শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
বাঙালীরা রুখে দাঁড়িয়েছে | নিউজ উইক | ১৯ জুলাই, ১৯৭১ |
নীতেশ বড়ুয়া
<১৪, ৬৮, ১৫৫-১৫৬>
নিউজ উইক- ১৯শে জুলাই, ১৯৭১
বাঙালীরা রুখে দাঁড়িয়েছে
“আমি আনন্দের সাথে আপনাদেরকে জানাচ্ছি” এইভাবে জাতির উদ্দেশ্যে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করেন যে “ পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতির উপর সেনাবাহিনীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আছে। এরা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী দুর্বৃত্ত, অন্তর্ঘাতী, অনুপ্রবেশকারীদের বিনাশ করেছে।” ইয়াহিয়ার প্রতি আফসোস , বাস্তবতা কিন্তু ভিন্ন কথা বলছে। সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে দেখা যাচ্ছে যুদ্ধরত বাঙালীদের প্রতিরোধ আন্দোলন আগের যেকোন কিছুর চাইতে আরও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এইটা প্রমাণ করতে যে এই আন্দোলন এখনও ভাল মতোই চলছে এবং ক্রমান্বয়ে ছড়িয়ে পরা ভারী অস্ত্রে সজ্জিত দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জীবনকে আরও জটিল করে তোলার ক্ষমতা রাখে।
পাকিস্তানের বিধ্বস্ত সমগ্র পূর্বাঞ্চল জুড়ে পুনুরুজ্জীবিত বিদ্রোহী দল নিঃশর্ত ভাবে তাদের অস্তিত্বকে জানান দিয়েছে। ভারতের দেয়া প্রচন্ড সংঘর্ষের অনুশীলন কার্যক্রম এবং অস্ত্র ও গোলাবারুদের সুযোগ তারা নিচ্ছে। মুক্তিবাহিনী (লিবারেশন আর্মি) আক্রমণাত্মক রূপ ধারণ করেছে। শিল্প-কারখানাতে অন্তর্ঘাত করা হয়েছে, প্রধান সেতুগুলো কার্যকরী বিস্ফোরণের মাধ্যমে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ রণযান চলাচলের পথে গোপনে রাখা ম্যাশিনগান আক্রমণের শিকার হয়েছে এবং অপেক্ষাকৃত কম রেল-ইঞ্জিন কার্যক্রম চালাচ্ছে এমন রেলপথগুলো মাইন দ্বারা উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
হুমকি
যদিও ভারত সীমান্তের কাছাকাছি ভারী আক্রমণ চলছিল, তবুও ৯০ মাইল দূরে থাকা পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকা প্রতিরোধকারী বাহিনীর আক্রমণের আওতায় চলে আসে। পাল্টাপাল্টি গোলাবর্ষণ ও মাঝে মাঝে মধ্যে বিস্ফোরণের শব্দে শহরের রাস্তাঘাট প্রকম্পিত হচ্ছিল। এবং এই মাসের শুরুতে এমনই এক রাতের আক্রমণে বাঙালী বিদ্রোহীরা ঢাকা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রধান ট্রান্সফরমারকে উড়িয়ে দিয়ে রাজধানীকে প্রায় ছয় ঘন্টার মতো সপর্ণই অন্ধকারে নিমজ্জিত করে দেয়। গত সপ্তাহে এক পশ্চিমা কূটনৈতিক বলেছেন যে “এটা হয়তো খুব আগবাড়িয়ে দেখা হবে যে মুক্তিবাহিনী সেনাবাহিনীর জন্য গুরুতর হুমকি স্বরূপ।” “কিন্তু এতে কোন সন্দেহ নেই যে, আমরা রক্তাক্ত, দীর্ঘকালীন গেরিলা যুদ্ধের প্রথম পর্যায়ের সাক্ষী হচ্ছি।”
এই পাহাড়ুসম সংগ্রামে তাদের অভ্যুত্থানের সাথে যুঝতে গিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অব্যাহত নির্বিচার নির্যাতন বাঙ্গালী বিদ্রোহীদের ক্ষোভের রসদ যোগাচ্ছিল। পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে বিদ্রোহীরা তাদের নিজস্ব এলোমেলো ত্রাসের ভীতিকে অন্তর্ভুক্ত করতে নিজেদের গেরিলা আক্রমণ আরও ছড়িয়ে দিয়েছে। যেখানে রাজ্যের কর সংগৃহীত হয় সেখানে কার্যক্রম না চালানোর জন্য জনগোষ্ঠীকে সতর্কবার্তা হিসেবে ঢাকাস্থ গুলিস্তান সিনেমা হলে ব্রিদ্রোহীদের গ্রেন্ড ছোঁড়া হয় এবং এতে এক ব্যক্তি নিহত ও আরও চৌদ্দ ব্যক্তি আহত হয়। একইভাবে পাকিস্তান সরকারের উদ্দেশ্যে আমেরিকার অস্ত্রের চালান ও সরবরাহের প্রতিবাদে উপকন্ঠের বাইরে ধানমন্ডিতে বসবাসরত আমেরিকান দূতের বাড়িতে একটি ছোটোখাটো বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।
