বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর উদ্দেশ্যে প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম, এ, জি, ওসমানীর ভাষণ

শিরোনামসূত্রতারিখ
৯। বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর উদ্যেশ্য প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম এ জি ওসমানীর ভাষণবাংলাদেশ আর্কাইভস মুজিবনগর২৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

 

ট্রান্সলেটেড বাইঃ Razibul Bari Palash

<১১, , ১৮৪-১৮৯>

 

বাংলাদেশ ফোর্সেস হেডকোয়ার্টার, মুজিবনগর

জনসংযোগ বিভাগ

২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

 

প্রতি

বার্তা সম্পাদক,

বাংলাদেশ আর্কাইভস

 

স্যার

কর্নেল MAG ওসমানী পিএলসি এমএনএ, বাংলাদেশ বাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ (মুক্তিবাহিনী) আজ রাতে জাতি এবং মুক্তিবাহিনীর লোকদের উদ্যেশ্যে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ভাষণ দেবেন। টেক্সট টু স্পিচ আপনার নিউজ পেপারে প্রকাশনার জন্য অগ্রগামী করা হল। এই টেক্সট সক্রিয় ব্রডকাস্ট করার পূর্ব পর্যন্ত গোপনীয় হিসাবে গণ্য করবেন।

 

 

 

ধন্যবাদান্তে

বিনীত

স্বা /-নজরুল ইসলাম

জনসংযোগ কর্মকর্তা

বাংলাদেশ বাহিনী।

 

 

রেডিও টক এর টেক্সট

কর্নেল আতাউল গণি ওসমানী, পি এস সি, এম এন এ,

কমান্ডার ইন চিফ বাংলাদেশ বাহিনী (‘মুক্তিবাহিনী’)

 

দেশে এবং বিদেশে অবস্থানরত আমার শ্রদ্ধেয় দেশবাসী,

 

আজ আমাদের উপর আরোপিত যুদ্ধের ৬ মাস পূর্ণ হল। বাংলাদেশ বাহিনীর (‘মুক্তিবাহিনী’) কমান্ডার-ইন-চিফ হিসেবে আমি আপনাদের সাহসী ছেলেদের নিয়ে গঠিত এই বাহিনীর পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। এই বাহিনী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করছে। ৭ ডিসেম্বর ১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচনে আপনারা যাদের উপর বিশ্বাস ও আস্থা অর্পন করেছেন এই সরকার তাদের নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে।

 

 

আপনারা দেশের কর্তা এবং আমরা আপনারদের সেবায় আপনাদের মানবাধিকার ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছি।

 

 

মানবাধিকার ও সার্বভৌমত্বের প্রতি দখলদার সেনাদের এই হুমকি জাতিসংঘ মানবাধিকার জাতিসংঘ চার্টারের ঘোর লঙ্ঘন। এবং ২৩ শে মার্চ ১৯৪০ সালের লাহোর রেজোল্যুশনের লঙ্ঘন-যেখানে বলা ছিল এই দুইটি অঞ্চল স্বাধীন ও সার্বভৌম ভাবে তাদের নিজ নিজ অংশ পরিচালনা করবে। এই মত ১৯৪৬ সালে সাধারণ নির্বাচনে মানুষের দ্বারা অনুমোদিত হয় এবং আর কখনো সংশোধিত হয়নি। বাংলাদেশের জনগণ ধারাবাহিকভাবে এই উপনিবেশবাদদের অনিষ্ট থেকে নিজেদের মুক্ত করার জন্য লড়াই করে যাচ্ছে। কিন্তু এই উপনিবেশবাদ পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকেরা আরও আঁকড়ে ধরে আছেন। অবশেষে, ইয়াহিয়ার সামরিক প্রশাসন বেয়নেটের খোঁচায় প্রথমবারের মতো সাধারণ পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত হল, ৭ ডিসেম্বর ১৯৭০ সালে। এতে বাংলাদেশের মানুষ ৯৯% ভোট দেয় এবং ভোটের ৮০% বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার দল আওয়ামী লীগ পায়-যারা অন্যায় শাসন ও উপনিবেশবাদের কবল থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করতে চায়।

 

আওয়ামী লীগ সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। আমাদের স্বাধীনতা প্রেমী মানুষ পরম শান্তি লাভ করে এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হিসাবে এটি সর্বজন প্রশংসিত হয়েছিল। কিন্তু ফলাফল সামরিক জান্তাকে অবাক করে। তাড়া হিসাবে ভুল করেছিল। তারা ভেবেছিল আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে ৬০% ভোট পাবে আর বাকি ৪০% এবং পশ্চিম পাকিস্তানের ভোট নিয়ে তারা সহজেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে যাবে। তারপর কী হল? জনাব ভুট্টো তার হাত প্রয়োগ করলেন। গণতন্ত্রের চর্চা এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ার প্রতি চরম অসম্মান করে তিনি তিনি ঢাকায় ৩রা মার্চ ১৯৭১ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অংশ গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন। এবং অধিবেশনের সহিংসতার হুমকি স্থগিত করা হয় নি। তাঁর হুমকি সামরিক শাসকদের দ্বারা সম্মান করা হতো। অধিবেশন স্থগিতের এই অনাহূত ঘটনায় জনগন অসন্তোষ প্রকাশ করে ও তাদের উপর বুলেট চালানো হয়। বাংলাদেশের জনগণ তারপর শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য অহিংস ও অসহযোগ আন্দোলনের আশ্রয় নেয়। এবং তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের উপর তাদের আস্থা প্রকাশ করছিল। জনাব ভুট্টো তখন কৌশলী প্রস্তাব দিলেন যে ক্ষমতার বণ্টন যে যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ তাকে সেখানে দেয়া হবে। এটা স্পষ্ট যে বাঙালির কাছে যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের কাছে তাদের কোন গ্রহণযোগ্যতা নেই-এর উল্টোটাও প্রযোজ্য। আর্থ-সামাজিক সমস্যা, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ক্রমাগত ঘনীভূত হতে থাকে। সাথে অনিশ্চিত হয়ে পড়ে পূর্ব পাকিস্তানের লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন ও ভবিষ্যৎ। পূর্ব পাকিস্তানের মুখপাত্র শেখ মুজিবুর রহমান এবং আওয়ামী লীগে এই অচলাবস্থার একটি দ্রুত রাজনৈতিক সমাধান চেয়েছিলেন এবং পরামর্শের ভিত্তিতে ক্ষমতার পৃথক বণ্টনের জন্য ভুট্টোকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন। জেনারেল ইয়াহিয়া আওয়ামী লীগের অন্তর্বর্তী সরকার ব্যবস্থার প্রস্তাবের সাথে একমত হন (তিনি ২৬ মার্চ ১৯৭১ যৌথভাবে এটি সম্প্রচারের সিদ্ধান্ত নেন)। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসকরা এটা চায়নি। ভুট্টো চতুরভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাধান্য এবং অবস্থিত পাকবাহিনীর ক্ষমতা ধরে রাখার আয়োজন করেন-যা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা মেনে নিতে পারেননি। যখন এসব কর্মকান্ড চলছিল তখন হঠাত করে কয়েক ঘণ্টার ব্যাবধানে বিমান ও জাহাজে করে প্রচুর সৈন্য আসতে থাকে এবং ইয়াহিয়া ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা ত্যাগ করেন। মধ্যরাত্রির দিকে ইয়াহিয়ার পশ্চিম পাকিস্তানী বাহিনী যুদ্ধাপরাধের দামামা বাজাতে শুরু করে। শেখ মুজিবের বাড়িতে মেশিনগান ও অন্যান্য স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে আক্রমণ করে এবং তাকে গ্রেফতার করা হয়। আমার নিজের ঘর মেশিনগান ফায়ারে ভেঙে দেয়া হয়। সৌভাগ্যক্রমে আমি পালাতে সক্ষম হই। তারপর তাদের বেলেল্লাপনা শুরু হল। সেই রাতে ঢাকা শহরে হাজার হাজার নারী, পুরুষ ও শিশুদের নিহত কর হয়। অঘোষিত গণহত্যা, আগ্রাসন মধ্যে, সে রাতে যখন শিক্ষাবিদ, দার্শনিক, বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, মেধাবী ও প্রতিশ্রুতিশীল যুবক (যারা আগামীর ভবিষ্যৎ), শ্রমিক, দরিদ্র রুটি উপার্জনকারী, মায়ের কোলে শিশু, নিরস্ত্র বাঙালি অফিসার ও নিয়মিত বাহিনীর লোকেদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়-বোঝা যায় যে এটি ছিল সুপরিকল্পিত। হিন্দু নারীসহ অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদেরকে তারা ধর্ষণ ও হত্যা করে এবং নগ্ন করে হাঁটতে বলে। উপাসনালয় ধ্বংস, গ্রামীণ বসতবাড়িতে এবং ফসলে আগুণ এবং জেনেভা কনভেনশনের হিউম্যান রাইটস চার্টার এ সন্নিবেশিত সবকিছুকে অবজ্ঞা করে তারা মানব ইতিহাসের সবচেয়ে নৃশংস ও জঘন্য গণহত্যা ও ধংস পরিচালনা করে। শাসকদের লক্ষ্য ছিল বাঙ্গালী নামের যে জাতিসত্তা বিরাজমান তাকে বিলুপ্ত করা, বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব পঙ্গু করে দেয়া ও লড়াইয়ের সামর্থ্য এবং বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্ন দেখার সম্ভাবনাকে নিছক অস্ত্রের মুখে চিরদিনের জন্য ধ্বংস করে দেয়া।

