<৯, ৪.৭, ২০৯-২১১>
সাটিয়াচড়ার (নাটিয়াপাড়া) যুদ্ধ
(সত্যেন সেন রচিত ‘প্রতিরোধ সংগ্রামে বাংলাদেশ’ আগষ্ট ১৯৭১, কলকাতা থেকে সংকলিত। জায়গাটির আসল নাম নাটিয়াপাড়া। ভুলক্রমে সাটিয়াচড়া নামে উল্লেখিত হয়েছে)
টাঙ্গাইল শহর তখনও মুক্ত অঞ্চল। পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্যদের বর্বর আক্রমনের বিরুদ্ধে পূর্ববঙ্গের জেলায় জেলায়, শহরে ও গ্রামাঞ্চলে প্রতিরোধ সংগ্রাম শুরু হয়ে গিয়েছে। ভারতীয় বেতার মারফত রক্ত পিপাসু পাক-সৈন্যদের হিংস্র আক্রমন আর বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষদের গৌরবময় প্রতিরোধের কাহিনী প্রচারিত হয়ে চলেছে।
হামলাকারীদের দল তখনও টাঙ্গাইল জেলায় এসে পৌছাতে পারেনি। টাঙ্গাইল শহরে মুক্তির উৎসব চলছে। রাজপথের দুধারে প্রতিটি ভবনে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে। “জয় বাংলা” সংগীতে সারা শহর মুখরিত। কিন্ত সমস্ত আনন্দ উৎসবের পিছনে আসন্ন বিপদের কালো ছায়া। শহরের মানুষ হাসতে গিয়েও প্রাণখোলা হাসি হাসতে পারে না। আকাশবাণী নিত্য নতুন দুঃসংবাদ বহন করে নিয়ে আসছে, মুক্ত শহরগুলি একের পর এক পাক-সৈন্যদর অধিকারে চলে যাচ্ছে। তারপর সেই হিংস্র জল্লাদের দল সেই সমস্ত শহরের অধিবাসীদের নির্মমভাবে হত্যা করে চলেছে। এখনো তারা ময়মনসিংহ এবং টাঙ্গাইল জেলা থেকে দূরে আছে। কিন্ত কতদিন তারা এভাবে থাকতে পারবে। দুদিন আগেই হোক আর পরেই হোক ওরা এখানে এসে হামল করবেই। সেদিন? সেদিন টাঙ্গাইলের মানুষ কেমন করে ওদের প্রতিরোধ করবে? কেমন করে নিজেদের স্বাধীনতা রক্ষা করবে?
আজ সারা বাংলাদেশের মানুষের মন স্বাধীনতার মন্ত্রে উদ্দীপ্তদ্ধ সারা প্রদেশের মানুষ কখনও এভাবে একতাবদ্ধ হয়ে ওঠেনি। টাঙ্গাইলের মানুষ-অতি সাধারণ মানুষও তাদের বাইরে নয়, তারাও তাদের সঙ্গে একতালে পা মিলিয়ে চলবার জন্য উন্মুক্ত। কিন্তু সেই সংগ্রামের প্রস্তুতি কোথায়? কোথায় অস্ত্র, কোথায় চালনার শিক্ষা ব্যবস্থা ? কামান বন্দুকের বিরুদ্ধে তো আরা লাঠি-সোঁটা বা বর্শা বল্লম নিয়ে যুদ্ধ করা যায় না। প্রতিরোধের দায়িত্ব সামনে আসতেই এই প্রশ্নটা সবাইকে ভাবিয়ে তুলছে।
