শিরোনামঃ | সুত্রঃ | তাংঃ |
পাকিস্তানঃ পতনের পদধ্বনি | টাইম ম্যাগাজিন | ৫ই এপ্রিল, ১৯৭১ |
<১৪, ১৫, ৩৫–৩৭>
টাইম ম্যাগাজিন, এপ্রিল ৫, ১৯৭১
পাকিস্তানঃ পতনের পদধ্বনি
বঙ্গপোসাগরে সৃষ্ট ভয়াবহ এক জলোচ্ছাসের পরে, গত সপ্তাহে পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। ধুলোমাখা জনাকীর্ণ শহরগুলোতে দাঙ্গা দমন করার জন্য সেনা বাহিনী সাধারন মানুষের উপর গুলি চালিয়েছে। হাজার হাজার মানুষ হতাহত হচ্ছে। যদিও এ গননা এখনও নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছেনা, কেননা প্রিথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এ এলাকায় (প্রতি বর্গমাইলে ১৪০০ জন) এমুহূর্তে চলছে চরম বিদ্রোহ আর কড়া প্রহরা। যদিও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এই অঞ্চলের জনগনের এরুপ ব্যাপক হারে হতাহতের স্বীকৃতি দিতে প্রস্তুত আছেন, তবে মনে হচ্ছে এর চুড়ান্ত ফলাফল দাঁড়াবে, পূর্ব পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কের স্থায়ী ভাঙ্গন আর বাংলাদেশ নামে নতুন একটি জাতির বেদনাদায়ক জন্ম।
১৯৪৭ সালের দেশবিভাগের মাধ্যমে পাকিস্তান নামের দেশটিকে একটি মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে গঠন করা হলেও, জাতিগত ও সাংস্কৃতিক পার্থক্য সবসময়ই দেশটির অভ্যন্তরে একটি অস্ফুট সঙ্ঘাতময় পরিস্থিতি তৈরি করে রাখছিল। দুইটি মুসলিমপ্রধান এলাকা, যা পূর্বে ভারতের অংশ ছিল, একত্রিত হয়ে একটি দেশ গঠন করে। দেশটির দুই অংশের মাঝখানে প্রায় ১০০০ মাইল জুড়ে ভারত সীমান্ত দিয়ে বিচ্ছিন্ন। ফলে, গত সপ্তাহে প্রায় ৮০ হাজার পশ্চিম পাকিস্তানি সেনা যখন পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে মাঠে নামে, তাদের সরবরাহ ঘাটি ছিল সেখান থেকে ১০০০ মাইল দূরে অবস্থিত। বেশির ভাগ খাবার এবং গোলা বারুদই প্রায় ৩০০০ মাইল লম্বা ভারত সীমান্ত উপকুল দিয়ে এপর্যন্ত বয়ে নিয়ে আসা হয়েছে। আয়তনে লম্বা, নির্ভয় পাঞ্জাবি জওয়ানদের চারপাশ ঘিরে এখন রয়েছে প্রায় ৭৮০ লক্ষ শত্রুভাবাপন্ন বাঙ্গালী। এই গৃহযুদ্ধ নিঃসন্দেহে দীর্ঘ সময় ধরে চলবে এবং প্রচুর রক্তপাত ঘটাবে। বাঙ্গালীরা সামান্য কিছু লুটের অস্ত্র, বল্লম আর বেশিরভাগ বাশের লাঠি হাতে কোনমতে গেরিলা যুদ্ধের ট্রেনিং নেয়। কিন্তু এই প্রতিরোধের আন্দোলন একবার সঙ্ঘটিত হয়ে গেলে, ধীরে ধীরে পশ্চিম পাকিস্তানিদেরকে হঠিয়ে দিতে পারে। একদিক থেকে দেখতে গেলে, এই আন্দোলন ১৯৬৭-৭০ সালে ঘটে যাওয়া নাইজেরিয়ান গ্রিহযুদ্ধের কথা মনে করিয়ে দেয়, যখন তাদের ফেডারাল শাসকরা জাতীয় সঙহতির নামে স্বায়ত্বশাসনের দাবি বাতিল করে দেয় এবং বায়ফ্রার বদলে আত্মনিয়ন্ত্রনের পন্থা বেছে নিয়েছিল।
প্রথম আঘাত
