শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
২৭। মিত্রবাহিনীর তৎপরতা ও অন্যান্য প্রাসঙ্গিক তথ্য | ‘বাংলা নামে দেশ’ অভীক সরকার সম্পাদিত কলিকাতা ১৯৭২, পৃষ্ঠা, ৯৮-১৩৯ | ১৯৭১ |
<১০, ২৭, ৫৩৮-৫৫৮>
মিত্র বাহিনীর তৎপরতা ও অন্যান্য প্রাসঙ্গিক তথ্য (প্রতিবেদন)
৩রা ডিসেম্বর ১৯৭১। মধ্যরাত্রি থেকেই পুরোদমে শুরু হয়ে গেল ভারত-পাকযুদ্ধ। এবং সেই সঙ্গে শুরু হয়ে গেল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়। চতুর্দিক থেকে বাংলাদেশের দখলদার পাকবাহিনীর উপর আক্রমণ শুরু করল ভারতীয় সেনা, বিমান এবং নৌবাহিনী। আর বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা।
সব যুদ্ধই কোনও একটা মুহূর্তে শুরু হয়। কিন্ত তা বলে কোনও যুদ্ধই ঠিক আকস্মিক শুরু হয় না। প্রত্যেকটা যুদ্ধের পেছনে থাকে দীর্ঘদিনের প্রস্তুতি। থাকে বিস্তারিত পরিকল্পনা।যুদ্ধের সম্ভবনা দেখা দিলেই শুরু হয় সেই প্রস্তুতি আর পরিকল্পনা। যেমন এ যুদ্ধেরও ছিল। এবারের ভারত-পাক যুদ্ধের। এবং তাঁরই মূল অংশ বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের চূড়ান্ত লড়াইয়েরও।
এপ্রিল- মে থেকেই ভারতীয় ও পাকিস্তানী প্রতিরক্ষা বাহিনী বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের নিজ নিজ পরিকল্পনা রচনার কাজ শুরু করে দিয়েছিলেন। আর সেই সঙ্গেই শুরু হয়েছিল প্রস্তুতি। সাধারণত লক্ষ্যটা স্থির করে দেন রাষ্ট্রনায়করা। সমরনায়করা সেই অনুসারে তাঁদের পরিকল্পনা রচনা করেন এবং প্রস্তুতি গড়েন।
এপ্রিল মাসের শেষদিকেই ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীর সামনে ভারত সরকার বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের কয়েকটা দিক তুলে ধরেছিলেন। বলেছিলেন- (এক) বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম চালাবে মূলত বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী। ভারতীয় বাহিনী ট্রেনিং এবং অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করবে।(দুই) মুক্তিবাহিনীকে ভারত সরকার সাহায্য দিচ্ছে বলে পাকবাহিনী যদি ভারতের উপর হামলা করে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে সেই আক্রমণের জবাব দিতে হবে।(তিন) বাংলাদেশের সমস্যার যদি কোন রাজনৈতিক সমাধান না হয় তাহলে ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীকেও বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের চূড়ান্ত লড়াইয়ের নামতে হতে পারে।(চার) যদি চূড়ান্ত লড়াইয়ে ভারতীয় প্রতিরক্ষাবাহিনীকে নামতেই হয় তাহলে তার লক্ষ্য হবে রাজধানী ঢাকা সহ গোটা বাংলাদেশকে দখলদার পাকবাহিনীর কবলমুক্ত করা।(পাঁচ) মুক্তিসংগ্রামে যদি প্রত্যক্ষভাবে ভারতীয় প্রতিরক্ষাবাহিনী নামে তাহলে রাজধানীসহ গোটা বাংলাদেশকে খুব দ্রুতগতিতে মুক্ত করতে হবে।(ছয়) বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় বাহিনীর অংশ নেওয়া মানেই হবে পাকিস্তানের সাথে ভারতের যুদ্ধ। সুতরাং লড়াই শুধু পূর্বে হবে না, হবে পশ্চিমেও। এবং(সাত) পাক- ভারত লড়াই হলে উত্তর সীমান্তে চীনের কথাও মনে রাখতে হবে।
এই নির্দেশের উপর ভিত্তি করেই ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী তাঁদের পরিকল্পনা রচনা করল এবং প্রস্তুতি গড়ে তুলল।(এক) মুক্তিবাহিনীকে ট্রেনিং দেওয়া এবং তাদের অস্ত্র সরবরাহ করা।(দুই) বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়ের লড়াইয়ের জন্য পরিকল্পনা রচনা করা এবং তার প্রস্তুতি গড়ে তোলা।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ের পরিকল্পনা রচনা করতে গিয়ে আমাদের প্রতিরক্ষাবাহিনীকে প্রথমেই কতগুলি অসুবিধার কথা বিবেচনা করতে হয়। প্রথমত, বাংলাদেশের প্রকৃতি। বাংলাদেশে অসংখ্য নদীনালা। কতগুলি বিশাল নদী। আর বাংলদেশের প্রায় সর্বত্র জলাভূমি এবং এইসব জলাভূমিতেও শীতকালেও কিছু কিছু জল জমে থাকে।দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের নদীনালাগুলির অধিকাংশই উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রবাহিত। তাই পশ্চিম থেকে পূর্বে অগ্রসর হওয়া বড় কঠিন। অথচ ভারত থেকে বাংলাদেশে কোনও বড় সেনাবাহিনীকে পাঠাতে হলে নানা কারণে পশ্চিম দিক থেকে পাঠানোই সুবিধা। তৃতীয়ত, বাংলাদেশের রাস্তাঘাট অত্যন্ত কম। সামান্য কয়েকটি মাত্র পাকারাস্তা আছে। সেগুলিও অসংখ্য নদীনালার উপর দিয়ে গিয়েছে। চতুর্থত, প্রয়োজনীয় সংখ্যার সৈন্য, বিমান এবং জাহাজবোট পাওয়া যাবেনা।বাংলাদেশে পাক দখলদার বাহিনীতে মোট সৈন্য এবং আধা সৈন্য প্রায় চার ডিভিশন। সামরিক বিশেষজ্ঞদের হিসাব মত ঘাঁটি থেকে কোনও সেনাবাহিনীকে উচ্ছেদ করতে হলে আক্রমণকারীর অন্তত তিনগুন শক্তি চাই। অর্থাৎ বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের জন্য অন্তত বারো ডিভিশন ভারতীয় সৈন্য প্রয়োজন। অথচ, তা পাওয়া যাবে না। কারণ, পশ্চিম খণ্ডেও বহু সৈন্য, বিমান এবং জাহাজ রাখা প্রয়োজন। আর উত্তরের জন্যও কিছু সৈন্য এবং বিমান মজুত রাখতে হবে। পঞ্চমত, এইসব অসুবিধা সত্ত্বেও খুব দ্রুত ঢাকা সহ সারা বাংলাদেশকে মুক্ত করতে হবে- কিন্ত বাংলাদেশে এমন সতর্কভাবে লড়াই চালাতে হবে যাতে সাধারণ নাগরিকের কোনও ক্ষতি না হয়, দেশের কোনও সম্পদ নষ্ট না হয় এবং লড়াইটা চলে শুধু পাকবাহিনীর সাথে। অর্থাৎ তাড়াতাড়ি লড়াই শেষ করতে হবে, কিন্ত আর পাঁচটা লড়াইয়ের মত সর্বাত্মক লড়াই করা যাবে না। এই পরিস্থিতিতে ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী বাংলাদেশের চূড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য একটা বিস্তারিত পরিকল্পনা রচনা করল।
সেই পরিকল্পনা পাঁচটা লক্ষ্য। প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য ক্ষিপ্রতা। ভারতীয় প্রতিরক্ষাবাহিনী স্থির করল যদি যুদ্ধে নামতেই হয় তবে দু সপ্তাহের মধ্যে ঢাকা পৌঁছতে হবে। কেন্দ্রবিন্দু ঢাকা। একমাত্র সেইদিকেই এগুতে হবে। অন্যান্য শহর বা ঘাঁটি দখলের জন্য সময় বা শক্তি নষ্ট করা হবে না। সেগুলো এড়িয়ে যেতে হবে।
দ্বিতীয় লক্ষ্য, শত্রুকে ধোঁকা দেওয়া। তাকে বোঝাতে হবে যে, তার চেয়ে অন্তত চারগুণ শক্তি নিয়ে ভারতীয় বাহিনী আক্রমণ করতে যাচ্ছে যাতে শত্রুপক্ষ তার সৈন্যবাহিনী কোনও একটা এলাকায় জড় না করতে পারে এবং বাংলাদেশের চতুর্দিকে ছড়িয়ে রাখতে বাধ্য হয়।
তৃতীয় লক্ষ্য, সেই ছড়িয়ে পড়া পাকবাহিনীকে আবার একত্রিত হতে না দেওয়া যাতে পাকবাহিনী রিগ্রুপড হয়ে কোনও দ্বিতীয় পর্যায়ে লড়াইয়ে না নামতে পারে এবং যাতে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সৈন্য সরিয়ে এনে তারা ঢাকা রক্ষার জন্য পদ্মাও মেঘনার মাঝামাঝি অঞ্চলে কোনও শক্ত ব্যূহ না রচনা করতে পারে।
চতুর্থ লক্ষ্য, ভারতীয় বাহিনী যাতে পাকবাহিনীর সাথে কোনও যুদ্ধে লিপ্ত না হয়ে পড়ে এবং যেন ভারতীয় বাহিনীর ক্ষতি যথাসম্ভব কম হয়। ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীর পরিচালকরা এটাও জানতেন যে, কোথাও কোন বড় দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধ হলে তাতে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ক্ষতি হবে এবং জাতীয় সম্পদও ধ্বংস হতে বাধ্য। এই জন্য ভারতীয় বাহিনী প্রথমে ঠিক করল বাংলাদেশে ধুক্তে হলে বড় সড়কগুলি এড়িয়ে যাবে। এবং এগুবে কাঁচা পথ দিয়ে যেখানে পাকবাহিনী তাকে আশা করবে না, যেখানে পাকবাহিনীর প্রতিরক্ষা ব্যূহ বা মাইন থাকবে না, যেখানে শত্রুপক্ষ ভারী অস্ত্রশস্ত্র আনতে পারবে না এবং যেখানে জনবসতি খুবই কম থাকবে।
পঞ্চম লক্ষ্য, গোড়া থেকেই আক্রমণটা চালানো এবং পরিচালনা করা যাতে বাংলাদেশের দখলদার পাকবাহিনীর মনোবল লড়াইয়ের প্রায় শুরুতেই ভেঙ্গে দেওয়া যায় এবং যাতে তারা শেষ পর্যন্ত লড়াই না করে আগেই আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।
এই পাঁচটা লক্ষ্য সামনে রেখে ভারত বাংলাদেশের চতুর্দিকে এইভাবে তার সেনাবাহিনীকে সাজালোঃ
২নং কোর। সদর দফতর- কৃষ্ণনগর। প্রধান- লেঃ জেঃ টি, এন রায়না। দুটো পার্বত্য ডিভিশন ৯ম ও ৪র্থ। তৎসহ টি- ৫৫ এস রুশ ট্যাঙ্কে সজ্জিত একটি মাঝারি আর্মাড রেজিমেন্ট, পিটি-৭৬ রুশ ট্যাঙ্ক সজ্জিত আর এক হাল্কা ট্যাঙ্ক রেজিমেন্ট, একটা মাঝারি আর্টিলারি রেজিমেন্ট-১৩০ মিলিমিটার দূরপাল্লার রুশ কামান সহ ব্রিজ তৈরি করতে পারে এমন একটি ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিট। ৯ম ডিভিশন তার প্রধান ঘাঁটি করল ২৪ পরগণার বয়রার কাছাকাছি। ৪র্থ ডিভিশনের মূল ঘাঁটি হল কৃষ্ণনগর গেদের মাঝামাঝি।
৩৩ নং কোর। সদর দফতর- শিলিগুড়ি। প্রধান- লেঃ জেঃ এম, এল, থাপান।৬ এবং ২০ নং পার্বত্য ডিভিশন। তৎসহ রুশ পিটি-৭৬ এস ট্যাঙ্কে সজ্জিত একটি হাল্কা আর্মাড রেজিমেন্ট, ব্রিটিশ ৫.৫ ইঞ্চি কামানে সজ্জিত একটি মাঝারি আর্টিলারি রেজিমেন্ট এবং ব্রিজ তৈরি করার জন্য ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিট। ২০ নং পার্বত্য ডিভিশন প্রধান ঘাঁটি করল বালুরঘাটের কাছে।৬নং ডিভিশন কোচবিহার জেলায়।
এই ৩৩ নং কোরের আর একটা অংশের ঘাঁটি হল গোহাটিতে।পরিচিতিঃ ১০১ নং কমিউনিকেশন জোন। প্রধানঃমেঃ জেঃ জি, এস গিল। শক্তিঃ দুই বিগ্রেড পদাতিক। জামাল্পুরের কাছে প্রচণ্ড এক লড়াইয়ে জেনারেল গিল আহত হওয়ার পর এই বাহিনীর প্রধান হলেন মেঃ জেঃ জি, নাগরা।
৪নং কোর। সদর দফতর- আগরতলা। প্রধান- লেঃ জেঃ সগত সিং। ৮, ৫৭ এবং ২৩ নং পার্বত্য ডিভিশন। তৎসহ দু স্কোয়াড্রন পিটি-৭৬ এস রুশ সাঁতারু ট্যাঙ্ক, ব্রিটিশ ৫.৫ ইঞ্চি কামানে সজ্জিত একটা মাঝারি রেজিমেন্ট এবং ব্রিজ তৈরির ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিট। ঐ তিনটি পার্বত্য ডিভিশনকে ভাগ ভাগ করে বাংলাদেশের পূর্ব সীমান্তে বিভিন্ন এলাকায় দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়।
এটা ভারতীয় সেনাবাহিনীর হিসাব। এর সঙ্গে ছিল কর্নেল ওসমানীর অধীনস্থ প্রায়৬০০০০মুক্তিসেনা। এরা মোটামুটি দুভাগে বিভক্ত ছিলঃ মুক্তিবাহিনী এবং মুজিব বাহিনী বা মুক্তিবাহিনী(এফ-এফ)। ট্রেনিং প্রাপ্ত ও পুনর্গঠিত মুক্তিবাহিনীর সৈন্যরা নবপর্যায়ে জুন মাস থেকেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে লড়াই চালাতে শুরু করেছিল। ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীর পক্ষ থেকে এদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন মেঃ জেঃ বি, এন, সরকার। যুদ্ধ যখন পুরোদমে শুরু হয়ে গেল এবং যখন ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রত্যক্ষভাবে লড়াইয়ে অংশ নিলেন তখন বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনীকে নিয়ে গঠিত হল একটি কমান্ড। এই কমান্ডের প্রধান হলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান লেঃজেঃ জগজিৎ সিং অরোরা।
