শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
২৭। শিরোনামঃ বাঙালী সৈনিকের ভয়ংকর অভিজ্ঞতা | সূত্রঃ নিউইয়র্ক টাইমস | ১৭ এপ্রিল, ১৯৭১ |
<১৪, ২৭, ৬১–৬৩>
নিউইয়র্ক টাইমস, ১৭ই এপ্রিল, শনিবার
আটকে পড়া বাঙালী কর্মকর্তার ভয়ংকর অভিজ্ঞতা
সিডনী এইচ শ্যানবার্গ
নিউইয়র্ক টাইমস এর বিশেষ প্রতিবেদক।
আগরতলা, ভারত, এপ্রিল ১৩ – দবির মনে করতে থাকেন, ২৫ মার্চ রাতে তিনি এবং ৫৩ডি ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্ট এর দুইজন পূর্ব পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা যখন বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তখন তাদের কমান্ডারকে তার কার্যালয়ে ডেকে আনা পাকিস্তানি সেনাদের উদ্দেশ্যে বলতে শুনলেনঃ
“তোমরা সবাই এখনই শহরে যাও, এবং সকালের মধ্যে আমি পুরো কুমিল্লা লাশে ঢাকা পড়া দেখতে চাই। যদি কোন কর্মকর্তা তা করতে ইতস্ততঃ বোধ করে, তাহলে সে আমার কাছে কোন ধরনের অনুকম্পা পাবে না।”
দবির বলতে থাকেন, পরবর্তিতে, ৩০শে মার্চ বিকেলে, অন্য দুইজন বাঙালী কর্মকর্তাসহ পাঁচদিন গৃহবন্দী থাকার পর পশ্চিম পাকিস্তানিরা তাঁদের হত্যা করার জন্য তাঁদের ঘরে একজন সেনা কর্মকর্তাকে পাঠায়- কিন্তু দবির মৃত্যুর অভিনয় করে আহত অবস্থায় পালিয়ে বাঁচতে সক্ষম হন।
তিনি এখন বাঙালী জনগণের দেওয়া পূর্ব পাকিস্তানের নতুন নাম বাংলাদেশ, তথা বাঙালী জাতির স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধরত সৈন্যবাহিনীতে যোগ দিয়েছেন।
তাদের সহকর্মীদের হত্যা
বস্তুতঃ দবির এর অভিজ্ঞতা ব্যতিক্রম কিছু ছিল না। পশ্চিমা উদ্বাস্তু, বাঙালী সৈনিক এবং শরণার্থীদের ভাষ্যমতে, সশস্ত্র বাহিনীগুলোতে আধিপত্যি বিস্তার করে রাখা পশ্চিম পাকিস্তানি সেনারা সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান জুড়েই তাদের পূর্ব পাকিস্তানি সহকর্মীদের হত্যা করছে যাতে করে অল্প সংখ্যক সেনা কর্মকর্তাও স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে না থাকতে পারে। বিভিন্ন সূত্র হতে পাওয়া প্রতিবেদন মতে, অনেক বাঙালী কর্মকর্তাদের পরিবারকেও একসাথে জড়ো করে হত্যা করা হয়েছে।
এভাবে আইন এবং শপথ ভেঙ্গে সেনা-কর্মকর্তাদের নিজেদের সহযোদ্ধাদের হত্যা করা যাদের সাথে কাঁধ মিলিয়ে তারা যুদ্ধ করেছেন, এই যুদ্ধের আরো অনেক ঘটনার মধ্যে একটি বাস্তবতাকে খুব পরিষ্কারভাবে সামনে তুলে আনে, তা হল ৭.৫ কোটি বাঙালীর প্রতি পাঞ্জাবী এবং পাঠান পশ্চিম পাকিস্তানিদের জাতিগত তীব্র ঘৃণার গভীরতা।