গত সপ্তাহ পর্যন্ত মনে হয়েছিল, পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতারা তাদের মতানৈক্য দূর করার প্রক্রিয়াটি প্রায় শেষ করে এনেছে। তারপর খুব অল্প সময়ের মধ্যে দেশে তিনটি ঘটনা ঘটে যার ফলে পুরো জাতি এখন সহিংসতার কবলে। চট্টগ্রামে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনারা একটি রসদ সরবরাহের জাহাজ খালি করার সময় জনতা তাদের ঘেরাও করে ফেলে। প্রথম কোন পক্ষ থেকে গুলি ছোড়া হয়েছিল, তা এখনও সঠিকভাবে না জানা গেলেও, এটা জানা যায় যে সেনাদের গুলিতে ৩৫ জন বাঙালি মারা যায়। এর প্রতিবাদে তাদের রাজনৈতিক নেতা শেখ মুজিবর রহমান অসহোযোগ আন্দোলন ঘোষণা করেন। অতঃপর ইয়াহিয়া খান তাকে দুর্বৃত্ত হিসেবে এবং তার রাজনৈতিক দল আওয়ামিলীগকে দেশের শত্রু হিসেবে ঘোষণা করেন এবং সেনাবাহিনীকে তাদের ‘দায়িত্ব” পালন করার নির্দেশ দেন।
শহরতলীর ঘাটি থেকে ট্যাংক এবং বেয়নেটওয়ালা বন্দুক কাধে সৈন্যভর্তি ট্রাক ঝংকার তুলে একের পর এক বের হয়ে আসে ঢাকার রাস্তায়। চিৎকার করে তারা বলতে থাকে, “নারায়ে তাকবির, পাকিস্তান জিন্দাবাদ”। টাইমস এর সংবাদদাতা ড্যান কগিন, যাকে বাকি সাংবাদিকদের মতই ঢাকা থেকে বহিষ্কৃত করা হয়, বলেন- আক্রমনের অনেক আগেই ঢাকার অন্তত হাফ ডজন এলাকায় বিক্ষিপ্তভাবে ক্ষুদ্র কামানসহ ট্যাঙ্ক, আর্টিলারি, রকেট ব্লাস্ট জমা করা হয়। শহরের অন্ধকার চিরে চক্রাকারে ঘুরছিল ট্রেসার লাইট। স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের সাথে সাথে গ্রেনেড বিস্ফোরণের শব্দও পাওয়া যাচ্ছিল। মাথার উপরের আকাশ ভারি হয়েছিল সারি সারি কালো ধোয়ার স্তম্ভে। রাতের বেলা হঠাত হঠাত শোনা যাচ্ছিল ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি আর তারপরি সেই চিৎকার ঢেকে যাচ্ছিল মেশিনগানের গুলির আঘাতে।
সেনাবাহিনী ঢাকাতে ২৪ ঘন্টার কঠোর কারফিউ আরোপ করে। ঘোষণা দেয়া হয় কারফিউ অবমাননাকারিদের দেখা মাত্র গুলি করা হবে। কিন্তু, অল্প কিছুক্ষন পরেই, চট্টগ্রামের কোন এক এলাকা থেকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র চালু করা হয়। এই গোপন বেতারকেন্দ্র থেকেই বলা হয় যে, মুজিব স্বাধীন বাংলাদেশের ঘোষণা দিয়েছেন এবং দেশের সর্বস্তরের জনগণকে যুদ্ধে যোগ দিয়ে দেশকে শত্রুমুক্ত করার আহবান জানিয়েছেন। যদিও, এই বেপরোয়া ঘোষণার মধ্যে কোন সামরিক দিকনির্দেশনা ছিল না। একি দিনে, রাত প্রায় দেড়টার দিকে সেনাবাহিনী শেখ মুজিবকে তার নিজ বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে। একি সময়, পশ্চিম পাকিস্তানেও এই প্রলম্বিত সামরিক শাসনের প্রতিবাদে কিছু বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
দেশে প্রথমবারের মত পরীক্ষামুলকভাবে সত্যিকারের গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া থেকেই মুলত পাকিস্তানের এই ভাঙ্গনের উৎপত্তি। তার পূর্বে পাকিস্তানের শাসন মুলত মনোনীত নির্বাচকমণ্ডলীদের দ্বারাই পরিচালিত হত। ১৯৬৯ সালের গনআন্দোলনের পর দেশে সামরিক আইন জারি করা হয়।
