বিলম্বিত কনফারেন্স

প্রতিবেদনঃ মেজর (অবঃ) রফিক-উল ইসলাম

 

বিলম্বিত কনফারেন্স

 

১০ জুলাই আমি আগরতলা থেকে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের একখানি বিমানে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। পথে গোহাটিতে আধঘণ্টার জন্য থেমে রাতে সাড়ে আটটার দিকে কলকাতার আকাশে পৌছে গেলাম।নীচে তখন মুষল ধারার বৃষ্টির সাথে বেগে বাতাস বইছিল।এহেন দুর্যোগে কয়েকবার চেষ্টা করার পর আমাদের বিমান রানওয়ে স্পর্শ করল। ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে আমাদের চার ঘণ্টার কষ্টকর যাত্রা শেষ হলো। রাত তখন ৯ টা।

 

অচেনা কলকাতায় আমি সম্পূর্ণ অপরিচিত আগন্তক।বিমানবন্দরের ভবনে কিছুক্ষণ পায়চারী করার পর একটি ট্যাক্সি ভাড়া করলাম। শিখ ড্রাইভারকে বললাম বাংলাদেশ আর্মি হেডকোয়াটারে নিয়ে যেতে।কিন্ত রাতে আর্মি হেডকোয়াটার খুঁজে পেলাম না। তখন ড্রাইভারকে একটি মাঝারি হোটেলে নিয়ে যেতে বললাম।

 

বহুদিনের পরিচর্যার অভাবে আমার চুল দাঁড়ি সমানে বেড়ে উঠেছিল। পায়ে ক্যাম্বিশের জুতো জোড়া ছেঁড়াও ময়লা। গায়ে বেঢপ ধরণের জামাটিও বেশ বড়,পরনে টাউজার এবং হাতে কিছু সরকারী কাগজপত্র ভর্তি একটি থলে এই ছিল আমার সেদিনের সর্বাঙ্গীণ চেহারা। শিখ ড্রাইভার নিশ্চয় আমার সাথে রসিকতা করে থাকবে। সে আমাকে একটি ব্যয়বহুল হোটেলে পৌছে দিল। হোটেলে ঢুকতেই অনুভব করলাম রিসেপশন রুমটি শীততাপ নিয়ন্ত্রিত।আমি যেন হঠাৎ  করে দারুণ  একটা আঘাত পেলাম।  মনের অজান্তেই হাত বাড়িয়ে আমার থলেটি স্পর্শ করলাম। সেখানে উপস্থিত সুন্দর বেশভূষার সজ্জিত পুরুষও মহিলার অবাক দৃষ্টির মুখে আমি বেশ অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। মুহূর্তের হতভম্ব ভাব কাটিয়ে রিসেপশনিস্টকে জিজ্ঞেস করলাম,’’ একটা রুম পাওয়া যাবে কি?’’ ভদ্রলোক আড়চোখে আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত একটু  জরিপ করে নিলেন। আমার জুতো,ট্টাউজার, শার্ট, থলে, দাঁড়ি কোনকিছুই তার দৃষ্টি এড়ালো না। তারপর কিছুটা কৌতুহলের হাসি ফুটিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,’’আপনি কি…?’’ ‘’হ্যাঁ আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি।‘’ সাথে সাথে জবাব দিলাম।

 

পরদিন সকালে হোটেল ত্যাগ করলাম। কিন্ত একরাতের ভাড়া হিসেবে পকেটে যা ছিল তার অর্ধেকটা বেরিয়ে গেছে।বাংলাদেশ বাহিনীর হেডকোয়াটার যাওয়ার সারাটা পথে আমি শুধু সেই শিখ ড্রাইভারকে অভিসম্পাত করছিলাম।

 

১১থেকে ১৭ জুলাই পর্যন্ত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হল।সম্মেলনের আলোচনা সকালে শুরু হয়ে শেষ হতো রাতে। সেখানে সকল সেক্টর কমান্ডারাই উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলনে আমরা নানা ধরণের সমস্যা এবং ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা সম্পর্কে আলোচনা করি। উলেখ্য যে, তখন পর্যন্ত আমাদের চিন্তার কিংবা কাজের কোন সমন্বয় ছিল না।

 

কলকাতা ৮ নম্বর থিয়েটার রোদের ভবনটিতে আমরা মিলিত হয়েছিলাম। এটা ছিল বি এস এফ এর অফিস। যুদ্ধের সময় বাংলাদেশ সরকারকে এটি ব্যাবহার করতে দেয়া হয়েছিল।

 

একাত্তরের মার্চে রফিক-উল-ইসলাম সাবেক ই পি আর সেক্টর হেডকোয়ার্টার, চট্টগ্রাম ক্যাপ্টেন পদে সেক্টর এডজুডেন্টের দায়িত্ব পালন করছিলেন।

 

