ্তাহের মধ্যে বর্বর পাকসেনারা মর্টারের সাহায্যে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রবর্তি ঘাঁটিতে গুলি বর্ষন করে। কিন্তু আমাদের জওয়ানরা সাহসের সাথে পালটা জবাব দিয়ে তাদের স্তব্ধ করে দেয়।

 

রউমারি দখলে অসমর্থ ও বিপর্যস্ত সেনারা এখন চিল্মারি থানার অধিকৃত অঞ্চলে তাদের অত্যাচার ও পোড়াও নীতিকে জোরদার করছে।

 

আরেক সংবাদে প্রকাশ, গত ২৪ অক্টোবর আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা ময়মন সিংহ জেলার কামাল পুড় অঞ্চলে আক্রমণ করে ৬৭ পাকসেনা নিহত ও অনেক আহত করে এবং কিছু অস্ত্র ও গোলাবারুদ হস্তগত করে। মুক্তিযোদ্ধাদের সাফল্যজনক এই অভিযান পরিচালনা করেন তাদের অধিনায়ক মেজর আবু তাহের।

 

বিলম্বে পাওয়া সংবাদে প্রকাশ, গত ১৭ ও ১৮ অক্টোবর আমাদের গেরিলা বাহিনী পৃথক দুটি অভিযানে ময়মন সিংহ ঢাকা রেলপথ ও তাঁর যোগাযোগ সম্পূর্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

–       অগ্রদূত, ২৭ অক্টোবর, ১৯৭১

 

 

 

মুনাফেকির পরিণাম

 

ফুলবাড়িয়া, ২৫ অক্টোবর, ফুলবাড়িয়া থানার কালীগঞ্জ বাজারে আমাদের বীর জোয়ানরা রাজাকার ঘাঁটি আক্রমণ করে ৩০ জন রাজাকার হত্যা ও ২৫ জন আহত করে।

 

ঘটনার বিবরণে প্রকাশ, রাজাকাররা আত্ম সমর্পন করবে এই মর্মে এক খবর মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটিতে প্রেরণ করে। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের কথায় বিশ্বাস করে ঘাঁটিতে আসতে অনুমিত দেন। সন্ধ্যার সময় মুক্তিযোদ্ধারা ঘাঁটির ভিতরে ইফতার করতে ব্যাস্ত। ঠিক সেই সুযোগে প্রায় ৫০ জন রাজাকার অতর্কিতে  আক্রমণ করে ৩ জন মুক্তিযোদ্ধাকে ধরে নিয়ে যায়। এই সংবাদ ভালুকা শাখার মুক্তিবাহিনীর অধিনায়ক জনাব আফসার সাহেব পাওয়া মাত্রই কালীগঞ্জে গিয়ে রাজাকার ঘাঁটি তে আক্রমণ চালান এবং ওই ৩ জন মুক্তিসেনাকে উদ্ধার করে ৩০ জন রাজাকার কে গ্রেফতার করেন। বীর জোয়ানরা শত্রু ঘাঁটি সম্পুর্ন ধ্বংস করে দেন। ২৫ টি রাইফেল সহ বহু গোলাবারুদ হস্তগত করেন। এই  যুদ্ধে স্থানীয় জনগণ বিরাট সাহসিকতার পরিচয় দেন। তারা পলায়নরত রাজাকারদের উপর দা , বল্লম, লাঠি, সড়কি নিয়ে আক্রমণ করেন। ফলে দুজন রাজাকার ঘটনা স্থলেই মারা যান। ৮ জন আত্মসমর্পন করে।

 

 

কাদেরের নেতৃত্বে কালিহাতি

 

টাঙ্গাইল জেলার কালিহাতি থানার রতনগঞ্জে গত ৪ ঠা কার্তিক পাক বাহিনীর সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের ১৬ ঘণ্টা ব্যাপী প্রচণ্ড সম্মুখ যুদ্ধ হয়। এতে ৪০ জন পাকসেনা খতম  হয় ও অনেকে আহত হয়। আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের ৩ জন শাহাদত বরন করেন ( ইন্নালিল্লাহে —- রাজিউন)

 

১৫ দিনে গেরিলা

 

বর্তমান মাসের গত ১৫ দিনে আমাদের দুঃসাহসী গেরিলারা ১০৩৪ টি স্থানে হামলা করে ১০৯০ জন শত্রু সৈন্য খতম করেছেন। এখানে উল্যেখ্য যে, এ সময়ে বাংলার কুখ্যাত মীর জাফর মোনায়েম খা সহ আরও ৯০০ জন দালাল কে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা হত্যা করেছেন।

 

 

ডিনামাইট দিয়ে পুল উড়িয়ে দেয়ায় ঢাকা ময়মনসিংহ ট্রেন চলাচল ব্যাহত

 

গফরগাঁও, ২৮শে আশ্বিন, শুক্রবার তাঁর ১২ টায় গেরিলারা মুশাখালি স্টেশনের অগ্রবর্তি ২৫ হাত লম্বা হুর চুঙ্গির পুর ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছেন। ওই রাতেই গেরিলারা লাইন পাহারা রত শত্রুবাহি ট্রেন অতর্কিতে আক্রমণ করে। এতে ১৯ জন শত্রু নিহত হয় ও প্রচণ্ড আক্রমণে টিকতে না পেরে ২৮ জন রাজাকার অস্ত্র সহ গেরিলাদের কাছে আত্মসমর্পন করে। গেরিলারা ট্রেনের সমস্ত অস্ত্র হস্ত গত করে ও ট্রেনটি বিধ্বস্ত করে। পুলটি বিধ্বস্ত হওয়ায় ঢাকা ময়মনসিংহ ট্রেন চলাচল সম্পূর্ন বিপর্যস্ত হয়ে পরেছে।

 

 

গ্রেনেড বিস্ফোরণ

 

ময়মন সিংহ – গত ৯ কার্তিক ময়মন সিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এঁর এক ছাত্র গ্রেনেড নিক্ষেপ করে কয়েকজন পাকসেনা খতম করেছেন।

 

আমাদের ঢাকাস্থ প্রতিনিধি জানিয়েছেন, গত ২৬ আশ্বিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে একজন দুঃসাহসী মুক্তিসেনা গ্রেনেড নিক্ষপ করেন। প্রচণ্ড শব্দের কারণে ক্লাসে যোগদানরত ছাত্রদের মনে ভীতির সঞ্চার হয়েছে।

 

 

 

কিশোর গঞ্জের বিভিন্ন থানায় মুক্তিযোদ্ধাদের সাফল্য

কিশোরগঞ্জের বিস্তির্ন এলাকা মুক্ত

 

গত ২২ আশ্বিন শনিবার থেকে ২৭ আশ্বিন বৃহস্পতিবার পর্যন্ত কিশোরগঞ্জের চারিদিকে অবিরাম যুদ্ধ করে মুক্তিযোদ্ধারা বিস্তির্ন এলাকা মুক্ত করেছেন। শুধুমাত্র কিশোরগঞ্জ শহর ব্যাতিত মহকুমার অন্য সব জায়গাই স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়তে দেখা যায়। মুক্তিযোদ্ধারা শহরের নিকতবর্তি মৌলানা আব্দুল হালিমের বাড়িতে ক্যাম্প করে খোলাখুলি চলাফেরা করছেন।

 

দ্রুত পলায়ন

কালিয়াকৈর থানার ফুলবাড়িয়া থেকে অধিনায়ক আফসার ও বীর কাদেরের আগমন সংবাদ শুনে পাক দস্যু দলটি দ্রুত পলায়ন করে। ফুলবাড়িয়া এখন আবার মুক্ত হল।

 

 

পুল বিধ্বস্ত

২৯ অক্টোবর বীর গেরিলারা কালিয়াকৈর থানার ফুলবাড়িয়ার উত্তর পূর্ব কোনার হাঁটু ভাঙ্গার লোহার পুল টা ডিনামাইট দিয়ে ইরিয়ে দেন। প্রসঙ্গত উল্যেখ্য যে, ঐদিন দস্যু হানাদার শ্রীপুর হতে ওই রাস্তা ধরে ফুলবাড়িয়া আসছিল।

–       জাগ্রত বাংলা , ৩০ অক্টোবর, ১৯৭১

 

 

সাবাস!

 

১২ অক্টোবর। নীলফামারী হইতে একটি ট্রেন সৈয়দপুরের দিকে যাইতেছে। ট্রেনের একটি কামরায় ৩ জন বন্দী গেরিলা, হাতে ও কোমরে শক্ত দড়ি বাঁধা, প্রহরায় ২ জন হানাদার পাক সেনা।

 

মুক্তি সংগ্রামী গেরিলারা তিনজন একদিন পূর্বে ডিম্লা থানায় শত্রুর হাতে ধরা পড়িয়াছেন। প্রাথমিক নিপীড়নের পর তাদের সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে নিয়া যাওয়া হইতেছিল। চলন্ত ট্রেন। যাত্রীরা নির্বাক।

 

হথাত যাত্রীদের মধ্য হইতে কয়েকজন প্রহরারত পাকসেনাদের উপর ঝাপাইয়া পড়িয়া তাহাদের অস্ত্র কাড়িয়া নেয়। গেরিদের হাতের বাধন খুলিয়া দেয়।

 

 

গেরিলাদের সফল অভিযান অব্যাহত

 

নবাবগঞ্জ – গত ২৯ অক্টোবর মুক্তিযোদ্ধাদের ৮ জন গেরিলা নবাবগঞ্জ থানায় এক আক্রমণ চালিয়ে ৫২ জন পাকসেনা হত্যা করে ও ২৮ জন রাজাকার কে অস্ত্রসহ বন্দী করে। এতে মুক্তিযোদ্ধাদের ১ জন শহিদ ও অন্য একজন আহত হয়।

লৌহজং – গত ২৬ অক্টোবর শত্রু সৈন্য বাহি ২ টি স্পিড বোট শ্রীনগর থেকে যাত্রা করলে আমাদের গেরিলারা পথে গোয়ালিনী মান্দ্রা বাজারের নিকট এক প্রবল আক্রমণে ৩৬ জন পাকসেনা নিহত ও ৮ জনকে বন্দী করে। নিহত দের মধ্যে সুবেদার কোরবান আলি ও ল্যান্স নায়েক মনসের খান ও রয়েছে। এতে দুটি হাল্কা মেশিন গান , ৩৪ টি রাইফেল সহ বেশ কিছু গোলাবারুদ হস্তগত হয়।

 

শ্রীনগর- গত ২৪ অক্টোবর শ্রীনগর থানার কামার খোলা গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলারা পাকসেনা ও রাজাকারদের একটি দলের উপর অতর্কিতে হামলা চালিয়ে ৪ জন নিহত করে।

 

 

ছদ্মবেশী রাজাকার ধৃত ও নিহত

 

গত ২৫ অচতব্র আমাদের গেরিলারা শেখের নগরে একটি স্পিড বোটে তল্লাশি চালিয়ে ছদ্মবেশী দুজন বিহারি রাজাকার গ্রেফতার করে। জিজ্ঞাসাবাদের পর তাদের হত্যা করা হয়। সংবাদে প্রকাশ, কয়েকদিন আগে গোয়েন্দাগিরি করতে এসে আরেকজন রাজাকার চুরাইনের জাগ্রত জনতার হাতে পরে প্রাণ দেয়।

 

দালাল নিধন – গত ১৫ অক্টোবর মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে হানাদার বাহিনীর দিশারি কুখ্যাত দালাল মাওলানা আহম্মদ ও তাঁর ছেলে বাহারুল ধরা পড়লে তাদেরকে গন আদালতে উপস্থিত করা হত। দেশ মাতৃকার প্রতি চরম বিশ্বাস ঘাতকটা ও বেইমানির প্রায়শ্চিত্য সরূপ তাদের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।

রাজাকারদের আত্মসমর্পন

 

জয়পারা থেকে এমদের নিজস্ব সংবাদ দাতা জানাচ্ছেন গত ২৬ অক্টোবর কিনাই মোল্লার ছেলে সহ ১২ জন রাজাকার অস্ত্র সহ মুক্তিবাহিনীর হাতে আত্মসমর্পন করে।

–       বাংলাদেশ, ৩১ অক্টোবর, ১৯৭১

 

 

রাজধানীতেও পাকবাহিনী কোণঠাসা

 

ঢাকা, ৩১ অক্টোবর, গেরিলারা ঢাকা শহরে খুব সক্রিয় হওয়ায় পাকসেনারা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে বলে লন্ডনের ‘সানডে টাইমস/ এ এক সংবাদে প্রকাশিত হয়েছে।

 

সানডে টাইমস এঁর বাংলাদেশস্থ সংবাদ দাতা জানিয়েছেন যে, প্রায় ৮০০ গেরিলা সম্প্রতি ঢাকা শহরের কর্ম ব্যাস্ত অঞ্চলে একের পর এক আক্রমণ চালিয়েছে। গেরিদের আক্রমণের ফলে পাকবাহিনীর বিমান ঘাঁটি যাওয়ার পথে পিলবক্স তৈরি করেছে এবং পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ওয়েজ এর বিমানগুলি ওঠা নামার পদ্ধতি বদলে গেছে। এতদিন পর্যন্ত বোয়িং বিমান গুলি সব আলো জ্বেলে ঢাকা বিমান ঘাঁটিতে অবতরণ করত। কিন্তু এখন বিমান গুলি যথা সম্ভব বিনা আলোয় জলের অপর দিয়ে উড়ে গিয়ে বিমানঘাঁটি তে অবতরণ করছে।

 

 

মুক্তিবাহিনী আবার জাহাজ ডুবিয়েছেন – পাক সৈন্যরা মরছে

 

ঢাকা, ২৮ অক্টোবর, পাকিস্তান সরকার উপকূলবাহি একটি নতুন জাহাজ সংগ্রহ করেছিল। গত সপ্তাহে মুক্তিযোদ্ধারা এই জাহাজ টি ডুবিয়ে দেয়। জাহাজ তীর নাম এস এস সপ্তডিঙ্গা। অত্যাবশ্যক সামগ্রী বোঝাই করা এই জাহাজ টি বরিশাল – খুলনা রুটে ছিল .

–       সাপ্তাহিক বাংলাদেশ, ১ নভেম্বর, ১৯৭১

 

 

মাদারীপুর, বরিশাল, খুলনায় মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে হানাদার বাহিনী নাস্তানাবুদ

/ ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধি /

 

বাংলার অগ্নিসন্তান মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশের জেলা অঞ্চল ফরিদপুর, বরিশাল ও খুলনা জেলার বিভিন্ন এলাকায় তাদের গেরিলা তৎপরতা জোরদার করেছেন। ইতিমধ্যেই মুক্তিযোদ্ধারা গোপালগঞ্জের নিকট মধুমতী নিদুতে ও ভাটিয়াপাড়া এলাকায় দস্যু বাহিনীর প্রহরায় থাকা পাট বোঝাই কয়েকটি বার্জ ও হানাদার সৈন্যদের কয়েকটি লঞ্চ ডুবাইয়া জঙ্গি শাহীর হৃতকম্পনের কারণ ঘটাইয়াছেন। ইদানীং জঙ্গি সেনারা এই পথে লঞ্চ কিংবা মাঝারি আকৃতির লঞ্চ দিয়াও চলাচল করিতে সাহস পাইতেছে না। এই অঞ্চলের নদী পথে খানসেনাদের লঞ্চ ডুবাইয়া দেয়া, আক্রমণ করা কিংবা মুক্তিযোদ্ধা দ্বারা দখল করিয়া নেয়ার তৎপরতা বৃদ্ধি পাইয়াছে। চলতি মাসের গোড়ার দিকে গোপালগঞ্জ মহকুমার অন্তর্গত ভাটিয়াপারার নিকট স্বাধীনতা সংগ্রামীদের হাতে প্রচণ্ড মার খাইয়া হানাদার বাহিনী বোমারু বিমানের সাহায্যে ভাটিয়াপাড়া এলাকায় নিরস্ত্র গ্রাম বাসীকে হত্যা ও কয়েক টি গ্রাম পোড়াইয়া দিয়া ও এই গুরুত্তপূর্ন জলপথটি আয়ত্তে আনিতে পারেনাই।

 

গত ১৭ অক্টোবর মুক্তিযোদ্ধারা খুলনা জেলার বয়রা এলাকায় লালসিয়া নামক একটি বড় জাহাজ এবং এক খানি বার্জ ডুবাইয়া দিয়া জঙ্গি শাসকদের মনে আতঙ্কের সৃষ্টি করিয়াছেন। এই জাহাজটি খুলনা নিউজপ্রিন্ট কাড়খানার জন্য সুন্দরবন এলাকা হইতে সরবরাহের কাজে ব্যাবহ্রিত হইত। ইদানীং ইহাকে খান সেনাদের চলাচলের জন্য ব্যাবহার করা উচিৎ বলিয়া জানা যায়।

 

স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নৌ ইউনিটের দুঃসাহসী কমান্ডোরা চলটি মাসের গোঁড়ার দিকে মাদারীপুর মহকুমার অন্তর্গত টেকের হাট এলাকায় ও দুইটি লঞ্চ ডুবাইয়া দেয়। এই সময়ে বরিশাল জেলার গৌর নদী এলাকায় খানসেনাদের একটি লঞ্চ পুড়াইয়া দেয় ও বরিশাল সদর উত্তর মহকুমার তথাকথিত প্রশাসক, পুলিশ কর্তা ও পাঞ্জাবি পুলিশ কে হত্যা করেন।

 

এইসব জলাঞ্চলের স্থল এলাকার থানা দফতর গুলিতে হানাদার বাহিনীর যে সব ঘাঁটি স্থাপিত হইয়াছে, স্বাধীনতা গেরিলা তৎপরতা এখন এই সব ঘাঁটির উপর বৃদ্ধি পাইয়া চলিয়াছে। মৃত্যু ভয়াল পদ্মা, যমুনা, মেঘনা ধলেশ্বরী আর মধুমতীর উত্তাল তরঙ্গমালার মধ্যে লালিত পালিত দুর্জয় মুক্তি সেনারা আধুনিক ভারি অস্ত্র শস্ত্র ছাড়াই আধুনি অস্ত্র সজ্জিত হানাদারদের পানিতে ডুবাইয়া মারিয়া ময়লা আবর্জনার মত ভাসাইয়া দিতেছেন।

 

চলটি মাসের প্রথম সপ্তাহে স্বাধীনতা সংগ্রামীরা মাদারীপুর মহকুমার ভেদর গঞ্জে হানাদার সৈন্যদের ঘাঁটিতে অতর্কিত আক্রমণ চালাইয়া অসীম সাহসের দৃষ্টান্ত স্থাপ্যর করিলেন। ভেদরগঞ্জ মুক্তিযোদ্ধারা বিপুল সংখ্যক খানসেনাদের সহিত এক দীর্ঘ সঙ্ঘর্ষে লিপ্ত হইয়া পৌনে দুশ খানসেনা খতম করেন। অবস্থা বেগতিক দেখিয়া জীবিতদের মধ্যে ৯ জন খানসেনা মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট অস্ত্র সহ আত্ম সমর্পন করে ও অবশিষ্ট রা পালাইয়া প্রাণ বাচায়। রা তাদের নিকট হইতে প্রায় ২০০ চিনা রাইফেল, কয়েকটি মাঝারি  মেশিন গান ও প্রচুর গোলাবারুদ দখল করে।

 

এও সময় মুক্তিযোদ্ধারা বরিশাক জেলার কাউখালি এলাকায় হানাদার বাহিনীকে সমুচিন শিক্ষা দেন। কয়েক ঘণ্টার সঙ্ঘর্ষে ৩৭ জন পাকসেনা নিহত হয়।

 

বাকিরা অস্ত্র পানিতে ফেলিয়া প্রাণ লইয়া পলায়ন করে। মুক্তিযোদ্ধারা ৮ টি রাইফেল, কয়েকটি মাঝারি মেশিন গান ও প্রচুর গোলাবারুদ দখল করিতে সক্ষম হয়।

 

গত ২৩ অক্টোবর  মুক্তিযোদ্ধারা খুলনা জেলাত আশা শুনি এলাকায় রাজাকার ক্যাম্পে আক্রমণ করে ৬৪ রাজাকার খতম ও ৪০ জন আহত করে। এ সময় ৫ টি রাইফেল দখল করে। একই দিনে খুলনা জেলার  পাটকেল ঘাটায় অতর্কিত আক্রমণে ১৫ জন খানসেনা হত্যা করে। এছাড়া খুলনার শ্যাম নগরে ও ভাটশাআল এলাকায় খান সেনাদের উপর প্রিথিক আক্রমণ চালাইয়া ১১ জন সেনাকে খতম করেন।

–       বাংলার বানি, ২ নভেম্বর, ১৯৭১

 

 

মুক্তিবাহিনী পাক সেনাদের ভারী ক্ষয় ক্ষতি দাবি

 

আগরতলা, ৩ নভেম্বর -বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধারা গত সপ্তাহে পাকিস্তানি সেনাদের অনেক ক্ষতি করে। তাড়া ৩৭৬ জন পাকসেনা নিহত  এবং ১০০ আহত করেন। এগুলো সব  ঢাকা, কুমিল্লা ও নোয়াখালী জেলায় হয়েছিল। পিটিআই রিপোর্ট।

সীমান্ত থেকে আজ এখানে পৌঁছনো প্রতিবেদন অনুযায়ী, মুক্তিবাহিনী বিপুল পরিমাণে অস্ত্র ও গোলাবারুদ দখল এবং তিন পাঠান সৈন্য ও ৫৩  রাজাকারদের বন্দী করে।

 

ঢাকায় হাসিম্পুর থানায় গত সপ্তাহে বেশ কয়েক ঘন্টা স্থায়ী একটি যুদ্ধ এ একজন পাকিস্তানি আর্মি ও ৮৬ জন  পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। অনেক অস্ত্র ও গোলাবারুদ দখল হয় যাদের মধ্যে – একটি মেশিনগান, দুটি এলএমজি এবং ৩৮ টি  হালকা অস্ত্র, বিপুল গোলাবারুদ । পাকিস্তানের বেতার স্টেশনের  সংযুক্ত কেন্দ্র ধ্বংস করা হয়।

 

একই এলাকায় আরেকটি সম্মুখযুদ্ধে বাংলাদেশ গেরিলা ২৭  পাক সেনা  নিহত করে।

 

পাকিস্তানিরা কুমিল্লা শহরে প্রায় ফরোয়ার্ড পজিশনের উপর তাদের আক্রমণ অব্যাহত রাখে। মুক্তিবাহিনী বারবার ২৮ অক্টোবর  এনকাউন্টার করে কোটবাড়ির পাকিস্তানি পোস্ট বন্ধ  করে। মোটের ওপর ১৪৭ জন  পাকিস্তানি সেনা নিহত ও অনেক অস্ত্র এবং গোলাবারুদ আটক হয়।

 

২৬ অক্টোবর নোয়াখালী জেলার ফেনী এলাকায়, মুক্তিবাহিনী পাকসেনাদের  প্রতিরক্ষা লাইন আপএ  ১৬ মালী বিল ওয়ালিখি  দখল করে  ও ১২৫ জন নিহত ও ৪০০ আহত করে।

 

মুক্তিবাহিনীর কার্যত কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ জেলার একটি সাব ডিভিশন অবরোধ করে পাকুন্দিয়া, হসিনপুর, কাত্তাদি, ইটনা, অষ্টগ্রাম দখল করেছে।

 

কিশোরগঞ্জ মহকুমার করিমগঞ্জ এবং নিকলি থানা আজ দখল  করে  , মুজিবনগরে লিবারেশন আর্মির সদর দপ্তরে র খবর ও পিটিআই রিপোর্ট।

 

চব্বিশ শত্রু সৈন্য এই সময় পাকুন্দিয়া ও হসেনপুর  থানায়  মুক্তিযোদ্ধাদের কমান্ডো হামলায় নিহত হয়।

এছাড়াও গেরিলা রা  কিশোরগঞ্জ এবং গৌরীপুর এঁর মধ্যে রেলওয়ে ব্রিজ ও একটি  কালভার্ট ধ্বংস করে কিশোরগঞ্জের এবং ময়মনসিংহ মধ্যে রেল সংযোগ বিঘ্নিত করে।  কিশোরগঞ্জের এবং ভৈরববাজার এঁর মধ্যে রেলওয়ে সেবা বন্ধ হয়।  এছাড়া ময়মনসিংহ শহরের সঙ্গে কিশোরগঞ্জের সংযোগ একটি সড়ক সেতু  ধ্বংস করে।

রিপোর্টএ জানা যায়,  কিশোরগঞ্জ মহকুমার সদর দপ্তর কার্যত অবরুদ্ধ ছিল এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনী শুধুমাত্র হেলিকপ্টারে তাদের  সরবরাহ পেয়ে ছিল।

 

সীমান্ত জুড়ে থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গত তিন দিনে কাতালদাঙ্গি, ভাতুড়িয়া এবং আদুরানি ও দিনাজপুরের রানিসান্দইল থানায় এ মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে হিংস্র এনকাউন্টার এ কমপক্ষে ১০০  জন পাক সেনা ও রাজাকার নিহত  ।

 

সিলেট জেলার রাধানগর এলাকায় গত ২৪ ঘণ্টা য় ১৭  পাকিস্তানি সেনা নিহত ও ৩০ জন  জন আহত  হয়েছে।

 

–       হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড, ৫ নভেম্বর, ১৯৭১

 

 

বিজয় বার্তা

 

ঢাকা – কুমিল্লা – চট্টগ্রাম রণাঙ্গন – ২৭ অক্টোবর কুমিল্লার নয়নপুরে মুক্তিযোদ্ধারা মর্তারের সাহায্যে পাকসেনাদের উপর আক্রমণ চালায় ও ৫ সেনা খতম করে। ওই দিন গিলাতলা এলাকায় গেরাল আক্রমণে ৩ সেনা নিহত হয়। জয় নগরে অন্য একটি আক্রমণে ২ পাকসেনা নিহত ও ৩ জন আহত হয় ।

 