 

এই গণহত্যা ও নগ্ন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে শান্তিকামী সাহসী বাঙ্গালীরা জেগে ওঠে। ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামের এবং স্বাধীনতা অর্জন করার জন্য আত্মত্যাগের অসামান্য উদাহরণ দিতে থাকে। বেসামরিক নাগরিক, চাকুরীজীবী সবাই আমাদের মানবাধিকার আদায়ের লক্ষে একসঙ্গে দাঁড়িয়ে যায়। তারা আমাদের নারীদের সম্মান, আমাদের বুদ্ধিজীবি, যুবক ও শিশুদের জীবন রক্ষার জন্য লড়াই শুরু করে। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের (বেঙ্গল টাইগার) এর সাহসী লোক, তাদের মধ্যে যারা খুব সাহসী আইআর অফিসারদের নেতৃত্বে ছিল তাদের ঘুমন্ত অবস্থায় গুলি করে হত্যা করা হয়েছে, নিরস্ত্র করে লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করা হয়েছে। অনেকে কোন ভাবে গুলি থেকে বেঁচে যান, যাদের অনেকে পশ্চিম পাকিস্তানের-বিশেষভাবে লাহোরের যারা ১৯৬৫ সালের তাণ্ডবে তাদের বাড়িগুলো রক্ষা পায়। সাবেক পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের (ইপিআর) অনেকে-যারা পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর কাছ থেকে পালাতে পেরেছে তারা নিয়মিত বাহিনীতে যোগদান করেন। ২৬ শে মার্চ প্রথম প্রহরে সাধারণ বাঙ্গালী পুলিশের ওপর মাঝারি ট্যাঙ্ক দিয়ে আক্রমণ করা হয়। ভাগ্য বিপক্ষে থাকলেও তারা প্রায় ৪ ঘন্টা ঘরে যুদ্ধ চালিয়ে যায়। পরে তারা পিছিয়ে যায় এবং বাংলাদেশের নিরস্ত্র বাঙ্গালীকে রক্ষা করছিলে এমন দলে যুক্ত হয়ে যায়। দেশের অন্যান্য এলাকাতেও পুলিশরা একই কাজ করেন। এরা সবাই দ্রুত পুনঃসজ্জিত হয় এবং বিভিন্ন জায়গাতে নেতৃত্ব দেয়া শুরু করে যেখানে সৈন্য, মাঝি, এয়ারম্যানসহ বিভিন্ন ধরনের লোকের অংশগ্রহণ ছিল। তাই এই বাহিনীকে মুক্তি বাহিনী (সেনাবাহিনী নয়) নাম দেয়া হয়েছিল। বাংলাদেশ ফোর্সের নিয়মিত বাহিনী ছাড়াও অনিয়মত বাহিনী নিয়ে গন বাহিনী তৈরি করা হয়। এই বাহিনীতে বিভিন্ন এলাকা থেকে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ-উচ্চশিক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, সাধারণ ছাত্র, শিল্প শ্রমিক ও কৃষক যোগ দেয়। এদের সবার উদ্দেশ্য ছিল হানাদার বাহিনীর ধ্বংসলীলা বন্ধ করা এবং আমাদের জনগণের মানবাধিকার রক্ষার জন্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া। অবস্থা বুঝে যুদ্ধ কৌশল বারবার পরিবর্তন করা হয়েছে। আপনারা জেনে আশ্চর্য হবেন যে আমাদের সাহসী ছেলেরা যুদ্ধে সফলতার একটি রেকর্ড প্রতিষ্ঠা করেছে। তারা নিজেদের চেয়ে সংখ্যা ও শক্তিতে বড় শত্রুসেনাদের সাথে দৃঢ় প্রত্যয়ে ভয়ানক লড়াই চালিয়ে গেছে। তাদের ডেডিকেশন, লক্ষ্য ও সাহসের সাথে লড়াই করে প্রচুর হতাহত হয়ছে-আজ পর্যন্ত যার সংখ্যা ২৫০০০ এরও বেশী। শত্রুরা আমাদের নিরস্ত্র লোক, অসহায় নারী ও নিষ্পাপ শিশুদের বিরুদ্ধে অত্যাধুনিক আধুনিক অস্ত্র ব্যবহারে করেছে, স্বামীদের হত্যা করার পর নারীদের ধর্ষণ, মায়ের উপস্থিতিতে শিশু হত্যা, এত সুনিপুনভাবে চালিয়েছে যাতে করে মনে হয় তারা স্রিস্টিকর্তার বিচারে বিশ্বাস করেনা। তবুও তারা মুভ করতে ভয় পেত। তাদের চলার পথে সামনে পেছনে তারা বাঙ্গালীকে রাখত। তবুও তারা মুক্তিবাহিনী থেকে নিজেদের নিরাপদ মনে করছিলোনা। সাহসী মুক্তিবাহিনীর প্রতি আমার আদেশ থাকবে তারা যেন শত্রুদের সহযোগীদের অতি সত্তর আটক করে এবং মুক্তি বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পনে বাধ্য করে। তাদের কেউ যদি মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করতে চায় তবে তাঁর সাথে ভালো আচরণ করা হবে। এবং তারা যেন মুক্তিবাহিনীর কার্যক্রম খুবই গোপন রাখে।

 

বাংলাদেশ ফোর্সে নিয়মিত বীর যোদ্ধাদের নিয়ে ‘মুক্তিবাহিনী’ এবং সাধারণ নাগরিকদের নিয়ে গঠিত ‘গন বাহিনী’কে আমি আমার আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। আমাদের শত্রুরা আমেরিকা ও চীন থেকে আধুনিক জেট বিমান, ভারী বন্দুক ও অত্যাধুনিক অস্ত্র পেয়েছে। কিন্তু আমাদের পাশে আছে আমাদের সততা ও ন্যায়পরায়ণতা। ভয়ানক সংকল্প ও বীরত্বের সঙ্গে, তারা যুদ্ধক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করছে।

 

 

