বাইবেল পাঠ ও আলোচনা
…..নভেম্বর, ১৯৭১
আজ আমরা আলোচনা করব যীশুখ্রষ্টের মৃত্যু সম্পর্কে। প্রথমেই পবিত্র বাইবেল শাস্ত্র থেকে কটি অংশ পাঠ করে নেই।
* * * * “প্রভাত হইলে প্রধান যাজকেরা ও লোকদের প্রাচীনবর্গ সকলে যীশুকে বধ করিবার নিমিত্ত তাঁহার বিপক্ষে মন্ত্রণা করিল; আর তাঁহাকে বধিয়া লইয়া গিয়া দেশাধ্যক্ষ পীলাতের নিকটে সমর্পণ করিল।”
“তখন পীলাত যীশুকে লইয়া কোড়া প্রহার করাইলেন । আর সেনারা কাঁটার মুকুট গাঁথিয়া তাঁহার মস্তকে দিল এবং তাঁহাকে বেগুনিয়া কাপড় পরাইল, ……তখন পীলাত আবার বাহিরে গেলেন ও লোকদিগকে কহিলেন, দেখ, আমি ইহাকে তোমাদের কাছে বাহিরে আনিলাম, যেন তোমরা জানিতে পার যে, আমি ইহার কোনই দোষ পাইতেছি না। …তখন যীশুকে দেখিয়াই প্রধান যাজকেরা ও পদাতিকেরা চেচাইয়া বলিল, উহাকে ক্রুশে দেও, উহাকে ক্ৰশে দেও। …পীলাত তাহাদিগকে কহিলেন, তোমাদের রাজাকে কি ক্ৰশে দিব? প্রধান যাজকেরা উত্তর করিল, কৈসর ছাড়া আমাদের অন্য রাজা নাই। তখন তিনি যীশুকে তাহাদের হস্তে সমর্পণ করিলেন, যেন তাঁহাকে ক্রুশে দেওয়া হয়।”
একথা বললে ভুল হবে না যে, জগতে যীশুখ্রীষ্টের আবির্ভাব ছিল ঈশ্বর-নিরূপিত। যীশু জগতে এসেছিলেন মানুষকে তার পাপের অন্ধকার থেকে পুণ্যের আলোক-সরণীতে পৌঁছে দিতে। তিনি এসেছিলেন মানুষকে পাপ থেকে পরিত্রাণ দেবার জন্য- মুক্তির পথ দেখাবার জন্য। তিনি বলেছিলেন, মানুষকে আমিই পথ, সত্য ও জীবন- আমাতেই তোমরা পরিত্রাণ পাবে। বলেছিলেনঃ সৎ হও, পবিত্র জীবনযাপন কর; কারণ তোমাদের স্বৰ্গস্থ পিতা ঈশ্বর পবিত্র। আহবান জানিয়েছিলেন, “হে পরিশ্রান্ত ভারাক্রান্ত লোকসকল, আমার নিকটে এসো, আমি তোমাদের শান্তি দেব।’ তাঁর সমস্ত বক্তব্য ছিল মানুষের শুভবুদ্ধির কাছে। জীবনভর তিনি অশুভ শক্তির সাথে যুদ্ধ করেছিলেন। তাই সামাজিক প্রভুত্বের ক্ষমতালোভী যাজক-পুরোহিত ও গোঁড়াদের বিরুদ্ধে তিনি সর্বদা প্রতিবাদ করেছেন। কারণ, এই সমস্ত ভণ্ড ধর্মগুরুরাই তখন মানুষকে এক মহাভ্রান্তির পথে ঠেলে দিয়েছিল নিজেদের বৈষয়িক স্বার্থে। এরাই নিজেদের কুটিল চক্রান্তে শাস্ত্রের ভুল ব্যাখ্যা করে, ঈশ্বর ও মানুষের মধ্যে নিজেদেরকে মধ্যস্থ ব্যক্তিরূপে বসাতে সক্ষম হয়েছিল। ফলে মানুষ তখনকার দিনে সরাসরি ঈশ্বরের চরণে নিজেকে সমর্পণ করতে পারতো না। আসতো ঐসব যাজকদের কাছে।
কিন্তু খ্ৰীষ্ট এসে মানুষকে দেখালেন প্রকৃত সত্যকে। কারণ, পাপী মানুষের প্রতি তাঁর ছিল অসীম সমমৰ্মিতা। মানুষকে ভালোবেসে তাই তিনি স্বর্গ ছেড়ে মাটিতে এসেছিলেন মানুষের অতি কাছে। এর ফলে পুরোহিত সম্প্রদায় ভিন্ন সকলের কাছে তিনি শুধু আপন হয়েই ওঠেননি- সকলের হৃদয়ে তাঁর জন্য পাতা হয়েছিল শ্রদ্ধার আসন। সকলেই তাঁর ধর্ম উপদেশ শুনতে ভালোবাসত। সকলেই তাঁকে প্রকৃত ধর্মগুরু হিসাবে গ্রহণ করেছিল।
কিন্তু পুরোহিত-তন্ত্র সেদিন এ ব্যাপারে সন্তুষ্ট হতে পারেনি। তারা তখন সর্বদাই যীশুর বিরুদ্ধে অপপ্রচার করেছে। তাঁর দোষ ধরতে চেষ্টা করেছে, তাঁকে জনসমাজে-অপদস্থ করতে সচেষ্ট হয়েছে। কিন্তু সমস্ত চেষ্টা তাদের ব্যর্থ হয়ে গেল। তখন হিংসায় উন্মত্ত হয়ে তারা যীশুর প্রাণনাশের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে মেতে উঠলো। আজও যেমন সুবিধাবাদী, বিশ্বাসঘাতকের অভাব নেই, সেদিনও অভাব হয়নি। যীশুর বারোজন শিষ্যের একজন এসে যোদ দিল এই ষড়যন্ত্রে- শুধুমাত্র অর্থের প্রলোভনে।
