পিপ্তির প্রলাপ *
১২ নভেম্বর, ১৯৭১
জঙ্গী শাসক ইয়াহিয়া খাঁ আর তার জল্লাদ বাহিনীর তোতাপাখীগুলা সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত একই শেখানো বুলি আউড়ে চলেছে রেডিও গায়েবি আওয়াজে গ্রামোফোন কোম্পানীর কুকুরের ছবিওয়ালা সেই রেকর্ডের মতো। পিন দিয়ে চড়িয়ে দিলেই হোল কলেরগান বাজতে শুরু করবে। বাঁধা গতে গান হবে। সকালসন্ধ্যা-রাত-যখনই শুনুন না কেন, পড়ানো লবজই বেতারের একমাত্র পুঁজি। সকালবেলা উঠে শুনতে পাবেন, অবস্থা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক, পরিস্থিতি সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। দুপুরে-দেশপ্রেমিক জনসাধারণ দৃস্কৃতকারীদের প্রশ্ৰয় তো দিচ্ছে-ই না বরং সেনাবাহিনীর কাছে ধরিয়ে দিচ্ছে। এরপর রাত গভীর হওয়ার সাথে সাথে পিন পাল্টে দেয়া হবে। আর তোতার কণ্ঠে শোনা যাবে- একদল অনুপ্রবেশকারী আমাদের সীমান্তের কয়েকশ’ গজ ভেতরে ঢুকে পড়েছিল। আমাদের সেনাবাহিনী শুরুতেই তাদের বাধা না দিয়ে পরিকল্পিতভাবে তাদের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। পরে সময়মতো আক্রমণ চালায়। আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে অনুপ্রবেশকারীরা অস্ত্রশস্ত্র ফেলে পালিয়ে যায়। এর পরেই একটি অস্ত্রপাতির লম্বা ফর্দ পেশ
* পিণ্ডির প্রলাপ’ শীর্ষক ধারাবাহিক কথিকাগুলো তোয়াব খান রচিত।
এবং হতহাতের সংখ্যা বহু বলে উল্লেখ করা হবে। সবশেষে বলা হবে, কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।’ দিনের পর দিন তোতার কণ্ঠে রেডিও গায়েবী আওয়াজের এই বাণীই শুনতে পাওয়া যাবে। অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যাও আবার কয়েক হাজার, কিন্তু তোমার প্রভুর ক’জন বরকন্দাজ মারা গেল সে সম্পর্কে গায়েবী আওয়াজ এক্কেবারেই চুপ৷
সমরবিদ্যার সবচেয়ে খারাপ ছাত্রটিরও পেটের পিলে এই জাতীয় কথাবার্তা শুনে ফেটে যেতে পারে হাসতে হাসতে। সীমান্তের কয়েকশ’ গজ ভেতরে, হতাহতের সংখ্যা বহু, কয়েকজন গ্রেফতার’- অর্থাৎ সঠিক সুস্পষ্ট কোন তথ্য তোতার মুখে ভুল করেও শোনা যাবে না। যদি প্রশ্ন করা যায়- মাথা খারাপ হয়েছে, ও কথা মুখে আনবেন না। কোন তথ্য সম্পর্কে প্রশ্ন করা সাফ মানা। তার উপর তোতা কি প্রশ্ন করতে পারে? কিন্তু মুশকিল হোয়েছে গ্রামোফোন কোম্পানীর তোতা আর তার প্রভু ছাড়াও বাইরের যে জগতটি রয়েছে তাকে নিয়ে তারা তো তোতা নয়, তাই প্রশ্ন তারা তুলছে। বলছে, নাদীর শাহের বংশধর আর গোয়েবলসের মন্ত্রশিষ্যারা হাতে কোন সুস্পষ্ট তথ্য থাকলে ছাডুন। কয়েক হাজার অনুপ্রবেশকারী, কয়েকশ’ গজ ভেতরে, কয়েকজন গ্রেফতার, হতাহত বহু- এসব কথা শুনলে তো পাগলেও হাসবে।
