<৯, ১৬.২, ৪৫১-৪৫৯>
কাদের বাহিনীর গঠন ও যুদ্ধ তৎপরতা-২
কাদের বাহিনী সাড়ে তিনশো লড়াই-এ অংশ নিয়েছে
(কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে বিশেষ সাক্ষাৎকারের উপর ভিত্তি করে রচিত প্রতিবেদন থেকে সংকলিত। প্রতিবেদনটি দৈনিক বাংলা ৮-১৩ ই ডিসেম্বর ১৯৭২ সালে বিভিন্ন শিরোনামে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিলো। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছিলেন হেদায়েত হোসাইন মোরশেদ)
কাদের বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা সংখ্যা ছিল ১৭ হাজার। এদের সহায়ক স্বেচ্ছাসেবকদের সংখ্যা ছিল ৭২ হাজারেরও বেশী। একটি সেনাবাহিনীরমতো সুশৃঙ্খল প্রশাসন ব্যবস্থা। সমগ্র টাঙ্গাইল জেলা এবং ঢাকা, ময়মনসিংহ ও পাবনার কিছু অংশ ছিল কর্মক্ষেত্র, ৫টি সেক্টরে বিভক্ত ছিল সমগ্র এলাকা। মুক্তিযোদ্ধারা বিভক্ত ছিল ৯৭ কোম্পানীতে। ৫টি সেক্টরে ছিল পাঁচটি সদর দফতর। কোম্পানীগুলোরও ছিল পৃথক সদর দফতর। এসব সদর দফতর ছিল ভ্রাম্যমাণ। এছাড়া সবার ছিল একটি উর্ধ্বতন স্থায়ী সদর দফতর যেখানে হানাদার পাকিস্তানীরা কোনদিনই পা ফেলতে পারেনি। মুক্তিযোদ্ধাদের বাহিনীতে ছিল সিগন্যালার- হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসের পাতায় যুদ্ধ বর্ণনায় যে ধরনের সিগন্যালার বা খবর সরবরাহকারীর সন্ধান মেলে তেমনি। আবার এর সাথে সাথে ছিল বেতার যোগাযোগ ব্যবস্থা।
এই বাহিনীর কোন যোদ্ধা অধিকৃত বাংলাদেশের বাইরের কোন জায়গা থেকে ট্রেনিং নিয়ে আসেনি। অধিকৃত এলাকাতেই তারা পেয়েছেন প্রশিক্ষণ, আঘাত হেনেছেন শত্রুর উপরে, ধ্বংস করেছেন শত্রুর হানাদারদের আর একের পর এক মুক্ত করেছেন অধিকৃত অঞ্চল। মুক্ত এলাকায় চালু করেছেন বেসামরিক শাসন ব্যবস্থা ১৬ই ডিসেম্বরের অনেক আগেই। একটি সেনাবাহিনীতে যে সব উপকরণ থাকা প্রয়োজন তার প্রায় সব কিছুই এদের ছিল। হাসপাতাল ছিল, যোদ্ধাদের উদ্দীপনা জাগানোর জন্য ছিল সাংস্কৃতিক দল। রণাঙ্গন নামে একটি সাপ্তাহিক মুখপত্র তারা প্রকাশ করতেন। ছিল সুষ্ঠ গণসংযোগ ব্যবস্থা। আরেকটি কথা- শুধু বিমান ছাড়া একটি সশস্ত্র বাহিনীর যে সব অস্ত্র ও গোলাবারুদ থাকা প্রয়োজন পরিমাণে সামান্য হলেও তার অনেকগুলোই তাদের কাছে ছিল। শত্রুর কাছ থেকে ছিনিয়ে তারা এসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ করেছিলেন। ব্যাপক সম্মুখসমর, খণ্ড যুদ্ধ ও ছোটখাটো সংঘর্ষ সহ বাহিনীর মোট লড়াইয়ের সংখ্যা সাড়ে তিনশোরও বেশী। তাদের হাতে নিহত হয়েছে সহস্রাধিক খানসেনা ও রাজাকার। আর এই বাহিনীর শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা হলো একত্রিশ জন।
তাদের নিজস্ব যুদ্ধপদ্ধতি ও কৌশল ছিল, গেরিলা যুদ্ধ তারা করেছেন। ঝাঁপিয়ে পড়েছেন অনেক সম্মুখ সমরে। গেরিলা পদ্ধতির যুদ্ধের একটি রীতি হলো ‘হিট অ্যাণ্ড রান’ অর্থাৎ আঘাত হেনে পালিয়ে যাও। কিন্তু এই বাহিনী গেরিলা যুদ্ধে একটি নবতর রীতি সংযোজন করেছিল। তা হলো ‘সাডেন হিট, ষ্টে অ্যাণ্ড অ্যাডভান্স’ অতর্কিতে এসে আঘাত হানো, অবস্থান করো ও এগিয়ে যাও।
বাহিনীর নাম কাদের বাহিনী আর অধীনায়কের নাম কাদের সিদ্দিকী। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে এই বাহিনী আর অধিনায়কের নাম চিরদিন ভাস্বর হয়ে থাকবে। কাদের বাহিনীর নাম শুনলে হানাদার পাকিস্তানী ও তাদের সহযোগীদের বুকের পাঁজরে ত্রাসের কাঁপন জাগতো। আর কাদের সিদ্দিকী রূপকথার নায়কের মত একটি নাম, অধিকৃত বাংলাদেশ একটি অঞ্চলের মুক্তিপাগল বাঙালির কাছে যে নাম ছিল আস্থা, প্রত্যয়, সাহস, সংগ্রাম ও বিজয়ের বরাভয় আর হানাদারদের কাছে ছিল ভীতি আর বিলুপ্তির পরোয়ানা।
…… দলগত বা বাহিনীগতভাবে ‘কাদের বাহিনী’ প্রথম যুদ্ধ সংগটিত হয় একাত্তর সালের ২২ শে মে চারানে। এই সংঘর্ষ চল্লিশ মিনিট স্থায়ী হয়েছিল। যুদ্ধে ১৫ জন খান সেনা নিহত হয়। আহত হয় আরো বেশী। মুক্তিযোদ্ধারা কেউ হতাহত হয়নি। দুজন গ্রামবাসী শহীদ হন। এরপর থেকে চলেছে খান সেনাদের উপরে অব্যাহত আক্রমণ। খান সেনাদের অস্ত্রবাহী জাহাজের উপর হামলা চালিয়ে এক কিস্তিতেই দখল করেছে একুশ কোটি টাকার গোলাবারুদ। ২৩ ঘণ্টা সময়ের মধ্যে টাঙ্গাইল থেকে কড্ডা পর্যন্ত রাস্তায় ১৭টি গুরুতবপূর্ণ সেতু ধ্বংস করেছে তারা। একাত্তরের নভেম্বর নাগাদ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ থানা মুক্ত করেন তারা এবং অমনি কয়েকশ অপারেশন। ১২ই ডিসেম্বর মুক্ত হয় টাঙ্গাইল। মেজর জেনারেল নাগরা, ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার ও ব্রিগেডিয়ার সানত সিং- এর ভারতীয় বাহিনীর সাথে সম্মিলিতভাবে কাদের বাহিনী অগ্রাভিযান করে ১২ই ডিসেম্বর পরবর্তী কয়েকটি দিন। ১৬ ডিসেম্বর মেজর জেনারেল নাগরার বাহিনী যখন সবার আগে ঢাকা প্রবেশ করে তখন তাঁর সাথে ছিল কাদের বাহিনী ও কাদের সিদ্দিকী।
