মোহাম্মদ আজিজুর রহমান আওয়ামী লীগ দলীয় প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য, সিলেট

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্রের ১৫তম খণ্ডের ২২৯ নং পৃষ্ঠায় মুদ্রিত ২৮ নং দলিল থেকে বলছি…

মোহাম্মদ আজিজুর রহমান

স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই আমরা সিলেটে গণআন্দোলন গড়ে তুলি। মূলতঃ ১৯৭১ সালের মার্চ মাস থেকে আমরা বহুমূখী কর্মসূচী ও আন্দোলনের মাধ্যমে পাক স্বৈরাচার সরকারের বিরোধিতা করি এবং বৃহৎ সংগ্রামের প্রস্তুতি নিতে থাকি।

২রা মার্চ পথসভা ও মশাল মিছিল, ৩রা মার্চ হরতাল, ৪ঠা মার্চ মশাল মিছিল, ৫ই ও ৬ই মার্চ হরতাল, ১০ই মার্চ গণসমাবেশ ও মিছিল বের করি।

১১ই মার্চ আমাকে আহবায়ক করে মৌলভীবাজার মহকুমাতে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়।

১২ই মার্চ থেকে ২৫শে মার্চ পর্যন্ত আন্দোলন, জনসভা, মিছিল ও কর্মীসভা আরো প্রবলভাবে চলতে থাকে।

২৫শে মার্চ বিকেল ৩ টায় শ্রীমঙ্গল থানার ভৈরববাজার স্কুল মাঠে শ্রমিক সমাবেশে আমি ভাষন দেই এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রস্তুতি নেয়ার জন্যে শ্রমিকদের প্রতি আহবান জানাই। প্রায় ২ হাজার শ্রমিক লাঠি, তীর-ধনুক সহ উক্ত জনসভায় উপস্থিত ছিল এবং তারা সবাই লাঠি উচু করে শত্রুদের প্রতিরোধের শপথ নেয়। সভাশেষে শ্রমিক নেতৃবৃন্দের সাথে দেশের সার্বিকি পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়, এবং যে কোন পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্যে প্রস্তুত থাকার সিদ্ধাবত নেয়া হয়। এরপর রাত ১১ টায় আমি মৌলভীবাজার নিজ বাড়িতে চলে যাই।

২৬শে মার্চ ভোর ৪টায় তদকালীন অবাংগালী এসডিও এবং এসপিডিও আমার বাড়িতে আসেন এবং থানায় নিয়ে যান। থানা থেকে আমাকে ব্যোমকেশ ঘোষ বাবুর বাড়িতে নিয়ে যায় এবং তাকে সংগে করে আমাদের ট্যুরিস্ট রেস্ট হাউজে বন্দী করে রাখে। এখানে অবাংগালী ও খানসেনারা আমাদের ওপর বিভিন্ন প্রকার অত্যাচার চালায়। ২৭শে মার্চ আমাকে ছেড়ে দিলে আমি বাসায় চলে আসি। ঐ দিন বিকেলে কার্ফু ভংগ করে হাজার হাজার জনতা মৌলভীবাজারের দিকে আসতে থাকে। পাক বাহিনী জনতাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। কার্ফু ভংগের মিছিলে রোদন মিয়া, ছওমন ঠাকুর, তারা মিয়া ও অজ্ঞাতনামা ৫ জন শ্রমিক শহীদ হন এবং বহু লককে গ্রেফতার করা হয়। ২৭ তারিখ রাতেই পাক ক্যাপ্টেন আবার আমাকে গ্রেফতার করে রেস্ট হাউজে নিয়ে যায় এবং লাঠি ও রাইফেলের বাট দিয়ে বেদম প্রহার করে। বহু নিরীহ বাঙালিকে কার্ফু ভঙ্গের দায়ে গ্রেফতার করে পাক সেনারা অমানুষিক নির্যাতন করে। রাতে পাক বাহিনীর অত্যাচারের শিকার বাঙালিদের চিৎকার শুনতে পেয়েছি। সৈন্যরা রাত ১১ টায় ব্যোমক্যাশ বাবু, গিয়াসনগর চা বাগানের ম্যানেজার এবং আমাকে সিলেট সার্কিট হাউজে বন্দী করে রাখে।