বাংলাদেশে কি ঘটেছে বা এখন কি ঘটছে, সে সম্পর্কে তোতার মুখের কাহিনীর ছাড়া অন্য কিছু যাতে দুনিয়ায় প্রচারিত না হয় তার জন্যই ইয়াহিয়া খাঁর আর সাঙ্গপাঙ্গরা প্রথমেই সমস্ত বিদেশী সাংবাদিককে ঢাকা সাংবাদিককে বাংলাদেশে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হলো। সেই সঙ্গে বলে দেয়া হলো- অমুক অমুক জায়গায় যেতে পারবেন না, তমুক তমুক কথা লিখতে পারবেন না। অমান্য করলে হয় ফাটক, না হয় লেখা গুম। এতসব বাধানিষেধ সত্ত্বেও বিদেশী খবরের কাগজগুলো যা লিখছে, তাতে জঙ্গীশাহীর বিচারের বেলুনটি ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে।
‘নিউজউইক’ পত্রিকার কথাই ধরা যাক। এই মার্কিন সাপ্তাহিকীটির সাথে সাক্ষাৎকারে ইয়াহিয়া খাঁ ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ অপরিহার্য বলেছিলেন। সেই কাগজই লিখেছে, ইয়াহিয়ার সরকার যাদেরকে অনুপ্রবেশকারী, ভারতীয় চর বলছে, তারা তো শুরু থেকেই লড়ছে সামরিক চক্রের বিরুদ্ধে। এরা বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর লোকজন ছাড়া আর কিছুই নয়। পত্রিকাটিতে ভারতীয় গোলাবর্ষণের পাকিস্তানী অভিযোগের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, শেলগুলো পরীক্ষা করলেই যে কোন পর্যবেক্ষক বুঝতে পারবেনএগুলো নিকটপাল্লার কামান বা দুইঞ্চি মর্টার থেকে বর্ষিত হয়েছে। দূরত্ব বিচার করে একথা অনায়াসে বলা বলে, ভারত থেকে বর্ষণ করলে শেলগুলো এত দূরে আসতে পারে না। বিলেতের কাগজগুলো বলছে, বিবিসি বলছে, ফ্রান্সের সবচেয়ে মর্যাদাসম্পন্ন সংবাদপত্র ‘লামদ বলছে একই কথা। কিন্তু তাতে কি আসে যায়! তোতার শেখানো লবজ তা পালেট যাবে না।
এরপর ধরুন না অবস্থা স্বাভাবিক, দেশপ্রেমিকেরা দুষ্কৃতকারীদের ধরিয়ে দিচ্ছে তোতার এ বাণীর কথা। দেশপ্রেমিক নাগরিকরা জঙ্গিশাহীর সাথে এমনই সহযোগিতা করছেন যে, এখন তাদের উপর পিটুনি ট্যাক্স ধার্য করতে হচ্ছে জঙ্গীশাহীকে। এতেও যদি নিজেদের দৈন্য প্রকাশ না পায়, তবে দৈন্য’ শব্দের আধিধানিক অর্থই পাল্টে ফেলতে হবে। বিবিসির ভাষ্যকারের মতে, পিটুনি ট্যাক্স ধার্য থেকে বাংলাদেশের অবস্থা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক, জঙ্গীশাহীর এ দাবির অসারতা দুনিয়ার মানুষ বুঝতে পেরেছে। শুধুই তাই নয়, মুক্তিবাহিনীর লোকজন বাংলার মানুষের যে অকুণ্ঠ সহযোগিতা পাচ্ছে, এ থেকেই তা স্পষ্ট বোঝা যায়। গার্ডিয়ান, ডেলি টেলিগ্রাফ ও বিবিসির মতে, বাংলাদেশের মাইলে পর মাইল এলাকায় ইয়াহিয়ার জল্লাদ বাহিনী বা তার ক্রীড়নক সরকারের কোন অস্তিত্ব নেই। সেখানে মুক্তিবাহিনীর কর্তৃত্ব সূদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত। সর্বোপরি ইয়াহিয়ার চামুর দল রাতের বেলা কোথাও বের হতে সাহস করে না।