বিগত বছরগুলোতে পাকিস্তানে শুধু ভৌগলিক পার্থক্যই ছিলনা। প্রায় ৫৮০ লক্ষ পশ্চিম পাকিস্তানি আধিবাসিরা দেহবৈশিষ্ট্য আর মন-মানসিকতায়ও বাঙ্গালীদের থেকে যথেষ্ট আলাদা। ধারনা করা হয় যে, তুরকি থেকে যেসকল ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষ এই ভুখন্ড দখল করেছিল, তাদেরই উত্তরসুরি এই দীরঘাঙ্গী, গৌর বর্ণের পশ্চিম পাকিস্তানিরা। আকারে অপেক্ষাকৃত খর্বকায়, শ্যামল বর্ণের পূর্ব পাকিস্তানিরা এই দক্ষিন ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়া অঞ্চলের অধিবাসীদেরই বংশধর। সরকার ও প্রশাসন খাতে পশ্চিমাদের একচেটিয়া অধিকার আর জাতীয় বানিজ্যিক খাতে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রনে আরো বেশি বিভেদের সৃষ্টি করে। বহু বছর ধরে, পাকিস্তানের মোট আয়কৃত বৈদেশিক মুদ্রার বেশিরভাগ অংশ পূর্ব পাকিস্তানে উৎপাদিত পাট রপ্তানি থেকে আসলেও এ অঞ্চলের তেমন উন্নয়ন কার্যক্রম চালানো হয়নি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট, নতুন কলকারখানা বা আধুনিক সরকারি দালান বেশিরভাগই স্থাপিত হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানে।
দেশে বেসামরিক শাসন ফিরিয়ে আনা ও ক্ষমতা থেকে পদত্যাগ করার উদ্যোগ নিয়েই ইয়াহিয়া গত ডিসেম্বরে নির্বাচন দিয়েছিলেন, যেন একটি জাতীয় পরিষদ গঠন করে দেশে নতুন সংবিধান প্রনয়ন করা যায়। এ নির্বাচনে, বাঙ্গালীদের ভোটে পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭তেই শেখ মুজিবের আওয়ামীলীগ বিজয়ী হয়। জাতীয় পরিষদের মোট ৩১৩টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন পেয়ে তারা নির্বাচনেও বিজয়ী দল হিসেবে ঘোষিত হয়। মুজিবের দল দাবী করে যে, কেন্দ্রীয় সরকারকে ফলতঃ ভেঙ্গে দেশটির দুই প্রদেশে দুইটি আলাদা প্রাদেশিক সরকার গঠিত হবে। নিজ নিজ অঞ্চলের রাজস্ব আয়, বানিজ্য ও বৈদেশিক সহায়তার নিয়ন্ত্রন প্রাদেশিক সরকারের হাতে থাকবে। প্রতিরক্ষা ও কুটনৈতিক সিদ্ধান্তগুলোও প্রাদেশিক সরকার নির্ধারণ করবে। দেশকে অক্ষুন্ন রাখতে অবিচল ইয়াহিয়া, মুজিবের এই স্বায়ত্বশাসনের দাবী প্রত্যাখ্যান করেন। জাতীয় পরিষদ গঠনের কার্যাবলী পিছিয়ে দিয়ে তিনি ঢাকার উদ্দ্যেশ্যে যাত্রা করলেন। মুজিবের সাথে একটি সমঝোতার চুক্তিতে আসার লক্ষ্যে তিনি টানা ১১ দিন বৈঠক করেন। ইয়াহিয়া দাবী করেন যে, যাই হোক না কেন, মুজিবকে পশ্চিম পাকিস্তানের অধিকাংশ আসনে বিজয়ী পার্টির নেতা ও প্রাক্তন পররাষ্ট্র মন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টুর সাথেও সমঝোতায় আসতে হবে। ভুট্টো পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্ব দাবী করলেও মুজিব তার বক্তব্যেই অনড় থাকেন যে নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হয়েছে তার দল। সুতরাং ভুট্টোকে ছাড়াই সরকার গঠন করা তার ন্যায্য অধিকার।
সর্বাপেক্ষা দরিদ্র জাতি
