শিরোনাম সূত্র তারিখ
১০৬। যুদ্ধের আলামত নিউজ উইক ১ নভেম্বর, ১৯৭১

অনুবাদ করেছেনঃ Aabir M. Ahmed

খণ্ড নং-১৪, দলিল নং-১০৬, পৃষ্ঠা নং- ২৪৭ থেকে ২৪৮

নিউজ উইক  ১ নভেম্বর, ১৯৭১

যুদ্ধের আভাস

পশ্চিম পাকিস্তানের উষর পাঞ্জাব প্রদেশ জুড়ে চলমান ট্যাংকের সারি ধূলোর মেঘ তৈরী করেছে। এবং হাজার মাইল দূরে, ভারত-পূর্ব পাকিস্তানের জলাভূমি সদৃশ সীমান্ত জুড়ে, ভারী অস্ত্রের গর্জনে রাতের নীরবতা ভেঙে পড়ছে। ভারতের শত শত শহর এবং গ্রামে রক্ষীবাহিনিকে সমাবেত করা হয়েছে এবং বিমানবাহিনীর বৈমানিকেরা দু’মিনিটের জরূরী তলবের জন্য সতর্ক অবস্থায় আছে যখন কি না পাকিস্তান জুড়ে গাড়িতে এবং ঘরবাড়িগুলোতে ‘ভারত ধ্বংস করো’ লেখা হাজারো স্টিকার লাগানো হয়েছে। শেষ সপ্তাহে উপমহাদেশের সর্বত্র যুদ্ধের সরঞ্জামাদিগুলোকে সচল করা হয়েছে। এবং যদিও মস্কো, লন্ডন, এবং ওয়াশিংটন এর উদ্বিগ্ন কূটনীতিকেরা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার এই অর্থহীন যুদ্ধ থামানোর সম্ভাব্য উপায় খুজছেন, কিন্তু দুই মুখোমুখী বৈরী মনোভাবের সরকার তাদের ক্রমবর্ধমান আতংকের খেলাই যালিয়ে যাচ্ছে। ‘বাতাসে যুদ্ধের আভাস পাওয়া যায়’- একজন উচ্চপদস্ত ভারতীয় কর্মকর্তা একটাই বললেন এবং বস্তুত তা সত্যি।

দুই দেশের সেনাবাহিনী প্রায় মুখোমুখী হবার আগপর্যন্ত প্রায় প্রতিদিনই সেনাদল , ট্যাঙ্ক এবং ভারী অস্ত্রশস্ত্র এর চলাচল বেড়েছে। পশ্চিম পাকিস্তান লাগোয়া ভারতীয় সীমান্ত জুড়ে ১৩ টি পাকিস্তানি ডিভিশন এর বিপরীতে ১৫টি ভারতীয় ডিভিশন অবস্থান নিয়েছে। প্রহরার কাজের জন্য সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে ভারতীয় স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী কে দ্রুত ডেকে পাঠানো হচ্ছে । কাশ্মিরে, যেখানে পশ্চিমা গুপ্তচর সূত্র থেকে জানা গেছে যে পাকিস্তানীরা শত শত সশস্ত্র এজেন্টদের সেখানে জমায়েত করাচ্ছে, সেখানে ভারতীয়রা শক্তি বাড়ানোর জন্য দ্রুত দুটি ডিভিশনকে প্রেরণ করেছে। এবং পূর্ব দিকে, প্রায় ৮০০০০ পাকিস্তানি জমায়েত হয়েছে একই সংখ্যক ভারতীয় সেনাদলের বিপরীতে। নয়া দিল্লীর একজন কূটনৈতিক বলছেন, ‘মাত্র একটি ফোন কলই যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবার জন্য যথেষ্ট’।

ইচ্ছেকৃতভাবে যুদ্ধের পথ বেছে নেওয়া উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটে নতুন কিছু নয়। যেমন সাম্প্রতিক সময়ে ১৯৬৫ সালে, ভারত এবং পাকিস্তান ২২দিনব্যাপী  অফলপ্রসূ এক যুদ্ধে মুখোমুখী হয়েছিলো কাশ্মিরের নিয়ন্ত্রন নেবার জন্য। কিন্তু সেই সময়ে যখন দুইটি দেশ সামরিক শক্তিতে প্রায় একই রকম ছিলো, এখন অধিকাংশ তুরুপের তাস ভারতের নিয়ন্ত্রনে। যদিও ভারতের জেটবহরের তুলনায় পাকিস্তানের ৬০টি আধুনিক প্রযুক্তির মিরেজ জেটবহরের ক্ষমতা বেশী, ভারতের আছে অধিক পরিমানের রাশিয়ান অস্ত্র- প্রায় দ্বিগুন বোমারু বিমান এবং প্রায় দ্বিগুন পরিমান ট্যাঙ্ক। অধিকন্তু, পাকিস্তানের ৪৫০০০০ সৈন্যের বিপরীতে নয়া দিল্লী ৯০০০০০ সৈন্য মাঠে নামাতে পারবে। পরিসংখ্যানগত এই অসামাঞ্জস্যতার কারনে ভারতীয় কর্মকর্তা যুদ্ধে দ্রুত ও সহজ জয় এবং চিরতরে বিজয়ের কথা ভাবছেন। ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম বলেছেন, ‘ যদি আমাদের উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হয়, আমাদের সৈন্যদল এগিয়ে যাবে রবং তাদের শহর দখল করবে। এবং এবার যাই হোক না কেন আমরা আমাদের দখলকৃত এলাকা থেকে সরে আসবো না’।

