বিচার চাই

বিচার চাই

.

সারা বাংলাদেশ যখন নবলব্ধ স্বাধীনতার নবীন আভায় অবগাহন করছে ঠিক সেই সময় এক দুঃসংবাদ আমাদের সবাইকে বিস্মিত, মর্মাহত ও বেদনার্ত করে তুলেছে। পরাজয়ের পূর্ব মুহুর্তে পশুর চেয়েও নির্মম খান-সেনারা ও তাদের দালালদরা ঢাকার বুক থেকে শত শত বুদ্ধিজীবীকে গোপনে ধরে নিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। এই নরঘাতকদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল বাংলার প্রতিভাকে ধ্বংস করে দেওয়া। এরা বেছে বেছে হত্যা করেছে প্রখ্যাত অধ্যাপকদের, ডাক্তারদের, ইঞ্জিনিয়ারদের, সাংবাদিকদের। ঢাকা সেক্রেটারিয়েটের অফিসারদেরকেও এরা হত্যা করার জন্য ডেকে পাঠিয়েছিল, কিন্তু পশুদের সে উদ্দেশ্য সফল হয়নি।

প্রথম থেকে এই নরপশুরা যে একটি ঘৃণ্য পরিকল্পনা হাতে নিয়ে ষড়যন্ত্র করে বাংলাদেশের মানুষকে, তার ইতিহাসকে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল, একথা বহুবার প্রমাণিত হয়েছে। আমরা প্রথম থেকেই বলে আসছি, এরা বর্ণগত ভিত্তিতে, ভাষাগত ভিত্তিতে, ধর্মগত ভিত্তিতে, সংস্কৃতিগত ভিত্তিতে ও রাজনৈতিক মতামতের ভিত্তিতে বাঙালী জাতির অস্তিত্ব পৃথিবীর বুক থেকে মুছে ফেলতে চায়। আমরা প্রমাণ উপস্থিত করেছি। আমরা বলেছি উপযুক্ত অনুসন্ধান করে আমাদের এই অভিযোগ যাচাই করা হোক। আমরা বার বার জাতিসংঘের সদস্যদের বলেছি যে, যে আইন আপনারা পাশ করেছিলেন সেই আইন অনুসারে বাংলাদেশে যা ঘটেছে তা গণহত্যা। বর্ণগত ভিত্তিতে গণহত্যা। চলেছে। গণহত্যা চলেছে ধর্মের নামে ভাষার নামে, সংস্কৃতির নামে। আমরা চিৎকার করে বলেছি, লক্ষ লক্ষ মানুষকে ষড়যন্ত্র করে বাংলাদেশে মেরে ফেলা হচ্ছে। নারীর উপর নির্যাতন চলছে, বৃদ্ধ ও শিশু পর্যন্ত রেহাই পাচ্ছে না। আপনারা গণহত্যা হচ্ছে কিনা অন্তত একবার তদন্ত করুন, একবার দেখুন আমাদের ক্ৰন্দন যথার্থ কিনা। আমরা আরও বলেছি, একই বিষয়ের জন্য দু’ধনের মানদণ্ড হতে পারে না- একথা আপনারাই একদিন বলেছিলেন। ন্যুরেমবার্গে হিটলারের সাঙ্গপাঙ্গদের আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে আপনারা বিচার করেছিলেন। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলেন যুদ্ধাপরাধের, শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধের ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের। তাদের বিরুদ্ধে আপনারা গণহত্যার অভিযোগ এনেছিলেন এবং সেই অপরাধে তাদের শাস্তিও দিয়েছিলেন। আর তখনই সেই আন্তর্জাতিক আদালতের মার্কিনী বিচারপতি কি মন্তব্য করেননি যে, একই অপরাধের জন্য বিচারের মানদণ্ড দু’রকম হতে পারে না? তিনি কি আরও বলেন নি যে, উর্ধ্বতন অফিসারের আদেশেই অপরাধ করেছি, সুতরাং আমার কোন দোষ নেই, সব দোষ অফিসারের, এ যুক্তি গ্রাহ্য নয়? তিনি কি বলেন নি যে, যে যার কাজের জন্য দায়ী হবে? সেই মহান বিচারপতি কি আরও ঘোষণা করেন নি যে আমরা এমন কোন আইন তৈরী করবো না যা আমাদের বেলায় ব্যবহার করা যাবে না? গণহত্যা সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক আইন পাশ করার সময় এ কথা কি ঘোষণা করা হয়নি যে গণহত্যার বিচার করার জন্য জাতিসংঘ যে-কোন ব্যবস্থা নিতে পারে এবং তার অর্থ কোন রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ বোঝাবে না? সেখানে কি বলা হয়নি যে বর্ণগত, ধর্মগত, সংস্কৃতিগত কারণে কাউকে হত্যা বা অত্যাচারিত করা যাবে না? জাতিসংঘের সনদের ৯৯ সংখ্যক ধারায় জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেলকে কি ব্যক্তিগতভাবে এসব ক্ষেত্রে

