যুদ্ধের পরিবর্তিত গতি
জুন মাসের শেষদিকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয়। এইসময় প্রচলিত যুদ্ধপদ্ধতি এবং গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ করার জন্য বাংলাদেশবাহিনীকে পুনর্গঠিত হয়।বস্তুতঃ জুনের চতুর্থ সপ্তাহ থেকে পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু হলেওবিভিন্ন সেক্টরের ততপরতার মধ্যে সমন্বয় সাধনের উদ্দেশ্যে জুলাই মাসে আমরা এক সম্মেলনে মিলিত হয়েছিলাম।এই সম্মেলনের কথা আগেই বলেছি। ১৫ই মে পর্যন্ত আর যা কিছু সাহায্য পেয়েছিলাম তার ব্যবস্থা করেছিলো ভারতীয় বিএসএফ। যাহোক, সময়ের বিবর্তনে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের দু’টি নতুন ডিভিশনকে বাংলাদেশে এনে মোতায়েন করার পর যুদ্ধ পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন ঘটে। এই কারণে সবকিছুতে ভিন্নতর সমন্বয়, প্রতিরক্ষা প্রস্তুতি এবং ব্যাপক সাহায্যের প্রয়োজন দেখা দেয়।কিন্ত প্রয়োজন মেটানোর সামর্থ্য বিএসএফ এর ছিলোনা। তাই ১৯৭১ এর১৬ই মে ভারতীয় সেনাবাহিনী বিএসএফ এর কাছ থেকে বাংলাদেশ এই অস্বাভাবিক ঘটনাবলী মোকাবেলার দায়িত্ব গ্রহণ করে।
লক্ষ্য করার বিষয় যে, বিভিন্ন পাকিস্তানী ডিভিশনে আক্রমণকারী দলগুলো ২৫শে মার্চ রাতে আকস্মিক আক্রমণের পর ৭২ ঘণ্টার মধ্যেই বিভিন্নস্থানে অবস্থান গ্রহণের জন্য কাজ সম্পন্ন করে। চলাচলের কাজ বিমানযোগে করা হয়। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার দূরত্ব বিবেচনা করে(১২০০মাইল ভারতীয় এলাকা)এবং ভারতের উপর দিয়ে সকল প্রকার পাকিস্তানী বিমান চলাচল বন্ধ থাকায় পাকিস্তানের পুরো দুটো আর্মি ডিভিশনকে পূর্বাঞ্চলে স্থানান্তর করতে অন্ততঃ একমাসের কম সময় লাগার কথা নয়। সেই হিসেবে দ্যাখা যায় একমাস আগে অর্থাৎ ৭১এর ২৮ শে ফেব্রুয়ারির মধ্যে যাত্রা প্রস্তুতি শুরু না করলে দুই ডিভিশন পাকসেনা বাংলাদেশে আসতে পারতো না। বাংলাদেশে গণহত্যার উদ্দেশ্য নিয়েই এইসব আর্মি ডিভিশন এখানে এনে মোতায়েন করার ষড়যন্ত্র হয়েছিলো। সবকিছুর তোড়জোড় শুরু হয়েছিল২৮ ফেব্রুয়ারির আগে। তাহলে দেখা যায়, ভুট্টো ১৬ই ফেব্রুয়ারি যে হুমকি দিয়েছিলেন তার সাথে এই ষড়যন্ত্রের নিশ্চয়ই একটা যোগসাজশ ছিল। ভুট্টো বলেছিলেন,” কেউ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ঢাকা যেতে চাইলে তাকে নিজ দায়িত্বেই যেতে হবে, তা তিনি খাকী পোশাকে অথবা সাদাকালো যে পোশাকেই যাননা কেন।‘’ রাওয়ালপিন্ডির আর্মি হেড কোয়াটারে ২২শে ফেব্রুয়ারি যে উচ্চ পর্যায়ের সম্মেলন হয়, সম্ভবত সেখানেই ষড়যন্ত্রের সূত্রপাত ঘটে।
৯ম ডিভিশনের ৩১৩ বিগ্রেডকে বিমানযোগে সিলেট পাঠানো হয়।১১৭ বিগ্রেড যায় কুমিল্লায়। ১৪ ডিভিশনের অধীনে কুমিল্লায় যে ৫৩ বিগ্রেড অবস্থান করছিলো ইতিমধ্যেই তাকে চট্টগ্রাম যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। ৯ম ডিভিশনের বাংলাদেশে আসার পরই মেঘনার পূর্বদিকে সমগ্র এলাকা অর্থাৎ সিলেট, কুমিল্লা, নোয়াখালী, চট্টগ্রামও পার্বত্য চট্টগ্রামের সামগ্রিক দায়িত্ব তাদের উপর ন্যস্ত করা হয়। এই পরিকল্পনা অনুসারে ৫৩ বিগ্রেড চট্টগ্রাম, ১১৭বিগ্রেড কুমিল্লায় এবং ৩১৩ বিগ্রেড সিলেটে অবস্থানগ্রহন করে। আগে থেকেই পূর্বাঞ্চলে মোতায়েন১৪ ডিভিশনের পর ঢাকা, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, যশোর, খুলনা প্রভৃতি জেলার দায়িত্ব ছিল। ৫৩ বিগ্রেডকে৯ম ডিভিশনের অধীনে এবং ৯মডিভিশনের২৭ বিগ্রেডকে ১৪শ ডিভিশনের অধীনে ন্যস্ত করা হয়। ১৪শ ডিভিশনের ৫৭ বিগ্রেড ঢাকায় অবস্থান করছিল। এই ডিভিশনের অপর বিগ্রেডটি ছিল উত্তরবঙ্গে।
পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েটা থেকে ১৬শ ডিভিশন চলে আসার পর উত্তরবঙ্গের দায়িত্ব এই ডিভিশন গ্রহণ করে। জেনারেল টিক্কা খান পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হওয়া ছাড়াও এই সকল বাহিনীর সার্বিক কমান্ডের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। ১১ এপ্রিল লেঃ জেনারেল এ, এ, একে নিয়াজি ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার নিযুক্ত হওয়ার পর জেনারেল টিক্কা খান তার এই বাড়তি দায়িত্ব ছেড়ে দেন। এরপর তিনি শুধু গভর্নর এবং সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে কাজ করেন। পাকিস্তানীদের উল্লেখিত সেনাবাহিনী ছাড়াও পরে আর দুটি ডিভিশন গড়ে তোলা হয়। এই দুটি পাক ডিভিশনের জন্য বাংলাদেশবাহিনী এমনকি ভারতীয়বাহিনীতেও পুনর্গঠনের প্রয়োজন দেখা দেয়।বাংলাদেশ বাহিনী পুনর্গঠনের সাথে সাথে সকল সেক্টরে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযানও অব্যাহত থাকে। আমাদের আক্রমণাত্মক তৎপরতা অক্ষুণ্ণ রাখা এবং লড়াইয়ের উদ্যমকে সমুন্নত রাখাই ছিল এর উদ্দেশ্য।