আমাদের প্রথম অধিবেশনে সভাপতি ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। বাংলাদেশ বাহিনীর চীফ ইন কম্যান্ডার কর্নেল(অব) এম, এ, জি ওসমানী প্রথম দিনের অধিবেশনে যোগ দিতে পারেননি।

১২ই জুলাই দ্বিতীয় দিনের অধিবেশনে ছিলেনঃ

 

    ১। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ

    ২। কর্নেল(অব) এম, এ, জি ওসমানী

    ৩। লেঃ এম, এ, রব

    ৪। গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ,কে খন্দকার

    ৫। মেজর(অব) নুরুজ্জামান

    ৬। মেজর সি আর দত্ত

    ৭। মেজর জিয়াউর রহমান

    ৮। মেজর কে, এম শফিউল্লাহ

    ৯। মেজর খালেদ মোশাররফ

    ১০। মেজর মীর শওকত আলী

    ১১। উইং কমান্ডার এম, কে বাশার

    ১২। মেজর ওসমান চৌধুরি

    ১৩। মেজর রফিক- উল- ইসলাম

    ১৪। মেজর নাজমুল হক

    ১৫। মেজর এম, এ,জলিল

    ১৬। মেজর এ, আর চৌধুরি

 

দশদিন ব্যাপী সম্মেলনে যুদ্ধের বিভিন্ন দিক, বিভিন্ন সমস্যা এবং ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা  নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করি। ওই বৈঠকে লেঃ এম, এ, রব চীফ অব –স্টাফ এবং  গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ, কে খন্দকার  ডেপুটি- চীফ- অব স্টাফ নিযুক্ত হন।

 

সম্মেলনে গুরুত্বপূর্ণ যেসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল তা হচ্ছেঃ            

 

১। বিভিন্ন সেক্টরের সীমানা নির্ধারণ             

 

২। নিম্নলিখিতভাবে গেরিলা যুদ্ধের আয়োজনঃ                

(ক)নির্ধারিত এলাকায় নির্দিষ্ট দায়িত্ব দিয়ে পাঁচ অথবা দশজন নিয়ে গঠিত  ট্রেনিং প্রাপ্ত গেরিলা দলকে বাংলাদেশে পাঠানো হবে।                

(খ)গেরিলাদের শ্রেণীবিভক্তিঃ

 

একশন গ্রুপঃ এই গ্রুপের সদস্যরা শত্রুর বিরুদ্ধে সরাসরি গেরিলা হামলা পরিচালনা করবে। তারা শতকরা ৫0 থেকে ১০০ ভাগ হাতিয়ার বহন করবে।

 

 

গোয়েন্দা সেনাঃ  এই গ্রুপের গেরিলারা সাধারণত সংঘর্ষে জড়িত হবেনা। এরা শত্রুপক্ষের খবরাখবর সংগ্রহ করবে। এদের সাধারণতঃ৩০ ভাগের বেশি অস্ত্র থাকবেনা।

 

গেরিলা ঘাঁটিঃ প্রতিটি ঘাঁটিতে গেরিলাদের থাকা খাওয়ার জন্য কয়েকটি নিরাপদ গৃহের ব্যাবস্থা থাকবে যেখান থেকে যথা যথ খবর প্রাপ্তির পরই তারা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌছাতে পারে। প্রত্যেক ঘাঁটিতে একটি করে মেডিক্যাল গ্রুপ থাকবে যারা প্রয়োজনে গেরিলাদের চিকিৎসা করবে। প্রত্যেক ঘাঁটিতে একজন রাজনৈতিক নেতার দায়িত্ব থাকবে। এদের দায়িত্ব ছিল বিভিন্ন  কর্মপদ্ধতির মাধ্যমে পাকিস্তানীদের মানসিকভাবে দুর্বল করে দেওয়া এবং একই সঙ্গে বাঙ্গালীরা যাতে সাহসও শক্তি হারিয়ে না ফেলে সেদিকে লক্ষ্য রাখা। শত্রুর বিরুদ্ধে বড় আক্রমণ পরিচালনার উদ্দেশ্যে আর বেশী সংখ্যকগেরিলা কিংবা নিয়মিত বাহিনীর সৈনিকদের স্থান সংকুলানের জন্য প্রতিটি ঘাঁটিকে তৈরি রাখাও এদের দায়িত্ব ছিল।

 

৩। নিয়মিত বাহিনীর সদস্যদের অবিলম্বে ব্যাটালিয়ান ফোর্সএবং সেন্টার ট্রুপস এর  ভিত্তিতে সংগঠিত করতে হবে।

 

৪। শত্রুর বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে নিম্নলিখিত পদ্ধতিতে যুদ্ধ পরিচালনার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়ঃ

(ক) প্রতিটি সুবিধাজনক স্থানে শত্রুর বিরুদ্ধে রেইড এবং অ্যামবুশের মাধ্যমে আঘাত হানার জন্য বিপুল সংখ্যক গেরিলাকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে।   

