<৪,২৯৯,৭০৮-৭১০>
অনুবাদকঃ সৈয়দা ইসরাত জাহান কনক
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
২৯৯। পাক সামরিক জান্তার অধীন গভর্নর মালিকের নিকট জনাব মুহিতের চিঠি | এ, এম, এ, মুহিত সংকলিত “Thoughts in Exile” | সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
|
গভর্নর মালিকের নিকট পত্র
সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
আপনি আমাকে একটি উন্মুক্ত সমাজ তৈরির জন্য বলেছিলেন যেখানে বিতর্কের মীমাংসা হবে যুক্তিতর্কের ভিত্তিতে। সত্যিকারঅর্থেই কি আপনার মনে হয়যতদিন না পর্যন্তইয়াহিয়ার দলের চাপ পুরোপুরি বিলুপ্ত না হচ্ছেততদিন পশ্চিম পাকিস্তান কিংবা বাংলাদেশের কোথাও এ ধরণের কোন পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব?দেশটা সেরকম কিছু করতে চাইছিল যখন ভুট্টো ইয়াহিয়ার সাথে সামিল হয়ে সবকিছুই ব্যর্থতায় পর্যবসিত করতে চাইছিল। আমি অবাক হচ্ছি যে,২১ ফেব্রুয়ারি গৃহদাসের মতো বরখাস্ত হবার পরআপনার বলা উচিত ছিল প্রকৃত ক্ষমতার স্থানান্তর কখন হবে। আপনি কিভাবে এ সন্দেহ দূর করতে চাইছেন?
আপনি অর্থনীতি এবং সমাজের পুণঃনির্মাণ করতে বলছেন এবং অতীতকে ক্ষমা করতে ও ভুলে যেতে বলছেন। কার জন্য আপনি অর্থনীতি পুণঃনির্মান করবেন? আপনার পশ্চিম পাকিস্তান এবং বিহারি মালিকগণের জন্য, যখন তারা ভূমিহীন ছিল এবং তখন যাদের আমরা আশ্রয় দিয়েছিলাম? যখন বাংলাদেশের একটি পরিবারও ইয়াহিয়ার সামরিক বাহিনীরঅত্যাচার ও ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচতে পারেনি তখনআপনি কিভাবে ক্ষমা করবেন বা ভুলে যাবেন? ভারত বিভাজনের সময়ে এর পরিমাণ অনেক কম ছিল। উদ্ধৃতি সহকারে বলতে হচ্ছে যে, “অবিচ্ছিন্ন পাকিস্তান থেকে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে আমরা আমাদের জন্য নতুন মাতৃভূমি চাইতে বাধ্য হচ্ছি,কারণ এখানে আমাদের অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন।” প্রকৃতপক্ষে ইহা ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি এবং যা আমি আগেও দেখেছি।
আল্লাহর দোহাই এই বলবেন না যে,বর্তমান পরিস্থিতির পেছনে ভারতে ষড়যন্ত্র কিংবা তাদের সংশ্লিষ্ঠতা আছে। যেকোন সময়ই বাঙালিদের প্রমাণ করার সুযোগ রয়েছে যে,এখানে ভারতের কোন হস্তক্ষেপ নেই। আপনার মালিকদের বিরুদ্ধেও কুরুচিপুর্ণ হঠকারিতার প্রমাণ রয়েছে যে,তারা শেরে-এ-বাংলাকে ভারতের সাথে ষড়যন্ত্রেলিপ্ত হবার অভিযোগে অভিযুক্ত করেছেন। আমিব্যক্তিগতভাবেজনাব নুরুল আমিনের বিরুদ্ধে এই ধরণের অভিযোগ শুনেছি,পাকিস্তানের স্বার্বভৌমত্ব নিয়ে যার উদ্বেগ পশ্চিম পাকিস্তানিদের চেয়ে অনেক বেশি ছিল।