তবু তাদের যেটুকু সম্বল তাই নিয়ে তারা প্রতিরোধের জন্য তৈরী হচ্ছে। তাদের সামনের সারিতে আছে কিছু সংখ্যক ইপিআর বাহিনীর যোদ্ধা। স্থানীয় ছাত্র ও যুবকেরা তাদের কাছ থেকে রাইফেল চালানোর ট্রেনিং নিচ্ছে। অস্ত্রশস্ত্র বলতে ইপিআর বাহিনীর সৈন্যদের হাতে কিছু রাইফেল আছে। আর আছে গুটি কয়েক পুরানো ধরনের মেশিনগান। এই নিয়েই তারা আধুনিক মরণাস্ত্রে সুসজ্জিত, সুশিক্ষিত পাক-সৈন্যদের সাথে লড়াই করবে। এই দুই অসম শক্তি-সংঘর্ষের পরিণতি কি হতে পারে, সেটা কি তারা অনুমান করতে পারে না? পারে বই কি। কিন্তু তার পরিণতি যাই হোক না কেন, প্রতিরোধ তারা তাদের মাতৃভূমিকে শত্রুর হাতে তুলে দিতে পারবে না। সারা বাংলাদেশ জুড়ে যে প্রতিরোধের সংগ্রাম চলছে তারাও সঙ্গে সামিল থাকবে।
অবশেষে সেই আশঙ্কা একদিন সত্যসত্যই প্রত্যক্ষ সত্য হয়ে দেখা দিল। নিছক জনরব নয়, প্রত্যক্ষদর্শীদের মুখে শোনা গেল পাক সৈন্যদের ট্রাকের পর ট্রাক বোঝাই করে টাঙ্গাইলের দিকে এগিয়ে আসছে। ঢাকা টাঙ্গাইল সড়কের দু’ধারে গ্রামগুলি তাদের হামলার ফলে বিপন্ন ও ব্যতিব্যস্ত। পাকসৈন্যরা এই সমস্ত গ্রামের নিরীহ অধিবাসীদের ঘরে ঘরে গিয়ে হানা দিচ্ছে, তাদের গরু বাছুর কেড়ে নিয়ে এসে নিজেদের ভোজের উৎসব চালাচ্ছে। খাদ্যশস্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র লুটপাট করে নিয়ে আসছে। ঘরের মেয়েরাও তাদের লুণ্ঠনরত হাত থেকে অব্যহতি পাচ্ছে না।
গ্রামের মানুষ প্রাণের ভয়ে আর মান-ইজ্জতের ভয়ে যে যেদিকে পারে পালাচ্ছে।
এইভাবে মানুষ নামধারী, এই হিংস্র পশুগুলি বিভীষিকা ছড়াতে চলে আসছে। ওরা ওদের রক্তাক্ত থাবা উদ্যত করে ছুটে আসছে টাঙ্গাইলের দিকে। টাঙ্গাইলের মানুষ হুঁশিয়ার। দেশপ্রেমিক সন্তানগন, শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধের জন্য তৈরী হও-সংগ্রাম পরিষদের প্রচার-ভ্যান ঘুরে ঘুরে মাইকযোগে উদ্দীপনাময়ী বাণী ছড়াতে লাগলো। আক্রমণকারী পাক-সৈন্যবাহিনী প্রথম বাধা পেল সাটিয়াচড়া গ্রামে।
ইপিআর বাহিনীর সৈন্যরা পাঁচটি ট্রেঞ্চ কেটে তার মধ্যে আশ্রয় নিয়েছিল। পথের দু’ধারে ঝোপঝাড়ের আড়ালে রাইফেলধারী ছাত্র ও যুবকেরা পজিশন নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। পাকসৈন্যরা এর আভাসটুকু পায়নি। তারা নিশ্চিন্ত মনে এগিয়ে আসছিল। এখানে যে কোন ভয়ের কারণ আছে তা তারা ভাবতেও পারেনি। হঠাৎ তাদের চমকে দিয়ে কতগুলি মেশিনগান ও রাইফেল গর্জে উঠল। বৃষ্টির মতো ঝাঁকে ঝাঁকে গুলির ঘায়ে অপ্রস্তুত পাক-সৈন্যরা ধরাশায়ী হয়ে পড়তে লাগল। নির্জন ও শান্ত পল্লীপথ এক মূহূর্তে রক্তাক্ত রণক্ষেত্রে পরিণত হয়ে গেল।
