গৌরনদীর প্রতিরোধ
(”দৈনিক বাংলা”, ২৪ মার্চ, ১৯৭২ সালে প্রকাশিত শহীদ সেরনিয়াবাত রচিত প্রতিবেদনের অংশ)
২৫শে এপ্রিল। মিলিটারী আসছে, গৌরণদীর সর্বত্র রব উঠল। সকাল থেকে চারখানা হেলিকপ্টার বেশ উঁচু দিয়ে বার বার মাদারীপুর থেকে যে রাস্তা গৌরণদীর বুক চিরে বরিশালের দিকে চলে গেছে তার উপর দিয়ে উড়ছে। ওদিকে বরিশাল শহরের চার মাইল উত্তরে জুনাহারে প্রচণ্ড গোলা বিনিময় হচ্ছে মুক্তি বাহিনীর সাথে। কামানের গর্জন, গানবোটের শেলিং আর মর্টারের শব্দে থেকে থেকে খেপে উটছে। অপর দিকে খবর পাওয়া গেল, মাদারীপুর দুদিন পূর্বে পাকবাহিনী দখল করে নিয়েছে এবং আজকেই সড়কপথে দস্যুরা গৌরণদী হয়ে বরিশাল যাবে। কি করা যায় ভাবছে কৃষক-শ্রমিক আর রাজনৈতিক কর্মীরা মুহুর্তের মধ্যে স্থির করে নিল তারা। যে করে হোক হানাদারদের বাধা দিতে হবে। অন্তত বাধা দেওয়ার চেষ্টা করতেই হবে। বীর যোদ্ধারা জানতো, সম্মুখযুদ্ধে কয়েকটা ৩০৩ রাইফেল আর পাঁচ-দশ রাউণ্ড করে গুলি দিয়ে ভারী অস্ত্রের সামনে কিছুই করা যাবে না। তবুও সাধারণ মানুষ যাতে ভেঙ্গে না পড়ে বা ভুল না বোঝে তার জন্য চেষ্টা চালাতে হবে। তাই তারা সকাল থেকে গৌরণদীর উত্তরে কটকস্থল নামক স্থানে পজিশনে রইল। ঘন্টা কেটে যাচ্ছে তবুও শত্রুর সাথে দেখা নেই।
সকাল গড়িয়ে দুপুর। রৌদ্রের প্রখরতায় পিপাসাকাতর হয়ে পড়েছে মুক্তিযদ্ধারা। তাদের গোপন অবস্থান থেকে (সিএণ্ডবি সড়কের পাশে) কয়েহ গজের মধ্যেই সাধারণ কৃষক জহরউদ্দীন মোল্লার বাড়ী। তাই কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা পানি খাওয়ার জন্য জহর মোল্লার আঙ্গিনায় বিরাট বটগাছটার ছায়ায় বসলো। ওরা বিশ্রাম নিচ্ছে আর জহরউদ্দীন মল্লা পানি ঢেলে দিচ্ছে। যেখানে বসে মুক্তিকামী ভাইয়েরা বিশ্রাম নিচ্ছিল তার থেকে কয়েক গজ উত্তরে একটা উঁচু পুল রয়েছে। এত উঁচু যে পুলের অপর দিকে কিছুই দেখা যায় না। দুপুর গড়িয়ে বেলা তখন তিনটা। হটাৎ করে শব্দ না করে একটা এসে দাঁড়ালো অদের সামনে। পরপর আর কয়েকটা একেবারে গুনে গুনে চল্লিশটা। বর্বর সেনারা গুলি চালালো। বসা অবস্থায়ই শহীদ হলেন চারজন মুক্তিযোদ্ধা। শহিদ হল জহরউদ্দীন মোল্লা ও তার ছেলে মোবারক মোল্লা। মুক্তিবাহিনীর হাতে সেদিন খতম হল দু ‘জন খানসেনা।
সেদিন ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়া মুক্তিবাহিনী কয়েক দিনের মধ্যেই আবার একত্রিত হল। এই একত্রিত করার পেছনে যাদের অক্লান্ত প্রচেষ্টা ছিল তারা হলেন এস, এম রকিব, অধ্যাপক এনায়েত, সেন্টু ও আরও কয়েকজন। তাদের প্রচেষ্টায় ২৪টা রাইফেল ও তিনশত রাউণ্ড গুলি দিয়ে প্রথম দল গঠন করা হয়। পরে এই দল মিলিত হয় গোপালগঞ্জের হেমায়েতের সঙ্গে।
গৌরণদীর প্রতিরোধ সংগ্রামে আরও যাদের নাম অম্লান তাদের কথা কিছু লিখতেই হবে। এই দলটি সরিকলে ঘাঁটি করেছিল। এই দলটি খসরুর পার্টি নামে পরিচিত ছিল। এরা বয়েসে তরুণ এবং সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক চেতনায় অনুপ্রণিত হয়ে একটি শক্তিশালী দল হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলেছিল। এরা সাধারণত হিট এ্যাণ্ড রান করে অনেক অস্ত্র পাক সৈন্য, পুলিশ ও রাজাকারদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল। বহু দালাল এদের হাতে নিহত হয়েছে। এরা নিজ হাতে অস্ত্র তৈয়ারও করত। আজ সরিকলবাসী আলমের কথা ভোলে নি। নিজের তৈরি বোমার আঘাতেই আলম শহীদ হয়েছেন শামসু মিয়ার বাড়িতে। জনতার প্রতিরোধ শক্তিশালী,দূর্জয়। তার প্রমাণ গৌরনদীর বাকাই। বাকাইর বীর জনতা বল্লম দিয়ে মেরেছিল চার-চারটে তরতাজা পাঞ্জাবী দস্যুকে। কেড়ে নিয়েছিল চারটে চায়না রাইফেল।
সেদিন ছিল ১৪ই মে। একদল খানসেনা বাকাই গ্রামে ঢুকে পড়েছে। যেভাবে হোক তাদের রূখতেই হবে। তাই প্রস্তুত হয়ে গেল গ্রামবাসী হাতে বল্লম ও রামদা। কয়েকজন গ্রামবাসী যেখান দিয়ে খানসেনারা আসবে সেই পথের ধারে একটি গর্তের মধ্যে আত্মগোপন করে রইল। কিছুক্ষণের মধ্যেই খানসেনারা কাছে এসে গেল। মুহুর্তের মধ্যে কয়েকটি বল্লম নির্ভুল লক্ষ্যভেদ করলো। বল্লম একেবারে হানাদার চারটের বক্ষভেদ করে দিল। তারপর টুকরো টুকরো করে চড়িয়ে দিল সে মৃতদেহ চারটি। খানসেনারা ওর পর থেকে আর ঢোকেনি বাকাই গ্রামে।