২৬ অক্টোবর, ছাগলনাইয়া মুক্তিযোদ্ধারা মাইনের সাহায্যে একটি পাকিস্তানী ট্রাক ধ্বংস করে। ওই আক্রমণ এ ৭ জন নিয়মিত পাকসেনা  ও ৫ জন অনিয়মিত সেনা নিহত হয়। ওই দিন আবুর কান্ট এলাকায় মারাত্মক যুদ্ধ হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড আক্রমণে দিশেহারা হয়ে, পাকসেনারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। খবরে প্রকাশ উক্ত এলাকায় বেশ কয়েকদিন ধরে মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতা অব্যাহত থাকে।

 

ময়মন সিংহ – সিলেট রণাঙ্গন – অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহে মুক্তিযোদ্ধারা ময়মন সিংহ জেলার নকলা, নলিতা বাড়ি, পূর্ব ধলা, ও দুর্গাপুরে কয়েকটি আক্রমণ চালিয়ে ১০ জন অনিয়মিত সেনা খতম করে ও অনেক অস্ত্র উদ্ধার করে। ২৯ অক্টোবর ঠাকুর কোনার নিকটে টহলদার পাকসেনাদের আক্রমণ করে ২ জন নিয়মিত, ৪ জন অনিয়মিত সেনা হত্যা করে। ঐদিন জামালপুর ও বাহাদুরাবাদ ঘাট এঁর মধ্যবর্তি এলাকায় রেল লাইন উড়িয়ে দিতে সমর্থ হয়। তাড়া ওই সময় পাহারা রত ২ রাজাকারকে জীবিত অবস্থায় আত্ম সমর্পনে বাধ্য করে। ২৮ অক্টোবর মুক্তিযোদ্ধারা ধোলাই চা বাগানে পাকসেনাদের  কয়েক ঘণ্টার আক্রমণে ১ জন ক্যাপ্টেন সহ ২১ জন পাকসেনা নিহত করে ও আরও বহু অনিয়মিত সৈন্য নিহত হয়। এতে আমাদের ৩ জন শহিদ হন। তাছাড়া মুক্তিযোদ্ধারা বারলেখা ও কাটলিমারারা মধ্যবর্তি রেল যোগাযোগ অচল করে দেয়।

 

অক্টোবর এঁর শেষ সপ্তাহ নাগাদ এমুড়া এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকার ও নিয়মিত সৈন্যদের একটি মিশ্র টহলে অতর্কিত আক্রমণ করে ৯ জন সেনা খতম ও ৪ জন আহত করে। এঁর আগে ২৪ অক্টোবর একই এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ৫ অনিয়মত শত্রু সেনা খতম হয়।

 

কুষ্টিয়া- যশোর – খুলনা রণাঙ্গন – মুক্তিযোদ্ধারা গোউয়াল হাটের সন্নিকটে ২ জন ও কোস্তনিয়ার নিকটে ৫ জন পাকসেনা হত্যা করে। এছাড়া যশোর জেলার গদ খালি ও নাভারনের মাঝা মাঝই এক জায়গায় রেল লাইন উড়িয়ে দেয়। মুক্তিযোদ্ধারা চুনাম কাঠির কোন এক জায়গায় ১৪ টি রাইফেল সহ ১৮ রাজাকার কে আটক করে। খুলনা জেলার খাজুরা, হামিদপুর, লেবুতলা, অসমান পুড় প্রভৃতি এলাকায় হানাদার পাক বাহিনী আক্রমণ চালালে মুক্তিযোদ্ধারা ৪ জনকে হত্যা করে।

 

 

 

 

 

 

বাংলাদেশ নৌ বাহিনীর সাফল্য

 

বাংলাদেশ নেভাল ফর্স ৯ নং সেক্টরে সাফল্যের সাথে মংলা ও চালনায় পাকসেনাদের কয়েকটি জাহাজ ডুবিয়ে দেয়। নৌবাহিনীর ডুবুরিরা এ আক্রমণ চালায়। এছাড়া তাঁর কয়েকটি নদী বন্দরে পাকসেনাদের বেশ কয়েকটি লঞ্চ ও স্টিমার ডুবিয়ে দেয়।

 

আমাদের রণাঙ্গন প্রতিনিধি সম্প্রতি একটি নৌযান পরিদর্শনে গেলে, নেভাল লে ম খুরশিদ ( তথাকথিত আগরতলা মামলার আসামি) – এঁর সাথে সাক্ষাতকার ঘটে। তিনি আমাদের প্রতিনিধিকে জানান জ্যাম এই নৌ বাহিনী পাকসেনাদের যে কোন শক্তির সাথে মোকাবিলা করতে সক্ষম। তিনি আরও বলেন, এই সেক্টরের নেভাল বাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি করার পেছনে সকল অফিসার ও কমান্ডারদের দান অপরিসীম।

 

‘মাহতাব গাবেদ’ নিমজ্জিত – ৪ ঠা নভেম্বর, খবর পাওয়া গেছে, চট্টগ্রাম বন্দরে মাহতাব জাভেদ নামের একটি বিরাট তৈল বাহি জাহাজ এ মুক্তিযোদ্ধারা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ডুবিয়ে দিয়েছে। এতে ফোর ম্যান সহ ৭ নাবিক হয়  ডুবে মারা যায় নয়ত প্রাণ নিয়ে পালিয়েছে। কেনোনা এদের কোন সংবাদ পাওয়া যাচ্ছেনা বলে জাহাজ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। এছাড়া ১০ জন খালাসি গুরুতর আহত হয়েছে বলে জানা গেছে।

 

 

কিশোরগঞ্জ হানাদার মুক্ত

 

৩ নভেম্বর, মুক্তিযোদ্ধারা ময়মন সিংহের কিশোরগঞ্জ শহরটিকে হানাদার মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে। এছাড়া এই মহকুমার পাকুন্দিয়া, হসেনপুর, কটিয়াদি, অষ্টগ্রাম, করিমগঞ্জ, ইটনা ও নিকলি থানাগুলি পূর্বেই মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে এসেছে।

 

গেরিলা বাহিনী কিশোরগঞ্জ – গৌরীপুরের মধ্যে একাধিক সেতু ও কাল্ভার্ট ঢং করে দিয়ে রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন  করেছে। কিশোরগঞ্জ ভৈরব বাজারের মধ্যে ট্রেন যোগাযোগ বিছিন্ন করে দিয়েছে।

 

বর্তমানে কিশোরগঞ্জ সহরতই মুক্তিযোদ্ধাদের স্পম্পূর্ন নিয়ন্ত্রণে। এখানে কয়েকদিনের সম্মুখ যুদ্ধে ২০ হানাদার সেনা নিহত ও অনেক আহত হয়েছে বলে জানা গেছে।

–       বিপ্লবী বাংলাদেশ, ৭ নভেম্বর, ১৯৭১

 

 

ঢাকা আজ এক বিচ্ছিন্ন নগরী

 

ঢাকা হইতে ডেইলি টেলিগ্রাফের সংবাদ দাতা জানাইয়াছেন – গত ৩ নভেম্বর ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের পোশাক পরিধান করিয়া ঢাকার প্রধান পাওয়ার স্টেশনের ভিতর ঢুকিয়া পড়েন । কয়েকদিন পূর্বে ৩ জন ইঞ্জিনিয়ারের নিহত হওয়া তদন্ত করিতে আসিয়াছেন বলিয়া তাহারা প্রহরীদের জানান। অতঃপর মুক্তিযোদ্ধারা উক্ত স্টেশনের ৪ টি জেনারেটরের মধ্যে ৩ টি উড়াইয়া দেন ও প্রহরীদের চোখে ধুলা দিয়া সেখান হইতে সরিয়া পড়েন।

 

মুক্তিযোদ্ধাদের জোর তৎপরতার ফলে ঢাকার আঁশে পাশে ৩০ মাইল এলাকার সকল শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ করিয়া দেওয়া হইয়াছে। ঢাকা পাওয়ার স্টেশনের ইঞ্জিনিয়ার রা জানান আগামী কয়েকদিন ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট, ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল ও বৈদেশিক কূটনীতিক দের আবাস স্থল ছাড়া অন্য কোথাও আলো জ্বলিবে না।

 

অন্যান্য সূত্র হইতে পাওয়া খবরে জানা যায়, ঢাকা বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চল হইতে প্রায় বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িয়াছে। ঢাকা হইতে বিভিন্ন অঞ্চলের যোগাযোগ রক্ষাকারী সড়ক  সমূহ ৩০ মাইলের ভিতর নষ্ট করিয়া দিয়াছেন। ও প্রধান সড়কের উপর মাইন স্থাপন করা রহিয়াছে।

 

অ্যামেরিকান সংবাদ সরবরাহ সংস্থা  এসোসিয়েটেড প্রেস জানাইয়াছেন, মুক্তিযোদ্ধারা দুটি বাণিজ্যিক ব্যাংক অবরোধ করিয়া বেশ কিছু অর্থ উদ্ধার করেন।

 

ঢাকা পুলিশ সূত্র হইতে জানা গিয়াছে, ৩ জন যুবক স্টেনগান হাতে ব্যাংকে ঢুকিয়া পরে। ঘটনা স্থল পরিত্যাগের পূর্বে তাদের সহযোগিতা দানের জন্য মুক্তিযোদ্ধারা ব্যাংক কর্মচারিদের ধন্যবাদ জানান।

 

গত অক্টোবর মাসের ১৮ তারিখ পিলখানা এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের মাইনের আঘাতে পাকসেনাদের সৈন্য বোঝাই একটি লরই বিধ্বস্ত হয়। ৯ অক্টোবর ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের বাইরে মর্টার আক্রমণে বেশ কিছু পাকসেনা নিহত হয়। তাড়া নরসিংদীর কাছে তিতাস গ্যাস পাইপ লাইন উড়াইয়া দেয়।

 

৪ নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা নৌ বাহিনীর জনৈক প্রাক্তন অফিসারের ৪ পুত্রকে খতম করেন। তাড়া লুট ও বাঙ্গালী হত্যায় হানাদার বাহিনীকে সহায়তা করছিল। ওই রাতে বীর গেরিলারা সবু খাঁর বাড়িতে বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়।

 

তেজগাঁ এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা নৌকায় করিয়া টহল দান রত পাঞ্জাবিদের বিরুদ্ধে আক্রমণ করেন। ৫ খানসেনা নিহত হয়।

৩ নভেম্বর বাগডাঙ্গা এলাকায় স্বাধিনিতা সংগ্রামীরা টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করিয়া দেন ও অনেক খুঁটি উড়াইয়া দেন।

–       বাংলার বানি, ৯ নভেম্বর, ১৯৭১

 

 

 

সিলেটে যুদ্ধ অন্য ধাপে উন্নীত

 

করিমগঞ্জ, ৯ নভেম্বর, – বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ সিলেট জেলায় জোরদার করা হয়েছে।

 

এক মুক্তি ফৌজ  কর্মকর্তা  গতকাল বাংলাদেশ সীমান্তে আমাকে বলেছিলেন যে, সিলেট জেলার স্বাধীনতা এখন ১ মাসের  ব্যাপার ছিল।

 

এ পর্যন্ত হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ মহকুমার  তিন-চতুর্থাংশ অংশ  এবং উত্তর সিলেট এঁর অর্ধেক মুক্তি ফৌজ  নিয়ন্ত্রণে এবং এখন গোয়াইনঘাট, শাড়ি, সালুটিঘাট, কানাইঘাট, শ্রীমঙ্গল, শমসেরনগর ও সিলেট জেলার মধ্যে যুদ্ধ  অব্যাহত আছে।

 

এছাড়া মুক্তি ফৌজ গেরিলারা ও ১০০০০  মুক্তিযোদ্ধারা এখন সিলেট এঁর মধ্যে পাকিস্তান সেনাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নিয়োজিত আছে। বেঙ্গল রেজিমেন্ট চীনা অস্ত্র যা তারা আগে দখল করেছিল তা দিয়ে সিলেট এ যুদ্ধ করছে।

-হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড, ১০  নভেম্বর, ১৯৭১

 

 

সিলেট রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনীর বিজয় অব্যাহত

দুটি থানা দখল – ৬ টি নৌযান ধ্বংস

 

সিলেট ও ময়মন সিংহ রণাঙ্গনের বিভিন্ন এলাকা য় এছাড়াদের প্রচণ্ড আক্রমণে পাক বাহিনী বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে। তাদের অবস্থা দাঁড়িয়েছে খাঁচায় আটকা জানোয়ারের মত।

 

দেশ প্রেমিক বীর যোদ্ধারা রাধানগর, সারিঘাট ও সানাইঘাটে পাক বাহিনীকে এমন ব্যাস্ত রেখেছে যে, তাদের পক্ষে অন্য চৌকির সাহায্য চাওয়া কিংবা চলাফেরা সম্পূর্ন বন্ধ হয়ে গিয়েছে। অপরদিকে পাক বিমান বাহিনীর সালিটিকর বিমান বন্দরের কাছাকাছি কোম্পানিগঞ্জের নিকটে এছাড়ারা পাকসেনাদের উপর আক্রমণ চালাচ্ছে।

 

দিশেহারা পাকসেনারা এছাড়াদের অগ্রগতি রোধ করতে না পেরে বিমান বাহিনীর সাহায্য গ্রহণ করছে। পাক বিমান থেকে উক্ত এলাকায় অসামরিক অধিবাসীদের উপর নির্বিচারে গুলি বর্ষন করা হয়েছে।

 

গত মঙ্গলবার সিলেটের উত্তর পূর্বে অবস্থিত রাধানগরে মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে পাকসেনারা ছত্র ভঙ্গ হয়ে পরেছে। এতে ১৭ পাকসেনা নিহত ও ৩০ জন আহত হয়েছে। রাধানগরে বিপর্যস্ত পাকসেনাদের সাহায্যের জন্য সারিঘাত থেকে একদল সৈন্য পাঠানো হয়েছিল কিন্তু এছাড়াদের আক্রমণের মুখে তাড়া নিজেদের প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যায়। এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত রাধানগরে যুদ্ধ চলছে বলে খবর পাওয়া গিয়াছে।

 

কয়েকদিন পূর্বে এছাড়ারা সিলেটের বানিয়াচং ও ধর্ম পাশা থানা দুটি মুক্ত করেছিল। এখন সেখানে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের শক্তি বৃদ্ধি করিয়াছে।

মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড শেল ও মেশিনগানের গুলি বর্ষনের মুখে পাকসেনারা তাদের পূর্ব অবস্থান থেকে ক্রমে পিছি হটছে।

মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল গোলাবর্ষনে ঢাকা – আজমিরিগঞ্জ, শেরপুর নৌপথ সম্পূর্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সিলেটের সরবরাহ প্রধানত এই পথ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় সেই সেক্টরে পাকবাহিনীর জরুরি সরবরাহ বন্ধ আছে। গত এক পক্ষকালে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের ফলে  এই নদী পথে ৬ টি জলযান ডুবে যায়। সেগুলো ঢাকা থেকে সিলেটে জরুরি সরবরাহ নিয়ে যাচ্ছিল।

 

 

 

পাক সেনা নিহত

জয়ন্তিপুর ও সারিঘাট এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সোমবার মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে ৮ জন সেনা নিহত হয়। গেরিলারা খুমার ঘাট বিধ্বস্ত করেছে ও সিলেট শহরের দুটি বিদ্যুৎ পাইলন ধ্বংস করেছে।

 

 

ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে দিন রাত কাফন তৈরি হচ্ছে

 

গেরিলারা ঢাকায় বর্তমানে খুবই সক্রিয়। এঁর ফলে পাকসেনারা কোণ ঠাসা হয়ে পড়েছে। প্রতিদিন গড় ১৮৯ জন সেনা নিহত হচ্ছে। তাদের মৃত অফিসারদের কাফন তৈরি করার জন্য ক্যান্টণন্মেন্টে দিনরাত কাজ করছে। কবরস্থ করার জন্য পাকসেনাদের লাশ এইসব কফিনে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানো হয়।

 

সম্প্রতি লন্ডনের ‘সানডে টাইমস’ পত্রিকায় প্রকাশিত রীপোর্টে একথা বলা হয়েছে।

 

বাংলাদেশ থেকে ‘সানডে টাইমস’ এঁর সংবাদ দাতা রিপোর্টে সম্প্রতি ঢাকায় একাধিক সরকারী ভবনের উপর ৮০০ র বেশী গেরিলার ধারাবাহিক আক্রমণে কথা জানিয়েছেন। এঁর মধ্যে কয়েকটি সরকারী বাড়ি শহরের প্রধান ব্যাবসা কেন্দ্রে অবস্থিত।

 

উক্ত রিপোর্টে আরও বলা হয় যে, গেরিলা আক্রমণের ফলে পাক বাহিনী বিমান বন্দর সুরক্ষিত রাখার জন্য প্রধান সড়কের দু পাশে ‘পিল বক্স’ স্থাপন করতে বাধ্য হয়েছে।

–       জয় বাংলা, ১২ নভেম্বর, ১৯৭১

 

 

চৌগাছায় তুমুল লড়াই

 

বনগাঁ সীমান্ত, ২৭ নভেম্বর – যশোর থেকে অসামরিক লোকদের অপসারণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এক অসমর্থিত সংবাদ থেকে জানা গেছে যে, যশোর শহরের কিছু লোক ভারতের ২৪ পরগনা সীমান্তে সিমান্তরক্ষি বাহিনীর কাছে আশ্রয় চেয়েছে।

রেডিও পাকিস্তান আজ অস্বীকার করেছে যে, যশোরের চৌগাছায় তুমুল লড়াই চলছে। এটি যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে ১২ মাইল পশ্চিমে। এই লড়াইয়ে পাকিস্তান ফৌজের জয় লাভের জন্য রেডিও পাকিস্তান মসজিদে মসজিদে প্রার্থনা করতে অনুরোধ জানিয়েছে। যশোর রক্ষার জন্য প্রতিটি সৈন্য ও প্রতিটি লোককে সর্ব প্রকার ত্যাগ স্বীকার করতে বলা হয়েছে।

উত্তর পূর্ব রণাঙ্গনে নোয়াখালী জেলায় উল্লেখ যোগ্য সাফল্য লাভ করেছে। গতরাতে মুক্তিবাহিনী বিলোনিয়া দখল করে ওই জেলার সদর ফেনী অভিমুখে অভিযান করে আজ ছাগল নাইয়া দখল করেছে। ছাগল নাইয়া ফেনী শহর থেকে মাত্র ৪ মাইল উত্তরে।

যশোর শহর থেকে প্রায় ১৮ মাইল পশ্চিমে ঝিনাইদহ  পাঁচমাথার মোঃর দখল করে মুক্তি বাহিনী সেখানে তাদের ঘাঁটি শক্তিশালী করেছে। ঝিকরগাছায় আজও যুদ্ধ চলছে। কপোতাক্ষের উপরকার গুরুত্তপূর্ন ব্রিজটি এখনো পাকিস্তানীদের দখলে। পশ্চিম রণাঙ্গনে দিনাজপুর জেলার পচাগর পুনরুদ্ধারের জন্য পাকিস্তানী ফৌজ আগ সেখানে আরও শক্তি নিয়ে আক্রমণ চালাচ্ছে।

–       আনন্দ বাজার পত্রিকা, ১২ নভেম্বর, ১৯৭১

 

গেরিলা বিস্ফোরণে মার্কিন জাহাজ বিধ্বস্ত

 

ঢাকা ইউ এস এইড রিপোর্ট অনুযায়ী কর্মকর্তারা জানিয়েছেন যে শনিবার  প্রথমবারের মত গেরিলাদের একটি লিম্পেট মাইনে ত্রাণ খাদ্যশস্য বহনকারী একটি  আমেরিকান জাহাজ বিধ্বস্ত হয়েছে। এতে  জাতিসংঘের চিহ্ন ছিল। \

 

কর্মকর্তারা জানান, গেরিলাদের  আরও আক্রমণের সম্ভাবনায় বন্দরে জমে থাকা খাবার এ ইতিমধ্যে ব্যাপক পচন শুরু হয়েছে  যাতে অন্তত ৫  মিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতি হবে।

-হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড, ১৪  নভেম্বর, ১৯৭১

 

 

ব্রিটিশ জাহাজ খতম

 

গেরিলারা চালনা বন্দরে একটি ব্রিটিশ জাহাজের উপর গুলিবর্ষন করলে সেটি পালিয়ে কলকাতায় আশ্রয় নিয়েছে বলে জানা গেছে। জাহাজের প্রচুর ক্ষতি হয়েছে।

এটির নাম ‘ সিটি অব সেন্ট আল্বান্স” । এটি গত বুধবার কলকাতা থেকে চালনা এসেছিল পাট নিয়ে বিদেশে যাবে বলে।

কবরে আড়ং জানা গেছে, জাহাজটি চালনা ছেড়ে কলকাতায় গেলে সেখানে অবস্থান রত বিদেশী জাহাজ গুলি বাংলাদেশে আসতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।

 

 

 

পাঞ্জাবি পুলিশরা পালাই পালাই করছে

 

১২ নভেম্বর, বাংলাদেশে মুক্তি ফৌজ দমনে জঙ্গি ইয়াহিয়া  পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ৬০০০ পাঞ্জাব পুলিশ পাঠিয়েছিল। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা দমন তো দূরের কথা পাঞ্জাবি পুলিশরাই পালাই পালাই করছে বলে ডেইলি টেলিগ্রাফের ঢাকাস্থ সংবাদ দাতা জানিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, এইসব পুলিশ দের সেপ্টেম্বর এর মধ্যে স্বদেশে ফিরিয়ে আনা হবে এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে আনা হয়েছিল। এদের মনোবল ভেঙ্গে পড়েছে বলেও তিনি জানান। তারা এখন দাবি তুলেছে তাদের ফেরার ব্যাপারে একটি সঠিক তারিখ দিতে হবে।

 

 

টাঙ্গাইল

 

আমাদের রণাঙ্গন প্রতিনিধি জানিয়েছেন যে, মুক্তিবাহিনী টাঙ্গাইল থেকে পাকসেনাদের হটিয়ে দিয়েছে। পাবনা  জেলার রায়গঞ্জ পর্যন্ত টাঙাইলের মুক্তাঞ্চল সম্প্রসারিত হয়েছে। দক্ষিণে ঢাকা জেলার মানিকগঞ্জ পর্যন্ত বেড়েছে। ঢাকা ও টাঙাইলের মধ্যে রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন আছে।

 

 

ফরিদপুর

 

ফরিদপুর জেলার ভাটিয়াপাড়া এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ চালিয়ে ১৭ পাঞ্জাবি পুলিশ হত্যা করে। ভেদরগঞ্জ থানায় আক্রমণ চালিয়ে পাঞ্জাবি পুলিশ ও পাক দালাল সহ ৮৫ জনকে হত্যা করে। ডুমুরিয়া থানায় এক আক্রমণ চালিয়ে একজন ক্যাপ্টেন সহ ৭২ জন পাকসেনা নিহত হয়। মক্সেদপুরে অন্য আক্রমণে ক্যাপ্টেন সহ ৭২ জন নিহত ও ১৭ রাজাকার খতম হয়। গোপালগঞ্জ মহকুমা ফুকরা নামক স্থানে আক্রমণে ৮৩ জন পাঞ্জাব সেনা নিহত হয় ও অনেকে আহত হয়। এখানে ১৫ জন রাজাকার ও নিহত হয়।

 

বরিশাল – নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে মুক্তিযোদ্ধারা হিজলা থানা আক্রমণ করে , ফলে ৭ পাঞ্জাবি পুলিশ ও ৮ জন রাজাকার নিহত হয়। ৩০ টি রাইফেল উদ্ধার হয়। একই দিনে মুলাদি আক্রমণে থানার কর্মচারিরা ৪০ টি রাইফেল ও ২১ শত রাউন্ড গুলি সহ আত্ম সমর্পন করে। মুলাদি থানার ৩ রাজাকার কে গ্রাম বাসী পিটিয়ে হত্যা করে। আমাদের রণাঙ্গন প্রতিনিধি জানিয়েছে যে, বরিশাল জেলার প্রতিটি মুক্ত এলাকায় স্বাধীন বাংলার পতাকা উড্ডীন আছে।

 

অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি ক্যাপ্টেন জিয়ার নেতৃত্বে তুষখালি থানায় আক্রমণে বেশ কয়েকজন পুলিশ ও রাজাকার বন্দী করা হয়। বেশ কিছু অস্ত্র উদ্ধার হয়। মুক্তিযোদ্ধারা এখানকার সরকারী গুদাম থেকে খাদ্য শস্য উদ্ধার করে জনসাধারণের মাঝে বিতরণ করে দেয়।

 

রংপুর – রংপুর রণাঙ্গনের ডিম্লা, নীল ফামারি, ও দমার এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বসুরা ও ফুলছড়ি ঘাটের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা একটি সামরিক ট্রেন উলটে দিতে সমর্থ হয়। ৫০ পাকসেনা নিহত হয়। ডিম্লায় এক গেরিলা আক্রমণে ১০ পাকসেনা ও কিছু রাজাকার নিহত হয়।

যশোর – নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে মুক্তিযোদ্ধারা যশোরের সাচানাঙ্গা এলাকায় অতর্কিতে আক্রমণ করে। পাকসেনারা মর্টার দিয়ে জবাব দেয়। কিন্তু ব্যার্থ হয়। পরে পলায়ন করতে বাধ্য হয়। এতে ৩ জন পাকসেনা নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা এখানে গোলাবারুদ সহ ৩ টি চিনা রাইফেল হস্তগত করে। মুক্তিযোদ্ধারা বাগডাঙ্গা এলাকায় টেলিফোন তাঁর ও খুঁটি বিনষ্ট করে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে।

 

খুলনা – শ্যামনগর থানার কৈখালী নামক স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পাকসেনাদের যুদ্ধে ২ জন পাকসেনা সহ ৬ রাজাকার নিহত হয়। ও বেশ কিছু আহত হয়। মল্লারহাট থানারচারকুলিয়া গ্রামের সন্নিকটে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণে ক্যাপ্টেন সেলিম সহ ১২ জন হানাদার নিহত হয়।

 

কুমিল্লা – সিম্পুরের কাছে মাইনে মুক্তিযোদ্ধারা ২ জন পাকসেনা খতম করে ও ১৪ জন আহত হয়। কোতোয়ালি কোটেশর এলাকায় শত্রু ছাউনির উপর মর্টার আক্রমণ চালিয়ে ২ পাকসেনা খতম করা হয়। ৩ জন আহত হয়।