(খ) শিল্প প্রতিষ্ঠান চালু রাখতে দেওয়া যাবেনা। বিদ্যুতের খুঁটি, সাবষ্টেশন প্রভৃতি উড়িয়ে দিয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ অচল করার মাধ্যমে একাজ করতে হবে।

(গ) পাকিস্তানীদেরকে কোন  কাঁচামাল কিংবা উৎপাদিত  পণ্য রফতানি করতে দেওয়া হবেনা। যেসব জিনিস গুদামে থাকবে সেগুলো ধ্বংস করে দিতে হবে।

(ঘ) শত্রু পক্ষের সৈন্যও সামরিক সরঞ্জাম আনা- নেওয়ার জন্য ব্যবহারযোগ্য রেলপথ, নৌপথ পরিকল্পিতভাবে ধংস করে দিতে হবে।

(ঙ)রণকৌশলগত পরিকল্পনা এমনভাবে প্রণয়ন করতে হবে যাতে শত্রুরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়তে বাধ্য হয়্।

(চ) শত্রুদের ছত্রভঙ্গ করার পর তাদের বিচ্ছিন্ন বাহিনীগুলোর উপর গেরিলারা মরনপ্রান আঘাত হানবে।

বিভিন্ন সেক্টরএবং ফোস পুনর্গঠনের কাজে ইপিআর ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ন। যুদ্ধের                প্রাথমিক পর্যায়ে ইপির বাহিনীর কাছ থেকেই বাংলাদেশ সরকার প্রায় সমুদয় অস্ত্র ও গোলাবারুদের ব্যবস্থা করেছিল। শুধু তাই নয় প্রথম থেকেই বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে তারাই প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল।ইপিআর এর অয়ারলেস সেট এবং যানবাহন ব্যাপকভাবে কাজে লেগেছিল। মুক্তিযুদ্ধে ইপিআর এর সিগন্যাল এবং ড্রাইভাররা সেদিন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভুমিয়া রাখে। সেই দুর্দিনে স্বাধীনতার জন্য নিবেদিত প্রাণ ড্রাইভাররা শত্রুপক্ষের তুমুল গোলাবৃষ্টির মধ্যে আমাদের সৈন্য ও রসদ বহন করে দৃঢ় মনোবল ও সাহসিকতার অত্যুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

 

আমাদের এই সম্মেলনে বাংলাদেশকে১১টি সেক্টরে বিভক্ত করা হয়।

 

১ নম্বর সেক্টরঃ চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং নোয়াখালীর জেলার অংশবিশেষ নিয়ে(মুহুরি নদীর পূর্ব এলাকা) এই সেক্টর গঠিত হয় । সমস্ত সেক্টরটি আবার পাঁচটি সাব-সেক্টরে বিভক্ত করা হয়।আমি এই সেক্টরের কমান্ডার নিযুক্ত হই।এই সেক্টরের মোট সৈন্য সংখ্যা ছিল ২১শ’। এর মধ্যে ১৫শ’ ইপিআর, ২শ’ পুলিশ ৩শ’ সামরিক বাহিনী এবং নৌও বিমানবাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় একশ। এখানে গেরিলাদের সংখ্যা ছিল প্রায়২০হাজার। যার মধ্যে৮ হাজারকে একশন গ্রুপ হিসেবে গড়ে তোলা হয়। এদের মধ্যে শতকরা৩৫ ভাগকে অস্ত্রও গোলাগুলি দেওয়া হয়েছিল।

 

২ নম্বর সেক্টরঃ কুমিল্লাও ফরিদপুর জেলা এবং নোয়াখালীও ঢাকার অংশবিশেষ নিয়ে এই সেক্টর গঠিত হয়। সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত হন খালেদ মোশাররফ। সেক্টরটি ৬ টি সাব সেক্টরে বিভক্ত ছিল।সেক্টরটি৬টি সাব-সেক্টরে বিভক্ত ছিল। সমগ্র সেক্টরে নিয়মিত বাহিনীর সদস্য ছিল প্রায় ৪ হাজারএবং গেরিলা ছিল প্রায়৩০ হাজার।

 

৩ নম্বর সেক্টরঃ মেজর কে এম শফিউল্লাহর মৌলভীবাজার মহকুমা, ব্রাক্ষণবাড়িয়া মহকুমা, নারায়ণগঞ্জ মহকুমা এবং কেরানীগঞ্জের অংশবিশেষ নিয়ে এই সেক্টর গঠিত হয়। ১০ টি সাব-সেক্টরে বিভক্ত এই সেক্টরে গেরিলা বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায়১০হাজার। এস-ফোর্স গঠনের পর মেজর শফিউল্লাহকে তার কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়। মেজর নুরুজ্জামানকে৩ নম্বর সেক্টরের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

 

