১৫। মেজর জিয়ার পরিবারের উপর পাকবাহিনীর নির্যাতনের বিবরণ (৩৮১-৩৮৪)
সূত্র – দৈনিক বাংলা, ২ জানুয়ারি, ১৯৭২
মেজর জিয়া যখন দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন, খান সেনারা তখন তাঁর পরিবার পরিজনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।
।। মঞ্জুর আহমেদ প্রদত্ত ।।
বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের বীর নায়ক মেজর( বর্তমানে কর্ণেল) জিয়া যখন হানাদার পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলে তাঁদের নাজেহাল করে তুলছিলেন, তখন তাঁর প্রতি আক্রোশ মেটাবার ঘৃণ্য পন্থা হিসেবে খান সেনারা নৃশংসভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তাঁর আত্নীয়-স্বজন পরিবার পরিজনের উপর।
তাঁদের এই প্রতিহিংসার লালসা থেকে রেহাই পান নি কর্নেল জিয়ার ভায়রা শিল্পোন্নয়ন সংস্থার সিনিয়র কো-অর্ডিনেশন অফিসার মোজাম্মেল হক।
চট্রগ্রাম শহর শত্রু কবলিত হবার পর, বেগম খালেদা জিয়া যখন বোরখার আবরণে আত্মগোপন করে চট্টগ্রাম থেকে স্টিমারে পালিয়ে নারায়ণগঞ্জে এসে পৌঁছেন, তখন জনাব মোজাম্মেল হকই তাকে নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। সেদিন ছিল ১৬ই মে। ঢাকা শহরে ছিল কারফিউ। নারায়ণগঞ্জেও সন্ধ্যা থেকে কারফিউ জারি করা হয়েছিল। এরই মধ্যেই তিনি তাঁর গাড়ীতে রেডক্রসের ছাপ এঁকে ছুটে গিয়েছিলেন নারায়ণগঞ্জের টার্মিনালে।
বেগম জিয়াকে নিয়ে আসার দিন দশেক পর ২৬মে হক সাহেবের কর্মস্থল ‘শিল্প-উন্নয়ন সংস্থা’-য় ‘হক’ নাম সম্বলিত যত অফিসার আছেন, সবাইকে ডেকে পাক সেনারা কর্নেল জিয়ার সাথে কারোর কোন আত্মীয়তা আছে কিনা জানতে চায়। সেনারা তার বাড়ি তল্লাশী করে। কিন্তু বেগম জিয়াকে সেখানে না পেয়ে যাবার আগে জানিয়ে যায়, সত্যি কথা না বললে আপনাকে ক্যান্টনমেন্ট নিয়ে যাওয়া হবে।
এরপরই জনাব হক বুঝতে পারেন, সর্বক্ষণ তাকে অনুসরণ করা হচ্ছে। যেখানেই যান, সেখানেই তার পেছনে লেগে থাকে ফেউ। এই অবস্থায় তিনি মায়ের অসুখের নাম করে ছুটি নেন অফিস থেকে এবং সপরিবারে ঢাকা ছেড়ে যাবার ব্যবস্থা করতে থাকেন।
১লা জুলাই গাড়ী গ্যারেজে রেখে পেছন দরজা দিয়ে বেরিয়ে তাঁর ফ্যামিলি দুটি অটোরিকশায় গিয়ে উঠেন। উদ্দেশ্য ছিল আপাততঃ ধানমন্ডি তে বেগম জিয়ার মামার বাসায় গিয়ে ওঠা। কিন্তু সায়েন্স ল্যাবরেটরি পর্যন্ত আসতেই একটি অটোরিকশা তাদের বিকল হয়ে যায়। এই অবস্থায় তারা কাছেই গ্রীনরোড এক বন্ধুর বাসায় গিয়ে উঠেন। কিন্তু এখানে তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল এক বিরাট বিস্ময়। বন্ধুর স্ত্রী তাকে জানান যে কর্নেল জিয়ার লেখা চিঠি তাদের হাতে এসেছে। চিঠিটা জনাব হককেই লেখা এবং এটি তার কাছে পাঠাবার জন্য কয়েকদিন ধরেই তাকে খোঁজা হচ্ছে।
তার কাছে লেখা কর্নেল জিয়ার চিঠি এ বাড়িতে কেমন করে এলো তা বুঝতে না পেরে তিনি যারপরনাই বিস্মিত হন এবং চিঠিটি দেখতে চান। তার বন্ধুর ছেলে চিঠিটা বের করে দেখায়। এটি সত্যি কর্নেল জিয়ার লেখা কিনা, বেগম জিয়াকে দিয়ে তার পরীক্ষা করিয়ে নেবার জন্য তিনি তার বন্ধুর ছেলের হাতে দিয়েই এটি জিওলজিক্যাল সার্ভের জনাব মুজিবর রহমানের কাছে পাঠান।
এদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসায় জনাব হক তার এই বন্ধুর বাসায় রাতের মত আশ্রয় চান। তাদেরকে আরো নিরাপদ স্থানে রাখার আশ্বাস দিয়ে রাতে তাদেরকে পাঠান হয় সূত্রাপুরের একটি ছোট্ট বাড়ীতে। তার বন্ধুর ছেলেই তাদেরকে গাড়িয়ে করে এই বাড়ীতে নিয়ে আসে। এখানে ছোট্ট একটি ঘরে তারা আশ্রয় নেন।