 

সিলেট – বিলম্বে প্রাপ্ত খবরে জানা গেছে – সিলেট জেলার গোয়াইন এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ চালিয়ে ২৩ পাকসেনা হত্যা করে ও বহু আহত করে।

 

চট্টগ্রাম – হাতিয়া ও সন্দীপ থানা মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে ও চট্টগ্রাম শহরে গেরিলা তৎপরতা আরও জোরদার হয়েছে। গেরিলারা শহর ও শহর তলির বিপুল সংখ্যক পাক দালাল কে খতম করে। পাকসেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়ে ছাউনিতে অবস্থান করছে।

–       বিপ্লবী বাংলাদেশ , ১৪ নভেম্বর, ১৯৭১

 

 

ফেনীতে মুক্তিফৌজের বিরাট সাফল্য

 

ঢাকা, ১৩ নভেম্বর – প্রচণ্ড সংগ্রামের পড় মুক্তিযোদ্ধারা নোয়াখালী জেলার ফেনী অঞ্চলের বিরাট এলাকা সম্পুর্ন হানাদার মুক্ত করেছেন। এতে ৩৯ জন পাকসেনা ও ১০ রাজাকার আত্ম সমর্পন করেছে। বহু অস্ত্র ও মূল্যবান যন্ত্রপাতি মুক্তিযোদ্ধারা জব্দ করেছে।

 

বাংলাদেশ সরকারের জনৈক মুখপাত্র জানান, এলাকাটির সামরিক গুরুত্ব অত্যাধিক। এটা মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে এক বিরাট সাফল্য।

 

বিলোনিয়া রেল স্টেশন মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে – ৭ দিন প্রচণ্ড লড়াইয়ের পড় গেরিলারা আজ পূর্ব বংগের বিলোনিয়া রেল স্টেশন দখল করেছে। পাকসেনারা এই অঞ্চল ত্যাগের পর বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ওড়ানো হয়।

 

মুক্তিযোদ্ধা কর্তৃক কসবায় বহু লক্ষ টাকার অস্ত্র ও গোলাবারুদ দখল – ঢাকা – ১৫ নভেম্বর- কষবার মুক্তাঞ্চলের যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা কমপক্ষে কয়েক লক্ষ টাকার পাক শত্রুদের গোলাবারুদ দখল করে নিয়েছে। হানাদার বাহিনী পালিয়ে যাবার  আগে সব ধ্বংস করে যেতে পারেনি। এখন মুক্তিযোদ্ধারা সেগুলো নিজেদের হেফাজতে নিয়েছে। কসবা এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে হানাদারদের মৃত্যু সংখ্যা এখনো সঠিক ভাবে জানা যায়নি। কারণ সেগুলো এখনো বাঙ্কার থেকে বেড় করা হচ্ছে।

 

এই অঞ্চলে হানাদার বাহিনীর ক্ষতি মারাত্মক হয়েছে বলে আমাদের সংবাদ দাতা জানান।

–       সাপ্তাহিক বাংলাদেশ, ১৫ নভেম্বর, ১৯৭১

ঢাকায় সাহসী গেরিলা অপারেশন

 

সুরক্ষিত ঢাকার শহর গত ২ সপ্তাহের মধ্যে অনেক সাহসী  গেরিলা অপারেশন হয়েছে।  সাম্প্রতিক এক ডজনেরও বেশি  বোমা বিস্ফোরণ দ্বারা  মতিঝিল এলাকায় সরকারী ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মতিঝিল ঢাকার  সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক জেলা।

 

১১ নভেম্বর জেনারেল পোস্ট অফিস থেকে প্রধান প্রবেশপথ এর কাছাকাছি একটি ভারী বিস্ফোরণ হয়। প্রত্যক্ষদর্শী জানান এতে তিন জন নিহত, ২১ জন  আহত এবং ছয়টি গাড়ি ধ্বংস হয়।  আরেকটি বিস্ফোরণে  বায়তুল মুকাররাম – শহর এর সর্ববৃহৎ শপিং সেন্টার এ একাধিক ব্যক্তি নিহত এবং ৪০  জন আহত হয়। , তাদের সাত জন মারাত্মক  আহত হন বলে  ঢাকা পুলিশ জানায়।

 

মুক্তিবাহিনীর নারায়ণগঞ্জ – ঢাকার বাইরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিল্প এলাকায় একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র উড়িয়ে দেয়।  স্থানীয় পুলিশ সূত্র এর বরাত দিয়ে  এএফপি গত সপ্তাহে রিপোর্ট করে যে গেরিলারা  স্টেশনের ভিতরের  স্থাপনা উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরক দিয়ে সমগ্র ভবন ভেঙ্গে ফেলে ও যন্ত্র নষ্ট করে।

 

এজেন্সি  প্রতিবেদনে আরও বলেন যে গেরিলারা ৯  নভেম্বর ঢাকার উপকণ্ঠে গেন্ডারিয়া রেলওয়ে স্টেশনের উপর একটি সাহসী আক্রমণ করে।  স্টেশন কর্মীদের বন্দী করে  এবং ভবনে আগুন দেয়।

 

 

হানাদার বাহিনী ২  সপ্তাহ বন্দী

 

অক্টোবরের প্রথমার্ধে মুক্তিবাহিনী বাংলাদেশে ১১৩৪ টি  গেরিলা অভিযান করে  এবং ১০৯০ জন  পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যকে হত্যা করে।  মুক্তিযোদ্ধারা ৯০০  পশ্চিম আধাসামরিক পুলিশ, সশস্ত্র সহযোগী হত্যা করে।  এই একই সময়ে ৪৫০ জন দালাল  মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।

-বাংলাদেশ, ১৯  নভেম্বর, ১৯৭১

 

 

 

রণাঙ্গন থেকে লিখছি

 

বাংলার বীর সন্তান তরুণ মুক্তিযোদ্ধারা কাপাসিয়া থানায় ১৪-১১-৭১ তারিখ রানিগঞ্জে ১৭ জন হানাদার পশু হত্যা করে। ১৭-১১-৭১ তারিখে বর্মিতে ৪ জন , ১৮-১১-৭১ তারিখে গোরসিঙ্গাতে বেশ কিছু সংখ্যক , ১৯-১১-৭১ তারিখে ঈদ করিবার ইচ্ছায় লুট করিয়া খাসি, ছাগল, মুরগি নিয়া নদী পার হইবার সময় ৯ হানাদার গুন্ডাকে হত্যা করে। মনহরদি, টঙ্গিবাড়ি, আড়াইহাজার, মুন্সিগঞ্জ থানা সহ ঢাকা জেলার বিস্তির্ন এলাকা নুক্ত ও পরোদমে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসনিক ব্যাবস্থা চলিতেছে। মুক্তিযোদ্ধারা নব পদ্ধতিতে বিবর ঘাঁটি ধ্বংসে লিপ্ত রহিয়াছেন।

–       মুক্ত বাংলা, নভেম্বর, ১৯৭১

 

 

ধলাপারায় হানাদারদের বিপর্যয়  – মেজর সহ ৯ জন নিহত

 

ঘাটাইল গত ৭ নভেম্বর ঘাটাইল থানার অন্তর্গত ধলা পাড়ায় প্রায় ৫০০ পাক সৈন্যের সাথে আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ভোর সাড়ে ৪ টা থেকে শুরু করে ৬ ঘণ্টা ব্যাপী এক মরণক্ষয়ী সঙ্ঘর্ষ হয়। এতে মুক্তিবাহিনীর একজন মেজর সহ ৬ পশ্চিমা কুকুর ও ৩ রাজাকার নিহত হয়। খবরে প্রকাশ ভোর রাতে দারুণ কুয়াশার আড়ালে বর্বর কুকুররা মুক্তিবাহিনীকে আক্রমণ করে। আমাদের জোয়ানরা সাহসিকতার সাথে এই আক্রমণ ব্যাহত করে দেয়।

 

 

 

 

 

রাজাকার সংবাদ

 

গত ৫ নভেম্বর থেকে ১৮ নভেম্বর টাঙ্গাইল জেলার বিভিন্ন এলাকা এবং ঢাকা টাঙ্গাইল ও টাঙ্গাইল ময়মনসিংহ রোড থেকে মোট ১৪৯ জন রাজাকার মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পন করেছে। এদের অনেকেই হাতিয়ার নিয়ে এসেছে ও তাদের কাছ থেকে ৫০০০ এর বেশী গুলি পাওয়া গেছে। সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর খবর হল, রাজাকাররা প্রতিদিনই ক্রমবর্ধমান হারে আত্ম সমর্পন করতে আসছে। এদের মনোবল হারিয়ে গেছে। হানাদারদের পদ লেহন করতে করতে এরা বিরক্ত হয়ে গেছে। আত্ম সমর্পন করলে ক্ষমা করা হবে এই মর্মে মাননীয় সি ইন সি মহোদয়ের ক্ষমা ঘোষণা করার পড় এরা আত্মসমর্পন করতে শুরু করেছে।

 

 

মর্টার শেলিং – ১৪ জন দস্যু নিহত

 

ফুলবাড়িয়া, গত ৫ নভেম্বর – ফুলবাড়িয়া থানার আছিম পোড়াবাড়িতে হানাদার কুকুর সেনাদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর একটি শক্তিশালী স্কোয়াডের  ৬ ঘণ্টা স্থায়ী এক প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়। আমাদের অগ্রবর্তি বাহিনীর সাফল্যজনক আক্রমণ অব্যাহত থাকার সময় পেছন থেকে গোলন্দাজ বাহিনী নিখুঁত ভাবে মর্টার চালায়। এতে ১৪ জন হানাদার কুকুর নিহত হয় ও ৬ জন আহত হয়।  মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে টিকতে না পেরে হানাদার রা বিপুল ক্ষয় ক্ষতি স্বীকার করে পিছিনে হটে যেতে বাধ্য হয়।

 

 

মেজর সহ ৬১ জন হানাদার নিহত

 

গত ৩১ অক্টোবর মির্জাপুর থানার পাথরঘাটায় দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে ইয়াহিয়ার লেলিয়ে দেয়া সৈন্যদের সাথে এক যুদ্ধ হয়। খবরে প্রকাশ ৬-৭ ঘণ্টা স্থায়ী যুদ্ধে গেরিলা কমান্ডো অতর্কিতে এই আক্রমণ চালায়। সম্মুখ সমর চলাকালীন গেরিলা কমান্ডো কজন পেছন থেকে হানাদার দস্যুদের ট্রেঞ্চ ও বাঙ্কারে প্রবেশ করে। বাঙ্কারে ৫ গজ দূর থেকে একজন কমান্ডো একজন পাঞ্জাবি মেজর কে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেয় – অন্যরা বাঙ্কারে অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে ১৮ জন পাঞ্জাবিকে হত্যা করে। আমাদের দুজন সৈন্য এখানে শহিদ হন। এছাড়া সম্মুখ যুদ্ধে মোট ২৯ জন হানাদার বর্বর সহ ১৪ জন রাজাকার নিহত হয়। যুদ্ধ শেষে আমাদের জোয়ান রা নিরাপদে ঘাঁটিতে ফিরে আসে।

 

 

৯৭ জন রাজাকার বন্দী

 

ফুলবাড়িয়া থানার পোড়াবারিতে গেরিলা মার খেয়ে হানাদার রা পালিয়ে গেলে মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকারদের ঘেরাও করে ৯৭ টি রাইফেল ও ২৫০২ টি গুলি সহ বন্দী করে।

 

 

গেরিলাদের মহড়া

 

টাঙ্গাইল – গত ৫ নভেম্বর টাঙাইলে সন্ধ্যে ৭ টা থেকে নিষ্প্রদীপ মহড়া চলাকালীন গেরিলারা তাদের গ্রেনেড ছোড়ার মহড়া চালায়। তাড়া শহরের বিভিন্ন গুরুত্তপুর্ন স্থানে প্রায় ৫০ টি গ্রেনেড ছোড়ে। এতে হানাদারদের কয়েকজন হতাহত হয়। টাঙাইলের প্রধান ডাকঘরের পেছনে অবস্থান রত রাজাকারদের উপর কমান্ডোরা ৩ জনকে হত্যা করে ও ৪ জনকে গুরুতর আহত করে।

 

বট তলায় যুদ্ধ

 

গত ১১ নভেম্বর মুক্তাগাছার বট তলায় মুক্তিবাহিনী এক যুদ্ধে ৩ জন পাঞ্জাবি হানাদার সেনা সহ ৩ রাজাকার হত্যা করে ও ৭ রাজাকার বন্দী করে।

–       রণাঙ্গন , ২১ নভেম্বর, ১৯৭১

 

 

বিজয় বার্তা

 

সিলেট – তুকার বাজারের কাছে পাকসেনা ও গেরিলাদের মধ্যে এক প্রচণ্ড লড়াই হয়। ফলে ৮ জন পাকসেনা ও রাজাকার নিহত হয়।

 

 

 

ঢাকা- চট্টগ্রাম – কুমিল্লা রণাঙ্গন

 

গত ১৫ নভেম্বর নোয়াখালী জেলার ছাগল নাইয়ায় পাক সেনাদের উপর মুক্তিযোদ্ধারা অতর্কিত আক্রমণে ৫ পাকসেনা নিহত হয়।

 

ঢাকা শাহরে ও উপকণ্ঠে গেরিলাদের প্রচণ্ড আক্রমণের ফলে পাক কর্তৃপক্ষ বেসামাল হয়ে ১৭ নভেম্বর সকাল ৫ টা  থেকে ঢাকা শহরে আকস্মিক ভাবে কারফ্যু জারি করে। ও প্রতি বাড়ি বাড়ি তল্লাশি চালায়। মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকার বিভিন্ন স্থানে পাক সেনার বিরুদ্দে সফল প্রতিরোধ গড়ে তোলে।

 

রংপুর- দিনাজপুর- রাজশাহী রণাঙ্গন – গত ১৬ নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী এলাকায় পাক সেনাদের ঘাঁটি অবরোধ করে ও আক্রমণ চালায়। এতে ৬ পাকসেনা নিহত ও ৪ জন আহত হয়। দক্ষিণ খেটকই বাড়িতে গেরিলারা ৩ শত্রু সৈন্য খতম করে। জাতিবাঙ্গা ও পাবেলিয়ার মধ্যবর্তি স্থানে গেরিলারা রেল লাইন ধ্বংস করে ও শত্রু সৈন্যের চলাচল ব্যাবস্থা বানচাল করে দেয়।

 

রংপুর জেলার ৮ টি থানা সম্পুর্ন পাক হানাদার মুক্ত। প্রায় ১২ হাজার বর্গ মাইল ব্যাপী এলাকায় ৭ লাখ জনতা স্বাভাবিক ভাবে জীবন যাপন করছে। এইসব এলাকায় বাংলাদেশ সরকার ইউনিয়ন পর্যায় থেকে থানা পর্যায় পর্যন্ত প্রশাসনিক কার্য পরিচালনা করছে।

 

বিস্তীর্ন এলাকা মুক্ত- আমাদের বিশেষ প্রতিনিধি প্রেরিত এক সংবাদে জানা গেছে যে, রাজশাহী জেলার দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চলের বিস্তীর্ন এলাকা এখন সম্পূর্ন মুক্ত। এই এলাকার ফরিদপুর, আলাগলি, হাকিমপুর, বাকড় আলি, রাধাকান্ত পুর, পাংকা, পিরোজপুর, পলাডাঙ্গা, চিল্মারি, সাহেব নগর প্রভ্রতিতি সীমান্ত চৌকি থেকে মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের হটিতে দিয়েছে। সেগুলি এখন মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি তে পরিণত হয়েছে।

 

এছাড়াও নবাবগঞ্জ শহরের উপকণ্ঠে ইসলামপুর, বারমারিয়াজ, উপর বাগডাঙ্গা, সুন্দরপুর, ছোড় কলকাতা, ইলশামারি, দেবনগর প্রভৃতি গ্রামে ১৩ নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে রাজাকার ও খানসেনাদের যুদ্ধ হয়। এতে ঐ অঞ্চলের গ্রামবাসীরা মুক্তিযোদ্ধাদের সক্রিয়ভাবে সাহায্য করেন। মুক্তিযোদ্ধারা এখানে ৫ টি ৩০৩ রাইফেল দখল করেন ও ৫ জন রাজাকার বন্দি করেন।

 

 

গেরিলাদের ব্যাপক আক্রমণ

 

ময়মন সিংহ- ময়মন সিংহের ঘেঁস গাও এলাকা থেকে হানাদারদের বিতাড়িত করে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের দখল কায়েম করেছে।

 

উত্তর বঙ্গ ও পূর্ব বঙ্গের সংযোগ স্থল দেওয়ানগঞ্জের বিস্তীর্ন এলাকাতেও মুক্তিযোদ্ধারা পূর্ন অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছে। এগুলোর মধ্যে আছে ডাংচর, চর রামপুর, গাম খাওয়া, হাতী বসটা ইত্যাদি। এখানে বেসামরিক প্রশাসন ব্যাবস্থা চালু করা হয়েছে।

 

ময়মন সিংহ জেলার আরও একটি গুরুত্তপুর্ন এলাকা থেকেও মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে হানাদার বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। এই জেলার তেলিখালিতে পাক সেনাদের একটি শক ঘাঁটিতে গেরিলারা প্রবল আক্রমণ চালায়। এখানে ৬৯ জন পাকসেনা নিহত হয়। ১ জন গেরিলাদের হাতে বন্দি হয়। গত ১৪ নভেম্বর ময়মন সিংহের আরও একটি অঞ্চল গেরিলারা অতর্কিত আক্রমণে জনৈক জুনিয়র কমিশন সামরিক অফিসার সহ ৯ পাকসেনা খতম করে।

 

গত কয়েক সপ্তাহের সংবাদে জানা যায় যে, এই জেলায় গেরিলাদের ব্যাপক আক্রমণে দুই শতাধিক পাকসেনা ও রাজাকার হতাহত হয়েছে।

 

পাক জঙ্গি বিমান বিধ্বস্ত – ১৮ নভেম্বর – চট্টগ্রাম। খবর পাওয়া গেছে মুক্তিযোদ্ধারা কক্স বাজারের নিকট একখানা জঙ্গি বিমান গুলি করে ভূপতিত করেছে।

 

ঘটনার বিবরণে প্রকাশ বাংলাদেশের অসীম সাহসী মুক্তিযোদ্ধারা শহরটি দখলের চেষ্টা করলে হানাদার রা বাঁধা দেয়। ফলে সামনা সামনি তুমুল যুদ্ধ হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের  প্রচণ্ড মারের মুখে হানাদার বাহিনী টিকতে না পেরে পিছু হটছে – তখন এই জঙ্গি বিমানের সাহায্য নেয়া হয়।

 

 

 

এ বৎসরেই ঢাকায় স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়বে – কর্নেল ওসমানী

 

অতি সম্প্রতি একটি প্রভাবশালী ইংরেজি সাপ্তাহিক পত্রিকার এক সাংবাদিকের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর প্রধান অত্যন্ত জোরের সাথে বলেন যে, আমাদের মুক্তিবাহিনী এখন এত দ্রুততার সাথে দেশকে মুক্ত করার সংগ্রামে অগ্রসর হচ্ছেন যে, আশা করা যায় এ বৎসর শেষ হওয়ার আগেই ঢাকার বুকে স্বাধীন বাংলাদেশের গৌরবোজ্জ্বল পতাকা উড্ডীন হবে।

 

তিনি বলেন, মুক্তিবাহিনী এখন স্থল, নৌ ও বিমান বাহিনী দ্বারা সজ্জিত ও ইতিমধ্যে নৌ বাহিনীর ডুবুরি গেরিলারা অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছেন। এখন বাংলাদেশের টাঙ্গাইল, যশোর, খুলনার সুন্দর বন, নোয়াখালী, কুমিল্লা, সিলেট, রংপুর ইত্যাদি অঞ্চলে ২৫০০ বর্গ মাইল এলাকা মুক্তিযোদ্ধারা মুক্ত করেছে ও এ সমস্ত অঞ্চলে বেসামরিক শাসন ব্যাবস্থা কায়েম হয়েছে।

–       বিপ্লিবি বাংলাদেশ, ২১ নভেম্বর, ১৯৭১

 

 

মুক্তিবাহিনী গেরিলাদের বিরাট কর্ম তৎপরতা

 

নবীনগর – ঢাকায় প্তাপ্ত সংবাদে জানা যায়, মুক্তিযোদ্ধারা এই থানার বিভিন্ন স্থানে পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্ঘর্ষে কমপক্ষে ৬০ জন হানাদারকে নিহত ও দিগুণ সংখ্যক হানাদারকে আহত ও বন্দি করেছে। মুক্তিযোদ্ধারা বাঞ্ছারাম পুর গোডাউন থেকে চার হাজার মন চাল উদ্ধার করে তা গ্রামবাসীদের মধ্যে বিলিয়ে দেন।

 

বিক্রমপুর- বিলম্বে প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ, ঢাকা জেলার লৌহজং থানাধিন বিক্রমপুর এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা পর পর কয়েকটি সঙ্ঘর্ষে খানসেনাদের প্রচুর ক্ষয় ক্ষতি করেছে ও সমরাস্ত্র হস্তগত করেছে। ২০ অক্টোবর তারিখে মাত্র কয়েকজন গেরিলা একটি শত্রুবাহি নৌকা অতর্কিত আক্রমণ করে একজন পাঞ্জাবি সেনা ও ২ জন রাজাকারকে নিহত ও ২ জনকে বন্দি করে পরে কান কেটে ছেড়ে দেয়।

 

পরের দিন অন্য এক আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা ২৮ জন পাকসেনা ও রাজাকার কে ঘটনাস্থলে হত্যা করে। তৃতীয় দিবসে দুটি লঞ্চ বাহী ৪৬ জন মিলিটারি গ্রামে প্রবেশ করে লুট তরাজ , নারিধর্ষন ও অগ্নি সংযোগ করে। ঐ সময় ওত পেতে থাকা গেরিলারা যুদ্ধে অবতির্ন হয়। দির্ঘ ১৮ ঘণ্টা মুখোমুখি লড়াই করে গেরিলারা সব খানসেনাকে খতম করে দেয়। এই সঙ্ঘর্ষে প্রচুর গোলাবারুদ ও অস্ত্র গেরিলাদের হস্তগত হয়। এই একই থানায় নদীবক্ষে প্রায় ১ লক্ষ টাকার পাটবাহি একটি নৌকা আমাদের বীর গেরিলারা ডুবিয়ে দেয়।

 

মুকুন্দপুর – সংবাদে প্রকাশ, আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা সাহসের সহিত এখানে পাক দস্যুদের মোকাবিলা করেন। যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধারা মুকুন্দ পুর দখল নেন। পলাতক হানাদার বাহিনীর ক্ষয় ক্ষতি এখনো জানা যায়নি। তবে অনুমান করা গেছে, এখানে কমপক্ষে ৪৫ জন হানাদার পাক সৈন্য নিহত ও ৮ জন জীবন্ত ধরা পরে।

আমাদের পাওয়া সংবাদে আরও প্রকাশ, কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর খুব সহসাই হানাদারমুক্ত হবে। পাক বাহিনী এখন চতুর্দিক থেকে কুমিল্লা জেলার বিভিন্ন স্থানে অক্রান্ত হচ্ছে।

অন্য এক সংবাদে প্রকাশ, কুমিল্লা জেলার লক্ষ্মীপুর এলাকাতেও হানাদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে প্রচণ্ড মার খেয়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে।

–       সাপ্তাহিক বাংলাদেশ, ২২ নভেম্বর, ১৯৭১

 

 

 

রণাঙ্গন সংবাদ

 

কুড়িগ্রাম, ২১ নভেম্বর – আমাদের কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি জানান মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল চাপের মুখে ভুরুংগ মারিতে পাকসেনারা তাদের অবস্থান ধরে রাখতে অসমর্থ হয় ও নাগেশ্বরীতে হটে আসে। আমাদের মুক্তিবাহিনীর বীর জোয়ানগণ নাগেশ্বরী শত্রু অবস্তানে সাড়াশি অভিযান পরিচালনা করে ও অনেক আহত করে।

 

এই অঞ্চলের পাকসেনারা এত ভিত হয়ে পরেছে যে, তারা স্বাভাবিক নিয়মে ঈদের নামাজ পড়তে ভিত। কাজেই কুড়িগ্রামে অবস্থানরত পাকসেনারা জনসাধারণের জামাতের পূর্বেই পাহার মোতায়েন করে নিজেরা ঈদের নামাজ সমাধা করবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের এই সিদ্ধান্ত কুড়িগ্রাম মহকুমার শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আব্দুল হাফেজ মাইকের সাহায্যে প্রচার করে।

 

 

 

পাক সেনার ট্যাঙ্ক ব্যাবহার

 

গত ২১ নভেম্বর যশোর , চট্টগ্রাম ও সিলেট রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধা ও পাকসেনাদের মধ্যে ভয়াবহ যুদ্দ হয়। পাকসেনারা ট্যাংক ব্যবহার করে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের বেপরোয়া আক্রমণের মুখে তারা টিকতে না পেরে পশ্চাদপসারণ করে। মুক্তিবাহিনীর দাবি অনুসারে এইসব রণাঙ্গন থেকে তারা ৫ টি ট্যাঙ্ক দখল করে নেয়। এর মধ্যে ২ টি একদম অকেজো হয়ে যায় ও ৩ টিআস্ত পাওয়া যায়। পাক সাঁজোয়া বাহিনীর এই বিপর্যয়ের ফলে পাক সামরিক জান্তার মনে শেষ বিজয়ের আশার প্রদীপের শিখা টি ও যেন আস্তে আস্তে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসছে।

–       অগ্রদূত, ২৪ নভেম্বর, ১৯৭১

 

 

 

যশোর, কিশোরগঞ্জ, মেহেরপুর, স্রীহট্ট অবরুদ্ধ। মুন্সিগঞ্জ মুক্ত। চট্টগ্রামে বোমা বর্ষন

 