অনেক শহীদের হয়েছে, অনেক আহত বা অক্ষম হয়েছে কিন্তু আপনারা শত্রুপক্ষে এর চেয়ে ৪০ গুণ বেশি হতাহতের করেছেন। আপনারা বাংলাদেশের শহর ও জেলা শহর থেকে অর্থনৈতিক সম্পদ গ্রহণ থেকে তাদের ঠেকিয়েছেন। এই মুহূর্তে তাদের আমাদের অর্থনৈতিক সম্পদ নিয়ে যাওয়া সম্পূর্ণ বন্ধ আছে। শত্রুদের রসদ বহনকারী প্রায় ১৫ টি নৌকা সফলভাবে ধ্বংস করা হয়েছে। আপনাদের বীরত্বের পুরস্কার হিসাবে সরকার ও কমান্ডারগণ চার রকমের পুরস্কার দেবার কথা সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে আছে:-

 

ক। সর্বোচ্চ মানসম্পন্ন-নগদ ১০০০০ রুপি

খ খুব উচ্চ মানসম্পন্ন-৫০০০ রুপি

গ প্রশংসনীয় মান-২০০০ রুপি

ঘ। বীরত্বের স্বীকৃতি সরূপ সনদপত্র

 

দ্বিতীয়ত, কমান্ডাররা ঘোষণা করেছেন যারা নিহত হবে তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে তাৎক্ষণিক নগদ ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে এবং সরকার তাদের বাসস্থান ও খাদ্যের ব্যাবস্থা করবে। যুদ্ধের পর তাদের একটি মাসিক অনুদান দেওয়া হবে। যারা শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী হবে তাদের সমাজে পুনর্বাসন করার ব্যাবস্থা করা হবে।

 

যেকোন পরিস্থিতে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। যত দ্রুত সম্বভ অমানবিক, বর্বর, অধার্মিক শত্রুদের ধ্বংস করতে হবে। এইজন্য দেশের সকল নাগরিককে ঝাঁপিয়ে পরতে হবে। যে সকল বাঙালি কর্মকর্তা, সৈন্য, নাবিক, এয়ারম্যান, শ্রমিক, ছাত্র ও যুবক (শরণার্থী শিবির আছে সেগুলিসহ) এখনো যুদ্ধে নামেননি তাদের অতি সত্তর সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার অনুরোধ করছি। মনে রাখবেন এই যুদ্ধ সত্য ও ন্যায়ের জন্য যুদ্ধ, দেশ রক্ষার জন্য এবং আমাদের মা-বোনদের ধর্ষণ ও দেশের সম্পদ লুণ্ঠন ঠেকানোর জন্য যুদ্ধ।

 

 

বিদেশে আমাদের প্রবাসীরা যারা আমাদের দেশের মুক্তিযুদ্ধ, গণহত্যা, নির্যাতনের ব্যাপারে ওইসব দেশকে সচেতন ও এগিয়ে আসার আবেদন করেছেন আমি তাদেরকেও আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। এছাড়া তাদের আর্থিক সহায়তার জন্যও ধন্যবাদ জ্ঞ্যাপন করছি। আমি আপনাদের সাহায্যের হাত আরও প্রসারিত করার অনুরোধ জানাই এবং পাশাপাশি এই অনুরোধ করি যে আমাদের পরামর্শ ছাড়া কোথাও খরচ করবেন না। এভাবে যদি আমরা চলতে পারি তাহলে আমাদের বিজয়ের ক্ষণ দ্রুততর হবে।

 

যুদ্ধে জয়ের জন্য আমাদের তিনটি জিনিসের প্রতি দৃষ্টি দিতে হবে-

 

১। বিশ্বাস-স্রস্টার বিচারে বিশ্বাস রাখতে হবে। ন্যায়বিচার ও সত্যে সবসময় জয়লাভ করেছে। এবং নিজের উপর বিশ্বাস রাখুন-তাতে কোন বাঁধাই আপনাদের কাছে কঠিন মনে হবেনা। এবং অবশ্যই আপনারা বিজয় লাভ করবেন।