পূর্ব পাকিস্তান থেকে যদি অবশেষে বাংলাদেশ নামে বিশ্বের দরবারে স্বীকৃত হয় তবে বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম জনসংখ্যা আর সর্বনিম্ন মাথাপিছু আয়ের (বাৎসরিক ৫০ ডলার) অধিকারী রাষ্ট্র হবে বাংলাদেশ। নিঃসন্দেহে এটিই হবে সর্বাপেক্ষা দরিদ্র রাষ্ট্র। বর্তমানে পাকিস্তানের এই দুই অঙ্গরাজ্য সংযুক্ত থাকায় যুক্তরাষ্ট্র কেবল ১৫০ মিলিয়ন ডলার অর্থ সহায়তা প্রদান করছে। পূর্ব পাকিস্তান পৃথক রাষ্ট্রে পরিণত হলে, দুইটি আলাদা রাষ্ট্রে আর্থিক সহায়তা প্রদান করতে হবে। ফলে, যুক্তরাষ্ট্রকেও তার আর্থিক সহায়তার পরিমাণ আরো ১৫০ মিলিয়ন ডলার বৃদ্ধি করতে হবে। পূর্ব পাকিস্তানের শিল্পখাতের সংখ্যা হাতে গোনা কয়েকটি মাত্র। পাটের চাহিদাও বিশ্ব বাজারে ক্রমহ্রাসমান। পশ্চিম পাকিস্তানও আয়তনে আরো ক্ষুদ্র ও আর্থিকভাবে দরিদ্র হয়ে পড়বে। যদিও সেখানে প্রাথমিকভাবে পোশাকশিল্পের একটি সম্ভাবনাময় খাত তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
এই দুর্ভাগ্যজনক বিচ্ছেদ থেকে যদি কেউ লাভবান হয়, তবে সেটি হবে ভারত। কেননা, দেশটিকে এখন অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্রতিপক্ষের সম্মুখীন হতে হবে। মুজিব ইতিমধ্যে ইঙ্গিত দিয়েছেন যে তিনি দিল্লী এবং সীমান্তের ওপারের হিন্দু বাঙ্গালীদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করবেন। কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে পশ্চিম পাকিস্তানের ভারতের প্রতি যে বৈরী মনোভাব , শেখ মুজিব তা ধারন করেন না। পূর্ব পাকিস্তান থেকে আয়কৃত বৈদেশিক মুদ্রা ছাড়া, অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র অর্থনৈতিক ভিত নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষে একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী পরিচালনা করা কঠিন হয়ে পড়বে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অত্যন্ত শক্তিশালি হওয়ার কারনে এতদিন পর্যন্ত ভারত তাদের প্রতিবেশীকে সঙ্ঘাতের সময় সমুচিত জবাব দিতে পারেনি। অবশ্য, ভারত নিজেও তাদের আদিবাসী বিচ্ছিন্নতাবাদি দলগুলোকে ছেড়ে কথা বলেনা, অনেক ভারতীয়র স্মৃতিতে নেতা নেহরু আজো বারবার ফিরে আসেন দুঃস্বপ্ন হয়ে। রাজনৈতিকভাবে একসময় যারা ঐক্যভুত ছিল, একসময় তারাই ব্যবধান আর শত্রুতার ফলে একে অপরের সাথে লিপ্ত হল রক্তাক্ত সঙ্ঘাতে, আর সেই পরিবর্তন বদলে দিল গোটা উপমহাদেশটাকেই।
হাত তোল, যোগ দাও আমার সাথে
গত সপ্তাহে শেখ মুজিবর (মুজিব) রহমানকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনারা তাকে এমন এক রেকর্ড করার সুযোগ করে দিয়েছেন, যা পৃথিবীর কোন মানুষ কোনদিন ভাংতে চাইবে না। ৯ বছর ৮ মাস সময় জেলে কাটিয়েছেন মুজিব, পাকিস্তানের অন্য যেকোন প্রসিদ্ধ রাজনৈতিক নেতাদের কারাবাসের তুলনায় অনেক বেশি।