আপনি বাঙালিদের জাতীয় আত্মহত্যার কথা বলছেন। সৌভাগ্যবশত এবারের ঘটনা সেরকম কিছু না। ২৫ শে মার্চে ইয়াহিয়া-ভুট্টো মৈত্রীপাকিস্তানের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দিয়েছে এবং আপনি তা পুনরায় একত্রিত করতে পারবেন না কারণ দুই প্রদেশের মধ্যে এখন আছে রক্তের নদীআর “ঝলসান পৃথিবী”। প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয় যে,পাকিস্তানের ধ্বংসের পেছনে দায়ী তারাই,যারা পাকিস্তানের আন্দোলনের সাথে একদমই জড়িত নয়,যারা পাকিস্তানের জন্য কোন আত্মত্যাগ স্বীকার করেনি কিন্তু পরবর্তিতে বড় লভ্যাংশ ভোগ করেছে। পাঞ্জাবিরা পাকিস্তানের জন্য সামান্যই করেছে বিনিময়ে তারা পেয়েছে সর্বোচ্চ লাভ। ইয়াহিয়া এবং তার বাহিনী কখনোই পাকিস্তানের জন্য কাজ করেনি কাজেই তাদের দিক থেকে দেশ ধ্বংস করে দেয়াটা খুবই সহজ ছিল। ১৯৫২ সাল পর্যন্ত ভুট্টো ছিলেন ভারতীয় নাগরিক। কাজেই এটাই স্বাভাবিক যে,পাকিস্তানের অস্তিত্বের চেয়ে ব্যক্তিগতক্ষমতার লালসাঅবশ্যই তার নিকট বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। যারা পাকিস্তানের সৃষ্টিতে ভূমিকারেখেছিল তাঁদের দ্বারাই পাকিস্তান ধ্বংস হচ্ছে না দেখে আমি সন্তোষ প্রকাশ করছি। ।
আপনি গভর্নর হিসেবে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে আপনি শরণার্থীদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করবেন এবং দাবি করেছেন যে সংখ্যালঘুরা ভাল নাগরিক। আমি আপনার কর্তৃপক্ষ এবং তথ্য সম্পর্কে নিশ্চিত নই। পাকিস্তানিরা আমাকে বলছে,প্রত্যেক হিন্দুই শত্রু এবং তারাই সকল ঝামেলার উৎস এবং তারা বাঙালি মুসলমানদের ভুল পথে পরিচালিত করছে। আমি ইহাকে বাঙালি মুসলমানদের জন্য অপমান হিসেবে নিয়েছি এবং আপনি দেখে থাকবেন যে ইয়াহিয়া সাহেবকে দেয়া আমার পত্রে আমি এরূপ অদ্ভুত ইঙ্গিতের বিরোধিতা করেছি। এটা দ্বারা বুঝায় আপনার বক্তব্য শুধুই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মন রক্ষার্থে দেয়া এবং তার জন্য যত মিথ্যাই বলা লাগুক আপনার কাছে সেটা কোন বিষয়ই না। সংখ্যালঘু সমস্যা সমাধানের জন্য আপনি ভারতের সঙ্গে কথা বলেছেন। আমি কি আপনাকে আপনাদের ইতিহাসের কথা মনে করিয়ে দেব;আপনি সে সময়কার কথা বলছেন যখন দু’দেশের মাঝে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বেঁধেছিল। এখন কোন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধেনি বরংবাঙালি বিশেষত বাঙালি হিন্দুদের বিরুদ্ধে ইহা একটি সংগঠিত সরকারের ইচ্ছাকৃত গণহত্যা ।
আপনি সন্ত্রাস আন্দোলনের নিস্ফলতার কথা বলছেন। আপনি ভুলে যাচ্ছেন যে, এটা কোন সন্ত্রাসী আন্দোলন নয়,এটাস্বাধীনতা যুদ্ধ। গণতান্ত্রিক আইনসভা দ্বারা শাসিত ব্রিটেনের মত করে আপনিও আপনার উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য সাংবিধানিক কার্যক্রমের উপর নির্ভরশীল হতে পারেন। তারপরেও আপনি অসহযোগ,অবাধ্য নাগরিক আন্দোলন (পাঞ্জাবএবং আসাম ১৯৪৬-৪৭) কিংবা সরাসরি এ্যাকশনের মুখেও পরতে পারেন। বর্তমানে আপনি কাজ করছেন স্বৈর সামরিক শাসনের সাথে,যার কৌশলও ভিন্ন হতে হবে। আপনি কাজ করছেন অসভ্য,অশিক্ষিত এবং দেশপ্রেমহীন সুবিধাভোগী পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে।
