<৯, ১৬.১১, ৪৯২-৪৯৪>
ঢাকায় গেরিলা অপারেশন–৬
প্রতিবেদন- মোঃ জহিরুল হক
(১৬ ডিসেম্বর ১৯৭৩ সালে ‘দৈনিক মর্নিং নিউজ’-এ প্রকাশিত ‘Guerilla operation in Dhaka’ শীর্ষক প্রতিবেদনের অংশ)
(অনুবাদ)
১৯৭১ জুলাইয়ে প্রথম সপ্তাহে আমাদের বীর মুক্তিবাহিনী দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান শুরু করে।এমন কি গেরিলারা (মুক্তিবাহিনী নামে ভালো পরিচিত) ঢাকা শহরেও অভিযান শুরু করে, যা পাকিস্তানিদের শক্তিশালী অভেদ্য দূর্গ ছিলো।
কিন্তু শহরে অপারেশন এর মাধ্যমে তারা আধিপত্য অর্জন করতে পারেনি। বরং বিশ্ব বাসীর কাছে এটা উপস্থাপন করা গেছে যে গেরিলারা প্রাণপনে পৃথিবীর একটি প্রশিক্ষিত ও শক্তিশালী বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছিল। গেরিলারা ২ ভাগে ভাগ হয়ে গেলো।
১৯৭১ এর সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে কিছু গেরিলা প্লাটুন বিভিন্ন অপারেশনের সময়ে আটক বেশ কিছু গেরিলা কমান্ডো কে মুক্ত করে নিয়ে আসে। গেরিলা কমান্ডারের আদেশ ছিলো যে গেরিলাদের কোন হদিস এবং পরিকল্পনা ও কর্মসূচি সংক্রান্ত কোন তথ্য যাতে কেউ জানতে না পারে। অপারেশনের সময় শত্রু বাহিনীর হতে ধরা পড়া কিছু অকুতোভয় গেরিলা হাসিমুখে মৃত্যু কে মেনে নিয়েছিলো কিন্তু কোন তথ্য প্রকাশ করেনি।
মেজর খালেদ মোশারফ কে ট্রান্সফার করা হয় গোরান-বাহিরদা থেকে নিয়ে আসা গেরিলা প্লাটুনে, যারা ঢাকার আশে পাশে রাজাকারদের উপর বেশ কয়েকটি অপারেশন চালায়। আগস্ট 1971 থেকে গেরিলারা শহরের মধ্যে তাদের আক্রমণ শানিত করে, যার ফলে পাকিস্তানিরা কি করতে হবে ভেবে না পেয়ে হতবিহব্বল হয়ে পড়ে। তারা বুঝতে পারেনা গেরিলারা কিভাবে এসে আক্রমণ করে আবার পালিয়ে যায়। ক্র্যাক প্লাটুন শহরে কিছু সফল অপারেশন সম্পন করে। তাদের মূল কাজ ছিলো পুলিশের চেকপয়েন্টে হামলা, পাওয়ার স্টেশন ও পেট্রোল পাম্প উড়িয়ে দেওয়া সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বিস্ফোরণ ঘটানো। ক্রাকপ্লাটুনের অন্যতম প্রধান একটি কাজ ছিল শহরের মানুষের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করা যাবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হয়। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দেশের বাইরে প্রচার করতে থাকে যে পূর্ব পাকিস্তানে সব কিছু স্বাভাবিক রয়েছে।
ক্রাকপ্লাটুনের আদেশককৃত অপারেশন এর মধ্যে রামপুর পাওয়ার স্টেশন উড়িয়ে দেয়া, হোটেল পূর্বানি ও ইউএসআইএস লাইব্রেরিতে বিস্ফোরণ, তাঁতারী বাজার এলাকায় রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ ও যাত্রাবাড়ীতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষ অন্যতম। শুরুদিকে ক্রাকপ্লাটুন যখন ঢাকায় আসে তখন তাদের সদস্য সংখ্যা ছিলো মাত্র ১৭ জন। কিন্তু পর্যায় ক্রমে সেই সংখ্যা ১৪০ গিয়ে পৌঁছায়। ৩০ জন ক্রাকপ্লাটুনের ৯ জন গেরিলা পাকিস্তানিদের হাতে ধরা পড়ে। এদের মধ্যে ৭ জন নিহত হয়। নিহতরা হলেন হাফিজ, জুয়েল, বদি, আজাদ, বাকি, রুমী ও আলতাফ।