বাঘা সিদ্দিকীর সাথে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে আমি মিলিত হয়েছিলাম। আমার টেপ রেকর্ডারে তিনি একনাগাড়ে প্রায় আড়াই ঘণ্টা তাঁর বক্তব্য রাখেন। ২৫শে মার্চের পরবর্তী পর্যায়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ ও বাহিনী সংগঠন থেকে শুরু করে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন ঘটনা ও বিষয়ের কথা বলেন।
কাদের সিদ্দিকী বলেন যে, কোন বাহিনী গঠনের মানসিকতা নিয়ে অন্তত প্রথম অবস্থায় তিনি যুদ্ধে নামেননি। তিনি বললেন, যখন ২৫শে মার্চ ইয়াহিয়া আমাদের উপর তার বাহিনী নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে তখন আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। আমি আগে ভাবতাম কোন কিছুর সমাধান হিংসাত্মক উপায়ে হয় না। ২৩শে মার্চ আমরা অধিকার আদায়ের শপথ নিলাম। এবং সেদিন প্রথম সবক নিলাম প্রয়োজন হলে অস্ত্রের মাধ্যমেও রাজনীতি করতে হতে পারে। ২৫শে মার্চের পর টাঙ্গাইলে সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। সেখানে আমার কোন যোগ্যতা নেই। তার জন্য কোন দায়িত্ব না পেলেও নিজে একজন কর্মী হিসাবে থাকার চেষ্টা করলাম। আমি আগে থেকেই জানতাম রাজনীতির মঞ্চের নেতৃত্ব আর যুদ্ধের নেতৃত্ব এক জিনিস নয়।
৩রা এপ্রিল, ১৯৭১ সাল। হানাদার পাক বাহিনী এগিয়ে এলো টাঙ্গাইলের পথে। তাদেরকে সাটিয়াচড়ায় বাধা দেয়া হয়, বললেন কাদের সিদ্দিকী। সেই যুদ্ধ প্রাক্তন ইপিআর’রাই করেছিল। মাত্র ২ প্লাটুন ইপিআর সেদিন বাধা দেয় হানাদার খান সেনাদের একটি ব্যাটালিয়নকে। যুদ্ধে আমাদের হার হয়। ভাবলাম পাহাড়ে পালিয়ে চলে যাবো। কিন্তু দেশ ছেড়ে যাবো না। যা হয় দেশেই হবে।
\ শত্রুর মোকাবিলা করেই কাদের বাহিনী যুদ্ধ শিখছে \
১৯শে এপ্রিল। ময়মনসিংহের পথে রওনা হয় পাকবাহিনী। পথে কালিহাতিতে তাদের বাধা দেয়া হয়। নেতৃত্ব ছিল ইপিআর-এর। কাদের সিদ্দিকীও এদের সঙ্গে অংশগ্রহণ করেন। শত্রুপক্ষের মেজর কামাল সহ বহু খান সেনা এই যুদ্ধে হতাহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা ডিফেন্স উঠিয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এদিকে গ্রাম-গ্রামান্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন কাদের সিদ্দিকী। সঙ্গে রয়েছেন কয়েকজন মুক্তিপাগল যুবক। কাদের সিদ্দিকী বলছিলেন, আমার আয়ত্তে কুড়ি পচিঁশটি বন্দুক ছিল। এগুলো নিয়ে পাহাড়ে চলে গেলাম। লুকিয়ে রাখলাম। কয়েকদিন পর শুনতে পেলাম কাদের সিদ্দিকীর মাথা কেউ এনে দিতে পারে তাকে লাখ টাকা পুরুস্কার দেয়া হবে। ভয় পেলাম প্রথমে। আমাদের দেশে হাজার টাকার জন্য মানুষ মানুষকে খুন করে। আমাকে তো ধরিয়েও দিতে পারে। অনেকগুলো যুবক ও তরুণ আমার সাথে গিয়েছিল। তাদের কয়েকজনকে ফিরিয়ে দিলাম। আমি তখন কিছুটা ফ্রাস্ট্রেটেড। আমি পারবো কিনা সন্দেহ ঢুকছে মনে। আমি যে যুদ্ধের নেতৃত্ব দিতে পারবো তা তখন আমার জানা নেই। সহগামী বন্ধুদের বললাম, তোমরা চলে যাও। তোমরা এখনো দোষী সাব্যস্ত হয়নি। আমি মনস্থির করলাম এমনিভাবে পালিয়ে থাকবো। যদি কোনদিন সুযোগ পাই এবং একজন পাকসেনাকেও হত্যা করতে পারি তাহলে মনে সান্ত্বনা পাবো তবু তো একটাকে মারলাম।
কাদের সিদ্দিকী বললেন, কিন্তু পরে দেখলাম আমাকে জঙ্গলে কাটাতে হলো না। মুক্তি পাওয়ার জন্য মানুষ পাগল। সংগ্রামের জন্য তাদের দারুণ আগ্রহ। লাখ টাকার বিনিময়েও তারা ধরিয়ে দিতে রাজী নয়। এভাবে কয়েকদিন কেটে গেলো। বিভিন্ন জায়গা থেকে ছেলেরা এসে আমাকে জিজ্ঞাসা করে, কাদের ভাই, কোথায় ট্রেনিং হচ্ছে? আপনি কোথায় ট্রেনিং দিচ্ছেন, বলুন। বুকে অনেক ভরসা পেলাম। রিক্রুট শুরু করলাম। ৬ই মে নাগাদ আমার দলের লোকসংখ্যা দাঁড়ালো ৪০০ জন। ১৪ই মে বাহেরাতৈলে পবিত্র কোরআন হাতে নিয়ে আমার জোয়ানদের শপথ করালাম যতদিন বাংলাদেশ স্বাধীন না হবে, বঙ্গবন্ধু ফেরত না আসবেন, ততদিন আমাদের যেই জীবিত থাকি যুদ্ধ করবো। সেই থেকে আমাদের সুপরিকল্পিত যুদ্ধ শুরু হলো।
