৫৬| বগুড়ার মান্নান ভাই এবং আরও কয়েকজন তরুণ হত্যার বিবরণ (৪৫৩)
সূত্র – -বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা, ২৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২
বগুড়ার পরিচিত মুখ ‘মান্নান ভাই’
আজ একুশের রক্তপলাশে আরেক পুস্পস্তবক
মান্নান ভাই কোথায়? বগুড়ার সবার মনেই একটি প্রশ্ন। বগুড়ার আনাচে কানাচে সবাই জানেন এই ভাইটিকে। বয়স বেশী নয়। খুব বেশী হলে বিশ-বাইশ বছর হয়েছে। মান্নান ভাই ছিলেন খুবই ব্যস্ত, ঘুরতেন কাজের নেশায়। তাঁর কাজ ছিল ছাত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা। শ্রমিক আর কৃষকদের মাঝে নিবিড় করে সম্পর্ক স্থাপন করা। বগুড়া জেলার পূর্বে চন্দনবাইসা আর পশ্চিমে শান্তাহার, পাঁচবিবির প্রায় প্রতিটি ছাত্রই তাঁর পরিচিত। অপরদিকে শেরপুর থেকে বগুড়ায় ঐতিহাসিক মহাস্থান আর গোবিন্দগঞ্জ পর্যন্ত তাঁর নাম ছাত্রদের মাঝে নিবিড় হয়ে ছড়িয়ে আছে।
স্কুল জীবনেই তিনি ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বগুড়া সেন্ট্রাল হাইস্কুল থেকে এস,এস,সি পাশ করার পর তিনি বগুড়া আজিজুল হক কলেজে ভর্তি হন। তিনি বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এইচএসসি পাশ করে একই কলেজেই বি,এসসিতে ভর্তি হন।
জনাব আব্দুল মান্নান প্রথমে ছিলেন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন বগুড়া জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক। পরে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত ছিলেন সংগঠনের সভাপতি। মান্নান ভাই এর মৃত্যু স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। বর্বর পাক দস্যুরা নির্মমভাবে হত্যা করেছে তাঁকে।
১১ই নভেম্বর তারিখে পাক দস্যুরা তাঁকে হাত বেঁধে ধরে নিয়ে যায়। শুধু তাঁকেই নয়, বগুড়া শহরের সুতরাপুর থেকে আরো তিনজনেক ঘেরাও করে পাক বাহিনী ধরে ফেলে। মান্নান ভাই সেদিন তাঁর ভাইয়ের সঙ্গেই ঘুমিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি জানতেন না যে নিষ্ঠুর আল-বদর বাহিনী পাক দস্যুদের সঙ্গে ইতিমধ্যেই ষড়যন্ত্রের জাল বুনেছে।
সেদিনের সূর্য ওঠার বহু পূর্বেই রাতের অন্ধকারে জল্লাদের তাঁর বাড়ী ঘিরে ফেলে। এরপরই মান্নান ভাইয়ের সামনে হাজির হয়েছিল একজন নরঘাতক। হাত বেঁধে ফেলল মান্নান ভাইয়ের। ছোট ভাই হান্নানও রেহাই পেল না। তাঁর হাত পাও বাঁধা হলো। ট্রাক বোঝায় করে একসঙ্গে চৌদ্দজন বাংলার দামাল ছেলেকে ছিনিয়ে নীল ওরা। মায়ের বুক খালি করে মানুষ বোঝাই ট্রাকটি চলে গেল বহুদূরে। তখনো সান্ত্বনা ছিল হয়তো তারা ফিরে আসবে। কিন্তু মিথ্যে সান্ত্বনায় কি আর মনকে প্রবোধ দেয়া যায়? খবর এলো শহর থেকে দূরে ‘রানীর হাট’ নামক জায়গার কাছে চৌদ্দ জনকেই এক লাইন করে হাত চোখ বেঁধে গুলী করে হত্যা করা হয়েছে।
খবর শুনে ছুটে গিয়েছিলেন মান্নান ভাইয়ের আত্মীয়স্বজন। তাঁরা সবাই সেদিন জল্লাদদের নিষ্ঠুরতা অবাক হয়ে স্বচক্ষে দেখেছেন। একটি দেহের উপর আর একটি দেহ জড়িয়ে ঠিক একটি লাইন হয়েই পড়ে আছে। পড়েছিল মান্নান আর হান্নান। দুই ভাই যেন গলাগলি ধরে শুয়ে আছেন আর বারটি ভাইয়ের সঙ্গে। পাক দস্যুরা একটি লাশও আত্মীয় স্বজনের পছন্দ মত জায়গায় কবর দিতে দেয়নি। বাধ্য হয়েই একসঙ্গে একস্থানে সকলকে কবর দেয়া হয়েছে।
বগুড়া জেলার এই ছাত্র সংগঠক আইয়ুব আমলের কালো দশকে ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়ায় কারাগারে গিয়েছেন। তিনি ছাত্র আন্দোলনের জড়িত থাকায় বহুবার ‘ওয়ারেন্ট’ মাথায় নিয়ে আত্মগোপন করেছেন। এবারের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত থাকায় তার উপর নেমে এসেছিল মৃত্যুর পরোয়ানা।
আত্মগোপন করে তিনি এবার অক্টোবর মাস পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। কিন্তু ১১ই নভেম্বর দালালদের সহযোগিতার ধরা পড়লেন। তাঁর সঙ্গে ধরা পড়েছিল প্রতিবেশী মুক্তিযোদ্ধা সাইফুল ইসলাম। সবার সঙ্গে মান্নান ভাই চিরতরে ঘুমিয়ে আছেন।