৪ নম্বর সেক্টরঃ উত্তরে সিলেট সদর এবং দক্ষিণে হবিগঞ্জ থানার মধ্যবর্তী সমস্ত অঞ্চল নিয়ে গঠিত এই সেক্টরের কমান্ডার নিযুক্ত হন মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত। সেক্টরটি ৬ টি সাব-সেক্টরে বিভক্ত ছিল। সেক্টরের সৈন্য সংখ্যা ছিল প্রায় ২ হাজার এবং গেরিলা ছিল প্রায়৮ হাজার। সেক্টর হেডকোয়াটার ছিল করিমগঞ্জে। পরে তা নাসিমপুরে স্থানান্তর করা হয়।

 

৫ নম্বর সেক্টরঃ সিলেট জেলার উত্তরাঞ্চল নিয়ে গঠিত এই সেক্টরের কমান্ডার নিযুক্ত হন মেজর মীর শওকত আলী। সেক্টরে নিয়মিত বাহিনীর সংখ্যা প্রায় ৮০০ এবং গেরিলা প্রায় ৭ হাজার। সেক্টরটি ৬ টি সাব-সেক্টরে বিভক্ত ছিল।

 

৬ নম্বর সেক্টরঃ এই সেক্টর রংপুরও দিনাজপুর জেলা নিয়ে গঠিত। উইং কমান্ডার এম, কে বাশার ছিলেন সেক্টর কমান্ডার। সাব-সেক্টর সংখ্যা ছিল ৫টি। সৈন্য সংখ্যা ছিল প্রায় ১২শ এবং গেরিলা ছিল ৬ হাজার। সেক্টর হেডকোয়াটার ছিল রংপুর জেলার পাট গ্রামের নিকট বুড়িমারীতে।

 

৭ নম্বর সেক্টরঃ রাজশাহী,পাবনা,বগুড়া এবং দিনাজপুর জেলার অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত। সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত হন মেজর নাজমুল হক। যুদ্ধকালে এক মটর দুর্ঘটনায় তিনি মারা গেলে সেক্টর কমান্ডার হিসেবে মেজর কিউ এন জামান দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সাব-সেক্টরের সংখ্যা ছিল৮ টি।সৈন্য সংখ্যা ছিল প্রায়২ হাজার এবং গেরিলার সংখ্যা ছিল প্রায়২ হাজার।

 

৮ নম্বর সেক্টরঃ ১৫ জুলাই পর্যন্ত এই সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন মেজর এম,এ ওসমান চৌধুরী। এসময় মেজর এম, এ মঞ্জুর পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসেন এবং তাকে ৮ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়। এর আওতায় ছিল কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা, বরিশাল পটুয়াখালী জেলা। পরে বরিশালও পটুয়াখালীকে এই সেক্টর থেকে বাদ দেওয়া হয়। সেক্টরে সৈন্য সংখ্যা ছিল ২ হাজার। গেরিলা ৭ হাজার। সাব-সেক্টরের সংখ্যা ছিল ৭টি। সেক্টর হেডকোয়াটার ছিল বেনাপোলে।

 

৯ নম্বর সেক্টরঃ বরিশাল, পটুয়াখালী, এবং খুলনাওফরিদপুর জেলার অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত হয়। সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত হন মেজর এম,এ, জলিল। সাব-সেক্টরের সংখ্যা ছিল৮ টি।  গেরিলা ছিল প্রায়১৫ হাজার। নিয়মিত সৈন্য ছিল এক ব্যাটালিয়নের মত।

 

১০ নম্বর সেক্টরঃ এই সেক্টরের কোন আঞ্চলিক সীমানা ছিলনা। শুধু নৌ-বাহিনীর কমান্ডোদের নিয়ে গঠিত এই সেক্টরের সদস্যদের শত্রুপক্ষের নৌযান ধ্বংস করার জন্য বিভিন্ন সেক্টরে পাঠানো হতো। প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন সংখ্যক কমান্ডো এক-একটি গ্রুপ গঠিত হতো। যে সেক্টরের এলাকায় কমান্ডো অভিযান পরিচালিত হতো সেই এলাকার সেক্টর কমান্ডারের অধীনে থেকে কমান্ডোরা কাজ করত। নৌ- অভিযান শেষ হওয়ার পর কমান্ডোরা তাদের মুল সেক্টর অর্থাৎ ১০ নম্বর সেক্টরে ফিরে আসতো।

 

১১ নম্বর সেক্টরঃ এই সেক্টরটি ছিল মেজর তাহেরের কমান্ডে। ১৫ নভেম্বর এক অভিযানে তিনি আহত হলে স্কোয়াড্রন লিডার হামিদুল্লাহকে  এই সেক্টরের কমান্ডার করা হয়। এখানে সাব-সেক্টর ছিল৮ টি এবং গেরিলাদের সংখ্যা ছিল প্রায় ২০ হাজার।

 