২৮শে মার্চ সকালে কর্ণেল সরফরাজ আমাকে ইন্টারোগেশন করেন। আওয়ামী লীগের কর্মীদের কে কোথায় আছেন, স্বাধীনতা সংগ্রামে আমার সমর্থন আছে কিনা এসব প্রশ্ন করে। আমি কর্ণেলের কোন প্রশ্নের উত্তর না দেয়ায় আমাকে ভেতরের এক কক্ষে নিয়ে গিয়ে ৩ জন খান সেনা একযোগে ভীষন প্রহার করেন। তাদের প্রহারে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। জ্ঞান ফিরে আসলে আমাকে আমার কর্ণেলের সামনে হাজির করা হয় এবং স্বাধীনতার বিরুদ্ধে বক্তব্য দেয়ার জন্যে চাপ দেয়, আমি তার প্রস্তাবে রাজী না হওয়ায় আমাকে থানায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। ২৯শে মার্চ বেলা ১টায় আমাকে সিলেট সেন্ট্রাল জেলে পাঠানো হয়। ৫ই এপ্রিল জেলের ভেতরে থেকেই সিলেট শহরের চারিদিকে গুলির শব্দ শুনতে পাই এবং দুপুরের পর কম করে হলেও তিনবার সিলেট শহরের উপর বিমানহামলে চলে। ব্রাশের শেলের কয়েক টুকরা আমাদের কক্ষে এসে পড়ে। ৬ই এপ্রিল জেলের পূর্ব-উত্তত দিক থেকে মুক্তিযোদ্ধা ও দক্ষিন-পশ্চিম দিক থেকে পাকবাহিনীর মাঝে তুমুল লড়াই চলে। ঐদিন প্রায় ৮বার পাক বিমান মুক্তিফৌজের ওপর হামলা করে। ঐদিন জেলের সাধারন কর্মীরা বিমান হামলার ভয়ে বাইরে রাখার দাবীতে সোচ্চার হয়ে ওঠে। কতৃপক্ষের সাথে কাটাকাটি হলে গুলি ছোড়া হয়। আমাদের জেলের দিকে প্রায় ৫০ রাউন্ড গুলি ছোড়া হয়। সারারাত ধরে গোলাগুলি চলতে থাকে। আমরা সৌভাগ্যক্রমে সেদিন রক্ষা পাই।

৭ই এপ্রিল খবর পাই মুক্তিবাহিনী শহরের বেশ কিছু অংশ মুক্ত করে নিয়েছে। ২টার সময় দুজন মুক্তিযোদ্ধা আমাদের সাথে সাক্ষাত করে এবং ৫টায় সিলেটের সিরাজ সাহেব আমদের মুক্ত করে নিয়ে আসেন। সন্ধ্যা ৬টায় মানিক চৌধুরী, এম এন এ কর্ণেল রেজা, ও মেজর দত্তের সাথে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প পরিদর্শন করি।

৮ থেকে ১০ই এপ্রিল ডাক্তারের পরামর্শে বিশ্রামে থাকার পর আমি মৌলভীবাজার আওয়ামীলীগ নেতাদের সংগে এক সভায় মিলিত হই।

১২ই এপ্রিল নিম্নোক্ত ব্যাক্তিদের নিয়ে সিলেট জেলা প্রশাসনিক কাউন্সিল গঠন করা হয়।

১. দেওয়ান ফরিদ গাজী, এম এন এ জেলা প্রশাসক
২. মোঃ ইলিয়াস, এম এন এ মৌলভীবাজার মহকুমা প্রশাসক
৩. মোস্তফা আলী, এম এন এ হবিগঞ্জ মহকুমা প্রশাসক
৪. মাসুদ চৌধুরী, এম এন এ সিলেট সদর মহকুমা প্রশাসক
৫. জনাব আবদুল হক, এম এন এ সুনামগঞ্জ মহকুমা প্রশাসক

উল্ল্যেখ্য যে, মুজিবনগরে অস্থায়ী সরকার গঠনে প্রতিনিধিত্ব করার জন্যে সিলেট থেকে কর্ণেল রব ও মানিক চৌধুরীকে ভারতে প্রেরণ করা হয়।