এখানে দুটো জিনিস বোধহয় আগাম ব্যাখ্যা করে রাখা ভাল। ওপরের তালিকা থেকেই দেখা যাচ্ছে ভারত বাংলাদেশের চতুর্দিকে যে সৈন্য সাজালো তার অধিকাংশ পার্বত্য ডিভিশনের। পার্বত্য ডিভিশন গঠনেও অন্য যেকোনো ডিভিশনের মতই, কিন্ত যেহেতু প্রধানত পাহাড়ে লড়াই করার জন্য পার্বত্য ডিভিশন গঠিত হয় সেই জন্য তাদের অস্ত্রশস্ত্র হয় একটু হাল্কা ধরণের। ট্যাঙ্ক বা ভারী কামান পার্বত্য ডিভিশনে থাকে না। এই জন্যই বাংলাদেশ লড়াইয়ের পরিকল্পনা করে গিয়ে ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী প্রতিটা ডিভিশনের সঙ্গে বাড়তি ট্যাঙ্কও আর্টিলারি রেজিমেন্ট যোগ করে। এর মধ্যে বেশকিছু রাশিয়ান সাঁতারু ট্যাঙ্কও ছিল। দ্বিতীয়ত, পার্বত্য ডিভিশনের সঙ্গে বড় ব্রিজ তৈরি করার মত ইউনিট থাকে না।কারণ, পাহাড়ের উপরে নদী চওড়া হয় না। অথচ, বাংলাদেশ চওড়া নদীতে ভরা। কতকগুলি নদী বিশাল। এই জন্য বাংলাদেশে অপারেশনের দায়িত্ব দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেকটি পার্বত্য ডিভিশনের সঙ্গে বড় বড় ব্রিজ তৈরির ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিটও দেওয়া হল।
স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হওয়ার পর থেকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রনায়করা তিন পর্যায়ের তিন কিস্তি সামরিক পরিকল্পনা তৈরি করে। প্রথম পর্যায়, ২৫শে মার্চ থেকে এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত। এই পর্যায়ে পাকিস্তানী সামরিক পরিকল্পনা ছিলঃ সমস্ত শহরগুলিতে ঝটিতি বাঙ্গালীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়, যাকেই স্বাধীনতা সংগ্রামী বলে মনে হয় তাকেই শেষ করে দাও। দ্বিতীয় পর্যায়ে, অর্থাৎ যখন ট্রেনিং সহ পুনর্গঠিত মুক্তিবাহিনী যখন গেরিলা কায়দায় আক্রমণ শুরু করল তখন পাকবাহিনীও বাংলাদেশে তার সামরিক পরিকল্পনা পাল্টালো। এই পর্যায়ে তারা শুধু সেনাবাহিনীর উপর নির্ভর করল না। গড়ে তুলল দুটি স্থানীয় বাহিনীও। এর একটা হল রাজাকার বাহিনী- সামান্য ট্রেনিং প্রাপ্ত অত্যাচারীর দল। আর একটা আলবদর বাহিনী- প্রধানত ধর্মান্ধ এবং গুণ্ডা শ্রেণীর লোকদের নিয়ে গঠিত সামরিক বাহিনী। গেরিলা এবং পাক বিরোধীদের খতম করার জন্য পাক সামরিক বাহিনী এই দুই দালাল বাহিনীর সাহায্য নিল। রাজাকার বাহিনীর হাতেও অস্ত্র দেওয়া হল-প্রধানত রাইফেল। নানা রকমের দায়িত্ব পেল তারা। যেমন, গেরিলাদের খুঁজে বের করা, গেরিলাদের সহকারী এবং আশ্রয়দাতাদের উপর অত্যাচার চালানো ও তাদের নামধাম সেনাবাহিনীকে সরবরাহ করা, ব্রিজ রেললাইন ইত্যাদি পাহারা দেওয়া। আলবদর বাহিনীকেও মোটামুটি একই রকমের দায়িত্ব দেওয়া হল- এক পাহারা দেওয়া ছাড়া। তাদের সক্রিয় করে তোলা হল প্রধানত শহর অঞ্চলে। শহরে এবং শহরের আশেপাশে যারা যারা পাকিস্তান বিরোধী এবং মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক তাদের খুঁজে বের করার দায়িত্ব পেল আলবদর। সেনাবাহিনী এই বাহিনীর কাজকর্ম নিয়মিত তদারক করত। এই দুই বাহিনীকেই সেনাবাহিনী ঢালাও সাহায্য দেওয়ারও ব্যবস্থা করেছিল।
মুক্তিবাহিনীকে গেলিরা আক্রমণ যতই বাড়াতে থাকল পাক কর্তৃপক্ষ ততই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। সাধারণ বাঙ্গালীর উপর সেনাবাহিনীও তার দুই দালাল গোষ্ঠীর অত্যাচারও বেড়ে চলল। একদিকে যখন সাধারণ মানুষের উপর, বিশেষ করে সাধারণ গ্রামবাসীর উপর অত্যাচার বাড়তে থাকল অন্যদিকে তখনই পাক সেনাবাহিনী সীমান্তেই মুক্তিবাহিনীর অনুপ্রবেশ বন্ধ করার জন্য ভারত- বাংলাদেশ সীমান্তের কাছাকাছি চলে আসার চেষ্টা করল। বর্ষাকালে এই কাজে তাদের অসুবিধা হল। কিন্ত বর্ষা একটু কমতেই তারা রাজাকারদের নিয়ে সীমান্তের জত সম্ভব কাছাকাছি চলে আসার চেষ্টা করল। সেপ্টেম্বর মাস নাগাদ এই ব্যাপারটা চূড়ান্ত পর্যায়ে উঠল। ২৭৪ টা সীমান্ত চৌকির মধ্যে ওরা প্রায় ২১০ টায় পৌঁছে গেল। ২৫ মার্চের পর পাক ফৌজও সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে ছেড়ে দিতে হয়েছিল। এই রকম সময়ে পাক রাষ্ট্রনায়করা তাদের ঢাকা কর্তৃপক্ষের জন্য আবার তাদের নতুন নির্দেশনাবলী প্রথম ভাগটা ছিল পরিস্থিতি বিশ্লেষণ। সমগ্র আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে পাক কর্তৃপক্ষ বললঃ আমরা মনে করি ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় বিচ্ছিন্নতাবাদীরা পূর্ব পাকিস্তানের কতগুলি সীমান্ত অঞ্চল দখল করার চেষ্টা করবে এবং ভারত সরকার সেই দখল করা এলাকায় স্বাধীন বাংলা সরকার বস্তুটিকে প্রতিষ্ঠিত করবে। তারপর সেই তথাকথিত স্বাধীন বাংলা সরকার দেখিয়ে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক চাপ বাড়াবার চেষ্টা করবে। আমাদের মনে হয় না ভারত সরকার গোটা পূর্ব পাকিস্তান দখল করার পরিকল্পনা নিয়ে নামবে। সে সাহস তারা পাবে না। তারা চাইবে সীমান্তের কাছাকাছি কয়েকটা বড় শহর নিয়ে তথাকথিত একটা মুক্ত এলাকা গঠন করতে।
এই বিশ্লেষণের উপর ভিত্তি করে ইসলামাবাদ ঢাকাকে নির্দেশ দিলঃ সুতরাং, এমনভাবে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সাজাতে হবে যাতে ওরা পূর্ব পাকিস্তানের কোনও বড় এলাকা না দখল করতে পারে। সীমান্ত অঞ্চলে এক আধ মাইল ওরা ঢুকে পড়লে ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই।কিন্ত বেশী দূর কিছুতেই দেওয়া হবে না।
এই নির্দেশ পেয়েই বাংলাদেশে দখলদার পাকবাহিনীর প্রধান লেঃ জেঃ এ, এ, কে নিয়াজী বোঝার চেষ্টা করল ভারতীয় সেনাবাহিনী কোন দিকটায় ঢোকার চেষ্টা করতে পারে। নানাভাবে খবর নিল। পাত্র মিত্রদের নিয়ে বারবার পরামর্শ করল।কিন্ত কিছুতেই বুঝতে পারল না ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং মুক্তিবাহিনী কোন দিক থেকে এগিয়ে কোন এলাকা মুক্ত করতে চাইতে পারে। ততদিনে সীমান্তে ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রস্তুতি পুরোদমে শুরু হয়ে গিয়েছে। নিয়াজি সবদিকে খবর নিল।এবং দেখল চতুর্দিকের প্রস্তুতি।যে কোনও দিক থেকে আক্রমণ হতে পারে। এই অবস্থায় নিয়াজি একটা ‘’ মাষ্টার প্লান’’ তৈরি করল। তার পরিকল্পনাটা হল এই রকমঃ সীমান্তের সবগুলি রাস্তার উপর প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরি করা হবে। ভারতীয় বাহিনী যেখানে যেখানে জড় হয়েছে তার উল্টো দিকে সুদৃঢ় বাঙ্কার তৈরি করে তাতে ভারতীয় কামান সহ পাকসেনাদের বসিয়ে দেওয়া হবে। যে রাস্তা দিয়েই ভারতীয় বাহিনী অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করুক সেই রাস্তায়ই তাকে বাধা দেওয়া হবে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর মোকাবিলা করবে পাক সেনাবাহিনী। আর অন্যান্য আধা সৈনিকরা লড়বে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে।
পরিকল্পনা পাকা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নিয়াজি তার গোটা সেনাবাহিনীকে বাংলাদেশের চতুর্দিকে ছড়িয়ে দিল।সীমান্ত থেকে দেশের ভেতরে দশ-পনেরো মাইল, কোথাও ত্রিশ- চল্লিশ মাইল পর্যন্ত বড় বড় সড়কের উপর অসংখ্য বাঙ্কার তৈরি করল এবং প্রধান প্রধান ভারতীয় ঘাঁটির মুখোমুখি ভারী কামান ও ট্যাঙ্ক সহ পাকবাহিনীকে দাঁড় করিয়ে দিল।
ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীর কর্মকর্তারা তা দেখে ভীষণ খুশি হলেন। তারা বুঝলেন পাখি ফাঁদে পা দিয়েছে। নিয়াজি তার সেনাবাহিনীকে দেশের চতুর্দিকে ছড়িয়ে দিয়েছে, গোটা সীমান্তটা রক্ষা করতে চাইছে এবং বুঝতেই পারছে না যে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে প্রত্যক্ষভাবে যোগ দিলে ভারতীয় সেনাবাহিনী কোন দিক দিয়ে এগুবে। বাংলাদেশে নিয়াজির হাতে তখন পাক সেনাবাহিনীর প্রায় ৪২টা নিয়মিত ব্যাটালিয়ন।৩৫ ব্যাটালিয়ন পাকসেনা এবং ৭ ব্যাটালিয়ন রেনজার। আর আধা সামরিকদের মধ্যে ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আরমড ফোর্সেস ১৭ টা উইং এবং ৫ উইং মোজাহেদ। অর্থাৎ মোট নিয়মিত বাহিনীর সৈন্য প্রায় ৪০০০০। এবং আধা সামরিক বাহিনীতে প্রায় ২৪২০০ লোক। এছাড়াও পাক কর্তৃপক্ষের হাতে বাংলাদেশের আরও ২৪০০০ ইন্ডাস্ট্রিয়াল সিকিউরিটি ফোর্স ছিল। মোট সৈন্য ছিল মাত্র ৪২ ব্যাটালিয়ন। কিন্ত নামে ডিভিশন ছিল চারটা। ১৪, ৩৯, ৯ এবং ১৬। এছাড়াও ৩৬ নং ডিভিশন নামে আর একটা ডিভিশন ছিল মেজর জামসেদের অধীনে। প্রধানত আধা সৈনিকেরা এই ডিভিশনের আওতায় ছিল।
সীমান্তের চতুর্দিকে এই বাহিনীকে সাজিয়ে দিয়ে নিয়াজি বেশ পরিতৃপ্ত হলেন। তার হাতে তখন গুলিগোলা প্রচুর। নিয়াজি যত সৈন্য চেয়েছিল পাক কর্তৃপক্ষ তা কখনও তাকে দেয় নি, চাহিদামত ট্যাঙ্ক,বিমান ও কামানও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসেনি। কিন্ত পাকিস্তানের কর্তারা নিয়াজিকে গোলাবারুদ দিতে কার্পণ্য করেনি। যা চেয়েছিল তার চেয়েও বেশি দিয়েছিল।মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন থেকে পাঠান প্রচুর গোলাগুলি তখন পাক কর্তৃপক্ষের হাতে। নিয়াজির নবম ডিভিশন তখন যশোরের ঘাঁটিতে। নবম ডিভিশনের সৈন্যরা সাতক্ষীরা থেকে কুষ্টিয়া পর্যন্ত ছড়িয়ে দাঁড়াল। ষোড়শ ডিভিশনের প্রথম হেড কোয়াটার ছিল নাটোরে। সরিয়ে সেটাকে নিয়ে আসা হল বগুড়ায়। গঙ্গা- ব্রহ্মপুত্রের মধ্যবর্তী অঞ্চলের সমগ্র সীমান্তে ষোড়শ পাক ডিভিশনের সৈন্যরা বাঙ্কার করে বসল।১৪ এবং ৩৯ নং ডিভিশনের ভাগে পড়ল পূর্ব সীমান্ত রক্ষার দায়িত্ব। উত্তর সীমান্তের জামালপুর থেকে দক্ষিণে কক্সবাজার পর্যন্ত ১৪ এবং ৩৯ ডিভিশনের সৈন্যরা ছড়িয়ে।
বাংলাদেশে পাকবাহিনীর হাতে ছিল ৮৪টি মার্কিন স্যাফি ট্যাঙ্ক। আর ছিল শ’ আড়াই মাঝারি বা ভারী কামান। নিয়াজি তাও সব সীমান্তের কাছাকাছি নিয়ে এল। এবং দৃশ্যমান প্রধান প্রধান ভারতীয় ঘাঁটিগুলির মুখোমুখি দাঁড়াবার জন্য এর প্রায় সব কিছু নিয়ে জড় করল পাঁচটা কেন্দ্রে- চৌগাছা, হিলি, জামালপুর, সিলেট এবং আখাউড়ায়। দু’ পক্ষই বুঝেছিল যা হওয়ার শীতকালেই হবে। তাই দুপক্ষই অক্টোবর- নভেম্বর মধ্যেই সীমান্তে সৈন্য- সামন্ত সাজিয়ে বসল। ওদিকে খোদ পাক সৈন্যবাহিনীও গেরিলাদের আক্রমণে ব্যতিব্যস্ত। গোটা সীমান্ত বরাবর এলাকায় রাত্রে পাক সৈন্যবাহিনীর পক্ষে চলাচল অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল। নিয়াজি বুঝল এবার বড় দরের কিছু একটা না করতে পারলেই নয়। তখন সীমান্তেও তার সৈন্যবাহিনী দাড়িয়ে গেছে। নিয়াজির বুকে তাই বেশ বল। হাজার হাজার লোককে বেগার খাঁটিয়ে গোটা সীমান্ত জুড়ে হাজার হাজার বাঙ্কারও তৈরি হয়ে গিয়েছে।পাক সেনাবাহিনীর লোকজনেরা সেই সব বাঙ্কারে পজিশনও নিয়ে নিয়েছে। নিয়াজি তাই হুকুম দিলঃ প্রয়োজনে সীমান্তের ওপারে গিয়ে মুক্তিবাহিনীকে ঘায়েল করে এস।
নভেম্বরেই শুরু হয়ে গেল পাক সেনাবাহিনীর ভারতীয় সীমান্ত অতিক্রম। সর্বত্র এই ঘটনা ঘটতে আরম্ভ করল। চব্বিশ পরগণায়, নদীয়ায়, দিনাজপুরে, কোচবিহারে, আসামের বিভিন্ন প্রান্তে এবং ত্রিপুরার বিভিন্ন অঞ্চলে। ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং সীমান্ত রক্ষীবাহিনী অর্থাৎ বি এস এফ ও প্রত্যুত্তর দিতে আরম্ভ করল। শুরু হয়ে গেল সীমান্তের বিভিন্ন অঞ্চলে গোলাগুলি বিনিময়। এবং প্রায় প্রতিদিন এই জিনিস বেড়ে চলল।