এই সম্মেলনে সেক্টর সমূহ সম্পর্কে সিদ্ধান্তের পর সৈনিকদেরও নিম্নলিখিত গ্রুপে পুনর্গঠন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল।

 

নিয়মিত আর্মি ব্যাটালিয়নঃ তখনকার স্বল্প সংখ্যক ব্যাটালিয়নগুলো নিয়ে বাংলাদেশ বাহিনী গঠিত হয়। এইসব ব্যাটালিয়নের জনশক্তি ছিল খুবই কম। প্রত্যেক সেক্টর থেকে লোক সংগ্রহ করে শক্তি বৃদ্ধির চেষ্টা চলে। তারপর এগুলোকে ব্রিগ্রেডগ্রুপে ভাগ করা হয়। কে-ফোর্স , এস- ফোর্স এবং জেড-ফোর্স নামে এগুলো পরিচালিত হয়। এসব বাহিনীর অধিকাংশ লোকই ছিল ইপিআর এর।

 

সেক্টর ট্রুপসঃ উপরোক্ত ব্যাটালিয়নগুলোতে যেসব ইপিআর,পুলিশ এবং সামরিক বাহিনীর লোকদের অন্তর্ভুক্ত করা যায়নি তাদেরকে যার যার সেক্টরে যুদ্ধ করার জন্য ইউনিটও সাব-ইউনিটে ভাগ করা হয়। নিয়মিত বাহিনীগুলোর চেয়ে সেক্টর ট্রুপের অস্ত্রবল ছিল কিছুটা কম।ওপরের প্রথমও দ্বিতীয় গ্রুপ, মুক্তিফৌজ, এম এফ মুক্তিবাহিনী অথবা নিয়মিত বাহিনী হিসেবে পরিচিত। এদেরকে সেনাবাহিনীর বিধিবিধানও নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হয়। এদেরকে জীবন-ধারণের ভাতা হিসেবে একটি যুক্তিসংগত অর্থের অংক দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয় কিন্ত তারা কোন বেতন গ্রহণ করেননি।সরকারীভাবে তাদের নাম রাখা হয় ‘নিয়মিত বাহিনী’।

 

অনিয়মিত বাহিনী অথবা ফ্রিডম ফাইটার্স(এফ এফ)ঃ গেরিলা পদ্ধতিতে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য জেসব লোককে ট্রেনিং দেওয়া হতো তারা ছিল ফ্রিডম ফাইটার্স। এর সরকারী নাম ছিল অনিয়মিত অথবা গণবাহিনী। এরা সেনাবাহিনীর নিয়ম-কানুন অনুসারে  চলতে বাধ্য ছিলো না। অনেকক্ষেত্রে নিয়ম-শৃঙ্খলার অভাব ছিলো এই গ্রুপের বৈশিষ্ট।তবে, আমরা নিশ্চিত ছিলাম যে, সুদীর্ঘ এবং কঠোর সংগ্রামী  জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে তারা আপনা থেকেই সুশৃঙ্খল হয়ে উঠবে।সাধারণতঃ এদেরকে বলা হত ‘গেরিলা’। মুক্তিফৌজ এবং ফ্রিডম ফাইটারদেরও সাধারণভাবে এফ-এফ অথবা ফ্রিডম ফাইটার্স বলা হতো এবং এই নামে সকল যোদ্ধাই সুপরিচিত ছিল।

 

অনিয়মিতবাহিনীর লোকেরা কোন বেতন কিংবা জীবনধারণ ভাতা পেতো না। ট্রেনিংয়ের পর বাংলাদেশের ভেতরে পাঠানোর খরচ হিসেবে রাহা খরচ হিসেবে কিছু অর্থ দেওয়া হতো।একে বলা হতো ‘ইনডাকশন মানি’ বা নিযুক্তি ভাতা।

 

আমাদের নিয়মিত(এম এফ) এবং অনিয়মিত(এফ এফ) বাহিনীর সাংগঠনিক কাঠামো এবং সদস্য সংখ্যা হিসেব করে তাদের জন্য কাপড় চোপড়, রেশন,অস্ত্র, গোলাগুলি অয়ারলেসসেট, টেলিফোন সেট কম্পাস, বাইনোকুলার ইত্যাদি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের তালিকা তৈরি করে পুরো সেক্টরের অত্যাবশ্যকীয় জিনিসপত্রের সাকুল্য তালিকা সরকারের কাছে পেশ করতে হতো।আমাদের সরকার আবার ভারত সরকারের কাছ থেকে জিনিসগুলো সংগ্রহ করতেন। অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহের ব্যাপারে আমাদের অভিজ্ঞতার কথা আগেও বলেছি। নিঃসন্দেহে এই সমস্যার জন্য আমরা প্রথম দিকে মার খেয়েছিলাম। সেক্টরগুলোতে ব্যবহৃত অশ্ত্র-শস্ত্রের তেমন কোন সামঞ্জস্য ছিলো না।  কিছু ছিল চীনের তৈরি,কিছু ব্রিটিশ আবার কিছু আমেরিকান। এগুলোর গোলাগুলির নিয়ে আমাদের নিদারুণ সংকটে পড়তে হতো। শেষপর্যন্ত আমাদের শুধু একধরণের( সম্ভবত ভারতীয়) অস্ত্র দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।