মুজিবনগর, ২৪ নভেম্বর – যশোর, খুলনা, কুষ্টিয়া ও ফরিদপুর – বাংলাদেশের এই ৪ জেলার ৮০ভাগ এলাকাই আজ মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে। মুক্তিযোদ্ধারা গুরুত্তপূর্ন কিশোরগঞ্জ, শ্রী হট্ট ও যশোর শহরে শত্রুসেনাদের ঘিরে ফেলেছে। যশোর ক্যান্টনমেন্টে প্রচণ্ড লড়াই হচ্ছে। উত্তর, পশ্চিম ও দক্ষিণ দিক থেকে মুক্তিযোদ্ধারা যশোর শহরকে ঘিরে রেখেছে। কুষ্টিয়া জেলার গুরুত্তপুর্ন মেহেরপুর শহরটির চারিদিকে এখন গেরালার। হটে যাবার মুখে পাকসেনারা গোলাবর্ষন করছে। ঢাকা থেকে সর্বশষ যা খবর এসেছে, তা হল, সামরিক দিক  থেকে গুরুত্তপূর্ন মুন্সীগঞ্জ শহর ও সন্নিহিত এলাকা এখন মুক্ত।

 

 

যশোর শহর ও ক্যান্টনমেন্ট থেকে নগত টাকা, নোট ও সোনাদানা সরানো শুরু হয়ে গেছে। পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ার অয়েজ এর বিমানে করে ঢাকায় এসব জিনিস নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এপর্যন্ত ১৫০০ পাক সৈন্য মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্ম সমর্পন করেছে।

 

বি বি সির খবর, আজ চট্টগ্রাম বন্দরের উপর মুক্তিযোদ্ধাদের বিমান থেকে বোমা বর্ষন করা হয়েছে। উপরন্তু একটি গান বোট, দুটি তেলবাহী জাহাজ, ৪ টি খাদ্যবাহি জলযান বাংলাদেশ নৌবহর ডুবিয়ে দিয়েছে।

–       আনন্দ বাজার পত্রিকা, ২৫ নভেম্বর, ১৯৭১

 

 

 

ঝিকরগাছা দখল – ১০ জি জেলা ৭ দিনে মুক্ত করার সংকল্প

 

২৫ নভেম্বর – আজ সন্ধ্যায় মুক্তিযোদ্ধারা ঝিকর গাছা থেকে পাকসেনাদের তাড়িয়ে দিয়ে ওদের ঘাঁটি দখল করেন। এখন সব জায়গায় বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে। শত্রু পালিয়ে যাবার সময় বহু অস্ত্র ফেলে গেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বড় দল এখন যশোর শহরের ৪ মাইল উত্তর- পশ্চিমে গিয়ে চাপ দিতে শুরু করেছে।

 

মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশের রংপুর থেকে খুলনা – এই বিস্তৃত এলাকার অন্তত ১০ টি জেলা অর্থাৎ রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, রাজশাহী, পাবনা, কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা – ইত্যাদি ৭ দিনের মধ্যে মুক্ত করার সংকল্প নিয়ে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে।

 

বাংলাদেশ সরকারের সূত্র থেকে যানা যায়, ইতিমধ্যে গত ১ সপ্তাহে প্রচণ্ড যুদ্ধ চলার পর রংপুর ও দিনাজপুরের প্রায় ৪৫০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা মুক্তিযোদ্ধারা দখল করে।

 

মুক্তিযোদ্ধাদের একজন মুখপাত্র বলেন, আমাদের এই এলাকা মুক্ত করে শত্রুকে নিশ্চিনহ করার কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে। প্রতি সেক্টরে আমাদের যোদ্ধার শত্রুদের কোন ঠাসা করে এনেছে।

 

এই মুখপাত্র আরও আশা করেন, যশোর দুর্গ শত্রু কবল মুক্ত করতে আর ৭২ ঘণ্টার বেশী লাগা উচিৎ নয়। তিনি অবশ্য বিস্তারিত কিছু বলতে অস্বীকার করেন।

 

মুক্তিবাহিনীর সূত্রে ঘোষণা করা হয় – সাতক্ষিরা মহকুমার প্রতিটি থানা মুক্ত হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা খুলনার দিকে অগ্রসর হচ্ছে।

 

মেহেরপুর শহর দখল নিয়ে জোর লড়াই চলছে।

দিনাজপুর শহরের আমবাগান ছেড়ে পাকবাহিনী সৈয়দপুরের দিকে পালিয়ে যাচ্ছে। রাঙ্গামাটিতে লড়াই – গ্রামের পর গ্রাম

মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে। সামনে ফেনী। 

 

২৫ নভেম্বর – মরণপণ লড়াই করে মুক্তিযোদ্ধারা ছিনিয়ে নিয়েছে ফুল্গাজি, আনন্দপুর আর চাঁদ গাজি বাজার। এখন হাত বাড়ালেই ফেনী – মাত্র ৩ মাইল দূরে। এছাড়া, পরশুরাম থানা এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের পুর্ন কর্তৃত্ব। গত ১১ নভেম্বর ঐ এলাকাটি মুক্ত হয়।

 

লড়াই চলছে রাঙ্গামাটিতে। মুখোমুখি। সেখানে ১৩ জন রাজাকার রাইফেল গোলাবারুদ নিয়ে আত্ম সমর্পন করেছে।

 

এদিকে খানসেনা কুমিল্লার পশ্চিমে দাউদকান্দিতে একটি নতুন ছাউনি খুলতে বাধ্য হল। স্পষ্টত বোঝা যাচ্ছে ওরা নাজেহাল। এখন অদের কাছে বড় সমস্যা এই গুরুত্তপূর্ন অঞ্চলটিকে মুক্তিবাহিনীর দুর্বার গতিপথ থেকে দূরে রাখা। তাই এখন ওরা শুধু কুমিল্লার উপর ভরসা করতে পারছেনা। তাই এই নতুন ছাউনি।

ইতিমধ্যে ভান্দিনা থানা মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে এসেছে। এটি দাউদকান্দির আরও পশ্চিমে। থানার পুলিশ রা পালিয়েছে। মেঘনার তীরে চান্দিনা জলপথে ঢাকার সঙ্গে কুমিল্লার সংযোগ রক্ষা করে থাকে।

–       আনন্দ বাজার পত্রিকা, ২৬ নভেম্বর, ১৯৭১

 

 

 

 

খুলনা শহরের দিকে মুক্তি সেনার অগ্রগতি

সাতক্ষিরা ঝিকর গাছা হতে খানেরা বিতাড়িত

(স্টাফ রিপোর্টার )

 

বনগাঁ সীমান্ত, ২৫ নভেম্বর – মুক্তিযোদ্ধারা ঝিকরগাছা বাজার থেকে পাকসেনাদের হটিয়ে যশোর সেক্টরে নতুন ফ্রন্ট খুলেছে আজ। এই গত ৮ এপ্রিল মুক্তিযোদ্ধারা আজ সারা সাতক্ষিরা মহকুমা থেকে পাকসেনাদের বিতাড়িত করেছে। সাতক্ষিরা থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি কলাম খুলনা শহরের দিকে অভিযান করছে।

 

যশোর ক্যান্টনমেন্টের চারপাশে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণের তীব্রতা বৃদ্ধি করেছে।

 

চৌগাছা থেকে কপোতাক্ষ নদী অতিক্রম করে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি নতুন কলাম যশোর শহরের ৪ মাইল উত্তর পশ্চিমে পৌঁছেছে।

 

কৃষ্ণ নগর থেকে যুগান্তরের এক সংবাদ দাতা জানিয়েছেন যে, গত রাতে ঝিনাইদহ শহরে অভিযান চালিয়ে সেখানে পাকসেনাদের একটি ব্রিগেড কে যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে বহিষ্কার করেছে। কুষ্টিয়ার মহেশপুর ও দর্শনা সম্পূর্নভাবে দখলে এসেছে। ফলে খুলনা দর্শনা ট্রেন সার্ভিস বাতিল হয়ে গেছে।

রংপুর ও দিনাজপুরে

 

শিলিগুড়ি থেকে প্রাপ্ত সংবাদে জানা গেছে যে, মুক্তিযোদ্ধারা রংপুর ও দিনাজপুরে প্রায় সাড়ে চারশ বর্গ্মাইল এলাকা মুক্ত করেছে।

 

কুষ্টিয়া জেলায় মহেশ পুর দখল করে মুক্তিযোদ্ধারা চিত্রা নদীর দক্ষিণ তীরে অগ্রবর্তি ঘাঁটি স্থাপন করেছে। কৃষ্ণ নগর এর সংবাদ দাতা জানিয়েছেন, মুক্তিযোদ্ধারা খুলনা কুষ্টিয়া রেল লাইনের কাছাকাছি  কিছু অঞ্চল থেকে সৈন্যদের বিতাড়িত করে ও এই অঞ্চলের ট্রেন সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। কুষ্টিয়া জেলার বিভিন্ন অংশে মুক্তিযোদ্ধারা সাফল্য অর্জন করে চিত্রা নদীর দক্ষিণ তীরে গিয়ে পৌঁছেছে। ফলে চুয়াডাঙ্গার ৯ তি গ্রাম পাক কবল মুক্ত হয়েছে। এখন মুক্তিযোদ্ধারা মেহেরপুরের ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করায় পাকিস্তানী ফৌজ চাদবিল গ্রামের দিকে পিছিয়ে যাবার চেষ্টা করছে।

মুজিব নগর থেকে ইউ এন আই জানাচ্ছেন- বাংলাদেশ সরকারের জনৈক মুখপাত্র বলেছেন যে, মুক্তিযোদ্ধারা ১২০০০ বর্গ

 

কিলোমিটার এলাকায় অসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে।

–       যুগান্তর, ২৬ নভেম্বর, ১৯৭১

 

 

যশোর দুর্গের পতন আসন্ন – বসন্তপুর ও পচাগর অধিকৃত – ঝিনাইদহ দর্শনায় লড়াই

 

টুঙ্গি ( নদীয়া) সীমান্ত , ২৬ নভেম্বর – কুষ্টিয়ার দর্শনা রেল স্টেশন এলাকায় প্রচণ্ড লড়াই এখনো চলছে। দিনাজপুর জেলার পচাগর ও খুলনা জেলারবসন্তপুরের পতন ঘটেছে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে। ঝিনাইদহ পাঁচ মাথার মোরে (ফাইভ পয়েন্ট ক্রসিং ) মুক্তিযোদ্ধারা আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করায় যশোর ক্যান্টনমেন্টের সাথে পাকসেনাদের যোগাযোগ এখন বিচ্ছিন্ন। যশোর দুর্গের পতন ও আসন্ন। ঢাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ প্রচণ্ড রূপ নিয়েছে। গ্রেনেড আর গুলির শব্দে পাকসেনাদের প্রধান শিবির ঢাকা এখন কম্পমান। বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন রণাঙ্গনে দুর্বার অগ্রগতির সংবাদ আজ পাওয়া গেছে।

 

এদিকে যশোর শহর থেকে ১২ মাইল উতরে ঝিনাইহদহ পাঁচ মাথার মোড়ে (ফাইভ পয়েন্ট ক্রসিং) মুক্তিযোদ্ধারা আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করায় দর্শনার পাকিস্তানী ফৌজের সঙ্গে যশোর ক্যান্টনমেন্টের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।

 

ঝিনাইদহ পাঁচ মাঠের মোড় সামরিক দিক দিয়ে অত্যান্ত গুরুত্তপূর্ন। কারণ এই মোড় থেকে কুষ্টিয়া – চুতাডাঙ্গার রাস্তায় বিরাট ব্যারিকেড গড়ে তোলায় ঝিনাইহদ থেকে পাকসেনারা যশোরে যেতে পারছেনা। ঝিনাইদহে পাকিস্তান যদি অতিরিক্ত ফৌজ প্যারাসুটে না নামাতে পারে তাহে ঝিনাইদহ পশ্চাৎপসারণ ছাড়া আর উপায় নেই।

 

জানাগেছে যে, ঝিকরগাছা থেকে এখনো সম্পূর্ন পশ্চাদপসরন করেনি। ঝিকরগাছা শহরটি কপোতাক্ষ নদের দ্বারা দুই ভাগে বিভক্ত। শহরের যে অংশ নদের উপর অবস্থিত ব্রিজের পুর্ব দিকে সেখানে এখনো যুদ্ধ চলছে ও নদের উপরের ব্রিজটি এখনো বিধ্বস্ত হয়নি।

–       যুগান্তর, ২৭ নভেম্বর, ১৯৭১

 

 

 

কুষ্টিয়ায় পাক সৈন্যরা পোড়া মাতি নীতি নিয়ে পিছু হটছে

 

শুক্রবার বানপুর সীমান্ত ঘুরে এসে স্টাফ রীপোর্টার জানাচ্ছেন, পাক দখলদার বাহিনী বাংলাদেশে পোড়ামাটি নীতি অবলম্বন করেছে। এক একটি ঘাঁটি ছেড়ে পালানর আগে তারা গ্রামকে গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। কুষ্টিয়ার ২২ টির মধ্যে ২০ টি সীমান্ত ঘাঁটি থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের তাড়া খেয়ে পাকসেনারা পালিয়েছে।

 

দামুর হুদা থানা মুক্তিযোদ্ধারা বৃহস্পতিবার দখল করে নেন। থানায় এখন বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে। থানার ও সি, তার স্ত্রী কন্যা, সেকেন্ড অফিসার, দুজন এস আই ও ৭ জন পুলিশ মোট ১৩ জনকে মুক্তিযোদ্ধারা বন্দি করে মুক্তাঞ্চলে নিয়ে আসেন।

 

চুয়াডাঙ্গা ছাড়া এই মহকুমার দুটি থানাই ( দামুর হুদা, জীবন নগর) এখন মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে। চুয়াডাঙ্গার ভিতরেও গেরিলা তৎপরতা বাড়ছে। মোজাম্মেল পেট্রোল পাম্প তাঁরা উড়িয়ে দিয়েছেন। বিজলি লাইন ধ্বংস করেছেন।

 

কুস্তয়া জেলার চারদিক থেকে এখন পাকসেনারা  মাগুরার দিকে যেতে চাইছে। লক্ষ্য রাজবাড়ি গোয়ালন্দ ঘাট হয়ে চাঁদপুরের দিকে পালান। গোয়ালন্দে তাঁরা সেজন্য ১৬ টি স্টিমার তৈরি রেখেছে।

 

একটির পর একটি এলাকা ছেড়ে পাক সেনারা পালাচ্ছে আর মুক্ত গ্রাম গুলিতে মুক্তিযোদ্ধারা ঢুকছেন বিরাট অভ্যর্থনা ও অভিনন্দনের মধ্যে।  ঘর বাড়ি শস্য জ্বলে যাক তবু মুক্তির আনন্দে ওরা এসে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘিরে ধরেন। ওরই মধ্যে রুটি, মাংস, ডাব যা পারেন যতটা পারেন। তাই নিয়ে সীমান্ত পর্যন্ত রাস্তাও তাঁরা বানিয়ে দিয়েছেন।

–       আনন্দ বাজার পত্রিকা, ২৭ নভেম্বর, ১৯৭১

 

 

বিজয় বার্তা

 

ময়মন সিংহ – কিশোরগঞ্জের ৭ টি থানা মুক্তিযোদ্ধারা দখল করে নিতে সমর্থ হয়েছেন। এছাড়া বীর মুক্তিযোদ্ধারা আরও ৬ টি পুলিশ ঘাঁটি অবরুদ্ধ করে রেখেছেন। তাজাস এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল আক্রমণে এক প্লাটুন সেনা খতম হয়েছে। এদের মধ্যে ২ জন অফিসার। মুক্তিযোদ্ধারা এখানে একটি ভারী মেশিন গান, ১ টি ১৬ মি মি ও কয়েকটি স্বয়ংক্রিয় রাইফেল দখল করে নিয়েছেন। 

 

শ্বরিহট্ট – ২৬ নভেম্বর – হাকিমগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধারা ২ কোম্পানি পাকসেনা অপসারণ করেছেন। একজন ক্যাওটেন ১ জন জে সি ও সহ ২৫ জন পাকসেনা আটক করেছেন। উত্তর শ্বরিহট্টের জয়ন্তিপুরে এক তীব্র লড়াইয়ে ৩০ জন দখলদার হানাদার নিহত হয়েছে। কয়েকটি সামরিক ট্রাক ভর্তি করে পাক বাহিনী হতাহত হানাদারদের নিয়ে যায়। এখন শত্রু মুক্ত।

রংপুর – এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের দুর্বার গতির সামনে পাকসেনারা বেসামাল হয়ে পরে। তাদের ঘাঁটি পারুলিয়া ধ্বংস করে মুক্তিযোদ্ধারা হাতী বান্ধা থানা দখলে নেয়। শত্রুদের সিমরা ঘাঁটি মুক্তিযোদ্ধারা ধ্বংস করে দিয়েছে। রংপুরের রউমারি, পাটগ্রাম, নাগেশ্বরী, ভুরুংমারি ও আরও অনেক মুক্ত এলাকায় স্বাধীন বাংলার পতাকা পত পত করে উড়ছে।

 

যশোর – মুজিব নগর , ২৬ নভেম্বর – খুলনা কুষ্টিয়া রংপুর দিনাজপুর কুমিল্লা প্রভৃতি স্থানে শত্রুরা যেভাবে নাজেহাল হয়েছে একই ভাবে যশোরেও তাঁরা বেসামাল। ৪ দন প্রচণ্ড লড়াইয়ের পর মুক্তিযোদ্ধারা পটাশ নদীর তীরবর্তি চৌগাছা দখল করে নিয়েছে। যশোর ক্যান্টনমেন্ট মুখি দুর্বার গতি ক্রমান্বয়ে সাফল্যের দিকে এগিয়ে চলেছেন। আজকের ভোরে বীর মুক্তিযোদ্ধারা যশোর ক্যান্টনমেন্টের অদুরবর্তি সিংহ জুলি দখল করে নিয়েছেন।

 

দিনাজপুর – ২৬ নভেম্বর – সফলতার পড় সফলতা অর্জন করে মুক্তিযোদ্ধারা পূর্ব দিনাজপুর জেলার মগকুমা শহর পচাগরের পাক দুশমনদের শক্ত ঘাঁটি দখল করে নিয়েছে। মার খেয়ে ঠাকুর গাওএর দিকে পালাতে শুরু করেছে। মুক্তিযোদ্ধারা ওদের পিছু ধাওয়া করছে। ঠাকুরগাঁও সড়কে ময়দান দীঘিতে হানাদাররা ঘাঁটি স্থাপন করেছে। মুক্তিযোদ্ধারা চতুর্দিক দিয়ে প্রবল আক্রমণ করে আজ ভোরে পচাগর মুক্ত করে নিয়েছে। পাক সৈন্যের কাছ থেকে মুক্তিযোদ্ধারা প্রচুর অস্ত্র দখল করে নিয়েছেন। সরকারী ও বেসরকারি ভবনে এখন স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়ছে।

পাবনা – ঈশ্বরদী টেলিফোন এক্সচেঞ্জ মুক্তিযোদ্ধারা সম্পুর্ন ধ্বংস করে দিয়েছেন। রেল লাইন ক্ষতিগ্রস্ত করায় রেল যোগাযোগ বন্ধ।

 

রাজশাহী – নবাব গঞ্জ থেকে ৩ মাইল দূরে ইসলামপুর ও চাতিডুবি অবস্থিত শত্রু ঘাঁটির উপর মুক্তিযোদ্ধারা মর্টার ও মেশিন গান নিয়ে প্রবল ভাবে আক্রমণ পরিচালনা করে। নবাব গঞ্জের উপকণ্ঠে এই ঘাঁটির পতন হলে রাজশাহী – নবাব গঞ্জ সড়ক যোগাযোগ সম্পূর্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। এই অঞ্চলে আক্রমণের প্রথম পর্যায়ে হানাদার বাহিনী রাজাকার দালালদের প্রথম এগিয়ে দেয় কিন্তু মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে প্রায় সবগুলি দালাল খতম হয়। এরপর শুরু হয় মুখোমুখি সংগ্রাম।

 

হানাদার বাহিনী একই সঙ্ঘর্ষে ভার মেশিনগান ৮১ মি মি মর্টারের গোলা ও ২৫ পাউন্ড ওজনের কামানের গোলা ব্যাবহার করে। কিন্তু কোন মতেই মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পারছেনা। এখন পর্যন্ত ১২৫ পাকসেনা ও ২৫০ জন রাজাকার মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে খতম হয়েছে ও ১৫ টি বাঙ্কার ধ্বংস হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের নায়েক কাসেম, মোহর আলি এই যুদ্ধে অভুতপুর্ব পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধারা এখানে ১৪ জন রাজাকার ও ২ জন পাকসেনা আটক করে ও ২০ টি রাইফেল ও অনেক গোলাবারুদ দখল করেছেন। রাজশাহী ১০০ বর্গ মাইল এখন মুক্তিযোদ্ধাদের পুর্ন দখলে এবং সেখানে স্বাধীন বাংলার প্রশাসন চলছে। লড়াই এখনো চলছে। নবাবগঞ্জ শহরটি ৩ দিক দিয়ে অবরুদ্ধ। পতন প্রায় আসন্ন। 

 

হিলিতে প্রচণ্ড যুদ্ধ – পাক ট্যাংক ধ্বংস – হিলি রক্ষার মরণ পণ যুদ্ধে লিপ্ত হয়েও পাক বাহিনীকে আরও ট্যাঙ্ক হারাতে হয়েছে বলে আজ এক বিশ্বস্ত সূত্রের খবরে জানা গেছে। হিলি পাকসেনাদের গুরুত্তপুর্ন ঘাঁটি। হিলির পতন হলে রংপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে উত্তর বাংলাদেশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পরবে। তাই পাকসেনারা এখানে মরিয়া হয়ে উঠেছে।

 

মুক্তিযোদ্ধারা হিলিকে ৩ দিন থেকে আক্রমণ করেছে। বেসামাল পাকসেনারা ভারতের বালুর ঘাটের দিকে অগ্রসর হলে ভারতীয় বীর সেনারা পাল্টা আক্রমণ করে। কয়েকখানা ট্যাংক ও ৮০ জন পাকসেনা খতম হয়েছে।

 

জানা গেছে হিলিতে ৮ হাজার সৈন্য ট্যাংক ও দূর পাল্লার ভারী কামান নিয়েও মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রসর কে প্রতিহত করতে পারছেনা।

–       বিপ্লবী বাংলাদেশ, ২৮ নভেম্বর, ১৯৭১

 

 

 

রণাঙ্গন থেকে লিখছি

 

দেশ মাতৃকার অতন্দ্র প্রহরী বীর মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশের প্রায় তিন চতুর্থাংশ স্থান শত্রুমুক্ত করে বাংলাদেশের পতাকা বিজয়ের স্তম্ভ হিসাবে ইস্পাত দৃঢ় মনোবল নিয়ে উড্ডীন করেছেন। শ্রীপুর, কাপাসিয়া, শিবপুর, রায়পুরা ও মনহরদি থানাসহ কিশোরগঞ্জ মহকুমা সম্পূর্ন শত্রুমুক্ত করেছেন। ওতর এলাকা র বহু রাজাকার ও বাঙ্গালী সৈন্য প্রচুর গোলাবারুদ সহ মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট আত্মসমর্পন করেছে। কালীগঞ্জ ও জয়দেব পুর থানার শিল্প এলাকা সহ বিস্তির্ন অঞ্চল এখন মুক্ত। উক্ত এলাকাত শত্রু ঘাঁটি তে আজ ২ দিন যাবত মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে তুমুল সঙ্ঘর্ষ চলছে।

–       মুক্ত বাংলা, ২৯ নভেম্বর, ১৯৭১

 

 

 

পাকসেনাদের হিলি থেকে পলায়ন – মুক্তি বাহিনীর দখলে জয়পুরহাট

 

হিলি সীমান্ত , ২৮ নভেম্বর- আজ ভারতীয় সীমান্ত বাহিনী পাক গোলন্দাজ বাহিনীকে বাংলাদেশের হিলি থেকে পিছু হটিয়ে দেন। অদিকে মুক্তিযোদ্ধারা তুমুল লড়াইয়ের পর হিলির ১০ মাইল ভিটরে জয়পুরহাট মুক্ত করেছেন। সেখানে ৪ টি পাক ট্যাঙ্ক ঘায়েল হয়েছে।

 

রাতে এই সীমান্তে আরও সংবাদ – এই জয়পুর হাতে উত্তর বঙ্গের সবচেয়ে বড় চিনির কলটি এখন মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে। এর আগে পাকবাহিনীর সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াইয়ে প্রায় ৪৫০ পাকসেনা নিহত হয়েছে।  আহত হয়েছে প্রচুর। কয়েকজন অফিসার সহ বেশ কিছু সৈন্য মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে বন্দি হয়েছে। একটি ট্যাঙ্ক ঘায়েল।

 

জয়পুর হাত শহরটি হল দিনাজপুর জেলার ও বগুড়া জেলার মাঝামাঝি স্থানে। হিলি থেকে জয়পুরহাটের দূরত্ব ১০ মাইল।

ঐ চিনি কারখানার উপর থেকে পাকবাহিনী ক্রমাগত ভারতের হিলির উপর গোলাবর্ষন করছিল। সন্ধ্যার আগেই পাকিস্তান বাহিনী তাদের শেফি ট্যাঙ্ক নিয়ে পালাবার চেষ্টা করলে মুক্তিযোদ্ধারা বগুড়া সড়কের দুদিকে আক্রমণ শুরু করে। সংঘর্ষের সময় পাকসেনারা ট্যাঙ্ক, ভারী কামান থেকে প্রচুর গোলাবর্ষন করে। রবিবার মুক্তিযোদ্ধারা ঐ সেক্টরে মোট ৪ ৎ ট্যাঙ্ক ঘায়েল করেছে।

–       আনন্দ বাজার পত্রিকা, ২৯ নভেম্বর, ১৯৭১

 

 

 

মুক্তিফৌজের নিয়ন্ত্রণে ফেনী – শ্বরই হটতের ১৫ মাইল দূরে তুমুল যুদ্ধ

 

