শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৭১। যন্ত্রণা এবং বিপদ (সম্পাদকীয়) | ক্রিস্টিয়ান সায়েন্স মনিটর | ৩১ জুলাই ১৯৭১ |
<১৪, ৭১, ১৬৫–১৬৭>
যন্ত্রণা এবং বিপদ (সম্পাদকীয়)
ক্রিস্টিয়ান সায়েন্স মনিটর – ৩১ জুলাই ১৯৭১
আমরা যতদিন সম্ভব আশা রেখেছিলাম যে কোনভাবে হয়তো সরকার এবং পাকিস্তানের জনগন তাদের যুদ্ধপীড়িত ও দগ্ধ দেশের দুটি পৃথক অংশের মধ্যে একটা সহনীয় সম্পর্কে ফিরে যাবে, কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের সাথে আমাদের মেনে নিতে হচ্ছে যে সমন্বয় সাধনের সেই সময় অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে।
চার মাস আগে পাকিস্তানের সরকার পুর্ব পাকিস্তানের লোকজনের উপরে সামরিক উন্মত্ততা ছড়িয়ে দেয়। ফলে ইতিহাসের ভয়ংকর এক ঘটনা সংঘটিত হয়।
পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্মমতার হাত থেকে বাঁচতে পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রায় এককোটি মানুষ ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। দশ লক্ষ মানুষের অন্তত চার ভাগের একভাগ মারা গেছে। ধারনা করা হচ্ছে এই সংখ্যা দশ লাখের কাছাকাছি। কলেরা ছড়িয়ে পড়েছে। ভারতে আশ্রিত শরণার্থী এবং এখনো যারা জীবন ও ঘরবাড়ীর ধ্বংসাবশেষ আকড়ে আছে, উভয়ের মধ্যে দুর্ভিক্ষ মহামারীর আকার নিয়েছে। ভারতের শরণার্থী সমস্যা ভারতের ক্ষমতার বাইরে।
যেখানে এতসব ঘটছে সেই অঞ্চলকে মানুষ বারবার বাংলা বলে ডাকছে, এসবের কারন ওই অঞ্চলকে ১৯৪৭ সালের পর থেকে এখনো অব্দি যুগ যুগ ধরে এই নামেই ডাকা হয়, মাঝের কয়েক বছর ছাড়া।
একটি তত্ত্ব ছিল ১৯৪৭ সালের দিকে, যে ভারত সরকারের অধীনস্ত ১১০০ মাইল এলাকা দ্বারা পৃথক হওয়া সত্ত্বেও, পাঞ্জাব ও বাংলার অধিকাংশ মানুষ মুসলমান হওয়ার কারনে উপমহাদেশের এই দুইটি অংশ হয়তো একটা একক জাতিতে পরিণত হতে পারে।
পাকিস্তানের প্রস্তাবিত নতুন রাষ্ট্রের দুটি অংশের মানুষের ভাষা, জাতি এবং সংস্কৃতি তাদের ধর্মের মতই এক হওয়ার কারণে হয়তো এটা হয়েছে। কিছু পাঞ্জাবী আছে যারা আরো বেশি বাঙালীদের সাথে ঐক্যবদ্ধ সরকার এবং দুই প্রদেশ ভাগাভাগি করতে ইচ্ছুক, বাস্তবে এটাই হওয়ার কথা।
কিন্তু বাস্তবে পাঞ্জাবীরা সরকারের উপর প্রাধান্য বিস্তার করেছে এবং বাংলার সম্পদের সিংহভাগ নিয়ে যাচ্ছে পাঞ্জাবে। পাকিস্তান নামের একের মধ্যে দুই রাষ্ট্রকে একত্র করার চেষ্টার অর্থ ৭৫ মিলিয়ন বাঙালীর উপর ৫৬ মিলিয়ন পাঞ্জাবীর (অথবা, পশ্চিম পাকিস্তানি) কর্তৃত্ব ও শোষণ।
ঐতিহাসিকভাবেই বাংলার আচার-ব্যবহারে যৌক্তিক অগ্রগতি ছিল। আজকের পশ্চিম পাকিস্তানিরা ফার্সি, আফগান, এবং পাঠানদের পাহাড়ি উপজাতির উত্তরসূরি যারা প্রায় ৮০০ বছর আগে উত্তর-পশ্চিম পর্বত থেকে নেমে আসে এবং গঙ্গার বদ্বীপ ও উপত্যকায় বাস করা শারীরিকভাবে ছোট-খাটো ও কম যুদ্ধপ্রিয় জাতির উপর জোরপুর্বক তাদের নিয়মনীতি ও মুসলিম ধর্ম চাপিয়ে দেয়।
কিন্তু দুই জাতি কখনোই ধর্ম ছাড়া অন্য কিছুতে এক হতে পারেনি। পাঞ্জাবীরা সবসময় জয়ী হয়েছে, জয় করেছে বাঙালীদের।
গত মার্চ মাসে জয়ী এবং পরাজয়ীদের অবস্থা পরিক্ষা (নির্বাচন) করা হয়। নির্বাচনে বাঙালিরা পাকিস্তান সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করার অধিকার লাভ করে। তাদের ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট। কিন্তু এটাকে সাংবিধানিক পরিণতি দেওয়ার সময় পাঞ্জাবীরা তাদের সেনাবাহিনীকে মাঝরাতে মুক্ত করে দেয় এবং ইতিহাসের বড় একটা গণহত্যা সংঘটিত হয়। বিজয়কে পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এটা ছিল ৮00 বছর পুর্বের প্রচেষ্টা।
