বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্রের ১৫তম খণ্ডের ২২৪ নং পৃষ্ঠায় মুদ্রিত ২৫ নং দলিল থেকে বলছি…
মমতাজ বেগম
২৫ শে মার্চের রাত্রে আমি ঢাকার দীননাথ সেন রোডে ছিলাম। এখানে থেকে ১লা এপ্রিল কুমিল্লায় যাত্রা করি। কয়েকদিন আমি কসবায় অবস্থান করি। এখানে অবস্থানকালে জনসাধারণকে স্বাধীনতা পক্ষে উৎসাহিত করি এবং আনসার ও স্থানীয় ছাত্রলীগ কর্মীদের সাথে নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে চেষ্টা করি।
ইতিমধ্যে মেজর বাহার কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট হতে পালিয়ে প্রাক্তন সৈনিক, ইপিআর ও আনসার বাহিনীর সদস্যদের একত্রিত করে বাংলাদেশের জন্য একটি সৈন্যদল গঠন করার চেষ্টা করেন। এ সময় আমাদের কিছু সদস্য ভারত সরকারের সাথে যোগাযোগ করে। বাংলাদেশকে শত্রুর কবল থেকে মুক্ত করার জন্য একটি সরকার গঠন করার প্রয়োজন পড়ে। ১০ এপ্রিল যখন সরকার গঠন করা হয় তখন সেখানে মহিলা সদস্যদের মধ্যে শুধু আমিই উপস্থিত ছিলাম। পরে সেই সরকার মুজিবনগর ( কুষ্টিয়ার আম্রকাননে) শপথ গ্রহণ করে।
১২ই এপ্রিল ক্যাপ্টেন ভূঁইয়া আমার সাথে যোগাযোগ করেন। তাঁর নেতৃত্ব আমার ছোট ভাই আজিজ, ফজলু, কদ্দুস, কসবা ছাত্রলীগের সভাপতি কাইউম, দোদুল ও আরো কিছু সংখ্যক ছেলে ইলিয়টগঞ্জ পুল ও কোম্পানিগঞ্জ পুল ধ্বংস করার পরিকল্পনা নেয়। উক্ত দলটি ইলিয়টগঞ্জ ধ্বংস করতে সক্ষম হয় কিন্ত কোম্পানীগঞ্জ পুল ধ্বংস করা যায় নি।
১৩ই এপ্রিল মেজর খালেদ মোশারফ আমার সাথে যোগাযোগ করেন। পরের দিন অতর্কিত পাকবাহিনী কসবা এসে পড়লে আমরা আগরতলার দেবীপুরে চলে যাই।
আগরতলায় পূর্বের মতোই বাংলাদেশ সেনাবাহিনী গঠন করার কাজে সহায়তা করি। এপ্রিল মাসের শেষের দিকে দেবীপুরে (আগরতলা) অবস্থানরত ক্যাপ্টেন গাফফার ও তার বাহিনীর সহযোগিতায় শালদানদীর খাদ্য মুক্তিবাহিনী ও মুজিব বাহিনীর যোদ্ধাদের সামরিক শিক্ষার জন্য এবং শিক্ষাপ্রাপ্তদের দেশের অভ্যন্তরে কুমিল্লায় খাদ্য আশ্রয় ও চিকিৎসার যথাসম্ভব ব্যবস্থা করে দিতেও সচেষ্ট ছিলাম। আমরা মহিলাদেরকেও মুক্তি সংগ্রামে অংশগ্রহণ করার জন্য উদ্ভৃত করি। তাই ‘মহিলা আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী’ নামে একটা সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা হয়। জাহানারা হক এই সংগঠনের সভানেত্রী ও ফরিদা মহিউদ্দিন সেক্রেটারি মনোনীত হন। এখানে মেয়েদের নার্সিং শেখার ব্যবস্থা করা হয়। আমরা বিভিন্ন ক্যাম্পে ত্রাণ কার্যও পরিচালনা করি।
চৌদ্দগ্রাম থানা, কোতোয়ালির বৃহৎ অংশ, বুড়িচং, মুরাদনগরের অংশ বিশেষ, কসবা, আখাউড়া কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট মুক্তিবাহিনীর লক্ষ্যস্থল ও পাকবাহিনীর দুর্ভেদ্য দুর্গ ছিল। সে সময় ঘরবাড়ি, মানুষ, রাস্তাঘাট ও যানবাহন ব্যাপক ক্ষতিসাধিত হয়। কসবা, আখাউড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, লালমাই ও লাকসামে বেশ কয়েকটি গণকবর রচিত হয়।
প্রতিরোধ যুদ্ধের মধ্যে কুমিল্লা পুলিশ লাইনের পুলিশ বাহিনীর কথা উল্লেখ করা যায়। রামমালার আনসার বাহিনী ও প্রতিরোধ যুদ্ধে অবর্তীণ হয় ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে। লালমাই স্টেশনের সন্নিকটে কিছু সংখ্যক ইপিআর ও বেঙ্গল রেজিমেন্টের কিছু লোক প্রায় ৫ দিন পর্যন্ত প্রতিরোধ যুদ্ধ করে। লাকসাম, চৌদ্দগ্রাম, বুড়িচং, কসবা ও আখাউড়া সর্বাধিক নারী নির্যাতন হয়। আমার কসবাস্থ বাসস্থান বোমাবর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে পাক সামরিক জান্তা বিনষ্ট করে।
যুদ্ধকালীন একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হচ্ছে, এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে বন্ধু রাষ্ট্র ভারতে যাওয়ার সময় কর্ণেল এম এ জি ওসমানী আমাদের কসবাস্থ বাসভবনে দুদিন অবস্থান করেন। প্রথম দিকে অবশ্য তাকে আমরা চিনতে পারি নি। কেননা তিনি পরিচয় গোপন রেখেছিলেন এবং তার সু-পরিচিত গোঁফ ছিল না। পরে তাকে চিনতে পারি এবং ভারত যাওয়ার ব্যাপারে সহায়তা করি। পথে এক জায়গায় তাঁকে পাঞ্জাবী মনে করে কয়েকজন মারতে উদ্যত হয়েছিল। কিন্ত আমার এক আত্নীয় সনাক্তকরণের ফলে তাকে রক্ষা করা সম্ভব হয়।
-মমতাজ বেগম
গণপরিষদ সদস্য
( সাবেক এম, এন, এ; মহিলা আসন-৬)
৩০ জুন, ১৯৭৩