ফেনী শহর সোমবার মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে এসেছে। কিন্তু শহরের আস পাশ থেকে পাক সেনাদের নিশ্চিনহ না করা পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধারা সরকারিভাবে ফেনী দখলের সংবাদ ঘোষণা করছেনা। আজ সকালে রেডিও পাকিস্তান ফেনী শহরের বুকে তুমুল লড়াইয়ের কথা স্বীকার করেছে।

 

ফেনী দখলের ফলে উতরে লাকসাম থেকে দক্ষিণে চট্টগ্রাম পর্যন্ত রেল সংযোগ বিচ্ছিন্ন হতে চলেছে। ফেনী থেকে লাকসামের রেল দূরত্ব ২৪ মাইল ও চট্টগ্রামের দূরত্ব ৪০ মাইল। ফেনীর কাছে সুলিনিয়া নদীর আসে পাশে এলাকাগুলি গতকাল মুক্তিযোদ্ধারা দখল করে।

 

মুক্তিযোদ্ধারা এই সেক্টরে আজ আরেকটি সফলতা লাভ  করেছে শ্রী হট্টে । আজ সন্ধ্যায় মুক্তিযোদ্ধারা শ্রী হট্ট শহর থেকে ১৫ মাইল দূরে এসে পৌছেছে । সেখানে শাহবাগে তুমুল যুদ্ধ চলছে।

 

যশোর ক্যান্টনমেন্টে  মুক্তিযোদ্ধাদের অবরোধ আরও তীব্র হয়েছে। জানা গেছে সেখানে কউএক্তি বিক্ষিপ্ত এলাকা থেকে পাকসেনাদের সরিয়ে ক্যান্টনমেন্টে আনা হয়েছে। ঝিকর গাছায় এখনো বিক্ষিপ্ত যুদ্ধ চলছে।

 

টাঙ্গাইল সম্পূর্ন মুক্ত হয়েছে ও কিশোরগঞ্জ মহকুমা শহরকে মুক্তিযোদ্ধারা চারদিক থেকে অবরোধ করে রেখেছে।

কুষ্টিয়া সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধারা গতকাল পাকসেনাদের কয়েকটি বাঙ্কার দখল করে ২০ জন পাকসেনা ও ১ জন মেজর কে বন্দি করেছে।

 

কুষ্টিয়ার জীবন নগর থেকে যশোরের চৌগাছা পর্যন্ত প্রায় ২২ মাইল এলাকা থেকে মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের হটিয়ে দিয়েছে।

 

মুক্তিযোদ্ধারা পূর্বে শ্রী  হট্ট ও ময়মন সিংহ জেলা এবং পশ্চিমে যশোর ও খুলনা জেলার বিস্তির্ন এলাকা মুক্ত করেছে। বিভিন্ন রণাঙ্গনে শত্রু সেনার উপর মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ররবাত্তক আক্রমণ চলছে। কয়েক স্থানে নতুন করে শত্রু ওপর আক্রমণ করা হয়েছে।

 

শ্রী হট্ট জেলায় গতকাল জয়মতিপুরের দক্ষিণে ছোট খেল এলাকা মুক্ত হয়েছে। কানাইঘাটে পাক আক্রমণ প্রতিহত করা হচ্ছে। 

উত্তর রণাঙ্গন

 

বাংলাদেশের উত্তর রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনী পনের শত বর্গ্মাইল এলাকার উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ জোরদার করেছে। তিনটি মহকুমা এই এলাকায় অন্তর্ভূক্ত।

 

সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও মৌলভবাজার মহকুমার বানিয়াচুল, আজমিরগঞ্জ, নবীগঞ্জ ও জগন্নাথপুর এলাকা মুক্তিযোদ্ধাদের পুর্ন নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

 

শ্রী হট্টের তাহেরপুর থানা অবরুদ্ধ। সূচনা ঘাঁটি মুক্তিযোদ্ধারা ঘিরে রেখেছে। কোম্পানিগঞ্জ সালুতিকর এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে পাকসেনারা শ্রী হট্ট শহরে আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছে। শ্রী হট্ট ও সুনামগঞ্জের মধ্যে সকল প্রকার যোগাযোগ বন্ধ।

 

ময়মন সিংহ জেলার কামাল পুর ঘাঁটির চারপাশে প্রচণ্ড লড়াই চলছে। টাঙ্গাইল এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রগতি অব্যাহত রয়েছে।

 

বাহাদুরাবাদ এলাকায় অস্ত্র বাহী ৩০০ ফুট দীর্ঘ একটি পাকিস্তানী বজরা মুক্তিবাহিনী ডুবিয়ে দিয়েছে।

 

ঢাকা থেকে বিলম্বে প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ, কোদালিয়াতে মুক্তিযোদ্ধারা একটি গুরুত্তপূর্ন সেতু ধ্বংস করে দিয়েছেন। ঢাকা ও টাঙাইলের মধ্যে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। মুক্তিযোদ্ধারা কুষ্টিয়া ও গোয়ালন্দের মধ্যে দুটি কাল্ভার্ট উড়িয়ে দিয়েছেন।

–       যুগান্তর ৩০ নভেম্বর, ১৯৭১

 

 

মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে পাকবাহিনী নাজেহাল

(বিশেষ প্রিতিনিধি)

 

মুক্তিযোদ্ধার হাতে পাকসেনারা পদে পদে নাজেহাল হচ্ছে। কদিন কাটুলিয়ায় গেরিলা বাহিনী পাকসেনার মধ্যে যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধার মেশিনগান ও রাইফেলের মুখে পাকসেনারা নাজেহাল হয়ে পিছু হটে যায়। এতে ৫ সেনা খতম হয়। কুষ্টিয়ার নিকটে মুন্সিগঞ্জ ও আলমডাঙ্গা রেল স্টেশনের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের মাইন বিস্ফোরণে একটি বোঝাই পাক সৈন্য বাহী ট্রেন সম্পূর্নভাবে বিধ্বস্ত হয়। বহু শত্রু হতাহত হয়।

 

সিলেটের চাতর শহরে মুক্তিযোদ্ধা ও পাকসেনাদের যুদ্ধে ৫০ এর বেশী খানসেনা নিহত হয়। তাদের সাথে এই পাপ যুদ্ধে লিপ্ত আরও ৬৫ জন রাজাকারও খুন হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার মুক্ত করে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে।

চট্টগ্রাম সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধারা প্রবল চাপ সৃষ্টি করার দরুন পাকসেনাদের নাভিশ্বাস দেখা দিয়েছে। তাদের হতাহতের খবর প্রতিদিনই আসছে।

 

মুক্তিযোদ্ধারা কুমিল্লা জেলার কসবা রণাঙ্গনে বিশেষ সাফল্য অড়রগণ করেছে। এক বিশাল এলাকা এখন মুক্তিযোদ্ধাদের কবলে রয়েছে। খবরে প্রকাশ, সালদা নদী অঞ্চলের যুদ্ধে গেরিলাদের ইস্পাত কঠিন আক্রমণ প্রতিহত করতে সর্ব শক্তি প্রয়োগ করেও পাক বাহিনী প্রচণ্ড মার ক্ষয়েছে। এতে ৬০ জনের ও বেশী সেনা প্রাণ হারিয়েছে।

রংপুর জেলার সীমান্ত এলাকা চিল্মারি ভুরুংগ মারিতে গেরিলা বাহিনী বিশেষ তৎপরতা চালিয়ে পাক সৈন্য ঘাঁটি নিশ্চিনহ করে দিয়েছে। বহু খানসেনা খতম হয়েছে।

 

গেরিলারা শান্তাহার ও পার্বতীপুরের মধ্য বর্বরটি রেল সেতু টি ডিনামাইট বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেয়।

 

 

 

 

 

 

রণাঙ্গন সংবাদ

 

বাংলার মুক্তি সংগ্রামের সুদীর্ঘ ৮ মাসের ইতিহাসে গত ১ সপ্তাহের মধ্যে প্রত্যেকটি রণাঙ্গন থেকে আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অভুতপূর্ব অগ্রগতি ও সাফল্যের সংবাদ বিভিন্ন বেতার কেন্দ্র ও নির্ভরযগ্য সূত্রে পাওয়া গিয়েছে – তা যেমনি উৎসাহ ব্যাঞ্জক ও মহিমান্বিত তেমনি বাংলার স্বাধীনতা সূর্যের উদয়নের নিশ্চিত সংকেত মূলক।

 

গত এক সপ্তাহে রংপুর দিনাজপুর, বগুড়া, কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা, পটুয়াখালী, চিটাগাং, সিলেট, ময়মন সিংহ, কুমিল্লা, টাঙ্গাইল ও নোয়াখালী প্রভৃতি জেলার রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধারা বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে পাকসেনাদের বিপুল ক্ষতি করছে ও তাদের ঘাঁটি থেকে হটিয়ে দিচ্ছে। মুক্ত অঞ্চলে স্বাধীন বাংলা সরকারের বেসামরিক শাসন ব্যাবস্থা চালু করা হয়েছে। বর্তমানে মুক্তি সেনারা সদ্য মুক্ত অঞ্চলগুলিতে নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করে পাকসেনাদের উপর চাপ বৃদ্ধি করেছে।

 

এ সপ্তাহের মুক্ত অঞ্চলের মধ্যে রংপুরে নাগেশ্বরী থানা, দিনাজপুরের পাঁচ গরা মহকুমা, টাঙ্গাইল জেলার অবশিষ্ট অংশ, সিলেটের শমসেরনগর, নোয়াখালীর পরশুরাম, ছাগল নাইয়া উল্লেখযোগ্য। এছাড়া ছত্রুদের গুরুত্ব পুর্ন অবস্থান যশোর দুর্গ, ফেনী শহর, সুনামগঞ্জের উত্তরাঞ্চল, দর্শনা এখন মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা অবরুদ্ধ। তুমুল লড়াই চলছে।

 

এ সপ্তাহে বীর মুক্তিযোদ্ধা নৌবাহিনীর গেরিলাদের অত্যান্ত তৎপর দেখা যায়। এর ফলে শত্রুদের ৪ টি জলযান ধ্বংস ও ২ টি আমাদের করতল গত হয়েছে।

 

শত্রু পক্ষের মোট ৩ টি বিমান ও ১৭ টি ট্যাঙ্ক ধ্বংস সাধন এ সপ্তাহের উল্লেখযোগ্য ঘটনা।

 

 

 

কালির বাজার অভিযান

 

রৌমারি। ২৯ নভেম্বর। আমাদের নিজস্ব প্রতিনিধি পরিবেশিত সংবাদে প্রকাশ, গত ২৯ নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা গাইবান্ধা মহকুমার কালির বাজারে অভিযানে ৬ জন পাক পুলিশ ও রাজাকার গ্রেফতার করে ৯ টি রাইফেল সহ প্রায় ৪০০ গুলি হস্তগত করে। আমাদের ১ জন মুক্তিযোদ্ধা শাহাদত বরন করে।

 

অন্য আর একটি অভিযানে কুড়িগ্রামের মোগল পুর অঞ্চলের অদূরে রাজাকারদের অবস্থান ঠেলে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা ৫ টি রাইফেল ও প্রায় ২০০ গুলি উদ্ধার করে।

 

 

 

নাগেশ্বরী অভিযানে মুক্তিফৌজের বিরাট সাফল্য

 

কুড়িগ্রাম। ৩০ নভেম্বর। আমাদের কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি পরিবেশিত সংবাদে প্রকাশ, গত ২ সপ্তাহে যুদ্ধে বিপুল ক্ষয় ক্ষতির জন্য পাকসেনারা বাধ্য হয়ে ভুরুংগ মারি ছেড়ে নাগেশ্বরীতে তাদের অবস্থান গড়ে তোলে ও মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ৩ দিক থেকে ঘিরে ফেলে। প্রায় ১০ দিন যাবত সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। অবশেষে ২৯ নভেম্বর আর টিকতে না পেরে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে।

 

আরও প্রকাশ, বিভ্রান্ত পাকসেনারা চাপের মুকে ছত্রভঙ্গ হয়ে পরে ও তাদের ইউনিফর্ম ত্যাগ করে সাদা পোশাকে কুড়িগ্রামের দিকে ছুটে পালায়। এই অভিযানে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ হস্তগত করে।

–       অগ্রদূত, ১ ডিসেম্বর, ১৯৭১

 

 

 

 

 

রণাঙ্গন থেকে  লিখছি

 

স্বাধীনতা সংগ্রামী বীর মুক্তিযোদ্ধারা কালীগঞ্জ থানায় কালীগঞ্জ , ঘোড়াশালে হানাদার বাহিনীকে চারদিক দিয়ে ঘেরাও পূর্বক মারনাঘাত হানিয়া প্রতি মুহুর্তে রক্তে রঞ্জিত পশুর মৃতদেহ গুলি দেখিবার গর্বিত আশায় উদগ্রীব হইয়া আছেন। এ পর্যন্ত ১৭ জন পাঞ্জাবি সৈন্য নিহত ও বহু আহত হয়। শ্রী পুর ও নরসিংদীতে হানাদার বাহিনীকে মুক্তিযোদ্ধারা ঘেরাও করিয়া প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করিয়াছে।

-মুক্তবাংলা, ২ ডিসেম্বর, ১৯৭১

 

 

এখনই চরম আঘাত হানতে হবে – ওসমানী

 

মুজিব নগর, ২৯ নভেম্বর – আমার ছেলেরা এখন সম্পূর্ন প্রস্তুত। মাত্র কয়েক মাসেই তাঁরা পৃথিবীর যে কোন সুশিক্ষিত সেনাবাহিনীর সাথে পাল্লা দেবার মত দুর্ধর্ষ হয়ে ওঠে। আর দেরি নয়, এখনই চরম আঘাত হানতে হবে – বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনী প্রধান কর্নেল ওসমানী মুজিব নগরে এই কথাগুলো বলেন।

 

মুক্তিযুদ্ধের বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তিনি বলেন – শত্রুরা এখন তাদের শিবির গুলিতে বন্দি হয়ে আছে। আমাদের গেরিলারা প্রতি পদে পদে বিপদের জাল পেতে রেখেছে। মুক্ত এলাকার কাছাকাছি আসতে গেলেই তাদের রক্তাক্ত নাক নিয়ে ফিরতে হচ্ছে।

 

জনাব ওসমানী বলেন, মার্সিনারি সৈন্য বাহিনী আর জাতীয় মুক্তিবাহিনীতে অনেক তফাত। এখানে গোটা দেশ এক হয়ে লড়ছে। আমার ছেলেরা চাকরী করার মন নিয়ে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয়নি। তাঁরা প্রতিরোধ নেবার শপথ নিয়ে সব কিছু পিছনে ফেলে বন্দুক কাঁধে নিয়েছে।

 

মুক্তিবাহিনীর শক্তি সম্পর্কে দৃঢ় আস্থা নিয়ে কর্নেল ওসমানী দৃপ্ত কণ্ঠে বলেন, আমরা এগিয়ে চলেছি। শত্রুরা বড় জোর আগামী মার্চ মাস পর্যন্ত টিকে থাকতে পারবে। আমার ছেলেরা তাদের নিশ্চিনহ করে দেবেই।

মুক্তিযোদ্ধারা সিলেট জেলা তোলপাড় করে তুলেছেন

 

মুজিব নগর, ২৮ নভেম্বর – শ্রী হট্টের রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপক আক্রমণে পাক সেনারা ছন্নছাড়া হয়ে ছুটে পালাচ্ছে। রাধানগর শহরটি মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আনতে আর বাকি নেই। এটি মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে এলে করিমগঞ্জ সীমান্ত থেকে শালুটিকর পর্যন্ত মুক্ত এলাকায় পরিণত হবে।

 

এদিকে সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার মহকুমা মিঘাউন, ইটনা, নিকলই, অষ্ট গ্রাম, কানিয়াচুল, আজমিরগঞ্জ, নবীগঞ্জ, জগন্নাথ পুর এলাকা মুক্তিযোদ্ধাদের পুর্ন নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

 

এই জেলার তাহেরপুর থানা ও সুছানা ঘাঁটি মুক্তিযোদ্ধারা ঘিরে রেখেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে পাকসেনারা শ্রী হট্ট শহরের ভিতর ঢুকে নিরাপদ আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছে। শ্রী হট্ট ও সুমাঙ্গঞ্জের মসয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা নৌকমান্ডোদের ভয়ে পাক জাহাজ বাংলাদেশে ভিড়তে পারছেনা।

 

মুজিবনগর , ২৮ নভেম্বর – বাংলাদেশের বীর গেরিলারা বর্তমানে নৌ বন্দরে ও নদীপথে তাদের প্রতিরোধ অব্যাহত রেখেছে। এদের আক্রমণে ভিত পাক নৌযান বাংলার ওকুল সাগরে দিশেহারা হয়ে পড়েছে।

 

খবরে প্রকাশ, গত ২৬ নভেম্বর বইত মুক্তিযোদ্ধারা নদীপথে ২ টি জাহাজ ও ৬ টি নৌযান ডুবিয়ে দিয়েছে। এর মধ্যে চিনের একটা বাণিজ্যিক জাহাজ ছিল। ফলে অবস্থা বেগটি দেখে কর্তৃপক্ষ করাচী বন্দরেও রাত্রি বেলায় জাহাজ নোঙ্গর করা নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন। এমন কি করাচী বন্দরের ১২০ কিলোমিটারের মধ্যে নিজেদের দায়িত্ব ছাড়া কোন জাহাজ কে প্রবেশ করতে বার্ন করা হয়েছে। কারণ, বলা তো যায়না, কখন আবার বন্ধু রাষ্ট্রের জাহাজগুলোর অবস্থাও বেগতিক হয়ে গেছে।

মুক্তিযোদ্ধাদের সদর দফতর জানাচ্ছে, চট্টগ্রাম বন্দর এলাকায় এক হাজার টনের একটি তৈল বাহী জাহাজ মেঘনা নদীতে চিনের একটি বাণিজ্যিক জাহাজ, চাঁদপুরের কাছে ৪ টি বড় স্টিমার ও পাক নৌ বহরের একটি গানবোট মুক্তিযোদ্ধাদের নৌ আক্রমণে নিমজ্জিত হয়ে গেছে।

 

উল্লেখ্য, ডুবে যাওয়া ওইসব জলযানে খাদ্য ও পণ্য সামগ্রী বোঝাই ছিল। মুক্তিযোদ্ধা নৌবহরের এই আক্রমণে চাঁদপুরের জলপথে জাহাজ চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে।

 

 

এবার বাঁচাও

(স্টাফ রিপোর্টার)

 

মুজিব নগর – ২৯ নভেম্বর – বীর মুক্তিযোদ্ধারা দিকে দিকে জঙ্গি শাহির মৃত্যু ভেরি বাজিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। আর হানাদার পাক দস্যুরা অবরুদ্ধ হয়ে আর্তনাদ করছে, এবার বাঁচাও মোদের।

 

গত ২৮ নভেম্বর সকালে মুক্তিযোদ্ধারা পাক সামরিক জান্তাদের বুহ্য ভেগ করে যশোর দুর্গের দিকে এগোতে থাকে। হানাদার বাহিনী মরিয়া হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের রোধ করার চেষ্টা করে। মুক্তিযোদ্ধারা তখন ভৈরব নদীর তীরে একটি পাকসেনাদের ইউনিট পর্যুদস্ত করে। বহু পাকসেনা প্রাণ হারায়।

 

সন্ধ্যা হতে না হতেই মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ আরও তীব্র হয়ে ওঠে। পাকসেনারা জরুরী বেতার সংকেত তৎক্ষণাৎ সাহায্য পাঠাবার জন্য আর্ত আবেদন জানায়। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তি শালি বেতার যন্ত্রে ঐ সঙ্কেত ধরা পরে যায়। সদা সতর্ক বেঙ্গল রেজিমেন্ট অফিসার গন সঙ্কেতের অর্থ বুঝতে পারেন।

 

মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র আক্রমণে পাকসেনাদের প্রতিরক্ষ ভেঙ্গে পরে। তাই আত্ম রক্ষার জন্য তাঁরা এখন দ্বিতীয় ফ্রন্ট খোলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই সকল ফ্রন্ট থেকে তাঁরা শেষ বারের মোট মরণ কামড় দেবার চেষ্টা চালাতে পারে।

 

 

পাক সেনারা এখন পালাবার পথ রক্ষার চেষ্টা পাচ্ছে

(নিজস্ব প্রতিনিধি)

 

পূর্ব বাংলায় এখন পাক সামরিক কর্তৃপক্ষ এর পলায়ন পর্ব শুরু হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড আক্রমণের সামনে দ্বারাতে না পেরে তাঁরা দুটো পন্থানিয়েছে। সমগ্র পূর্ব বাংলায় ৪/৫ টা ক্যান্টনমেন্ট শহর বেছে নিয়ে সেগুলিকে সর্ব শক্তি দিয়ে ঘাঁটি তৈরি করছে। যাতে কিছু দিন ও আত্ম রক্ষা করা যায়। এবং বাংলাদেশ থেকে যথা সম্ভব বিশিষ্ট ব্যাক্তিদের ও কতগুলি সামরিক সরঞ্জাম সরিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাচ্ছে। পাকিস্তান প্রধান ঘাঁটি করেছে ঢাকায়। ঢাকার বিমান বন্দর রক্কাহ করার জন্য ব্যাবস্থা নিয়েছে। যে ৪/৫ টি  ঘাঁটি তৈরি করতে চাইছে তার প্রত্যেকটিতে ২/৩ ব্রিগেড সৈন্য রাখার পরিকল্পনা করেছে। ঢাকায় অবশ্য প্রায় দু ডিভিশন সৈন্য রাখা হয়েছে।

 

এই ৪//৫ টি ঘাঁটি থেকে   বিমানে করে যথা সম্ভব নিজেদের লোকজন নিরাপত্তার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়ার ব্যাবস্থা করা হচ্ছে। পাকিস্তান বুঝেছে জলপথে তাঁরা সুবিধা করতে পারেনা। চালনা ও মংলা বন্দরের দিকে এগোলেই মুশকিল, চট্টগ্রাম বন্দরকে বলা যায় অকেজো। প্রতি বন্দরে প্রতিপক্ষের কামান ওত পেতে আছে।

 

পাকিস্তান ইতিমধ্যেই তাদের বিমান বাহিনী বাংলাদেশ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়েছে। বাংলাদেশে তাদের স্থান নাই দেখে এগুলি নিয়ে যাচ্ছে। এবং এভাবে পশ্চিম পাকিস্তানে বিমান বাহিনীর শক্তি আরও বাড়াচ্ছে। ঢাকা ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে পি আই এ স্বাভাবিক যাত্রা বন্ধ করে তাদের নিজেদের বিশিষ্ট ব্যাক্তি ও পরিবার বর্গ কে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাবস্থা করছে। সর্বদা এই বিমান যাতায়াত করছে। পাক কর্তৃপক্ষের কিছুটা সময়ের দরকার কারণ যাতে তারা এই পলায়ন পর্বটা ভালভাবে সম্পন্ন করতে পারে। তারা বুঝতে পেরেছে স্থল ও জলপথে যাওয়া তাদের বিপদ। পলায়ন পথে যাতে তাদের কোন বিপদ না থাকে তার জন্য ভালো বিমান বন্দর দরকার। এদিকে আবার শক্ত ঘাঁটি যশোর  বিমান বন্দর ও ক্যান্টনমেন্ট। কিন্তু তাদের অসুবিধা হয়েছে যশোর ক্যান্টন্মেন্ট্বের পাশের বিমান বন্দরটি প্রচণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত। কামানের আঘাতে গোলার আঘাতে বিধ্বস্ত বিমান ঘটি থেকে বড় জেট বিমান ওড়ানো প্রায় অসম্ভব। তাই তাদের যশোর ক্যান্টনমেন্ট ও ছাড়তে হয়েছে।

পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষের পালাবর জন্য অন্তত ৩/৪ সপ্তাহ সময়ের দরকার। ঐ সময় টুকু তারা প্রাণ পণে চেষ্টা করবে। কতগুলি  ছোট ছোট ঘাঁটি করেছে, সেগুলি হচ্ছে মূল ঘাঁটির চতুর্দিকেও কামানের পাল্লার বাহার (অন্তত ২০ মাইল) , প্রথম ধাক্কাটা সামলাতে ঐ ছোট ঘাঁটি সাধারণ সৈন্যদের জীবন দিতে হবে। কারণ বিশিষ্ট ব্যাক্তিদের জীবন রক্ষা করার জন্য।

 

 

ধাকাত উপকণ্ঠ জ্বলছে

 

মুজিব নগর – ১ লা ডিসেম্বর – মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারদের আচমকা আক্রমণে ভিত পাক বাহিনী গতকাল ঢাকা শহরের চারপাশে বহুদূর পর্যন্ত মুক্ত রাখার জন্য শহর উপকণ্ঠে বহু গ্রামের বাড়িঘর জ্বালিয়ে নিশ্চিনহ করে ফেলেছে ও প্রায় ৩০০ লোক হত্যা করেছে বলে খবরে প্রকাশ।

 

এ পি র জনৈক ফটোগ্রাফার গতকাল ঢাকার প্রায় ৯ মাইল উতরে গ্রাম দেখে এসেছেন। তিনি জানান যে, খরের চালাঘর, বাঁশের বেড়ার ঘরের অধিকাংশই ওয়াক সৈন্যরা পুড়িয়ে দিয়েছে। তিনি বলেন পাকসেনারা তাদের অন্য গ্রামে যেতে বাঁধা দেয়। ওইসব গ্রামের সমস্ত বাড়ি ঘর নাকি ধ্বংস করা হয়েছে।

 

আগুনে পোড়া ৩ টি গ্রামে, যে কয়জন গ্রাম বাসি রয়েছেন, তাঁরা বলেন, প্রায় ৫০০ সৈন্য বৃহস্পতিবার রাত থেকে মোট ৩ বার গ্রাম গুলোতে ঢুকেছিল। তাঁরা আরও জানান যে, পাক সৈন্যরা সেই সকল অঞ্চলের ঘর বাড়ির উপর হ্যান্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করেন। যারা বোমা বিস্ফোরণের পরেও বেঁচে ছিলেন তাঁরা বন্দুকের গুলিতে অথবা জ্বলন্ত গৃহে আটক থেকে প্রাণ হারিয়েছেন। উক্ত ফটোগ্রাফার জানান যে, তিনি ঘাস, লতাপাতা ও কাদামাটি দিয়ে ঢাকা বহু মৃতদেহ দেখেছেন।