চার মাস পর, বর্তমানে বাংলার প্রধান শহরগুলো পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণ করছে, কিন্তু গ্রামাঞ্চল এখনো পারেনি। প্রতিরোধ বৃদ্ধি পাচ্ছে। গেরিলা বাহিনী রাজধানী ঢাকার বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছে দুইবার। তারা ঘন ঘন ঢাকা থেকে অন্যান্য শহরে যাওয়া রেল লাইন কেটে দিচ্ছে। আমেরিকার ব্যাপক হস্তক্ষেপে থিউ শাসকরা দক্ষিন ভিয়েতনামে যেমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিল, দখলদার পাঞ্জাবি সেনাবাহিনী (পশ্চিম পাকিস্তান) বাংলায় একই পরিস্থিতির মুখোমুখি – শান্তিসংস্থাপন কর্মসূচির প্রত্যাশা অন্তহীনভাবে ভবিষ্যতে সম্প্রসারিত হচ্ছে।
এই দুঃখজনক এবং ভয়ঙ্কর অবস্থা যে কাওকে দুটি সমস্যার (নিয়ে উদ্বিগ্ন করবে) মুখোমুখি করবে। কিভাবে বাংলায় ভয়াবহ এবং দুর্বিপাকের আশু সমস্যার সমাপ্তি টানা যায়। পাঞ্জাবীদের আদিম, স্ব-পরাজিত সামরিক নিপীড়ন নীতি থেকে সরে আসতে হবে এবং দুটি পৃথক বাংলার অস্তিত্বকে বাস্তবায়ন করতে হবে যা রোধ করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
কিন্তু মনে হচ্ছে এটা শুধুমাত্র তখনই ঘটতে পারে যদি বড় সমস্যা সমাধানের দিকে কিছুটা অগ্রসর হওয়া যায়; অর্থাৎ সর্বময় ক্ষমতা নিয়ে পাকিস্তানের সমস্যা।
বাংলায় সন্ত্রাস নিরসণে ইসলামাবাদের তুলনায় পাকিস্তান সরকারের উপর কার্যত কোন চাপ নেই কারন চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করার ঝুঁকি নিতে চায়না যেহেতু রাশিয়া ভারতের প্রধান বহিঃ বন্ধু হয়ে উঠছে। ওয়াশিংটন এমন কোন কিছু করতে প্রত্যাখ্যান জানিয়েছে যা জেনারেল আগা মোহাম্মাদ ইয়াহিয়া খানের বিপক্ষে যায়, যিনি যুগান্তকারী চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে জড়িত ছিলেন। চীন স্বভাবতই পাকিস্তানে তাদের স্বার্থের পেছনে লেগে আছে। এবং স্বাধীন বাংলার বিবাদের বিষয় কতটা বিপজ্জনক হতে পারে সেটা সম্পর্কে সবাই সচেতন। এটা রাশিয়া ও চীনের মধ্যে যুদ্ধ বাধিয়ে দিতে পারে।
এর তাত্ত্বিক সমাধান সহজ। শুধু রাশিয়া, চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের মধ্যে এরকম একটা চুক্তির প্রয়োজন যাতে চীন অথবা রাশিয়া কতৃক বাংলা মুক্ত এবং ঝামেলামুক্ত থাকে।
শুধু এটুকুই প্রয়োজন কিন্তু মনে হচ্ছে বর্তমানে সেটা অসম্ভব, ভারত মহাসাগরে সংযুক্ত একটি নালিকার সঙ্গে গঙ্গা অববাহিকার নিয়ন্ত্রণ জয়ের সম্ভাবনায় চীন ব্যাপকভাবে প্রলুব্ধ হয়েছে, এটা প্রতিরোধ করতে রাশিয়া নিশ্চয়ই বহুদুর পর্যন্ত যাবে।
এদিকে যেকোনো মুহূর্তে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আবার যুদ্ধ বেধে যেতে পারে। সীমান্তের ওপাশে পাঞ্জাবী মুসলিম কতৃক ভারতের স্বজাতি হিন্দুদের হত্যা ভারতের সহ্যসীমার মধ্যে থাকলেও এটা তার থেকেও বেশি।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তার নিজের সংযম এবং তার জেনারেলদেরকে সংযত রাখার জন্য সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়ার যোগ্য।
কিন্তু যে ক্ষনস্থায়ী শান্তি পার্শবর্তী শক্তির (দেশগুলোর) মধ্যে বিরাজমান তা কেনা হচ্ছে বাংলার জনগনের দুর্ভোগের মুল্যে।
স্বার্থসংশ্লিষ্ট ওইসব দেশের মধ্যকার বৈঠকের ফলাফল হিসাবে আমরা শুধুমাত্র একটি দীর্ঘমেয়াদী নিষ্পত্তির ক্ষীন আশা দেখতে পাচ্ছি। ভিয়েতনাম সমস্যা বিবেচনায় চীনের প্রেসিডেন্ট চৌ এনলাই প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে একটা সমাবেশ করার প্রস্তাব দিয়েছে। চীন, রাশিয়া, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে এমন একটা সম্মেলন হয়তো বাংলা ও পাকিস্তান সম্পর্কের ক্ষেত্রেও কিছুটা কাজ করতে পারে।
দুঃখদূর্দশা ও বিপর্যয় অসীম ক্ষমতার জন্য নতুন একটা পারস্পরিক চুক্তির উপর গুরুত্ব আরোপ করে। এমন অনুপাত ও জটিলতার সমস্যাকে পরিচালনা করতে পারে তেমন কিছু এখনো উদ্ভাবিত হয়নি।