বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির উপায়
……..ডিসেম্বর, ১৯৭১
যুদ্ধ একদিন শেষ হয়। ধ্বংসস্তুপের মধ্য থেকে গড়ে তুলতে হয় নতুন জীবন,সভ্যতা। মানুষ যুদ্ধ চায় না। চায় শান্তি। তবু যুদ্ধ চলে আসছে মানব অস্তিত্বের আদিকাল থেকে। আমরা যুদ্ধ চাইনি। তবু যুদ্ধ চেপে বসেছিল আমাদের উপর ন্য মাস ২২ দিন পরে বাংলাদেশের পাক দখলদার বাহিনী সর্বত্র আত্মসমর্পণ করেছে। এখন আমাদের ভাববার পালা যুদ্ধোত্তর পুনর্গঠন নিয়ে। এখন আমাদের লক্ষ্য হবে বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়ে দেশ গড়বার কাজে আত্মনিয়োগ করা। সাধারণ মানুষের জীবন থেকে দুঃখ-দারিদ্রকে দূর করে, সমগ্র দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।
বাংলাদেশ পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম জনবহুল দেশ। এখানে গড়পড়তায় প্রতি বর্গমাইলে জনসংখ্যার হার ৯০০ জনের উপরে। জমির উপর জনসংখ্যার চাপ এখানে খুব বেশী। আমাদের প্রধান এবং প্রাথমিক সমস্যা এই বিরাট জনসংখ্যার মুখে অন্ন যোগান।
বাংলাদেশের মোট আয়তন ৩৫.৩ মিলিয়ন একর। এর মধ্যে আবাদী জমির পরিমাণ হল ২২.৫ মিলিয়ন একর। এর মধ্যে বৎসরে একাধিকবার আবাদ করা হয় এমন জমির পরিমাণ হল ৩ মিলিয়ন একর। তাই বলতে হয় মোট ফসল উৎপাদন জমির পরিমাণ হল ৩৮.৮ মিলিয়ন একর।
একটা দেশের কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করা যায় দু’ভাবেঃ
(১) নতুন জমিকে কর্ষণ উপযোগী করে; এবং
(২) আবাদী জমিতে ফসলের উৎপাদন মাত্রা বাড়িয়ে।
বাংলাদেশে বর্তমানে চাষ করা হয় না কিন্তু চেষ্টা করলে কর্ষণ উপযোগী করা যায় এমন জমির পরিমাণ প্রায় ১ মিলিয়ন একর। উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করলে, যেমন কলের লাঙ্গল ব্যবহার করে এই ভূমিকে কর্ষণ উপযোগী করা সম্ভব। বিগত কয়েক বছরে অনেক উন্নয়নগামী দেশে খাদ্য উৎপাদনের মাত্রা দ্রুত বেড়েছে। অনুসন্ধান করলে দেখা যায় তা সম্ভব হয়েছে প্রধানত নতুন জমি আবাদ করে। কিন্তু বাংলাদেশে আবাদযোগ্য অনাবাদী জমির পরিমাণ খুব বেশী নয়। তাই ফসল বাড়াবার প্রধান উপায় হিসাবে এখানে গ্রহণ করতে হবে বর্তমানে যে আবাদী জমি আছে তাতেই অধিক ফসল ফলানোর উপায় উদ্ভাবন করে- উন্নত কৃষিপ্রণালীর প্রয়োগ ঘটিয়ে।
বাংলাদেশে ফসলের ফলনের মাত্রা খুবই কম। যেখানে বাংলাদেশের ধানের গড়পরতা ফলনের পরিমাণ একরপ্রতি ৯০০-১০০০ পাউণ্ডের মত সেখানে জাপানে একরপ্রতি ধানের ফলন হচ্ছে ২০০০ পাউণ্ডের উপর। আমাদের দেশে ধানের ফলন-মাত্রা কমের একটি বড় কারণ জমিতে যথাযথভাবে সার দেওয়ার ব্যবস্থা নাই। পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে, বাংলাদেশের জমিতে কেবলমাত্র নাইট্রোজেন ঘটিত সার প্রদান করে ফসলের হার অনেক বাড়িয়ে দেওয়া যায়। যেমনঃ একর প্রতি ৪০ আউন্স নাইট্রোজেন ঘটিত সার দিয়ে দেখা গিয়েছে যে, এর ফলে আউশ ধানের ফলন ৩৭ ভাগ, আমন ধানের ফলন শতকরা ৪০ ভাগ ও বোরো ধানের ফলন শতকরা ৪৬ ভাগ বাড়িয়ে দেওয়া যায়।