নভেম্বরের গোঁড়ায় পাকিস্তানীরা ত্রিপুরায় প্রচণ্ড গোলা বর্ষণ শুরু করল। তারা গোলাগুলি চালাল প্রধানত আখাউড়া অঞ্চল থেকে। এই গোলা বর্ষণে কমলপুর শহর এবং আশেপাশের কতগুলি গ্রাম বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হল। ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং সীমান্ত রক্ষীবাহিনী ও নিয়মিত জবাব দিল।ওদিকে তখন মুক্তিবাহিনীও ঢাকা- চট্টগ্রাম রেললাইন ও সড়কপথ কেটে দেওয়ার চেষ্টা করছে।
আখাউড়ার কাছে পাকিস্তানীরা একটা বড় ঘাঁটি করেছিল। এর কারণও ছিল। বাংলাদেশের ট্রেন- সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থায় আখাউড়ার স্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চট্টগ্রাম- ঢাকা- শ্রীহট্ট- ময়মনসিংহ রেল পথে আখাউড়া প্রধান জংশন। রেলপথ চট্টগ্রাম থেকে এসে আখাউড়ায় দুভাগ হয়ে গিয়েছে। একটা উত্তর- পূর্বে চলে গিয়েছে শ্রীহট্টের দিকে। আর একটা মেঘনা নদী ডিঙ্গিয়ে উত্তরে গিয়েছে ময়মনসিংহের পথে। দক্ষিণে লাইনটা গিয়েছে ঢাকায়। আখাউড়া তাই বেশ গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি। ভারতের একেবারে লাগোয়া। পাক সমর নায়করা জানত, সুযোগ পেলেই মুক্তিবাহিনী আখাউড়া দখল করে চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে বাংলাদেশের বাদবাকি অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে। তারা আরও জানত, লড়াই হলে ভারতীয় সেনাবাহিনীও সঙ্গে সঙ্গে আখাউড়া দখলের চেষ্টা করবে। তাই তারা আখাউড়ায় বেশ শক্ত একটা ঘাঁটি তৈরি করেছিল। এবং এই শক্ত ঘাঁটি থেকেই ত্রিপুরার নানা এলাকায় অবিরাম গোলাবর্ষণ করছিল। কিছুটা দক্ষিণে ফেনীর কাছাকাছি তারা আর একটা বড় ঘাঁটি তৈরি করেছিল। একই উদ্দেশ্য ঢাকা- চট্টগ্রাম- শ্রীহট্ট যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন চেষ্টায় বাধাদান।
এই ফেনীর ঘাঁটি থেকেও পাকিস্তানীরা ভারতীয় এলাকার উপর প্রচণ্ড গোলাগুলি শুরু করল। পাঁচ- ছয়দিন এইভাবে চলার পর ভারতীয় প্রতিরক্ষাবাহিনী দেখল এগিয়ে গিয়ে পাক ঘাঁটিগুলি ধ্বংস করে দিয়ে না এলে এই গোলা বর্ষণ বন্ধ করা যাবে না। কারণ পাকিস্তানীরা কংক্রিটের বাঙ্কার তৈরি করে তার ভেতরে বসে গোলা চালাচ্ছে। দূর থেকে গোলা ছুঁড়ে কংক্রিটের ঘায়েল করা যাচ্ছে না। তাই পূর্ব সীমান্তের সৈন্যবাহিনী তখন এগিয়ে গিয়ে পাক ঘাঁটি ধ্বংস করার অনুমতি চাইল দিল্লীতে। সমগ্র পরিস্থিতি বিবেচনা করে দিল্লীও সেই অনুমতি দিয়ে দিল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হল অ্যাকশন। ৮নভেম্বর জাতীয় ভারত বাহিনী এগিয়ে গিয়ে ত্রিপুরা সীমান্তবর্তী পাক ঘাঁটিগুলিতে জোর আঘাত হানল। পাকিস্তানীরা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করল। কিন্ত পারল না।সীমান্তবর্তী ঘাঁটিগুলো ছেড়ে তাদের পালাতে হল।
এক অ্যাকশনের দুটো প্রত্যক্ষ ফল হল। প্রথমত, ত্রিপুরার বিভিন্ন এলাকার উপর কামানের গোলা বর্ষণ ততটা ক্ষমতা আর পাকিস্তানীদের থাকল না।দ্বিতীয়ত, মুক্তিবাহিনীও আরও জোরে পাকবাহিনীর উপর আক্রমণ করার সুযোগ পেল। কারণ, পাকবাহিনী তখন শক্ত ঘাঁটি থেকে উচ্ছেদ হয়েছে।
গোলাগুলি যেমন বাংলাদেশের পূর্ব প্রান্তে চলছিল তেমনি চলছিল পশ্চিম প্রান্তেও। পশ্চিম প্রান্তে সবচেয়ে বেশী চলছিল তিনটি এলাকা- বালুরঘাটে, গেদেতে এবং বয়রায়। অক্টোবরের শেষ থেকেই প্রায় প্রতিদিনই পাকবাহিনী এই অঞ্চলে হানা দিচ্ছিল। বিভিন্ন ভারতীয় গ্রামের লোক পাক গোলা বর্ষণের ফলে মারাও যাচ্ছিলেন। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে পাকিস্তানীরা এই তিনটি ঘাঁটির উপর বড় বড় কামানের গোলা বর্ষণ শুরু করল। ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী এবং সীমান্ত রক্ষীরা তার জবাবও দিচ্ছিল। কিন্ত এখানেও সেই একই সমস্যা দেখা দিল। পাকিস্তানীরা বাঙ্কারের মধ্যে বসে বসে দুরপাল্লার কামান চালাচ্ছে। কখনও কখনও সেই কামানের গোলাবর্ষণের আড়ালে এসে ভারতীয় গ্রামগুলির উপরও আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে বাধ্য হয়ে এখানেও ভারতীয় সেনাবাহিনীকে এগিয়ে যেতে হল।
বয়রা অঞ্চলে সীমান্ত হল কপোতাক্ষ নদ। বয়রা থেকে একেবারে সোজা মাইল বারো- তেরোর মধ্যেই যশোর ক্যান্টমেন্ট। ভারতীয় সেনাবাহিনী কপোতাক্ষের পশ্চিম পাড়ে জড় হতেই যশোর ক্যান্টমেন্ট থেকে পাক সেনাবাহিনীও এগিয়ে এসেছিল। কংক্রিটের প্রতিরক্ষাবাহিনী তখন দিল্লীর নতুন নির্দেশ পেয়ে গিয়েছে। সেই নির্দেশের মর্ম কথা, প্রয়োজন হলে সর্বত্র এগিয়ে গিয়ে এদের ওদের ঘাঁটিগুলো ধ্বংস করে দিয়ে আসবে। যেন ওই সব ঘাঁটি থেকে আক্রমণ চালিয়ে ওরা না এপারের মানুষ মারতে পারে। ভারতীয় বাহিনী তাই কপোতাক্ষ অতিক্রম করে এগিয়ে গেল।
সেদিন ২১ নভেম্বর। ওদিক থেকে এগিয়ে এল পাকবাহিনীও।সঙ্গে নিয়ে এল ১৪টা চীনা সাফি ট্যাঙ্ক। ভারী ভারী কামান। এবং পাঁচ হাজার সৈন্য।
শুরু হল তুমুল লড়াই। ভারতীয় বাহিনীও বাধ্য হয়ে ট্যাঙ্ক নিয়ে আসছিল। ট্যাঙ্কে, কামানে, মেশিনগানে প্রচণ্ড যুদ্ধ হওয়ার পর দেখা গেল প্রথম রাত্রি লড়াই শেষে পাকিস্তানের ছয় ঘণ্টা স্যাফি ট্যাঙ্কই ঘায়েল। গোটা আটেক পিছু হটে পালিয়েছে।ভারতীয় বাহিনী কিন্ত সেখানেই পাকবাহিনীকে ছাড়ল না। আরও এগিয়ে এল। জগন্নাথপুর এবং গরীবপুর ছাড়িয়ে।পাক সেনাবাহিনী ওখানেও বেশ শক্ত প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরি করেছিল।দ্বিতীয় দিন আরও বড় লড়াই হল।এবং সেখানে আরও সাতটা পাকিস্তানী স্যাফি ট্যাঙ্ক ঘায়েল হল। দ্বিতীয় দিনের লড়াইয়ে পাকিস্তান তার বিমানবাহিনীকে পুরোপুরিভাবে আসরে নামাল। প্রথম দিনের লড়াইয়েই পাক বিমানবাহিনী যোগ দিয়েছিল। কিন্ত বেশীক্ষণের জন্য নয়। ভারতীয় বিমানবাহিনী আসার আগেই তারা পালিয়ে যায়। দ্বিতীয় দিন পাক বিমানবাহিনীর বিমান আকাশে ওড়া মাত্র ভারতীয় বিমানও আকাশে উড়ল।শুরু হল বিমান যুদ্ধ। দুপুরবেলা। তিনখানা পাক স্যাবর জেট ধ্বংস হল সেই লড়াইয়ে।
তেরখানা ট্যাঙ্ক, তিনখানা বিমান এবং বেশকিছু সৈন্যসামন্ত হারিয়ে পাক সেনাবাহিনী রণে ভঙ্গ দিল।ভারতীয় সেনাবাহিনী আর এগোলা না। কারণ, তখনও দিল্লী থেকে তেমন নির্দেশ আসেনি। তবে জগন্নাথপুর আর গরীবপুর ছেড়েও চলে এল না।ওইখানেই ঘাঁটি গেঁড়ে বসে রইল। এখানেও একই ফল হল। ভারতীয় গ্রামের উপর গোলা বর্ষণ বন্ধ হল।মুক্তিবাহিনী যশোর ক্যান্টমেন্টের চতুর্দিকে আক্রমণ করার সুযোগ পেল।
এই পর্যায়ে তৃতীয় বড় লড়াই হয় বালুরঘাটে।পূর্বে যেমন আখাউড়া, পশ্চিমে তেমনি হিলি। বালুরঘাট অঞ্চলটা কুজেরই শীর্ষবিন্দু হল হিলি। হিলি শহরটা পশ্চিম বাংলার ভেতরে, কিন্ত হিলি রেলস্টেশন বাংলাদেশের মধ্যে।এই হিলি স্টেশন হয়েই চলে গিয়েছে বাংলাদেশের অন্যতম রেলপথ। যে রেলপথ বাংলাদেশের উত্তর খণ্ডের সঙ্গে বাদবাকি অঞ্চলের যোগাযোগ রক্ষা করছে।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাকবাহিনী বুঝল মুক্তিবাহিনী এই রেলপথটা বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করবে। তাই শুরু থেকেই তারা হিলি স্টেশনে একটি শক্ত ঘাঁটি তৈরি করল।কিন্ত তৎসত্ত্বেও শুরু থেকেই হিলির উপর আক্রমণ চালাচ্ছিল। অক্টোবরের শেষাশেষি ভারতীয় প্রতিরক্ষাবাহিনীও বালুরঘাট অঞ্চলে বড় ঘাঁটি তৈরি করল। পাকিস্তানীরা ততদিনে হিলির ঘাঁটি আরও করেছে। খুব বড় বড় বেজায় মজবুত অসংখ্য বাঙ্কার তৈরি করেছিল।
সমগ্র সীমান্তে যখন উত্তেজনা এবং গোলাগুলি চলছে সেই সময় পাকিস্তানী সৈন্যরা ঐ কুজের উত্তর ও দক্ষিণ দিক থেকে বালুরঘাটের উপর প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ শুরু করল। প্রথম প্রথম কয়েকদিন ব্যাপারটা শুধু গোলাবর্ষণে সীমাবদ্ধ রইল। তারপর তারা এগোবার চেষ্টা করল তাদের আসল উদ্দেশ্য নিয়ে। সেই উদ্দেশ্যে দক্ষিণ দিক থেকে প্রচণ্ড আক্রমণ করে ঐ কুজটা কেটে দেওয়া এবং ওইভাবে বালুরঘাটে ভারতীয় সামরিক ঘাঁটিটাকে মূল ভূখণ্ড বিচ্ছিন্ন করে ফেলা। এজন্য তারা বাংলাদেশের ধামরাহাট এবং সাপাথের মাঝামাঝি অঞ্চল থেকে ট্যাঙ্ক এবং ভারী কামান নিয়ে ভারতীয় এলাকায় ঢুকে পড়ার চেষ্টা করল। ওদিকে ভারতীয় বাহিনীও তখন চুপচাপ বসে নেই। কুজের উত্তরও দক্ষিণ থেকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর প্রস্তুতি দেখেই তারা শত্রুপক্ষের উদ্দেশ্যটা বুঝে গিয়েছিল এবং সেইমত প্রস্তুত হচ্ছিল।
নভেম্বরের শেষাশেষি এই অঞ্চলে একটা পুরোদমে লড়াই-ই শুরু হয়ে গেল। প্রথম প্রথম ভারতীয় সেনাবাহিনী শুধু ঘাঁটিতে বসেই পাকিস্তানী গোলার জবাব দিচ্ছিল। কিন্ত যে মুহূর্তে ওরা ট্যাঙ্ক নিয়ে আসার চেষ্টা করল ভারতীয় বাহিনীও তাদের ট্যাঙ্ক নিয়ে এগিয়ে গেল।২৫,২৬,২৭ নভেম্বর গোটা অঞ্চল জুড়ে বড় ট্যাঙ্কের লড়াই হয়ে গেল। এবং শেষদিনের লড়াইয়ে পাকসেনারা এত মার খেল ধামরার হাটের দিকে পালাতে বাধ্য হয়। এই যুদ্ধে পাকিস্তান মোট পাঁচটা ট্যাঙ্ক হারাল। কিন্ত ট্যাঙ্ক হারিয়ে বা বড় মার খেয়েও পাকবাহিনী হিলি স্টেশন ছাড়তে চাইল না। ভারতীয় সেনাবাহিনী অবশ্য হিলি স্টেশন দখল করার জন্য তেমনভাবে অগ্রসর হল না।
এইভাবে গোটা সীমান্তে অঘোষিত লড়াই চলতে চলতে শুরু হয়ে গেল পুরোপুরি যুদ্ধ- ঘোষিত হল পাক-ভারত লড়াই। এবং লড়াই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই বাংলাদেশের চতুর্দিক থেকে এগিয়ে গেল ভারতীয় সেনাবাহিনী আর বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধারা। নিয়াজি তখন চোখে সর্ষে ফুল দেখল। এবং এই সর্ষে ফুলেই বাংলাদেশে পাকসেনা নায়ক ইসলামাবাদ থেকে পূর্ণ যুদ্ধের খবর পেয়েও তারা রণকৌশল পাল্টালো না। তখনও তার সেনাবাহিনী এবং কামান-বন্দুক গোটা দেশের সীমান্তেই ছড়ানো রইল। এবং নিয়াজি তখনও সীমান্তে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে প্রতিহত করার জন্য ব্যগ্র। এর মধ্যেও কিছুটা বাস্তব বুদ্ধির পরিচয় দিল পাক নবম ডিভিশনের প্রধান জেনারেল আনসারি। তার সদর ঘাঁটি সরিয়ে নেওয়া হল আরও বেশকিছু ভেতরে- মাগুরায়। শোনা যায় সেটা প্রধানত কামানের গোলা খাওয়ার ভয়ে। গরীবপুরের লড়াইয়ের পর খোদ যশোর ক্যান্টমেন্ট ভারতীয় কামানের রেঞ্জের মধ্যে এসে গিয়েছিল। নবম পাক ডিভিশনের প্রধান হেড কোয়াটার যশোর থেকে সরালো; কিন্ত সৈন্যসামন্ত যেমন সীমান্তে ছিল তেমনি রইল।তখনও পাকসেনা নায়কদের সংকল্প বাঙ্কারে বসে গোলা চালিয়েই ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং মুক্তিবাহিনীর অগ্রগতি রোধ করবে।
যে কোনও মুহূর্তে পাকিস্তান সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে এ খবর নভেম্বরের শেষদিকেই ভারতীয় প্রতিরক্ষাবাহিনী পেয়েছিল। তাই যে কোন মুহূর্তে লড়াইয়ে নামার জন্য ভারতীয় সেনা, বিমান এবং নৌবাহিনীও প্রস্তুত ছিল।৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় বিমান যখন অতর্কিত ভারতের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল তার উত্তর পেতে মোটেই দেরি হল না। দুই সীমান্তেই জবাব পেল সাথে সাথেই। পূর্বেও । পশ্চিমেও।