কাদের সিদ্দিকী বললেন, অক্টোবর মাস পর্যন্ত আমি চেষ্টা করেছি আমাকে ছায়া দেয়ার মতো এবং নেতৃত্ব দেয়ার মতো কাউকে যদি পেতাম। আমরা তার হুকুম মেনে কাজ করতাম। অনেকে এসেই আমার সাথে যোগদান করেছে। প্রথমে ভেবেছি এই বোধ হয় কোন নেতা পাবো। কিন্তু পরে দেখেছি তারা আমাকে নেতৃত্ব দেয়ার চেষ্টা করেননি বরং আমার কাছ থেকে নেতৃত্ব আদায়ের চেষ্টা করেছে। তাদের জোরেই আমি নেতা হয়েছিলাম।
কাদের সিদ্দিকী বলেন, কাদের বাহিনী নাম আমি দিইনি। স্বাধীন বাংলা বেতার থেকেই প্রথম আমাদের যুদ্ধকে কাদেরিয়া মার বলে বর্ণনা করে। আমার বাহিনীর নাম দেয় কাদের বাহিনী। পরে আমার ছেলেরাও এই নাম গ্রহণ করে। বঙ্গবন্ধুও পাকিস্তানি কারাগার থেকে বেরিয়ে এসে আমাদেরকে কাদের বাহিনী নামে অভিহিত করেন। কিন্তু আমি আগেও ভাবতাম এবং আজো ভাবি স্বাধীনতার জন্যে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। আমরা মুক্তিবাহিনী। মুক্তিযোদ্ধা।
৩রা জুন কাদের বাহিনীর সাথে সংঘর্ষ হয় গোপালপুর, মধুপুর ও টাঙ্গাইল থানার সম্মিলিত পুলিশ বাহিনীর সাথে। খণ্ডযুদ্ধ হয় বইলামপুরে। হেরে পুলিশ বাহিনী পালিয়ে যায়। সাতজন পুলিশ কাদের বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়। ১২ই জুন হলো বল্লার যুদ্ধ। পাঁচ ঘণ্টা চলে এই যুদ্ধ। কাদের সিদ্দিকীর ভাষায় জনগণের মনোবল বৃদ্ধির জন্য প্রথম পর্যায়ের এই যুদ্ধ অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে আমাদের কাছে আবির্ভূত হয়েছিল। দল সংগঠনের পর খানসেনাদের সাথে এটা ছিল আমাদের প্রথম সম্মুখযুদ্ধ। আমরা ছিলাম প্রায় ১৫০জন। কিন্তু পজিশন নিয়েছিলাম কৌশলগত কারণে মাত্র ১৩ জন। সেই যুদ্ধে ১৬ জন পাকসেনা নিহত হয়। আহত কত হয়েছিল বলতে পারবো না। যুদ্ধে ওরা হেরে গিয়ে পিছিয়ে গেলো। কিন্তু লাশগুলো নিয়ে যাওয়ার জন্য তারা তখনো গুলি চালিয়ে একটি কভার সৃষ্টির চেষ্টা করেছিল। আমি তখন ভাবছি, খান সেনাদের অন্তত কয়েকটি লাশ আমাদের নিয়ে যেতেই হবে। তাহলে মানুষ বিশ্বাস করবে যে আমরাও লড়তে পারবো। আপ্রাণ চেষ্টা করে পাঁচটি লাশ নিয়ে এলাম। একটি লাইট মেশিন গানসহ ৯টি রাইফেলও হস্তগত করলাম। কিন্তু সেদিন মেশিনগান রাইফেলের চেয়েও বড় কাজে এসেছিল ওই লাশগুলো। পাঁচটি লাশ দেখার জন্য কুড়ি হাজারের মতো লোক জমায়েত হয়েছিল। এমন কোন লোক ছিল না যে লাশগুলোকে সেদিন ঘৃণাভরে লাত্থি মারেনি। পরে লাশগুলোকে আমরা নদীতে ভাসিয়ে দিই। এরপর জনগণের মনে এক অদ্ভুত উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়েছিল।
আগষ্ট মাসে কাদের সিদ্দিকীর হাতে গুলি লাগে। টাঙ্গাইল থেকে ১২৮ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে তিন দিনে তিনি সীমান্তের ওপারে গিয়ে পৌঁছেন। ২৩শে আগষ্ট তিনি চলে যান। বাংলাদেশে আবার ফিরে আসেন ১৩ই সেপ্টেম্বর। ভারত অবস্থানকালীন অভিজ্ঞতা সম্পর্কে কাদের সিদ্দিকী বলেন যে, ‘ভারতীয় বাহিনী আমার সাথে খুব ভাল ব্যবহার করেছে। আমার যদ্দুর জ্ঞানবুদ্ধি আছে তাতে মনে করি ভারতীয় বাহিনীর লোকেরা খুব ভালো করেই অনুভব করেছে যে আমাদের স্বাধীন করা উচিত’।
কাদের বাহিনীর সংগঠন গত ব্যাপারে কয়েকটি প্রশ্নও আমি কাদের সিদ্দিকীর কাছে রেখেছিলাম। তিনি জানান, মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়ক হিসাবে ছিল স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। প্রত্যেক ইউনিয়ন, গ্রাম এবং ওয়ার্ডে এই বাহিনী ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা জনগণের সাথে সরাসরি যোগাযোগ রাখতো না। মুক্তিফৌজ কোথাও অপারেশনে গেলে বা ঘাঁটি গেড়ে অবস্থান করলে তাদের খবরদারির ভার থাকতো স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর হাতে। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যেও কয়েকটি দল ছিল। এগুলো হলো হেলথ কোর, যোগাযোগ দল ও যুদ্ধের দায়িত্ব প্রাপ্ত যোদ্ধাদল। এই শেষোক্ত শ্রেণীই ছিল সর্বাধিক সম্মানের অধিকারী। যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের জন্য কোন ক্ষেত্রের অভাব ছিল না। যুদ্ধক্ষেত্রেই তারা প্রশিক্ষন পেয়েছে। বিশেষ কোন ট্রেনিং দিয়ে তাদের যুদ্ধ শেখাতে হয়নি। শত্রুর মোকাবেলা করেই তারা যুদ্ধ শিখেছে। টাঙ্গাইল জেলায় কাদের বাহিনী তাদের তৎপরতা সর্বাধিক কেন্দ্রিভূত করেছিল। পাঁচটি সেক্টরে জেলাটি বিভক্ত ছিল। কোম্পানী ছিল ৯৭ টি। সেক্টরের অধিনায়ক হিসাবে কাউকে কখনো বিশেষ দায়িত্ব দেয়া হয়নি। একজন সিনিয়র কোম্পানী কমান্ডারের উপর তার নিজস্ব কোম্পানী ছাড়াও সেক্টরের দায়িত্ব দেয়া হতো।
