বাংলাদেশের নিম্নপদস্থ পুলিশ কর্মচারীসহায়ক সংস্থার একটি আবেদন

<৪,২৫৩,৫৮৯-৫৯০>

অনুবাদকঃ কাজী সাদিকা নূর

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৫৩। বাংলাদেশের নিম্নপদস্থ পুলিশ কর্মচারী

সহায়ক সংস্থার একটি আবেদন

বাংলাদেশের পুলিশ কর্মচারী

সহায়ক সংস্থা

……

১৯৭১

 

বাংলাদেশ

নিম্নপদস্থ পুলিশ কর্মচারী সংস্থা

স্বাধীন বাংলাদেশের নিম্নপদস্থ পুলিশ কর্মচারী ভাইয়েরা আমার-

 

উনিশ শ’ সাতচল্লিশ সালের চোদ্দই আগস্ট ইংরেজ শাসকদের কবল থেকে স্বাধীনতা লাভের পর আমরা যে মুক্তির শপ্ন দেখেছিলাম, বিগত চব্বিশ বছর ধরে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানের কবলে পড়ে আমাদের সে আশা – আকাঙ্ক্ষা চিরতরে পর্যুদস্ত হতে চলেছিল। সোনার বাংলাকে শোষণের কলোনি করে পাক শাসকচক্র আমাদের দাসত্বে পরিণত করার হীন ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিয়েছিলো কতিপয় পদলেহনকারী বাঙ্গালী দালালদের সহযোগিতায়। আমরা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক আর সামাজিক দিক থেকে হয়েছিলাম পংশু আর অসহায়। ওদের শাসন- শোষণ ও অত্যাচারের ষ্টীম রোলারের আঘাতে বাংলার নিরীহ সরল মানুষ হয়েছে ক্ষিপ্ত অশান্ত। তারই মৃত্যু প্রকাশ ঘটে উনিশ শ’ বায়ান্ন সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে- যে আন্দোলনের প্রবাহে বাংলার সোনা- মাণিক- ভাইদের তাজা রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল বাংলার পীচঢালা রাজপথ। শহিদ সালাম বরকত রফিকের লাল তাজা রক্তের বদলা শপথ নিয়েছিলো বাংলার সাতে সাত কোটি মানুষ। তারা বিনা দ্বিধায়ে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে মরণজয়ী সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো পাক জঙ্গিশাহীর বিরুদ্ধে- একাত্মতা প্রকাশ করেছিলো দেশের মুক্তির সংগ্রামে।

গত পঁচিশ মার্চের রাত থেকে পাক জঙ্গিশাহী বাংলার নিরীহ নিরস্ত্র জনসাধারণের উপর যেরূপ অত্যাচার অবিচারের ষ্টীম রোলার চালিয়ে যাচ্ছে, পৃথিবীর ইতিহাসে এধরনের বর্বরোচিত জঘন্য দমন নীতির নজীর নেই।

বাংলার নিরীহ মানুষ আজ ক্ষিপ্ত, অশান্ত। তারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উদ্বুদ্ধ মুক্তি সৈনিক পাক জঙ্গিশাহীর বিরুদ্ধে সংগ্রামরত। দশ লক্ষাধিক নরনারীর রক্তে রঞ্জিত বাংলার পদ্মা- মেঘনা- যমুনার অথই জলরাশি- পথে- ঘাটে আজ মানুষের হাহাকার। বর্বর পাকসৈন্যদের নরহত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, নারীধর্ষণের করুণ কাহিনীতে পৃথিবীর মানুষ আজ স্তব্ধ, হতবাক- বিশ্ববিবেক আজ স্তম্ভিত, নির্বাক। তবুও বাংলার মানুষ আজ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, ইস্পাতকঠিন চেতনায় আজ সংগ্রামমূখর।

পৃথিবীর ইতিহাসে স্বাধীনতা আন্দোলন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, যে দেশেই বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে- সে দেশের সশস্ত্র বাহিনী হয় সরকারের পক্ষ সমর্থন করছে, না হয় নীরাবতার ভুমিকা পালন করছে। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে আমাদের (বাঙ্গালী) ইস্ট পাকিস্তান রেজিমেন্ট, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস, ইস্ট পাকিস্তান পুলিশ, মুজাহিদ ও আনসার বাহিনী জনগণের পক্ষে যেভাবে সরকার বিরোধী ভূমিকা সমর্থন করছে- তার কোন নজীর নেই। এ ধরণের বিপ্লব অনন্য- একক। এর একমাত্র কারণ, পাক জঙ্গিশাহীর শোষণ আর অত্যাচার; অপর দিকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি তাদের অকুণ্ঠ সমর্থন।

আমরা সশস্ত্র বাহিনী বিশেষ করে তথাকথিত পূর্ব পাকিস্তানের পুলিশ কর্মচারীরা ইংরেজ আমলের আইনের মাধ্যমে চব্বিশ ঘণ্টার জন্যে কাজ- কর্মে নিয়োজিত থেকেও আমরা ছিলাম সমাজের এক শ্রেণীর ঘৃণিত অস্পৃশ্য বীজ- পাক শাসকচক্রের ক্রিড়নক সমাজের এক শ্রেণীর অবহেলিত পদদলিত সরকারী কর্মচারী। আমরা কোনদিন মানুষের আস্থাভাজন হতে পারি নি- অথচ গাধার খাটুনি খেটে আমরা ছিলাম অস্পৃশ্য অবহেলিত। আমরা চব্বিশ ঘণ্টা বিরামহীন পরিশ্রম করেও সমাজের কাছে হয়েছি লাঞ্ছিত- অবহেলিত। আমাদের দৈনন্দিন দুঃখ –কষ্ট, অভাব- অনটন থাকা সত্ত্বেও আমরা বিরামহীন সমাজের সেবা করেছি, কিন্তু তার বিনিময়ে শুনেছি ‘পুলিশ জুলুম চলবে না’ ‘পুলিশ গোষ্ঠী নিপাত যাক’ স্লোগান। কিন্তু কেন, কেন এই বিরাম্বনা, এর জন্য দায়ী কারা- সমাজ, না রাষ্ট্রব্যবস্থা? এ বিচার কি কেউ কোনদিন করেছিলো? করেনি। তাই আমাদের এ বিপ্লব পাক জঙ্গিশাহীর বিরুদ্ধে আমাদের বিক্ষোভ। বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনে আমরা একার- আর পূর্ণ সহযোগী।