 

২। দৃঢ় লক্ষ্য-যে কোন মূল্যে সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর বিজয় ছিনিয়ে আনতে হবে।

 

৩। নিস্বার্থ এবং সবল প্রচেষ্টা-যুদ্ধে জেতার জন্য এর প্রয়োজনীয়তা অসীম-কারণ এখানে প্রচুর ক্ষয় ক্ষতির সম্ভবনা থাকে। আমাদের ব্যাক্তিগত ও সমষ্টিগত ভাবে এর জন্য কাজ করে যেতে হবে। তাতে আমাদের ব্যাক্তিগত রাজনৈতিক মতাদর্শ যাই থাকুক। দিনরাত পরিকল্পনা মাফিক প্রস্তুতি নিয়ে শত্রুদের আঘাত করতে হবে এবং ধ্বংস করতে হবে। শেষ শত্রুটি জীবিত থাকা পর্যন্ত আমাদের লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। মনে রাখতে হবে যে শত্রুরা আমাদের মাঝে বিভক্তির সৃষ্টি করার চেষ্টা করবে। জাতিগত বিভেদ সৃষ্টি করবে। আমাদের বন্ধু রাষ্ট্রের কাছে আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট করার চেষ্টা করবে। আমাদের সেটা পাহারা দিয়ে রাখতে হবে।

 

আমাদের লাখ লাখ মানুষ দমন বাহিনী দ্বারা উচ্ছেদ হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। ভারতের নিজস্ব অর্থনৈতিক সমস্যা সত্ত্বেও, সরকার উদার ভাবে তাদের গ্রহণ করেছে এবং সাময়িকভাবে তাদের দেখাশোনা করছে-এইজন্য আমি ভারতের সরকার ও জনগণের কাছে কৃতজ্ঞ। এই শরণার্থী শিবিরে আমাদের মানুষ আশ্বস্ত থাকতে পারে যে আমরা তাদের জীবন্ত বাড়িতে ফিরে আসা দেখতে পাব।

 

বাংলাদেশ এর জনগণ এখন যুদ্ধে লিপ্ত। আমাদিগের এটি একটি জাতীয় যুদ্ধ যাতে সমগ্র জাতি, রাজনৈতিক বিশ্বাসের, শ্রেণী, ধর্মবিশ্বাস-সব মিলে নির্বিশেষে একাত্ম হয়েছে। তাদের আদর্শ ইস্পাতের মত শক্তিশালী। আমরা নৈতিকতা বর্জিত অধার্মিক শত্রুকে আমাদের বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত করে যেকোণ মূল্যে দেশ স্বাধীন করব।

 

 

আমাদের প্রিয় ও মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিঃশর্ত মুক্তি, সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং পশ্চিম পাকিস্তানী সেনা প্রত্যাহার-এর সাথে কোন আপোস করা হবেনা।

 

তাই আপনার যেখানেই থাকুন না কেন-নদী, হ্রদ, ক্ষেত, এবং দুর্গম গ্রাম, নদীমাতৃক জনপথ, সড়ক রুট, গ্রামীণ বাজার, শিল্পকেন্দ্র, শহর ও উপশহর-শত্রুদের উপর কঠোর আঘাত করুন। যা আছে তাই দিয়ে তাদের ধ্বংস করুন। প্রিয় দেশবাসী আপনারা এগিয়ে আসুন। আমাদের দেশের নারী পুরুষ-প্রত্যেকের জীবন ও আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিরাপত্তা-সন কিছু বিবেচনায় নিয়ে ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য এগিয়ে আসুন।

 

 

উপসংহার, আমি মহান বাঙালি কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর কবিতার লাইন দিয়ে শেষ করতে চাই-

“Striking at the doors of dawn

We shall bring a brighter mom

Singing the song of youth

We shall bring life to the value of desolation

We shall give spirit anew

With vigor of arms anew”

 

 

জয় বাংলা