মুক্তিবাহিনীর সাথে লড়াইয়ে জঙ্গিশাহীর এই যখন হালহকিকত, সৈন্যদলের মোর্যাল ঠিক রাখার জন্য তখনই খাঁ সাহেবরা গোয়েবলসের প্রেতাত্মার ঘাড়ে ভর করেছেন, তাই প্রতিদিন কুৎসা আর মিথ্যার বোঝা তাদের বেড়েই চলেছে। কিন্তু এমন দিন আর দূরে নয়, যখন মিথ্যার বোঝা চাপা পড়ে জঙ্গশাহীকে পুঁজিপাটাসমেত পৈত্রিক প্রাণটাও হারাতে হবে।
১৬ নভেম্বর, ১৯৭১
একেবারে গোমড় ফাঁক! ইয়াহিয়া খাঁর জবর বাক্যবাগীশ জেনারেল এ, এ, কে নিয়াজীকে একেবারে পথে বসিয়ে দিয়েছে মার্কিন কাগজ ‘নিউজউইক’। এত জাঁক করে তিনি বলেছিলেন, মার্চে যা করেছি, প্রয়োজনবোধে আবার তা করবো ঢাকার রাজপথে। আমাদের ট্যাঙ্কগুলো অপেক্ষা করছে। কিন্তু নিউজউইকের সিনিয়র এডিটর আরনড-দ্য-ব্ৰচগ্রেভ তো আর নিয়াঁজীর ক্যান্টনমেন্টের সিপাই নয়। সাফ বলে দিয়েছেন, জেনারেল তুমি মূখের স্বর্গে বাস করছো। পায়ের তলায় মাটি যে কতটা সরে গেছে তার খবর রাখ না। বাংলাদেশের শতকরা ২৫ ভাগ থানার উপর তোমাদের কোন কর্তৃত্ব নেই। মুক্তিবাহিনীর কর্তৃত্ব সেখানে সুপ্রতিষ্ঠিত। খোদ ঢাকার উত্তরাংশ এখন মুক্ত।
বাংলাদেশের ৭২ ঘন্টার মধ্যে অভিযান শেষ করার লম্বা-চওড়া আশ্বাসদানীকারী নরঘাতক জেনারেল টিক্কা খানের সর্ববৃহৎ বেলুনটি চুপসে যাওয়ার সাথে সাথেই এ, এ, কে নিয়াজীর আবির্ভাব। পাঞ্জাবের সাবেক সামরিক প্রশাসন এই জেনারেলের ভূমিকা সামরিক চক্রের জঘন্য ষড়যন্ত্রগুলিতে কোন অংশেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। ’৬৯ সালের জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারী-মার্চ যখন সারাদেশ গর্জে উঠেছিল আইয়ুবের স্বৈরাচারী কুশাসনের বিরুদ্ধে, হরতাল মিছিল আর ঘেরাওয়ে প্রকম্পিত হয়েছিল সামন্ত প্ৰভু একচেটিয়া পুঁজিপতি আর সামরিক অফিসারদের বাড়িতে বাড়িতে সেই সময়ে এই নিয়াজীকে দেখা যায় ঝিলামের একটি সামরিক ছাউনি এলাকায় অফিসারদের সাথে সলাপরামর্শ করতে-সংগঠিত করতে। ’৬৯ সালের ২৫ মার্চের ইয়াহিয়ার সামরিক অভ্যুত্থানের নেপথ্য কাহিনী সম্পর্কে লিখতে গিয়ে লণ্ডনের ডেলী টেলিগ্রাফ বলেছিল, জেনারেল নিয়াজীর-যাকে সামরিক চক্র টাইগার নিয়াজী বলে অভিহত করে থাকে- নেতৃত্বে একদল অফিসার এই মর্মে আলটিমেটাম দিয়েছিল যে তারা বাংলাদেশের তথাকথিত অরাজকতা কোনমতেই বরদাস্ত করতে রাজি নয়। তাদের মতে, এই সমেয় যা চলেছে তাকে বাড়তে দিলে সব যাবে। শোনা যায়, ঝিলামের সেই কুখ্যাত বৈঠকেই ঠিক করা হয়েছিল, বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থানকে স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য যদি দরকার হয় তবে লক্ষ লক্ষ লোককে সাবাড় করে দেওয়া হবে। শহরে-নগরে বিক্ষুব্ধ জনতার মিছিলের উপর প্রয়োজনবোধে চালানো হবে ট্যাঙ্ক। তবে নিয়াজীর বড় আফসোস ছিল ’৬৯ সালেই এগুলো ঘটেনি বলে। অতএব নিয়াজী এ্যান্ড কোম্পানীরা বাংলাদেশের গণহত্যার ব্লপ্রিন্টটা দু’বছরের জন্যে কোল্ড ষ্টোরেজে রেখে দিয়েছিলেন। তাই ’৭১ সালের মার্চের শুরুতেই বাংলাদেশের মানুষের অসহযোগ আন্দোলনের আলোতেই এইসব জেনারেলরা তাদের বিপদের সংকেত দেখতে পেলো। কায়েমী স্বার্থ বিপন্ন। তাই তারা চক্রান্তের জাল ফেলতে শুরু করলো একে একে। অবশেষে এলো ২৫শে মার্চের সেই কালোরাত। টিক্কা খাঁর সাথে সাথে জেনারেল নিয়াজী বাংলাদেশে এলেও প্রেক্ষাপটে তার আগমনবার্তা ঘোষিত হয়নি। কিছুটা নেপথ্যেই রয়ে গেলেন তিনি। দায়িত্ব দেওয়া হলো বাঙালী নিধনের অপারেশনের। তারপর একদিন রণাঙ্গণে তার আবির্ভাব সামরিক প্রশাসন ও ইষ্টার্ন কমান্ডের কমাণ্ডাররূপে।
কিন্তু এবারে জেনারেল সাহেবের এস্টার্ন কমান্ড একোবরেই ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়েছে মুক্তিবাহিনীর গোলা আর বুলেটের আঘাতে আঘাতে অবস্থা বেগতিক দেখে রাজাকার নামক একদল ক্ষুদে ডাকাত সৃষ্টি করা “হাতে অস্ত্র আছে বলে রাজাকারদের দল নিজেদের খোদা বলে মনে করে। যত্রতত্র নিরীহ নিরস্ত্র জনসাধারণের কাছ থেকে
টাকা-পয়সা আদায় করছে। যারা তাদের আশ্রয় দিতে বা মেয়েলোক সরবরাহ করতে অস্বীকার করছে তাদেরকে হত্যা করছে গুলি করে। এরপর মুক্তিবাহিনীর দুর্জয় অভিযানের সামনে সেনাবাহিনী প্রথমেই ঠেলে দিচ্ছে এইসব নিবোধ রাজাকারের দলকে।”
এসব সত্ত্বেও জেনারেল নিয়াজীর লম্বা-চওড়া দাবি কেন? নিউজউইকের মতে, পরাজয়ের গ্রানি কিছুটা লাঘবের জন্য জেনারেলের জল্লাদ বাহিনী নিরীহ-নিরস্ত্র সাধারণ মানুষকে হত্যা করছে, ব্যাপকাকারে চালাচ্ছে লুটতরাজ। সংবাদদাতা ঢাকার ডেমরা এলাকার কথা উল্লেখ করে বলেছেন, ইয়াহিয়ার সৈন্যদল এই গ্রামটি ঘেরাও করে ১২ থেকে ৩৫ বছরের প্রত্যেকটি মহিলার উপর পাশবিক অত্যাচার চালায় এবং ১২ বছরের উপরের সকল পুরুষকে হত্যা করে। এই হত্যা, লুণ্ঠন ও পাশবিকতায়ও শেষরক্ষা যে অসম্ভব, বাংলার দিগন্তবিস্তৃত মাঠ আর পদ্মা-মেঘনা-যমুনার উত্তাল তরঙ্গমালার দিকে একবার তাকালেই তা পরিষ্কার হয়ে যাবে।
২৮ নভেম্বর, ১৯৭১
মিথ্যোবাদী রাখালের কান্নায় ভিজে তার মহাপ্ৰভু শ্বেতপ্রাসাদ থেকে একেবারে দূরপাল্লার টেলিফোন করে বসেছেন ১০ ডাউনিং স্ট্রিটে। অভিপ্রায়- কিভাবে বাঁচানো যায় রাখালটিকে। স্বস্তি পরিষদের বৈঠক-টৈঠক কিছু করা যায় কিনা, তারই শলাপরামর্শ নাকি চলছে। হাজার হলেও এই রাখাল আর তার দেশ দীর্ঘদিন ধরে সাথে সাথে আছে সবকিছুতেই। সেই বাগদাদ চুক্তি, সিটো আর পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি থেকে শুরু করে সব সময়ে