 

যানবাহনের সমস্যার তো কোন অন্তই ছিলো না। খুচরো যন্ত্রপাতির অভাবে গাড়িগুলি প্রায়ই অচল থাকতো। এরপর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যেভাবে হোক যতদূর সম্ভব বেশী গাড়ি চালু রাখতে হবে। ভারত সরকারের সাথে উচ্চপর্যায়ের আলোচনার পর ভারতীয় সেনাবাহিনীর ই-এম-ই(ইলেকট্রিক্যাল মেকানিক্যাল এন্ড ইকুইপমেন্ট) বিভাগকে এই কাজের ভার দেওয়া হয়।

 

চিকিৎসার সুযোগ- সুবিধার  অভাব ছিল প্রকট। ভারতের হাসপাতালগুলো আহত শরণার্থীতে ভরে গিয়েছিল। এদের বেশিরভাগই ছিল বুলেট কিংবা বেয়োনেটের আঘাতে আহত। আমরা বাঙ্গালী সৈনিকদের জন্য কয়েকটি অস্থায়ী ফিল্ড হাসপাতাল গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেই। পরে সবচাইতে সবচাইতে বড় হাসপাতালটি স্থাপিত হয়েছিল ২ নম্বর সেক্টরে। যুদ্ধের সময় খুব কম সংখ্যক চিকিৎসকই ভারত গিয়েছিলেন। এই ঘাটতি পূরণের জন্য ৪র্থ বর্ষের মেডিক্যাল ছাত্রদের পর্যন্ত কাজে নিয়োগ করা হয়। তারা চিকিৎসা ক্যাম্প এবং সাব- সেক্টরের দায়িত্বও গ্রহণ করে। ভারতের সামরিক হাসপাতালগুলোতে আমাদের আহত সৈনিকদের চিকিৎসা করার জন্যও ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গেও একটি ব্যবস্থা করা হয়েছিলো।

 

এরকম আরো অনেক সমস্যার কথা এবং সেগুলো সমাধানের উপায় নিয়ে আমাদের সাথে আলোচনা করা হয়। সেক্টরগুলোতে কতগুলো অত্তযাবশ্যকীয় দ্রব্য এবং যন্ত্রপাতি একেবারেই ছিলো না। এ ব্যাপারে আমাদের চাহিদা পুরণ করা হবে বলেও প্রতিশ্রুতি পেয়েছিলাম। কিন্ত যুদ্ধকালে কোনকিছুই আমরা পর্যাপ্ত পরিমাণে পাই নাই। হয়ত এর যুক্তিসঙ্গত কোন কারণও থাকতে পারে। বর্ষার সময়ে আমাদের অধিকাংশ সৈনিকদের জন্য জরুরী ভিত্তিতে আচ্ছাদন নির্মাণের কথা ছিল কিন্ত কোনসময়েই এই আচ্ছাদনের উদ্দেশ্য সাধিত হয়নি। তাঁবুর সরঞ্জামও চাহিদা অনুযায়ী পাইনি। শীতে কম্বলের সংখ্যা ছিল অল্প , গরম কাপড় তারও কম। আমাদের সৈনিকরা অধিকাংশ যুদ্ধই করেছে খালি পায়ে। জঙ্গলে চলাচলের বুটও ছিল মাত্র কয়েক জোড়া। আমরা বিপুল সংখ্যক প্লাস্টিকের স্যান্ডেল পেয়েছিলাম। ওগুলো ছিল বাথরুমের জন্য উপজুক্ত, যুদ্ধক্ষেত্রের জন্য নয়।

 