 

স্বাধীনতা যোদ্ধার মরণোত্তর সন্মান – সিলেট, ২৬ নভেম্বর – বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনির এই হাই কমান্ড লিডার শ্রী জগজ্যতি দাস কে বীরত্বের জন্য মরণোত্তর সন্মান দানের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাকে গেরিলা যোদ্ধা বলে বর্ননা করা হয়। তিনি শত্রুর বুলেটে নিহত হবার আগে ১৭ পাকসেনাকে খতম করেছেন। ও কিছু অস্ত্র দখল করেছেন।

 

এই সঙ্ঘর্ষ শ্রী হট্টের দক্ষিণ পশ্চিমে আজমির গঞ্জে হয়েছে। তার সঙ্গী দেশ প্রেমিক গেরিলারা শত্রুর চেষ্টা ব্যার্থ করে নিহত শ্রী দাসের মৃতদেহ নিয়ে সামরিক মর্যাদায় শেষ কৃত্য সম্পন্ন করেন।

 

 

 

বালুর হাঁট হিলি এলাকায় পাকিস্তানের আরও ৪ খান ট্যাঙ্ক ধ্বংস

 

মুজিবনগর, ২৯ নভেম্বর – সপ্তাহ খানেক যাবত বালুরঘাট হিলি এলাকায় দারুণ উত্তপ্ত হাওয়া বয়ে চলেছে। ভারতীয় সৈন্যরা প্রতিরক্ষা ব্যাবস্থা নিতে গীয়ে এখানে গত সপ্তাহে ৪ টি পাক ট্যাঙ্ক ধ্বংস করে। উল্লেখ্য যে, ইতিপূর্বে ঐ এলাকায় আরেকটি পাক ট্যাঙ্ক বিধ্বস্ত করা হয়।

 

গত শুক্রবার বয়রা সেক্টরে ১৩ খানা পাক সাফই ট্যাঙ্ক স্পম্পুর্ন ধ্বংস করা হয়।

 

এই নিয়ে গত সপ্তাহে পাকিস্তান মোট ১৮ খানা ট্যাঙ্ক হারালো। বয়রা এলাকায় পাক শেলের আঘাতে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর একজন জোয়ান নিহত হন। ২ জন আহত হন। এখানে পাকিস্তানের এক খানা সামরিক গাড়িও ধ্বংস হয়।

 

 

পতনের মুখে যশোর ক্যান্টনমেন্ট – বরিশালে পাকসেনাদের নতুন ঘাঁটি স্থাপনের উদ্যোগ

(রণাঙ্গন প্রতিনিধি)

 

মুজিবনগর, ৩০ নভেম্বর – বাংলাদেশের পশ্চিম অঞ্চলে যশোর ক্যান্টনমেন্ট হচ্ছে পাকসেনাদের সর্ব বৃহৎ ও সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী ঘাঁটি। কিন্তু এখানে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে খানসেনারা মুক্তিবাহিনীর হাতে মার খাচ্ছে। তাদের বহু সৈন্য হতাহত হয়েছে। কয়েকখানি ট্যাঙ্ক ও সামরিক গাড়ী ধ্বংস হয়ে গেছে। সর্ব পরী ক্যান্টনমেন্ট সহ যশোর শহরটি মুক্তিযোদ্ধারা অবরোধ করে রেখেছেন।

 

মুক্তিযোদ্ধাদের ধারনা, যশোর ক্যান্টনমেন্টের পতন ওতই আসন্ন। এ এলাকার পাক সেনারা ত্রাহি ত্রাহি রবে আকাশ ফাটাচ্ছে।

 

অতএব দস্যু বাহিনী এখন মরিয়া হয়ে একটা নতুন আশ্রয় বা ঘাঁটি স্থাপনের স্বপ্ন দেখছে। তাদের এই স্বপ্নের ঘাঁটি হিসেবে তারা বরিশাল শহরকেই বেছে নিয়েছে। ইতিমধ্যেই তারা বরিশাল শহরের চতুর্দিকে প্রচুর গানবোট, স্পিড বোট ও নৌ সেনাদের নিয়ে কড়া বেষ্টনী গঠন করে ফেলেছে। কিছুকাল আত্মরক্ষার জন্য ও মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ প্রতিরোধ করার দুরাকাঙ্ক্ষা নিয়ে তারা বরিশাল শহরে একটি শক্তিশালী ঘাঁটি স্থাপনের প্রয়াস পাচ্ছে।

–       সাপ্তাহিক বাংলা, ২ ডিসেম্বর, ১৯৭১

 

 

বিভিন্ন রণাঙ্গনে পাক বাহিনীর লোটা কম্বল গুটানো শুরু

 

মুক্তিযোদ্ধাদের মাড়ের চোটে বিভিন্ন এলাকা থেকে পাক বাহিনীর লোটা কম্বল গুটানোর সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। বিভিন্ন রণাঙ্গনে একের পড় এক পাক ঘাঁটি পতন হচ্ছে। খানসেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের বহুমুখী আক্রমণে পর্যুদস্ত হয়ে একের পর এক এলাকা ছেড়ে পিছু হটছে। যশোর রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের অভিযান চলছে। তাঁরা অবিরাম গোলাবর্ষন করছে। দিনাজপুরের পাঁচ গড় শহর পুর্ন দকলে এসেছে। ময়মন সিংহ রণাঙ্গনে কয়েকদিন তুমুল সঙ্ঘর্শের পর কামাল পুর ঘাঁটি দখল হয়েছে। শত্রুদের বিপুল ক্ষয় ক্ষতি হয়েছে। রংপুর  ও দিনাজপুরে ২৫০০ বর্গ মাইল এলাকা মুক্ত করে নিয়েছে। সেখানে আরেকটি শহর দখলে এসেছে। সিলেটের সমশেরনগর বিমান ঘাঁটি মুক্তিযোদ্ধারা অবরোধ করে রেখেছে। বালুঘাটে তুমুল যুদ্ধ চলছে। সুনামগঞ্জের তাহেরপুর মুক্ত হয়েছে। নোয়াখালীর রণাঙ্গনে অভিযান চলছে। ফেনী দখলে আক্রমণ বাড়ছে। সাংবাদে আরও প্রকাশ, বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে পাকসেনারা আতঙ্কে পালিয়ে যাচ্ছে ও বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েছে।

 

 

 

মুক্তিযোদ্ধাদের ডায়েরি থেকে

 

মা,

তুমি আজ কোথায় জানিনা। তোমার মত শত শত মায়ের চোখের জ্বল মুছে ফেলার জন্য বাংলার বুকে জন্ম নিয়েছে লক্ষ লক্ষ মুক্তিযোদ্ধা। আমি যদি মরে যাই তুমি দুঃখ করোনা। তোমার জন্য আমার যোদ্ধা জীবনের ডায়েরি রেখে গেলাম আর রেখে গেলাম লক্ষ লক্ষ মুক্তিযোদ্ধা। তাঁরা সবাই তোমার ছেলে। আজ হাসপাতালে শুয়ে তোমার স্নেহ মাখা মুখ খানি বার বার মনে পড়ছে। আমার ডায়েরিটা তোমার হাতে গেলে তোমার সকল দুঃখ দূর হয়ে যাবে। দেখবে তোমার ছেলে শত্রুকে পেছনে রেখে কোনোদিন পালায়নি। যেদিন তুমি আমাকে বিদায় দিয়েছিলে আর বলেছিল শত্রু দেখে কোনোদিন পিছনে আসিসনি বাবা। তুমি বিশ্বাস কর মা শত্রু দেখে আমি কোনোদিন পালাইনি। শত্রুর বুলেট যেদিন আমার বুকের বা দিকে বিঁধল সেদিন ও তোমার কথা স্মরণ রেখেছিলাম। মা, আমার সবচেয়ে আনন্দ কোথায় জান? আজ থেকে ৪ দিন পূর্বে একটি গ্রামের পাশ দিয়ে যাচ্ছি হঠাত বেদনা ক্লিষ্ট একটি নারী কণ্ঠ ভেসে আসল। কাল বিলম্ব না করে সেদিকে দৌড়ে গেলাম। একটা গুলি আমার মাথার উপর দিয়ে চলে গেল – আবার একটা। আবার বুঝলাম শত্রুরা আমাকে লক্ষ্য করেই গুলি ছুড়ছে। তবু আমি এগিয়ে চলেছি। বাড়িটার পিছনে একটা বাঁশ ঝাড়ের আড়ালে পজিশন নিলাম। দেখলাম বিবস্ত্রা একটি নারিদেহ নিয়ে কয়েকজন শত্রু পৈশাচিক খেলায় মেতে উঠেছে। আমি আর স্থির থাকে পারলাম না মা। মনে পরে গেল বাংলার লক্ষ লক্ষ মায়ের কথা। শত্রুকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়লাম। ওরা অনবরত গুলি বর্ষন করল। গ্যাং ফিরে দেখি আমি হাসপাতালে। জানতে পারলাম আমার গুলিতে ৫ জন নর খাদক পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। দোয়া কর মা। ভালো হয়ে আবার যেন তোমার শত শত সন্তানদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পরে মায়ের অপমানের প্রতিশোধ নিতে পারি।

–       ইতি

–       তোমার ছেলে

–       – বাংলাদেশ, ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১

 

 

 

 

ফেনী, টাঙ্গাইল, জাকিগঞ্জ দখলে – কিশোরগঞ্জ মুক্তিবাহিনী পূর্ন নিয়ন্ত্রণে

(জন্ম ভূমির রণাঙ্গন প্রতিনিধি )

 

বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধারা ক্রমাগত পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদার দের উপর আক্রমণ চালিয়ে পবিত্র মাটি থেকে আস্তে আস্তে জঙ্গি শাহির ভাড়াটেদের সরিয়ে দিতে একের পর এক জায়গা গেরিলারা দখল করে নিচ্ছে। গত সপ্তাহে মুক্তিযোদ্ধারা টাঙ্গাইল ও কিশোরগঞ্জ মহকুমা এবং সিলেটের জকিগঞ্জ মুক্ত করে। খুলনা জেলার সাতক্ষিরা ও নোয়াখলির ফেনী মহকুমা মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

 

ফেনী দখলের ফলে উতরে লাকসাম থেকে দক্ষিণে চট্টগ্রাম পর্যন্ত রেল সংযোগ বিছিন্ন হয়ে পড়েছে। সাতক্ষিরার দেব হাটা , কালীগঞ্জ প্রভৃতি থানা ও টাঙ্গাইল ও সিলেটের জকিগঞ্জ থানাকে শত্রুমুক্ত করে কিশোরগঞ্জ ও সাতক্ষিরার আসে পাশে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। অচিরেই এগুলো মুক্ত হবে বলে মুক্তিযোদ্ধাদের সদর দফতর জানিয়েছে।

 

বরিশাল, ফরিদপুর ও কুমিল্লা অবরোধ – সংগ্রামী বাংলার মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুদের যগাযদ বিচ্ছিন্ন করে দেয়ায় একমাত্র জেলা সদর ছাড়া সারা ফরিদপুর ও বরিশাল থেকে পাক হানাদার বাহিনী নিজেদের প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়েছে। যশোর জেলার গুরুত্তপুর্ন বাণিজ্য কেন্দ্র চৌগাছা মুক্ত হওয়ার পড় মঙ্গলবার থেকে সেখানে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এসেছে।

সামগ্রিক ভাবে বরিশাল ও ফরিদপুরের তিন চতুর্থাংশের বেশী এলাকা জনপথের উপর নির্ভরশিল। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা স্টিমার ও লঞ্চগুলির উপর আক্রমণ চালাবার ফলে সেগুলি চলাচল বন্ধ আছে। গেরিলারা উত্তর রণাঙ্গনের ১ মাস যুদ্ধ করে ঐ এলাকা দখল করে নিয়েছে।

 

 

 

বিয়ানীবাজার, আখাউড়া, কুলাউড়া, ব্রাহ্মণ বাড়িয়া, দর্শ্না দখলে

সিলেট, যশোর, কুমিল্লা ও নোয়াখালীর পতন আসন্ন

 

বাংলাদেশের বিভিন্ন রণাঙ্গনে ভারতীয় সৈন্য ও মুক্তিযোদ্ধারা কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সাফল্য লাভ করেছে। তাঁরা বিয়ানীবাজার, কুলাউড়া, লাকসাম, আখাউড়া, দর্শনা, লাল্মনিরহাট, মিয়াবাজার, কোট চাঁদ পুর দখল করেছে। বর্তমানে সিলেট , যশোর, কুমিল্লা দখলে জন্য যুদ্ধ চলছে। শীঘ্রই এই তিন জেলা শত্রু মুক্ত হবে বলে আমাদের প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন।

 

সিলেটে প্রচণ্ড যুদ্ধ – মুক্তিযোদ্ধারা সিলেটের ১০ মাইল দূরে শাহিবাগে শত্রুদের সাথে লড়াই চালাচ্ছে। সিলেট জেলার সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার মহকুমার মিটাউন, ইটনা, নিকলই, অষ্ট গ্রাম, বানিয়াচং, আজমিরগঞ্জ, নবীগঞ্জ ও জগন্নাথপুর এলাকা এখন গেরিলাদের পূর্ন নিয়ন্ত্রণে।

 

তাহেরপুর থানা অবরুদ্ধ। কোম্পানিগঞ্জ ও সালুটিকর এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে শত্রু সেনাদের যুদ্ধ চলছে। সিলেট ও সুমন গঞ্জের মধ্যে যম্পূর্ন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। শ্রীমঙ্গল মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে।

 

 

বাংলাদেশে পাক বিমান বহর খতম

 

মুজিবনগর, ৬ ডিসেম্বর – তিন দিনের শুধে ভারত দখলকৃত বাংলাদেশে এহিয়া বাহিনীর প্রায় সমস্ত বিমান বহর নিসচিনহ করে দিয়েছে। শনিবার ১৭০ বার ও রবিবার ২৭০ বার ভারতীয় বিমান বাহিনী পাকিস্তানের বিভিন্ন জায়গায় আক্রমণ করে ৪৭ টি জঙ্গি বিমান ধ্বংস করেছে।  ঢাকা, লাহোর, পেশোয়ার, চট্টগ্রাম, সারগোদা, করাচী সহ বহু স্থানে বোমাবর্ষন করেছে। ভারতীয় সূত্রে যানা গেছে, রবিবার ও সোমবার বাংলাদেশের আকাশে স্বাধীনভাবে ভারতীয় জঙ্গি বিমান বিনা বাঁধায় উড়ে যায় ও কুর্মিটোলা সহ দখলকৃত বাংলাদেশে জঙ্গি শাহির বিভিন্ন সামরিক বিমান ঘাঁটিতে আক্রমণ করেছে। বাংলাদেশে জঙ্গি এহিয়ার বর্তমানে কোন বিমান আর নেই। ভারতীয় বিমান বাহিনী সব নিশ্চিনহ করে দিয়েছে।

 

চট্টগ্রামে ৫ টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র বিধ্বস্ত

 

করাচী থেকে এসোসিয়েটেড প্রেস অব পাকিস্তান জানিয়েছে, গত বৃহস্পতিবার সকালে পর পর কয়েকটি বিস্ফোরণের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা চট্টগ্রামের ৫ টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও কয়েকটি পেট্রোল পাম্প ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

 

 

শমসের নগর ও ঠাকুর গাও বিমান ঘাঁটি দখলে

 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে অনুপ্রাণিত বাংলার বীর মুক্তিযোদ্ধারা পাক হানাদারদের ভাড়াটিয়া সৈন্যদের আঘাতের পর আঘাত হেনে পবিত্র মাটি থেকে সমূলে বিনাশ করছে। মুক্তিযোদ্ধারা গত শুক্রবার সিলেটের শমশেরনগর বিমান ঘাঁটি এলাকার চারদিক থেকে ক্রমাগত আক্রমণ চালিয়ে শত্রু বাহিনীর সাথে প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়ে বিমান ঘাঁটি দখল করে নেয়। মুক্তিযোদ্ধারা ঐ দিনই ঠাকুরগাঁও শহর ও বিমান ঘাঁটি দখল করে। গুরুত্তপুর্ন রেল শহর সৈয়দপুরের  দিকে অগ্রসর হয়ে আক্রমণ অব্যাহত রাখে।

 

 

চারটি কামান দখলে

কুমিল্লার গঙ্গা সাগরে মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের পরাস্ত করে তাদের অগ্রবর্তি ঘাঁটিতে ফেলে যাওয়া ৪ টি বড় কামান দখল করেছে।

–       জন্মভূমি, ৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১

 

 

দশ দিগন্তে মুক্তিযোদ্ধাদের জয়জয়কার

/রনবার্তা পরিবেশক/

 

বাংলাদেশের সকল রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত আছে। দখলীকৃত এলাকার অভ্যন্তরে  দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধারা জলে স্থলে শত্রুদের উপর আক্রমণ চালাইয়া খতম ও আহত করিতেছেন।

 

ইতিমধ্যে সিলেটের উত্তরাঞ্চলে টেংরাটিলা, গড়া, শিমুল তানা, কার্নি, আলির গাও, পিরিজ পুড়, সুলতান পুড়, উত্তরে  রংপুর জেলার নাগেশ্বরী মুক্ত করিয়া স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করিয়াছেন। ময়মন সিংহ জেলার গুরুত্তপূর্ন কামাল পুড় এলাকায় বিস্তৃত পূর্বাঞ্চল হইতে শত্রুদের বিতাড়িত করিয়াছেন।

 

ফরিদপুর ও বরিশাল পটুয়াখালী জেলার বহু এলাকা হইতে হানাদার সরিয়া গিয়াছে। এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত (বৃহস্পতিবার) নোয়াখালী জেলার ফেনী, যশোর শহর, ঝিকরগাছা, সাতক্ষিরা, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, দর্শনা, কিশোরগঞ্জ, সিলেট, শমশেরনগর, আখাউড়া প্রভৃতি স্থানে প্রচণ্ড লড়াইয়ের খবর পাওয়া যায়। সকল রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে মার খাইয়া হতাশা গ্রস্ত হানাদার বাহিনী পছু হটিয়া যাইতেছে। সঙ্গে সঙ্গে লোকজনের ত্রাণ কার্য পুনর্বাসন কার্য শুরু হইতেছে।

 

গত মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে, ময়মন সিংহ জেলার নেত্রকোনা ও ত্রিশালে মুক্তিযোদ্ধারা ২ টি অফিস স্থাপন করেন। খানসেনা কর্তৃক গঠিত রাজাকার, বদর ও সমাজ বিরোধী ব্যাক্তিরা এই অফিসে আসিয়া স্বেচ্ছায় আত্ম সমর্পন করিতেছে।

 

ময়মন সিংহের দেওয়ান গঞ্জ হইয়ে আমাদের প্রতিনিধি লিখিয়াছেন যে, মুক্তিযোদ্ধারা গত ১৪ নভেম্বর জামালপুর মহকুমার কামাল পুরে হানাদার বাহিনীর সহিত ৩৬ ঘণ্টা স্থায়ী যুদ্ধে শতাধিক দুশমন হতাহত করে। উল্লেখ্য কামাল পুর শত্রুদের একটি শক্তিশালী ঘাঁটি। মুক্তিযোদ্ধারা ভারী মেশিনগান, মর্টার সহ বহু চিনা ও মার্কিন অস্ত্র হস্তগত করে। ওইদিনই বক্সিগঞ্জ মাদ্রা সড়কে অতর্কিত হামলায় ১৯ পাকসেনা নিহত করে। ইহার পর পাকসেনারা সুর্য নগর, উঠানপাড়া ও মাসির গ্রাম জ্বালাইয়া দেয়।

 

গত ২১ নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা বাহাদুরাবাদ ঘাটে জঙ্গি সেনাদের রসদ ও অস্ত্র বাহী ২ টি স্টিমার ও ১ টি লঞ্চ ধ্বংস করিয়া দেন। এতে কয়েকজন পাকসেনার সলিল সমাধি হয়।

১৭ নভেম্বর সিরাজগঞ্জের নিকট অতর্কিত হামলায় ৭ টি ২ ইঞ্চি মর্টার , একটি ভারী মেশিন গান,  ও অন্যান্য অস্ত্র  উদ্ধার করেন। এসময় বেলুচ রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন শাহ তাহার ১২ জন সঙ্গী সহ আত্ম সমর্পন করে।

 

বরিশাল হইতে বিলম্বে প্রাপ্ত খবরে জানা যায়, মুক্তিযোদ্ধারা উজিরপুর, মূল্যাদি থানা দপ্তর, ভোলা মহকুমার লালমোহন চরফ্যাশন, বোরহান উদ্দিন ও পিরোজপুর মহকুমার স্বরূপকাঠি ও বানারিপাড়া থানায় হামলা চালাইয়া মোট ২১ জন হানাদার সৈন্য ও উহাদের অনিয়মিত বাহিনীর ১১৫ জন খতম করেন। এতে মুক্তিযোদ্ধারা ৬০ টি রাইফেল সহ ৩ টি লঞ্চ, কয়েকটি গানবোট ও ২ টি বার্জ দখল করিয়া নেয়।

 

 

 

দেশে হাজার হাজার খান সেনা অবরুদ্ধ

/রনবার্তা পরিবেশক/

 

বাংলাদেশে দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর চতুর্মুখি দুর্বার অগ্রযাত্রায় হাজার হাজার পাক কাপুরুষ সৈন্যরা দেশের বিভিন্ন রণাঙ্গনে অবরুদ্ধ হইয়া পড়িয়াছেন। শুধু রণাঙ্গনেই কেন, গোতা বাংলাদেশেই এরা অবরুদ্ধ। পলায়নের সকল পথ রুদ্ধ। তাই রণাঙ্গনেই তাঁরা আত্ম সমর্পন করিতেছে দলে দলে।

 

হানাদারদের সব দখলকৃত বিমান বন্দরে মিত্র বাহিনীর বিমা বোমা বর্ষনের ফলে সব ঘাঁটি বিশ্বস্ত হইয়াছে। মুক্তিযোদ্ধারা ইতিমধ্যেই দিনাজপুরের ঠাকুরগাঁও ও সিলেটের শমসের নগর বিমান ঘাঁটি দখল করিয়া লইয়াছেন। ফলে বাংলাদেশের হানাদার পাকিস্তানী সৈন্যদের আকাশ পথে চলাচল কিংবা পলায়নের সকল সুযোগ বন্ধ হইয়া গিয়াছে। চতুর্দিক থেকে তাঁরা অবরুদ্ধ।

 

স্থলভাগেও মুক্তিযোদ্ধারা গুরুত্তপুর্ন সড়ক ও রেল সেতু উড়াইয়া দেওয়ায় খানসেনাদের ঘাঁটি হইতে বাহীর হইবার পথ নাই। মুক্তিযোদ্ধারা খুলনা জেলায় সাতক্ষিরা – খুলনার মধ্যে সড়ক সেতু উড়াইয়া দেওয়ায় ও সাতক্ষিরা – যশোর ও খুলনা – সাতক্ষিরা রাস্তার গুরুত্তপুর্ন অংশ দখল করিয়া রাখায় সাতক্ষিরা অবস্থান হইতে খানসেনারা হটিয়া যাইতে পারিতেছেনা। যশর কুষ্টিয়া সেক্টরে খানসেনাদের অপারেশনাল হেড কোয়ার্টার ঝিনাইদহের মধ্যে রাস্তার গুরুত্তপুর্ন অংশ মুক্তিযোদ্ধারা দখল করায় ঢাকা অভিমুখে পলায়নের পথ পাইতেছে না। কুষ্টিয়ার রেল জংশন টি মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসায় ইহারা আর কুষ্টিয়া হইতে বাহীর হইতে পারিবে না।

 

কুমিল্লা- নোয়াখালী – চট্টগ্রাম গুরুত্তপুর্ন আখাউরা রেল স্টেশন দখল করিয়া লওয়ায় সিলেট – কুমিল্লা – চট্টগ্রাম ও ঢাকার সহিত যোগাযোগ বিছিন্ন হইয়া গিয়াছে। কুমিল্লা হইতে ঢাকা ফিরিয়া যাওয়ার পথে দাউদকান্দি ফেরিঘাট তথা গোটা দাউদ কান্দি এলাকা এখন মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে।

 

কুমিল্লা- ফেনী- চট্টগ্রামের মধ্যে গুরুত্তপুর্ন রেল মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসায় কুমিল্লার সাথে ফেনী ও ফেনীর সাথে চট্টগ্রামের  যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হইয়া গিয়াছে। চট্টগ্রাম বা কুমিল্লা হইতে খানসেনারা ফেনীতে আর রসদ সরবরাহ করিতে পারিবেনা। এদিকে সিলেটে ও আকাশ, সড়ক ও রেল পথ বিচ্ছিন্ন হইয়া পরিয়াছে। জলপথে সিলেটের গুরুত্তপূর্ন লঞ্চঘাট আজমির গঞ্জ, অষ্ট গ্রাম, চাটল পাড় মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে রহিয়াছে। জলপথে চট্টগ্রাম, বরিশাল, খুলনা হইতে ঢাকা যাওয়ার পথ ও বন্ধ রহিয়াছে। ময়মন সিংহ সেক্টরে জামালপুর রেলওয়ে জংশন দুই একদিনের মধ্যে পতন ঘটিলে রেলপথে উত্তর বাংলা – ময়মন সিংহ যোগাযোগ সম্পুর্ন বিচ্ছিন্ন হইয়া পরিবে।

 

উল্লেখ্য, ঢাকা বিমান বন্দর ও সম্পুর্ন অচল হইয়া পড়ায় বাংলাদেশ হইতে খানসেনাদের আকাশ পথে পলায়নের পথ রুদ্ধ হইয়া পরিল। সমুদ্রপথে বাংলাদেশের সীমানা বরাবর বঙ্গোপসাগরে মুক্তিযোদ্ধাদের মিত্র ভারতের নৌবহর কঠোর বুহ্য রচনা করায় চট্টগ্রাম দিয়াও খানসেনারা সমুদ্র পথে পাকিস্তান পলায়নের পথ পাইবে না।

 

 

 

 

 

সাবাস!