কিন্তু পরদিনই তারা খেলতে পেলেন পাক বাহিনীর লোকেরা বাড়িটি ঘিরে ফেলেছে। জনা দশেক সশস্ত্র জওয়ান বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে। এই দলের প্রধান ক্যাপ্টেন সাজ্জাদ আর ক্যাপ্টেন আরিফ। তারা ভেতরে ঢুকে কর্নেল জিয়া ও বেগম জিয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। জনাব হক ও তার স্ত্রী জিয়ার সাথে তাদের সম্পর্কের কথা অস্বীকার করে যান। কিন্তু ক্যাপ্টেন সাজ্জাদ জনাব হ্ব বেগম হকের সাথে তোলা বেগম জিয়ার একটি গ্রুপ ছবি বের করে দেখালে তখন তারা জিয়ার সাথে সম্পর্কের কথা স্বীকার করেন। তবে তারা জানান যে, কর্নেল ও বেগম জিয়া কোথায় আছেন তা তারা জানেন না।
এই পর্যায়ে বিকেল পাঁচটায় জনাব হক ও তার স্ত্রীকে সামরিক বাহিনীর একটি গাড়ীতে তুলে মালিবাগের মোড়ে আনা হয় এবং মৌচাক মার্কেটের সামনে তাদেরকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গাড়ীতে বসিয়ে রাখা হয়। এখানেই তাদেরকে জানানো হয় যে বেগম জিয়াকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এরপর তাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
অর্থাৎ ২ জুলাই আবদুল্লাহর সিদ্ধেশ্বরীর বাসা থেকে বেগম জিয়া, জনাব আবদুল্লাহ এবং জনাব মুজিবর রহমানকেও পাক বাহিনী গ্রেফতার করে। ৫ই জুলাই জনাব মোজাম্মেল হক অফিসে যোগ দিলে সেখান থেকেই ক্যাপ্টেন সাজ্জাদ তাকে গ্রেফতার করে।
ক্যাপ্টেন সাজ্জাদ তার কাছে পরিকল্পনার কথা জানতে চাইলে তিনি অস্বীকার করেন এবং ক্যাপ্টেন তাকে মিথ্যাবাদী বলে শাস্তি দেবার হুমকি দিলেও কথা আদায় করতে না পেরে হাজার ওয়াটের উজ্জল আলোর নিচে শুইয়ে রাখার হুকুম দেয়।
প্রায় ৪ ঘন্টা তাকে এই যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়।
পরদিন আবারও একই কাজ করা হয় ক্যাপ্টেন সাজ্জাদ বারবার জানতে চায় যে, শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে তার কি কথা হয়েছে এবং ভারত যাবার আগে কি পরিকল্পনা হয়েছে। এবং জনাব হক অস্বীকার করলে সাজ্জাদ ঘাড়ে প্রচন্ড আঘাত হানেন এবং চব্বিশ ঘন্টা হাজার ওয়াটের বাতি জ্বালিয়ে রাখার হুকুম দেয়।
অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে বারবার তিনি একটা কথাই বলতে থাকেনঃ “ আমাকে একবারেই মেরে ফেল। এভাবে তিলে তিলে মেরো না।“
এক পাঠান হাবিলদার হক সাহেবের উপর এই অত্যাচার সইতে না পেরে, সেন্ট্রিকে ডেকে হুকুম দিয়েছিল বাতি নিভিয়ে দিতে। কোন জীপ আসলেই যেন শুধু বাতি জ্বালানো হয়, চলে গেলে আবার বন্ধ করে দেওয়া হয়।
ক্যাপ্টেন সাজ্জাদ এর পর কয়দিন আরো জিজ্ঞাসাবাদ করে নতুন নির্যাতন চালায়। তাকে দিয়ে একই বিবৃতি বারবার লেখিয়ে ছিড়ে ফেলে। উনি লেখার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেন। সাথে সাথে দৃষ্টিশক্তিও প্রায় হারিয়ে ফেলেন। তখন তিনি রাত এবং দিনের পার্থক্য বুঝতে পারতেন না।
২৬সে জুলাই বিকালে তাকে ‘ইন্টার স্টেটস স্ক্রিনিং কমিটি’-তে নিয়ে যাওয়া হয়। এখানে ছোট এক কামড়ায় ১১০ জন আটক ছিলেন। বিকাল ৫টায় তাকে বের করে রান্নাঘরের বড় পানির ড্রাম ভরার কাজ দেওয়া হয় তার সাথে আর একজন থাকেন জিওলজিক্যাল সার্ভের জনাব আবদুল্লাহ। প্রায় পোয়া মাইল দুরের ট্যাপ থেকে বড় বালতিতে করে পানি টেনে তিনটি ড্রাম ভরে দিলেই তাদের রাতে লাইনে করে খাবার দেওয়া হতো। এতদিন পর তিনি প্রথম খেতে পান গরম ভাত এবং ডাল।
৬ আগস্ট এর পর তাদের নিয়ে যাওয়া হয় ফিল্ড ইনভেস্টিগেশন সেন্টারে। এখানে তাকে আবার জিজ্ঞাসাবাদ করে নির্যাতন করে বিবৃতি দিতে বলে সেই পুরাতন নির্যাতন প্রকৃয়া আবার শুরু হয়।
৩০শে অক্টোবর তিনি মুক্তি পান।
রাজাকাররা এর মধ্যে ৩ দফা তার বাড়ীতে লুটপাট চালায় এবং সর্বশেষ ১৩ই ডিসেম্বর তার গাড়ীটিও নিয়ে যায়।