শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৩৬। মৃতের শহর ঢাকা | টাইম | মে ৩, ১৯৭১ |
<১৪, ৩৬, ৮২–৮৩>
টাইম, ৩ মে ১৯৭১
মৃতের শহর ঢাকা
ঢাকা ও অন্যান্য পূর্বপাকিস্থানি শহরে ট্যাংকবাহিনী আক্রমণ চালানোর কয়েক ঘন্টার ভেতরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পূর্বপাকিস্তান থেকে সকল বিদেশী সাংবাদিক বহিস্কার করে সেখানে চলমান গৃহযুদ্ধ ধামাচাপা দিতে দৃশ্যত সফল হয়। টাইম পত্রিকার সাংবাদিক ড্যান কগিন ও সেই সময় পূর্বপাকিস্তান থেকে বহিস্কৃত হন, তবে তিনিই প্রথম আমেরিকান সাংবাদিক যিনি সম্প্রতি ভারত থেকে হোন্ডা, ট্রাক, বাস , এবং সাইকেলে করে আবার যুদ্ধ শুরু হবার পর আবার পূর্বপাকিস্তানে প্রবেশ করেছেন। তিনি জানান,
ঢাকা সবসময়ই মোটামুটি নিরস একটি শহর ছিল। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল এবং এক ডজন চাইনিজ রেস্তোরার বাইরে শহরের ১৫ লক্ষ বাসিন্দার ভেতর স্বচ্ছল মানুষদের জন্য অবকাশের তেমন সুজোগ কখনোই ছিল না। তবে বর্তমানে, নানাভাবেই এই শহর মৃতের শহরে পরিণত হয়েছে। সেনাবাহিনীর ট্যাংক ও সংক্রিয়অস্ত্র বহর নিয়ে নিরস্ত্র মানুষের উপর চালানো বর্বর আক্রমণের এক মাস পর, ঢাকা শহর এখনো স্তম্ভিত, এর বাকি অধিবাসীগণ সেনাবাহিনীর বজ্রকঠিন নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আতঙ্কের ভেতর শহরে আছেন। মৃতের সঠিক সংখ্যা কোনোদিনও জানা সম্ভব হবে না, তবে সম্ভবত শুধু ঢাকা শহরেই প্রায় ১০০০০ নিহত হয়েছেন এবং শহরের প্রায় অর্ধেক মানুষ পার্শবর্তী গ্রাম গুলোতে আশ্রয় নিয়েছেন। জনপথ ও ফেরিঘাটের উপর থেকে সেনা অবরোধ তুলে নেবার সাথে সাথেই শহর থেকে জনস্রোত বাইরে বইছে। শহরে যারা আছেন, তারা শুধু খাদ্যবস্তু আহরণের তাগিদেই বাড়ি হতে বের হচ্ছেন। সেনাবাহিনী অনেক জায়গায় কালের গুদামে আগুন দিয়ে দেয়ায় কালের দাম ৫০% বেড়ে গিয়েছে। শহরে ১৪টি ও মোট ১৮টি বাজার ধ্বংস হয়ে গেছে। সব ব্যস্ত রাস্তা জনমানবহীন, এবং স্থানীয় সরকার অচল হয়ে আছে।
“জারজদের মার!” – সব ছাদেই পাকিস্তানের সবুজ-সাদা পতাকা নীরবে নিশ্চল হয়ে ঝুলছে। একজন বাঙালি মন্তব্য করেন, “আমরা সবাই জানি যে পাকিস্তান শেষ” , “কিন্তু পতাকা ঝুলিয়ে রেখেছি সৈন্যদের এড়ানোর আশায়।” পাকিস্তানের জনক জিন্নাহ ও সমসাময়িক প্রেসিডেন্ট আঘা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের ছবি প্রকাশ্যে ঝুলিয়ে কেউ কেউ আরেকটু রক্ষা পাবার আশা করছেন। তবে সত্য এই যে