বাহিনীর ঊর্ধ্বতন সদর দফতর ‘মহানন্দপুরে’ অবস্থিত ছিল। বাহিনীর একজন প্রশাসনিক প্রধান ছিলেন। একাত্তর সালের জুলাই মাস থেকে বাংলাদেশে সরকারের অনুমতিক্রমে কাদের বাহিনী জনগণের দৈনন্দিন জীবনের সকল দুঃখ-দুর্দশা মোচনের জন্য সামগ্রিক ব্যবস্থা গ্রহণ শুরু করেন।
কাদের বাহিনীর একটি সিকিউরিটি বা ইনটেলিজেন্স বিভাগ এবং সাথে সাথে কাউন্টার ইনটেলিজেন্স ব্যবস্থা চালু ছিল। বাহিনীর লোকজন সম্পর্কে খবরাখবর সংগ্রহ করে রিপোর্ট করা ছিল এদের কাজ। মুক্তিযোদ্ধাদের গতিবিধি ছিল কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত। কাদের বাহিনীর সিগন্যাল বা কুরিয়ার সার্ভিসের ব্যবস্থা ছিল অদ্ভুত। সর্বক্ষন বিভিন্ন এলাকায় রুটিনমাফিক সিগন্যালম্যানের কাছে দ্রুত দৌড়ে দিয়ে খবর পৌঁছে দিতো। সে পৌঁছে দিতো পরের পয়েন্টে। এমনি করে করা হতো খবর এবং তা সব সময়ই (বিশেষ করে যা জরুরী গোপন আশু নির্দেশ) থাকতো লিখিত। বিভিন্ন পয়েন্টের সিগন্যালম্যানের নাম তাতে স্বাক্ষরিত থাকতো। কাদের সিদ্দিকী জানান যে, এভাবে ১০ মাইল দুরবর্তী কোন স্থানে খবর পাঠাতে তাদের সময় লাগতো বড়জোর ২৫ মিনিট। নভেম্বর মাস থেকে কাদের বাহিনীর শক্তিসম্পন্ন বেতার ব্যবস্থা চালু করে।
\ যুদ্ধে কখনো হারি নি-কিন্তু নাগপুরের কোন যুদ্ধে আমি জিতিনিঃ
কাদের সিদ্দিকী \
কাদের বাহিনীর মোট লড়াইয়ের সংখ্যা তিনশরও বেশী। প্রত্যেকটি যুদ্ধ হামলা কিংবা স্যাবোটাজ অপারেশনই ছিল কোন না কোন দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। তবুও এর মধ্যে কয়েকটি লড়াই-এর স্মৃতি মনে দাগ কেটে রয়েছে। সে কথাই বলছিলেন কাদের সিদ্দিকী। ১১ই আগষ্ট কমান্ডার হাবিবের নেতৃত্বে কাদের বাহিনী একটি দল ভূয়াপুরের কাছে মাটিকাটায় ধলেশ্বরীতে পাকবাহিনীর অস্ত্রবাহী জাহাজের ওপর হামলা চালাল। জাহাজটির নাম আর এস ইউ ইঞ্জিনিয়ার্স, এলসি-৩। ঢাকা থেকে রংপুরের সেনানিবাসে যাচ্ছিল ২১ কোটি টাকার অস্ত্র নিয়ে। সঙ্গে আরও কয়েকটি জাহাজ ছিল। কিন্তু কাদের বাহিনীর যোদ্ধারা সিরাজকান্দির উত্তরে মাটিকাটা চরে নদী তীরবর্তী দুটি বাড়ি থেকে ষ্টেনগান, এলএমজি আর মর্টার দিয়ে হামলা চালিয়েছিল সঠিক লক্ষ্যবস্তুর উপর। ঘায়েল হলো জাহাজ, কুপোকাত হলো জাহাজের অধিনায়ক আমানুল্লাহ খান, খতম হলো শতাধিক খান সেনা। কাদের বাহিনী ছিনিয়ে নিল ২১ কোটির অস্ত্র ও গোলাবারুদ যার মধ্যে ছিল ১২০ এম এম ২ ইঞ্চি ও ৩ ইঞ্চি মর্টার, ৮৩ এম এম ক্যালেন্ডার সাইজ ভারী কামান ও প্রচুর রাইফেল। এরপর পাক বাহিনী প্রচণ্ড আক্রোশে পাল্টা হামলা চালিয়েছিল। দুটো এফ-৮৬ স্যাবর জেট তাদেরকে কভার দিতে এগিয়ে এসেছে। কিন্তু কিছুই হয়নি। ২১ কোটি টাকার অস্ত্র কাদের বাহিনী তাদের সদর নিয়ে চলে গেল। এই যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে কাদের সিদ্দিকীও মাটিকাটায় ছিলেন।
ব্যাক্তিগতভাবে যে সব যুদ্ধ করেছেন তার মধ্যে মনে দাগ কাটার মতো কয়েকটি যুদ্ধের কথা কাদের সিদ্দিকী বললেন। একটি যুদ্ধ হল আগষ্টে ধলাপাড়ার যুদ্ধ। এই যুদ্ধে কাদের সিদ্দিকী আহত হন। ২০শে নভেম্বর আড়াই হাজার পাকসেনা অর্থ্যাৎ পুরো একটি বিগ্রেডকে ঢাকা-টাঙ্গাইল রোড থেকে হটিয়ে দিয়ে করটিয়া পর্যন্ত এলাকা কব্জায় রেখে ২৩ ঘণ্টায় ১৭টি সেতু ধ্বংস করে দেয় কাদের বাহিনী। পাক বাহিনী পাল্টা বিমান আক্রমণ চালায় কাদের সিদ্দিকী জানান, এত সামনাসামনি যুদ্ধ এর আগে আমি কোন দিন করিনি। ওরা একবার এগিয়ে আসছে, আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি। আবার আমরা এগিয়ে যাচ্ছি ওরা পিছু হটছে। এভাবে পাঁচ ঘণ্টা যুদ্ধ চলার পর পাক সেনারা হেরে যায়। কাদের বাহিনী পাকসেনাদের কয়েক মাইল পিছু হটিয়ে দিয়ে আসে।