এই বিশ্বাসঘাতক শিষ্যের সাহায্যে চক্রান্তকারীরা লোকচক্ষুর আড়ালে রাতের অন্ধকারে গেৎশিমানী বাগান থেকে যীশুকে বন্দী করল। ভাবতে অবাক লাগে, যে মানুষ পিতা ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করবার জন্য বিচারকের কাছে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হল- এ ব্যক্তি ঈশ্বর-নিন্দুক, কারণ এ নিজেকে ঈশ্বরের পুত্র বলে দাবী করে। আরও অভিযোগ করা হল, এ ব্যক্তি রাজদ্রোহী, কারণ এ নিজেকে যিহুদীদের ইব্রীয়দের রাজা বলে ঘোষণা করেছে। বলা বাহুল্য, সে সময় সমগ্র প্যালেস্টাইন দেশ রোম-সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। যাহোক, যীশুর বিরুদ্ধে যে সমস্ত অভিযোগ আনা হয়েছিল তার জন্য পুরোহিত-তন্ত্র হাজির করেছিল বহু মিথ্যা সাক্ষীকে। রোম সম্রাটের প্রতিনিধি ছিলেন দেশাধ্যক্ষ পীলাত। তার সামনে চলল এক বিচারের প্রহসন। তিনিও বুঝলেন যাজকরা হিংসার বশে যীশুর বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ তুলেছে। বুঝলেন, ধর্মীয় নেতার বিরুদ্ধে এনেছে রাজদ্রোহিতার
অভিযোগ- যাকে অবজ্ঞা করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। সে যুগে পুরোহিততন্ত্রের প্রভাব ও ক্ষমতা ছিল বিস্তৃত। তারা পীলাতকে ভয় দেখাল যে, যদি পীলাত যীশুর বিচার না করে তবে তিনি রোম সম্রাটের প্রকৃত বন্ধু নন।
পরিশেষে পীলাত নিজের ভালো দেখলেন। চাইলেন তার বিরুদ্ধে যেন সম্রাটের কাছে কোন নালিশ না যায়। তাই তার বিচার প্রহসনে দাঁড়িয়ে গেল। সাক্ষ্য-প্রমাণ ছাড়াই বিচার বিচার খেলাটা শেষ হয়ে গেল। প্রকাশ করা হল রায়- ঐ ব্যক্তিকে চরম দণ্ড দেওয়া হল। না, ফাঁসী নয়- আরও নির্মম, নৃশংস ও লাঞ্ছনার মৃত্যুদণ্ডাদেশ-ক্রুশীয় মৃত্যু। হাতে, পায়ে পেরেক গেথে ক্রুশকাঠে ঝুলিয়ে যীশুকে হত্যা করা হল- যিনি ছিলেন নিরপরাধ, নিষ্কলঙ্ক, নিষ্পাপ ব্যক্তি। যিনি এসেছিলেন মানুষের ধর্মীয় পরিমণ্ডলের শুচিতা, শুভ্রতা ফিরিয়ে আনতে। যিনি এসেছিলেন মানুষকে পাপ থেকে উদ্ধার করে অনন্ত, অমৃত জীবনের সন্ধান দিতে।
এখন প্রশ্ন হল, তাঁর মৃত্যুতেই কি সব শেষ হয়ে গেল? তিনি কি হেরে গেলেন পাপী প্রতিক্রিয়াশীল পুরোহিত-তন্ত্রের কাছে? তাঁর মৃত্যু কি তাঁর সাথে মানুষের চিরবিচ্ছেদ ঘটিয়ে দিল? না। এর উত্তরে অসংকোচে বলা যাবে, তা নয়। অন্ধকারের পরে আসে আলো- এটা বিতর্কিত নয় কিন্তু প্রাকৃতিক সত্য। যীশু প্রমাণ করলেন মৃত্যুর পরে তেমনি আসে পুনরুত্থান। মৃত্যুর তিন দিন পর কবর থেকে অমোঘ মৃত্যুকে পরাজিত করে তিনি পুনরুখিত হলেন। তাঁর পুনরুত্থান তার প্রতি বিশ্বাসী মানুষকে পাপ থেকে পরিত্রাণ দিল। মানুষকে বললেন, আমাকে বিশ্বাস কর। বললেনঃ ভয় নেই আমি আছি, আমি তোমাদের শক্তি দেব। সমস্ত অন্যায়ের বিরুদ্ধে তোমরা যুদ্ধ কর, সমস্ত অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর- পরাজিত হবে না। আমার মতো বিজয়ী হবে। পাপের সাথে যুদ্ধ কর-অবশ্যই তোমরা পাপকে জয় করতে পারবে। কারণ, আমি তোমাদের পরিত্রাণ কর্তাতোমাদের শক্তিদাতা। মৃত্যুকেও তোমরা জয় করবে, আমার মতো মৃত্যুঞ্জয়ী হবে- ঈশ্বরের রাজ্যে, অনন্ত জীবনের দেশে তোমরা পৌছাতে পারবে। তখন অনায়াসেই বলতে পারবে- মৃত্যু, তুমি নাই।
কবির ভাষায়ঃ
“মেঘ ঢেকে কেঊ করিস নে ভয়,
আড়ালে তার সূর্য হাসে।”
(ডেভিড দাস রচিত)