মুক্তাঞ্চল ঘুরে এলাম
৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এই মুহুর্তে একটি উজ্জ্বলতম অধ্যায়ের মধ্যে প্রবেশ করেছে। প্রতি প্রহরে মুক্তিযোদ্ধা ভায়েরা নতুন নতুন এলাকায় তাদের বিজয় ধ্বনিত করে তুলছে। তাদের বিজয়দৃপ্ত পদচারণা মানুষের মুক্তি এবং মানবিকতার শাশ্বত বাণীকে চিরন্তন এবং মহিমান্বিত করে তুলছে। শত্রুরা হটছে, পিছু হটছে, মুক্তিযোদ্ধারা এগিয়ে চলেছে, সামনে চলেছে। মানবিকতার শক্রপাক-হানাদাররা মৃত্যুমুখী যাত্রাপথের শেষ প্রান্তে এসে ঠেকেছে, বাঙালীরা মহিমাময় মুক্তিতোরণের দ্বারে এসে গেছে। মুক্তিযোদ্ধা ভায়েরা পায়ে পায়ে চলেছে, সামনে চলেছে, চলেছে মুক্তির মহাসঙ্গীত উৎসে। পাক হানাদাররা পায়ে পায়ে মরছে, আরো মরছে, মরছে ঘৃণা এবং গ্লানির অন্ধকারে। ওদের মৃত্যু সহজ, সম্ভব- তাই সত্য। আমাদের অমরত্ব ন্যায়ত্ব, সত্যত্ব তাই অবধারিত। ওরা লাঞ্ছিত সমগ্র মানুষের বিবেকের বিচারে। আমরা নন্দিত সমগ্র সভ্যতার সান্নিধ্যে। সভ্যতার বিনাশে ওদের পাশবিক তৃপ্তি। সেই সভ্যতার স্থায়িত্ব আমাদের একমাত্র মুক্তি।
সভ্যতার বিরুদ্ধে দীর্ঘ নয় মাস যে যুদ্ধ বাংলাদেশের সীমানায় বন্দী ছিল, হানাদার হায়েনারা সে যুদ্ধকে ছড়িয়ে দিয়েছে আরো বৃহত্তর পৃথিবীতে। পাকিস্তানীরা সমগ্র মানুষের রক্তে স্নাত হতে চাইছে। চাইছে পৃথিবী জুড়ে তাদের বর্বর মৃত্যু, হত্যাযজ্ঞ নির্বিচারে শুরু করতে।
এদের থামতে হবে। এদের থামাতে হবে। এদের অস্তিতুকে ধ্বংস করতে হবে। এদের বিনাশ করতে হবে। মানব সভ্যতাকে রক্ষা করতে হবে। মানুষকে বাঁচাতে হবে।
আজ মানুষকে বাঁচাবার লড়াই। বিস্তারিত মুক্তাঞ্চলে অন্ততঃ তারই বিরামহীন প্রচেষ্টা চলেছে। ওরা তোলার শ্রমে জড় হচ্ছেন। ইতিমধ্যে বাংলার বহু অঞ্চল মুক্ত হয়ে গেছে। কিন্তু সেগুলোর অনেক স্থানই এখন জ্বলছে। পশ্চিমারা পিছু হটার প্রাক্কালে অনুসরণ করছে পোড়ামাটি নীতি। জ্বালিয়ে দিয়েছে গ্রামের পর গ্রাম, বসতির পর বসতি।
খুলনার দক্ষিণাঞ্চল ঘুরে দেখে এলাম। কয়েকদিন আগে এই অঞ্চলে পাক-হানাদারদের সাথে প্রচণ্ডভাবে লাড়াইয়ে আমাদের মুক্তিবাহিনী খুলনার দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রায় ৬০০ বর্গমাইল এলাকা মুক্ত করেছেন। এই এলাকা সম্পর্কে কথা হচ্ছিল শাজাহান মাস্টারের সাথে। তিনি দেবহাটা থানার টাউন শ্রীপুর হাই-স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন। আজ তিনি কলম ছেড়ে ষ্টেনগান হাতে নিয়েছেন। শিক্ষকের চেয়ার ছেড়ে সৈনিকের বাঙ্কারে বসেছেন।
দশমাস আগেও যিনি ছাত্রদের নিয়ে ক্লাসে বসতেন, আজ তাদেরকে নিয়েই তিনি বৈরীদের মুখোমুখী লড়াই করতে বসেছেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেনঃ কি লাভ, কি হবে স্কুলে, যদি ভবিষ্যতের ছাত্রদের না বাঁচানো যায়।
একটা আশ্চর্য দেশপ্রেম এবং সাহস ভদ্রলোককে আজ এতখানি দুর্বার করে তুলেছে যে অন্ততঃ একটা রাত দেখলেন না ঘুমিয়ে- মুক্তিবাহিনীর সরবরাহ কর্মে কাটিয়ে দিলেন। আমার মনে হোল শিক্ষকরা মহান, কিন্তু ক্যাপ্টেন শাজাহানের মত নিরলস শিক্ষকরা? নিশ্চয় ভবিষ্যৎ জবাব দেবে।