আপনি খাদ্য সংকটের ব্যাপারে জোর দিয়েছেন কিন্তু পরিবহনের কথাটা মাথায় রেখেছেন কিন্তুখাদ্যের উৎস কি সেটা নিয়ে ভাবেননি এবং খাদ্য সংকটও দূর হয়নি। যখন আমরা খাদ্য সংকটের কথা বলছিলাম ইয়াহিয়া প্রতিশোধপ্রবণ হয়ে তীক্ষ্ণস্বরে বলেছিলেনগোডাউনগুলো খাদ্যে ভরপুর আছে। কিন্তু এখন এটা প্রমাণিতদেশে যে পরিমাণ খাদ্য প্রয়োজন, আপনি তার পুরোটার জোগান দিতে পারবেন না। আপনি ২.৩ মিলিয়ন টন আমদানির পরিকল্পনার কথা বলছেন। আমার সরাসরি অভিজ্ঞতা থেকে আমি আপনাকে বলতে পারি যে,পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের “দয়া”য় আপনি এ পরিমানের আশেপাশেও যেতে পারবেন না। আপনি কি জানেন গত বছরের পরিকল্পিত ২.৩ মিলিয়ন টনের কতোটুতু আমদানি হয়েছিল? শুধুমাত্র ১.১ মি টন।আপনিই ভালো জানেন আপনি কিভাবে আপনার মালিকদের দোষ ঢাকবেন, যাদের প্রতিক্ষেত্রেই সততার ঘাটতি রয়েছে।
আপনি ত্রাণ কার্যক্রম,প্রত্যাগমনকারীদের আর্থিক সাহায্য এবং পুনর্গঠনেরওয়াদা করেছিলেন । আপনার কি মনে হয় আপনি প্রচলিত নোট(ছাপানো টাকা) অথবা সম্পদ পাবেন?গত নভেম্বরের অভিজ্ঞতা ভিন্ন কথা বলে।বাহিরের দেশগুলো থেকে যে সম্পদগুলো আসে তাও বাংলাদেশে পৌঁছে না। দুই প্রদেশের মধ্যকার সম্পর্কের বেলায় বাংলাদেশকেএত বেশি শোষণ করা হয়েছে যে শঠতা,মিথ্যা এবং কুটিল চালের মত বিষয়গুলো পশ্চিম পাকিস্তানের নজরে আসে না। আপনার কি মনে হয় আপনার বক্তব্য এবং সিদ্ধান্ত তাদেরকে এসব থেকে বদলে দেবে?
আপনি ২৭৯মিলিয়ন রুপিঅর্থব্যয়ে বাংলাদেশে উন্নয়ন কার্যক্রমের কথা বলেছেন। আমি অবাক হয়েছি যে আপনিএই ব্যাপারটা উল্লেখ করেননি যা আপনার করা উচিত ছিল। যারা বাজেট তৈরি করেন,তারা তাঁদের কল্পনাতেও এমন কোন কিছু ভাবেন না।
আপনার অবিভক্ত,শক্তিশালী এবং গর্বিত পাকিস্তানের স্বপ্ন সত্যিই অযৌক্তিক এবং জনগণের প্রতি ক্ষমতার পুনর্বহাল এতোটাই দাম্ভিকতাপূর্ণ যে,সেখানে আমি স্পর্শ পর্যন্ত করতে পারছি না। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এখন অসভ্য দলে পরিণত হয়েছে,তাঁদের দ্বারা সভ্য সমাজ তৈরি করা সম্ভব না। তারা জনগণের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পক্ষেও নেই। ২৮ জুনের ইয়াহিয়ার বক্তব্যটি পড়ুন এবং যেদিন থেকে তিনি বাংলাদেশকে হাতের পুতুল বানিয়ে রেখেছেন সেদিন থেকে তার কর্মকান্ড বিশ্লেষণ করুন ।