প্রতিরোধকারী দেশভক্তরা বিপুলসংখ্যক শত্রু সৈন্যর বিরুদ্ধে একটানা লড়াই করে চলেছে। বেশ কিছুকাল এই লড়াই চলেছিল।
হামলাকারী পাক-সৈন্যরা মুক্তিযোদ্ধদের কাছ থেকে কঠিন প্রতিরোধ পেয়ে একটু পেছনে হটে গেল। ইতিমধ্যেই তাদের শক্তি বৃদ্ধি করার পেছনে থেকে আরও অনেক সৈন্য এসে পৌঁছে গেছে। এবার কামান-মর্টারের সজ্জিত ছাব্বিশটি ট্রাক-বোঝাই সৈন্য সামনে এগিয়ে এল। মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে লক্ষ্য করে তারা অবিরল ধারায় গোলাবর্ষণ করে চলল। তারা ভাবতেও পারেনি যে, মাত্র তেইশ জন ইপিআর এর যোদ্ধা ট্রেঞ্চের ভিতর থেকে তাদেরকে প্রতিরোধ করে চলেছে। তাদের সম্বল ছিল মাত্র দুটো হালকা মেশিনগান, আর কিছু রাইফেল। তাই দিয়েই তারা কামান মর্টারের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচিছলো।
জীবন পণ করে তারা শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করেছিল। কিন্তু এই প্রবল গুলিবর্ষনের মুখে এরা তাদের কতক্ষণ ঠেকিয়ে রাখবে। প্রতিরোধ যখন চুরমার হয়ে ভেঙ্গে গেল, তখন ট্রেঞ্চের এই তেইশজন যোদ্ধার মধ্যে একুশজন নিহত হয়েছে। কোথায় ছিল এদের বাড়ীঘর কে জানে। কোথায় ছিল এদের বাপ-মা, ভাই-বোন, স্ত্রী আর ছেলেমেয়েরা! এরা কোথায় কিভাবে প্রাণ দিল, সেই বীরত্বপূর্ণ কাহিনী কোন দিন এদের কাছে পৌঁছাবে কিনা, তাই বা কে জানে!
লড়াই থেমে গেছে। এদের কামানগুলি কিন্তু তখনও গোলাবর্ষণ করেই চলেছে। এবার এদের আক্রমনের লক্ষ্য সাটিয়াচড়া, গোড়াই আর তার আশেপাশের গ্রামগুলি। তাদের রকেটের আগুনে সেইসব গ্রামের ঘরবাড়ি পুরে ছাই হতে লাগলো। এরপর গোলাবর্ষণ থামিয়ে ওরা ঘরে ঘরে চড়াও হয়ে হত্যালীলা চালিয়ে যেতে লাগল। সামনে যাদের পেল তাদের কাউকে রেহাই দিল না। তাদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য গ্রামের লোকেরা যে যেদিকে পারল প্রাণ নিয়ে ছুটে পালাল।
সাটিয়াচড় গ্রামটি আমার কাছে অপরিচিত নয়। এই গ্রামেই আমার সহকর্মী ও বন্ধু বাকী সাহেবের (কৃষক নেতা খন্দকার আবদুল বাকী) বাড়ী। এই সাটিয়াচড়ে যাঁরা সেদিন পাকসৈন্যদের আক্রমনের বিরুদ্ধে এই প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল বাকী সাহেব তাদের অন্যতম। হামলাকারীরা বাকী সাহেবের বাড়িতে ঢুকে তাঁর আশি বছর বয়সের বৃদ্ধ পিতাকে বন্দুকের কুঁদা দিয়ে এমন আঘাত করল যে, তিনি জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন।
বাড়িতে আর যারা ছিল, এরা তাদের সবাইকে হত্যা করল।