আমাদের দেশে মাটির নীচে যে প্রাকৃতিক গ্যাসের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে, তার সাথে বাতাসের নাইট্রোজেন গ্যাস যুক্ত করে নাইট্রোজেন ঘটিত সার যথেষ্ট পরিমাণে উৎপাদন করা সম্ভব। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত যে পরিমাণ প্রাকৃতিক গ্যাসের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে তার পরিমাণ হল ৯.৩৪ মিলিয়ন কিউবিক ফুট। এই গ্যাস আমরা বহুদিন ধরে ব্যবহার করতে পারবো। সার উৎপাদনের কাজে জ্বালানী হিসাবে প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যবহার ত্বরান্বিত করতে হবে।
বাংলাদেশের আবাদী জমির কম করে শতকরা ৬০ ভাগ শীতকালে পতিত থাকে। এর প্রধান কারণ শীতকালে আমাদের দেশে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ খুবই কম। ডিসেম্বর ও জানুয়ার মাসে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ গড়পরতায় দেড় ইঞ্চির বেশী নয়। শীতকালে জলসেচের ব্যবস্থা করে তাই বহু জমিতে ফসল ফলান সম্ভব। এইভাবে রবিশস্যের উৎপাদন বৃদ্ধি করে বাংলাদেশের খাদ্য সমস্যা বহুলভাবে সমাধা করা চলে। পাকিস্তানী আমলের সরকারী হিসাব থেকে দেখা যায় যে, ১৯৬৬-৬৭ সালে বাংলাদেশে ১.৫ মিলিয়ন একর জমিতে জলসেচ ব্যবস্থা ছিল। অর্থাৎ মোট আবাদী জমির মাত্র শতকরা ৫ ভাগ জমিতে জলসেচ ব্যবস্থা ছিল। উপযুক্ত পরিকল্পনা গ্রহন করে দ্রুত আরো অনেক জমিতে সেচ-ব্যবস্থা সম্ভব।
বাংলাদেশের এক বিরাট সমস্যা বন্যা। বন্যার পানি প্রতিবছর যথেষ্ট পলিমাটি বহন করে বাংলার মাটিকে উর্বর করে। কিন্তু বড় বন্যা হলে তাতে বাংলাদেশের ফসলের যথেষ্ট ক্ষতি হয়। সরকারি হিসাব মতে বাংলাদেশে যখন মাঝারি রকমের বন্যা হয়, তখন প্রায় ৯ মিলিয়ন একর জমি জলমগ্ন হয়। ১৯৫৭ সাল থেকে বন্যা নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে অনুসন্ধান এ পর্যন্ত চালান হয়েছে। তা থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশে বন্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে ভারতের সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন। পাকিস্তানের রাজনৈতিক কারণে, ভারতের সাথে এতদিন বন্যা নিয়ন্ত্রণ ব্যাপারে কোন সহযোগিতা সবস্তব হয়নি। কিন্তু এই সহযোগিতার প্রতিবন্ধক এখন দূর হয়েছে।
একটা দেশের আর্থিক শ্ৰীবৃদ্ধির জন্য বর্তমান যুগের রাষ্ট্রক পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তার কথা এখন মোটামুটি সব অর্থনীতিবিদই স্বীকার করেন। কিন্তু সব পরিকল্পনার সাফল্য নির্ভর করে যেমন পরিকল্পনা তৈরির নির্ভুলতার উপর, তেমনি সেই পরিকল্পনাকে বাস্তবে কাযর্কর করার ভার যাদের হাতে ন্যস্ত থাকে তাদের নিষ্ঠা ও সত্যতার উপর। কেবল আমলাতন্ত্রের সাহায্যে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি সম্ভব নয়। এর জন্যে প্রয়োজন হয় উপযুক্ত গণসংগঠনের। আমাদের দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে, যে মুক্তিযোদ্ধারা লড়াই করে দেশকে শত্রুকবল
থেকে মুক্ত করল, তাদের দেশপ্রেম ও কর্মশক্তিকে অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের কাজে লাগাতে হবে। এদের সাহায্যে গ্রামবাংলার কৃষি অর্থনীতিতে দ্রুত বিরাট পরিবর্তন আনা সম্ভব।
(ডা, এবনে গোলাম সামাদ রচিত)