দুদিনে-সুদিনে পাশ্চাত্যের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সাথে তাল মিলিয়ে চলেছে পিণ্ডির জঙ্গীচক্র। ৫৮ সালের ইরাকী বিপ্লবের পর বাগদাদ জোট থেকে খোদ বাগদাদ খসে পড়ার পরও পিণ্ডির জঙ্গীচক্র উৎসাহী দোসর হিসাবে পাশ্চাত্যের সাথে থেকেছে সেন্টো চুক্তির বাঁধনে। আর এশিয়ার মাটিতে পরিবর্তনের ঢেউ বয়ে গেলেও পিণ্ডির জল্লাদের দল কোন সময়েই সিটো জোট থেকে সরে দাঁড়ায়নি। অতএব এ ধরনের একটি বিশ্বস্ত দালালকে তো রক্ষা করতেই হবে। কিন্তু মুশকিল হয়েছে জাতিসংঘ নামক সংস্থাটির সনদ নিয়ে। এই সনদ অনুযায়ী একমাত্র আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার মত অবস্থা দেখা দিলেই শুধু স্বস্তি পরিষদ কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও পিণ্ডির জঙ্গীচক্র এখনও এমন অবস্থা সৃষ্টি করতে পারেনি, যাকে আন্তর্জাতিক শান্তি বিপন্ন হওয়ার মত পরিস্থিতি বলে অভিহিত করা চলে। অন্যদিকে জঙ্গীচক্রের বরকন্দাজেরা একথা ক্রমান্বয়ে স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছে যে, বৈদেশিক হামলা-টামলা নয়, মুক্তিবাহিনীর দুর্বার আক্রমণেই এখন তারা চোখে সর্ষের ফুল দেখতে শুরু করেছে। বরকন্দাজ দলের পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান জেনারেল নিয়াজী তো খোলাখুলিভাবে বলেই ফেলেছেন যে, একমাত্র ঢাকাতেই দু’হাজার গেরিলা সক্রিয় রয়েছে। আর রেডিও গায়েবী আওয়াজ বলছে, যশোরের চৌগাছার কাছে লড়াই চলছে। তবে কিনা মুক্তিবাহিনী এখনও সরাসরি যুদ্ধ করার পর্যায়ে যায়নি। আতএব জঙ্গীচক্র শীঘ্রই চৌগাছা আবার দখল করতে পারবে-এই তাদের আশা বিভিন্ন সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে রেডিও গায়েবী আওয়াজ এটা প্রচার করলেও একটি সত্য সকলের কাছে সুস্পষ্ট হয়ে যায়- চৌগাছায় মুক্তিবাহিনীর সাথেই জল্লাদ দলের লড়াই চলছে। অতএব বৈদেশিক আক্রমেণর জুজুটা যে একেবারেই নির্জলা মিথ্যা, এটা রেডিও গায়েবী আওয়াজও স্বীকার আইন-কানুনেই তা স্পষ্টই ধোপে টেকে কি করে? বাংলার মানুষের মুক্তিসংগ্রোমের আট মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। এই দীর্ঘ আট মাসের তীব্র ও তিক্ত সংগ্রামকালে যাদের মুখ থেকে এমনকি সমবেদনার একটি কথাও শোনা যায়নি। আজ তারা এতই উদ্বিগ্ন যে, স্বস্তি পরিষদে হাজির হওয়ার কথা পর্যন্ত ভাবছেন। অবশ্য মিথ্যেবাদী রাখালটিকে নিয়ে শ্বেতপ্রসাদের মহাপ্রভুরা উদ্বেগে আজ সোচ্চার হলেও নতুন কিছু নয়।কিছুদিন আগে ছ’জন সদস্যকে নিয়ে একটি তদন্তদল গঠনের কথা তারা ঘোষণা করেছিলেন। এটার মাধ্যমে তারা আসর জাঁকাতে চেয়েছিলেন। ওয়াশিংটনের পররাষ্ট্র দফতর থেকে ঐ রাখাল বালকটিকে কিছু কিছু সুপরামর্শও দেয়া হয়েছে। এবং সেই অনুযায়ী বাংলার গভর্নর পদে আবদুল মোতালিব