পশ্চিম পাকিস্তানিরা শেখ মুজিবের প্রতি এত বিদ্বেষ পোষণ করার মুল কারন, প্রায় ২৩ বছরেরও বেশি সময় ধরে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য তিনি পূর্বদেশ (আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন) প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। গত ডিসেম্বর নির্বাচনী প্রচারনায়, এই পূর্বদেশই ছিল মুজিবের প্রচারনার মুল বিষয়। নির্বাচন শুরু হওয়ার ঠিক পূর্বেই তিনি জলোচ্ছাসে ক্ষতিগ্রস্ত উপকূলীয় এলাকা পরিদর্শনে যান। সেখানে যেয়ে তিনি বক্তৃতায় বলেন- “ যদি নির্বাচনে আমরা হেরে যাই, তবে এই লক্ষ মানুষের কাছে আমাদের দায় থেকে যাবে। জলোচ্ছাসের আঘাতে নিহত এই মানুষগুলোর জীবন বিসর্জন বৃথা যাবেনা। এই লক্ষ মানুষের সর্বচ্চো আত্মত্যাগ আরো লক্ষ বাঙ্গালীর স্বাধীনতার অধিকার আদায়ের দাবিতে শক্তি যোগাবে”।
বাঙ্গালীদের তুলনায় লম্বা (৬ ফুট), গাঁট্টাগোট্টা শরীর, মাথাভর্তি পাকা চুলের মুজিবকে সবসময় দেখা যায় ঢিলেঢালা পাঞ্জাবির সাথে একটি কালো হাতকাটা কোর্ট পরিহিত অবস্থায়। একজন গম্ভীর মানুষ, বাঙ্গালীদের তিনি নিজের সন্তানের মতই ধমকান। ৫১ বছর আগে, পূর্ববাংলার টুঙ্গিপাড়ার এক মধ্যবিত্ত গৃহস্থ পরিবারে তার জন্ম (গৃহস্থের পদমর্যাদার কারনেই শেখ পদবী দেয়া হয়)। মুজিব কলকাতা ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে কলা বিষয়ে অধ্যয়ন করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেন। ধানমন্ডির অভিজাত এলাকায় অবস্থিত তার দোতলা বাড়িটি বেশ অনাড়ম্বর হলেও ছিমছাম। এবাড়িতেই স্ত্রী ফজিলাতুন্নেসা, তিন ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে তার বসবাস। মাত্র সামান্য কিছুদিন বীমাকর্মকর্তা হিসেবে চাকরি করলেও, তার জীবনের বেশির ভাগ সময় তিনি রাজনিতীকেই উৎসর্গ করেছেন। প্রথমে তিনি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৪৭ এর দেশবিভাগের পর তিনি পূর্ব পাকিস্তানের উপর চালানো পশ্চিম পাকিস্তানিদের প্রতিটি শোষণের প্রতিবাদ করেছেন প্রচন্ড কড়া ভাষায়। তিনি তার সমরথকদের উদ্দেশ্যে বলেন- “ভাইয়েরা আমার, তোমরা কি জানো করাচি শহরের প্রতিটি রাস্তা সোনা দিয়ে মোড়া? তোমরা কি সেই লুট হয়ে যাওয়া সোনা ফিরিয়ে আনতে চাওনা? তবে হাত তোল, হাত তোল, যোগ দাও আমার সাথে। পাকিস্তানের জনক মোহাম্মদ আলি জিন্নাহর উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণার প্রতিবাদে গড়ে ওঠা ছাত্রআন্দোলনে যোগ দিয়ে প্রথমবারের মত তিনি গ্রেফতার হন ১৯৪৮ সালে।
এখনও পর্যন্ত, অনেকক্ষেত্রেই, তিনি রাজনৈতিকভাবে মধ্যপন্থী হিসেবে রয়ে গেছেন। তিনি একজন সামাজিক গণতন্ত্রবাদী, যিনি বড় বড় শিল্পকারখানা, ব্যাংক এবং বীমা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির রাষ্ট্রায়ত্তকরনে বিশ্বাসী করেন। এমনকি বৈদেশিক মুদ্রার নীতিতেও তিনি মধ্যপন্থাই অবলম্বন করেন। যেখানে পশ্চিম পাকিস্তানের জুলফিকার আলী ভুট্টো গণচীন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে আন্তরিক সম্পর্ক বজায় রাখেন এবং কঠোরভাবে ভারত-বিরোধিতা করেন, সেখানে মুজিব ভারতের সাথে বানিজ্যে আগ্রহী এবং কিছুটা পশ্চিমা ধ্যানধারনার বাহক হিসেবেই পরিচিত।