৩ ডিসেম্বরঃ ফোর্ট উইলিয়াম থেকে সংকেত পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ৩ তারিখ রাত্রেই ভারতীয় সেনাবাহিনী চতুর্দিক থেকে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ল। নবম ডিভিশন এগোলো গরীবপুর, জগন্নাথপুর দিয়ে ঢাকা- যশোর হাইওয়ের দিকে। চতুর্থ ডিভিশন মেহেরপুরকে পাশ কাটিয়ে কালিগঞ্জ-ঝিনাইদহের দিকে। বিংশতিতম ডিভিশন তার দায়িত্ব দুভাগে বিভক্ত করে নিল- একটা অংশ রইল হিলির পাক ঘাঁটি মোকাবিলা করার জন্য। আর একটা অংশ হিলিকে উত্তরে রেখে এগিয়ে চলল পুবে। ষষ্ঠ ডিভিশনও তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে অগ্রসর হল- একটা তেতুলিয়া থেকে ঠাকুরগাঁওয়ের দিকে, আর একটা পাটগ্রাম থেকে কালিগঞ্জের মুখে এবং তৃতীয়টা কোচবিহার থেকে নাগেশ্বরী- কুড়িগ্রামের দিকে। উত্তর মেঘালয়ের দিকে যে দুটো বিগ্রেড তৈরি হয়েছিল তারাও ঐ রাত্রিতেই এগিয়ে গেল। একটা ঢালু থেকে নেমে এগিয়ে গেল জামালপুরের দিকে। আর একটা, এক বিশেষ উদ্দেশ্য, একটু এগিয়ে দাঁড়িয়ে রইল হালুয়াঘাটের মুখোমুখি।
পূর্ব দিক থেকেও একই সঙ্গে ৮,৫৭ এবং ২৩ নং ডিভিশন নানা ভাগে বিভক্ত হয়ে বাংলাদেশে ঢুকল। একটা বাহিনী এল সুনামগঞ্জ থেকে সিলেটের দিকে। ছোট ছোট তিনটা বাহিনী এগিয়ে চলল হবিগঞ্জ এবং মৌলভীবাজারের পথে। আখাউড়াকে সোজাসুজি আঘাত করে গোটা একটা বিগ্রেডই এগিয়ে চলল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে।
ওদিকে কুমিল্লা ময়নামতি ক্যান্টমেন্টে পাকিস্তানীদের বেশ একটা শক্ত ঘাঁটি ছিল। কুমিল্লা সেক্টরের দায়িত্ব ছিল আমাদের ২৩নং ডিভিশনের উপর। যুদ্ধ শুরু হতেই ডিভিশন কুমিল্লা শহরকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে চলল দাউদকান্দির পথে।ময়নামতি ক্যান্টমেন্টের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার জন্য রেখে গেল মাত্র কয়েক কোম্পানী সৈন্যকে। এই ২৩ নং ডিভিশনেরই আর একটা বিগ্রেড চৌদ্দগ্রাম থেকে অগ্রসর হল লাকসামের দিকে। লক্ষ্য চাঁদপুর। পাকবাহিনীও এই আক্রমণ আঁচ করে লাকসাম একটা শক্ত ঘাঁটি তৈরি করে রেখেছিল। এখানেও ভারতীয় বাহিনী সেই একই কৌশল নিল। লাকসামের পাক ঘাঁটিকে ব্যস্ত রাখার জন্য একটা ছোট্ট বাহিনীকে রেখে কলামটা এগিয়ে চলল চাঁদপুরের দিকে। পুরে এর একটা বড় বাহিনী এগোলো বিলোনিয়া দিয়ে ফেনীর দিকে। লক্ষ্য চট্টগ্রাম যাতায়াতের পথ বন্ধ করে দেওয়া। এই বাহিনীরও সেই একই কৌশল। ফেনীতে পাকিস্তানীরা বেশ শক্ত ঘাঁটি তৈরি করেছিল। শুরুতেই সেই দখল করার জন্য ভারতীয় বাহিনী কোনও চেষ্টা করল না। একটা ছোট্ট বাহিনী রেখে যাওয়া হল ফেনীর পাক সৈন্যদের ব্যস্ত রাখার জন্য। আর মূল বাহিনীর পাশ কাটিয়ে এগিয়ে চলল দক্ষিণ-পশ্চিম।পশ্চিম প্রান্তে বিমান হামলার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বিমানও নৌবাহিনী আসরে নেমে পড়ল। বাংলাদেশে ভারতীয় বিমানবাহিনী এবং নৌবাহিনীর অ্যাকশন শুরু হল ৩রা মধ্যরাত্রি থেকে। বিমানও নৌবাহিনীর জঙ্গী বিমানগুলি ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে গিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন পাক ঘাঁটির ওপর আক্রমণ চালাল। প্রধান লক্ষ্য ছিল অবশ্য ঢাকা ছিল পাক বাহিনীর প্রধান ঘাঁটি। এই ঘাঁটিতে ছিল তাদের জঙ্গী বিমানগুলি। প্রথমে বাংলাদেশে পাক বিমানবাহিনীতে ছিল দুই স্কোয়াড্রন মার্কিনী সাবর জেট। যুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছুদিন ইয়াহিয়া খাঁর নির্দেশে মিগ-১৯ বিমানগুলি পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হল। বাংলাদেশে থাকল শুধু সাবর গুলি। তারও কয়েকটা ঘায়েল হয়ে গিয়েছিল বয়রার লড়াইয়ে।
বাংলাদেশের কাজে নেমেই ভারতীয় বিমানবাহিনীর প্রধান লক্ষ্য হল পাকিস্তানী জঙ্গী বিমানগুলিকে শেষ করে দেওয়া যাতে অন্তরীক্ষে শত্রুপক্ষ কিছুই না করতেপারে। যাতে লড়াইয়ের শুরুতেই আকাশটা মিত্রপক্ষের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।
সেই উদ্দেশ্য নিয়েই ৩ তারিখ মধ্যরাত্রে ভারতীয় বিমানবাহিনী একেবারে তেজগাঁও আক্রমণ করল। ঐ বিমানবন্দরেই পাকিস্তানের সব জেট মজুত ছিল। কারণ গোটা বাংলাদেশের ওই একটি মাত্র বিমানবন্দর যেখান থেকে সব বিমান উড়তে পারে। ভারতীয় মিগ সেই ঘাঁটিতে হানা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানী সাবর জেটগুলিও বাধা দিতে এগিয়ে এল। প্রায় সারারাত ধরে চলল ঢাকার বিমান যুদ্ধ। প্রথম রাত্রি আক্রমণেই পাকবাহিনীর অর্ধেক বিমান ধ্বংস হয়ে গেল। বিমানবন্দর এবং কুর্মিটোলা ক্যান্টমেন্টও নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হল।
ভারতীয় বিমান এবং নৌবাহিনীর বিমানগুলি সেদিন যে শুধু ঢাকা আক্রমণ করেছিল তাই নয়। আক্রমণ করেছিল কুমিল্লা, চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এবং চাঁদপুরেড় অভিযান চালিয়েছিল প্রধানত বিমানবাহিনীর বিমানগুলি। চট্টগ্রাম নৌ বন্দরের প্রায় অর্ধেকটাই ধ্বংস হয়ে গেল। বন্দরের তেলের ডিপোগুলোও জ্বলে উঠল দাউ দাউ করে।
এর মধ্যে পাক বিমানবাহিনীর জঙ্গী বিমানগুলি একবার কলকাতা শহরেও হানা দেওয়ার চেষ্টা করল। কিন্ত প্রতিবারই তাদের ফিরে যেতে হল। আমাদের বিমানবাহিনীর বিমানগুলি সেদিন প্রায় সারারাত ধরে কলকাতা শহরকে পাহারা দিয়েছিল।
৪ ডিসেম্বর সকালে প্রতিরক্ষা দফতরে প্রধানরা আলোচনায় বসে দেখলেন ভারতীয় বাহিনী পূর্ব খণ্ডে ঠিকই এগিয়েছে। প্রথমত, তারা কোথাও শহর দখলের জন্য অগ্রসর হয় নি।
দ্বিতীয়ত, কোথাও শক্ত পাক ঘাঁটির সঙ্গে বড় লড়াইয়ে আটকে পড়েনি।
তৃতীয়ত, পাকিস্তানী সমরনায়করা তখনও বুঝতে পারে নি ভারতীয় বাহিনী কোন দিক থেকে ঢাকা পৌঁছতে চাইছে।বরং তারা মনে করছে ভারতীয় বাহিনী সবদিক দিয়েই রাজধানী দিকে অগ্রসর হচ্ছে, এবং তখনও ভাবছে ভারতীয় বাহিনী সীমান্তের মূল পাক ঘাঁটিগুলিরই আক্রমণ চালাবে।
চতুর্থত, ব্যাপক বিমান এবং স্থল আক্রমণে শত্রুপক্ষকে একেবারে বিহবল করে দেওয়া হয়েছে।
পঞ্চমত, পাক বিমানবাহিনীকে অনেকটা ঘায়েল করে ফেলা হয়েছে। তাদের বিমান ঘাঁটিগুলিও বিধ্বস্ত।
ষষ্ঠত, পাকিস্তানের প্রধান নৌ বন্দরগুলি অর্থাৎ চট্টগ্রাম, কক্সবাজার,চালনা, চাঁদপুর এবং নারায়ণগঞ্জে জাহাজ বা স্টীমার বেড়াবার ব্যবস্থা অনেকটা বিপর্যস্ত। এবং
সপ্তমত, বাংলাদেশের সাধারণ নাগরিক ও বাড়িঘর মোটেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। সেনা, বিমান এবং নৌবাহিনী তাই যুদ্ধের দ্বিতীয় দিনেও পূর্ব লক্ষ্য মতই এগিয়ে চলল।
পশ্চিম দিকে থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং মুক্তিফৌজের সবকটা কলামপুরে এগিয়ে চলল। কিন্ত কোথাও তারা সোজাসুজি পাক ঘাঁটিগুলির দিকে এগালো না। মূল বাহিনী সর্বদাই ঘাঁটিগুলোকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে চলল। এবং ঘাঁটিতে অপেক্ষমাণ পাকবাহিনী যাতে মনে করে যে ভারতীয় বাহিনী তাদের দিকেই এগিয়ে আসার চেষ্টা করছে সেই জন্য প্রত্যেক পাক ঘাঁটির সামনে ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনীর কিছু কিছু লোক রেখে যাওয়া হল।
ওদিকে মূল ভারতীয় বাহিনী যে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তানীরা সেই খবরও পেল না। কারণ প্রথমত, তাদের সমর্থনে দেশের লোক ছিল না, যারা খবরাখবর দিতে পারে। দ্বিতীয়ত, তাদের বিমানবাহিনীও তখন বিধ্বস্ত। সর্বত্র উড়ে পাক বিমান ভারতীয় বাহিনীর অগ্রগতির খবরাখবর পাক সেনাবাহিনীকে জানাতে পারল না। তৃতীয়ত, বাংলাদেশে পাকবাহিনীর বেতার খবরাখবর পাঠাবার তেমন ভাল ব্যবস্থা ছিল না। সুতরাং নিজস্ব ব্যবস্থায়ও তারা খবরাখবর পেল না।
তাই ভারতীয় বাহিনী যখন সোজাসুজি যশোর, হিলি, শ্রীহট্ট, কুমিল্লা, ফেনী প্রভৃতি শক্ত ঘাঁটির দিকে না গিয়ে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল তখন পাকবাহিনীর অধিনায়করা তা মোটেই বুঝতে পারল না। বরং ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনীর গোলাবর্ষণের বহর দেখে তখনও তারা মনে করছে ভারতীয় বাহিনী সোজাসুজিই এগোবার চেষ্টা করছে। সেই জন্য তখনও তারা মূল সড়কগুলি আগলে বসে রইল। সীমান্তের কাছাকাছি শহরগুলিতে তখনও পাকবাহিনীতে অধিষ্ঠিত একমাত্র কুষ্টিয়া জেলার দর্শনা ছাড়া। দর্শনা যে মুহূর্তে আমাদের ৪নং পার্বত্য ডিভিশনের কামানের পাল্লার মধ্যে এসে গেল পাকিস্তানীরা অমনি শহর ছেড়ে আরও পশ্চিমে পালাল।
এদিকে তখন ভারতীয় বিমান এবং নৌবাহিনীও প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। লড়াইয়ের দ্বিতীয় দিনেও ভারতীয় বিমান এবং নৌবাহিনীর জঙ্গী বিমানগুলি বারবার ঢাকা, চট্টগ্রাম, চালনা প্রভৃতি এলাকায় সামরিক ঘাঁটিগুলির ওপর আক্রমণ চালাল। ঢাকায় সেদিনও জোর বিমান যুদ্ধ হল। কিন্ত সেদিনই প্রায় শেষ বিমান যুদ্ধ। অধিকাংশ পাক বিমানই ঘায়েল হল। বিমানবন্দরগুলিও প্রচণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হল।
ওদিকে তখন মিত্রবাহিনীও প্রচণ্ড গতিতে এগিয়ে চলেছে- প্রধান সড়ক এবং পাক ঘাঁটিগুলি এড়িয়ে। তখনও পর্যন্ত প্রধান লক্ষ্য বাংলাদেশের চতুর্দিকে ছড়ানো পাকবাহিনীকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া এবংআবার যাতে একত্র হয়ে ঢাকা রক্ষার জন্য কোনও বড় লড়াইয়ে নামতে না পারে তার ব্যবস্থা করা।
৫ডিসেম্বরঃ লড়াইয়ের তৃতীয় দিনেই স্বাধীন বাংলার আকাশ স্বাধীন হয়ে গেল। বাংলাদেশে পাকবাহিনীর প্রায় সব বিমান এবং বিমানবন্দরই বিধ্বস্ত।গোটা দিন ভারতীয় জঙ্গী বিমানগুলি অবাধে আকাশে উড়ে পাক সামরিক ঘাঁটিগুলিতে প্রচণ্ড আক্রমণ চালাল। ভারতীয় বিমানবাহিনীর হিসাব মত বারো ঘণ্টায় দু’শ ত্রিশ বার। তেজগাঁও এবং কুর্মিটোলা বিমানঘাঁটিতে পঞ্চাশ টনের মত বোমা ফেলল। কুর্মিটোলা রানওয়েতে কয়েক পাউন্ড বোমা ফেলায় ছোটখাটো কয়েকটা পুকুরই সৃষ্টি হয়ে গেল। পাকবাহিনীর শেষ সাবর জেট তিনটা ঐখানে আটকে ছিল। রানওয়ে বিধ্বস্ত হওয়ায় ছাউনিতেই সেগুলিকে আটকে থাকতে হয়। ভারতীয় বিমানের আক্রমণে সেদিন বড় রাস্তা দিয়ে পাক সেনাবাহিনীর যাতায়াতও প্রায় বন্ধ হয়ে গেল।পাকবাহিনীর প্রত্যেকটা কনভয়ের উপর ভারতীয় জঙ্গী বিমানগুলি আক্রমণ চালাল। ওদের নব্বইটা গাড়ি ধ্বংস হল। ধ্বংস হল পাকিস্তানী সৈন্য বোঝাই বেশ কয়েকটা লঞ্চ এবং স্টিমারও।
জামালপুর আর ঝিনাইদহের পাক সামরিক ঘাঁটিও ভারতীয় বিমান আক্রমণে ধ্বংস হল। তেজগাঁও এবং কুর্মিটোলা বিমানবন্দর ধ্বংস ভারতীয় জঙ্গী বিমানগুলি সারাদিন ধরে গোটা বাংলাদেশের সব কটা বিমানবন্দরে হানা দিল। উদ্দেশ্য, আর কোথাও পাক বিমান আছে কিনা খুঁজে দেখা কিন্ত কোথাও আর একটাও পাকবিমান খুঁজে পাওয়া গেল না। পরে নিজেদেরই অর্থাৎ মিত্রপক্ষেরই কাজে লাগবে এই ভেবে ভারতীয় বিমানবাহিনী অধিকাংশ বিমানবন্দকেই অক্ষত অবস্থায় ছেড়ে দিল।
পূর্বে খণ্ডে ভারতীয় নৌবাহিনীও সেদিন বিরাট সাফল্য অর্জন করেছে। বঙ্গোপসাগরে পাক সাবমেরিন’গাজী’ সেদিন ভারতীয় নৌবাহিনীর উপর আক্রমণ শেষ হল। সাবমেরিন ‘ গাজী’ ছিল পাক নৌবহরের গর্বের বস্ত।
ওইদিন ভারতীয় নৌবাহিনী প্রত্যেকটা নিরপেক্ষ রাষ্ট্রের জাহাজকে হুঁশিয়ার করে দিল। প্রধান হুঁশিয়ারিটা চট্টগ্রাম বন্দর সম্পর্কে বলা হলঃ আপনারা সবাই চট্টগ্রাম বন্দর ছেড়ে চলে আসুন। আপনাদের স্বার্থ এবং নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে আমরা চট্টগ্রাম এর উপর তেমন প্রচণ্ডভাবে গোলাবর্ষণ করিনি।আজ রবিবার আপনাদের বন্দর থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। কাল সোমবার আমরা প্রচণ্ডভাবে আক্রমণ চালাব। সুতরাং কাল থেকে আপনাদের নিরাপত্তা সম্পর্কে আমরা কোনও নিশ্চয়তা দিতে পারব না।