“গ্রামাঞ্চলে” নিউজউইকের লরেন জেঙ্কিন্স যিনি গত সপ্তাহে পূর্বাঞ্চল পরিদর্শন করেছিলেন তিনি তারবার্তা পাঠান এই বলে যে “ পরিস্থিতি আরও বহু দূর গড়িয়েছে। সম্প্রতি গাঙ্গেয় ব্ব-দ্বীপের শহর খুলনাতে অভিবাসিত দুই সেনা কর্মকর্তা- গোলাম সরোয়ার ও আব্দুল হামিদ খান
বিদ্রোহী দল হতে একটি ‘চরম পত্র’ পায় যেখানে বলা হয়েছে তাদেরকে গোপনে হত্যার জন্য চিহ্নিত করা হয়েছে। যদিও ব্যক্তিদ্বয় নিজেদেরকে রাজাকার(অভিবাসিত-সরকারের আইনরক্ষাকারী) দেহরক্ষী দ্বারা ঘিরে রেখেছে, তবুও এক সপ্তাহের মধ্যেই সেই দুইজনের মৃত্যু হয়। এবং কাল মুখোশধারী ভয়ংকর গেরিলা আক্রমণে সারোয়ারের বাড়ির রাজাকার দলটি পরাজিত করা হয়, পরবর্তীতে তারা স্বারোয়ারের মাথটি শরীর হতে বিচ্ছিন্ন করে তাদের সাথে নিয়ে যায়।”
বার্তা
পূর্ব পাকিস্তানের মিলিটারী গভর্ণর লেঃ জেঃ টিক্কা খানের নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীও একই রকমের প্রতিক্রিয়া দেখায়। গেরিলারা উত্তর ঢাকার একটি সেতু উড়িয়ে দেওয়ার পর পাঞ্জাবী সৈন্যরা পার্শ্ববর্তী বেশ কিছু গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়, গেয়াম্বাসীদের পর্যায়ক্রমে হত্যা করে এবং অন্যদেরকে তাদের হেফাজতে রেখে দেয়। জেঙ্কিন্স জানায় যে খুলনার গুপ্তহত্যার ব্যাপারে পাকিস্তানি আর্মিদের প্রতিক্রিয়া আরও অনেক ভয়ংকর ছিল। “ সারোয়ারের মস্তক ছিন্নের পরের দিন সকালে খুলনা জুটমিলের উদ্দেশ্যে থাকা শ্রমিকেরা রেলস্টেশনের সামনে সারিবদ্ধভাবে সাজানো সতেরটি মৃতদেহ দেখতে পায় যাদের হাত পিছমোড়া করে বাঁধা এবং প্রতিজনকে গুল করে হত্যা করা হয়েছে। সেনাবাহিনী মৃতদেহগুলোকে ২৪ ঘন্টার মতো জনসম্মুখে ফেলে রাখে যাতে জনতার এর অর্থ বুঝে নিতে পারে।”
কিন্তু এই আনুমানিক ৩০,০০০ গেরিলা যোদ্ধার উপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এই কৌশল কিভাবে সফল হবে তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় বিদ্যমান। এটা সত্য যে, টিক্কা খান যেখানেই তার সৈন্যদল নিয়ে একাগ্রতা দেখিয়েছে সেখানেই তারা এগিয়ে থাকার লক্ষণ দেখা গিয়েছে। কিন্তু অন্যত্র ব্যর্থ চেহারা। মুক্তিবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের ৭ কোটীরও বেশী জনসংখ্যাকে নিজেদের দিকে টেনে নিতে পারে। এবং সেনাবাহিনীর প্রতিটি নতুন করে করা হত্যাযজ্ঞ ভীত বাংলার জনতার দৃঢ় সংকল্পকে আরো শক্তিশালী করে তোলে। পশ্চিমা কূটনৈতিক ব্যক্তি জেঙ্কিন্স গত সপ্তাহেই বলেছেন যে “ইয়াহিয়া খান এবং সেনাবাহিনীর উর্ধ্বতনেরা মনে করেছিল যে বাঙ্গালীদেরকে তারা ভীত-সন্ত্রস্ত করে তুলতে পারবে।” “সত্যই যে বাঙ্গালীরা ভয় পেয়েছে কিন্তু এর ফলাফল পুরোই উল্টো। যদিও তিনি আগে কোনদিন তা করেননি কিন্তু তিনি তা টেনে নিয়ে গিয়েছেন এবং তিনি বুঝেছেন যে তার নিজেকে মুক্ত করার একমাত্র উপায় হচ্ছে- শুধুমাত্র সহিংসতা।”