মালিক নামক জনৈক দালাল দন্তচিকিৎসককে বসানো হয়েছে। বিগত সাধারণ নির্বাচনে জনগণের কাছে পরিত্যাক্ত কতিপয় রাজনীতিককে নিয়ে একটি তথাকথিত বেসামরিক সরকারও খাড়া করা হয়েছে। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার প্রহসকে তথাকথিত ‘সুবিচার’ হিসেবে দেখানোর জন্য একজন অনুমোদিত কৌঁসুলি দেয়া হয়েছে। আরো শোনা যায়, মার্কিনী সুপারিশ অনুযায়ীই গঠন করা হয়েছে রাজাকার বাহিনী, দেখানো হয়েছে সাধারণ ক্ষমার প্রহসন।
বাংলাদেশের মানুষ, সংগ্রামী মুক্তিযোদ্ধারা আর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কেউই এই ধরনের কোন ফাঁদে পা দেননি। সকলের কাছেই এই ধরনের সুকৌশল-চাতুর্যের আসল মতলবটা সব সময়ই ছিল অত্যন্ত পরিষ্কার। এবার তাই মরণোন্মুখ রাখাল বালটিকে বাঁচানোর জন্য শেষ চেষ্টা শুরু হয়েছে শ্বেতপ্রাসাদ আর ডাউনিং স্ট্রিট থেকে। যে সংস্থা বাংলার লাখ লাখ মানুষ হত্যার, গণহত্যার অভিযোগ শুনতে চায়নি, জল্লাদ দলের অত্যাচারে পৈত্রিক ভিটেমাটি থেকে উৎখাত হয়ে বিদেশে আশ্রয়গ্রহণকারী প্রায় এক কোটি মানুষের আকুল আবেদন যাদের কর্ণকুহরে প্রবেশ করেনি, তাদের নতুন যেকোন চক্রান্ত বাংলার মানুষ বানচাল করে দেবে। হানাদার বাহিনীকে চিরতরে খতম করে দিয়ে বাংলার স্বাধীনতার সূর্যকে অম্লান অক্ষয় রেখেই সাড়ে সাত কোটি বাঙালী এই নতুন চক্রান্তের দাঁতভাঙ্গা জবাব দেবে।
১০ ডিসেম্বর, ১৯৭১
স্বস্তি পরিষদ বা সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে চীনের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা মার্কিন চক্রান্ত একের পর এক চলতে থাকলেও গণপ্রজাস্ত্রী বাংলাদেশ এখন একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য। এটা অস্বীকারের অর্থ সকালের নবীন সূর্যের আলোকরশ্মি থেকে নিজেকে বঞ্চিত করা। নিরাপত্তা পরিষদে ব্যর্থ হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাধারণ পরিষদে কতিপয় পেটুয়া রাষ্ট্রের সাহায্যে এবং চীনের সহযোগিতায় বাংলাদেশ তথা ভারতের বিরুদ্ধে একটি প্রস্তাব পাস করিয়ে নিয়েছে। আর তাদের সাথে এ ব্যাপারে ভিড়ে গেছে ইসলামের বেশধারী কতিপয় ইসলামপন্থী রাষ্ট্র। কিন্তু জাতিসংঘে যত তাড়াহুড়ো করেই তারা প্রস্তাব পাস করুক না কেন বাংলাদেশের পিণ্ডির জল্লাদ দলের বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর দুর্বার অভিযান তাতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাগ্রস্ত হবে না । জাতিসংঘের ফরমান বাংলাদেশে পৌঁছানোর আগেই পাকিস্তানী হানাদারদের প্রতিরোধের সকল প্রাচীর ধসে পড়বে, এটা এখন প্রায় সুনিশ্চিত। সত্যি কথা