প্রতিটি সেক্টরে সামরিক অভিযানের ক্ষমতা এবং কি পরিমাণ সৈন্য আমাদের আছে সেসব নিয়েও বিস্তারিত আলোচনা করেছিলাম। কমান্ডো ধরণের হামলার জন্য তখনো আমরা সৈন্যদের পুরা পুনর্গঠন করতে কিংবা ট্রেনিং দিতে পারিনি। তাই বাংলাদেশের খুব ভেতরে প্রবেশ করার  পরিকল্পনা আমরা কিছুদিনের জন্য বাদ দিয়ে তখনকার মত সমগ্র সীমান্ত এলাকা বরাবর শত্রুর উপর আঘাত হানার প্রস্তুতি নেই। গেরিলা তৎপরতা উপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়াহয়। এই উদ্দেশ্যে বিপুল সংখ্যক লোককে গেরিলা যুদ্ধের ট্রেনিং দেওয়া হয়। স্থানীয়ভাবে আমরা স্বল্পসংখ্যক র ফ্রিডম ফাইটারকে ট্রেনিং দেওয়ার ব্যাপক পরিকল্পনা হাতে নেয়। আমরা আশা করেছিলা এর দ্বারা কয়েকমাসের মধ্যে আমরা পর্যাপ্ত পরিমাণ গেরিলা গড়ে তুলতে পারব এবং এদেরকে দিয়ে পাকবাহিনীকে ব্যতিব্যস্ত রাখা যাবে। ইত্যবসরে সরাসরি  অভিযান পরিচালনার জন্য নিয়মিতসৈন্যদের প্রশিক্ষণও পুনর্গঠন পূর্ণোদ্যমে চলবে। ফ্রিডম ফাইটারদের উপর যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রভৃতি ধ্বংসের দায়িত্ব থাকবে। প্রয়োজনে তারা শত্রুদল্কে অ্যামবুশ করবে এবং সশস্ত্র  ঘাঁটি, জ্বালানিও অস্ত্র মজুতের স্থান কিংবা সরবরাহ স্থানের উপর হামলা চালাবে। এরপর নিয়মিতবাহিনীর সর্বাত্মকঅভিযানে শত্রুপক্ষকে সহজে কাবু করা যাবে।

 

এইভাবে আমরা চূড়ান্ত রণকৌশল নির্ধারণ করি।কিন্ত প্রশ্ন দাঁড়ায় কে কখন সেই সর্বাত্মক অভিযান চালাবে।

 

তখনকার মতো যুদ্ধের জন্য সর্বাধিক সংখ্যক লোককে ট্রেনিং দেওয়ার ব্যাপারেই আমরা বেশী আগ্রহী ছিলাম। ট্রেনিং সপ্তাহের তা মেয়াদ ছিল দুই থেকে তিন সপ্তাহের। এসময়ের মধ্যে তারা রাইফেল, লাইট মেশিনগান, হ্যান্ড গ্রেনেড, বিস্ফোরক  প্রভৃতি কিভাবে ব্যবহার করতে হয় তা শিখতো। এছাড়া অ্যামবুশের কায়দা- কানুন এবং রণাঙ্গনের কৌশল কিছু শেখানো হতো। আমাদের সব প্রচেষ্টার লক্ষ্য ছিল গুণগত নয়, পরিমাণগত দিক দিয়ে কি করে আরও বেশি লোক গড়ে তোলা যায়।প্রয়োজনীয় সকল প্রকার দ্রব্য-সামগ্রীও ট্রেনিংের জন্য আমাদেরকে পুরোপুরি ভারতীয় সেনাবাহিনীর উপর নির্ভর করতে হতো।এ ব্যাপারে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য ভারতীয় সরকার তাঁদের কয়েকজন সিনিয়র সামরিক কর্মকর্তাকে নিয়োগ করেন। ব্রিগ্রেডিয়ার রাঙ্কের এইসব অফিসার ভারতীয়বাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের সামরিক এবং প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে থেকে কাজ করতেন। তাদের নিযুক্তি ছিল ভারতীয় সেক্টর কমান্ডার হিসেবে। ভারতের একজন সেক্টর কমান্ডার দুই অথবা তিনটি সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন। প্রধানতঃ ভারতীয় বাহিনীর সেক্টর কমান্ডারদের মাধ্যমে বাংলাদেশ বাহিনীর হেডকোয়াটার এবং ইস্টার্ন কমান্ডের সাথে আমাদের যোগাযোগ রাখতে হতো। যুদ্ধের যাবতীয় আমাদের হেড কোয়াটার এবং ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ড যৌথভাবে প্রণয়ন করতেন।এই সকল নীতি কার্যকর করার দায়িত্ব দেওয়া হতো ভারতীয় এবং বাংলাদেশ সেক্টর কমান্ডারদের হাতে। অনেকসময় পরস্পর বিরোধী একাধিক নির্দেশনা আসতো। তখন আরা পড়তাম বিপাকে, কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি হতো।

 

১৫ই জুলাই আমরা অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদের সাথে বৈঠকে  মিলিত হই। এ অনুষ্ঠানে কোন মতবিনিময় কিংবা বিভিন্ন  সেক্টরের পরিস্থিতি সম্পর্কে কোন আলোচনা হয়নি। সে রাতে সেটি ছিল শপথ গ্রহণের অনুষ্ঠান।আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে শপথ গ্রহণ করি।

 