এই ‘ওয়ার্নিং’ দুটো কাজ হল। (এক) বিশ্বের সব দেশ বুঝল বাংলাদেশের বন্দরগুলি রক্ষা কোনও ক্ষমতা আর পাকবাহিনীর নেই। এবং(দুই) ভারতীয় নৌবাহিনীর জাহাজও বিমানগুলি বাংলাদেশের সব বন্দরগুলিকে অবাধে ঘায়েল করার সুযোগ পেল।
এদিকে তখন স্থলেও মিত্রবাহিনীও এগিয়ে চলেছে। পাক স্থলবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রায় বিচ্ছিন্ন। প্রধান সড়কগুলি দিয়ে না এগিয়েও ভারতীয় বাহিনী বিভিন্ন সেক্টরে প্রধান প্রধান সড়কের কতগুলি জায়গায় অবরোধ সৃষ্টি করল। ফলে ঢাকার সঙ্গে কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও সিলেটের, নাটোরের সঙ্গে ঢাকা এবং রংপুরের এবং যশোরের সঙ্গে নাটোর ও রাজশাহীর যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। শুধু ঢাকার সঙ্গে যশোর এবং খুলনার যোগাযোগ তখনও অব্যাহত। কতকগুলি ঘাঁটি সেদিন কিছুটা লড়াইও হল। একটা বড় লড়াই হল লাকসামে।আর একটা হল ঝিনাইদহের কাছে কোটচাঁদপুরে। দুটো লড়াইয়েই পাকসেনারা বেজার মার খেল এবং ঘাঁটি দুটি ছেড়ে যেতে বাধ্য হল।
এই দুটো ঘাঁটি দখলের চেয়েও কিন্ত মিত্রবাহিনীর বড় লাভ হল পাকবাহিনীর যোগাযোগ ব্যবস্থাটা বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারায়। এটাই ছিল তাদের প্রথম পর্যায়ে বড় লক্ষ্য যাতে পাকসেনারা পিছু হটে গিয়ে আবার না রিগ্রুপড হতে পারে- ঢাকা রক্ষার লড়াইয়ের জন্য পদ্মাও মেঘনার মাঝখানে কোনও নতুন শক্ত ব্যূহ রচনা না করতে পারে। বিভিন্ন বড় সড়কে অবরোধ সৃষ্টি করে মিত্রবাহিনী সীমান্তের ঘাঁটিগুলি থেকে পাকবাহিনীর ঢাকা ফেরার পথ প্রায় বন্ধ করে দিল। এ ব্যাপারে তাদের আরও বড় সুবিধা হল আকাশে ভারতীয় বিমানবাহিনীর একাদিপত্ত প্রতিষ্ঠা হওয়ায়। গোটা বাংলাদেশের বড় বড় সড়কও নদীর উপর তখন ভারতীয় জঙ্গী বিমান পাহারা দিচ্ছে। এবং পাক সেনাবাহিনীর কনভয় চোখে পড়লেই তাকে আক্রমণ করছে।
এই রকম যখন অবস্থা নিয়াজিও সবটা বুঝতে পারল। চতুর্দিক থেকে মিত্রবাহিনীর অগ্রগতির খবর পৌঁছল ঢাকায়। আর পৌঁছল পাকবাহিনীর বিপর্যের সংবাদ।নিয়াজি আরও জানতে পারল যে মিত্রবাহিনীর সবকটা কলাম মূল পাকঘাঁটি এবং সুরক্ষিত পথ এড়িয়ে এগিয়ে আসছে। পাক সমরনায়কদের তখন বুঝতে অসুবিধা হল না যে মিত্রবাহিনীর মূল উদ্দেশ্য বিভিন্ন পাক ঘাঁটির যোগাযোগ কেটে দেওয়া।এবং পেছন থেকে পাক ঘাঁটিগুলির উপর অতর্কিত আক্রমণ করা। নিয়াজি এবং ঢাকার পাক সমরনায়করা ততক্ষণে বুঝে গিয়েছে মিত্রবাহিনী শুধু বাংলাদেশের অঞ্চল বিশেষ দখল করতে চায় না- তারা চায় গোটা বাংলাদেশের পাকবাহিনীকে পরাজিত করতে। তারা বুঝল মিত্রবাহিনী ঢাকার দিকে এগোবেই। কিন্ত তখনও তারা এটা ঠিক বুঝতে পারেনি যে, মিত্রবাহিনীর কোন কোন ঢাকার দিকে এগিয়ে আসবে। নিয়াজি তাই অন্যান্য পাক সমর নায়কদের পরামর্শ করে সেদিনই সর্বত্র হুকুম পাঠিয়ে দিল- পুলব্যাক। পুলব্যাক করে তাদের ঢাকার কাছাকাছি অর্থাৎ পদ্মা- মেঘনার মাঝামাঝি অঞ্চলে ফিরে আসতে বলা হল।
৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যে বেলায়ই সেই হুকুম সবগুলি পাক সামরিক ঘাঁটিতে চলে গেল।
৬ডিসেম্বরঃ ৬ডিসেম্বর সূর্য ওঠার আগেই কতকগুলি সীমান্ত ঘাটি থেকে পিছু হটা শুরু হল। কোনও কোনও ঘাঁটির আবার এডভান্স পার্টি পাঠিয়ে পেছনের খবর সংগ্রহের চেষ্টা করল। এবং অনেকে দেখল পেছনের অবস্থা ভাল নয়। একে তো যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন তার উপর আবার বহু এলাকায় পেছনে গিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী ঘাঁটি করে বসে গিয়েছে। নিয়াজির পুলব্যাক নির্দেশের পর তাই গোটা বাংলাদেশের পাকবাহিনীতে এক অরাজক অবস্থার সৃষ্টি হল।
অধিকাংশ পাক সীমান্ত ঘাঁটি সামনেই তখন এক সমস্যা- সীমান্তে ঘাঁটিতে বসে থাকার চেষ্টা করলেও মৃত্যু অনিবার্য, আবার পেছাতে গেলেও বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী। কয়েকটা সীমান্ত ঘাঁটি থেকে তাই নিয়াজিকে জানানো হল পুলব্যাক করার চেয়ে শক্ত বাঙ্কারে ঘেরা বসে লড়াই চালিয়ে যাওয়াই শ্রেয়।
কুর্মিটোলার নির্দেশ তাই সর্বত্র সমানভাবে পালিত হল না। কোথাও পূর্ণ পুলব্যাক হল। কোথাও হল আধা-পুলব্যাক। কোথাও আবার যেমন ছিল তেমনই রইল। যেসব ঘাঁটিতে ওরা থেকে গেল সেগুলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ময়নামতি, চট্টগ্রাম, জামালপুর এবং হিলি। যেসব ঘাঁটি থেকে পালাল সেগুলির মধ্যে সবচেয়ে আগে নাম করতে হয় শ্রীহট্ট এবং যশোরের।
শ্রীহট্ট এবং যশোরের চতুর্দিকে পাকবাহিনী যতগুলো ঘাঁটি করেছিল সবগুলি ছেড়ে পালাল। পাক নবম ডিভিশনের উপর পদ্মার দক্ষিণের গোটা অঞ্চলটা রক্ষার দায়িত্ব ছিল। আগেই বলা হয়েছে যে, আনুষ্ঠানিকভাবে লড়াই শুরু করার আগেই পাক নবম ডিভিশনের সদরদফতর যশোর ক্যান্টমেন্ট থেকে সরিয়ে মাগুরা নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সদরদফতর সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরও সৈন্যসামন্ত ঠিকই সীমান্তে ছিল। চৌগাছায় পরাজয়ের পর তারা তিন ভাগে ছড়িয়ে ছিল। ঝিনাইদহ- মেহেরপুর অঞ্চলে একটা অংশ, ঝিকরগাছার উত্তর-পশ্চিমে আর একটা অংশ এবং সাতক্ষীরা থেকে খুলনা পর্যন্ত আর একটা অংশ।
৫ ডিসেম্বর মাঝরাতে ভারতীয় চতুর্থ ডিভিশন আঘাত হানল ঝিনাইদহের উত্তর- পশ্চিমের পাকবাহিনীর উপর। প্রায় একসঙ্গে নবম ডিভিশন ঘা দিল ঝিকরগাছা থেকে ঝিনাইদহের পশ্চিমে ছড়ানো অংশটার উপর। এই দুই প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়েই পাকবাহিনী একেবারে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল।এবং দুদিক থেকে মিত্রবাহিনীর দুটো কলাম যশোর- ঢাকা হাইওয়ের উপর এসে দাঁড়াল। ততক্ষণে নিয়াজির পুলব্যাক অর্ডারও এসে গিয়েছে।৬ ডিসেম্বর ভোর থেকেই তাই গোটা পাক নবম ডিভিশনের পলায়ন পর্ব শুরু হয়ে গেল। ইচ্ছা ছিল গোটা বাহিনীটাই ঢাকার দিকে পালাবে। কিন্ত পারল না। কারণ ততক্ষণে ভারতীয় চতুর্থ এবং নবম ডিভিশন যশোর- ঢাকা হাইওয়ে ডিভিশনের দুটি অঞ্চলে ঘাঁটি করে বসেছে। বাধ্য হয়ে তাই নবম পাক ডিভিশনের একটি অংশ পালাল মাগুরা হয়ে মধুমতি ডিঙ্গিয়ে ঢাকার পথে। আর একটি অংশ পালাল খুলনার দিকে। কুষ্টিয়ার দিক দিয়েও পালাল একটি ছোট্ট অংশ।সাতক্ষীরা অঞ্চলে যে পাকবাহিনীটা ছিল এতদিন তাদের সঙ্গে লড়াই চালাচ্ছিল প্রধানত মুক্তিবাহিনীর সৈন্যরা এবং বিএসএফের সেপাইরা।পুল ব্যাক অর্ডারের সঙ্গে সঙ্গে তারাও পালাল খুলনার দিকে। পালাবার সঙ্গে সঙ্গে সবকটা বাহিনীই রাস্তায় ওপারের সব ব্রিজ ভেঙ্গে যাওয়ার চেষ্টা করল। শ্রীহট্টের দিকেও তখন প্রায় একই অবস্থা। দু’পাশ দিয়ে এগিয়ে মিত্রবাহিনী শ্রীহট্টের পশ্চিমে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। পূর্বদিক থেকে একটা গোলন্দাজ বাহিনীর উপরও গোলাবর্ষণ করে চলেছে। শ্রীহট্টের পাক সমরনায়ক পুলব্যাক অর্ডার পাওয়া মাত্রই পিছিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। ইচ্ছা ছিল আশুগঞ্জ থেকে মেঘনা অতিক্রম করে ঢাকার দিকে যাবে। কিন্ত পারল না। কিছুটা পিছিয়েই দেখল সম্ভাব নয়- মিত্রবাহিনী তার আগেই পথ রোধ করে দাঁড়িয়েছে। তখন গোটা বাহিনীটাকে দুভাগে বিভক্ত করা হল। একটা থাকল শ্রীহট্টে। আর একটা পেছন দিকে দাঁড়িয়েছে। তখন গোটা বাহিনীটাকে দুভাগে ভাগ করা হল। একটা থাকল শ্রীহট্টে। আর পেছনের দিক দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। দু’ দলই লড়াইয়ে হেরে গেল।শ্রীহট্টের বাহিনীটা বাঙ্কারে বসে ভালই লড়ল। ওই বাহিনীকে ঘায়েল করতে ভারতীয় বিমানবাহিনীকেও বেশ কয়েক টন বোমাবর্ষণ করতে হল। সমগ্র বাংলাদেশেই মিত্রবাহিনী তখন দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে। তখনও এই লক্ষ্য যাতে পিছু হটে গিয়ে কোথাও না জড় হতে পারে, যাতে সীমান্তের কোনও পাক সৈন্য না ঢাকায় পৌঁছতে পারে।
৭ডিসেম্বরঃ কার্যত যশোরের পতন হয়েছিল আগের দিনই। ৬তারিখ সন্ধ্যা হতে না হতে পাকবাহিনীর সবাই যশোর ক্যান্টমেন্ট ছেড়ে পালিয়ে যায়। কিন্ত ভারতীয় বাহিনী তখনই সে খবরটা পায়নি। ৭ ডিসেম্বর বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ ভারতীয় নবম ডিভিশনের প্রথম কলামটা উত্তর দিক দিয়ে যশোর ক্যান্টমেন্টে এসে পৌঁছল। তখনও তারা জানে না যশোর ক্যান্টমেন্ট শুন্য। তখনও তাদের কাছে খবর পাকবাহিনী যশোর রক্ষার জন্য বিরাট লড়াই লড়বে। কিন্ত মিত্রবাহিনীর কলামটা যতই এগিয়ে এল ততই আশ্চর্য হল। কোনও প্রতিরোধ নেই! সামনে থেকে একটাও গোলাগুলি আসছে না! প্রায় বিহবল অবস্থায় যখন কলামটা ক্যান্টমেন্টের সামনে এসে দাঁড়াল তখন বুঝতে পারল ব্যাপারটা। দশ-পনেরো জন লোক ‘’ জয় বাংলা’’ ধ্বনি দিয়ে তাঁদের সামনে এসে দাঁড়াল। জড়িয়ে ধরে তাদের সংবর্ধনা জানাল। আর জানাল যে, আগেরদিন সব পাকসেনা যশোর ছেড়ে পালিয়েছে। ভারতীয় বাহিনী তখন গোটা ব্যাপারটা বুঝল। দেখতে দেখতে বেশ লোক এসে সেখানে জড় হল। তারাই ক্যান্টমেন্টের ভেতরটা ছিনিয়ে দিল ভারতীয় বাহিনীকে। পাকসেনারা যে ট্যাঙ্ক, কামান এবং ট্রাক- জিপ নিয়ে খুলনা পালিয়েছে যশোরের নাগরিকরা তাও ভারতীয় বাহিনীকে জানাল। সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় বাহিনী ছুটল খুলনার পথে।
ওদিকে তখন নবম ডিভিশনের সদর ঘাঁটিতেও সব খবর পৌঁছে গিয়েছে। ডিভিশনের প্রধান মেঃ জেনারেল দলবীর সিং বয়রা-ঝিকরগাছার পথ ধরে গোটা নবম ডিভিশন নিয়ে এগিয়ে গেলেন যশোর শহরে। যশোর ক্যান্টমেন্ট পাক নবম ডিভিশনের মত আমাদের নবম ডিভিশনের সদর দফতর হল।
শ্রীহট্টেরও পতন হল ওই দিনই দুপুরে। প্রথমে ভারতীয় ছত্রীসেনারা নামল শ্রীহট্টের নিকটবর্তী বিমানবন্দর শালুটিকরে। খুব ভোরে। তারপর চতুর্দিক থেকে মিত্রবাহিনী শ্রীহট্টের পাক ঘাঁটিগুলোর উপর আক্রমণ চালাল। দুপুর বেলায়ই শ্রীহট্টের পাক সেনানায়ক আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হল।
৮ ডিসেম্বরঃ বৃহস্পতিবার সকালে মিত্রপক্ষের সামরিক নেতার পূর্ব রণাঙ্গনের সমগ্র পরিস্থিতিটা বিশ্লেষণ করে দেখলেন তাঁদের প্রথম লক্ষ্য সফল হয়েছে। বাংলাদেশের নানা খণ্ডে পাক সেনাবাহিনী বিচ্ছিন্ন এবং অবরুদ্ধ। ঢাকার দিকে পালাবার কোন পথ নেই। দক্ষিণে একটা পাকবাহিনী আটকে পড়েছে খুলনার কাছে। ওদের গোটা পাকবাহিনী ব্রহ্মপুত্র ও পদ্মার মধ্যবর্তী তিন-চারটা অঞ্চলে অবরুদ্ধ। একটি বড় বাহিনী, প্রায় একটা বিগ্রেড হিলির কাছে অবরুদ্ধ। আর একটা বিগ্রেড আটকে রয়েছে জামালপুরে। ময়মনসিংহ থেকে যে বাহিনীটা সরিয়ে শ্রীহট্টের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সেটা কার্যত ফিনিসড। ময়নামতি ক্যান্টমেন্টে অবরুদ্ধ আর একটা বিগ্রেড। আর একটা বড় পাকবাহিনী অবরুদ্ধ চট্টগ্রামে। একের সঙ্গে আর একের যোগ দেওয়ারও কোন সুযোগ নেই। ঢাকার দিকে পিছু হটা কার পক্ষেই সম্ভব নয়।
