শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৭২। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্ব | সেন্ট লুই পোষ্ট ডিসপ্যাচ বাংলাদেশ (ডক্যুমেন্ট ১ম খন্ড) | ১ আগস্ট, ১৯৭১ |
<১৪, ৭২, ১৬৮-১৬৯>
সেন্ট লুই পোষ্ট–ডিসপ্যাচ, আগস্ট ১, ১৯৭১
পাকিস্তানে (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের) দায়িত্ব
সম্পাদকীয়
পুর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতির উপর করা প্রতিবেদনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক উচ্চ কর্মকর্তা বলেন, “পোল্যান্ডে নাৎসিদের সময়ের পর থেকে হিসাব করলে এটা সবথেকে অবিশ্বাস্য”। পরিসংখ্যান খুব মর্মান্তিকঃ কমপক্ষে দুই লক্ষ এবং সম্ভবত সাত লক্ষের মত মৃত; পঁয়ষট্টি লক্ষের বেশি ভারতে শরনার্থী, পাশাপাশি আরো লক্ষ লক্ষ পুর্ব পাকিস্তানে বাস্তুচ্যুত; প্রতিদিন প্রায় পঞ্চাশ হাজারের বেশি ভারত পাড়ি দিচ্ছে; ক্ষুধা ও রোগের শিকার এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বেয়োনেটের খোঁচায় এখনো মারা যাচ্ছে হাজার হাজার।
চার মাস হয়ে গেলো, যখন থেকে পূর্বের একটা বিদ্রোহ দমন করতে বিভক্ত দেশের প্রভাবশালী পশ্চিম অংশের সামরিক বাহিনী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কতৃক বছরধরে সরবরাহকৃত অস্ত্র হাতে নিয়েছে। প্রথমে বিদ্রোহীরা নায্য সরকার গঠনের থেকে সামান্য বেশি চেয়েছিল। এখন বিদ্রোহীরা ভারতের সাহায্য পাওয়ায় গেরিলা প্রতিরোধ বাড়ছে সেখানে এবং পাকিস্তান আবার এক হতে পারবে কিনা সে সন্দেহ ঘনীভূত হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত হয়তো পুর্ব পাকিস্তান ও ভারতের বাঙালীরা মিলে “বাংলাদেশ” নামক একটা নতুন প্রদেশ তৈরি করবে।
অনেক আশা থাকলেও এশিয়ার এই সংকট নিরসনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভুমিকা বলতে গেলে সবথেকে কম। যেমন একজন পর্যবেক্ষক মন্তব্য করেছেন, মনে হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যা করছে তা বাঙালিদের শত্রুতা অর্জন করার জন্য যথেষ্ট হলেও, পাকিস্তানের বন্ধুত্ব জয়ের জন্য যথেষ্ট নয়। বাকচাতুরী নীতির মাধ্যমে আমরা পশ্চিম পাকিস্তানিদের পুর্ব পাকিস্তানে তাদের কৃতকর্মের জন্য কড়া সমালোচনা করছি, এমনকি অর্থনৈতিক সহায়তা বন্ধ করেছি যখন দেশ অনাহারে ভুগছে এবং কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে অস্ত্র পাঠানো বহাল রেখেছি এরকম একটা বিকৃত ভাবনা থেকে যে এসব করা এই দেশের “কৌশলগত স্বার্থ”।
কৌশলগত স্বার্থই যদি প্রধান চিন্তার বিষয় হয় তাহলে এই দ্বন্দ্বের অবসান এবং পুর্ব পাকিস্তান পুনর্গঠনে ওয়াশিংটনের সম্পদ ব্যায়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। ক্রমাগত অস্ত্র প্রেরণে শুধু ধ্বংস সাধিত হবে। ওয়াশিংটনের অজুহাত যুদ্ধবিগ্রহ শুরু হওয়ার আগে পাকিস্তান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার চুক্তির শর্তাবলী পূরণই জাহাজ প্রেরণের মুল লক্ষ্য (যা প্রকৃতপক্ষে যা নিষ্পত্তি মূলক ছিলনা)। যেমন সিনেটর সিমিংটন বলেছেন, “আমরা তাদের থামাতে পারবো না সেজন্য নয়, কিন্তু যেহেতু আমরা তাদের না থামানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি এজন্য এই জাহাজ পাঠাচ্ছি”। অন্যথায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
আমেরিকার প্রেসে মানুষের দুর্দশার প্রতিবেদন মনে করিয়ে দেয়, পুনরাবৃত্তির জন্য মানুষকে ইতিহাস ভুলে যাওয়ার দরকার নেই যা স্যান্টায়ানার সতর্কবানীর পরিপন্থী। লক্ষ লক্ষ বেসামরিক নাগরিক যখন নাৎসিদের হাতে প্রান হারিয়েছিল, বিশ্বের অধিকাংশ দেশ সেই নীরবতা এখনো স্মরণ করে। অজুহাত আছে যে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে কি ঘটছে সেটা কেউ জানতো না। পুর্ব পাকিস্তানিদের উপর যে হত্যা ও নিপীড়ন চলছে সেটাকে হয়তো পরিকল্পিত ভাবে ইহুদী ধ্বংসের সাথে তুলনা করা যাবেনা, কিন্তু এটা যথেষ্ট খারাপ। এবং কেউ বলতে পারবে না “আমি জানতাম না”।
আমাদের কাছে মনে হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পুর্ব পাকিস্তান ও ভারতীয় সীমান্ত জুড়ে দুর্ভাগা মানুষদের আরো সহায়তা দেওয়ার জন্য এবং পুর্ব থেকে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনী উঠিয়ে নিতে বাধ্য। গঠনমূলক পদক্ষেপের জন্য এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে যেটা সপ্তাখানেক আগেও নেওয়া যেতো; এমনকি এই দ্বন্দ্ব বৃহত্তর সংগ্রামে পরিণত হলেও সেটা প্রতিরোধ করতে হয়তো দেরি হয়ে যাবে। কিন্তু দুঃস্থদের সাহায্য করতে নিশ্চয়ই দেরি করা যাবেনা।
সেন্ট লুইস পোষ্ট–ডিসপ্যাচ, আগস্ট ১, ১৯৭১