যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি ও বাংলার নারী
২২ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
গত ২৫শে মার্চ রাত ১২টা থেকে বাংলাদেশে যে আন্দোলনের শুরু হয়েছে, সে আন্দোলন আমাদের মুক্তির আন্দোলন, সে আন্দোলন আমাদের বাঁচার আন্দোলন, স্ব-অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। বর্বর জঙ্গশাহী সুদীর্ঘ ২৪ বছর ধরে আমাদের বুকের রক্ত শোষণ করে আমাদের সোনার বাংলাকে নিঃস্ব করে তার বুকে মেরেছে ছুরি। সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা বাংলাদেশকে তারা ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছে। আমাদের শস্য-শ্যামলা মাকে তারা পরিয়েছে শ্বেত বসন, মাঠের ফসলে জঙ্গীশাহী বিমান থেকে ফেলেছে বিষ। আমাদের ঐতিহ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক-অধ্যাপিকাদের তারা নির্মমভাবে হত্যা করেছে। বৃদ্ধ অধ্যাপকদেরও তারা রেহাই দেয়নি। বিখ্যাত দার্শনিক ডঃ গোবিন্দ চন্দ্রদেবকে বিছানা থেকে পথে টেনে এনে জঙ্গীশাহী তাঁর বুকের উপর করল বেয়নেট চার্জ। এমনি করে মারা হয়েছে মনিরুজ্জামানকে ও আরো অনেককে। জগন্নাথ হল, ইকবাল হলের ছাত্ররা রাত ১১টার দিকে নিদ্রামগ্ন ছিল। সেই অসস্থায় তাদের উপর চালান হয়েছে মেশিনগান। ঘুম থেকে তারা উঠতে পারেনি। যখন তাঁরা পড়াশুনা করে ঘুমিয়েছিল তখন তাদের মনে ছিল কত আশা, কত স্বপ্ন। কিন্তু না, তারা সেই যে ঘুমিয়েছিল- সে ঘুম তাদের আর ভাঙ্গেনি। তারা আর ঘুম থেকে ওঠেনি, আর উঠবেও না কোনদিন। রোকেয়া হলে রাত ১২টায় জ্বালিয়ে দিল আগুন। ঘুমন্ত হল আগুনের লেলিহান শিখার মধ্যে চিরতরে ঘুমিয়ে পড়ল। আরো কত হাজার হাজার মানুষকে এই হিংস্র জানোয়ারদের বর্বরতার শিকার হতে হয়েছে তার কোন হিসাব নেই। ভাবতে পারেন? কলপনা করতে পারেন? কি নির্মম্ভাবে জঙ্গীশাহী আমাদের রক্ত দিয়ে আমাদের জন্মভুমিকে রক্তস্নান করিয়েছেন ?
হিংস্র পশুর মত টিক্কা খান ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বাংলাদেশের উপর ২৪ ঘণ্টা সময় নিয়ে। দম্ভভরে বলেছিল জঙ্গীসর্দার ইয়াহিয়াকে “আমার হাতে ক্ষমতা দাও, আমি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সব ঠিক করে দেব।” হ্যাঁ, নেমেছিল সে তার সবটুকু ক্ষমতা নিয়ে, কিন্তু পেরেছিল কি? পারেনি, পারবেও না। ২৪ ঘণ্টা অতীত হয়ে কতদিন পার হয়ে গেল তবুও পারেনি। শেষ পর্যন্ত হালে পানি না পেয়ে হাল ছেড়ে পালিয়ে গেল। এবার আর এক মিরজাফর
ক্ষমতা হাতে নিয়ে বসেছে গদিতে। দেখা যাক কদিন এর আয়ু? এই কদিনেই ডাঃ মালিকের অবস্থা হয়েছে ছেড়ে দে মা কেদে বাঁচি।
যাক সে কথা। জঙ্গী সরকার যেভাবে আমাদের অগণিত মা-বোনদের নিঃস্ব করে গৃহছাড়া করেছে আমাদের ভাইকে হত্যা করেছে, আমাদের বোনকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে-সেই হানাদারদের আমাদের দেশ থেকে নির্মুল করতেই হবে। আজ আমাদের দেশে যে সংগ্রাম চলছে সে হল মুক্তির সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম। এই সংগ্রামে আমাদের অর্থাৎ নারীদেরও ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। যেমনভাবে এই স্বাধীনতা সংগ্রামে নেমেছে আমাদের ভাইয়েরা। ভাইয়েদের সাথে আমাদের হাতে হাত মেলাতে হবে। এখন দেশের এই দুর্যোগপূর্ণ মুহুর্তে আমাদের পিছিয়ে থাকলে চলবে না। আমাদের আজ ঘরে বসে থাকলেও চলবে না। তোমারা এস- এগিয়ে এস- আজ আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ি। আমাদের ভাইয়ের মত আমরাও মেশিনগান-মর্টার হাতে নিয়ে শত্রুনিধনযজ্ঞে অংশগ্রহণ করি। আমাদের এগিয়ে আসতেই হবে। বোনেরা আমার এগিয়ে এস। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা আমরা কেন ঘরে থকব? মহাবিদ্যালয় ও বিদ্যালয়ের ছাত্রীরা তোমরা কেন ঘরে থাকবে? পথে নামো। আজ আমাদের ঘরে থাকার দিন নয়, আমাদের সামনে আজ বহু কাজ। ঝাঁসির রানীর বাহিনীর মত আমাদেরকেও সেনাবহিনী গঠনে অগ্রণী হতে হবে। আমাদেরকে নার্সিং-এ অংশগ্রহণ করতে হবে আহত ভাইদের সুস্থ করে তাঁদেরকে আবার দেশমাতৃকার বন্ধনমোচনে পাঠাতে হবে। যেদিন দেশমাতৃকাকে সম্পূর্ণরূপে শত্রুমুক্ত করতে পারব- সেদিন আবার আমরা আমাদের ঘর আলোকিত করব-আবার স্বপ্নের জাল বুনব। শুধু বোনদেরই এগিয়ে আসলে চলবে না। মায়েদেরও এই সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে হবে। মায়েরা তাঁদের সন্তানকে উৎসাহিত করবেন এই মুক্তির সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে। এই সংগ্রাম আমাদের সকলের সংগ্রাম। বঙ্গবন্ধুর অগ্নিমন্ত্রে আমাদের সকলকে দীক্ষিত হতে হবে। জয় আমাদের সুনিশ্চিত। জয় আমাদের হবেই। আমাদের রক্ত আমরা বৃথা যেতে দেব না।
(মিস ডলিনাথ রচিত)