বাংলাদেশে সামরিক শক্তি প্রয়োগের সমালোচনাঃ পররাষ্ট্র সচিব হিউম বিবৃত

শিরোনাম সূত্র তারিখ
বাংলাদেশে সাময়িক শক্তি প্রয়োগের সমালোচনাঃ পররাষ্ট্র সচিব হিউম-এর বিবৃতি ও বাংলাদেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি সম্পর্কে বিতর্ক কমনস সভার কার্যবিবরণী ৫ এপ্রিল, ১৯৭১

 

                                             পাকিস্তান

স্যার এলান ডগলাস হিউম, সচিব, বৈদেশিক এবং কমনওয়েলথ বিষয়ক দপ্তরঃ

মাননীয় স্পীকার এবং হাউসের অনুমতিক্রমে আমি পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আবারও আমার বক্তব্য পেশ করতে যাচ্ছি। গত রিপোর্টে হাউসকে আমি যেরকমটা জানিয়েছিলাম,পূর্ব পাকিস্তানে এখনো হানাহানি চলছে।সকল ঘটনা সম্পর্কে আমাদের তথ্য নেওয়া সম্ভব হয়নি,কিন্তু এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই যে,এতে অনেক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে আমরা উৎকণ্ঠারসহিতপাকিস্তানেররাজনৈতিকআলোচনাগুলোরগতিপ্রকৃতিঅবলোকনকরছিলামএবংআমারবন্ধুপ্রতীমমাননীয়“প্রধানমন্ত্রী”, প্রেসিডেন্ট “ইয়াহিয়া খানের” কাছে তাঁর মত প্রকাশ করে বলেছিলেন যে,রাজনৈতিক বৈষম্যগুলো সমঝোতার ভিত্তিতে সমাধান করা উচিত।প্রেসিডেন্ট যে এই বিষয়ের সুরাহা চান সে বিষয়ে আমরা অবগত ছিলাম,আমরা আশা করেছিলাম এই বিষয়ে তিনি সফল হবেন।আমরা এটা ভেবে ভীত হয়েছিলাম যে,কোন ধরণের সংঘাত/উগ্রতা পাকিস্তানের সাংবিধানিক কাঠামোয় স্থায়ী সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।আমাদের পরিতাপের বিষয় এই যে,সকল আলোচনা ভেস্তে গিয়েছিল এবং সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার করা হয়েছিল। আমরা মানুষের প্রাণসংহার ও পাকিস্তানের সর্বস্তরের মানুষের দুর্দশা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তিত ছিলাম এবং পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের একটি বক্তব্যকে স্বাগত জানিয়েছিলাম,সেই বক্তব্যে তিনি(প্রেসিডেন্ট) জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা স্থানান্তরের কথা উল্লেখ করেছিলেন।আমাদের অকপট আশা ছিল যে,এই উদ্দেশ্যটি বাস্তবায়িত হবে। এই বিষয়ে আমি আমার সরকারের অবস্থান পরিষ্কার করে বলতে চাই যে,পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার কোন উদ্দেশ্যই তার সরকারের নেই।পাকিস্তানের জনগণকেই নিজেদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং বাইরের কোন হস্তক্ষেপ পরিস্থিতিকে আরো কঠিন এবং জটিল করে তুলবে। ব্রিটিশ সরকার এবং জনগণ,গত বছর পূর্ব পাকিস্তানের সাইক্লোনপীড়িত মানুষের প্রতি তাদের সহানুভূতির প্রমাণ দিয়েছে।যদি এখনো তাদেরকে এরকম কোন অনুরোধ করা হয়,তারা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের দুর্দশা লাঘবে এগিয়ে আসতে প্রস্তুত। পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত কোন ব্রিটিশ স্থাপনা বা নাগরিক এর কোন ক্ষয়ক্ষতি কিংবা আহত হওয়ার কোন রিপোর্ট আমাদের কাছে আছে কিনা হাউস সেটা জানতে চেয়েছিল,আগের বক্তব্যে উল্লেখিত ঢাকাস্থ ব্রিটিশ কাউন্সিল প্রাঙ্গনে হামলা ছাড়া আর কোন ঘটনা আমরা পাইনি।তবে,দূরবর্তী অঞ্চলের কিছু ব্রিটিশ নাগরিকের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।এমতাবস্থায়,যেসব নারী ও শিশুর এই দেশে অবস্থান করা জরুরি নয়,তাদেরকে ডেপুটি হাইকমিশনার মহাশয় দেশত্যাগের পরামর্শ দিয়েছেন।ফলস্বরূপ, একশ জনের মতো যুক্তরাজ্যের নাগরিক রয়্যাল এয়ার ফোর্স এবং বেসামরিক বিমানে করে ঢাকা ছেড়েছেন এবং আমার সর্বশেষ বক্তব্যের পর থেকে ৪০ জন ব্যাক্তি নৌপথে চট্টগ্রাম ছেড়েছেন। ঢাকায় নিযুক্ত ডেপুটি হাইকমিশনার এবং তাঁর সহকর্মীদের,পূর্ব পাকিস্থানের ব্রিটিশ সম্প্রদায়ের সদস্যবৃন্দ, রয়েল এয়ার ফোর্স এবং বাণিজ্যিক জাহাজের সদস্যবৃন্দকে এমন বিপদজনক অবস্থায়,অত্যন্ত নিষ্টার সাথে এবং ঠান্ডা মাথায় তাঁদের দায়িত্ব পালনের জন্য,তাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। 