যে রাতে সেনাবাহিনী স্বাধীনতা সংগ্রামকে দমন করার চেষ্টা শুরু করেছিল সে রাত থেকেই বাঙালী সৈনিকদের হত্যা করা শুরু হয়।
২০ বছর বয়সী, অবিবাহিত, মোটামুটি সুঠাম দেহের অধিকারী সেকেন্ড লেফটেনেন্ট দবির পূর্ব পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের এক শিবিরে বসে সেই রাত এবং পরবর্তি দিনগুলোতে তার ঘটনাগুলো এই প্রতিবেদককে বলছিলেন।
দবির তাঁর আসল নাম নয়; তিনি একটি ছদ্মনাম ব্যবহার করতে চেয়েছেন তাঁর পরিবার- বাবা-মা, এক ভাই, তিন বোনে- এদের মধ্যে কেউ একজন বেঁচে থাকার সম্ভাবনার কথা ভেবে।
কার্যালয়ের দায়িত্ব অর্পণ
কোমল, প্রায় আবেগহীন কন্ঠে তিনি বলতে লাগলেনঃ
পশ্চিম পাকিস্তানি সেনারা অস্ত্র সংগ্রহ করতে কমান্ডারের কার্যালয় থেকে অস্ত্রাগারের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যাওয়ার পরেই তিনজন নিরস্ত্র বাঙালী কর্মকর্তাকে ভেতরে ডাকা হল এবং বলা হল তাঁদের কার্যালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, যদিও তাঁরা অবস্থাদৃষ্টেই বুঝতে পেরেছিলেন তাঁদের গৃহবন্দী করা হচ্ছে।
যে রাতে তাঁদের কমান্ডারের পাশের কক্ষে রাখা হয়েছিল সে রাতে দবির ঘুমাতে পারেন নি। রাত ১টার দিকে উঠোনের কোথাও সাত বা আটটি গুলি হয়েছিল।
পরের তিন দিন দবির এবং অন্য দুইজন, উভয়েই ক্যাপ্টেন, যখন প্রহরীদের প্রহরায় টেলিফোন এবং কাগজপত্রের জবাব দিচ্ছিলেন তখন তারা দূরে ম্যাশিন-গান, ছোটখাট আগ্নেয়াস্ত্র এবং গোলার আওয়াজ শুনেছেন।
একটি জানালা দিয়ে তাঁরা কিছু পাকিস্তানি সৈন্যকে দেখলেন রেজিমেন্টের ৬০ জন বাঙালী সেনাকে হাত উপরে তুলে একটি দালানের পেছনে নিয়ে যেতে। তারপর তিনজন আগ্নেয়াস্ত্রের অবিরাম হুংকার শুনলেন এবং বুঝলেন বাঙালীদের হত্যা করা হয়েছে।
মার্চের ২৯ তারিখে সকল ছলচাতুরির অবসান ঘটিয়ে এই তিন কর্মকর্তাকে একসাথে একটি কক্ষে বন্দী করে ফেলা হল। ভীতির মধ্য দিয়েই তাঁরা রাত কাটালেন।
৩০ তারিখ বিকেলে একজন পশ্চিম পাকিস্তানি কর্মকর্তা দরজার সামনে এলো এবং বন্দুকের বাঁট দিয়ে দরজার কাঁচ ভেঙ্গে ফেলল।
একজন বাঙালী ক্যাপ্টেন হাঁটু গেড়ে বসে প্রাণভিক্ষা চাইলেন। জবাব ছিল এক পশলা গুলি। দ্বিতীয় পশলা গুলি চালানো হল দ্বিতীয় ক্যাপ্টেনের দিকে।
দবির দরজার পাশের দেয়ালের সাথে ঘেঁষে দাঁড়ালেন। পশ্চিম পাকিস্তানি দরজার তালা খোলার চেষ্টা করল এবং গালি দিয়ে চাবি আনতে চলে গেল।