বলতে কি, জাতিসংঘ নামক ঠুটো জগন্নাথকে রবার স্ট্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করার সুযোগ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে আর পাচ্ছে না বা এ সুযোগ তাদেরকে দেয়া হবে না। বাংলাদেশের আকাশে স্বাধীনতার যে সূর্য আজ আপন মহিমায় বিকশিত হয়েছে তাতে কলঙ্কিত করার মওকা পাক-দোস্ত চীন বা পিণ্ডির মহাপ্ৰভু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা তাদের রবার স্ট্যাম্প জাতিসংঘ পাবে না।
বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের যে সংগ্রাম শুরু করেছেন মহান গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের কূটনৈতিক স্বীকৃতির পর তা আজ এক নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করেছে। মুক্তাঞ্চলে নবজীবনের রূপায়নের মহান দায়িত্ব আজ মুক্তিসংগ্রামী সকলের উপর বর্তেছে। তারাই আজ স্বাধীন বাংলাদেশে সুখী শোষণহীন গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার নকিব। এজন্যই প্রথমে মনে রাখা দরকার, আমাদের এই স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমি ও মূলনীতির কথা। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ তাদের সাম্প্রতিক বেতার ভাষণে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় স্বাধীন বাংলার অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের মূলনীতি জানিয়ে দিয়েছেন। এই নীতির ভিত্তি হলো ধর্মনিরেপক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র। তারা বলেছেন, মানুষের উপর মানুষের শোষণের নীতিতে আমরা বিশ্বাসী নই। ধনী ও দরিদ্রের মধ্যকার অর্থনৈতিক ব্যবাধানের অবশ্যই বিলোপ সাধন করতে হবে। আজ তাই এমনভাবে সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থাকে পুনর্গঠিত করতে হবে, যাতে বাংলাদেশের মেহনতি মানুষ উপকৃত হয়। যাতে শ্রমিক-কৃষক পায় সকল সুযোগ-সুবিধা তাদের জীবনযাত্রার পুনর্বাসনের জন্য।
বস্তুতঃপক্ষে স্বাধীন বাংলাদেশের শোষণহীন সমাজব্যবস্থার অর্থনৈতিক কাঠামোটি কি ধরনের দাঁড়াবে তার একটি মোটামুটি রূপরেখা দেয়া হয়েছে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ম্যানিফেষ্টোতে। এতে অর্থনৈতিক রফতানী বাণিজ্য রাষ্ট্রায়তুকরণের কথা বলা হয়েছে। ভূমিব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন সাধন এবং কর কাঠামোর প্রগতিশীল রূপায়নের দিকও নির্দেশিত হয়েছে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ম্যানিফেষ্টেতে। যেহেতু বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান ও কৃষিনির্ভর দেশ সেহেতু গ্রামবাংলার উন্নয়ন তথা কৃষির পক্ষে কল্যাণকর ব্যবস্থা ছাড়া