<১০, ১৪.৪, ৩৫৬–৩৫৭>
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি
“সে পথ দিয়ে পাকসেনারা ফিরলো না আর”
অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে ক্যাপ্টেন ইদ্রিস আকস্মিকভাবে একটি সিক্রেট ইনফরমেশন পেয়ে গেলেন। ধেয়ে চললেন তিনি তার মুক্তিবাহিনী নিয়ে। হাতে তাদের থ্রি-নট-থ্রি, গ্রেনেড আর দুটি এল-এম-জি। হানাদার পাক বাহিনী সেদিন দিনাজপুর শহর থেকে স্কুলপাড়া হয়ে বর্ডার সাইডে আসছিল যে রুটে সেই রুটে পৌঁছে গেল ক্যাপ্টেন ইদ্রিস, খানসেনারা পৌঁছানোর আগেই। বিকেল তিনটা। খানদের ট্রাকের আওয়াজ পাওয়া গেল। দিনাজপুরের স্কুলপাড়ার রাস্তার পাশে, ঝোঁপেঝাড়ে, গাছের ফাঁকে, আমগাছের ওপর, বাঁশঝাড়ের ফাঁকে প্রস্তুত লেঃ সাইদুল্লাহ, লেঃ আমিন, লেঃ কায়সার, সুবেদার এস এ রহমান, সুবেদার ইয়াসিন, হাবিলদার হাসান, হাবিলদার আজিজ, প্লাটুন কমান্ডার দেলওয়ার হসেন, এফ-এফ-বাবলু, আবদুল লতিফ, আব্দুর রাজ্জাক, নূর মোহাম্মদসহ দেড়শ মুক্তবাহিনীর বীর সেনানী। এগিয়ে আসছে হানাদার ট্রাক দুটো স্কুলবাড়ির সন্নিকটে। ক্যাপ্টেন ইদ্রিস পরপর দুটো শিস দিলেন। দম ধরে মুক্তিযোদ্ধারা গুনে যাচ্ছে প্রতিটা সেকেন্ড। মুক্তিবাহিনীর এ্যামবুশের ভেতরে ঢুকেছে হানাদারদের প্রথম ট্রাক। ট্রাকের ওপর ২০/৩০ জন জোয়ান, হাতে তাদের অটোমেটিক চায়নিজ অস্ত্র। ট্রাকের ওপর এল-এম-জি ধরে দাঁড়িয়ে আছে তাগড়া দুজন, সামনের ট্রাক এ্যামবুশ পার হয়ে যাচ্ছে প্রায়। ক্যাপ্টেন ইদ্রিস সংকেত দিচ্ছেন না। সবাই হতভম্ব হয়ে যাচ্ছে। কি হচ্ছে। কিন্তু ক্যাপ্টেনের লক্ষ্য তখন পেছনে। আরও ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ঢুকছে আরেক ট্রাক পেছনে, সেটাকে এ্যামবুশের মধ্যে এন না ফেলে তিনি পারেন না। সামনের ট্রাকে ফায়ার ওপেন করার নির্দেশ দিলেন।
সৌভাগ্য খানদের। পেছনের ট্রাক প্রায় ১৫০ গজ ব্যবধানে এলো এবং এ্যামবুশের এলাকায় এক ইঞ্চি ঢোকা মাত্র ক্যাপ্টেনের শিস সাথে ফায়ার। বজ্র কড় কড় আওয়াজের মত ভেঙ্গে পড়লো মুক্তিবাহিনী হানাদারদের উপর। এমন হাতের মুঠোয় বহুদিন পায়নি খানদের। সম্পূর্ণ নিরাপদে দাঁড়িয়ে অকস্মাৎ বজ্রপাতের মত ঝাঁপিয়ে পড়লো মুক্তিবাহিনীর জোয়ানরা। পেছনের ট্রাক, সামনের ট্রাক- দুই ট্রাকের ওপরেই চলছে বৃষ্টির মত থ্রি-নট-থ্রি আর এল-এম-জি’র ফায়ার। সম্বিত ফিরে পাবার আগেই পেছনের ট্রাক শেষ, এ্যাম্বুশের যেখানে ঢুকেছিল, সেখানেই দাঁড়িয়ে। খুনী ৩২ জন হানাদারদের ছিন্নভিন্ন দেহ সেখানেই লুটিয়ে। কোনটা ট্রাকের ওপর। বাকিগুলি পাশে, রাস্তায়, নীচের খানায়। কিন্তু না, সামনের ট্রাককে ততখানি কাবু করা গেল না। মাত্র দুটো ডেডবডি পেছনে ফেলে ট্রাকটি গোঁ গোঁ করতে করতে ছুটে বেরিয়ে গেল কব্জা থেকে- যদিও ট্রাকটি পালাবার আগেই গাছের ওপর থেকে মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা ফায়ার করে কয়েকজনকে আহত ও নিহত করে। পাওয়া যায় বহু গোলাবারুদ, এক ইঞ্চি মর্টার, কয়েকটি এল-এম-জি, দুই ইঞ্চি মর্টার এবং চায়নিজ অটোমেটিক রাইফেল কিছু। ৩রা অক্টোবর সেই সাফল্যের পর এ্যামবুশে হানাদারকে খতম করার পরিকল্পনা ক্যাপ্টের ইদ্রিস বাড়িয়ে দেন এবং বহু এভাবে খানসেনারা ঐ সেক্টরে হতাহত হতে থাকে এবং গেরিলা যুদ্ধের এই কৌশলের এবং সাফল্যের প্রোগ্রাম সকল সেক্টরে জানিয়ে দেয়া হয়। এর ফলে সব স্থানে অনুপ্রেরণার সৃষ্টি হতে থাকে। ৪ঠা অক্টোবর সেই আম-জাম-বাঁশঝাড়ে ঢাকা স্কুলপাড়া দেখতে যায় হামজাপুরের সকল মুক্তিযোদ্ধা। খানদের চরমভাবে পরাজিত ও খতম করে দেয়ার সেই পবিত্র ভূমিতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা স্কুলপাড়ার মাটি কপালে ছুঁইয়ে যাত্রা করে ফ্রন্টের দিকে। ১৪ই ডিসেম্বর যুদ্ধে লেঃ সাইদুল্লাহ’র একটা হাতের সমস্ত মাংস কাঁদের নীচ থেকে উড়ে যায় শত্রুর ব্রাশ ফায়ারে। কিন্তু হাড় ভাঙ্গেনি। দিনাজপুরের রণাঙ্গনে যে বীর বহুবার পাঞ্জা লড়েছে হানাদারদের সাথে বিজয়ের দু’দিন আগে তিনি আহত হন। দুর্ধর্ষ ক্যাপ্টেন ইদ্রিসও আহত হন অন্য যুদ্ধে এবং তার কোমরের নীচ দিয়ে ব্রাশ ফায়ার লেগে হিপের মাংস ধসে যায়।
**দৈনিক ‘সংবাদ’ ১৬ ডিসেম্বর ১৯৮১ সংখ্যায় প্রকাশিত মুসা সাদিক রচিত প্রতিবেদন থেকে সংকলিত।