৭.৮.২৬-২৮
শিরোনামঃ ৮। পদগর্নির বাণীর জবাবে ইয়াহিয়াঃ অভ্যন্তরীন ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে দেব না
সূত্রঃ দৈনিক পাকিস্তান
তারিখঃ ৭ এপ্রিল, ১৯৭১
.
পদগর্নির বাণীর জবাবে ইয়াহিয়া
“অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে দেব না”
ইসলামাবাদ, ৬ই এপ্রিল এপিপি- প্রেসিডেন্ট জেনারেল এ এম ইয়াহিয়া খান আজ পুনরুল্লেখ করেন যে, পাকিস্তান তার অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কোন দেশকে হস্তক্ষেপ করতে না দেওয়ার ব্যাপারে দৃঢ় সংকল্প।
সোভিয়েট প্রেসিডেন্ট এন পদগর্নির ৩রা এপ্রিলের বাণীর জবাবে তিনি বলেন পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারত খোলাখুলি ও নির্লজ্জ হস্তক্ষেপের একটিই মাত্র উদ্দেশ্য- গোলযোগ সৃষ্টির জন্য মুষ্টিমেয় লোককে উসকানি ও বৈষয়িক সাহায্য দিয়ে পরিস্তিতিকে প্রজ্বলিত করে তোলা। কোন শক্তির পক্ষেই এই উদ্যোগকে সমর্থন বা ক্ষমা করার অর্থ হচ্ছে জাতিসংঘ সনদ ও বান্দুং নীতি খেলাপ করা। পাকিস্তানের দিক থেকে পাকিস্তান সর্বদাই এই নীতিগুলি মেনে চলছে।
প্রেসিডেন্ট উল্লেখ করেন যে, গণতান্ত্রিক পদ্ধতির নিজস্ব পথে চলতে দেওয়ার প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে তার নিজের চাইতে বেশী কেউ সচেতন নন এবং এই নীতির প্রতি তিনি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু সোভিয়েট ইউনিয়নসহ কোন দেশই জাতিবিরোধী ও অ-দেশপ্রেমিক ব্যাক্তিদের দেশকে ধ্বংস করার ব্যাপারে অগ্রসর হতে দিতে পারে না বা কখনও দেয়নি কিংবা নাশকতামূলক কর্ম সমর্থন করতে পারে না।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ থেকে নয়াদিল্লীকে বিরত করার জন্য সোভিয়েট ইউনিয়নের প্রতি ভারতে তার অভ্যন্তরীণ প্রভাব ব্যবহার করার আহ্বান জানান। কারণ উপমহাদেশে শান্তি বজায় ও অগ্রগতি অব্যাহত রাখার ব্যাপারে সোভিয়েট আগ্রহের সঙ্গে এটা সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে।
প্রেসিডেন্টের বাণীর পূর্ণ বিবরণ
আপনার বাণী আমাকে ৩রা এপ্রিল প্রদান করা হয়েছে। স্পষ্টতঃ প্রধান মন্ত্রী কোসিগিনের বাণীর জবাবে প্রদত্ত আমার বাণী আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করেনি এবং আপনি যে প্রশ্নগুলো তুলেছেন তা প্রাসঙ্গিক বলে আমি পুনরুল্লেখ করছি।
উক্ত বাণীতে আমি বলেছিলামঃ গত ২৮শে মার্চ করাচীতে নিযুক্ত সোভিয়েট কনসাল জেনারেল আপনার মৌখিক বাণী আমাকে জানিয়েছে। ইতিপূর্বে ঢাকায় নিযুক্ত আপনাদের কনসাল জেনারেল আমার সঙ্গে দেখা করেন এবং শাসনতান্ত্রিক সমস্যাবলী নিরসনের ব্যাপারে আমার প্রচেষ্টা সম্পর্কে তাকে অবহিত করি।
আপনার বাণীতে বলা হয়েছে যে তা অসমাপ্ত খবরভিত্তিক। আমি আশা করি, মিঃ প্রধানমন্ত্রী, আপনাদের রাষ্ট্রদূত আপনাকে আমার ২৬শে মার্চের বিবৃতির বিবরণ অবহিত করেছে। উক্ত বিবৃতিতে আমি যে ঘটনাবলীতে বর্তমান পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তা পাকিস্তানের জনগণের কাছে পেশ করেছি। পাকিস্তানে গনতান্ত্রিক পদ্ধতির পুনঃপ্রতিষ্ঠা আমার অবিরাম প্রচেষ্টা এবং আমাদের পথে যে সকল অসুবিধা সৃষ্টি হয় সেগুলো নিরসনের জন্য আমি চেষ্টার ত্রুটি করিনি। একই সঙ্গে পাকিস্তানের অখন্ডতা, সার্বভৌমত্ব ও ঐক্য রক্ষার জন্য জাতির প্রতি আমার দায়িত্ব সম্পর্কে আমি সচেতন।