মিত্রবাহিনীর কর্তারা তখন তিনটি ব্যবস্থা নিলেন। প্রথম ব্যবস্থায় গোটা পাক সেনাবাহিনীকে আত্মসমর্পণ করতে বলা হল। দ্বিতীয় ব্যবস্থায় জেনারেল সগত সিংকে বলা হল তাঁর অন্তত তিনটা কলাম খুব দ্রুত ঢাকার দিকে এগিয়ে নিতে। তৃতীয় ব্যবস্থায়, একটা বিগ্রেডকে যথা শীঘ্রসম্ভব হালুয়াঘাটের দিকে থেকে ময়মনসিংহের দিকে নিয়ে আসা হল।
যুদ্ধের শুরুতেই ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান মানেকশ বাংলাদেশের দখলদার পাকবাহিনীর উদ্দেশ্যে আত্মসমর্পণের আহবান জানিয়েছিলেন। ৮ ডিসেম্বর আবার তার সেই আবেদন নানা ভাষায় আকাশবাণী থেকে প্রচার করা হল। তিনি পাকসেনাদের আত্মসমর্পণ করতে বললেন এবং সঙ্গে সঙ্গে এই আশ্বাস দিলেন যে, আত্মসমর্পণ করলে পাক সেনাবাহিনীর প্রতি জেনেভা কনভেনশনের রীতি অনুযায়ী সম্মানজনক ব্যবহার করা হবে। জেনারেল মনেকশ বললেনঃ আমি জানি আপনারা পালাবার জন্য বরিশাল এবং নারায়ণগঞ্জের কয়েক জায়গায় জড় হচ্ছেন। আমি এও জানি, এখান থেকে আপনাদের উদ্ধার করা হবে বা পালাতে পারবেন এই আশাতেই মিলিত হচ্ছেন। কিন্ত আমি সমুদ্রপথে আপনাদের পালাবার সব পথ বন্ধ করে দিয়েছি। এজন্য নৌবাহিনীকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এখনও যদি আপনারা আমার পরামর্শ না শোনেন এবং ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ না করেন তাহলে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে কেউ আপনাদের বাঁচাতে পারবে না।
বাংলাদেশের পূর্ব সীমান্তে থেকে জেনারেল সগৎ সিং এর প্রায় সবকটা ডিভিশনই তখন প্রচণ্ড গতিতে পশ্চিমের দিকে এগোচ্ছিল। একটা এগোচ্ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া দখল করে আশুগঞ্জের দিকে। আশুগঞ্জে মেঘনার একটি বাহিনী। ওদিকে সেদিন কুমিল্লারও পতন ঘটেছে। ওই সেক্টরের সব পাকসৈন্য গিয়ে ময়নামতি ক্যান্টমেন্টে গিয়ে আশ্রয় নিল। মিত্রবাহিনীর প্রধান জেনারেল অরোরা সেদিন হেলিকপ্টারে কুমিল্লা ঘুরে এলেন। ময়নামতিকে পাশ কাটিয়ে আর একটা বাহিনী দ্রুত অগ্রসর হল চাঁদপুরের মুখে। সবকটা বাহিনীরই লক্ষ্য ঢাকা। যদি প্রয়োজন হয় তাহলে যাতে এই বাহিনী নদীপথেই নারায়ণগঞ্জ- ঢাকার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এই বাহিনীর আর একটা বাহিনীর লক্ষ্য ছিল চাঁদপুর বন্দর থেকে মেঘনাও পদ্মার নদীপথের উপর নজর রাখা।
বাংলাদেশের লড়াইয়ে নামতে হতে পারে এই কথা ভাবার সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় প্রতিরক্ষা দফতরের কর্তারা ঠিক করে রেখেছিলেন ঢাকার উপর প্রধান আক্রমণটা হবে উত্তর দিক দিয়ে। ময়মনসিংহ টাঙ্গালের পথে একটা বড় বাহিনীকে দ্রুত নিয়ে যাওয়া হবে ঢাকায়। ওপথে নদীনালা খুব কম। সেই উদ্দেশ্যে গোড়া থেকেই তাঁরা গারো পাহাড়ে দুই বিগ্রেড সৈন্য মজুদ করে রেখেছিলেন। বেশী সৈন্য ওপথে জড় করেননি। কারণ ভয় ছিল যে, তাহলে পাকিস্তানীরা খবরটা আগাম পেয়ে যাবে এবং আগে থেকেই পথে জড় প্রতিরক্ষা ব্যূহ রচনা করে রাখবে। সেই জন্য ওপথে কম সৈন্য জড় করে রাখা হল। এবং ঠিক করে রাখা হল যে পদাতিক সৈন্য টাঙ্গালের কাছাকাছি পৌঁছবার পর ওখানে একটি ছত্রীবাহিনীও নামানো হবে।
পাক সমরনায়করাও ধরে রেখেছিল যে ভারত উত্তর দিক দিয়ে একটা বড় সেনাবাহিনী নামাবার চেষ্টা করবেই। সেই জন্য তারা জামালপুরের কাছাকাছি একটা শক্ত ঘাঁটি তৈরি করে রেখেছিল। আর একটা ছোট ঘাঁটি করে রেখেছিল হালুয়াঘাটের কাছে। লড়াই শুরু হতে ১০১ নং কমিউনিকেশন জোনের একটা বিগ্রেড এগোলো জামালপুরের দিকে। আর একটা গেল হালুয়াঘাটের কাছে। হালুয়াঘাটের সীমান্তবর্তী ভারতীয় বাহিনী প্রথমে অগ্রসর হল না। দু’ চারদিন ওখানেই অপেক্ষা করল। জামালপুরে বড় লড়াই শুরু হতে পাক সামরিক নেতারা তাদের হালুয়াঘাটের বাহিনীকে সরিয়ে নিয়ে গেল জামালপুরের দিকে।আর ময়মনসিংহ থেকে একটা বিগ্রেড নিয়ে শ্রীহট্ট- ভৈরববাজার সেক্টরে। তারা তখন ভাবতেও পারেনি যে একটা ভারতীয় বিগ্রেড হালুয়াঘাটের মুখে অপেক্ষা করছে। হালুয়াঘাট থেকে ভারতীয় বাহিনীটা খুব দ্রুত এগিয়ে গেল ময়মনসিংহের পথে।পথে বড় কোন বড় বাধাই পেল না। কারণ একটা পাকবাহিনী লড়াই করছে জামালপুরে আর একটা গিয়েছে সিলেট- ভৈরব বাজার সেক্টরে। একই বিমান আক্রমণও বাড়ানো হল। বিমানও নৌবাহিনীর জঙ্গী বিমানগুলি সারাদিন অসংখ্যবার বিভিন্ন পাক সামরিক ঘাঁটিতে আক্রমণ চালাল। বিমান আক্রমণের ভয়ে দিনের বেলা পাক সামরিক বাহিনীর চলাচলও প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। পরিকল্পনা মতই বিমান আক্রমণ বৃদ্ধি করা হল।লক্ষ্যটা একই।প্রথমত, পাক সেনাবাহিনীকে আবার কোথাও রিগ্রুপড হতে না দেওয়া। এবং দ্বিতীয়ত, ওদের মনোবল ভেঙ্গে দেওয়া এবং আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।
৯ডিসেম্বরঃ ৯তারিখ চতুর্দিক মিত্রবাহিনী ঢাকার দিকে অগ্রসর হল। তখন তাদের চোখের সামনে শুধু ঢাকা। এর আগেই তাদের প্রথম লক্ষ্যটা পূরণ হয়ে গিয়েছে।অর্থাৎ মিত্রবাহিনী বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়া পাকবাহিনীকে বেশ ভালোমত বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে, তাদের ঢাকা ফেরার বা পালাবার প্রায় সব পথ বন্ধ। এবার দ্বিতীয় লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে গেল ভারতীয় বাহিনী।
দ্বিতীয় লক্ষ্যটা হল, খুব দ্রুত ঢাকার পাকবাহিনীর মনোবল সম্পূর্ণ ভেঙ্গে দিয়ে নিয়াজিকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করা।
সবদিক দিয়েই মিত্রবাহিনী ঢাকার দিকে অগ্রসর হল। পূর্বে পৌঁছে গেল আশুগঞ্জে, দাউদকান্দিতে এবং চাঁদপুরে। পশ্চিমে বাহিনী পৌঁছল মধুমতি নদীর তীরে। আর একটা বাহিনী কুষ্টিয়া মুক্ত করে চলল গোয়ালন্দ ঘাটের দিকে। হালুয়াঘাট থেকে এগিয়ে আসা বাহিনীও পৌঁছল ময়মনসিংহের কাছাকাছি। নৌবাহিনীর গানবোটগুলিও ততক্ষণে নানাদিক থেকে এগোচ্ছে ঢাকার দিকে।এবং বিমানবাহিনীর আক্রমণও পুরোদমেই চলছে। সেদিন বিকালে মিত্রবাহিনীর প্রধান জেনারেল অরোরা এক সাংবাদিক বৈঠকে বললেনঃ আমরা এখন ঢাকার লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত। সাংবাদিকরা জিজ্ঞেস করলেনঃ পাকিস্তানীরা যদি মাটি কামড়ে লড়াই চালায় তাহলে আপনি কি করবেন? জেনারেল অরোরা জবাব দিলেনঃ ওরা কি করবে জানিনা। তবে আমরা বড় ধরণের লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত। জেনারেল অরোরাকে সাংবাদিকরা আবার জিজ্ঞেস করলেনঃ ঢাকাকে মুক্ত করার পথে আপনার সামনে সবচেয়ে বড় বাধা কি? অরোরা বললেনঃ নদী। তারপর আবার বললেনঃ নদী যদিও বড় বাধা সে বাধা অতিক্রমের ব্যবস্থা আমরা করে ফেলেছি। আমাদের পদাতিক সৈন্য এবং রসদ পারাপারের ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছে। আর আমাদের পি, টি৬৭ ট্যাঙ্কগুলি নিজ থেকেই নদী সাঁতরে যেতে পারবে।
১০ ডিসেম্বর পরদিনই ৫৭ নং ডিভিশন গোটা বিশ্বকে দেখিয়ে দিল মিত্রবাহিনী কিভাবে রাজধানী ঢাকার মুক্তিযুদ্ধের পথে বাধা অতিক্রম করবে। ভোররাত্রি থেকেই ভৈরব বাজারের তিন- চার মাইল দক্ষিণে নামানো শুরু হল ৫৭ নং ডিভিশনের সৈন্য। সারাদিন ধরে সেই মেঘনা অতিক্রমের কার্যক্রম চলল। প্রথম বাহিনীটা ওপারে নেমেই ঘাঁটি গেঁড়ে বসল। কিছুটা উত্তরে ভৈরববাজারের কাছেই পাক সৈন্যদের একটা বড় বাহিনী মজুত। ব্রিজটার একটা অংশ ভেঙ্গে দিয়ে নদীর পশ্চিম পাড়ে ওত পেতে বসে আছে। আকাশে সূর্য উঠতেই তারা দেখতে পেল হেলিকপ্টার নদী পার হচ্ছে। কিন্ত দেখেও তারা ঘাঁটি ছাড়ার সাহস পেল না। ভাবল, ওটা বোধহয় বিমানবাহিনীর একটা ধাপ্পা। ওদিকে ছুটে গেলেই আশুগঞ্জ থেকে মূল ভারতীয় বাহিনীটা ভৈরব বাজারের ওখানে এসে উঠবে। তারপর ভৈরব বাজার- ঢাকা রাস্তা ধরবে। সত্যিই কিন্ত পাকবাহিনীকে ভুল বোঝানোর জন্য এসে মিত্রবাহিনীর একটা বড় কলাম তখন ভাবসাব দেখাচ্ছিল যে তারা আশুগঞ্জ দিয়েই মেঘনা পার হবে।
পাকবাহিনী এইভাবে ভুল বোঝায় মিত্রবাহিনীর সুবিধা হল। একরকম বিনা বাধায় মেঘনা পার হওয়া গেল। হেলিকপ্টারে নদী পার হল কিছু সৈন্য। অনেকে আবার পার হল স্টিমারে এবং লঞ্চে করে। কিছু পার হল স্রেফ দেশী নৌকাতেই। ট্যাঙ্কগুলি নিয়ে কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছিল প্রথমে। কিন্ত সে সমস্যাও দূর হল এক অভাবনীয় উপায়ে। রাশিয়ান ট্যাঙ্ক সাঁতরাতে পারে ঠিকই। কিন্ত আধা ঘণ্টার বেশী সাঁতরালে ট্যাঙ্ক ভীষণ গরম হয়ে যায়। অথচ মেঘনা পার হতে আধ ঘণ্টার বেশী সময় লাগবে। তখন ঠিক হল, ট্যাঙ্কগুলি যতটা সম্ভব নিজেই সাঁতরে এগোবে। তারপর নৌকাতে দড়ি বেঁধে ট্যাঙ্কগুলিকে নদীর ওপারে নিয়ে যাওয়া হবে। স্থানীয় মানুষের অভূতপূর্ব সাহায্য ছাড়া এই বিরাট অভিযান কিছুতেই সার্থক হত না। ওখানের মানুষ যে যেভাবে পারল মিত্রবাহিনীকে সাহায্য করল। শত শত নৌকা নিয়ে এল তারা। সেইসব নৌকা বারবার পার করল। সেখান থেকে মিত্রবাহিনী নদী পেরিয়েছিল সেখানে কোনও রাস্তাঘাট ছিল না। সেটা ছিল জলা জমি।এই জলা জমি দিয়ে কামান বন্দুক ঘাড়ে করে নিয়েছিল ওই এলাকার শত শত বাঙ্গালী। বেশ কয়েক মাইল হেঁটে তারপর তারা পৌঁছেছিল ভৈরববাজার- ঢাকা মূলসড়কে।এবং পরদিনই তারা রায়পুর দখল করে নিল।
ওদিকে তখন উত্তরের বাহিনীটাও এগিয়ে আসছে ময়মনসিংহের কাছে পৌঁছে তারা দাঁড়াল। খবর ছিল ময়মনসিংহে পাকবাহিনীর একটা বিগ্রেড আছে। কিন্ত সেই বিগ্রেডটাকে যে আগেই ভৈরববাজারের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে মিত্রবাহিনী তা জানত না। তাই মিত্রবাহিনী ময়মনসিংহে বড় লড়াই করার জন্য সেদিনটা ব্রহ্মপুত্র নদীর ওপারে শম্ভগঞ্জে অপেক্ষা করল। অন্যদিকে ভারতীয় বিমান এবং নৌবাহিনীও সেদিন পাকবাহিনীকে ভয় পাইয়ে দিল। বিমানবাহিনীর জঙ্গী বিমানগুলি ঢাকার বেতারকেন্দ্রকে স্তব্ধ করে দিয়ে এল। কুর্মিটোলার উপর বারবার রকেট আর বোমা ছুঁড়ল।
নৌবাহিনীর বিমান আক্রমণে চট্টগ্রামও চালনার অবস্থাও অত্যন্ত কাহিল। কয়েকটা ভর্তি হয়ে পাকবাহিনী বঙ্গোপসাগরে পালাতে গিয়েছিল। একটা জাহাজে নিরপেক্ষ দেশের পতাকা উড়িয়েও কিছু পাক সৈন্য সিঙ্গাপুরের দিকে পালিয়ে পালাচ্ছিল। সব ধরা পড়ল। কয়েকটা পাক বাণিজ্য জাহাজও মাঝদরিয়ায় ঘায়েল হল।
১১ ডিসেম্বরঃ ১১ তারিখ চতুর্দিকে পাক সেনাবাহিনীর প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়ল। বহু পাক ঘাঁটির পতন হল।মুক্ত হল জামালপুর, ময়মনসিংহ, হিলি,গাইবান্ধা, ফুলছড়ি, বাহদুরাবাদ, পিসপাড়া, দুর্গাদীঘি, বিগ্রাম এবং চণ্ডীপুর। বিভিন্ন এলাকায় শত শত পাকসৈন্য আত্মসমর্পণ করল। এক জামালপুরেই আত্মসমর্পণ করল৫৮১ জন। চাঁদপুরের উত্তরে মতলব বাজারেও বহু পাকসৈন্য আত্মসমর্পণ করল। কিছু আবার পেছনের দিকে পালাতে গিয়ে মার খেল। যেমন জামালপুরের বাহিনীর একটা অংশ। জামালপুরের পাকবাহিনী বেশকিছু দিন ধরে ভাল লড়াই- ই চালিয়েছিল। মাটি কামড়ে তারা লড়াই চালাচ্ছিল। এই লড়াইয়ে ভারতীয় জেনারেল গিল মারাত্মকভাবে আহত হলেন। ১১ তারিখ আর পারল না। একটা বাহিনী আত্মসমর্পণ করল। আর একটা টাঙ্গাইলের দিকে পালাল।