আজকে সমাজ মানুষের চিন্তাধারায় পরিবর্তন হয়েছে। আমরা বাঙ্গালী, মানুষ। সরকারী কর্মচারী হলেও খাকী পোশাকের অন্তরালে আমাদেরও একটি সবুজ মন ঘুমিয়ে আছে, তাকে জাগিয়ে দিতে অনেক সফল সম্ভাবনা আছে বলেই অসহযোগ আন্দোলনের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধু দেশের অভ্যন্তরীণ আইন- শৃঙ্খলার ভার পুলিশের উপরই ন্যস্ত করেছিলেন। সেই মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়েই আমরা পূর্ব বাংলার প্রায় পঁয়তাল্লিশ হাজার পুলিশের কর্মচারী এই আন্দোলনের পাক জঙ্গিশাহীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র ভূিমকায় অবতীর্ণ হয়েছি। বঙ্গবন্ধু আমাদের যে দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন, আমরা সে দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে চেষ্টা করেছি- বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সে কাহিনী স্বর্ণাক্ষরে লিখিত হবে। ( এ ব্যাপারে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের ভূমিকা শীর্ষক প্রবন্ধ যা দৈনিক যুগান্তরের গত পনেরই অক্টোবর সংখ্যায় প্রকাশিত- প্রণিধানযোগ্য।

আজ বাংলাদেশ স্বাধীন ও গণপ্রজাতন্ত্রী রাশ্ত্ররুপে স্বীকৃত। আমরা পুলিশ কর্মচারী, অতীতের দুঃখ- দৈন্য ভুলে গিয়ে জনগণের সাথে একাত্ম হয়ে দেশ গঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করার দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করবো। ইংরেজ আমলের শোষকরূপ আইন যন্ত্রকে পালটে নিয়ে জনগণের একাত্মতাই হবে আমাদের কাম্য। আমরা হবো প্রকৃতই জনগণের বন্ধু ও সেবক এবং সেই ভাবধারার পরিপ্রেক্ষিতেই রচিত হবে আমাদের শাসন ব্যবস্থা। আমাদের দিয়েই হবে তার সার্থক রুপায়ন। এ আশা নিয়েই আমরা অতীত- ধ্যান ধারণার পরিবর্তন হওয়া বাঞ্ছনীয়।

পাক বাহিনীর অত্যাচারের প্রাণের ভয়ে আমাদের প্রায় দু’হাজার কর্মচারী আশ্রয় নিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়ের বিভিন্ন স্থানে। আরও অসংখ্য পুলিশ কর্মচারী রয়েছেন পাক অধিকৃত এলাকায়। আমরা আজ আত্মীয়- স্বজন, বন্ধু- বান্ধব, স্ত্রী- পুত্র, ছেলে- মেয়েদের সাথে সম্পর্কচুত, তবুও আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রত্যক্ষ সংগ্রামমুখর- অতীতকে ভুলে গিয়ে আমরা অনাগত ভবিষ্যতের সফল সংগ্রামে নিয়োজিত।

চলমান জীবনে যেকোনো কাজে সংগঠনের গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের অগণিত পুলিশ কর্মচারীরা আজও ছড়িয়ে আছে অধিকৃত এলাকায় এবং ভারতের বিভিন্ন স্থানে। তাদের অভাব- অভিযোগ, দুঃখ- দৈন্য অবর্ণনীয়- এ জন্য আমাদের বিশেষ করে বাংলাদেশের নিম্নপদস্থ পুলিশ কর্মচারীরা আমাদের ভাইদের দুঃখ- কষ্ট অভাব- অভিযোগের সাথে একাত্ম হতে চাই। আর তাদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থার জন্য দরকার একটি সহায়ক সংস্থা। বাংলাদেশের নিম্নপদস্থ পুলিশ কর্মচারীদের দৈনন্দিন অভাব- অভিযোগ, দুঃখ- দৈন্য মোচনের জন্য একটি সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। আর এজন্যই আমরা একটা সংস্থার অভাব উপলব্ধি করছি- আশা করি এ ব্যাপারে আপনাদের সক্রিয় সহযোগিতা অবশ্যই পাবো।

এ ব্যাপারে আপনাদের পক্ষে আমি আমাদের পুলিশ প্রধানের অনুমতি চেয়ে আবেদন প্রকাশ করছি নিয়ম- শৃঙ্খলা ও আইনানুভাবে আমরা  আমাদের অভাব- অভিযোগ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও বাংলাদশ সরকারের কাছে পেশ করার দৃঢ় সংকল্প নিয়েই আমরা আমাদের লক্ষ্য পথে এগিয়ে যাবো- আপনাদের সক্রিয় সহযোগিতাই আমাদের কাম্য। জয় বাংলা।

বাংলাদেশের নিম্নপদস্থ পুলিশ কর্মচারীদের পক্ষে-

(স্বাক্ষর) এ,কে, মকবুল আহমদ

(প্রাক্তন) ভারপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মচারী, মেহেরপুর থানা,

কুষ্টিয়া, বাংলাদেশ।

Scroll to Top