মিঃ প্রধানমন্ত্রী, আমি নিশ্চিত, আপনি আমার সঙ্গে একমত হবেন যে আমি অন্য কোন পথ নিতে পারতাম না। ২৬শে মার্চ জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত বেতার ভাষণে উক্ত লক্ষ্য পূরণের জন্য আমরা সরকার কর্তৃক গৃহীত ব্যবস্থার কারণে আমি বিশদভাবে বলেছি। পাছে এই বিবৃতির পূর্ণ বিবরণ আপনি না পান তাই আমার রাষ্ট্রদূতকে আমার বিবৃতির একটি কপি আপনার হাতে দেবার জন্য আমি নির্দেশ দিচ্ছি।
পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি সম্পর্কে
পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি ভালবাবেই নিয়ন্ত্রণ আছে এবং স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ধীরে ধীরে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। কোন কোন বাইরের সূত্র, বিশেষ করে ভারতীয় তথ্য মাধ্যমে প্রচারিত বিবরণে সঠিক পরিস্থিতি প্রতিফলিত হয় না এবং বিশ্বজনমতকে বিভ্রান্ত করাই এর উদ্দেশ্য।
আমি আপনার সাথে একমত যে, এশিয়ার কতিপয় শক্তি ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাবলীকে নিজেদের পক্ষে অনুকূল মনে করে আমাদের জাতীয় স্বার্থ ও অখন্ডতার প্রতিকূলে বর্তমান পরিস্থিতিকে ব্যবহার করার চেষ্টা করছে। সুতরাং সর্বতোভাবে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে যাতে কোন হস্তক্ষেপ না ঘটে তার নিশ্চয়তা বিধানের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো অতীব গুরুত্বপূর্ণ।।
ভারতীয় হুমকি
এই ব্যাপারে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ না করে পারছি না যে, আমরা যখন আমাদের অখন্ডতা রক্ষার জন্য জাতীয় পর্যায়ে প্রচেষ্টা চালাচ্ছি তখন ভারতীয় মনোভাব আমাদের গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্র মন্ত্রী, ও অন্যান্য বিশিষ্ট নেতৃবর্গ পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাবলী সম্পর্কে প্রকাশ্য বিবৃতি দিচ্ছেন যা আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে সরাসরি হস্তক্ষেপের সামিল। এইরুপে ভারত এক বিপজ্জনক নজীর স্থাপন করছে যা আন্তর্জাতিক সমাজের সরাসরি উদ্বেগের বিষয়।
আরো গুরুতর ব্যাপার হচ্ছে, পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তের অনতিদূরে প্রায় ছয় ডিভিশন ভারতীয় সৈন্য মোতায়েন। এই বাহিনীর মধ্যে গোলন্দাজ রেজিমেন্ট ও ছত্রী ব্রিগেড আছে। পশ্চিম বাংলার অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বা তিন সপ্তাহ পূর্বে সমাপ্ত নির্বাচনের প্রয়োজনের সঙ্গে এর সঙ্গতি নেই।
আমাদের সীমান্ত বরাবর ভারতের সৈন্য সমাবেশ আমাদের নিরাপত্তার প্রতি সরাসরি হুমকি স্বরূপ। এমত পরিস্থিতিতে আপনার কাছে আমার অনুরোধ, আপনারা ভারতের ওপর আপনাদের অনস্বীকার্য প্রভাব খাটাবেন এবং তাদেরকে (ভারতকে) পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ এবং ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে ও পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে পারে তেমন কাজ থেকে বিরত থাকার প্রয়োজনটা বুঝিয়ে দেবেন।