ক্রাকপ্লাটুন সারা শহর কে অন্ধকারে নিমজ্জিত করে ফেলার জন্য রামপুরা পাওয়ার স্টেশন উড়িয়ে দেয়। কিন্তু তার ফলে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয় যা অর্থনীতির উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলে।
১৬ জুলাই ১৯৭১ রাত ৯ টার সময় ক্রাকপ্লাটুনের ৬ জন গেরিলা রামপুরায় অবস্থিত শহরের সবচেয়ে বড় পাওয়ার স্টেশন উড়িয়ে দেয়ার কাজ শুরু করে। তারা সাথে করে ২০ পাউণ্ড প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ, ডেটোনেটর এবং ফিউজ নিয়েছিলো। এই অল্প কয়েকজন গেরিলা খুব ভালো ভাবে অপারেশনটি সম্পন্ন করলো। পাওয়ার স্টেশনের গেটে পৌঁছে তারা বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে পুলিশ এবং গার্ডদের রাইফেল কে ফাঁকি দেয়। একই সময় একজন কমান্ডো টেলিফোন লাইন বিচ্ছিন্ন করে দেয়। তারা গার্ডের থেকে চাবি ছিনিয়ে নেয় এবং অস্ত্রের মুখে অন্য গার্ড এবং পুলিশদের রুম দেখিয়ে দিতে বাধ্য করে। তারা ১৭ জন পুলিশকে বন্দি করে এবং অপারেটরকে বাধ্য করে তাদের কে ট্রান্সফর্মার রুমে নিয়ে যেতে। ট্রান্সফরমার রুমে গেরিলারা এক্সপ্লোসিভ বসিয়ে ট্রান্সফরমার উড়িয়ে দেয়।
১৯৭১ এ নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ২ জন গেরিলা কলাবাগানে আর্মি ভ্যানের উপর এক দুঃসাহসিক অপারেশন চালায়। গেরিলা ২ জন যখন রিক্সাওয়ালার ছদ্মবেশ ধারণ করে রিক্সা নিয়ে কলাবাগান থেকে আসছিলো, তখন তারা দেখতে পেলো একটা পাকিস্তানি মিলিটারি ভ্যান তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। তারা তাড়াতাড়ি রিক্সা থেকে নেমে রিক্সায় লুকানো অস্ত্র বের করে নেয়। মিলিটারি ভ্যান তাদের কাছাকাছি আসলে গেরিলারা গুলি শুরু করে, এতে ভ্যানের ড্রাইভার বাদে সবাই মারা পড়ে।
ঢাকায় গেরিলা অপারেশন যখন তীব্র রূপ নিয়েছিল তখন সেনাবাহিনীর কার্যত রাতের বেলায় ব্যারাকের বাইরে আসতো না। গেরিলারা দিনে দুপুরে বক্সীবাজার মেডিকেল কলেজ হোস্টেল গেটে হামলা চালায় এবং ২ জন রাজাকারকে হত্যা করে।এছাড়াও নারায়ণগঞ্জ ভিক্টোরিয়া হাসপাতালের দায়িত্বে থাকা ৫ জন রাজাকারকেও গেরিলারা হত্যা করে।
হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে কর্তৃপক্ষ কঠোর নিরাপত্তা বিধান করলেও গেরিলারা সেখানে বিস্ফোরণ ঘটায়। হোটেলের হামলা করার কারণ হলো, হোটেলে অবস্থান করা বিদেশীরা যাতে বুঝতে পারে পাকিস্তানিরা দেশের অবস্থা সম্পর্কে যা বলেছে তা মিথ্যা প্রোপাগান্ডা ছাড়া আর কিছুই নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবন, এসএসসি পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে সিদ্ধেশ্বরী হাইস্কুল সহ বায়তুল মোকাররম এবং বাণিজ্যিক এলাকা মতিঝিলের বেশ কিছু স্থানেও বোমা হামলা করা হয়। বাইতুল মোকাররম এবং মতিঝিল এলাকায় করা বোমা হামলা বেশ কার্যকর হয়েছিলো। এতে সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে এবং শহর ছাড়তে শুরু করে। বিশ্ববিদ্যালয় এবং স্কুলে বোমা বিস্ফোরণের পর থেকে ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষালয়ে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। ক্রাকপ্লাটুনের গেরিলারা যাত্রাবাড়ীতে সম্মুখযুদ্ধে পাকবাহিনীর বহু সৈনিক খতম করে এবং যাত্রাবাড়ীর ব্রিজ উড়িয়ে দিয়ে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের যোগাযোগ ব্যবস্থা অচল করে দেয়।
বিজয় যত ঘনিয়ে আসে ততই গেরিলাদের অপারেশন তীব্রতর হতে শুরু করে।অক্টোবর থেকেই তারা তাদের অপারেশন বৃদ্ধি করে। একই সময়ে মানিক প্লাটুন সাভারে সক্রিয় ছিলো এবং সেখানে তারা কয়েকটা অপারেশন সম্পন্ন করে। এই প্লাটুন ওই এলাকায় নভেম্বর মাসে একটা স্কুলের বিল্ডিং এর প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে। নভেম্বর মাসে গেরিলারা রূপগঞ্জ থানা নিজেদের দখলে নেয় এবং সেখানে নিজেরদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে।
৪ ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে, ভারত গেরিলা বেষ্টিত ঢাকায় ঢাকায় ভারতীয় ফাইটার দিয়ে সব দিক থেকে আক্রমণ শুরু করে। প্রায় ৮০০০ গেরিলা সারা শহর সক্রিয় ছিল। গুল টেক্সটাইল মিলসে গেরিলারা শত্রুদের বাংকারে হামলা চালিয়ে ২৭ সৈন্যকে হত্যা করলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সেই এলাকা থেকে পিছু হটে। ১১ ডিসেম্বর ক্যাপ্টেন মালেক তার বাহিনীসহ তারাবোতে পৌঁছেন, ১৩ ডিসেম্বর মেজর হায়দার রূপগঞ্জ আসেন এবং শীতলক্ষ্যার তীরে মেজর শফিউল্ল্যাহর সাথে দেখা করেন। মেজর শফিউল্ল্যাহ “এস” ফোর্সের কমান্ডার ছিলেন। এদিকে কাদের সিদ্দীকির গেরিলা বাহিনী টাঙ্গাইল শত্রুমুক্ত করার পর ঢাকার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। কারণ ঢাকা গেরিলাদের সহায়তা ছাড়া মুক্ত হতে পারতো না। গেরিলারা পাকিস্তানিদের মনোবল ভেঙ্গে দিয়েছিলো এবং বুঝিয়ে দিয়েছিল যে তাদের পতন আসন্ন।
———————————————
(৯, ১৫.১১, ৪৯৪)
স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে রংপুরের স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহৃত কোডসমূহঃ
