পাক হানাদারদের ধবংসযজ্ঞের কবলে কয়েকটি ঐতিহাসিক স্মৃতিচিহ্ন

৭৩। পাক হানাদারদের ধবংসযজ্ঞের কবলে কয়েকটি ঐতিহাসিক স্মৃতিচিহ্ন (৪৭৭-৪৭৮)

পাক হানাদারদের ধবংসযজ্ঞের কবলে কয়েকটি ঐতিহাসিক স্মৃতিচিহ্ন
সুত্র – দৈনিক পূর্বদেশ, ২৩ জুন, ১৯৭২

।। মাজেদুর রহমান ।।

পাকিস্তানী হায়েনার দল ১৯৭১ সালের ১৪ই এপ্রিল মঙ্গলবার বিকালে সৈয়দপুর থেকে (রংপুর) বৃষ্টির মত বুলেট ছুড়তে ছুড়তে দিনাজপুর শহর যখন পুনর্দখল তখন অনেকেই ধারণা করতে পারেনি যে, তাঁরা শুধু এ দেশের মানুষের রক্ত নিয়ে হোলি খেলবে না, সব রকম ঐতিহাসিক স্মৃতিচিহ্নগুলো ধ্বংস সাধন করবে।

দিনাজপুর শহর পুনর্দখল করবার পর সম্ভাবত ১৭ই এপ্রিল রোজ শুক্রবার বেলা ৯/১০ টার দিকে পাঞ্জাবী হায়েনারা কয়েকটি সাঁজোয়া গাড়ী নিয়ে শহর থেকে এলোপাতাড়ি গুলী করতে করতে দক্ষিনের পাকা রাস্তা ধরে ভারত সীমান্তের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু চেরাডাঙ্গির নিকট ‘’লক্ষী জলের সাঁকো’’ বলতে একটা রাস্তার সংযোগস্থলে ঐ পল্লী এলাকার সংগ্রামী ছাত্র- জনতার নির্মিত আমগাছের একটা ব্যারিকেডে বাঁধা পেল।

রাস্তার উপর ব্যারিকেড দেখতে পেয়ে পাক দস্যুরা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো। এরই প্রতিশোধ হিসেবে ব্যারিকেডের স্থান থেকে দূরপাল্লার শক্তিশালী রকেটের দ্বারা একের পর এক মহরমপুর, পাইকপাড়া, তাজপুর ও মহব্বতপুরের কিয়দংশ জ্বলিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করেছিল। সেদিনের সবচাইতে বেদনাদায়ক ও হৃদয়বিদারক ঘটনা হল যে পাঞ্জাবী নরাধমরা পাইকপাড়া নিবাসী স্থানীয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষক জনাব মোহাম্মদ রোস্তম আলীকে ধরে নিয়ে আসে। বয়সে তরুণ ও বলিষ্ঠ চেহারার অধিকারী যুবক রোস্তম তাঁর পরিবারের জ্যেষ্ঠ পুত্র এবং একমাত্র উপার্জনক্ষম সন্তান ছিলেন। তাঁকে তারা কি বলেছিল এবং তিনি নিজে কি বলতে চেয়েছিলেন তা আজও জানা যায়নি। পাক সেনারা ঐ স্থান ত্যাগ করে চলে যাবার পর দেখা গেল রোস্তম আলী বাড়ী ফিরছে না।

তাঁর উদ্বেগাকুল পরিবার খোঁজাখুঁজি শুরু করলে বিকেল বেলা দেখা গেল রোস্তমের তাজা লাশ লক্ষীজল সাঁকোর ধারে কয়েক রাউন্ড গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পড়ে রয়েছে। স্বভাবতই আঁচ করা গেছে যে গাছ কেটে ব্যারিকেড নির্মাণের অভিযোগে রোস্তম দেশের জন্য ঐ এলাকার বাঙ্গালীদের মধ্যে প্রথম শহীদ হন। শহীদ রোস্তম কোনকালেই রাজনীতির সাথে নিজেকে জড়িত করেননি।

হায়েনার দল যখন বেলা ১/২ টার দিকে শহরে ফিরে আসছিল তখন পথে জেলার প্রাচীনতম (১৯৩২সন) হাইস্কুল চেরাডাঙ্গীপাড়ায় তারা সাঁজোয়া বাহিনী নিয়ে ঢুকে পড়ে। চেরাডাঙ্গী হলো ইউনিয়নের বোর্ড কার্যালয় ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রাণকেন্দ্র। বোর্ড কার্যালয় ভবনটি প্রধান মিলনায়তন সহ কয়েকটি ছোট ছোট কক্ষে বিভক্ত ছিল।

এসব কক্ষে জেলার বৃহত্তম চেরাডাঙ্গী জেলার কার্যালয়, চেরাডাঙ্গী ডাকঘর, চেরাডাঙ্গী দাতব্য চিকিৎসালয় ও ইউনিয়ন কনজুমার্স ষ্টোরের অফিসগুলো বিদ্যমান ছিল। এ ছাড়াও ঐ একই এলাকায় জেলার বৃহতম বেসরকারী ১৯৩২ সালে নির্মিত চেরাডাঙ্গী উচ্চবিদ্যালয়ের এক বিরাট হোস্টেল সহ চেরাডাঙ্গী নবীন মজলিস ও পাবলিক লাইব্রেরী নামে একটি ক্লাবও রয়েছে। হানাদার বাহিনী প্রথমে চেরাডাঙ্গীতে ঢুকে বেদম এলোপাথাড়ি গুলী করে স্কুলের বিজ্ঞান ভবন ও অফিস ঘরটিতে ঢুকে পড়ে।

এর পরপরই নাকি একদল সেনা ছুটে আসে চেরাডাঙ্গী বোর্ড কার্যালয়টিতে। প্রথমে ভালভাবে পেট্রোল ভবনটির বিভিন্ন কক্ষে ছিটিয়ে দেয় এবং একসঙ্গে কয়েক স্থানে আগুন ধরিয়ে দেয়। মাত্র এক ঘন্টার মধ্যে প্রাচীনকালের এ বোর্ড ভবনটি দেখতে দেখতে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ফলে বোর্ড ভবনে রক্ষিত ইউনিয়নের ২২ হাজার অধিবাসীর যাবতীয় রেকর্ড ও আনুষাঙ্গিক দলিল পত্র পুড়ে যায়।

বোর্ডের প্রায় ১৫ হাজার টাকার আসবাবপত্রসহ বিভিন্ন মালামাল নিশ্চিহ্ন হয়েছে। চেরাডাঙ্গী পশু মেলার একটি বিরাট লোহার সিন্দুকসহ চেয়ার টেবিল আলমারী এবং বিগত ২৫ বছরের সবরকম কাগজপত্র পুড়ে গেছে। চেরাডাঙ্গী ডাকঘরটিও সেখানে তাঁর নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে পারেনি।

Scroll to Top