 

এসোসিয়েটেড প্রেসের এক সংবাদে প্রকাশ, মুক্তিযোদ্ধারা গত ১ ডিসেম্বর ঢাকার দুইজন মুসলিম লিগ দলীয় কর্মিকে সাবাড় করে দিয়েছে।

 

হসাপাতাল সূত্রে জানা গেছে, আরও ২ জন কে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ভর্তি করা হয়েছে – তাদের অবস্থা গুরুতর।

 

পুলিশ জানিয়াছে যে, নিহত শাহ জাহান ও আশেক নসরুল্লাহ যখন শান্তিবাগের এক রেস্টুরেন্টে বসিয়া ছিল তখন মুক্তিযোদ্ধারা তাদের উদ্যেশ্যে স্টেনগান হইতে গুলি বর্ষন করে। গেরিলাদের কাহাকেও গ্রেফতার করা হয় নাই।

 

এ এফ পি র এক খবরে প্রকাশ, ঢাকায় পিপলস পার্টির অফিস এক বোমা বিস্ফোরণের ফলে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই অফিস টি জুলফিকার আলি ভুট্টো গত ২ মাস পূর্বে উদ্বোধন করেন।

 

অফিসের আসবাব সম্পুর্ন বিনষ্ট হয়। বিস্ফোরণের সময় অফিসে কোন কর্মকর্তা উপস্থিত ছিল না।

 

গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের আরেক অভিযানে একজন ব্যাংক প্রহরী ও ১ জন ব্যাংক কর্মচারি আহত হয়।

 

 

 

মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা তৎপরতায় দিশেহারা

হানাদার বর্বর বাহিনীর পোড়ামাটি নীতি অবলম্বন

 

গেরিলা তৎপরতা বৃদ্ধি পাওয়ায় সামরিক জান্তাদের নির্দেশে সামরিক বাহিনীর লোকেরা পুনরায় গ্রাম বাসিদের হত্যা ও বাড়ি জ্বালাইয়া দেওয়ার এক বর্বর অভিযান শুরু করিয়াছে।

 

গেরিলা সন্দেহে জিঞ্জিরা কতজন যুবক কে সারিবদ্ধভাবে দার করাইয়া হত্যা করা হইয়াছে তাহার এক চাঞ্চল্যকর রিপোর্ট গত ১ ডিসেম্বর নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত হইয়াছে।

 

এই রীপোর্টে বলা হইয়াছে যে, বুড়িগঙ্গার অপর পারের এই গ্রামে অন্তত ৮৭ জনকে সামরিক বাহিনীর লোকরা হত্যা করিয়াছে। ইহাদের অধিকাংশই যুবক। নারী ও শিশুরাও তাহাদের হাত হইতে রক্ষা পায় নাই।

 

ঢাকায় এই মর্মে খবর ছড়াইয়াছে যে, এই সকল এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা চরম আঘাত হানার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করিতেছে। গত সপ্তাহে ১ জন সামরিক অফিসার স্বীকার করিয়াছে যে, মুক্তিযোদ্ধারা তাহাদের তৎপরতা বৃদ্ধি করিয়াছে।

 

এই সামরিক অফিসার টি তাহাদের এই অভিযান কে মুক্তিযোদ্ধাদের ‘ ঠাণ্ডা’ করার অভিযান বলিয়া বর্ননা করে এবং বলে কয়দিন অপেক্ষা করুন।

 

জিঞ্জিরা হইতে চার্চ ও রিলিফ কর্মিদের বক্তব্য উধ্রিত করিয়া এক রীপোর্টে বলা হইয়াছে যে ঢাকার উত্তরে ১০ মাইল এলাকা ব্যাপিয়া হানাদার বাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হইয়া চার্লস আর ইউজার নামক একজন ধর্ম যাজক ও বহু ‘নান’ নিহত হন।

 

–       বাংলার বানী। ৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১

 

 

 

 

 

বিভিন্ন ঘাঁটি হইতে পাক বাহিনীর পশ্চাদপসারণ

(নিজস্ব সংবাদ দাতা)

 

আমাদের দুর্ধরষ মুক্তিযোদ্ধা ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়া বাংলাদেশের বিভিন্ন রণাঙ্গনে শত্রু সেনাদের উপর চূড়ান্ত আঘাত হেনেছেন। আঘাতে নাজেহাল হয়ে পাকবাহিনী একের পর এক পিছু হটতে বাধ্য হচ্ছে। শত্রু সেনারা এখন কয়েকটি ক্যান্টনমেন্টে  অবরুদ্ধ হয়ে আছে। মুক্তি ও মিত্র বাহিনী তাদের সব দিক থেকে ঘিরে রেখেছে। তাদের পালাবার আর পথ নেই। যশোর রণাঙ্গনে মুক্তি বাহিনী মিত্র বাহিনীর সহযোগিতায় দুর্ভেদ্য যশোর ক্যান্টনমেন্ট দখল করে নিয়েছে। যশোর বিমান বন্দর সম্পূর্ন শত্রু মুক্ত করে আর ঝিনাইদহ শহরটি দখল করে নেয়। যশোর এখন সম্পুর্ন শত্রু মুক্ত। রংপুরের লালমনিরহাট বিমান বন্দরে আমাদের ও মিত্র বাহিনীর দখলে এসেছে। দিনাজপুর দখলের জন্য শত্রু ছাউনিতে আক্রমণ করা হয়। কুমিল্লায় আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা শহর ও বিমান বন্দর দখল করে নেয়। ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট এখন সম্পূর্ন অবরুদ্ধ। মোমেনশাহী জেলায় কিশোরগঞ্জ, শেরপুর ও জামালপুর শত্রুকবল মুক্ত। এখন সম্মিলিত বাহিনী মোমেন শাহি শহর ও ক্যান্টনমেন্টের দিকে যাচ্ছেন। লাকসাম ও আখাউরা আমাদের দখলে। আখাউরা ও কুমিল্লার সংঘর্ষে ৭ শতাধিক খানসেনা নিহত হয়েছে। ছাতক ও স্রী হট্ট শত্রুমুক্ত হয়েছে। ঢাকা জেলার মানিকদঞ্জ ও মুন্সিগঞ্জ মহকুমা শত্রু কবল থেকে মুক্ত। চারিদিক থেকে সম্মিলিত বাহিনী দ্রুত গতিতে ঢাকার দিকে এগিয়ে আসছে। নারায়ণগঞ্জ থেকে মাত্র ১২ মাইল দূরে মেঘনার তীরে দাউদকান্দি পর্যন্ত আমাদের বীর সেনারা ও মিত্র বাহিনী এসে পৌঁছেছেন। তাদের সুবিশাল দৃষ্টি এখন ঢাকার দিকে।

 

 

 

তোমরা মরবে কেন? অস্ত্র ছেড়ে দাও – জে ম্যানেকশ

 

ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ম্যানেকশ বাংলাদেশে হানাদার পাকসেনাদের উদ্যেশ্যে বলেন, ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে, তোমরা যদি বাঁচতে চাও ভারতীয় বাহিনীর সামনে অস্ত্র ছেড়ে দিয়ে আত্ম সমর্পন কর। তোমাদের বিমান বাহিনী সম্পূর্ন নিসচিনহ হয়ে গেছে। ভারতীয় বাহিনী ও মুক্তি বাহিনী তোমাদের সব দিক থেকে ঘিরে ফেলেছে। তোমাদের যোগাযোগ সুম্পুর্ন বিচ্ছিন্ন। তোমাদের আকাশ পথ অবরুদ্ধ। জলপথেও তোমরা যোগাযোগ করতে পারবেনা। চট্টগ্রাম, খুলনা ও চালনা সকল নদী বন্দর ভারতীয় নৌবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর কাছে অবরুদ্ধ। বাংলাদেশে তোমরা যে বর্বরতা ও নৃশংসতা চালিয়েছ মুক্তিবাহিনী তার প্রতিশোধ নিতে প্রস্তুত, আর সময় নেই, তোমরা যদি বাঁচতে চাও অস্ত্র ছেড়ে দিতে আত্ম সমর্পন কর নতুবা তোমাদের কে নির্মম ভাবে হত্যা করা হবে। তোমরা একটি সুসজ্জিত বাহিনীর সম্মুখীন হয়েছ। তোমরা জান অস্ত্র ছেড়ে দেয়া সৈনিকের পক্ষ গ্লানিকর কিছু নয়। ভারতীয় বাহিনী তোমাদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেবে। তোমরা মরবে কেন, ভারতীয় বাহিনীর সামনে অস্ত্র ছেড়ে দিয়ে দেশে ফিরে গিয়ে আত্মীয় স্বজন ও পরিবারের সাথে পুনর্মিলিত হও।

–       বাংলাদেশ, ১০ ডিসেম্বর, ১৯৭১

 

 

 

আফসারের নেতৃত্বে

নয়নপুরে ১৪ জন নিহত

 

১২ নভেম্বর – হাবিলদার আব্দুল হাকিম সাহেভ ঢাকা জেলার জয়দেবপুর থানার নয়ন পুরে পাকসেনাদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হন। এতে ১৪ জন হানাদার নিহত হয়।

 

অস্ত্র সহ আত্ম সমর্পন – ১৯ নভেম্বর। ভালুকা ঘাঁটি হতে পলায়ন করে আব্দুল হাকিম নামে একজন রাজাকার রাইফেল সহ মুক্তিবাহিনীর শিবিরে আত্মসমর্পন করে।

 

কালিয়াকৈরে সাফল্য – ২০ নভেম্বর। ঢাকা জেলার কালিয়া কৈর থানার অনতিদূরে ঢাকা টাঙ্গাইল রাস্তার লতিফুর ব্রিজে দুঃসাহসী হাবিলদার আব্দুল হাকিম সাহেবে নেতৃত্বে প্রায় দুই ঘণ্টা যুদ্ধ চলে। উক্ত ব্রিজে পশ্চিমা ৬ জন রেঞ্জার পুলিশ নিহত হয়। নিকটস্থ ধানক্ষেতে রাইফেল ফেলে দিয়ে বাকি রেঞ্জার পুলিশ ও রাজাকার পালিয়ে যায়।

 

পরপরই পাশের আরেকটি কাল্ভার্টে আক্রমণ করে ৬ জন রাজাকার গ্রেফতার ও ৩ জনকে গুলি করা হয়। ৮ তি রাইফেল ও ৩০০ রাউন্ড গুলি উদ্ধার হয়।

 

ধান কাটার সাজা- ৩ ডিসেম্বর শুক্রবার বেলা ৩ তার সময় রাজাকারদের একটি গ্রুপ ধামসুর গ্রামে ধান কাটার জন্য আসে – তখন মুস্লেহ উদ্দিনের নেতৃত্বে ২ নং প্লাটুন কমান্ডার নাজিমুদ্দিনের সেকশনটি আক্রমণ চালায়। আক্রমণের প্রথমেই দুজন রেঞ্জার ও ৪ জন রাজাকার নিহত হয়। বাকি কিছু সংখ্যক রাজাকার এক বাড়িতে আশ্রয় নেয়। তখন মর্টারের সাহায্যে বাড়িটি ধ্বংস করে দেয়া হয়।

 

ধ্বংসস্তূপের নিচে ৩ জন রাজাকারের মৃতদেহ পাওয়া যায়, বাকি সব রাজাকার অস্ত্র নিয়ে লাশগুলো ফেলে পালিয়ে যায়।

 

হানাদার খতম – ২ ডিসেম্বর। কমান্ডার মসলেহ উদ্দিনের নেতৃত্বে বৃহস্পতিবার বেলা ২ টার সময় ভালুকা থেকে পশ্চিমা হানাদার সহ একদল রাজাকার কাঁঠালি গ্রামে বাড়ি ঘর লুট করতে আসে। আমাদের সেকশন কমান্ডার গিয়াস উদ্দিন ও ৩ নং সেকশন কমান্ডার আব্দুল ওয়াহেদের নেতৃত্বে পরিচালিত বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণে ৩ পাকসেনা ও ৭ রাজাকার নিহত ও ৭ জন আহত হয়। পরে হানাদাররা মৃত লাশ নিয়ে পালিয়ে যায়।

 

কারগো ধ্বংস – ৬ ডিসেম্বর- কালিয়াখের থানার অন্তর্গত ঢাকা – টাঙ্গাইল রাস্তার উপর কালিয়াকৈর হতে ৬ টি আড়াইটনি কারগো ভর্তি পশ্চিমা রেঞ্জার পুলিশ ঢাকার দিকে যাচ্ছিল। হাবিলদার হাকিম সাহেবের নেতৃত্বে একদল সুদক্ষ মুক্তিযোদ্ধা অতর্কিত আক্রমণ চালায়। ফলে ৩ টি কার্গো ধ্বংস হয়। ২৭ জন রেঞ্জার পুলিশ নিহত ও ১৩ জন আহত হয়।

 

কাঁঠালিতে সংঘর্ষ – ২৩ নভেম্বর – সেকশন কমান্ডার এমদাদুল হোক (দুলু) ও নাজিম উদ্দিন তাদের সেকশন নিয়ে কাঁঠালি  গ্রামের ধুপজান কালের উত্তর পাশে পাকসেনাদের উপর আক্রমণ করে ৯ জন রেঞ্জার পুলিশ ও ৩৪ জন রাজাকার খতম করেন । ৪ জন রাজাকার আহত হয়।

 

ধুপজানে সঙ্ঘর্ষ – ২৬ নভেম্বর- ভালুকা থানার কাঁঠালি গ্রামে ঢাকা ময়মন সিংহ সি এন্ড বি রোডের ধুপজান খালের পাড়ে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণে ৩ পাকসেনা ও ৪ রাজাকার নিহত করেন।

 

ভাওয়ালিবাজুতে প্রচণ্ড যুদ্ধ – ৩০ নভেম্বর। কমান্ডার হালিমের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা বাওয়ালিবাজুতে পাক রেঞ্জার ও রাজাকারের উপর আক্রমণ করে ২৭ জন রাজাকার  নিহত ও বহু আহত করে। এইদিন একজন স্বদেশ প্রেমী রাজাকার তার কমান্ডারকে হত্যা করে ৩ টি রাইফেল নিয়ে মুক্তিবাহিনী ক্যাম্পে চলে আসে।

 

ধামসুরে ৪ জন পাকসেনা ও ১৩ জন রাজাকার নিহত-  ধামসুর – ২ ডিসেম্বর। প্লাটুন কমান্ডার নাজিমুদ্দিন, দুলু, সুবেদার মস লেহ উদ্দিন এর নেতৃত্বে কাঁঠালি গ্রামের বড় রাস্তায় পাক দস্যু ও রাজাকারের বিরাট দলের সাথে যুদ্ধে ৪ পাকসেনা ও ১৩ রাজাকার নিহত হয়।

 

রাইফেল উদ্ধার – গত ২৮ নভেম্বর বিকেল ৪ টার সময় হবিবারি ইউনিয়নের রক্ষীবাহিনী কুখ্যাত ডালা আবুল হাশেমের বাড়িতে তল্লাসি চালিয়ে মোরগের খোঁয়াড়ে ৯০ রাউন্ড গুলি  সহ ১ টি ৩০৩ রাইফেল উদ্ধার করে।

 

গোলাঘাট সেতু ধ্বংস – সম্প্রতি কাওরাইদ ও সাতখামারের মাঝে অবস্থিত গোলাঘাট রেল সেতু টি মুক্তিযোদ্ধারা ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়। উল্লেখ করা যায়, এই ৪০ হাত লম্বা সেতুটি বহুদিন যাবত পাক দস্যুদের দ্বারা সুরক্ষিত ছিল।  বর্তমানে ঢাকা ময়মন সিংহ রেল যোগাযোগ সম্পুর্ন বিপর্যস্ত।

 

খা খা খা বক্ষিলারে খা , পাকসেনারে খা – ১ ডিসেম্বর। কালিয়াকৈর থানার এক পরিত্যাক্ত বাঙ্কারে ডিফেন্স নেয়ার জন্য ৫ খানসেনা প্রবেশ করে। বাঙ্কারের ভিটরে কবে অলক্ষ্যে এক বিষধর সাপ শীতকালীন ঘুমের প্রয়োজনে আশ্রয় নিয়েছিল। খানসেনারা তা জানত না। কিন্তু উত্যাক্ত সাপটি সকল সমর আয়োজন তুচ্ছ করে নিজের উপস্থিতির চিনহ বসিয়ে দেয় বলিষ্ঠ পাঁচ পাঁচটি শরীরের উপর। পরে এদেরকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় বাঙ্কারের ভিতর। বিচ্ছিন্নতাবাদী সাপ টিকে সেখানে আর দেখতে পাওয়া যায়নি।

 

চাপড়বাড়িতে ৩ জন রাজাকার নিহত – ৪ ডিসেম্বর। ভালুকা থানার চাপড় বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুদের সাথে এক যুদ্ধে ৩ রাজাকার নিহত হয়।

 

তল্পি তল্পা সহ পিয়াজির পশ্চিম যাত্রা – ৬ ডিসেম্বর – শ্রুত গায়েবি বেতারের এক ঘোষণায় জানা যায় বাংলাদেশ থেকে ওয়ার্ল্ড এর বেস্ট সোলজারদের নায়ক আয় মেরা জান , আসমানকে চান , আঁখকে তাঁরা, পেয়ারে দামান, লে জে এ এ কে নিয়াজি তমঘায়ে পাকিস্তান যৌথ বাহিনীর সাড়াশি আক্রমণের সামনে বেকায়দা বুঝে তল্পিতল্পা সহ পশ্চিমে পাড়ি জমিয়েছে।

 

এদিকে বাংলাদেশের  মুছোয়াগুলোর সামনে চরম পত্র দাখিল করেছেন মিত্র বাহিনীর চিফ অব স্টাফ। বলা হয়েছে, তারা যদি জীবনের মায়া রাখে তাহলে যেন অবিলম্বে আত্মসমর্পন করে।

 

ভাওলিয়াবাজুতে ৫ জন পাকসেনা ও ৩ রাজাকার নিহত – বিলম্বে প্রাপ্ত খবরে জানা যায়, বাওয়া গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যুদ্ধে ৫ পাকসেনা ও ৩ রাজাকার নিহত হয়।

 

খবরে প্রকাশ, ১১ নভেম্বর সেক নুরুল ইসলামের নেতৃত্বে মুষ্টিমেয় কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা পাকসেনাদের একটি বড় দলের সাথে যুদ্দে লিপ্ত হয়। অনেকক্ষণ গোলাগুলির পর বিশেষ কৌশলে মুক্তিযোদ্ধারা সরে পড়েন।

এ যুদ্ধে আমাদের ৬ জন শহীদ হন।

 

রণাঙ্গন সংবাদ – ১০ ডিসেম্বর ঢাকা। এখানে প্রাপ্ত সংবাদে প্রকাশ, মেজর আফসারের বাহিনী ৭ ডিসেম্বর ভালুকা থানা ৩ দিক থেকে ঘেরাও করে। শত্রুরা ৮ তারিখ দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে সেখান থেকে সামনে একটি পথ খোলা থাকায় সেটি ধরে পালিয়ে যাওয়া শুরু করে। আমাদের ডিফেন্সটা টের পেয়ে শত্রুদের পিছনে ধাওয়া করে। রাস্তায় গুলি বিনিময় হওয়ার ফলে ২৫/৩০ জন রাজাকার নিহত হয়। ৫৫ জন রাজাকার ৫৫ টি রাইফেল, ৪০০০ রাউন্ড গুলি ও কিছু নগদ অর্থ সহ আত্মসমর্পন করে।

 

উক্ত দুদিনের লড়াইয়ে মোট ৬০ রাজাকার নিহত ও প্রচুর আহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের একজন সামান্য আহত হন। এ অভিযানে যারা সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন তাঁরা হলেন কমান্ডার আবুল কাশেম, কমান্ডার ফয়েজ উদ্দিন, কমান্ডার খলিলুর রহমান, কমান্ডার চান মিয়া, সুবেদার মোস্লেহ উদ্দিন ও আরও অনেকে।

–       জাগ্রত বাংলা – ১১ ডিসেম্বর , ১৯৭১

 

 

যশোর ক্যান্টনমেন্ট দখল – কুমিল্লা ও রংপুর অবরুদ্ধ

 

যশোর ক্যান্টনমেন্টের পতন হইয়াছে। শত্রুর এই শক দুর্গ অন্যতম বৃহৎ সেনা ছাউনি এখন যৌথ বাহিনীর করায়ত্ত। গত ৭ ডিসেম্বর মঙ্গলবার বিকালে ভারতীয় সেনাবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী সেখানে প্রবেশ করে। মিত্র বাহিনী ক্যান্টনমেন্টের নিকতবর্তি হওয়ার পূর্বেই সকল পাকসেনা দুর্গ খালি করিয়া পলায়ন করে।

 

এর পতনের সাথে পদ্মার পশ্চিমে বাংলাদেশের প্রায় অর্ধাংশে শত্রু রক্ষ ব্যাবস্থা সম্পূর্ন ভাঙ্গিয়া পড়িল।

মঙ্গলবার ভোরে ভারতীয় বাহিনী যশোর বিমান বন্দরের কাছে পৌঁছানর সাথেই দখলদার পাক বাহিনী ক্যান্টনমেন্ট ছাড়িয়া চম্পট দেয়। অসংখ্য বিবর ঘাঁটি পাকা বাঙ্কার আর কিংক্রিটের প্রকারে ঘেরা এই দুর্ভেদ্য দুর্গ ছাড়িয়া পাকবাহিনী পড়ি কি মরি খুলনার পথে পলায়ন করে।

 

মিত্র ও মুক্তি বাহিনী সরাসরি পশ্চিম দিক হইতে যশোর আক্রমণ না করিয়া নিপুণ রঙ কৌশলের আশ্রয় লইয়া উত্তর পশ্চিম চৌগাছা হইতে আঁকড়ি ও চুড়ামন কাঠি হইয়া উত্তর ও পূর্ব দিক হইতে ক্যান্টনমেন্ট ঘিরিয়া ফেলিলে পাকবাহিনী প্রতিরোধ না করিয়া এইভাবে দুর্গ ছাড়িয়া দেয়।

 

পলায়নের সময় তাঁরা বিপুল অস্ত্র, নিজেদের বিছানা পত্র, রেশন এমনকি কন্ট্রোল রুমের দেওয়াল জোড়া সামরিক মানচিত্রটি অক্ষত অবস্থায় ফেলিয়া যায়।

 

ক্যান্টনমেন্ট দখলের পর মিত্র বাহিনী যশোর শহরে প্রবেশ করে। শহর ছিল তখন জনমানব শূন্য, পরিত্যাক্ত। যৌথ বাহিনীর আগমনের সাথে হাজার হাজার মানুষ যাহারা পাক বাহিনীর অত্যাচারে গ্রামান্তরে চলিয়া গিয়াছিল তাহারা শহরে ফিরিয়া আসতে শুরু করে। মুক্ত যশোরের পথে জনতা আনন্দ উল্লাসে মাতিয়া মিত্র বাহিনী ও মুক্তি বাহিনীকে সংবর্ধনা জানায়। পরিত্যাক্ত বাড়িঘরে ক্রমেই সকলে ফিরিয়া আসিতেছে ও হাঁট বাজার চালু হইয়াছে।

 

শত্রুরা পলায়নের পথে যেসব সড়ক ও রেল সেতু ধ্বংস করিয়া গিয়াছিল সেগুলি মেরামত করিয়া যোগাযোগ ব্যাবস্থা চালুর কাসজ শুরু হইয়াছে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর জওয়ান ও মুক্তিবাহিনীর সাথে জনগণ এইসব কাজে হাত লাগাইয়াছে।

 

 

সিলেট ও কুমিল্লা দখল

 

যশোর ক্যান্টনমেন্ট পতনের দিনেই রণাঙ্গনে মিত্র বাহিনী সিলেট ও কুমিল্লা মুক্ত করে। মিত্র বাহিনী হেলিকপ্টারে সিলেট অবতরণ করে ও পাক বাহিনীকে শহর হইতে বিতাড়িত করে। তারা শালুটিকর বিমান ক্ষেত্র অবরোধ করিয়া রাখিয়াছে।

কুমিল্লার ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট এ কিছু পাকসেনা অবরুদ্ধ হইয়া আছে। উহাদের পালানর পথ নাই। এদিকে মিত্র বাহিনী দাউদ কান্দি পর্যন্ত চলিয়া সিয়াছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শত্রুমুক্ত করিয়া আশুগঞ্জ হইতে মেঘনা পাড় হইয়া উপনীত হইয়াছে যৌথ বাহিনী।

 

 

দিনাজপুর – রংপুর

 

বাংলাদেশের উত্তর পশ্চিমে ঠাকুরগাঁও, অইরগঞ্জ সহ সদর মোহর ছাড়া দিনাজপুর জেলার সবটাই মুক্ত হইয়াছে। শহর দখলের জন্য এই রীপোর্ট লেখার সময় পর্যন্ত লড়াই চলিতেছে।

রংপুরের বিস্তির্ন অঞ্চল মুক্ত হওয়ার পড় সৈয়দ পুড়ের সাব ক্যান্টনমেন্ট এ শত্রুরা অবরুদ্ধ হইয়া পরিয়াছে।

–       মুক্তিযুদ্ধ, ১২ ডিসেম্বর, ১৯৭১

 

 

টাঙ্গাইল সহ বিভিন্ন জেলা সদর মুক্ত – ঢাকায় পতন আসন্ন

 