এসব হস্তক্ষেপের অধিকার দেয়া হয়নি? দুঃখের বিষয়,বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে পুরাপুরি গণহত্যা অনুষ্ঠিত হোল, লক্ষ লক্ষ মানুষের রক্তে বাংলার মাটি রঞ্জিত হোল, লক্ষ লক্ষ নারীর আর্তনাদে বাংলার আকাশ-বাতাস কেঁপে উঠলো, লক্ষ শিশুর আর্তনাদে কেঁদে উঠলো বাংলার গাছপালা, কিন্তু তাতে জাতিসংঘের গলাবাজ সদস্যদের হৃদয় সামান্যতমও কাঁপলো না। মানুষের মরণ আর্তনাদ তাদের কানে পৌছালো না। তারা নির্বিকার চিত্তে সম্মতি জানালো পাকিস্তানী জঙ্গীশাহীর কার্যাবলীর প্রতি। তারা গণহত্যা হতে দিলো, তারা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হতে দিলো, তারা লক্ষ লক্ষ নিরীহ নিরস্ত্র মানুষকে মরতে দিলো, তারা অত্যাচারিতকে পায়ে দলে দিলো, অত্যাচারীকে সাদরে কোলে টেনে নিলো। তারা আইন ভঙ্গ হতে দিলো, তারা অত্যাচারীরর পক্ষ অবলম্বন করলো।

বিশ্বশান্তির এই সব ধ্বজাধারীদের ধারণা যে, চোখ বুজে থাকলেই কঠিন কঠোর সত্যকে এড়িয়ে যাওয়া যাবে। এদের ধারণা, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র বলেই ন্যায়বিচার করার দরকার নেই। এরা মনে করে, দু’একবার আইন ভঙ্গ হতে দিলে এমন দোষ ঘটে না। এরা ভাবে, যত আইন ভঙ্গ হোক না কেন গোলমালে না জড়িয়ে পড়লেই বাঁচা যাবে। এরা ঠিক করেছে যে, কেবল নিজের স্বার্থ ছাড়া আর কিছুই দেখবো না।

দুঃখের বিষয় মহাকালের শিক্ষা এরা ভুলে গেছে। এরা ভুলে গেছে যে, আইন ভঙ্গ হতে দেওয়া কোন উদারতার ব্যাপার নয়, আইন ভঙ্গ হতে দেওয়া দুপক্ষেরই বিপজ্জনক। হিটলার যখন বারবার অন্যায় করছিল তখন বৃহৎ শক্তিগুলো সব মেনে নিচ্ছিল, হিটলার ছোট ছোট দেশগুলো যখন দখল করছিল তখন চেম্বারলিন ছাতা দিয়ে তাকে বাতাস করছিলেন। কিন্তু সেই আইন ভঙ্গকারী হিটলারই কোটি কোটি মানুষের মৃত্যু ডেকে আনলো, বৃটেন ফ্রান্সসহ বহু দেশে প্রচণ্ড ধ্বংসলীলা চালালো। যদি প্রথম থেকেই বাধা দেয়া হোত তাহলে এই ধ্বংসের সম্মুখীন হতো না পৃথিবী।

পৃথিবীর সর্বত্র অন্যায় হচ্ছে। অথচ স্বার্থপরতার জন্য তার প্রতিকার করা হচ্ছে না। বাংলাদেশের মানুষ প্রাণ দিলো, কিন্তু অপরাধীর শাস্তি হলো না। পৃথিবীর রাষ্ট্রগুলো চেয়ে চেয়ে তাই দেখলো। আমরা ক্ষুদ্র বলেই এই অবহেলা। কিন্তু ইতিহাসের শিক্ষা যদি মিথ্যা না হয় তাহলে একদিন অন্যায়ের প্রশ্রয়দানকারীরা উপযুক্ত শিক্ষাই পাবে। অত্যাচারীর পক্ষ অবলম্বন করার জন্য রক্ত দিয়েই শাস্তি পেতে হবে। এবং অত্যাচারীর হাতেই সেই শাস্তি পেতে হবে তাদের।

আমার সোনার বাংলার শত শত প্রতিভাকে বিনষ্ট করা হয়েছে। কি আর কোন ভাষায় যে আমরা হাহাকার করবো বুঝতে পারছি না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে পড়েছি। শত স্মৃতি আজ মনে পড়ছে। আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষকরাও অনেকে প্রাণ হারিয়েছেন। কোন কিছুই দিয়েই তাদের শূন্য স্থান পূর্ণ হবে না। যেসব সাংবাদিক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার চিরকালের জন্য হারিয়ে গেলেন তাঁদের অভাবে সারা দেশ আজ কাঁদছে।। আমরা সবাই আজ হাহাকার করছি। সেইসব বিদেহী আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করার সময় চীৎকার করে আমরা বলতে চাই- হত্যঅকারী যেন শাস্তি পায়, হত্যাকারী যেন শিক্ষা পায়, হত্যাকারীদের সাগরেদ যেন শাস্তি পায়, হত্যাকারীদের সাগরেদ যেন শিক্ষা পায়।

তবে এ কথা ঠিক, অপরাধীর বিচারের ভার আমরা নিজের হাতে তুলে নেবো না। বিচার করবেন আমাদের সরকার। বিচারের ভার বহন করবেন সরকারের আইন বিভাগ।

(মোহাম্মদ আবু জাফর রচিত)

Scroll to Top