বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তি সমন্বয় কমিটির নিজস্ব ভূমিকা ব্যাখা করে প্রদত্ত বিবৃতি

<৪,২৩০,৫০৮-৫০৯>

অনুবাদকঃ রায়হান রানা

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৩০। বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তি সমন্বয় কমিটির নিজস্ব ভূমিকা ব্যাখা করে প্রদত্ত বিবৃতি বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তি সমন্বয় কমিটি ১০ আগস্ট, ১৯৭১

 

১০ই আগস্ট ১৯৭১ “বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তি সমন্বয় কমিটি” কর্তৃক নিন্মোক্ত বিবৃতি প্রচারিত  হয়ঃ

আজ যখন একদিকে শত শহীদের রক্তস্নানে বাংলার মুক্তিসংগ্রাম এক নতুন স্তরে উন্নীত হইয়াছে এবং অপরদিকে সাম্রাজ্যবাদ-সামন্তবাদ ও বৃহৎ পুঁজির প্রতিভূ পাক-জঙ্গিশাহী এই মুক্তিসংগ্রামকে নস্যাৎ করিবার জন্য নূতনতন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, ঠিক সেই মুহুর্তে যে প্রশ্নটি বাংলাদেশে মুক্তিসংগ্রামের  সম্মুখে সর্বেপেক্ষা গুরুত্ব লইয়া উপস্থিত হইয়াছে তাহা  হইতেছে বাঙালী জাতির ঐক্যের  প্রশ্ন। গত ১লা জুন সেদিন বাংলাদেশকে দস্যুকবলমুক্ত এবং পরিপূর্নরুপে স্বাধীন করিবার ব্রত লইয়া কতগুলি রাজনৈতিক দল ও সংগঠন একত্রিত হইয়া  “বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম সমন্বয় কমিটি” গঠন করিয়াছিল , সেই দিনই এই ঐক্যের উপর গুরুত্ব দিয়াছিল। ১লা জুনের  ঘোষণায় তাই উল্লেখিত হইয়াছে।

এই সমন্বয় কমিটির আশু লক্ষ্য হইল সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি ও কর্মপদ্ধতির ভিত্তিতে বাংলাদেশ সরকারের ও মুক্তিসংগ্রামরত সকল শক্তির সহিত সংযোগ ও সমন্বয় সাধন করিয়া জাতীয় মুক্তিযুদ্ধকে সাফল্যের পথে অগ্রসর করিয়া লওয়া।

আমরা বিশ্বাস করি বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তিসংরামকে সফল করিয়া তুলিবার জন্য প্রয়োজন সকল দল-মত-ব্যক্তির সমবায়ে গঠিত একটি সুসংহত ও ঐক্যবদ্ধ জাতীয় মুক্তিফ্রন্টের। তাই এই সমন্বয় কমিটির তরফ হইতে আমরা আওয়ামী লীগ সহ স্বাধীনতাকামী অন্যান্য সকল রাজনৈতিক দল, গ্রুপ, গণ-সংগঠন, শ্রেনী-সংগঠন ও দেশপ্রেমিক ব্যক্তিবর্গের নিকট এইরুপ একটি জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গঠনের আহ্বান জানাইতেছি।

কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক যে , যে মুহুর্তে সমন্বয় কমিটির তরফ হইতে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের প্রচেষ্টা করা হইতেছে, সেই মুহুর্তে ‘সমন্বয় কমিটি’র গঠনকে কেন্দ্র করিয়া বিভিন্ন মহল বিভ্রান্তির ধুম্রজাল সৃষ্টি করিতেছে। তাহারা ইহাকে বিভেদাত্নক ও বিভ্রান্তিকর কার্যকলাপ বলিয়া চিত্রটি করিতে প্রয়াস পাইতেছেন।
অথচ আমাদের ঘোষণা হইতে এইরুপ মনে করিবার কোন কারন নাই। ‘সমন্বয় কমিটি’র পূর্নাঙ্গ ঘোষণা সংশ্লিষ্ট সকল মহলকে বহু পূর্বেই প্রেরণ করা হইয়াছিল। তাহা ছাড়া আমাদের এই বক্তব্য লইয়া গত ১লা জুলাই সমন্বয় কমিটির দুইজন প্রতিনিধি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সহিত সাক্ষাৎ করিয়াছেন। ‘সমন্বয় কমিটি’ গঠনের পূর্বে ও পরে সমন্বয় কমিটি পৃথকভাবে ও সমষ্টিগতভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিদের সহিত ব্যক্তিগতভাবে ও আনুষ্ঠানিকভাবে ঐক্যের প্রস্তাব লইয়া আলাপ-আলোচনা করিয়াছেন। সুতরাং ‘সমন্বয় কমিটি’কে কেন্দ্র করিয়া কোন প্রকার বিভেদাত্নক কর্মকান্ড আবিষ্কার করা নিছক কষ্টকল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়। বরং সমন্বয় কমিটি বিরোধী কোন প্রকার মন্তব্য ঐক্যের ক্ষেত্রই বিনষ্ট করবে।