যাই হোক, ভারতের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো পাকিস্তানের অধিকাংশ সৈন্যকেই পাঠানো হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের তথাকথিত মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের সাথে যুদ্ধ করতে। শেষ এপ্রিলে প্রেসিডেন্ট মোহম্মদ ইয়াহিয়া খান বিদ্রোহ-প্রবণ বাংলাদেশের বিপক্ষে বিদ্বেষমূলক প্রচারণা শুরু করবার পরে থেকে, এবং পরবর্তীতে প্রায় ৯ মিলিয়ন শরণার্থীকে ভারতে চলে যেতে বাধ্য করার পরে,  বাঙালি গেরিলারা প্রায় ৫০০০০ লোকের বাহিনী প্রস্তুত করেছে। মূলত ভারতে, যেখানে বিদ্রোহীদের জন্য যথেষ্ট সহানুভূতি আছে, প্রশিক্ষন নিয়ে তারা সরকারি বাহিনীকে পর্যুদস্ত করতে যথেষ্ট সক্ষম হয়েছে। এবং অনেক পশ্চিমা বিশ্লেষক ধারনা করছেন যে তাদের এই সাফল্য অব্যাহত থাকবে। একজন পর্যবেক্ষক বলেন, ‘গেরিলাদের মোকাবেলা করার মতো যথেষ্ট বাহিনী সেখানে ইয়াহিয়ার নেই। এবং ভারতীয় কর্তৃত্বের এলাকা থেকে শক্তি না কমিয়ে তিনি সেখানে আরও সৈন্যও পাঠাতে পারছেন না’।

পলায়ন

অধিকাংশ রাজধানীগুলোতে এটাই আশংকা যে ভারত এবং পাকিস্তান হয়ত এমন একটা সংকটাপূর্ণ অবস্থায় পড়বে যেখানে শুধু মাত্র যুদ্ধই হবে সংকট থেকে উত্তোরণের একমাত্র পথ। এই সম্ভবনাকে রুখতে যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ঘোষণা দিয়েছিলো যে পররাষ্ট্র উপমন্ত্রী নিকোলাই ফাইরাইউবিন এর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল বিশেষ আলোচনার জন্য ভারতে যাবে, তখন ব্রিটিশ কূটনীতিকেরা ভারত ও পাকিস্তানের জাতিসংঘ প্রতিনিধিদের সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন। এবং ওয়াশিংটনে, নিক্সন প্রশাসন ইয়াহিয়া খানের প্রস্তাব সমর্থন করেন যে, দুই পক্ষই সীমান্ত থেকে তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করে নেবে । ভারত এরকম কিছুই করেনি। ইয়াহিয়ার প্রস্তাবকে ষড়যন্ত্র বলে নাকচ করে দিয়ে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, ‘হাতের মুঠো পাকিয়ে হাত মেলানো যায় না’।

এই উত্তেজনা প্রশমনে তেমন কোনো অগ্রগতি দেখা না যাওয়া সত্ত্বেও , অন্তত সামনের কটা সপ্তাহে অনেক কূটনীতিকই আশা করছেন যুদ্ধ এড়ানোর জন্য কিছু আশার আলো দেখার। প্রথমেই, সপ্তাহের শুরুতে ছয়-দেশ সফরে বের হবার ব্যাপারে মিসেস গান্ধী পরিকল্পনার পরিবর্তন করেননি। যুক্তরাষ্ট্রের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, ‘তার অনুপস্থিতিতে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর আক্রমন শুরু করার সম্ভবনা খুবই কম।’। সে ক্ষেত্রে অবশ্যই পাকিস্তানের পক্ষ থেকে যুদ্ধ শুরু করার সম্ভবনা রয়ে যায়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র কর্মকর্তারা মনে করছেন সেই সম্ভবনাও ক্ষীণ। ওয়াশিংটনের একজন পর্যবেক্ষক বলেন, ‘এটা হবে পাগলামির পরিচয়। তারা তাদের সব কিছুই হারাবে’। এখনো পর্যন্ত, হিন্দু ভারত এবং মুসলমান পাকিস্তানের মধ্যকার সম্পর্ক কখনোই যৌক্তিকতার বিচারে চিহ্নিত হয়নি। এবং এই কারনেই, যুদ্ধের সম্ভবনাকে কেউই অস্বীকার করতে চাচ্ছে না।  নয়া দিল্লীর একজন কূটনীতিক বলেন , ‘যুক্তি আপনাকে বলবে যুদ্ধ হওয়া উচিত নয়। ভারত-পাকিস্তানের ব্যাপারে কথা বলতে হলে আপনাকে জানালা দিয়ে যুক্তি ছুঁড়ে ফেলে দিতে হবে’

Scroll to Top