১২ই এপ্রিল থেকে ২৬শে এপ্রিল পর্যন্ত সিলেট জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে যুদ্ধ চলতে থাকে। এইসব যুদ্ধে প্রধান ঘাটি স্থাপিত হয়। এই ঘাটির দায়িত্বে ছিলেন কর্ণেল রব, কর্ণেল রেজা, মেজর সি আর দত্ত। সিলেট জেলার সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করতে তারা এ ঘাটি থেকে সেনা পরিচালনা করতেন। শেরপুর মুক্তিবাহিনীর ঘাটির দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন আজিজ। ২৫শে এপ্রিল রাতে ক্যাপ্টেন আজিজ আহত হলে তাকে কালীঘাট হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। ঐদিনই শেরপুর সেক্টরের পতন ঘটে।

২৬শে এপ্রিল রাতে প্রধান সেনাপতি আতাউল গণি ওসমানী এবং ইলিয়াস সাহেবের ওপর মৌলভীবাজার সোনালী ব্যাকংকের সমস্ত টাকা নিয়ে যাবার দায়িত্ব দেন। ভারতীয় ডেমোলিশন পার্টির এক্সপ্লোসিভ দিয়ে ব্যাংকের স্ট্রং রুমের দরজা খুলতে গেলে সমস্ত রুম বিধ্বস্ত হয়। ব্যাংক থেকে ২ কোটি ৫ লাখ ৩ হাজার টাকা পাওয়া যায়। এখান থেকে প্রায় ২ কোটি টাকা আগরতলা ৯১ নং বিএসএফ হেডকোয়ার্টারে বাংলাদেশের প্রতিনিধি এম আর সিদ্দিকী ও কর্ণেল রবের মাধ্যমে মুজিবনগর সরকারের কাছে জমা দেয়া হয়। এ অভিযানে ইলিয়াস সাহেব ছাড়াও মানিক চৌধুরী ও মেজর জামান অংশগ্রহন করেন।

২৮শে এপ্রিল মৌলভীবাজার শহর পাকবাহিনীর কবলে চলে যায়।

২৯শে এপ্রিল আমরা শ্রীমঙ্গল হতে কয়েক হাজার ব্যারেল পেট্রল, ৩০লাখ সিগারেট, কয়েক হাজার মন চাউল, ২৫০টি ট্রাক্টর, ৩০০টি ট্রাক, ২০০ জীপ ও মটরকার বন্ধুরাষ্ট্র ভারতে নিয়ে যেতে সক্ষম হই।

আমি ভারতের কৈলাশ্বরে অবস্থানকালে ক্যাম্পে পৌছিয়ে দেয়া ও মুক্তিফৌজে ভর্তি করার ব্যাবস্থা করি। মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহ যোগানোর জন্যে কৈলাশ্বর মুক্তিফৌজ হতে ৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে আমি, মোজাফফর সাহেব ও সুবেদার চৌধুরী মাঝে মাঝে পাক বাহিনীর ক্যাম্প গুলোতে আক্রমন করতাম। কইলাশ্বরে ভগবাননগরে যুব ক্যাম্প আমি স্থাপন করি এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করি।

সেপ্টেম্বর মাসে চাতলাপুর হতে মুক্তিফৌজের ক্যাম্প টিলাবাজারে স্থাপিত হয়। তখন আমাদের ৪ নং সেক্টরে দায়িত্বে ছিলেন কর্ণেল সি আর দত্ত এবং উক্ত সেক্টরের রাজনৈতিক লিয়াজো ছিলেন দেওয়ান ফরিদ গাজী। আমাকে কইলাশ্বর ও ধরমনগরের রাজনৈতিক লিয়াজো অফিসার নিয়োগ করা হয়। ইতিমধ্যে চীফ অব স্টাফ কর্ণেল রবকে চেয়ারম্যান এবং ডক্টর হাসানকে প্রশাসনিক ফইসার নিয়োগ করে হবিগঞ্জ জেনারেল কাউন্সিল গঠন করা হয়। সেপ্টেম্বরের শেষ নাগাদ বিহারের চাকুলিয়া ক্যাম্পে ২২ জন যুবককে আমার নেতৃতবে ট্রেনিং করার জন্যে পাঠানো হয়, আমি তাদেরকে ট্রেনিং শেষে কলকাতা হয়ে কইলাশ্বর পাঠিয়ে দেই। এ সময় আমি, মোজাফফর আহমেদ, মেজর জেনারেল কে বি কেশব রাও- এর সাথে বিভিন্ন যুদ্ধ পরিকল্পনা নিয়ে বেশ কয়েকবার আলোচনা করি। আমি প্রত্যক্ষভাবে মেরলীচড়া পাক ক্যাম্প, আলীনগর পাক ক্যাম্প, চাতলাপুর বিওপি ইত্যাদি ক্যাম্পে বিভিন্ন সময় আক্রমন করি।