শাজাহান মাস্টার সাহেব আমাকে নিয়ে গেলেন শরীফপুর গ্রামে। গ্রামটি খুবই ভালো। অবাক বিস্ময়ে আমি লক্ষ্য করলাম গ্রামে একটা বাড়িও নেই। আমার চোখকেই যেন ক্ষণমুহুর্তের জন্য বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। কোনো কোনো পোড়া ঘর থেকে তখনও মৃদু মৃদু ধোঁয়া উঠতে দেখলাম। গ্রামের অস্তিত্বটাই যেন হরণ করেছে কোন এক পাষাণ দানব। ক্যাপ্টেন শাজাহান সাহেব বললেনঃ হ্যাঁ-এই গ্রামের এগার হাজার লোকের বাসযোগ্য গৃহাদি ছিল। কিন্তু এখন আপনি দেখছেন- তার একটাও নেই। আমি মাষ্টার সাহেবের দিকে তাকালাম। তিনি বললেনঃ দীর্ঘ বাইশ ঘণ্টা তীব্র সংঘর্ষের পর পাক-হানাদাররা পিছু হটবার সময় সব বাড়িতে পেট্রল ছিটিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয়। আমরা মাত্র চার ঘণ্টা আগে এই গ্রাম দখল করেছি। এক বৃদ্ধাকে দেখিয়ে তিনি বললেনঃ এর নাম রতন। বৃদ্ধ ধীরে ধীরে আমাদের কাছে এলেন। চোখে তাঁর অশ্রুধারা। ঠোঁট দুটো একটু নড়লো। কোন শব্দ উচ্চারিত হোল না। আবার ফিরে গেলেন। মাষ্টার সাহেব জানালেন, বৃদ্ধার পেশা ছিল দুধ বিক্রী করা। চারটে গাই গরুই ছিল তার সম্বল। এবারে আসুন আমার সাথে। শাজাহান সাহেব আমাকে যে গোয়ালঘরের কাছে নিয়ে এলেন সেখানে সে কি বীভৎসতা, কি দুর্গন্ধ- চারটে গরুর বিকৃত পোড়া দেহ পড়ে আছে। চার ধারের মাটিতে পোড়া চর্বির তেল গড়িয়ে গড়িয়ে ভিজিয়ে তুলছে। নাকে কাপড় চেপে বেরিয়ে এলাম সেখান থেকে। আমি বললাম, ক্যাপ্টেন সাহেব আমার বড় খারাপ লাগছে। আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে চলুন।
ভাঙ্গা ধরা গলায় ক্যাপ্টেন শাজাহান কথা বললেন। আমি চমকে উঠলাম। তিনি বললেনঃ ও, আপনি আমার এক ছাত্রের বৃদ্ধা আচল মাকে ওরা ঘরে পুড়িয়ে মেরেছে তা দেখবেন না? তারপর বললেনঃ আর কটাই বা দেখবেন? ওরা যেখানে যেখানে যাচ্ছে সর্বত্র গ্রাম, ধানের গাদা, গরুর গোয়াল, পাটের ঘর, সাঁকো, পুল সবই তো জুলিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। শুধু একটা শরীফপুর গ্রামই না-এমন বহু শরীফপুর ওরা প্রতিদিন তৈরী করছে। কিন্তু আপনি জেনে রাখুন, আমরা আবার গড়ে তুলবো পোড়া ঘর ভাঙা ভিটেগুলোকে। কথাগুলো শুনতে শুনতে আমার চোখ চলে গেল বড় একটা ভিটের ওপর, যেখানে ঘরের চারকোণের চারটে পোড়া ফাটা কাঠই অবশিষ্ট আছে- আর সব ফাঁকা। আমার মনে হোল এই ফাঁকা ঘরকে এরা একদিন ভরাট করবে, এই পোড়া নির্জনতার বুক চিরে এরা তুলে আনবে জীবনের স্পন্দন, নির্মাণ করবে পুনরায় সেই শান্তির নীড়-ছোট ছেলে-মেয়েদের কলকাকলিতে আবার ভরে উঠবে ঘরের আনাচ-কানাচ, সোনার বাংলায় আবার জেগে উঠবে সোনার গ্রাম। সেই সাধনায় এরা রত-রত শিক্ষক, রত ছাত্র, রত গ্রামের কৃষক-শ্রমিক।
সন্ধ্যা হলে এলো। ভাবছিলাম এবার আমাকে ফিরতে হবে। এমন সময় সাইকেলে একজন লোক এলো। হাতে তার একটা ভাঙ্গা সাইকেল। ক্যাপ্টেন সাহেবকে জানালেনঃ আমাকে মাফ করবেন, এক্ষুণি আমাকে অগ্রবর্তী ঘাঁটির দিকে যেতে হচ্ছে যে ছেলেটি এসেছিলো তাকে দেখিয়ে বললেনঃ ওর নাম মৃণাল কান্তি মুখার্জি ও আমার অত্যন্ত স্নেহের ছাত্র ছিল। এখন ও একজন মুক্তি সৈনিক ও খুব সাহসী যোদ্ধা। একবার দেবহাটা থানায় ও এগার জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ১০০ জন পাকবাহিনীকে পিছু হটিয়ে দিয়েছিল। ১৮ জনকে হত্যা করেছিল। লেঃ মৃণাল বাবু আমাকে হাত বাড়ালেন। তার সাথে পরিচয় হোল। তার ডান আর বাম হাতে ব্যান্ডজ বাঁধা। বললাম, এ কেন? তুচ্ছভাবেই জবাব দিলো যোদ্ধা মৃণালঃ কয়েকদিন আগে দুই হাতে হারামীদের ব্রাশ
লেগেছিল। ও কিছু না, শত্রুদের খতম না করা অবধি আমরা ক্ষান্ত হবো না। তার দৃঢ় জীবন্ত শব্দগুলো আমার বিস্ময় এনে দিল
তারপর ওঁরা আমার কাছ থেকে বিদান নিয়ে চলে গেলেন সাইকেলে চেপে হাত নেড়ে ক্যাপ্টেন শাজাহান সাহেব বললেনঃ দানবের সাথে সংগ্রামের তরে- আমি হাত নেড়ে বললামঃ জয় বাংলা।
(মুসা সাদেক রচিত)