কাদের সিদ্দিকীর ব্যাক্তিগত অংশগ্রহ্ন-সমৃদ্ধ যুদ্ধের মধ্যে সবচেয়ে ধকল গেছে নাগপুরের যুদ্ধে। কাদের সিদ্দিকী আমাকে বললেন, আমার জন্য টাঙ্গাইল জেলায় একটি দুর্ভাগ্যজনক থানা ছিল নাগরপুর। আমি জীবনে কোন যুদ্ধেই হারিনি। কিন্তু নাগরপুর থানার কোন যুদ্ধেই জিতিনি। ১৭ই অক্টোবর আমি নাগরপুর অভিযান করেছিলাম। সেদিন আমার মারা যাওয়ার মত অবস্থা। কোন রকমে বেঁচে যাই। তারপরও আমি অভিযান চালাই। সেখানেও আমি হেরে যাই। ৩০শে নভেম্বর বেলা প্রায় সাড়ে ১২টায় নাগরপুর থানা দফতরের উপর হামলা করি। আমাদের মনে ছিল প্রচণ্ড উৎসাহ। নাগরপুর থানায় ৬৫ জন সৈন্য রয়েছে-তাও মিলিশিয়া। আর আমাদের হল ২৫০ জন যোদ্ধা। ভাবলাম, আজ হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে থানায় উঠবো। কিন্তু পারলাম না। ২টা তিন ইঞ্চি মর্টার, ২টা আড়াই ইঞ্চি মর্টার, ৭/৮টি ২ ইঞ্চি মর্টার, ৪টা গ্রেনেড নিক্ষেপকারী রাইফেল আমাদের সাথে। এ ছাড়া রয়েছে ১৯টি লাইট মেশিনগান। জীবনে এত এলএমজি আর কোথাও ব্যবহার করিনি। এছাড়া স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ছাড়া কোন সিংগলশট অস্ত্রও আমরা ব্যবহার করিনি। কিন্তু থানাটির অবস্থান ছিল ভারী বিদঘুটে। সম্মুখে ফাঁকা জায়গা। কভার নেয়ার মতো কোন স্থান নেই। ফলে এগোনো যায় না। আর শত্রুরা মরিচা থেকে ফায়ার করছে। আমি ১৫৮ রাউণ্ড ৩ ইঞ্চি মর্টারের গোলাবর্ষন করি। কিন্তু একটি গোলাও থানার ওপরে ফেলতে পারলাম না। আমি এমন ব্যর্থ আর কোথাও হয়নি। একশ গজ দূর থেকে ৫৪ রাউণ্ড দুই ইঞ্চি মর্টারের ফায়ারও করেছি। কিন্তু একটাও লক্ষ্যস্থলে পড়েনি। ২রা ডিসেম্বর পর্যন্ত হামলা চালালাম। কিন্তু পাক সেনাদের মরিচা থেকে ডিবপার্জ করতে পারলাম না। এত প্রস্তুতির পরও সবচেয়ে বেশী ধকল আমার এখানে গেছে। আসল চাইনিজ ৮৩ ব্লেণ্ড সাউণ্ড কিন্তু তার ফ্লাশ প্রোটেক্ট করার জন্য যে কভার থাকে তা নেই। রাউণ্ড ভরলাম ফায়ার করলাম। থানায় শত্রুদের একটা মরিচা উড়ে গেল। কিন্তু আমাকেও ধাক্কা মেরে হাত তিনেক পেছনে ফেলে দিল। আমার মাথার টুপি উড়িয়ে নিয়ে ফেলল প্রায় পনের হাত পিছনে।
৩রা ডিসেম্বর পাক বাহিনীর রিইনফোর্সমেন্ট কন্টিনজেন্ট এগিয়ে এলো ময়মনসিংহ থেকে টাঙ্গাইল। কাদের সিদ্দিকী এগিয়ে গেলেন এলাসিন গুদারা ঘাটে পাক বাহিনীকে বাধা দিতে। কিন্তু সময়ের সামান্য হেরফের তিনি গুদারা ঘাটের ওপারে পাক বাহিনীকে বাধা দিতে পারলেন না। পাক বাহিনী এপারে চলে এলো। কাদের বাহিনী সুবিধামত পজিশন নিতে পারলেন না। কাদের সিদ্দিকী বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেন। কিন্তু মাত্র কয়েক ঘন্টার জন্য। আবার সবকিছু ঐ এলাকায় সুসংগঠিত হয়ে গেল। ৩রা ডিসেম্বর মধ্য রাতে কাদের সিদ্দিকী ছিলেন কেদারপুরে। শেষ রাতে গোলা আর বোমাবর্ষনের শব্দ শুনতে পেলেন। খনিক পরই মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল বিমান। সঙ্গীদের বললেন কাদের সিদ্দিকী, কাল থেকে নতুন সুখবর হবে। সঙ্গীরা এ কথার অর্থ জানতে চাইলেন। কাদের সিদ্দিকী বললেন। এই যে দেখলে না আমাদের বিমান শত্রুদের উপর আক্রমণ হেনে চলে গেলো। এরকম আঘাত হানলেই কাজ হবে। বাদবাকি আমরা পারব। পরের দিন কাদের সিদ্দিকী নবতর পরিস্থিতিতে সবাইকে সংগঠিত করলেন।
কাদের সিদ্দিকী নতুন পরিকল্পনা নিলেন ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়কে যে সেতুগুলো বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে তার নিচু দিয়ে যে রাস্তা হয়েছে তাতেও প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করা হবে। সেখানে এন্টি ট্যাংক মাইন বসানো হবে এবং এই মাইন প্রতিরক্ষার জন্য এর চারপাশে বসানো হবে একাধিক এন্টি পারসোনেল মাইন। প্রতি রাতে এই মাইন বসানোর নির্দেশ দেয়া হল। কাদের বাহিনীর যোদ্ধারা জালের মতো মাইন বিছিয়ে ফেললো। সঙ্গে সঙ্গে কাদের সিদ্দিকী আরেকটি পরিকল্পনা নিলেন, আগামী দুই দিনের মধ্যে টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ সড়কের সেতুগুলো ভেঙ্গে ফেলতে হবে। তারপর টাঙ্গাইল দখল করতে হবে। উল্লেখ্য, ২০শে নভেম্বর টাঙ্গাইল দখলের পরিকল্পনা কাদের সিদ্দিকীর ছিল। ঢাকা-টাঙ্গাইল এবং টাঙ্গাইল- ময়মনসিংহের সড়কের সেতুগুলো একযোগে ভেঙ্গে ফেলা হবে- মধুপুর থেকে শুরু করে ৯টা সেতু ধ্বংস করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল। কিন্তু অপাশের দায়িত্বে যারা ছিলেন তারা আর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজে হাত দিতে পারেনি।