উত্তরে ১০১নং কমিউনিকেশন জোনের একটা বিগ্রেড তখন ময়মনসিংহ দখল করে নিয়েছে। ময়মনসিংহ থেকে সোজা তারা ঢাকা এগোতে পারল না। কারণ রাস্তাটাই সোজা যায়নি। গিয়েছে টাঙ্গাইল ঘুরে। ময়মনসিংহ থেকে ঢাকার রেললাইনটা ছিল সোজাসুজি। কিন্ত পালাবার আগে পাকবাহিনী ব্রহ্মপুত্রের উপর রেলসেতুটা ভেঙ্গে দিয়েছিল ওই পথের আরও কয়েকটা রেল পুল। তাই ভারতীয় বাহিনীকে টাঙ্গাইলের পথেই এগোতে হল। সেইটাই অবশ্য ছিল তাদের পরিকল্পনা।
ওদিকে ভৈরববাজারের দিক থেকে তখনও এগিয়ে ৫৭নং ভারতীয় ডিভিশন। কিছুটা এগিয়ে তারা দুভাগে ভাগ হয়ে গেল। একটা গেল নরসিংদীর দিকে। বিমানবাহিনীও তখন পুরোদমে আক্রমণ চালাচ্ছে। পাকিস্তানীরা মিত্র পক্ষের সেনাবাহিনীর হাত থেকে পালায় তো বিমানবাহিনীর হাতে গিয়ে ধরা পড়ে। বিমানবাহিনী সেদিন একমাত্র ঢাকাকে রেহাই দিল। কারণ, ভারত সরকার আগেই ঘোষণা দিয়েছিল, ওইদিন ঢাকাও করাচির উপর কোনও আক্রমণ হবে না। বিদেশীদের ঢাকা থেকে বের করে আনার জন্য আন্তর্জাতিক বিমান তেজগাঁওয়ে নামতে দেওয়া হবে। এবং সেজন্য তেজগাঁও বিমানবন্দর সারতেও দেওয়া হবে। নৌবাহিনী কিন্ত সেদিনও ভীষণ সক্রিয়। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এবং চালনার উপর নৌবাহিনীর বিমানগুলি সেদিনও প্রচণ্ড আক্রমণ চালাল।
১২ ডিসেম্বরঃ পরদিনও বিমানবাহিনী ঢাকার উপর কোনও আক্রমণ করল না। সেদিন বিদেশীদের নিয়ে ঢাকা থেকে তিনখানা বিমান এল কলকাতায়। অবরুদ্ধ ঢাকা থেকে মুক্ত মানুষেরা এল কলকাতায়। বিমানবাহিনী সেদিন অন্যত্র ব্যস্ত। ভোররাতেই ছত্রীসেনাদের নামানো হল টাঙ্গাইলে। ময়মনসিংহের দিক থেকে মিত্রবাহিনীর বিগ্রেডটাও দ্রুত এগিয়ে আসছে টাঙ্গাইলে।ভোররাতে ছত্রীসেনাদের নামানো হল নদীর দক্ষিণে। মীর্জাপুর আর টাঙ্গাইলের মাঝামাঝি।
ভুয়া ছত্রীদের নামানো হয়েছিল প্রথম রাত্রে। কিছু পাকসেনা সেই ভুয়া ছত্রীসেনা খুঁজতে ছুটল। তারপর ভোররাতে নদীর উত্তরে নামানো হল আসল ছত্রীসেনা। এক ব্যাটালিয়ন অর্থাৎ প্রায় একহাজার। মাটিতে নামতে তারা স্থানীয় অধিবাসীদের সাহায্য পেল। স্থানীয় সবাই সাহায্য করতে এগিয়ে এল। বিমান থেকে যে অস্ত্রশস্ত্র ফেলা হয়েছিল স্থানীয় অধিবাসীরা ছুটোছুটি করে তা সংগ্রহ করে দিল ছত্রীসেনাদের।
উত্তর দিকে পাকবাহিনীর একটা অংশ তখন পিছু হটে আসছিল। এদের আগমনের খবর জানা ছিল না ভারতীয় বাহিনীর। কারণ এরা প্রধানত কাঁচা রাস্তা দিয়ে আসছিল। আচমকা এই পাকবাহিনীটা এসে পড়ল ছত্রীসেনাদের সামনে। ওরাও আবার জানতো না যে ভারতীয় ছত্রীসেনারা ওখানে নেমেছে। ভারতীয় ছত্রীসেনারাই প্রথম দেখতে পেল পাকবাহিনীকে। দেখতে পেয়েই দমাদম গুলি চালাল। এবং সেই আচমকা আক্রমণে পাকবাহিনী একেবারে হতভম্ব হয়ে পড়ল। প্রথমেই তারা ছিটকে পড়ল। তারপর রিগ্রুপড হয়ে দক্ষিণে এগোবার চেষ্টা করল। কিন্ত ততক্ষণে ভারতীয় ছত্রীসেনারা পুরোপুরি তৈরি। লড়াই হল। পাকসেনারা কিছুক্ষণ লড়ার পরই পিছু হটার চেষ্টা করল। কিন্ত তাও পারলো না। কারণ ততক্ষণে ময়মনসিংহের দিক থেকে ১০১নং কমিউনিকেশন জোনের বিগ্রেডটাও এসে গিয়েছে পেছনে। বাধ্য হয়ে পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করল।
টাঙ্গাইলের ছত্রীসেনারা কিছুক্ষণের মধ্যেই ছোট্ট বিমানবন্দরটা দখল করে নিল। তারপর থেকে প্রতি দশ মিনিট অন্তর সেখানে ক্যারিবু বিমানের অবতরণ শুরু হল। এল আরও সৈন্য। এল বহু অস্ত্রশস্ত্র।যুদ্ধের নানা সরঞ্জাম। কয়েক ঘণ্টা পর ১০১নং কমিউনিকেশন জোনের বিগ্রেডটা এসে তাদের সঙ্গে যোগ দিল। এবং দুই বাহিনী একত্রে এগিয়ে চলল ঢাকার পথে মির্জাপুরের দিকে।
ওদিকে তখন ৫৭ নং ডিভিশনও পূর্ব দিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে ঢাকার দিক।সেই দিন তারা নরসিংদী অতিক্রম করে বেশকিছু এগিয়েছে। সেদিনই প্রথম ঢাকায় ভারতীয় কামানের গর্জন শোনা গেল। এবং সেই গর্জন শুনে নিয়াজিসহ ঢাকার পাকবাহিনী অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো।
এদিকে কলকাতায় পূর্বাঞ্চলীয় বাহিনীর চীফ অব স্টাফ জেনারেল জ্যাকবও আর এক কাণ্ড করে বসে আছেন। সকালে সাংবাদিক বৈঠক। জেনারেল জ্যাকব সেখানে সমগ্র পরিস্থিতি বোঝাচ্ছিলেন। সাংবাদিকরা তাঁকে এই ছত্রীসেনা নামাবার ব্যাপারটা জিজ্ঞেস করল। জেনারেল জ্যাকব বললেন,’’ হ্যাঁ ছত্রীসেনা নেমেছে। তবে কোথায় নেমেছে, কত নেমেছে আমাকে জিজ্ঞেস করো না। বিদেশী সাংবাদিকরা যত এই ব্যাপারে প্রশ্ন করেন, জেনারেল জ্যাকব ততই প্রশ্নটাকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তাঁরই মধ্যে তিনি ইঙ্গিতে এমন ধারণা দিলেন যে, এক বিগ্রেডের বেশী ছত্রসেনা নামানো হয়েছে এবং ঢাকার কাছাকাছি বিভিন্ন এলাকায় তারা নেমেছে। আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থাগুলি এই খবর সঙ্গে সঙ্গে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিল। খবরটা ঢাকায়ও পৌঁছল।এবং পাক সমরনায়করা সেই খবর পেয়ে বিষম ভয় পেয়ে গেল। তারা ভাবল হয়ত ঢাকার চতুর্দিকে মিত্রবাহিনী প্রচুর ছত্রীসেনা নামিয়েছে। এবং হয়ত সব খবর তারা তখনও পায়নি। ঢাকার সবাই বুঝল, এবার আর রক্ষা নেই। জেনারেল মানেকশের আবেদনও তখন বারবার প্রচারিত হচ্ছেঃ বাঁচতে চান তো আত্মসমর্পণ করুন।পালাবার কোন পথ নেই। লড়াই করা বৃথা। আত্মসমর্পণ করলে জেনেভা কনভেনশন অনুসারে ব্যবহার পাবেন।
১৩ ডিসেম্বরঃ মিত্রবাহিনী যতই ঢাকার দিকে এগিয়ে আসছিল এবং ঢাকার উপর বিমান হানা যতই বাড়ছিল ঢাকার পাক সামরিক নেতাদের অবস্থাও ততই কাহিল হয়ে উঠেছিল। সাধারণত বিপদে পড়লে জেনারেলরা যা করেন এরাও প্রথম প্রথম তাই করল- ইসলামাবাদের কাছে বারবার আরও সাহায্য পাঠাবার আবেদন জানাল। বলল; ভারত অন্তত ন’শ ডিভিশন সৈন্য এবং দশ স্কোয়াড্রন বিমান নিয়ে আক্রমণ শুরু করেছে। সুতরাং আমাদেরও অবিলম্বে কয়েক ডিভিশন সৈন্য এবং কয়েক স্কোয়াড্রন বিমান চাই। ইসলামাবাদ প্রথমে ঢাকার কর্তাদের বলেছিলঃ তোমরা মাত্র কয়েকটা দিন লড়াই চালিয়ে যাও। আমরা দিন সাতেকের মধ্যে পশ্চিমখণ্ডে ভারতীয় বাহিনীকে এমন মার দেব যে তারা নতজানু ক্ষমা চাইতে বাধ্য হবে। এবং তখন যুদ্ধই থেমে যাবে। সুতরাং তোমাদেরও আর কোনও অসুবিধা থাকবে না। কিন্ত দিন পাঁচ- ছয়ের মধ্যেই ঢাকার পাক কর্তারা বুঝতে পারল যে ওদিকেও বেশী সুবিধা হচ্ছে না। ভারত নতজানু হওয়ার কোনই সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না বরং ভারতীয় বাহিনী প্রচণ্ড বেগে ঢাকার দিকে এগোচ্ছে। তখন তারা অনেকেই ভয় পেয়ে গেল। ভয় পেল প্রধানত দুই কারণে। প্রথমে কারণ, পালানোর পথ নেই। কোথাও যে পালিয়ে গিয়ে আত্মরক্ষা করবে তার উপায় নেই। বিমানবন্দরে পালানোর মত কোনও পথ নেই। মাথার উপরে ভারতীয় বিমান। সমুদ্রে ভারতীয় নৌবাহিনীর অবরোধ। স্থলপথেই যেদিকে যাওয়া যাবে, ভারতীয় সেনা।মুক্তিবাহিনী বা স্থানীয় মানুষের হাতে পড়লে মৃত্যু অনিবার্য। তাদের অত্যাচারের ফলে বাংলাদেশের মানুষ কতটা ক্ষেপে আছে তা জানতে তাদের বাকি নেই। তাই মিত্রবাহিনী পদ্মা ও মেঘনার কূলে এসে দাঁড়ানো মাত্রই পাক কর্তাদের মনোবল ভেঙ্গে পড়েছিল। তারা অসহায় বোধ করতে শুরু করেছিল। এর উপর তারা যখন দেখল যে বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়ানো পাকবাহিনীও আর ঢাকার দিকে ফিরতে পারছে না তখন তারা অনেকেই একেবারে হাত-পা ছেড়ে দিল।
ওদিকে তখন পূর্ব ও উত্তর দিক থেকে মিত্রবাহিনী ঢাকায় প্রায় পনেরো মাইলের মধ্যে পৌঁছে গেছে।৫৭ নং ডিভিশনের দুটো বিগ্রেড এগিয়েছে পূর্ব দিক থেকে। উত্তর দিক থেকে এসেছে গন্ধর্ব নাগরার বিগ্রেড এবং টাঙ্গাইলে নামা ছত্রীসেনারা। পশ্চিমে সেদিন ৪ নং ডিভিশনও মধুমতি পার হয়ে পৌঁছে গিয়েছে পদ্মার তীরে। উত্তর এবং পূর্ব দিক থেকে মিত্রবাহিনীর কামানের গোলাও পড়া শুরু হয়েছে কুর্মিটোলা ক্যান্টমেন্টে। এবং ভারতীয় বাহিনীর জঙ্গী বিমানগুলিও বারবার হানা দিচ্ছে ঢাকার সব কটা সামরিক ঘাঁটির উপর। পাকবাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য মিত্রপক্ষ সেদিন সর্বতোভাবে সচেষ্ট। একদিকে চলছে কামানে-বিমানে তীব্র আক্রমণ আর একদিকে বেতারে প্রচারিত হচ্ছে আত্মসমর্পণের আবেদন। জেনারেল মানেকশঃ বাণী সেদিন প্রচারিত হয়েছিল রাও ফরমান আলীর উদ্দেশ্যে। জেনারেল মানেকশ এখন বললেনঃ আমার সৈন্যরা এখন ঢাকাকে ঘিরে ধরেছে এবং তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হবে এবং তাদের প্রতি ন্যায়সঙ্গত ব্যবহার করা হবে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় সেদিন শত শত পাকসেনা আত্মসমর্পণ করল।এক ময়নামতিতেই আত্মসমর্পণ করল ১১৩৪ জন। কিন্ত নিয়াজি তখনও অবিচল। তখনও সে লড়াই চালিয়ে জেতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। এবং তখনও তার সঙ্গে একমত হয়ে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে খুলনা, বগুড়া এবং চট্টগ্রামের পাক অধিনায়করা।
১৪ডিসেম্বরঃ নিয়াজি তখনও গোঁ ধরে বসে আছে, কিন্ত আর প্রায় সকলেরই হৃদকম্পন উঠে গিয়েছে। ১৩ তারিখ রাত থেকে ১৪ তারিখ ভোর পর্যন্ত পূর্ব এবং পশ্চিম দিক দিয়ে মিত্রবাহিনী কামান অবিরাম গোলা মেরে চলল। গোলাগুলি পড়ল গিয়ে প্রধানত ঢাকা ক্যান্টমেন্টে। কিন্ত সে গোলার আওয়াজে সারারাত ধরে ঢাকা কাঁপল। ঢাকার সবাই সেদিন ভীষণ আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। বুঝল, আর রক্ষা নেই। গভর্নর মালিক সেদিন সকালেই সমগ্র পরিস্থিতি বিবেচনার জন্য গভর্নর হাউসে মন্ত্রীসভার এক জরুরী বৈঠক ডাকল। এই বৈঠকে বসবার ব্যাপারেও আলী এবং চীফ সেক্রেটারী মুজাফফর হোসেনের হাত ছিল। তারা তখনও মনে করেছে, আত্মসমর্পণ ছাড়া উপায় নেই, রক্ষা নেই।
মন্ত্রীসভার বৈঠক বসল সকাল এগারোটা নাগাদ। এবং একটা পাকিস্তানী ওয়ারলেস মেসেজ ধরে মিত্রবাহিনীও প্রায় সঙ্গে সঙ্গে জেনে গেল সেই বৈঠকের খবরটা। সঙ্গে সঙ্গে খবর চলে গেল ভারতীয় বিমানবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় হেডকোয়াটারে। এবং কয়েক মিনিটের মধ্যেই এক ঝাঁক জঙ্গী বিমান উড়ে এল ঢাকা গভর্নর হাউসের উপর। একেবারে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে তারা ছুঁড়ল রকেট। গোটা পাঁচেক গিয়ে পড়ল একেবারে গভর্নর হাউসের ছাদের উপর। মিটিং তখনও চলছিল। মালিক এবং তার মন্ত্রীরা ভয়ে প্রায় কেঁদে উঠল। চীফ সেক্রেটারি, আইজি, পুলিশ বড় বড় কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিল। তারাও ভয়ে যে পারল পালাল। বিমান হানা শেষ হওয়ার পর মালিক সাহেব তার পাত্রমিত্রদের সঙ্গে আবার বসলেন।এবং তারপর আর পাঁচ মিনিটও লাগল না তাদের সিদ্ধান্তে পৌঁছতে। তারা সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত করলেনঃ আমরা সবাই পদত্যাগ করলাম। সেই পদত্যাগের সিদ্ধান্ত তারা সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটি প্রতিনিধি রেনড সাহেবকে জানাল এবং তার কাছে আশ্রয় চাইল। রেনড সাহেব তখন ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলকে রেডক্রসের অধীনে ‘’ নিরপেক্ষ এলাকা’’ করে নিয়েছেন। এই ‘’নিরপেক্ষ এলাকা’’ তখন ঢাকার এক অদ্ভুত জিনিস। গোটা ঢাকা তখনও পাকিস্তানীদের দখলে, শুধু হোটেলটা ছাড়া। হোটেলটার উপর রেডক্রসের বিরাট বিরাট পতাকা উড়ছিল। বহু বিদেশী এবং পশ্চিম পাকিস্তানী আশ্রয় নিয়েছিল ওই হোটেলে। ১৪তারিখ সেখানে সদলবলে গিয়ে আশ্রয় নিল মালিক সাহেব। তখন ঢাকার সবাই মনে করছে- ওটাই একমাত্র নিরাপদ আশ্রয়- ভারতীয় বৈমানিকরা কিছুতেই রেডক্রসের বড় বড় পতাকা ওঠা বাড়িতে আক্রমণ করবে না। রেনড সাহেব তার এলাকায় ওদের আশ্রয় দিয়ে খবর পাঠালেন জেনিভায়। সেই বার্তায়; পূর্ব পাকিস্তান সরকারের সর্বোচ্চ কর্মকর্তারা পদত্যাগ করেছেন এবং রেডক্রস আন্তর্জাতিক অঞ্চলে আশ্রয় চেয়েছেন। জেনিভা চুক্তি অনুযায়ী তাদের আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। ভারত ও বাংলাদেশ সরকারকে যেন অবিলম্বে সমস্ত ঘটনা জানানো হয়। খবরটা যেন সামরিক বাহিনীকে জানানো হয়।