মিঃ হিলেঃ কিছুক্ষণ আগে বক্তব্যপ্রদানকারি ভদ্রলোক(জনাব,হিউম),বর্তমান অবস্থার ভূক্তভোগীদের সরকার কর্তৃক ত্রানসামগ্রী দিয়ে সাহায্য করার ইচ্ছার কথা বলেছেন-হাউস তার বক্তব্যকে স্বাগত জানাচ্ছে এবং এর পাশাপাশি ব্রিটিশ নাগরিকদের নিয়ে আসার ব্যাপারকেও হাউস সমর্থন করে।তাঁর(হিউম) পাশাপাশি আমরাও সেই ব্যাক্তিদের সম্মান জানাতে চাই,যারা ঐরকম কঠিন অবস্থায় আটকে পড়া মানুষদের বের করে আসতে সাহায্য করেছিল। পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত নির্বিচারে মানুষহত্যা এবং বাইরের হস্তক্ষেপের ঝুঁকির কথা উল্লেখ করে বলা পূর্ববর্তী বক্তার বক্তব্যের সুত্রানুসারে,আমি দুইটি বিষয়ে দৃষ্টিপাত করতে আগ্রহী।প্রথমত,পূর্ব পাকিস্তানে রক্তপাত তাৎক্ষণিকভাবেবন্ধহওয়াউচিতএবংদ্বিতীয়ত,পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক সমস্যাগুলোর শান্তিপূর্ণ সমাধান,ঐ অঞ্চলের মানুষের মতানুসারে হওয়া উচিত,যে মত সাম্প্রতিককালের নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়েছে। আমি নিশ্চিত যে,এই হাউসের সবাই শেখ মুজিবর রহমান এবং পূর্ব পাকিস্তানের অন্যান্য নেতাদের জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ।আমার আগের বক্তব্যদানকারী ব্যাক্তি কি তাঁদের বর্তমান অবস্থা ও ঠিকানা সম্পর্কিত কোন তথ্য হাউসকে জানাতে পারবেন?হাউসের দুপাশে বসে থাকা সকল সদস্যের ইচ্ছা যে,জনগণ সাম্প্রতিককালে বিপুল ভোটের মাধ্যমে যে প্রতিনিধি নির্বাচন করেছেন,তাঁদেরকে তাঁদের প্রাপ্য মর্যাদা দেওয়া হোক-এই কথাটি তিনি পাকিস্তানের সরকারের কাছে প্রকাশ করবেন এমন নিশ্চয়তা কি তিনি হাউসকে দিতে পারেন? 

স্যার এলেক ডগলাস হিউমঃ আমরা আশা করি রক্তপাত অতি শীঘ্রই বন্ধ হবে।অতি সাম্প্রতিককালে সেখানে নির্বাচন হয়েছে এবং সংবিধান গঠনের জন্য এসেম্বলী আহবান করার কথা ছিল।আমরা আশা করি,এই প্রক্রিয়া আবার শুরু হবে ।আমরাও ন্যায় ও সহানূভূতি দেখানোর পক্ষে কিন্তু আমার পূর্বতন বক্তা(জনাব,হিলে),আমাকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে বলবেন না। 

মিঃ ব্রায়ানঃ যদিও কমনওয়েলথভূক্ত বন্ধুপ্রতীম দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা অনুচিত,পাকিস্তানের অন্যতম প্রধান সমস্যা হল দেশের দু অংশে তীব্র অর্থনৈতিক বৈষম্য-এই বিষয়ে আমার পূর্বতন বক্তা (জনাব,হিউম)অবগত আছেন কি? 