২রা ডিসেম্বর মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী যৌথভাবে সমরেশনগরে আক্রমন করে। ভীশন যুদ্ধ হয় এবং এ যুদ্ধে মেজর গুরুমসহ বেশকয়েকজন মৈত্রীসৈন্য ও মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।

৩রা ডিসেম্বর সকালে তৈয়াবুর রহীম এম্পি সহ আমি চাতলাপুর বিওপি ও সমরেশনগর স্কুলে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করি। এ সময় ভারতের মুক্তিছড়া থেকে মেজর আনোয়ারুজ্জামানের নেতৃত্বে ৩টি বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোম্পানী কমলাগঞ্জের থানা হেডকোয়ার্টারে পাঠানো হয়। তাদের আমি ২০ জন গাইড সংগ্রহ করে দেই।

৪ঠা ডিসেম্বর বিকেলে সিএনসি স্পেশাল ব্যাচ ও মুক্তিযোদ্ধা সহ কড়াইয়াহাড়ি মুক্তিযোদ্ধার প্রধান ক্যাম্পে এসে যোগ দেই।

৫ই ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে সৈয়দ মহসীন আলীর নেতৃত্বে এক কোম্পানী মুক্তিবাহিনী এসে যোগ দেয় এবং মুন্সিবাজার (কমলাগঞ্জ) পাক বাহিনীর ক্যাম্পে হানা দেয়। যুদ্ধে পাক বাহিনীর পতন ঘটে এবং পাক বাহিনী পিছু হঠতে বাধ্য হয়।

৬ই ডিসেম্বর রাজনগরের তেরকপাশা স্কুলে এক সমাবেশে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করি। ৭ই ডিসেম্বর মুক্তিফৌজের কোম্পানীকে রাজনগর থানার বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠানো হয়।

৯ই ডিসেম্বর মৌলভীবাজার আসি। ঐদিন মৌলভীবাজারে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়। তৈয়াবুর রহীমকে মৌলভীবাজারের প্রশাসনিক দায়িত্ব দেয়া হয়।

২০শে ডিসেম্বর মৌলভীবাজার সরকারী বিদ্যালয়ে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে এক দুঃখজনকি ঘটনা ঘটে। একটি মাইন বিস্ফোরনের ফলে ক্যাম্পের কমান্ডার সহ ২৩ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। সৌভাগ্যক্রমে আমি বেচে যাই।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কুলাউড়া থানার শরীফপুর ইউনিয়নের ১০হাজার লোকের বসতিপূর্ণ অঞ্চল মুক্ত ছিল এবং এ অঞ্চলে বাংলাদেশের নিজস্ব প্রশাসন চালানো হয়েছিল। প্রশাসনিক দায়িত্বে ছিলেন তুয়াবুর রহীম এমপি সাহেব। মুক্তিবাহিনী সবসময় এ অঞ্চলে অবস্থান করত এবং পাক বাহিনী কখনও এ অঞ্চল অধিকার করতে পারে নি।

বর্বর পাকবাহিনী যুদ্ধকালে সিলেটে অনেক নির্যাতন চালিয়েছে। শুধুমাত্র মৌলভীবাজারে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে ৪০০ নিরীহ মানুষকে পাক-বাহিনী হত্যা করে। ৪-৫ হাজার বাড়ীঘর জ্বালিয়ে দেয়। যুদ্ধচলাকালে আমরা হারিয়েছি মুকিত, সহীদ, রানু, সুদর্শন, নরেশ, অরুন, খোকা, কাজলসহ নাম না জানা আরো অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধাকে।

-মোহাম্মদ আজিজুর রহমান
গণপরিষদ সদস্য, (সাবেক এম, পি, এ) সিলেট
২২ অক্টোবর, ১৯৭৩

Scroll to Top