পূর্বপাকিস্তানের মানুষ সেনাদখলদারিত্বকে নিজেদের স্বাধীনতার পথে শুধুমাত্র একটি বাধা মনে করছেন, আত্মসমর্পন হিসেবে নয়। “আমরা ক্ষমা করবোনা, ভুলেও যাবো না” , একজন বাঙালি বলেন। আমি সাংবাদিক জানতে পারার পর অনেক মানুষ নিজেরাই আমাকে গণ কবর, একটি সিড়িঘর যেখানে দুইজন প্রফেসর নিহত হন, ও যেখানে যেখানে অন্যান্য পাশবিকতা ঘটেছে, সেসব জায়গা দেখতে নিয়ে যান। সবচেয়ে পাশবিক আঘাত হানা হয় পুরান ঢাকায়, সেখানে অনেক অংশই পুড়িয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়। সেনাবাহিনি শহরের কিছু অংশের চারদিকে পেট্রল ঢেলে, আগুন দিয়ে, ও আগুনথেকে পালানো মানুষদের পিষে ফেলে ধংসযজ্ঞ চালায়। “ওরা বের হয়ে আসছে”, “জারজদের মার!” , এমন ডাক এক সৈন্যের গলায় এক পশ্চিমা সেসময় শুনতে পান। এক ব্যবসায়ী সেই আগুনে দৃশ্যত সামান্য কয়জনই পুরান ঢাকার সেকশন-২৫ ব্লকের ধংসযজ্ঞ হতে রক্ষা পেয়েছিলেন। যারা আগুনের হাত থেকে বেঁচেছিলেন, তারা সোজা বন্দুকের গুলির সামনে পড়েন। বেঁচে থাকা মানুষদের আরো আতংকিত করতে সৈন্যরা মৃতদেহ তিন দিন ধরে অপসারণে বাধা দেন, যদিও মুসলমান রীতি হচ্ছে মারা যাবার সাথে সাথেই বা অন্তত ২৪ ঘন্টার মধ্যেই তা কবর দিয়ে ফেলা।
পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী : পাশবিকতার কাহিনী অপরিসীম। এক তরুণ যার বাসাযা তল্লাসী হচ্ছিল, সৈন্যদের অনুরোধ করেন তারা যেন তার ১৭ বছর বয়স্ক বোন কে ছেড়ে দেয় ; সৈন্যরা মেয়েটিকে বেয়োনেট খুঁচিয়ে মারে ও ছেলেটিকে তা দেখতে বাধ্য করে। সৈন্যরা কর্নেল আব্দুল হাই, যিনি ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন বাঙালি ডাক্তার, তাকে বাসায় শেষবারের মতো ফোন করার সুজোগ দেয়। তার এক ঘন্টা পর তার লাশ তার বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। এক বৃদ্ধ, যিনি শুক্রবারে নামাজ পড়তে যাওয়াকে কারফিউ এর চেয়ে বেশি দরকারি মনে করেছিলেন, তাকে মসজিদের পথে গুলিকরে মারা হয়। আক্রমণ শুরুর দিনেই, রাত প্রায় ১:৩০টার দিকে দুই গাড়ি বোঝাই সৈন্য বাঙালি জাতির স্বাধীনতা আন্দোলনের মূল নেতা, শেখ মুজিবর রহমানের বাসায় পৌঁছে। সৈন্যরা যখন তার বাড়ির দিলে লক্ষ করে গুলি ছুড়তে শুরু করে, তিনি তখন আত্মরক্ষার জন্য খাটের নিচে শুয়ে পড়েন। গুলি চালানোর এক বিরতির সময় তিনি দুই হাত তুলে বাড়ির নিচ তলায় চলে আসেন, এবং চিৎকার করে সৈন্যদের জানান, “গুলি করার দরকার নাই, আমি এখানে, আমাকে নিয়ে যাও। “
————