কলকাতা ত্যাগের পূর্বেই জানতে পারলাম পাকিস্তান থেকে কয়েকজন সামরিক অফিসার পালিয়ে আসতে  পেরেছিলেন। এইসব সামরিক অফিসারদের কাছে জানা গেলো যে, অন্যান্য বাঙ্গালী অফিসাররাও আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগদানের উদ্দেশ্যে পালানোর চেষ্টা করছেন। কিন্ত পালানোর এই চেষ্টা অর্থাৎ পাকিস্তানের সীমান্ত পার হয়ে ভারতে আসা এবংযুদ্ধে যোগ দেওয়া খুবই বিপজ্জনক ছিল বিশেষ করে পাকিস্তানে যারা পরিবার- পরিজন নিয়ে বসবাস করছিলেন তাদের জন্য ত বটেই। পাকিস্তান থেকে আমাদের অফিসাররা চলে আসছিলেন এই খবরে আমরা খুবই খুশি হয়েছিলাম। আবার অন্য কিছু ঘটনা আমাদের ভাবিয়ে তুলেছিল। আমাদের যুব শিবির থেকে অসময় কিছু লোক পালিয়ে যায়। হয়তো যুবশিবিরের কষ্ট সহ্য না করতে পেরে কিংবা ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কাজে হতাশাগ্রস্ত হয়ে তারা একাজ করেছিলেন। তবে এদের সংখ্যা ছিল নগণ্য। এই ঘটনা তেমন উল্লেখযোগ্য সমস্যারও সৃষ্টি করেনি।

 

যুবশিবিরের কিছু লোকের মধ্যে হতাশা ছিল একথা সত্য। জুলাইয়ের শেষদিকে মেজর খালেদ মোশাররফ এবং আমি আগরতলার কাছে এই ধরণের একটি শিবির দেখতে যাই। সেখানে তিন হাজারের বেশী যুবক দু’ মাসের বেশী সময় ধরে ট্রেনিংএর জন্য অপেক্ষা করছিলো। স্বাস্থ্যরক্ষার ব্যবস্থা ছিল খুবই দুঃখজনক। খাদ্যও পানি সরবরাহের ব্যবস্থা নেই  বললেই চলে। অন্যান্য যুবশিবিরেরও একই হাল। লক্ষ্যহীন সুদীর্ঘ অপেক্ষার পর একটি লোকের পক্ষে হতাশ হয়ে পড়া খুবই স্বাভাবিক। যুবশিবিরে সংখ্যা পরেরদিকে দ্বিগুণ হওয়া সত্ত্বেও এতো  বিপুলসংখ্যক যুবকের জন্য সকল ব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা দুরূহ হয়ে পড়েছিল।

 

আরেকটি বিষয় উল্লেখ না করে পারছিনা শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় গ্রহণকারী খুব কম লোকের মধ্যেই ট্রেনিং গ্রহণের কিংবা শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাওয়ায় আগ্রহ দেখা যেতো। যুদ্ধকালে এক লাখেরও বেশী মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং নেয়। কিন্ত এরমধ্যে শতকরা একভাগও শরণার্থী শিবিরের লোক ছিলোনা। এর কারণ সম্ভবতঃ যুবশিবিরগুলোতে যারা এসেছিলো তাদের পরিবার-পরিজন বাংলাদেশে ফেলে এসেছিলো তাই ট্রেনিং এর পরই  এরা বাংলাদেশে ফিরে যাবার জন্য ছিল উদগ্রীব । তদের স্বদেশ ত্যাগের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল সামরিক ট্রেনিং গ্রহণ করা।অন্যদিকে বাড়ি থেকে পালিয়ে যারা যুবশিবিরে আশ্রয় নিয়েছিলো তারা পরিবার-পরিজন সহই সেখানে থাকতো। জীবন বাঁচানোর জন্য অন্ততঃ দু’বেলা দু’মুঠো আহার জুটবে এই নিশ্চয়তাও শিবিরে তাদের ছিল। বাংলাদেশে তাদের জন্য দুশ্চিন্তা করার খুব বেশী কেউ ছিলোনা। শিবিরে তাদের জীবনের ভয়ও কম ছিল। এসব কারনেই অন্ততঃ সেই মুহূর্তে দেশে ফেরার তেমন আগ্রহ তাদের ছিলনা।তাদের নিরাপদ স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা কারা করছে ,কিভাবে করছে এই নিয়ে তাদের তেমন মাথাব্যথা ছিলোনা। মনে মনে তারা চাইত কষ্টের কাজটুকু অন্যে করুক, তারা একদিন ধীরেসুস্থে ফিরতে পারলেই হলো। শরণার্থী শিবিরের বাসিন্দাদের মধ্যে এবং নিছক ভয়ে যারা দেশত্যাগ করেছিলো তাদের মধ্যে এই মনোবৃত্তি লক্ষ্য করা গেছে। যুদ্ধে তাদের বিশেষ কোন আবদার ছিলোনা , থাকলে তা ছিল পরিস্থিতিসাপেক্ষ, স্বেচ্ছাপ্রণোদিত নয়। এদিকে শত ভয়ভীতি এবং দারুণ বিপদের মাঝেও যে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙ্গালী দেশে থেকে গিয়েছিলো, স্বাধীনতার জন্যই তাদেরকেই দিতে হয়েছে সবচাইতে বেশীমূল্য।     

Scroll to Top