যাহোক, এবার কাদের সিদ্দিকী সেতু ভাঙ্গার জন্য নতুন করে পরিকল্পনা নিলেন। তিনি ভাবলেন, ঢাকায় এখন শত্রুদের ওপর বিমান আঘাত হানা হবে; সীমান্ত ছেড়ে পাকবাহিনী আসবে না এবং এই সড়কটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই সেতু ভেঙ্গে পাকবাহিনী যোগাযোগের পথ বিচ্ছিন্ন করে টাঙ্গাইল তিনি দখল করবেন। ৪ঠা ডিসেম্বর কাদের সিদ্দিকী মার্চ শুরু করলেন। তখন কামালপুরে সম্মিলিত বাহিনীর সাথে পাকবাহিনীর যুদ্ধ চলছে। কাদের সিদ্দিকী স্থির করলেন তিনি মধুপুর দখল করে পুংলী সেতু পর্যন্ত আসবেন।
কাদের সিদ্দিকী বললেন, ৭ই ডিসেম্বর আমি নিকরাইল থেকে কোথায় কি করা হবে তার পরিকল্পনা করলাম। স্থির করলাম আমার ৫ হাজার যোদ্ধাকে নিয়ে এবারকার পরবর্তী পর্যায়ের অপারেশন চালাবো। আর সব যোদ্ধা থাকবে ডিফেন্সে এবং এই ৫ হাজার করবে এ্যাকশন। এর আগে ৬ই ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। ৭ই ডিসেম্বর আমি নিকরাইলে জনসভা করলাম। কুড়ি থেকে ত্রিশ হাজার লোক হল। সভায় জনগণকে বললাম, আপনাদের সাথে আর দেখা হবে কিনা জানি না। বাংলাদেশ আজ স্বীকৃতি পেয়েছে। কাদের সিদ্দিকী বললেন, ৭ই ডিসেম্বর রাতে সম্মিলিত বাহিনীতে ভারতীয় বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার সানত সিং আমাকে অয়ারলেসে যোগাযোগ করে জানালেন, আমরা জামালপুর পর্যন্ত এসে গেছি, ব্রহ্মপুত্র নদী আমরা পার হতে পারছি না। আপনি জামালপুরের দক্ষিন দিক থেকে পাকবাহিনীর উপর হামলা করুন আর আমরা উত্তর দিক থেকে হামলা করছি। আমি তাই জামালপুর রওয়ানা হলাম। কিন্তু ধনবাড়ী পর্যন্ত গিয়ে মত পরিবর্তন করলাম। আমি ঘুরে পথ পরিবর্তন করলাম। ৯ই ডিসেম্বর ব্রিগেডিয়ার সানত সিংকে অয়ারলেসে জানালামঃ আমি আপনার প্রস্তাব মানতে পারলাম না। কিন্তু ঢাকা থেকে পাকবাহিনী যেন ফোর্স পাঠাতে না পারে আমি সেই চেষ্টা করছি। আমি কথা দিলাম, পাক বাহিনীর একটিও সৈন্য যদি এই পথে এইদিকে আসতে পারে তবে আমি আইনত দণ্ড নেবো। আপনি আমাদের একটু উপকার করুন- গোপালপুরে আমাদের একটু এয়ার কভার দিন।
কাদের সিদ্দিকী বললেন, তাঁরা আমাদের কথায় রাজী হলেন। ১০ই ডিসেম্বর সকাল বেলা আমরা ঘাটাইল থানায় হামলা করলাম। বিকেল সাড়ে চারটায় থানা ঘাঁটির উপর হামলা করলাম। সেদিনই ঘাটাইলের পতন হলো। এদিকে সকাল ১০টা-১১টায় গোপালপুরে এয়ার কভার দেওয়ার কথা, আমার বাহিনীর যোদ্ধারা সেখানে অপেক্ষা করছে। কিন্তু বিমানের দেখা নেই। আমাদের কোন কনফার্মও করেনি। আমার ছেলেরা গোপালপুর ঘাঁটিতে আক্রমণ চালিয়ে কব্জা করে নিতে পারে। কিন্তু তারা বিমান হামলার জন্য অপেক্ষা করছে। পরে ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেল। বলা সাড়ে তিনটার দিকে আমার ছেলেরা শত্রুর ঘাঁটির উপর আক্রমণ করলো। পতন হলো গোপালপুরের।
বলছিলেন কাদের সিদ্দিকীঃ এদিকে জামালপুর আর আমাদের সাহায্যের দরকার হয়নি সম্মিলিত বাহিনীর। জামালপুর শত্রুর অবস্থানের উপর সম্মিলিত বাহিনীর বিমান এক হাজার পাউন্ডের দুটি বোমাবর্ষন করে। এতে ব্রক্ষপুত্র নদীর তীরে শত্রুদের প্রায় ৩৮টি মরিচা ধসে একেবারে পুকুরের মতো হয়ে যায়। এরপর পাকবাহিনী পালাতে শুরু করে। এদিকে রাস্তাটি এলেঙ্গা পর্যন্ত আমাদের দখলে এসেছে। টাঙ্গাইলে পাকবাহিনী রযেছে। পলাতক পাকবাহিনীর কনভয়ের উপর সম্মিলিত বাহিনীর বিমান স্ট্রাফিং করে গেল। ১১ ডিসেম্বর ভোর বেলায় আমরা পরিকল্পনা নিলাম আজ টাঙ্গাইল দখল করতেই হবে। কমান্ডার হাবিবের নেতৃত্বে একটি বাহিনীকে পাঠানো হলো ময়মনসিংহ থেকে পাকবাহিনীর আগমনকে ঠেকিয়ে রাখার জন্য। আগের রাতেই খবর পেয়েছি পাকবাহিনীর কনভয় যেতে পারছেনা। টাঙ্গাইল-ঢাকা রোডে পাতা আমাদের মাইনের জালের ফাঁদে তারা আটকা পড়েছে। প্রত্যেকটি সেতুর নিচের ডাইভারসন রোডে রয়েছে মাইন। ভাতকুড়া ব্রীজের নীচে একটি মাইনের ঘায়েই পড়ে গেল এগারটি গাড়ি। রোড ক্লিয়ার নেই। টাঙ্গাইল থেকে ভাতকুড়া হয়ে কালিহাতি পর্যন্ত লাইনআপ হয়ে রয়েছে শত্রুদের কনভয়ের