১২ ডিসেম্বর। টাঙ্গাইল জেলা শহর মুক্ত করার জন্য স্থানীয় মুক্তিবাহিনী পুর্ব হতে বিভিন্ন দিক থেকে শত্রু উপর আঘাত হানতে থাকে। বিশেষ করে তারা টাঙ্গাইল ঢাকা রাস্তার বহু গুরুত্তপুর্ন সেতু ধ্বংস  করে দেন ও বাসাইল মুক্ত করেন। ১২ ডিসেম্বর ভারতীয় মিত্র বাহিনী ও আমাদের সম্মিলিত আক্রমণ পরিচালনা করেন। এর আগে বহু ভারতীয় সেনা টাঙাইলের আসে পাশে অবস্থান করছিলেন। অবস্থা সংকট জনক দেখে পাক বাহিনী ঢাকার দিকে পালিয়ে যেতে শুরু করে। ফলে বিনা রক্তপাতে টাঙ্গাইল মুক্ত হয়। ১২ ডিসেম্বর সকাল ১২ টার সময় যৌথ বাহিনী শহরে প্রবেশ করে।

 

টাঙ্গাইল ১৪৭২ জন রাজাকার, ৫০০ পাকসেনা ও ২৯৪ জন মিলিশিয়াকে বন্দি করা হয়েছে। এছাড়া কিছু দালাল ও ধরা পড়েছে।

 

ইতিপূর্বে ময়মন সিংহ, যশোর, সিলেট ও কুমিল্লা সহ বহু গুরুত্ব পুর্ন শহর মুক্ত হয়ে গেছে। ঢাকা নগরী চারদিক থেকে ঘেরাও করা হয়েছে। খণ্ড খণ্ড লড়াই চলছে। মিত্র বাহিনীর বিমান আক্রমণ ঠেকাবার কোন ক্ষমতাই পাক বাহিনীর নেই। ফলে ঢাকার পতন আসন্ন ও অবধারিত হয়ে উঠেছে।

 

মিত্র বাহিনীর চিফ অব স্টাফ জেনারেল ম্যানেকশ অধিকৃত বাংলাদেশের পাক সামরিক প্রধান লে জে নিয়াজিকে তার লোকজন ও অস্ত্রসহ আত্মসমর্পন করার আহবান জানাচ্ছেন। বলা হচ্ছে, অনিবার্য মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আত্মসমর্পনই সর্বত্তম পথ।

 

লড়াই এখনো চলছে – ১৪ ডিসেম্বর – ময়মন সিংহ থেকে পলাতক পাকসেনাদের একটি দল জামালপুর হয়ে মধুপুর গড়ে প্রবেশ করে এবং টাঙ্গাইল ময়মন্সিং জেলাত মধ্যবর্তি বন এলাকা দিয়ে ঢাকার দিক অগ্রসর হতে থাকে। কালিহাতি থানার কালিয়া ইউনিয়িনের রক্ষীবাহিনী খবর পেয়ে দলটিকে অনুসরণ করে। কচুয়ার দক্ষিণ দিকে একটি বনে এদের গতি রোধ করার চেষ্টা করে। মেজর অফিসারের ফৌজেরা সিগন্যাল মারফত সংবাদ পেয়ে পাকসেনাদের ঘিরে ফেলেন ও আত্ম সমর্পন করাতে চেষ্টা করেন। কিন্তু বর্বরদের দল টি তা না করে দক্ষিণ দিকে যেতে থাকে। সেদিকে অবরুদ্ধ হলে তারা পূর্ব দিকে মোড় নেয়, ও সুবিধাজনক জায়গা পেলেই গুলি ছুড়তে থাকে। ১৫ তারিখ এ খবর লেখা পর্যন্ত তারা একই পন্থা অবলম্বন করে চলছে। এ পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ৪৮ জন, ধরা পড়েছে ৩ জন। বন্দিদের কয়েকজন গুরুতর আহত। এরা সকলেই পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সৈন্য।

 

আমাদের ৫ জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছে মেজর আফসারের তৃতীয় পুত্র নাজিম উদ্দিন আহমেদ। অন্যরা হলেন, নাজিমুদ্দিন, আব্দুল খালেক, আবুল কাশেম ও বশীর উদ্দিন। এছাড়াও রক্ষী বাহিনীর একজন আহত ও ৩ জন নিরীহ গ্রাম বাসি নিহত হয়েছেন। উল্লেখ্য যে ১৫ তারিখ থেকে মেজর আফসার নিজে এ যুদ্ধ পরিচালনা করছেন। পাকসেনাদের প্রতি বার বার আত্মসমর্পনের নির্দেশ দেয়া সত্ত্বেও তারা এখনো অস্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে।

 

কালিয়াকৈর সংঘর্ষ – ১৪ ডিসেম্বর কালিয়াকৈর। টাঙ্গাইল মুক্ত করার পড় যখন যৌথ বাহিনী ঢাকা অভিমুখে তাদের ত্রিমুখী অভিযান শুরু করেন ঠিক তখনি প্রায় ৬০০ হানাদার পাকসেনা ঢাকার সেনানিবাস হতে বেরিয়ে এসে কালিয়াকৈর বন এলাকায় ঢুকে পরে। টের পেয়ে আমাদের মুক্তি বাহিনীর হাবিলদার হেকিমের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা এদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। শত্রুরা টিকতে না পেরে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পরে।

 

ঢাকার পথে – ১৫ ডিসেম্বর। মেজর আফসারের এক দন বীর গেরিলা যোদ্ধা ঢাকা আক্রমণ অভিযানে অংশ গ্রহণ করার জন্য গতকাল ঢাকার পথে যাত্রা শুরু করেছেন।

 

নিয়াজির আর্তনাদ – ১৫ ডিসেম্বর। ঢাকা শহরকে উত্তর, উত্তর – পূর্ব ও পশ্চিম দিক থেকে মিত্র ও মুক্তিবাহিনীর বীর যোদ্ধারা অক্টোপাসের ন্যায় বেঁধে ফেলেছেন। জানা গেছে, তারা ভারী অস্ত্রে সজ্জিত। ঢাকা শহরের সামরিক লক্ষ্য স্থল সমূহ তাদের কামানের আওতায় এসে গেছে।

 

এ পরিপ্রেক্ষিতে পাক বাহিনীর পূর্বাঞ্চলিয় শাখার প্রধান লে জে এ এ কে নিয়াজি ত্রাহি ডাক ছেড়েছেন। নির্বিচারে গণহত্যার এ পুরহিত টি ভারতীয় বাহিনীর চিফ অব স্টাফ কে অনুরোধ জানিয়েছেন যুদ্ধ বিরতির জন্য। জেনারেল ম্যানেকশ তার আবেদন মঞ্জুর করে কাল সকাল সাড়ে নটা নাগাদ যুদ্ধ বিরতি দিয়েছেন। এ মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই নিয়াজিকে জানাতে হবে তিনি তার লোকজন সহ আত্মসমর্পন করতে সম্মত কিনা। অন্যথায় উক্ত সময় অতিক্রম করার সাথে সাথেই — ।

–       জাগ্রত বাংলা, ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১

 

 

বাংলার বিভিন্ন এলাকার সহিত কুমিল্লা শত্রুমুক্ত

 

গত ৮ ডিসেম্বর বুধবার প্রত্যুষে শহরবাসী কুমিল্লা শহরকে যেন হাল্কা, স্বচ্ছ ও পবিত্র বলিয়া দেখিতে পায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই জানিতে পারে কুমিল্লা শহর শত্রুমুক্ত এবং যৌথ বাহিনী কুমিল্লা শহরে পৌঁছেছে। জনগণ আনন্দ উল্লাসে একে অন্যের সহিত আলঙ্গন ও জয় বাংলা ধনী দিতে থাকে।

 

এই সঙ্গে সর্ব প্রথম কুমিল্লা কোর্ট রোডে সহকারী সমবায় রেজিস্ট্রার অফিস ও সাব রেজিস্ট্রার অফিস গৃহের উপড়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িতে দেখা যায়। প্রতিটি গৃহে স্বাধীন বাংলার পতাকা শোভা পাইতে থাকে।

 

সকাল ৮ টা নাগাদ শহরের উত্তর পূর্ব সীমান্ত হইতে মুক্তিযোদ্ধারা ক্ষিপ্রতার সহিত শহরে প্রবেশ করে ও মিত্র বাহিনীর সহিত কাঁধে কাঁধ মিলাইয়া ময়নামতির দিকে ধাবিত হইতে থাকে। কেহ কেহ আবার শহর প্রদক্ষিণ করিয়া জনগণকে স্বাধীনতার মোবারকবাদ জানাইতে থাকে।

 

উল্লেখ্য যে, গত ৬ ডিসেম্বর বিকাল ৪ টা হতে কারফিউ ও রাতে সম্পূর্ন ব্ল্যাক আউট ঘোষণা করা হয়। ঐ দিন বিকাল ৪ টায় খবর পাওয়া যায়, খানসেনারা সীমান্ত হইতে পশ্চাদ পসরন করিয়া শহর সংলগ্ন গোমতী নদীর তীরে অবস্থান করিতে থাকে। সন্ধ্যায় শহরে বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্পুর্ন বোধ থাকায় কুমিল্লা ইলেকট্রিক পাওয়ার হাউজে টেলিফোন অনুসন্ধান করিতে গেলে জনৈক ব্যাক্তি জানান যে, ইলেকট্রিক সাপ্লাই সাময়িক বন্ধ আছে। আরও জানা, পাওয়ার হাউজ প্রহরা রত পাঞ্জাবি পুলিশ বাহিনী ঠিক সন্ধ্যায় উধাও হইয়া গিয়াছে। তার  পরক্ষনেই কুমিল্লা টেলিফোন  এক্সচেঞ্জ হইতে জনৈক বাঙ্গালী পুলিশ জানায় , এক্সচেঞ্জে প্রহরারত পাঞ্জাবি পুলিশ পালাইয়াছে ও যাওয়ার সময় তাহাদের দায়িত্ব ভার সম্বন্ধে বাঙ্গালী পুলিশ বা টেলিফোন এক্সচেঞ্জ অফিসারের কাহাকে কিছু বলিয়া যায় নাই। আরও জানা গেল, পুলিশ লাইন হইতে পাঞ্জাবি পুলিশ বাহিনী এই কারফিউ ও ব্ল্যাক আউটের সাহায্য লইয়া তাহার ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে আশ্রয় লইয়াছে।

 

ঐ রাত ৯ টা হইতে শেষ রাত অবধি শহর তলী এলাকা হইতে খান সেনাদের যৌথ বাহিনী ধাওয়া করিয়া শহরের পশ্চিম অঞ্চলে ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় কোণঠাসা করিয়া রাখে। তারপর হইতে যুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায়ে ক্যান্টনমেন্ট দখলের অভিযান চলে।

 

 

ক্যান্টনমেন্ট বন্দি শিবির হইতে ৩০ টি পরিবারের মুক্তিলাভ

 

কুমিল্লা শহর বিজয়ের পর খানসেনারা ক্যান্টনমেন্ট বন্দি শিবির হইতে একজন মেজর , ১ জন ক্যাপ্টেন ও জুনিয়র কমিশন্ড অফিসারের পরিবার সহ ৩০ টি পরিবারের লোকজনকে মুক্তি দেয়। কুমিল্লা পুলিশ বাহিনী একটি ট্রাক যোগে কয়েক দফায় ৩০ টি পরিবারের লোককে কোতোয়ালি থানায় আনা হয়। থানা হইতে তাহার নিজ নিজ বাড়িঘর ও আত্মীয় স্বজনের নিকট ফিরিয়া যায়। এই দীর্ঘ আট মাস টের দিন পড় মুক্তি পাইয়া মুক্ত এলাকায় পৌঁছালে তাহার সঠিকভাবে জানতে পাড়ে নাই তাহাদের পরিবারের কর্তা ব্যাক্তিরা কোথায় আছে বা আদৌ জীবিত আছে কিনা।

 

 

১৯৭৭ জন বন্দি

 

বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর কুমিল্লাস্থ সদর দফতর হইতে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের নবম ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার মেজর আইনুদ্দিন হইতে যানা যায়, গত ৮ ডিসেম্বর হইতে ১৪ ডিসেম্বর এই ৭ দিনে চাঁদপুর হইতে ৭ জন অফিসার সহ ১৩০০ জন চান্দিনা হইতে ১১ জন অফিসারসহ ৪০১ জন ও কুমিল্লা হইতে জে শি ও সহ ২৭৬ জন মোট ১৯৭৭ জন পাক বাহিনীর সৈনিককে বন্দি করা হয়। এর মধ্যে অধিকাংশই আত্মসমর্পনকারী।

 

 

বঙ্গশার্দুল মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণে ক্যান্টনমেন্ট পতনের মুখে

 

বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর কুমিল্লার সদর দফতর হইতে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৯ নং ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার মেজর আইনুদ্দিন হইতে জানা যায় যে, গত ৬ ডিসেম্বর হইতে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের এই ব্যাটালিয়ন , সম্মিলিত মুক্তি বাহিনী ও মিত্র বাহিনীর ঝাট রেজিমেন্টের ১৪ নং ব্যাটালয়ন সঙ্গে লইয়া কুমিল্লার পুর্বাঞ্চল ধনপুর, সুয়াগাজি ও চিওরার পাকবাহিনীর ৩ টি দুধর্ষ অবরোধ কে চুর্ন বিচুর্ন করিয়া ৭ ডিসেম্বর বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৯ নং ব্যটালিয়ন কুমিল্লায় প্রবেশ করে।

 

এখানে উল্লেখ্য যে, বেঙ্গল রেজিমেন্টের এই ব্যাটালিয়ন টি প্রথম কুমিল্লা প্রবেশ করিয়া বর্তমানে শহরের পশ্চিম অঞ্চলে ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টের উপর আঘাত হানছে। এই ব্যাটালিয়ন গত মঙ্গলবার অপরানহ দুই ঘটিকার সময় দুর্গাপুর গ্রাম হইতে পাক বাহিনীকে পিছু হটাইয়া আরও অগ্রসর হইয়াছে। গত মঙ্গলবার দুর্গাপুর যুদ্ধে বহু পাকসেনা নিহত হয়। আরও উল্লেখ করা যাইতে পারে, কুমিল্লা শহরে প্রবেশ কালে  একটি পাক গোলন্দাজ বাহিনীকে বঙ্গশার্দুলরা পরাস্ত করিয়াছিলেন।

 

বর্তমানে বঙ্গশার্দুল মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনী পাকিস্তানের শ্রেষ্ঠ ক্যান্টনমেন্ট ময়নামতি কে চতুর্দিক হইতে এমনি ভাবে ঘেরাও করিয়া অগ্রসর হইতেছে যার ফলে ক্যান্টনমেন্ট হইতে খান সেনারা তাদের অগ্রগতিকে বাঁধার বদলে দলে দলে আত্ম সমর্পন করিতেছে। এছাড়া প্রত্যহ মিত্র বাহিনীর বিমান অনবরত বোমা বর্ষন করিয়া চলিয়াছে। ইহার পরি প্রেক্ষিতে যে কোন মুহুর্তে এই ক্যান্টনমেন্টের পতন ঘটিবে বলিয়া আশা করা যাইতেছে।

–       আমোদ, ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১

 

 

 

 

 

হানাদার বাহিনীর পলায়ন ও দলে দলে আত্ম সমর্পন

ঢাকা ঘেরাও – তেজগাঁ দুর্গ কামানের লক্ষ্যের মধ্যে

 

বাংলাদেশ ১৪ ডিসেম্বর। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্র বাহিনী একই সঙ্গে মির্জাপুর, নরসিংদী ও দাউদ কান্দি হইতে ঢাকার দিকে আগাইয়া চলিয়াছে। ঢাকা এখন ৩ দিক হইতে পরিবেষ্টিত।

 

গতকাল টাঙ্গাইল মুক্ত করিয়া মির্জাপুর পর্যন্ত পৌঁছানো হইয়াছে। খুলনা শহরে তীব্র লড়াই চলছে। ইতিমধ্যে যৌথ বাহিনী বগুড়ার উপকণ্ঠে পুঁছিয়া গিয়াছে।

 

গতকাল ডিলিটে মিত্র বাহিনীর জনৈক মুখপাত্র প্রকাশ করেন যে, ২৪ হইতে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ঢাকার চারপাশে সুদৃঢ় বুহ্য রচনা করা হইবে। এখনই ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট মিত্র বাহিনীর আর্টিলারির পাল্লার মধ্যে আসিয়া গিয়াছে।

 

ইত্যবসরে পদ্মার উপড়ে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ আমাদের নিয়ন্ত্রণে আসিয়াছে। এই ব্রিজের পাড়ে পাকশি ও তার পরি ঈশ্বরদী। গতকাল মঙ্গলবার স্থল বাহিনীর সাহায্যে মিত্র বাহিনী ভেড়ামারা, পাবনা, রংপুর, ময়নামতি ও নরসিংদীতে শত্রুদের অবস্থানের উপর বোমাবর্ষন করে।

 

অদিকে যৌথ বাহিনী ফেনী হইতে চট্টগ্রামের পথে সুতাকুন্দে গিয়া পুঁছিয়াছে। খুলনাতে যদিও তীব্র লড়াই চলিতেছে তথাপি দৌলত পুড়ের পতনের পর হানাদারদের আর তেমন মনোবল নেই।

 

 

 

সম্পাদকীয়  – নিক্সনের হুমকি ও ৭ম নৌবহর

 

বাংলাদেশ মুক্তির দ্বারপ্রান্তে। ঢাকা শহরকে শত্রু কবল মুক্ত করার জন্য তুমুল যুদ্ধ চলিতেছে। বাংলাদেশের মাতি হইতে হানাদার শত্রুকে নিশ্চিনহ করার এই চূড়ান্ত সংগ্রামের মুহূর্তে নিক্সন হুমকি দিয়াছে। আক্রমণকারী ইসলামাবাদের জঙ্গি চক্রকে যুদ্ধ বন্ধ করিতে বলার পরিবর্তে নিক্সন ভারতের বিরুদ্ধে হুংকার দিতেছে। জঙ্গি ইয়াহিয়ার বুট চুম্বনকারী মাও সে তুং এর চিন তার দোসর।

 

বাংলাদেশে সরাসরি হস্তক্ষেপের জন্য নিক্সন সরকার বঙ্গোপসাগরে ৭ম নৌবহর পাঠাইয়া দিয়াছে। এইভাবে উনবিংশ শতাব্দীর গানবোট পলিসি আজ নিক্সন সরকার গ্রহণ করিয়াছে। ভারত কে ভয় দেখাইয়া ও হুমকি দিয়া বাংলাদেশের শত্রুর বিরুদ্ধে মিত্রশক্তির অভিযানকে বানচাল করাই ইহার লক্ষ্য। ইহা নিক্সন সাহেবদের পুরাতন খেলা। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ১৯৪৮ সালে ইতালীয় সাধারণ নির্বাচনের সময় আটলান্টিক সাগরে ও ভূমধ্য সাগরে আমেরিকা নৌবহর পাঠিয়েছিল। লেবাননের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় ১৯৫৩ সালে ৬ষ্ঠ নৌবহর হইতে বৈরুতে সৈন্য নামাইয়াছিল। দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশে গণতান্ত্রিক সরকারের পতন ঘটানর জন্য সেখানকার সমুদ্রে বার বার নৌবহর পাঠাইয়াছে। আজ স্বাধীন বাংলাদেশ কে আতুর ঘরে গলা টিপিয়া মারা তাহার অসাধ্য। তবুও ৭ম নৌবহর পাঠাইবার পিছনে তাহার আরও একটি উদ্যেশ্য আছে – তাহা হইল স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারকে দেখানো। এজন্যই বাংলাদেশের মার্কিন নাগরিকদের ‘নিরাপত্তা বিধান ও উদ্ধারের ‘ জন্য নৌবহর পাঠানো হইয়াছে বলিয়া সাফাই গাহিতেছে। সেখানে পাকিস্তানের করাচী প্রভৃতি শহরের মার্কিন নাগরিকদের বিমানে অপসারণ করা হইয়াছে , যেখানে বাংলাদেশে নৌবহর পাঠানো কেন? বাংলাদেশের ঢাকা হইতে অন্যান্য বিদেশী যাত্রীদের যেভাবে বিমানে অপসারণ করা হইয়াছে তাহারা সে পথে কেন গেলেন না? তাহাদের উদ্যেশ্য বিবিধ, হানাদার সৈন্যদের হত্যা অবশিষ্ট দের রক্ষা করার ‘পবিত্র’ দায়িত্বও তাহারা নিয়াছেন। তাই রাও ফরমান আলির আত্ম সমর্পনে ইয়াহিয়া প্রথমে অনুমতি দিয়াছিল কিন্তু পরে মত পালটাইয়াছে। ৭ম নৌবহরের গতিবিধি পাকিস্তান সরকার পরম উল্লাসের সহিত বার বার ঘোষণায় উল্লেখ করিতেছে।

 

প্রথম উদ্যেশ্যের কথা আগেই বলিয়াছি। অপরদিকে ‘কাগজের বাঘ’এর নয়া দোস্ত চিন ইয়াহিয়ার পক্ষ লইয়া জাতিসঙ্ঘে নিরাপত্তা পরিষদে আর পিকিং এর বেতারে ভারত বিরোধী তথা সোভিয়েত বিরোধী কুৎসা চালাইতেছে । বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের পদে পদে বিরুদ্ধাচরণ করিতেছে।

 

কোথায় গেল তাহার বড় বড় সাম্রাজ্যবাদী বুলি। ৭ম নৌ বহরের এই গতিবিধিতে চীন  নীরব কেন? আমরা চীন কে তার নিজের চরকায় তেল দিতে বলি। দেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ তাইওয়ানে মার্কিন ঘাঁটি তাহার চোখে পড়েনা, চোখে পরে বাংলাদেশে ভারতীয় সৈন্যের অভিযান। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ তাইওয়ান দখল করিয়া রাখিয়াছে তাই নয়া জাতসঙ্ঘ ও নিরাপত্তা পরিষদে তাহার গলাবাজি শুনিনা। শুনি ভারত নাকি ‘পাকিস্তানের একটা অংশ’ দখল করিয়া নিতেছে। মহান চীন কে তাহার বর্তমান নেতারা মার্কিন সাম্যাজ্যবাদের গাধা বোটে পরিণত করিয়াছে।

 

তাই মার্কিন ৭ম নৌবহরের গতি বিধির সহিত তাল মিলাইয়া চীন ভারতের উত্তর সীমান্তে তিব্বতে সৈন্য মোতায়েন করার উদ্যোগ নিয়াছে। তিব্বতে চীনা  সৈন্য চলাচলের পিছনে ভারতকে ব্ল্যাক মেইল করার দুরভিসন্ধি রহিয়াছে।

–       নতুন বাংলা , ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১

 

 

 

 

 

শেষ কথা

 

আমরা চাইলে প্রোফেশনাল কাউকে দিয়ে এই দলিলপত্র কম্পাইল/অনুবাদ করাতে পারতাম। কিংবা স্ক্যান করে ওসিআর-এর সাহায্যে দলিলপত্রকে ইউনিকোডে কনভার্ট পারতাম। কিন্তু আমরা সেই কাজ আমরা করতে চাইনি এবং চাইবোও না। আমরা চাই যে এই প্রজন্ম নিজে কম্পাইল/অনুবাদ করতে করতেও মুক্তিযুদ্ধের কিছু সঠিক ইতিহাস জানুক, ধীরে ধীরে নিজের দেশের জন্মের ইতিহাস বুঝতে শিখুক, নিজের মধ্যে ধারণ করতে শিখুক। কাজ থেকেই জন্ম নিক চেতনা, শুধু শুধু ফাঁপা কথা থেকে নয়।

 

পাঠকালে বানান কিংবা অন্য যে কোন ইস্যুতে যে কোন ভুল-ভ্রান্তি চোখে পড়লে সাথে সাথে আমাদের ফেসবুক পেইজ “বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধঃ দলিলপত্র থেকে বলছি” একটি মেসেজ দিয়ে জানানোর অনুরোধ করছি। ভালো/মন্দ যে কোন ধরণের পরামর্শ অত্যন্ত আনন্দের সাথে গৃহীত হবে এবং আপনাকে অত্যন্ত দ্রুত আমাদের ফেসবুক পেজ থেকে থেকে লাইভ চ্যাটের মতো রিপ্লাই দেয়া হবে। কারণ আমাদের ফেসবুক পেজটি একই সাথে দেশ এবং বিদেশ থেকে পরিচালিত হচ্ছে। ফলে এডমিন প্যানেলের কেউ না কেউ সারাক্ষণই অনলাইনে আপনার ফিডব্যাকের অপেক্ষায় আছেন। আমাদের ফেসবুক পেজের লিংকঃ

 

https://www.facebook.com/muktizuddho1971/

 

প্রকল্পটি নতুনদের জন্য সদা উন্মুক্ত। অর্থাৎ আপনি যদি আমাদের সাথে মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র নিয়ে কাজ করতে চান, তবে আমাদের ফেসবুক পেজে একটা মেসেজ পাঠিয়ে আপনার আগ্রহের কথা জানালেই হবে। আমরা কিছুদিন পর আপনাকে আমাদের কর্মযজ্ঞের অংশ করে নেবো। কাজ বুঝিয়ে দেবো। দল-মত-ধর্ম-বর্ণ-পরিচয় নির্বিশেষে আমাদের এই উদ্যোগ। তাই সকলের শুভকামনা আমাদের কাম্য।

 

এটি কোন একক ব্যক্তি কিংবা একক গ্রুপের উপর নির্ভরশীল প্রোজেক্ট নয়। তাই স্পেসিফিক কেউ একজন থাকলে বা না থাকলে এই প্রোজেক্টের কিছুই যাবে-আসবে না। আগামীকাল Aparajita Neel নামক আইডিটি না থাকলে কিছুই আসে-যায় না। তাঁর জায়গায় অন্য কেউ কাজ করতে থাকবেন। আমাদের ফেসবুক পেজ থেকে কাজ চলতে থাকবে। ফেসবুক পেজ কোন কারণে বন্ধ হয়ে গেলে তা আবার নতুন করে খোলা হবে। কারণ আমাদের হাতে দলিলপত্র আছে। ডেডিকেটেড কম্পাইলাররা আছেন। তাই এই প্রোজেক্টটা থেমে যাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। এভাবেই প্রোজেক্টটাকে ডিজাইন করা হয়েছে। আমাদের এই পথচলায় আপনাদের শুভকামনা এবং সাপোর্ট সবসময় সাথে পাবো বলে আশা করছি।

 

-ধন্যবাদ

অপরাজিতা নীল

২২-১০-২০১৬

 

Scroll to Top