দবির নিজের খাটিয়ার নিচে গিয়ে ঢুকলেন এবং হাত দিয়ে মাথা ঢেকে রাখলেন। লোকটি ফিরে এল। “আমি জোরে চিৎকার করেছিলাম”, বললেন দবির। “সে গুলি করল। আমি টের পেলাম আমার গায়ে গুলি লেগেছে। আমি এমনভাবে শব্দ করলাম যেন আমি মারা যাচ্ছিলাম। আমি মারা গেছি ভেবে সে গুলি বন্ধ করল এবং চলে গেল।”
লাঠি এবং ধারালো অস্ত্র দিয়ে খোঁচানো
একটি গুলি গিয়ে লেগেছিল দবির এর ডান কব্জিতে, অন্য একটি তার চোয়াল ছুঁইয়ে গিয়েছিল এবং তৃতীয়টি তার পেছন দিকে তাঁর জামা ছিঁড়ে গিয়েছিল। তিনি তাঁর কবজি থেকে রক্ত নিয়ে তাঁর মুখে মেখে দিলেন এবং নিঃশ্বাস বন্ধ করে রাখলেন যখন অন্যান্য কর্মকর্তারা তাঁরা মারা গিয়েছেন কিনা তা নিশ্চিত করতে ফেরত এসেছিল।
পশ্চিম পাকিস্তানিরা যতক্ষণ পর্যন্ত তৃপ্ত হচ্ছিল না ততক্ষণ পর্যন্ত লাশগুলিকে লাঠি এবং ধারালো অস্ত্র দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে দেখছিল। পরের আড়াই ঘন্টা ধরে একের পর এক সৈন্য এই প্রদর্শনী দেখতে কক্ষটিতে আসছিল। এক পাঞ্জাবী সার্জেন্ট দুই ক্যাপ্টেন এর মৃতদেহে লাথি মারছিল। প্রত্যেক বারই দবির প্রাণপণে নিশ্বাঃস আটকে রেখেছিলেন।
“সময় গড়ালো”, দবির বলতে থাকলেন, “রক্ত শুকিয়ে গিয়েছিল আমার ক্ষতের উপর মাছি এসে জড়ো হচ্ছিল। গন্ধটা খুব বাজে ছিল।”
সাত ঘন্টা পর দবির জানালা দিয়ে বের হলেন এবং চার ফুট নিচে মাটিতে গিয়ে পড়লেন। একজন পাহারাদার তাঁর শব্দ শুনে ফেলল এবং গুলি করা শুরু করল, কিন্তু অন্ধকার থাকার কারণে তার গুলিগুলো উল্টোপাল্টা ভাবে চলে গেল। প্রাঙ্গণে থাকা অন্যান্য সৈন্যরাও গুলি করা শুরু করল, কিন্তু দবির সর্বশেষ প্রহরী কুঠুরীটি পার হয়ে, একটি ধানক্ষেত হামাগুড়ি দিয়ে এবং একটি ছোট নদী পার হয়ে পালাতে সক্ষম হলেন। পরের দিন একজন গ্রাম্য চিকিৎসক তাঁর কব্জি থেকে গুলিটি বের করে ব্যান্ডেজ করে দিলেন।
দবিরকে দেখতে এখনো কিশোর মনে হয়- ওজনে মাত্র ১২০ পাউন্ড- কিন্তু তাঁর আচার ব্যবহার এ ব্যাপারে কোন দ্বিধা রাখে না যে পশ্চিমা পাকিস্তানের কাবুলে অবস্থিত মিলিটারি একাডেমি থেকে শ্রেণীতে ৪র্থ হয়ে স্নাতক করার মাত্র ৩ মাসের মধ্যেই তিনি এখন পুরোপুরি বড় হয়ে গেছেন।
পশ্চিম পাকিস্তানিদের প্রতি তাঁর ঘৃণা অন্ত্যন্ত তীব্র কিন্তু নিয়ন্ত্রিত। “কোন কারণ ছাড়াই তারা আমাদের হত্যা করেছে”, তিনি বলেন, “তারা আমাদের বাধ্য করেছে তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে”।