আপনি বয়সে আমার থেকে বড় এবং আমার অত্যন্ত কাছের একজন।বার্ধক্যে উপনীত হয়ে আপনার এমন জঘন্য কাজে অংশগ্রহণ আমাকে কস্ট দিচ্ছে, যার কারণে আমি বাজে ভাষা ব্যবহার করতে বাধ্য হয়েছি। ইয়াহিয়া গত ফেব্রুয়ারি মাসেআপনাকে আপনার মতামতের বিরুদ্ধে চাকুরি থেকে বিদায় দিয়েছেন। পাগল হয়ে গেছে কিংবা পাগল হতে যাচ্ছে এরকম একজন মানুষের আশা কিংবা যোগ্যতায় আপনি কিভাবে বিশ্বাস রাখেন? পাকিস্তানের আর কোন পথ খোলা নেই। বাংলাদেশের সকল মা দুর্দশাগ্রস্থ, সকল যুবক আজ বিপ্লবী, আপনার পূর্ববর্তী শাসকদের হাত থেকে দেশকে রক্ষার জন্য প্রতিটি আত্মা আজ স্বাধীনতার বন্দরে। এ স্বাধীনতা শীঘ্রই আসবে এবং শাসকদের যথাপোযুক্ত শিক্ষা দেবে। তা পশ্চিম পাকিস্তানকেও স্বাধীন করে দেবে। এ ধারায় আপনি একজন অ-সত্তা এবং যতদ্রুত আপনি এ ব্যাপারটি অনুধাবন করবেন ততই আপনার এবং দেশের জন্য তা মঙ্গলজনক।
শেষ কথা
- আমরা চাইলে প্রোফেশনাল কাউকে দিয়ে এই দলিলপত্র কম্পাইল/অনুবাদ করাতে পারতাম। কিংবা স্ক্যান করে ওসিআর-এর সাহায্যে দলিলপত্রকে ইউনিকোডে কনভার্ট পারতাম। কিন্তু আমরা সেই কাজ করবো না। আমরা চাই যে এই প্রজন্ম নিজে কম্পাইল করে/অনুবাদ করে ধীরে ধীরে শিখতে শিখতে নিজেদের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগিয়ে তুলুক। কাজ থেকেই চেতনার জন্ম, কথা থেকে নয়।
- পাঠকালে বানান কিংবা অন্য যে কোন ইস্যুতে যে কোন ভুল-ভ্রান্তি চোখে পড়লে সাথে সাথে আমাদের ফেসবুক পেইজে একটি মেসেজ দিয়ে জানাবেন। ভালো/মন্দ যে কোন ধরণের পরামর্শ অত্যন্ত আনন্দের সাথে গৃহীত হবে এবং আপনাকে অত্যন্ত দ্রুত আমাদের ফেসবুক পেজ থেকে লাইভ চ্যাটের মাধ্যমে রিপ্লাই দেয়া হবে। কারণ আমাদের ফেসবুক পেজটি একই সাথে দেশ এবং বিদেশ থেকে পরিচালিত হচ্ছে। ফলে এডমিন প্যানেলের কেউ না কেউ সারাক্ষণই অনলাইনে আপনার ফিডব্যাকের অপেক্ষায় আছেন। আমাদের ফেসবুক পেজের লিংকঃ https://www.facebook.com/muktizuddho1971
- প্রকল্পটি নতুনদের জন্য সদা উন্মুক্ত। অর্থাৎ আপনি যদি আমাদের সাথে মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র নিয়ে কাজ করতে চান, তবে আমাদের ফেসবুক পেজে একটা মেসেজ পাঠিয়ে আপনার আগ্রহের কথা জানালেই হবে। আমরা কিছুদিন পর আপনাকে আমাদের কর্মযজ্ঞের অংশ করে নিবো। কাজ বুঝিয়ে দেবো। দল-মত-ধর্ম-বর্ণ-পরিচয় নির্বিশেষে আমাদের এই উদ্যোগ। তাই সকলের শুভকামনা আমাদের কাম্য।
- এটি কোন একক ব্যক্তি কিংবা একক গ্রুপের উপর নির্ভরশীল প্রোজেক্ট নয়। তাই স্পেসিফিক কেউ একজন থাকলে বা না থাকলে এই প্রোজেক্টের কিছুই যাবে-আসবে না। আগামীকাল সজীব বর্মণ নামক আইডিটি না থাকলে কিছুই আসে-যায় না। তাঁর জায়গায় অন্য কেউ কাজ করতে থাকবেন। আমাদের ফেসবুক পেজ থেকে কাজ চলতে থাকবে। ফেসবুক পেজ কোন কারণে বন্ধ হয়ে গেলে তা আবার নতুন করে খোলা হবে। কারণ আমাদের হাতে দলিলপত্র আছে। ডেডিকেটেড লেখকেরা আছেন। তাই এই প্রোজেক্টটা থেমে যাওয়ার কোন সম্ভবনা নেই। এভাবেই প্রোজেক্টটাকে ডিজাইন করা হয়েছে। প্রকৃতি শূণ্য স্থান পছন্দ করে না। আমরাও না। আমরা প্রকৃতির অংশ। আপনিও, তাই না?
-মাউ