পাকিস্তানের ঘটনাবলীতে আপনার উদ্বেগকে অনুধাবণ করে পরিশেষে একটা কথা বলবো যে, আমার লক্ষ্য অপরিবর্তিত রয়েছে।
প্রথম সুযোগেই আমি পূর্ব পাকিস্তানের যুক্তিবাদী ব্যাক্তিদের সাথে আলাপ শুরু করার ইচ্ছা পোষণ করি।
মিঃ প্রেসিডেন্ট, আমি আরো বলব যে, যে কোন সরকারই সেই দেশের সার্বভৌমত্ব এবং অখন্ডতার ওপর আক্রমণকারী ধ্বংসাত্মক ব্যাক্তিদের ক্ষমা করতে পারে না কিংবা পাশ কাটাতে পারে না।
আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ দেশকে খন্ডিত করার কোন ম্যাণ্ডেট পাকিস্তানের জনগণের কাছ থেকে পায়নি। তথাপি তারা সক্রিয় শত্রুতায় লিপ্ত এক প্রতিবেশীর বৈষয়িক সমর্থনপুষ্ট রাষ্ট্র বিরোধী ব্যাক্তিদের পাকিস্তানের ঐক্য বিনাশকারী কাজকে উৎসাহ দিয়েছেন।
এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি হলো যে, ক্রমন্বয়ে আইন-শৃংখলা ভেঙ্গে পড়ছিল, নির্দোষ লোকদের সস্ত্রস্ত করা হচ্ছিল, ব্যাপকভাবে ঘরবাড়ি জ্বালানো, লুটতরাজ ও হত্যা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছিল। পরিস্থিতির মোকাবেলা করা ছাড়া কোন বিকল্প পথ ছিল না। সরকার যে সব ব্যবস্থা গ্রহন করছেন তা বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব পাকিস্তানী নাগরিকের জান-মাল ও সম্মান রক্ষার জন্যই করেছেন। কতিপয় আওয়ামী লীগ নেতা যে ফ্যাসিবাদী তৎপরতা চালাচ্ছিলেন সে সম্পর্কে কেউই দ্বিমত পোষণ করবেন না।
গণতন্ত্রকে তার নির্ধারিত পথে এগোতে দেওয়ার ব্যাপারে আমার চেয়ে কেউ বেশি সচেতন নন। এবং আমি এই নীতিতে অবিচল রয়েছি। কিন্তু সোভিয়েট ইউনিয়নসহ কোন দেশই রাষ্ট্র বিরোধী দেশপ্রেম বিবর্জিত লোকদের দেশ ধ্বংস করার সুযোগ কিংবা নাশকতামূলক কাজ চালানোর সুযোগ কখনো দেয়নি, দিতে পারে না।
আমার দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারতের প্রকাশ্য ও নির্লজ্জ হস্তক্ষেপের মাত্র একটাই লক্ষ্য রয়েছে। তা হলো গোলযোগ সৃষ্টিকারী সামান্য কিছু লোককে উৎসাহ এবং বৈষয়িক সমর্থন দিয়ে পরিস্থিতি আরো উত্তপ্ত করে তোলা। কোন শক্তি যদি এ রকম তৎপরতাকে সমর্থন করে কিংবা ক্ষমা করে তবে সেটা হবে জাতিসংঘ সনদ ও বান্দুং নীতির পরিপন্থী। পাকিস্তান সব সময় এসব নীতি মেনে চলেছে এবং পাকিস্তান তার অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কোন দেশকে হস্তক্ষেপ করতে না দেয়ার প্রশ্নে দৃঢ় সংকল্প।
তাই আবার সোভিয়েট ইউনিয়নের কাছে আমার আহ্বান, পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলান থেকে ভারতকে যেন বিরত করার ব্যাপারে সোভিয়েট ইউনিয়নে ভারতের উপর তার অনস্বীকার্য প্রভাবকে ব্যবহার করে। বস্তুতঃ সেটাই হবে এই উপমহাদেশে শান্তি, শৃংখলা এবং বাধাহীন অর্থনৈতিক অগ্রগতি অব্যাহত রাখার সোভিয়েট ইউনিয়নের ইচ্ছার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।