গাড়ী। কালিহাতী থানা আমাদের ছেলেদের দখলে। আমরা এগিয়ে এলাম। আমি ১১ই ডিসেম্বর আবার স্মমিলিত বাহিনীর বিমানকে টাঙ্গাইল থেকে এলাঙ্গা পর্যন্ত বিমান হামলা ও এয়ার কভারের কথা বলেছি। তারা জানিয়েছেন, দিচ্ছেন, এদিকে কমান্ডার সবুরকে রেকি পার্টি নিয়ে পাঠিয়েছি। কিন্তু তারা এগিয়ে গেছে। ভয় হলো বিমান হামলা না আবার ভূলে তার উপর হয়। আল্লাহর রহমত, এলাঙ্গা থেকে অল্প একটু এ পাশে সবুর হল্ট হয়েছে। হল্ট এ জন্য করেছে যে ওপাশে পাকবাহিনী রয়েছে এক ব্যাটালিয়ন। আটকা পড়েছে। সবুরকে নির্দেশ দিলাম একটু পিছিয়ে আসার জন্য। এর পাঁচ মিনিটের মধ্যেই বিমান হামলা হলো। সে কি মার! পাকবাহিনী যেখানে পালিয়েছে সেখানেই তার উপর হামলা। শত্রুরা দিশেহারা হয়ে পড়লো। আমরা ডবল মার্চ করে এগিয়ে গেলাম। আমাদের দেখে পাকবাহিনীর সেকি দৌড়। পাকবাহিনী যে এমন দৌড়াতে পারে তা না দেখলে বোঝা সম্ভব নয়। আমরা তাদের দিকে ভ্রুক্ষেপই করলাম না। ধরাতো ওরা পড়বেই। আমাদের বাহিনী সড়ক ধরে এগিয়ে চললো। আমাদের বাহিনী তারপর পুংলী ব্রীজে পৌঁছলো। সে সময় ওখানে ভারতীয় বাহিনীর ছত্রীসেনা নামলো। অনেক এলাকা জুড়ে তারা নামলো। একটু পরে খবর আসলো ভারতীয় বাহিনী এসে পড়েছে। আমি ভাবতে পারিনি এত তাড়াতাড়ি তারা আসতে পারবে। আমাকে তারা জিজ্ঞাসা করলেন টাঙ্গাইলের খবর কি? টাঙ্গাইলের দায়িত্ব তো আমার। একটু সবুর করুন। খানিক পর খবর দিচ্ছি। পাকবাহিনীর ফেলে আসা বাসে উঠলাম। এসে দেখি গোলাগুলি চলছে শহরে। পাকবাহিনীর তিনশ সৈন্য রয়েছে শহরে। আমার বাহিনীর যোদ্ধাদের সঙ্গে পাল্টা গুলি বিনিময় হচ্ছে। কিন্তু আত্মসমর্পন করছে না। বলছে যে, হয় ভারতীয় বাহিনী, নয়তো কাদের বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পন করবে। আমি গিয়ে আহবান জানালাম আত্মসমর্পনের জন্যে। পাকবাহিনীর কমান্ডার এসে আত্মসমর্পন করে বললেন ‘যো আপ করে’ ভারতীয় বাহিনীর কাছে খবর গেল, এবার আসতে পারেন। টাঙ্গাইল ক্লিয়ার। অবশ্য টাঙ্গাইল সকালেই ক্লিয়ার হয়েছিল। আমার শুধু অন্য সব দায়িত্বে আটকে থাকায় আসতে দেরি হয়েছিল। ভারতীয় বাহিনী টাঙ্গাইল এলো। গোড়াই পর্যন্ত আমি অপারেশন প্লান করে দিয়েছিলাম। খবর পেলাম গোড়াই পর্যন্ত সব ক্লিয়ার।
\ আমার পরিচয় পেয়ে নিয়াজী তড়াক করে দাঁড়িয়ে আমাকে স্যালুট করলো \
১২ই ডিসেম্বর। গোরাই গিয়ে অবস্থান নিল ভারতীয় বাহিনী। কাদের সিদ্দিকী তার বাহিনীকে ১২ ও ১৩ই ডিসেম্বর বিশ্রামের নির্দেশ দিলেন। ১৪ ডিসেম্বর তিনি টাঙ্গাইলে জনসভা করলেন। সেই জনসভায় বললেন, এই বোধ হয় শেষ দেখা। আর দেখা নাও হতে পারে। এই যে আপনাদের সাথে মিলিত হতে পারলাম এটাই আমার শান্তি। কাদের সিদ্দিকী আমাকে এ প্রসঙ্গে বললেন, ঢাকা যে এত সকালে মুক্ত হবে তখনো তা ভাবিনি। আমি মনে করেছিলাম অন্তত আরো একমাস যুদ্ধ হবে। কাদের সিদ্দিকী ঢাকা অভিযানের জন্য নিজের বাহিনী থেকে আড়াই হাজার যোদ্ধা বাছাই করলেন। শুরু হলো ঢাকা অভিমুখে অভিযান। স্থির হপ্লো দুটি পথে সম্মিলিত বাহিনী ঢাকার দিকে এগিয়ে যাবে-
১। সাভার হয়ে এবং
২। টঙ্গী হয়ে।
১৫ই ডিসেম্বর সকালে পাক বাহিনী সম্মিলিত বাহিনীর অগ্রাভিযান রোধ করার জন্য কড্ডার সেতু ভেঙ্গে দেয়। এসব ঘটনার কথা বলছিলেন কাদের সিদ্দিকী, “সকালে ওরা ব্রিজ উড়িয়ে দিল। সম্মিলিত বাহিনীতে ভারতীয় বাহিনীর মেজর জেনারেল নাগরা আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কেয়া সিদ্দিকী! কেয়া হো গেয়া! আমি বললাম, কি আর হবে। পাক বাহিনী ব্রিজ ভেঙ্গে দিল। পাকবাহিনীর কাণ্ড দেখে আমার তখন খুব হাসি পাচ্ছিল। ভাবছিলাম, পাক মিলিটারি তোদের রোধ করার জন্য ব্রিজ ভেঙ্গে ফেলি। মেজর জেনারেল নাগরাকে বললাম, আজ আভি অর নেহী যায়েগা। জেনারেল নাগরা বললেন, কিউ সিদ্দিকী কিউ? আমি বললাম, হাম প্লান বানায়েঙ্গে। রাতের বেলা পরিকল্পনা তৈরি করলাম। একদল ডানদিকে আর একদল বাম দিকে রাতের আবছায়ায় নদী পার হলো স্থানীয় লোকজনদের সহায়তায়। আমাদের ১০০ জন করে মুক্তিযোদ্ধা এবং ভারতীয় বাহিনীর একটি করে ব্যাটালিয়ান। পাক বাহিনী তখনো নিশ্চিন্তে রয়েছে। ভেবেছে, আমরা তো নদী পার হতে পারবোই না। আল্লাহর কি রহমত, সম্মিলিত বাহিনী নদী পার হয়েই শত্রুদের দুজনকে মেরে ফেলল। ব্রিজ ভেঙ্গে যারা খেতে বসেছিল তাদের পাকড়াও করলো।”