স্যার এলেক ডগলাস হিউমঃ অন্যান্য সকলের মতো,আমিও নিশ্চিত যে,পূর্ব পাকিস্তানের জন্য একটি অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মসূচী প্রয়োজন।আন্তর্জাতিক কোন সংস্থা-যেটি সমস্যাটির সমাধান করবে,তার অংশ হিসেবে আমরা সাহায্য করতে আগ্রহী।যদিও,আমাদের প্রধান লক্ষ্য হল যুদ্ধ বিগ্রহের অবসান ঘটানো এবং দেশটিতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা। 

মিঃ শোরঃ পূর্বতন বক্তা দ্বন্দ্বের নিরসন এবং বন্ধুত্ব পুনঃস্থাপনের জন্য যেসব প্রস্তাব করেছেন,সে প্রস্তাবকে আমরা স্বাগত জানাই।শেখ মুজিবর রহমানের জীবনের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়া সচল রাখার নিমিত্তে নির্বাচিত দলের জনপ্রতিনিধিদের মুক্তি দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা পাকিস্তান সরকারকে বোঝানোর জন্য তিনি কি নতুন কোন বিষয় যোগ করতে চান কিনা সেটা জানতে চাই? 

স্যার এলেক ডগলাস হিউমঃ আমাদের দৃষ্টিতে সেখানে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসা উচিত,এই বক্তব্যের এর চেয়ে বেশি কিছু বলার এখতিয়ার আমার আছে বলে,আমি মনে করি না।এই কথা বলার জন্য রাজনৈতিক আলোচনার প্রয়োজন।আমি ব্রিটিশ সরকারের একজন সদস্য হয়ে, এই ব্যাপারে কি ধরণের আলাপ হওয়া উচিত,সেই সংক্রান্ত কোন আদেশ পাকিস্তানের কোন নাগরিককে দিতে পারি না। 

মিঃ সেন্ট জন স্টেভাসঃ নিরপেক্ষ ও হস্তক্ষেপ না করার ব্যাপারে আমার পূর্বতন বক্তা(জনাব,হিউম) যে ঘোষণা দিয়েছেন,সেটা আমি পুরোপুরি সমর্থন করছি।ভারতসহ অন্যান্য প্রতিবেশী রাস্ট্রের সাথে সদ্ভাব বজায় রাখতে কি আমাদের কি একই নীতি অবলম্বন করা উচিত? 

স্যার এলেক ডগলাস হিউমঃ যতটুকু আমি জানি,ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন যে,পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার কোন উদ্দেশ্য ভারতের নেই এবং ভারতের জনগণকেও এই বিষয়ে মন্তব্য না করার নির্দেশ দিয়েছে।

মিঃ থর্পঃ আমাদের মধ্যে সবাই একমত যে,আমাদের পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়।আমি পূর্বতন বক্তার(জনাব হিউম) কাছে জানতে চাই,কমনওয়েলথ প্রাথমিকভাবে যখন দুপক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতা স্থাপন করতে পারছিল না তখন কেন কমনওয়েলথ এর মহাসচিবের সাহায্য চাওয়া হয়নি? 

স্যার এলেক ডগলাস হিউমঃ এটা অবশ্যই পাকিস্তান সরকারের ব্যাপার,তারা যদি চায় তারা সেটা নিতে পারে। 

মিঃ ডগলাস ম্যানঃ আমার পূর্বতন বক্তা(জনাব হিউম) কি,সমগ্র পাকিস্তানের অবস্থা সম্পর্কে অবগত আছেন? গত কয়েক সপ্তাহের ঘটনার পর,তারা আবার কখনোই কি একীভূত হতে পারবে?তিনি কি আরো অবগত আছেন,যদিও ব্যাপারটি অভ্যন্তরীণ,কিন্তু অন্যান্য দিক বিবেচনায় এই বিষয়টি যৌক্তিক এবং প্রাসঙ্গিক;যা মোটেও খাটো করে দেখার যোগ্য নয়।ব্রিটিশ সরকারের এই ব্যাপারে প্রভাব/ক্ষমতা আছে এবং যুদ্ধবিরতি কার্যকরের লক্ষ্যে ব্রিটিশ সরকারের উচিত এই ক্ষমতা প্রয়োগ করা।আমার পূর্বতন বক্তা কি আরো অবগত আছেন যে,এই হাউসের উভয় পাশের মানুষের এই বিষয়ে মত আছে।যেটার পক্ষে আজকে একশর ও বেশি স্বাক্ষর সংগ্রহ করা হয়েছে,যেটা গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে পাকিস্তানে যুদ্ধবিরতি কার্যকরে ব্যবহৃত হওয়া উচিত। 

স্যার এলেক ডগলাস হিউমঃ অবশ্যই আমি সকল সম্মনিত সুধীজনের অনুরোধ অনুযায়ী কাজ করব।এই ব্যাপারে যতটা সম্ভব করা যায়,আমরা তা করব।আমরা পাকিস্তানের বৈষম্য নিয়ে গভীর দুশ্চিন্তাগ্রস্থ।আমরা বিশ্বাস করি যে,এই বৈষম্য বন্ধ হবে।আমি চাই না,এই বৈষম্য বাইরের কোন হস্তক্ষেপের মাধ্যমে সমাপ্ত হোক,যদিও বাইরের কোন শক্তির পরামর্শের মাধ্যমেও প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হতে পারে।।

Scroll to Top