(রংপুর জেলার পলাশবাড়ী হতে সংগৃহীত)
পাকবাহিনী -R.F
পাঞ্জাব রেজিমেন্টে -P.R
বেলুচ রেজিমেন্ট -B.R
রাজাকার বাহিনী -R.F
লাইট মেশিনগান -LMG
ভারী মেশিনগান -HMG
মর্টার -MG
জয়পুরহাট -৩য় বাড়ী
পাঁচবিবি -২য় বাড়ী
হিলি -১ম বাড়ী
ক্যাম্প -বাড়ী
ট্রেঞ্চ -কুঠুরী
কর্নেল -বড়কর্তা
ব্রিগেডিয়ার -বড় ভাই
মেজর -মেজ ভাই
ক্যাপ্টেন -ছোট ভাই
বিহারী -NB
গোলাগুলি -রাগারাগী
DIB -টিকটিকি
পশ্চিম পাকিস্তানী -লাল ককুর
India-pak Border -বেড়া
শেষ কথা
- আমরা চাইলে প্রোফেশনাল কাউকে দিয়ে এই দলিলপত্র কম্পাইল/অনুবাদ করাতে পারতাম। কিংবা স্ক্যান করে ওসিআর-এর সাহায্যে দলিলপত্রকে ইউনিকোডে কনভার্ট পারতাম। কিন্তু আমরা সেই কাজ করবো না। আমরা চাই যে এই প্রজন্ম নিজে কম্পাইল করে/অনুবাদ করে ধীরে ধীরে শিখতে শিখতে নিজেদের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগিয়ে তুলুক। কাজ থেকেই চেতনার জন্ম, কথা থেকে নয়।
- পাঠকালে বানান কিংবা অন্য যে কোন ইস্যুতে যে কোন ভুল-ভ্রান্তি চোখে পড়লে সাথে সাথে আমাদের ফেসবুক পেইজে একটি মেসেজ দিয়ে জানাবেন। ভালো/মন্দ যে কোন ধরণের পরামর্শ অত্যন্ত আনন্দের সাথে গৃহীত হবে এবং আপনাকে অত্যন্ত দ্রুত আমাদের ফেসবুক পেজ থেকে থেকে লাইভ চ্যাটের মতো রিপ্লাই দেয়া হবে। কারণ আমাদের ফেসবুক পেজটি একই সাথে দেশ এবং বিদেশ থেকে পরিচালিত হচ্ছে। ফলে এডমিন প্যানেলের কেউ না কেউ সারাক্ষণই অনলাইনে আপনার ফিডব্যাকের অপেক্ষায় আছেন। আমাদের ফেসবুক পেজের লিংকঃ
https://www.facebook.com/muktizuddho1971।
- প্রকল্পটি নতুনদের জন্য সদা উন্মুক্ত। অর্থাৎ আপনি যদি আমাদের সাথে মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র নিয়ে কাজ করতে চান, তবে আমাদের ফেসবুক পেজে একটা মেসেজ পাঠিয়ে আপনার আগ্রহের কথা জানালেই হবে। আমরা কিছুদিন পর আপনাকে আমাদের কর্মযজ্ঞের অংশ করে নিবো। কাজ বুঝিয়ে দেবো। দল-মত-ধর্ম-বর্ণ-পরিচয় নির্বিশেষে আমাদের এই উদ্যোগ। তাই সকলের শুভকামনা আমাদের কাম্য।
- এটি কোন একক ব্যক্তি কিংবা একক গ্রুপের উপর নির্ভরশীল প্রোজেক্ট নয়। তাই স্পেসিফিক কেউ একজন থাকলে বা না থাকলে এই প্রোজেক্টের কিছুই যাবে-আসবে না। আগামীকাল আলামিন সরকার নামক আইডিটি না থাকলে কিছুই আসে-যায় না। তাঁর জায়গায় অন্য কেউ কাজ করতে থাকবেন। আমাদের ফেসবুক পেজ থেকে কাজ চলতে থাকবে। ফেসবুক পেজ কোন কারণে বন্ধ হয়ে গেলে তা আবার নতুন করে খোলা হবে। কারণ আমাদের হাতে দলিলপত্র আছে। ডেডিকেটেড লেখকেরা আছেন। তাই এই প্রোজেক্টটা থেমে যাওয়ার কোন সম্ভবনা নেই। এভাবেই প্রোজেক্টটাকে ডিজাইন করা হয়েছে। প্রকৃতি শূণ্য স্থান পছন্দ করে না। আমরাও না। আমরা প্রকৃতির অংশ। আপনিও, তাই না?
-মাউ