অর্থনৈতিক বৈপ্লবিক রূপায়ণ প্রায় অসম্ভব বলা চলে। দারিদ্র্য তার সর্বগ্রাসী সংহার মূর্তি নিয়ে সর্বত্র সমান ছায়া ফেললেও পাকিস্তানী শাসকদের ঔপনিবেশিক নীতির ফলে বাংলাদেশের গ্রামবাংলার চেহারা আজ ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। পাকিস্তানী শোষকরা দরিদ্র কৃষককুলের কল্যাণের জন্য কোন ব্যবস্থা তো গ্রহণ করেইনি বরং এমন সমস্ত ব্যবস্থা নিয়েছে যাতে ভূমিহীন কৃষকের হাতে এককাঠা জমি না যায়। এক সময়ে ভূমির সর্বোচ্চ সীমা পরিবারপ্রতি ৩৩ একর নির্ধারণ করে যে আইন পাশ করা হয়েছিল, জল্লাদ ইয়াহিয়ার গুরদেব আইয়ুব খাঁ তা রদ করে ১২৪ একরে নির্ধারণ করে। যার ফলে উদ্ধৃত্ত ভূমি বাংলাদেশে বন্টনের সম্ভাবনা চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যায়। তাই আজকে বাংলাদেশের মেহনতি কৃষকসমাজের ৭৬ শতাংশ হয় ভূমিহীন আর না হয় নিতান্তই গরীব। পশ্চিম পাকিস্তানী সামন্ত ভূস্বামী একচেটিয়া পুঁজিপতিদের সীমাহীন শোষণের ফলে বাংলাদেশের কৃষকের ঋণের পরিমাণ শুধু সরকারের কাছে দাঁড়ায় একশো কোটি টাকার উপরে। জোতদার ও মহাজনী ঋণের পরিমাণ তাতে ধরা হয়নি। আর কৃষকদের মধ্যে এই মহাজনী ঋণের পরিমাণ যে কত ব্যাপক তা সকলেরই জানা আছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ আবাদী জমিও এদের কবজার মধ্যে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় এই যে, বাংলাদেশের শস্যভাণ্ডার বলে বিবেচিত জেলাগুলো- সিলেট, ময়মনসিংহ, রংপুর, রাজশাহী, দিনাজপুর, বরিশাল, পটুয়াখালী, খুলনার দক্ষিণাঞ্চলে মহাজনী ও জোতদারী শোষণের রূপটা সবচেয়ে প্রকট। এই সমস্ত অন্যায় ও অবিচার অবসানের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ম্যানিফেষ্টেতে। ভূমিব্যবস্থাকে এমনভাবে পুনর্বিন্যাসের কথা বলা হয়েছে যাতে সত্যিকারের কৃষক উপকৃত হয়। বর্তমান ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার বিলোপ সাধনের উদ্দেশ্যে প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমি করমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে এবং এই পরিমাণ জমির জন্য বকেয়া কোন খাজনা দিতে হবে না বলে ঘোষণা করা হয়েছে।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো সম্পূর্ণ শোষণমুক্ত করে কৃষক-শ্রমিক মধ্যবিত্ত-ব্যবসায়ী তথা আপামর জনসাধারণের জন্য এক সুখী-সমৃদ্ধিশালী সমাজ গঠনের দায়িত্ব আজ সকলের গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যেই মুক্তাঞ্চলে বেসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থা চালু করার কাজ হাতে নিয়েছেন। নয়া জামানার নতুন নকীবদের কণ্ঠে ধ্বনিত হোক আজ নবজীবনের শপথ, নতুন সমাজ গঠনের রণতর্য।