মালিক এবং তার গোটা ‘’ পূর্ব পাকিস্তান সরকারের’’ এই সিদ্ধান্তে অবস্থা আরও কাহিল হল। ঢাকার উপর তখন প্রচণ্ড আক্রমণ চলছে। আক্রমণ চলছে কামানের। আক্রমণ চলছে বিমানের। প্রধান লক্ষ্য কুর্মিটোলা ক্যান্টমেন্ট। নাগরার বাহিনী তখন টঙ্গীর কাছে পৌঁছে গিয়েছে। এবং পাক শীতলক্ষ্যা নদীর একটা শাখার উপর ব্রিজটা উড়িয়ে দিয়ে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছে। মূল পাকবাহিনীটা কিন্ত কামান এবং বিমান আক্রমণে প্রায় পাগল হয়ে গিয়ে কুর্মিটোলা ছেড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছে। পূর্বদিকের বাহিনীটাও প্রায় পৌঁছে গিয়েছে ডেমরায়। তবু নিয়াজি তখনও বলছে; আমি শেষ পর্যন্ত লড়ে যাব। নিয়াজি অবশ্য একথা বলেছিল প্রধানত মার্কিনীদের ভরসায়। মার্কিনী সপ্তম নৌবহর যে বঙ্গোপসাগরের দিকে এগোচ্ছে এ খবর চার-পাঁচদিন আগে থেকেই জানা গিয়েছিল। গোটা দুনিয়ায় তখন সপ্তম নৌবহরের বঙ্গোপসাগরে আগমন নিয়ে জোর জল্পনা- কল্পনা চলছে। মার্কিন সরকার যদিও ঘোষণা করলেন যে কিছু আমেরিকান নাগরিককে অবরুদ্ধ বাংলাদেশ থেকে উদ্ধারের জন্যই সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরে যাচ্ছে।আসলে কিন্ত কেউ তা বিশ্বাস করল না। সকলেরই মনে তখন বেজায় সন্দেহ। সকলেরই মনে তখন প্রশ্ন; প্রেসিডেন্ট নিকসন কি ইয়াহিয়ার রক্ষার্থে মার্কিন নৌবহরকে আসরে নামাবেন। ঠিক কি উদ্দেশ্যে মার্কিন সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরে এসেছিল এবং কেনই বা তারা কিছু না করে ( কিছু করতে না পেরে) সে রহস্যের এখনও সম্পূর্ণ কিনারা হয়নি। তবে ইতিমধ্যেই ঢাকায় এতটুকু খবর গিয়েছে ইসলামাবাদের খবর মত ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত নিয়াজি আশা করেছিল যে, সপ্তম নৌবাহিনীর জঙ্গী বিমানগুলি তার সাহায্যে আসবে নামবে। ইয়াহিয়া নিজে নাকি নিয়াজিকে সে খবর জানিয়েছিল। সেই ভরসায় নিয়াজি ১৪ তারিখেও বলে চলেছে; একেবারে শেষ পর্যন্ত শেষ পর্যন্ত লড়াই চালাব।
ওদিকে মিত্রবাহিনী তখন প্রচণ্ডভাবে ঢাকায় সামরিক লক্ষবস্তগুলির উপর আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে কিন্ত তখনও তারা ঠিক জানেনা ঢাকার ভেতরের অবস্থাটা কি। অর্থাৎ পাকবাহিনী কিভাবে ঢাকার লড়াইটা লড়তে চায় এবং ঢাকায় তাদের শক্তিই বা কতই। সে খবর মিত্রবাহিনী জানে না। নানাভাবে এই খবর সংগ্রহের চেষ্টা হল।কিন্ত আসল খবরটা কিছুতেই পাওয়া গেল না। যা পাওয়া গেল সব ভুল। সেই ভুল খবরগুলির একটাঃপাকিস্তানীরা গোটা শহরে ছড়িয়ে পড়ে পরিখা খনন করে হাউস-টু-হাউস লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। আর একটা খবরঃ ঢাকায় পাকবাহিনীর অন্তত দেড় ডিভিশন সৈন্য রয়েছে। এবং রয়েছে প্রচুর পরিমাণে অস্ত্রশস্ত্র। এই দুটো খবরই ভুল ছিল। কিন্ত তখনকার মত এই খবর দুটোই ঠিক মনে হয়েছিল। মিত্রবাহিনী এই অবস্থায় মনে করল যে ঢাকার ভেতরে লড়াই করার জন্য যদি সৈন্যদের এগিয়ে দেওয়া হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে যদি বিমান আক্রমণ চালানো হয় তাহলে লড়াইয়ে প্রচুর সামরিক মানুষও মরবে। মিত্রবাহিনী এটা কিছুতেই চাইছিল না। তাই ওইদিনই তারা একদিক যেমন পাকবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের আবেদন জানাল এবং তেমনি আর একদিকে ঢাকার সাধারণ নাগরিকদের অনুরোধ জানাল আপনারা শহর ছেড়ে চলে যান। যত তাড়াতাড়ি পারেন ঢাকা শহর ত্যাগ করুন। উত্তর এবং পূর্ব রাজধানী দুদিকেই তখন আরও বহু মিত্রসেনা এসে উপস্থিত হয়েছে। চাঁদপুরেও আর একটা বাহিনী তৈরি হচ্ছে নদীপথে অগ্রসর হওয়ার জন্য।
১৫ ডিসেম্বরঃ আগেই বলা হয়েছে নিয়াজি মার্কিন সপ্তম নৌবহরের সাহায্য আশা করছিল। এবং সেই ভরসায়ই দিন গুনছিল।কিন্ত ১৩ বা ১৪ তারিখ কোনও একটা সময়ে নিয়াজি বুঝল না মার্কিন সপ্তম নৌবহর তাকে সাহায্য করতে আসরে নামবে না। এই জিনিসটা ঠিক কখন এবং কিভাবে নিয়াজি জানল সেটা বলা মুশকিল। এখনও সে তথ্য প্রকাশিত হয়নি। ভবিষ্যতে হয়ত কোনও একদিন জানা যাবে এবং তখন বোঝা যাবে আসল ব্যাপারটা। তবে ইতিমধ্যেই যতটা জানা গিয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে ১৪ডিসেম্বর সকাল থেকেই নিয়াজি সবরকম আশা ছেড়ে দিয়েছে। ওইদিনই সে শর্তসাপেক্ষে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব নিয়ে ঢাকার বিভিন্ন বিদেশী দূতাবাসের সঙ্গে আলাপ- আলোচনা করল বিশেষত মার্কিনীদের সাথে। ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের কর্মীরা সেই প্রস্তাবটা পাঠিয়ে দিলেন দিল্লীর মার্কিন দূতাবাসে।তারা আবার খবরটা পাঠালেন ওয়াশিংটনে। তখন ওয়াশিংটন ইসলামাবাদের মার্কিন দূতাবাস বহু চেষ্টা করেও ইয়াহিয়াকে ধরতেই পারল না। ১৫ তারিখ দিল্লীর মার্কিন দূতাবাস মারফৎ খবরটা পৌঁছল ভারত সরকারের কাছে- নিয়াজি আত্মসমর্পণ করতে চায়, তবে কতগুলো শর্তসহ। প্রধান শর্ত, পশ্চিম পাকিস্তানীদের সবাইকে চলে যাওয়ার সুযোগ দিতে হবে এবং কাউকে গ্রেফতার করা চলবে না। ভারত সরকার এ প্রস্তাবটা সঙ্গে সঙ্গে নাকচ করে দিলেন। শর্ত- টর্ত নয় বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করতে। ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশের পাকবাহিনীকে অবশ্য এ আশ্বাস দিতে রাজি নয় যে যুদ্ধবন্দীরা জেনিভা চুক্তিমত ব্যবহার পাবে। নিয়াজি যে পুরো ভেঙ্গে পড়েছে, ঢাকায় যুদ্ধ চালাবার মত মনোবল তার বা তার বাহিনীর মোটেই নেই এটা কিন্ত ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তখনও জানেন না। ঢাকার ভেতরে খবরাখবর ভারতীয় বাহিনী খুব কমই পাচ্ছিল। নিয়াজির শর্তসাপেক্ষে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব পেয়ে ভারতীয় বাহিনী মনে করল, এটা নিয়াজির কৌশল। আসলে সে কিছুটা সময় চাইছে যাতে সপ্তম নৌবহরের সাহায্যে সৈন্যসামন্ত পাত্রমিত্র নিয়ে বাংলাদেশ থেকে বেরিয়ে যেতে পারে। নিয়াজি যে প্রস্তাব দিল তার মানে দাঁড়াল যুদ্ধবিরতি- আত্মসমর্পণ নয়। কিন্ত মিত্রবাহিনী তখন বিনা শর্তে পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণ ছাড়া আর কিছুতেই রাজি নয়।দিল্লীর মার্কিন দূতাবাস মারফৎ সেই কথা জানিয়ে দেওয়া হলঃ আমাদের প্রস্তাব ভেবে দেখার জন্য আপনাকে ১৬তারিখ সকাল ৯টা পর্যন্ত সময় বেধে দেওয়া হল। ভারতীয় বিমানবাহিনী ওই পর্যন্ত কোনও আক্রমণ করবে না।কিন্ত মিত্রপক্ষের স্থলও নৌবাহিনী যথারীতি অগ্রসর হতে থাকবে। যদি সকাল ৯টার মধ্যে আত্মসমর্পণের খবর না পাই তাহলে তখন থেকে আবার বিমানবাহিনীর আক্রমণ পুরোদমে শুরু হবে। ঢাকার ভেতর পাকবাহিনীর অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। তাদের মনোবল একেবারে ভেঙ্গে গিয়েছে।
জেনারেল মানেকশ তাঁর শেষ বার্তায় নিয়াজিকে বলেছিলেনঃ সকাল নয়টার মধ্যে বেতার জানতে হবে আত্মসমর্পণ করেছেন কিনা। একটা বেতার ফ্রিকোয়েন্সিও বলে দিয়েছিলেন।
শোনা যায় নিয়াজি সেদিন সারারাত ধরে ইসলামাবাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে। এব্যাপারে বিভিন্ন বিদেশী দূতাবাসেরও সাহায্য নেয়। কিন্ত কোনও ফলই হল না।
ইয়াহিয়া খাঁকে কিছুতেই খুঁজে পাওয়া গেল না। ওদিকে তখন মিত্রবাহিনীর কামানের গোলার আওয়াজ বাড়ছে এবং পাকবাহিনীতে ত্রাসও বাড়ছে। ঢাকার অসামরিক পাকিস্তানীরাও আত্মসমর্পণের পক্ষে চাপ বাড়াচ্ছে। চাপ দিচ্ছে কয়েকটা বিদেশী দূতাবাসও।
১৬ডিসেম্বরঃ সকালে নিয়াজি আবার কয়েকজন বিদেশী দূতের সঙ্গে কথা বলল এবং শেষপর্যন্ত স্থির করল যে মানকশের প্রস্তাবই মেনে নেবে। তখন শুরু হল ওই ফ্রিকোয়েন্সিতে গিয়ে ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা। কয়েকজন বিদেশীর সঙ্গে বসে নিয়াজি বারবার সেই চেষ্টায়ই করতে থাকল। সকাল প্রায় সোয়া আটটা থেকে। কিন্ত কিছুতেই যোগাযোগ করতে পারল না। ন’টা বাজে বাজে তখন গোটা ঢাকা আকাশবাণীর কলকাতা স্টেশন খুলে কান পেতে বসে রয়েছে। তাঁরাও ভীষণ ভীত। তাঁরাও বুঝতে পারছিলেন ঢাকার লড়াই যদি হয়ই তাহলে তাঁদেরও অনেকের প্রাণ যাবে। তাঁরাও তখন জানতে একান্ত আগ্রহী নিয়াজি মানকেশর প্রস্তাবে রাজি কিনা। কিন্ত হায় ন’টার সংবাদে তারা আকাশবাণীর বাংলা খবরে জানতে পারল নিয়াজি কোনও জবাবই দেয়নি!বিমান আক্রমণ বিরতির সময়ও পার হয়ে গিয়েছে!ঠিক তখনই নিয়াজি মিত্রবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছে। এবং জানিয়েও দিয়েছে তার বাহিনী বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করবে। তখনই ঠিক হল বেলা বারোটা নাগাদ মিত্রবাহিনীর চীফ অব স্টাফ জেনারেল জ্যাকব ঢাকা যাবেন নিয়াজির সঙ্গে আত্মসমর্পণের ব্যাপারটা পাকা করতে।ওদিকে তখন জেনারেল নাগরাও প্রায় মিরপুরের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। ঢাকা- টাঙ্গাইল রোডের উপর নাগরার বাহিনী আটকে পড়েছিল। টঙ্গীর কাছাকাছি। নদীর ওপরের ব্রিজটা পাকিস্তানীরা ভেঙ্গে দিয়েছিল।
১৬ তারিখ ভোর নাগরার বাহিনী নয়ারহাটের ফরেস্ট রোড দিয়ে সাভারের কাছাকাছি এসে ঢাকা- আরিচাঘাট রোডের উপর এসে পড়ল। পাকবাহিনী এই রাস্তায় ভারতীয় বাহিনীকে আশাই করে নি। তাই ওদিকে কোনও প্রতিরোধের ব্যবস্থায়ই রাখেনি। এমনকি ব্রীজগুলি পর্যন্ত ভাঙ্গে নি। আরিচাঘাট রোডে পড়ে গন্ধর্ব নাগরার বাহিনী সোজা ঢাকার দিকে এগোলো। মাত্র কয়েক মাইল। প্রথমেই মিরপুর। পাকবাহিনীর জেনারেল জামসেদ সেখানে গিয়ে নাগরার কাছে আত্মসমর্পণ করল। নাগরার বাহিনী ঢাকা কয়েক মিনিটের মধ্যেই জেনারেল জ্যাকব হেলিকপ্টারে ঢাকা পৌঁছলেন। নিয়াজির সঙ্গে কথাবার্তা পাকা হল। আত্মসমর্পণের দলিলও তৈরি হল।বিকাল ৪টা নাগাদ সদলবলে ঢাকা পৌঁছলেন মিত্রবাহিনীর প্রধান জেনারেল অরোরা। ৪-২১ মিনিটে ঢাকার রেসকোর্সে জনতার ‘’জয় বাংলা’’ ধ্বনির মধ্যে নিয়াজি আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করল। বাংলাদেশের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে থাকা পাকবাহিনীর কাছে ততক্ষণে আত্মসমর্পণের নির্দেশ চলে গিয়েছে। সেদিন শুধু লড়াই চলেছিল চট্টগ্রাম এবং খুলনায়। পাক নবম ডিভিশনের প্রধান ওইদিন সকালে নিজ থেকে আত্মসমর্পণ করেছিল। মধুমতি নদীর পূর্বতীরে। চট্টগ্রাম শহরেও ভারতীয় সৈন্য তখন প্রায় ঢুকে পড়েছে। আর খুলনার পাকবাহিনীর একটা অংশ তখন খালিশপুরের অবাঙ্গালী জনবসতির মধ্যে ঢুকে মিত্রবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ চালাচ্ছে।
নিয়াজি আত্মসমর্পণের পর সব যুদ্ধই থেমে গেল। ১৬ডিসেম্বর থেকেই বাংলাদেশ মুক্ত এবং স্বাধীন।