১৫ই ডিসেম্বর সকালে সম্মিলিত বাহিনীর আরেকটি দল এগিয়ে গিয়েছিল সভারের পথে। এখন যেখানে রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্প সেখানে যুদ্ধ হয়। তারপর আর কোন যুদ্ধ হয়নি। এই বাহিনী ১৬ই ডিসেম্বর সকালে মিরপুর থেকে সাভার অভিমুখী সড়ক সেখানে প্রস্থে দ্বিগুণ হয়ে অর্থাৎ ডবল রোড হিসেবে শুরু হয়েছে সেখানে এসে অবস্থান নিল। আর এদিকে টঙ্গী অভিমূখী বাহিনী ১৬ই ডিসেম্বর বোর্ড বাজারে এসে পৌঁছালো।
১৬ই ডিসেম্বর সকালে মেজর জেনারেল নাগরা ও কাদের সিদ্দিকী একটি হেলিকপ্টারে এসে সাভারগামী সড়কে মিরপুর ব্রিজের পরবর্তী ব্রিজের কাছে নামলেন। সঙ্গে রয়েছেন ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার। বলছিলেন কাদের সিদ্দিকীঃ ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার টঙ্গী অভিমুখে এগিয়ে যাওয়া বাহিনীর অধিনায়কত্ব করছিলেন। সাভারগামী বাহিনীর অধিনায়কত্ব করছিলেন ব্রিগেডিয়ার সানত সিং। হেলিকপ্টার থেকে নেমে মেজর জেনারেল নাগরা জেনারেল নিয়াজীর কাছে একটি চিঠি লিখলেন। তাতে তিনি নিয়াজীকে লিখলেন, আমি অমুক জায়গায় রয়েছি। তুমি আত্মসমর্পন করবে কিনা জানাও এবং উত্তর দাও। ভারতীয় বাহিনীর একজন মেজরকে বাহক করে চিঠি পাঠানো হলো। তার সাথে রয়েছে ভারতীয় বাহিনীর তিনজন জওয়ান ও পথ চেনাবার জন্য একজন মুক্তিযোদ্ধা। দু’টি জীপ তাদের নিয়ে চলে গেলো। জীপের সম্মুখে সাদা পতাকা। সঙ্গে কোন অস্ত্র নেই। নিয়াজী চিঠি পেয়ে জানাল যে, সে আত্মসমর্পন করতে প্রস্তুত। কিন্তু কোন লিখিত ভাষ্য সে দিল না। পাকবাহিনীর মেজর জেনারেল জামশেদকে পাঠিয়ে দিল। জামশেদ এসে মেজর জেনারেল নাগারাকে স্যালুট করলো। তখন নাগারা বললেন, ‘শুনো সিদ্দিকী, হামকো স্যালুট করেগা তো হাম লেগা আউর তুম লেগা। হামলোগ দো এক সাথ আয়া হ্যায়।’ জামশেদ এসে তার নিজের রিভলভার ও মাথার ফৌজি টুপি তুলে দিল সম্মিলিত বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পনের প্রতিক হিসাবে। রিভলভারটি গ্রহণ করলেন মেজর জেনারেল নাগরা এবং টুপি তুলে দিল আমার হাতে। জেনারেল নাগরা তখন আমাকে বললেন, আরে সিদ্দিকী, ক্যামেরাম্যান হ্যায়? ইয়েতো হিষ্ট্রি বন যায়েগা। কিন্তু দুর্ভাগ্য, সে সময়ে কোন ক্যামেরা ম্যান সেখানে ছিল না। মেজর জেনারেল জামশেদ যখন আত্মসমর্পন করলো, তখন সকাল দশটা।
কাদের সিদ্দিকী বললেন, ‘আমরা ঠিক করলাম যে, জেনারেল নিয়াজীর সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে হবে। মিরপুর ব্রিজের এপারে এলাম জেনারেল নাগরা, ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার, ব্রিগেডিয়ার সানত সিং ও আমি এলাম পাক বাহিনীর গাড়ীতে চেপে। রাস্তায় প্রহরারত পাক বাহিনী আমাদের স্যালুট ঠুকছে। আমাদের বাহিনী পড়ে রইলো পেছনে। এপারে এসে এক জায়গায় টেলিফোন করতে গিয়ে দেখি কোন শব্দ নেই। টেলিফোন ডেড। লাইন কাট আপ। এলাম মোহাম্মদপুর। নিয়াজীকে টেলিফোন করা হলো কিন্তু সাড়া নেই রিং হচ্ছে না। তখন জেনারেল নাগরা বললেন, উন লোক চালাকি কিয়া। যেধার যাতাহু ওধারই লাইন নেহী হ্যায়। তখন সকাল প্রায় সোয়া দশটা পেরিয়েছে। জেনারেল নাগরা তখন ভাবছেন যে আমরা ক্যান্টনমেন্টে যাবো কি যাবো না। যাওয়াটা কি ঠিক হবে। আমি বললাম, যখন এসেই পরেছি তখন যাবোই। তারপর দশটা চল্লিশ মিনিটে আমরা ক্যান্টনমেন্টে নিয়াজীর দফতরে পৌঁছলাম। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘর। নিয়াজী এসে স্যালুট করলো। নাগরা স্যালুটের জবাব দিলেন। নাগরা বসলেন। নিয়াজী বসলো। নাগরা তখন পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন, ইয়ে হ্যা ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার, ইয়ে হ্যায় ব্রিগেডিয়ার সানত সিং, আউর ইয়ে হ্যায় বাংলাদেশ বাহিনীর কাদের সিদ্দিকী। নিয়াজী তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে স্যালুট করলো এবং করমর্দনের জন্যে হাত বাড়িয়ে দিল। আমি তখনো বসে রয়েছি। ইতস্তত করছি, আর ভাবছি নিয়াজীর সাথে হ্যাণ্ডসেক করবো কিনা। নিয়াজী তখনো হাত বাড়িয়ে রয়েছে। জেনারেল নাগরা বললেন, কেয়া হুয়া সিদ্দিকী, হাত মিলাও। তুমকো নিয়াজীকে সাথে নেহী-এক ইনসানকে সাথ হাত মিলাতা হ্যায়। মিলাও।