আমরা মনে করি বাংলা স্বাধীনতা লড়াইয়ে অংশগ্রহনের অধিকার প্রত্যেকটি বাঙালী নাগরিকের  আছে। একমাত্র পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর মুষ্টিমেয় দালাল ইহার ব্যতিক্রম। কে ছোট, কে বড়, কে ইয়াহিয়া প্রদত্ত ১৯৭০- এর নির্বাচনে অংশগ্রহন করিইয়াছিল কে করে নাই , কে সেই নির্বাচনে  জয়লাভ করিয়াছে বা পরাজিত  হইয়াছে- সেকথা বড় নয় , বড় হইল বাংলা স্বাধীনতা । সেই স্বাধীনতার উদগ্র আকাংক্ষা লইয়া সমন্বয় কমিটি ইতিমধ্যেই দেশের অভ্যন্তরে নিজের শক্তিও সামর্থ অনুযায়ী জনগণকে সংগঠিত করা, পাকসেনা ও তাহার দালালদের খতম করিবার কাজ  শুরু করিয়াছে। সে সকল এলাকায় এইরুপ কাজ ভাল ভাবে করা গিয়াছে সেইখানেই জনগনের মধ্যে নূতন উৎসাহ সৃষ্টি করা  সম্ভব হইয়াছে, এবং ফলে আরও কিছু রাজনৈতিক গ্রুপ এবং সংগঠন সমন্বয় কমিটির সহিত সংযোগ  স্থাপন  করিয়াছে। সমন্বয় কমিটির উদ্যেগে বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে কৃষক-শ্রমিক ও জঙ্গী সমবায়ে গড়িয়া উঠিয়াছে ছোট ছোট গেরিলা দল ও গেরিলা এলাকা। এই সকল এলাকায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও সমন্বয় কমিটি বহির্ভৃত অন্যান্য রাজনৈতিক দলের কর্মীরাও সমন্বয় কমিটির সহিত ঐক্যবদ্ধভাবে উক্ত প্রচেষ্টায় অংশগ্রহন করিয়াছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কি ঘটিতেছে এবং সমন্বয় কমিটির কাজগুলি কিভাবে চলিতেছে সে সম্পর্কে যাহাদের নূন্যতম ধারণা আছে , তাহারাই জানেন সমন্বয় কমিটির কাজ দেশের অভ্যন্তরে সংগ্রামরত মানুষের মধ্যে ব্যপক ঐক্যের ক্ষেত্র রচনা করিতেছে। তথাপি যেহেতু সমন্বয় কমিটির বিরুদ্ধে কিছু কিছু ভ্রান্ত ধারণা প্রচার করা হইতেছে সেইহেতু কতগুলি প্রশ্নে আমাদের পুনরুক্তি করিতে চাই। প্রথমতঃ সমন্বয় কমিটি কোন জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট নয়। বরং সমন্বয় কমিটির তরফ হইতে জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গঠনের আহবান জানানো হইয়াছে। সেই ফ্রন্টই হল একটি খাঁটি জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট যাহা ছোট-বড় সকল সংগ্রামী শক্তিকেই সংঘবদ্ধ করিতে পারে। দ্বিতীয়তঃ সমন্ব্য় কমিটি  দেশের  অভ্যন্তরে জনগণকে সংগঠিত করিয়া  যে গেরিলা বাহিনী গঠন ও যে গেরিলা যুদ্ধের প্রোগ্রাম উপস্থাপিত  করিয়াছে, তাহা  কোন ক্রমেই  বাংলাদেশের  মুক্তিযুদ্ধের ও  মুক্তিবাহিনীর বিরোধী নয়। আমাদের ১লা জুনের ঘোষণায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে, “ এই গেরিলা যুদ্ধ পরিচালিত হইবে বাংলাদেশের মুক্তিফৌজের সহিত যোগাযোগ রক্ষা ও সমন্বয় সাধনের  মাধ্যমে। ’’ তৃতীয়তঃ এই সমন্বয় কমিটি আওয়ামী লীগ বা অন্য কোন রাজনৈতিক শক্তির বিরোধী কোন শক্তি নয়। সমন্বয় কমিটির  ঘোষণায় প্রতিটি ছত্রে ইহার সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়।

আমরা মনে করি, বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের সকল শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করিতে পারিলেই বিজয়কে সুনিশ্চিত করা যায়। তাই জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে আমরা সর্বপ্রকার দলীয় সংকীর্ণতা পরিহার করিবার জন্য  সকলের নিকট উদাত্ত আহবান জানাইতেছি। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোন প্রকার দলীয় সংকীর্ণ মনোবৃতি খুনী ইয়াহিয়ার হাতকেই শক্তিশালী করিবে। আমাদের তাই শ্লোগান-ঐক্য, একমাত্র ঐক্য, বাংলাদেশের মহান জনতার ব্যপক সংগ্রামী ঐক্যই বিজয়ের চাবিকাঠি। এই ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা অত্যন্ত নিষ্ঠার সহিত কাজ করিয়া যাইতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। কিন্তু আমরা মনে করি, অনুরুপভাবে আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য স্বাধীনতাকামী দলগুলিকে আগাইয়া আসিতে হইবে।

প্রসঙ্গক্রমে আমরা আরও একটি বিষয় সম্পর্কে আমাদের  মতামত সুস্পষ্টভাবে  উল্লেখ করিতে চাই। কিছুদিন ধরিয়া একটি মহল ‘সমন্বয় কমিটি’কে ভারতের রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে জড়িত করিয়া বিভ্রান্তিকর অবস্থার সৃষ্টি করিতে প্রয়াস পাইতেছে। সর্বপ্রকার বিভ্রান্তি নিরসনকল্পে আমরা সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করিতে চাই যে, ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির সাথে আমরা কোন ভাবেই সম্পর্কিত নই এবং সম্পর্কিত হইতেও চাই না। আমরা চাই, ভারত সরকার, ভারতের জনগণ ও ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলসহ পৃথিবীর সকল স্বাধীনতাকামী গনতান্ত্রিক শক্তিই স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠনের সংগ্রামে আমাদের সর্বপ্রকার সাহায্য করুক। যে-কোন মহল হইতে এই ধরনের যে কোন শর্তহীন সাহায্যে আমরা
কৃতজ্ঞতা সহকারে গ্রহন করিব।

Scroll to Top